টুরান চোখ খুলে তাকাল। তার ঘুম ভেঙে গেছে–ঠিক করে বলতে হলে বলতে হবে তার ঘুম ভাঙিয়ে তাকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। যার অর্থ তারা হয়তো কেপলার টুটুবি গ্রহে পৌঁছে গেছে। মাঝখানে কতোটুকু সময় পার হয়েছে কে জানে? এক বছর? একশ বছর? এক লক্ষ বছর? কী আশ্চর্য!
টুরান নিজের হাত নাড়ানোর চেষ্টা করল, পারল না। সেটি এখনো শিথিল হয়ে আছে। সে জানে ঘুম ভাঙার পর বেশ কিছুক্ষণ তার শরীর শিথিল হয়ে থাকবে, সেখানে জোর পাবে না। ধীরে ধীরে তার শরীরে শক্তি ফিরে পাবে। টুরান ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে থাকে। ক্যাপসুলের ভেতর মিষ্টি গন্ধের একটি শীতল বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে–এটি নিশ্চয়ই তার শরীরকে সতেজ করে তুলবে। খুব হালকা একটি সঙ্গীতের শব্দ ভেসে আসছে। মিষ্টি একটা সঙ্গীত, মনে হয় বহুদূরে কোনো একটা নদীর তীরে সে দাঁড়িয়ে আছে আর দূরে কোথাও কোনো একজন নিঃসঙ্গ শিল্পী নদীতীরে একটা গাছে হেলান দিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। টুরান তার চোখ বন্ধ করল। বুক ভরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিল, ভেতরে ভেতরে সে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছে।
ক্যাপসুলের ভেতর টুক করে একটা শব্দ হল, সঙ্গীতটি বন্ধ হয়ে গেছে। ভেতরে একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠেছে। টুরান তার হাতটি চোখের সামনে নিয়ে এল, তার শরীরে শক্তি ফিরে এসেছে। সে হাত দিয়ে ক্যাপসুলের ঢাকনাটি স্পর্শ করতেই সেটা নিঃশব্দে খুলে গেল। টুরান সাবধানে ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এসে ক্যাপসুলের পাশে দাঁড়াল। সে দাঁড়াতে পারছে, ভেসে যাচ্ছে না যার অর্থ মহাকাশযানটি তার অক্ষের উপর ঘুরছে, মহাকাশযানের মাঝে কৃত্রিম একটা মাধ্যাকর্ষণ তৈরি করে রাখা আছে।
টুরান মাথা ঘুরিয়ে ডানদিকে তাকাতেই সে চমকে ওঠে। মহাকাশযানের দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে ইহিতা বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
বসার ভঙ্গিটি দুঃখি মানুষের মতো, দেখে মনে হয় কিছু একটা নিয়ে ইহিতা গভীর বিষাদে ড়ুবে আছে। টুরান জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
তুমি এমন করে বসে আছ কেন?
আমি তো এমন করেই বসি।
টুরান বলল, আমরা কেপলার টুটুবিতে পৌঁছে গেছি, মানুষের নতুন সভ্যতা শুরু করব, তোমার মাঝে তার উত্তেজনা দেখছি না।
আমরা কেপলার টুটুবিতে পৌঁছাই নি। আমাদের যাত্রা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
টুরান চমকে ওঠে বলল, কী বলছ তুমি?
আমরা সৌরজগতের ভেতরেই আছি।
টুরান উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, কেন? আমাদের যাত্রা কেন বন্ধ করে দেয়া
হল?
ইহিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না। ট্রিনিটি কিছু বলতে রাজি হচ্ছে না। যখন সবাই জেগে উঠবে তখন বলবে তার আগে বলবে না।
অন্যদের কখন জাগাবে? তোমাকে কেন আগে জাগিয়েছে?
আমাকে আগে জাগায় নি, সবাইকে একই সাথে জাগানো শুরু করেছে। একেকজনের শরীর একেকভাবে কাজ করে তাই একেকজন একেক সময়ে জেগে উঠছে।
টুরান হেঁটে হেঁটে অন্য ক্যাপসুলগুলোর কাছে যায়, ভেতরে কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে আবার ইহিতার কাছে ফিরে এসে বলল, আমার কাছে পুরো ব্যাপারটি খুব দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে।
ইহিতা কথাটার কোনো উত্তর দিল না। টুরান তখন বলল, আমার কাছে মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু ঘটেছে। খুব খারাপ এবং ভয়ংকর।
সেটি কী হতে পারে?
আমি জানি না।
সবাই ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর ট্রিনিটি সবাইকে একটা ছোট হলঘরে নিয়ে এলো। ঘরটিতে বসার জন্যে কার্যকর চেয়ার, চেয়ারের সামনে ডেস্ক এবং ডেস্কে ধূমায়িত খাবার। ক্লদ ছাড়া আর কেউ সেই খাবারে উৎসাহ দেখাল না।
টুরান বলল, ট্রিনিটি, তুমি ভূমিকা ছেড়ে দিয়ে সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এসো।
ট্রিনিটি বলল, আমি আসলে ভূমিকা করছি না। সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এসেছি। আমি তোমাদেরকে একটি দুঃসংবাদ দেবার জন্যে ডেকে তুলেছি।
কেউ কোনো কথা না বলে দুঃসংবাদটি শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। ট্রিনিটি ভাবলেশহীন গলায় বলল, পৃথিবীটি রবোমানবেরা দখল করে নেবে সেই আশংকায় এই মহাকাশযানে করে তোমাদের সাতজনের নেতৃত্বে বিশালসংখ্যক মানুষ, মানুষের দ্রুণ, জিনোম, পশুপাখি, গাছপালা পাঠানো হচ্ছিল। এর উদ্দেশ্য মানুষ দূর মহাকাশের কোনো একটি উপযুক্ত গ্রহে বসতি স্থাপন করবে। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের কথা কিছুক্ষণ আগে পৃথিবী থেকে আমাকে জানানো হয়েছে তোমাদের সাতজনের মাঝে দুইজন রবোমানব।
ক্লদ ছাড়া অন্য সবাই ভয়ানক চমকে উঠল। ক্লদ ঠিক সেই মুহূর্তে তার খাবারের মাঝে একটা লাল চেরি আবিষ্কার করেছে। সে এটা খাবে না কি এটা দিয়ে খেলবে সেটি নিয়ে মনস্থির করতে পারছিল না।
টুরান কাঁপা গলায় বলল, কোন দুইজন?
আমি জানি না। পৃথিবীর মানুষও জানে না। এটি জানলে পুরো ব্যাপারটা খুব সহজ হয়ে যেতো।
সবাই সবার দিকে তাকাল, চোখে চোখ পড়তেই আবার তারা নিজেদের দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ইহিতা জিজ্ঞেস করল, আমাদের ভেতর যারা রবোমানব তারা নিজেরা কী জানে যে তারা রবোমানব?
রবোমানবের মস্তিষ্কের থ্যালামাসে একটা অত্যন্ত ক্ষুদ্র ইমপ্ল্যান্ট বসানো হয় যেটা মস্তিষ্ককে পরিবর্তন করে, ওভার ড্রাইভ করে। তোমাদের দুজনের সেই ইমপ্লান্ট কার্যকর করা হয়ে থাকলে তোমরা ইতোমধ্যে জান যে তোমরা রবোমানব।
ইহিতা জানতে চাইল, সেটা কী কার্যকর করা হয়েছে?
আমি জানি না। এই মহাকাশযানে সেটা পরীক্ষা করার উপায় নেই।
নীহা জিজ্ঞেস করল, এখন কী করা হবে? আমরা কী আবার পৃথিবীতে ফিরে যাব?
না। ট্রিনিটি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তোমাদের সাতজনকে এই মহাকাশযান ছেড়ে চলে যেতে হবে।
সবাই চমকে উঠল, সুহা আর্তচিৎকার করে বলল, কী বলছো!
আমি কী বলেছি তোমরা সেটি শুনতে পেয়েছ, তারপরেও আমি আবার বলি। তোমাদের এই সাতজনকে মহাকাশযান ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমার এই মহাকাশযানের নিরাপত্তার জন্যে এখানে কোনো রবোমানবকে স্থান দেয়া যাবে না।
সুহা হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, আমরা কোথায় যাব? আমি আমার এই শিশু বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাব?
ক্লদ এই ছোট হলঘরের ভেতরের উত্তেজনাটুকু টের পেতে শুরু করেছে। সে তার খাওয়ার প্যাকেটটি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল।
ট্রিনিটি বলল, আমরা পৃথিবী থেকে খুব বেশিদূর যাই নি। গ্রহাণু বেল্ট পার হয়েছি মাত্র। গতিপথ পরিবর্তন করে আমি মহাকাশযানটিকে মঙ্গলগ্রহ ঘিরে একটি কক্ষপথে নিয়ে এসেছি। তোমাদের একটা স্কাউটশিপে করে আমি মঙ্গলগ্রহে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
টুকন চিৎকার করে বলল, মঙ্গলগ্রহে?
হ্যাঁ মঙ্গলগ্রহে।
তুমি কী জান মঙ্গলগ্রহ হচ্ছে পৃথিবীর ভাগাড়। মানুষ যখন পুরোপুরি সভ্য হয় নি তখন ভয়ংকর পরীক্ষাগুলো করেছে মঙ্গলগ্রহে? এখানে রয়েছে তেজস্ক্রিয়তা, রয়েছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। শুধু তাই না এখানে জৈবিক পরীক্ষা হয়েছে। নতুন প্রাণ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। এরকম ভয়ংকর একটা জায়গায় আমাদের পাঠাবে?
হ্যাঁ। ট্রিনিটি শান্ত গলায় বলল, আমার কোনো উপায় নেই। আমি যখন জেনেছি তোমাদের দুজন রবোমানব এবং কোন দুজন রবোমানব আমার জানা নেই তখন এছাড়া আমার কিছু করার নেই। একটি কম্পিউটার হিসেবে আমাকে কোনো মানুষকে হত্যার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। যদি দেয়া হতো তাহলে শীতলঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় সাতজনকেই হত্যা করে আমি নিশ্চিত হয়ে যেতাম।
টর বিড়বিড় করে বলল, ভাগ্যিস ক্ষমতা দেয়া হয় নি। ক্ষমতা ছাড়াই তুমি যা ইচ্ছে তাই করতে পার।
ইহিতা বলল, ট্রিনিটি, তুমি কী বলছ সেটা চিন্তা করেছ?
চিন্তা প্রক্রিয়াটি মানুষের। আমি মানুষ নই, তাই চিন্তা করতে পারি না। তবে যে কোনো বিষয় আমি আমার মতো বিশ্লেষণ করতে পারি। কাজেই আমি যেটা বলেছি সেটা অনেক ভাবে বিশ্লেষণ করে বলেছি।
না। ইহিতা মাথা নাড়ল, তুমি পুরোপুরি বিশ্লেষণ কর নি। তুমি বলেছ মানুষকে হত্যা করার ক্ষমতা তোমাকে দেয়া হয় নি। কিন্তু যদি আমাদের ভয়ংকর বাস-অযোগ্য মঙ্গলগ্রহে পাঠিয়ে দাও আমরা কিন্তু সবাই মারা যাব। রবোমানব আর সাধারণ মানুষ সবাই মারা যাব। কাজেই তুমি আসলে আমাদের হত্যাই করছ।
ট্রিনিটি গমগমে গলায় বলল, তোমার বক্তব্য সঠিক নয়। মঙ্গলগ্রহে অনেকবার মানুষ এসেছে গেছে। এখানে তারা অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছে। এখানে অনেক জায়গায় মানুষের পরিত্যক্ত আবাসস্থল আছে, সেখানে খাবার আছে, রসদ আছে। তোমরা ইচ্ছে করলেই একরম একটি দুটি আবাসস্থল খুঁজে বের করে সেখানে আশ্রয় নিতে পার। সেখানে তোমরা মানুষেরা এবং রবোমানবেরা নিজেদের মাঝে বোঝাপাড়া করে নিতে পারবে।
টুরান বলল, আমরা সেই বোঝাঁপড়া এখানে বসে করতে পারি।
ট্রিনিটি বলল, না।
ইহিতা বলল, এটি সরাসরি আমাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া।
ট্রিনিটি বলল, আমার কিছু করার নেই।
সুহা হাহাকার করে বলল, আমার সাথে একটি ছোট শিশু। একটা নিরাপদ জীবনের জন্যে আমি ছোট শিশুকে নিয়ে বের হয়েছি। আমাদের এই বিপদের মাঝে ঠেলে দিয়ো না।
ট্রিনিটি বলল, স্কাউটশিপটা প্রস্তুত করে রাখা আছে। তোমরা সেখানে ওঠো।
নীহা অবাক হয়ে বলল, এখনই?
হ্যাঁ। এখনই।
আমরা যদি রাজি না হই।
ট্রিনিটি বলল, অবশ্যই রাজি হবে। টরকে জিজ্ঞেস করে দেখো আমার প্রস্তাবে রাজি না হয়ে থাকা সম্ভব কী না!
ইহিতা বলল, আমাদের পুরো ব্যাপারটি ভেবে দেখার সময় দিতে হবে। আমরা মানুষ, এই মহাকাশযানটির নেতৃত্ব আমাদের দেয়া হয়েছে। তুমি একটা কম্পিউটার, তোমায় আমাদের সাহায্য করার কথা। আমাদের আদেশ নির্দেশ মেনে চলার কথা। আমাদের পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে দাও, ভাবনা-চিন্তা করতে দাও।
তোমরা মানুষ—এবং রবোমানব, শুধুমাত্র এই কারণে আমি তোমাদের ভাবনা-চিন্তা করতে দেব না। তার কারণ তোমরা এমন কোনো একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলতে পারবে যার কারণে আমি তোমাদের রেখে দিতে বাধ্য হব। আমি সেরকম পরিস্থিতিতে যেতে রাজি নই। তোমরা স্কাউটশিপে উঠে যাও।
ঘরের ভেতরে যারা আছে তারা সবাই একে অপরের দিকে তাকাল। সুহা কাতর গলায় বলল, তোমাদের ভেতর যে রবোমানব সে নিজের পরিচয় দিয়ে দাও। দোহাই তোমাদের। আমাদের সবাইকে মেরে ফেলো না?
নীহা বলল, রবোমানবদের বুকের ভেতর কোনো ভালোবাসা থাকে না। তারা তোমার কথাকে কোনো গুরুত্ব দেবে না। তারা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে। সেই উদ্দেশ্য সফল না হওয়া পর্যন্ত তারা এখান থেকে যাবে না।
ট্রিনিটি গমগমে গলায় বলল, তোমরা স্কাউটশিপে উঠে যাও। এক মিনিটের মাঝে স্কাউটশিপে উঠে না গেলে আমি জোর করতে বাধ্য হব।
ক্লদ জিজ্ঞেস করল, মা, আমরা স্কাউটশিপে করে কোথায় যাব? মঙ্গলগ্রহে। ক্লদের মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, কী মজা হবে। তাই না মা?
সুহা অসহায়ভাবে একবার ক্লদের মুখে আরেকবার সবার মুখের দিকে তাকাল। ট্রিনিটি আবার বলল, দশ সেকেন্ড পার হয়ে গেছে। আর পঞ্চাশ সেকেন্ড বাকি আছে।
সবাই পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। ট্রিনিটি বলল, আর চল্লিশ সেকেন্ড।
সবার আগে ইহিতা ওঠে দাঁড়াল। তার দেখাদেখি অন্য সবাই। ইহিতা ফিসফিস করে বলল, ট্রিনিটি, তুমি মানুষ হলে আমি তোমাকে অভিশাপ দিতাম। কিন্তু তুমি একটি নির্বোধ কম্পিউটার, তোমাকে অভিশাপ দেয়া অর্থহীন। তবু আমি অভিশাপ দিচ্ছি। তুমি যেন মানুষের হাতে ধ্বংস হও।
ট্রিনিটি বলল, পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড।