ঝা অপারেশন থিয়েটারে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। কিছুতেই সে তার নাকে অস্ত্রোপচার করতে দিতে রাজী হচ্ছিল না বলে তাকে তার বিছানার সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার বিশাল শক্তিশালী শরীর নিয়ে সে বিছানাসহই প্রায় ওলট পালট খাচ্ছিল বলে তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে নিস্তেজ করে রাখা আছে। আধো ঘুমে তার স্নায়ু দুর্বল হয়ে আছে তার মাঝে সে ঘোলা চোখে অস্ত্রোপচারকারী রবোট এবং ডাক্তারকে দেখার চেষ্টা করল। উপর থেকে তীব্র আলো এসে পড়ছে তাই ভাল করে সে তাদের চেহারা দেখতে পেল না কিন্তু যেটুকু দেখতে পেল তাতে মনে হল সে এই রবোট এবং ডাক্তারকে আগে দেখেছে। কোথায় দেখেছে সে কিছুতেই মনে করতে পারল না ঘুমের ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছে তার মস্তিষ্ক চিন্তাও করতে পারছে না। চিন্তা করতে ইচ্ছেও করছে না, পুরো ব্যাপারটা একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মত। সাধারণ দুঃস্বপ্ন ভেঙে গেলে সব ঝামেলা মিটে যায় এই দুঃস্বপ্ন সেরকম নয়। এটা ভেঙে যাবার পর দেখা যায় নতুন দুঃস্বপ্নের শুরু হয়েছে। গভীর হতাশার মাঝে ড়ুবে যেতে যেতে ঝা অপারেশান থিয়েটারে জ্ঞান হারাল।
ঝায়ের জ্ঞান হবার পর সে নিজেকে নতুন একটা ঘরে আবিষ্কার করে। চারদিকে সাদা পর্দা দিয়ে ঢাকা হাত দিয়ে নিজের নাক স্পর্শ করার চেষ্টা করে দেখল তার দুই হাত শক্ত করে বিছানার সাথে বাধা। ঝা খানিকক্ষণ নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে কোন সুবিধে করতে না পেরে বিকট স্বরে একটা চিৎকার করল এবং সাথে সাথেই ডাক্তার, নার্স এবং অস্ত্রোপচারকারী রবোট ছুটে এসে ঢুকল। নার্স নাক দুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমার?
ঝা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমার সর্বনাশ কী হয়ে গেছে?
নার্স শান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গীতে বলল, সর্বনাশ হবে কেন? কী চমৎকার তুলতুলে কোমল একটা নাক লাগিয়েছে তোমার, নাড়াও দেখি একটু—
ঝা নাক নাড়ানোর কোন চেষ্টা না করে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল। ডাক্তার এগিয়ে এসে বলল, ডেলিরিয়াম হচ্ছে মনে হয়। তুমি ঘুমের ওষুধ নিয়ে এস আমি দেখছি।
নার্স ঘর হতে বের হতেই ডাক্তার ঝায়ের কাছে এগিয়ে এসে বলল, ঝা–
ঝা নিজের নাম শুনে চমকে উঠে তাকাল। তার সামনে ডাক্তারের পোশাক পরে টুকি দাঁড়িয়ে আছে—শুধু তারও নাকের জায়গায় একটা শাড় ঝুলছে। ঝা আর্তনাদ করে বলল, সর্বনাশ তোমার নাকেও লাগিয়েছে?
ধুর বেকুব। এটা প্লাস্টিকের শূড়, আঠা দিয়ে লাগানো আছে। ভিতরে ব্যাটারী পাওয়ারের যন্ত্রপাতি দিয়ে নাড়া চাড়া করার ব্যবস্থা।
তুমি এখানে কী করে এসেছ?
সেটা অনেক বড় ইতিহাস। এখন বলার সময় নেই। শুধু শুনে রাখ আমি আর রোবি মিলে ডাক্তার আর অস্ত্রোপচারকারী রবোট সেজে তোমার নাকে অপারেশান করেছি।
সত্যি?
ছাই অপারেশন। প্লাস্টিকের একটা নাক আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছি। ভিতরে নাড়াচাড়া করার যন্ত্রপাতি আছে—শুয়ে শুয়ে নাক নাড়ানো প্র্যাকটিস কর। যদি ধরা পরে যাই আমার হবে জেল আর তুমি পাবে সত্যিকারের শূঁড়।
টুকির কথা শেষ হবার আগেই নার্স বড় একটা সিরিঞ্জে বেগুনি রংয়ের কী একটা ওষুধ নিয়ে হাজির হল। টুকি বলল, রোগী মনে হয় নিজেকে সামলে নিয়েছে। আজে বাজে কথা আর বলছে না।
সত্যি?
হ্যাঁ! টুকি ঝায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, নাড়াও দেখি তোমার নাক।
ঝা মুখে হাসি ফুটিয়ে তার নাক নাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু খুব সুবিধে করতে পারল না। নার্স শান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গী করে বলল, নার্ভগুলো এখনো জোড়া লাগে নি। একটু সময় নেবে।
ঝা মাথা নেড়ে বলল, আমার কোন তাড়া নেই।
দুদিন পর ঝা ছাড়া পেল, তাকে বিদায় দিতে এল সরকারি কর্মচারী, পুলিশ অফিসার এবং দয়ালু চেহারার মোটাসোটা কিছু মহিলা। ঝা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ব্যাটারীর কলকজা লাগানো এই নাকটিকে এর মাঝে বেশ বাগে এনেছে। উপরে তুলতে পারে নিচে নামাতে পারে ডানে বায়ে দুলাতেও পারে। বিদায় সম্ভাষণ জানানোর জন্যে সে তার নাককে দোলাতেই হাসিখুশি চেহারার মোটাসোটা মহিলা খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি সবকিছু ওলট-পালট করছ।
ঝা অবাক হয়ে বলল, কী ওলট-পালট?
বিদায় সম্ভাষণ একটা দুঃখের ব্যাপার। দুঃখের ব্যাপারে নাককে দোলাতে হয় না। নাককে তখন সোজা উপরে তুলে রাখতে হয়।
ঝা নাককে উপরে তুলে রাখার চেষ্টা করতে করতে আবার সবার কাছে। বিদায় সম্ভাষণ জানালো। পুরো ব্যাপারটি যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় ততই ভাল। তাকে নেয়ার জন্যে টুকি আর রোবি একটা ভাসমান গাড়ি নিয়ে একটু দূরে অপেক্ষা করছে। ভাসমান গাড়ি করে যাবে তাদের স্কাউটশীপে। সেই স্কাউটশীপে করে মূল মহাকাশযানে। সেটি এখন এই গ্রহটিকে ঘিরে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে।
যথসময় ঝা ভাসমান গাড়িতে গিয়ে হাজির হল। ড্রাইভারের সীটে রোবি বসে আছে, ঝাকে দেখে বলল, উঠে পড়ন মহামান্য ঝা। আমরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি।
ঝা উঠে নিজের সীটে বসতে বসতে বলল, ধন্যবাদ রোবি।
আপনার সেবা করতে পেরে আমার জীবন ধন্য মহামান্য ঝা এবং মহামান্য টুকি।
ঝা নিচু গলায় টুকিকে জিজ্ঞেস করল, রোবির ভাবভঙ্গী এত নরম, ব্যাপার
কী?
টুকি দাঁত বের করে হেসে বলল, তোমার নাকে অপারেশান করার জন্যে যে ডাক্তার ঠিক করা হয়েছিল তাকে যখন খুঁজে বের করছিলাম তখন এক কাণ্ড হল।
কী কাণ্ড?
মনে আছে রোবির মেজাজের কথা?
মনে নেই আবার?
সেই মেজাজ দেখিয়ে ফেলল এক পুলিশ রবোটের সাথে। আর যায় কোথা তক্ষুণি ধরে কপোট্রনে অস্ত্রোপচার। রাগ বদমেজাজ যা ছিল তক্ষুণি পরিষ্কার করে সেই পুলিশ রবোট টেরাবাইট ভদ্রতা আর আদব লেহাজের সফটওয়ার ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমাদের রোবি সেই থেকে একেবারে মাটির মানুষ। তাই না রোবি?
রোবি বলল, আপনাদের সেবা করার জন্যে আমার জন্ম। এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির কাছে প্রার্থনা করি আপনাদের সেবা করতে করতে একদিন আমার কপোট্রনে শর্ট সার্কিট হোক।
ঝা দাঁত বের করে হেসে বলল, চমৎকার। এই তো চাই।
ভাসমান গাড়ি স্কাউটশীপের কাছে পৌঁছে গেল। দুজনে রোবির পিছু পিছু স্কাউটশীপে ঢুকে পড়ল। স্কাউটশীপে প্রাথমিকভাবে চালু করার সময় এক ধরনের স্পেস স্যুট পরতে হয়, নাকের কাছ থেকে প্রাস্টিকের শূড় ঝুলছে বলে তাদের স্পেস স্যুটের হেলমেট পরতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। ঝা বলল, টান দিয়ে খুলে ফেলব না কী এই নাক?
টুকি হা হা করে বলল, না না-এখনই না। এই এলাকা ছেড়ে পার হই আগে।
কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল টুকি এবং ঝাকে নিয়ে একটা স্কাউটশীপ মহাকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছে।
যে নক্ষত্রের কাছে এসে তাদের হাইপার ডাইভ দেবার কথা টুকি এবং ঝা প্রায় তার কাছাকাছি চলে এসেছে। কয়েকদিনের মাঝেই তারা হাইপার ডাইভ দিতে পারবে। এম-সেভেন্টিওয়ানের মানুষের কলোনীর এলাকা মোটামুটি শেষ। এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু মানুষ বা রবোট থাকতে পারে কিন্তু বিপজ্জনক কিছু নেই। নানারকম যন্ত্রণার পর পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত ফিরে যেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে সেটা চিন্তা করে টুকি এবং ঝা দুজনেরই মনে আনন্দের ভাব। রোবির কপোট্রনে এক টেরাবাইট দ্রতা এবং আদব লেহাজের সফটওয়ার ঢুকিয়ে দেওয়ার পর সে একেবারে পাল্টে গেছে। টুকি এবং ঝায়ের আরাম আয়েশের জন্যে রোবি মোটামুটিভাবে নিজের জীবন পাত করে ফেলছে। মহাকাশযানের গোপন রিজার্ভ থেকে ভালমন্দ খাবার বের করে দুই বেলা রান্না হচ্ছে সব মিলিয়ে মহাকাশযানে একটা স্কুর্তি সূর্তি ভাব। টুকি এবং ঝায়ের আনন্দের বড় কারণ অন্য জায়গায় বিদ্রোহী গ্রহ থেকে তারা যে পরিমাণ হীরা তুলে এনেছে পৃথিবীতে পৌঁছে সেটা বিক্রি করে তারা কয়েকশ বছর রাজার হালে থাকতে পারবে।
টুকি নরম একটা চেয়ারে আরাম করে হেলান দিয়ে শুয়েছিল। আলস্যে চোখ আধবোজা হয়ে আছে, সে অবস্থাতেই চোখ অল্প খুলে ডাকল, রোবি।
রোবি কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল প্রায় ছুটে এসে বলল, বলুন মহামান্য টুকি। আপনার জন্যে আমি কী করতে পারি?
আপাতত এক গ্লাস তরল পানীয় নিয়ে এস তারপর কিনিস্কীর নবম সিম্ফোনীটা লাগিয়ে দাও।
রোবি টুকির জন্যে নবম সিম্ফোনী লাগিয়ে দিয়ে তরল পানীয় আনার জন্যে ছুটে গেল। ক্লাসিক্যাল সংগীত ঝায়ের মোটেই পছন্দ নয়। বিরক্ত হয়ে বলল, দিনরাত এসব কী প্যানপ্যানানি শোন? মেজাজ গরম হয়ে যায়।
টুকি চোখ অল্প একটু খুলে বলল, না হলে করবটা কী? এই মহাকাশযানে আর কিছু করার আছে?
কথাটা সত্যি, ঝা আর কিছু বলতে পারে না। টেবিলে রাখা বড় একটা গলদা চিংড়ির কাটলেট নিয়ে চিবুতে শুরু করে। রোবি কিছুক্ষণের মাঝেই টুকির জন্যে তরল এক গ্লাস পানীয় নিয়ে আসে। টুকি সেটায় চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে আরামের এক ধরনের শব্দ করল।
রোবি কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ স্ক্রিণটা পরীক্ষা করে বলল, আমরা এখন এম সেভেন্টি ওয়ানের মানুষের শেষ কলোনীটা পার হয়ে যাচ্ছি।
ঝা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তাড়াতাড়ি পার হয়ে যাও।
রোবি বলল, মহামান্য ঝা, মানুষের এই বসতি থেকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
ওসব বলে লাভ নেই। মানুষের যে কোন বসতি বিপজ্জনক।
রোবি মধুর গলায় বলল, কিন্তু এই বসতিটি সত্যিই শান্তিপূর্ণ বসতি। এদের মাঝে কোনই বিপদ নেই।
টুকি চোখ খুলে বলল, কেন এই কথা বলছ?
এই বসতির মানুষ হচ্ছে, সৃষ্টি জগতের মানুষদের মাঝে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ মানুষ। তারা এত শান্তিপূর্ণ মানুষ যে এদের সমাজে কোন অস্ত্র নেই।
কোন অস্ত্র নেই?
না।
তাহলে চোর ডাকাতদের ধরে কেমন করে?
এদের সমাজে কোন চোর-ডাকাত নেই।
টুকি সোজা হয়ে বসে বলল, চোর-ডাকাত নেই? কী বলছ তুমি?
সত্যি কথাই বলছি মহামান্য টুকি। এই দেখুন গ্যালাক্টিক এনসাইক্লোপিডিয়াতে স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে। এই সমাজে চোর ডাকাত অপরাধী নেই, পুলিশ শান্তিরক্ষার মানুষও নেই।
টুকি জ্বলজ্বলে চোখে ঝায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ঝা, শুনেছ কথাটা। মানব সমাজ অথচ কোন চোর-ডাকাত নেই। পুলিশ নেই।
ঝা একটা হাই তুলে বলল, নীচু ধরনের সমাজ। আনন্দ উত্তেজনাহীন সমাজ। খোঁজ নিয়ে দেখ সেখানে ধন-সম্পত্তিও নেই। সবাই মাদুরে শুয়ে শুয়ে ধ্যান করছে।
রোবি বলল, আমার বেয়াদবী মাপ করবেন মহামান্য ঝা, কিন্তু গ্যালাক্টিক এনসাইক্লোপিডিয়াতে লেখা রয়েছে এখানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে অমূল্য সম্পদগুলো রয়েছে। অতুলনীয় ঐশ্বর্য।
এবারে ঝাও সোজা হয়ে বসল। টুকির দিকে তাকিয়ে বলল, শুনেছ টুকি?
শুনেছি।
কী মনে হয়?
অতুলনীয় ঐশ্বর্য অথচ চোর-ডাকাত নেই, পুলিশও নেই। মনে হচ্ছে আমাদের জন্যে কেউ একটা দাও মারার ব্যবস্থা করে রেখেছে।
ঝা দুই হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙে বলল, শুয়ে বসে থেকে থেকে শরীর ম্যাদা মেরে গেছে, চল একটা দাও মেরে আসি।
টুকি মাথা নেড়ে বলল, যে সমাজে চোর-ডাকাত নেই তাদেরকে ডাকাতি সম্পর্কে একটা ধারণা দিয়ে আসাই উচিত। না হয় তাদের জ্ঞানভাণ্ডার অপূর্ণ থেকে যাবে।
ঝা দাঁত বের করে হেসে বলল, ঠিকই বলেছ। কিভাবে করবে কাজটা?
খুব সোজা। ভারী কয়টা অস্ত্র নিয়ে গিয়ে হাজির হব কিছু সোনাদানা একত্র করে হুংকার দিয়ে বলব, কেউ কাছে আসেলেই গুল্লি।
ঝা একটু ইতস্তত করে বলল, কাজটা গোপনে করলে হত না?
সারাজীবন তো গোপনেই কাজ করলাম। একবার প্রকাশ্যে করে দেখি না কেমন লাগে। এই রকম সুযোগ আর কখনো পাবে বলে মনে হয়?
তা ঠিক।
রোবি বেশ মনোযোগ দিয়ে দুজনের কথা শুনছিল এবারে সুযোগ পেয়ে বলল, আপনারা এই শান্তিপূর্ণ মানব বসতির উপরে হামলা করবেন বলে মনে হয়?
হ্যাঁ। আপত্তি আছে তোমার?।
কী যে বলেন আপনারা–আমার কেন আপত্তি থাকবে? অত্যন্ত চমৎকার একটা কাজ হবে। অত্যন্ত আনন্দদায়ক কাজ।
তাহলে আর দেরী করা যায় না। যাও—স্কাউটশীপটাকে রেডি কর, কিছু ভাল ভাল অস্ত্র নিয়ে আস। ছোট মাঝারী আর লম্বা রেঞ্জের অস্ত্র।
এক্ষুণি নিয়ে আসছি।
ঘন্টা খানেক পরে দেখা গেল টুকি এবং ঝা রোবিকে নিয়ে ছোট একটা স্কাউটশীপে করে সোনাদানা ডাকাতি করার জন্যে উড়ে চলেছে।
গ্রহটি ছোট এবং মসৃণ। উপর দিয়ে দুবার পাক খেয়ে এসে টুকি বলল, এইটাই সেই গ্রহ? মানুষজন কোথায়?
ভিতরে।
ভিতরে? গ্রহের ভিতরে মানুষ থাকে নাকি? মানুষ থাকবে গ্রহের উপরে।
এই গ্রহটির আকার এত ছোট যে এর কোন বায়ুমণ্ডল নেই। তাই এর বাইরে কেউ থাকতে পারে না। সবাই ভিতরে থাকে। তা ছাড়া এত ছোট গ্রহে মাধ্যাকর্ষণ বলতে গেলে নেই; সেজন্যে বাইরে থাকার কোন ঝুকি নেই।
ঝা বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশেষ কিছু বুঝে না, ইতস্তত করে বলল, যদি বাইরে মাধ্যাকর্ষণ না থাকে তাহলে কিভাবে ভিতরে থাকবে?
রোবি বলল, গ্রহটিকে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয় তখন সেন্ট্রিফিউগাল বলের কারণে ভিতরে এক ধরনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনুভব করা যায়।
ঝা কিছুই না বুঝে বলল, অ।
টুকি চিন্তিত মুখে বলল, কিন্তু গ্রহের ভিতরে ঢুকব কেমন করে?
নিশ্চয়ই ঢোকার একটা কিছু রাস্তা আছে। রোবি তার টেলিস্কোপিক চোখ ব্যবহার করে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেয়, খানিকক্ষণ এদিক সেদিক তাকিয়ে উৎফুল্ল গলায় বলল, পাওয়া গেছে। ঐ যে একটা গোল গর্ত।
টুকি এবং ঝা ভাল করে তাকিয়েও কিছু খুঁজে পেল না। জিজ্ঞেস করল, কোথায়? কিছু তো দেখছি না।
আপনাদের চোখ তো ইনফ্রারেড দেখতে পারে না তাই দেখছেন না। কোন চিন্তা করবেন না, আমি নিয়ে যাচ্ছি।
গ্রহের মাঝামাঝি এক জায়গায় সুড়ঙ্গের মত একটা গর্ত নিচে নেমে গেছে, ভিতর থেকে উষ্ণ এক ধরনের বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। ঝা মনমরা গলায় বলল, ঢোকার এই একটাই রাস্তা?
রোবি বলল, হ্যাঁ! ঢোকার এবং বের হবার একটাই রাস্তা।
ঝা বলল, টুকি মনে আছে চুরি বিদ্যার ডিপ্লোমা কোর্সে আমাদের সবচেয়ে প্রথম কি শিখিয়েছিল?
মনে আছে। যেখানে ঢোকার এবং বের হবার রাস্তা মাত্র একটা কখনো তার মাঝে চুরি করতে ঢুকবে না।
তাহলে ঢোকা কী উচিত হচ্ছে?
আমরা তো এখন চুরি করতে ঢুকছি না, ঢুকছি ডাকাতি করতে।
ঝা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অ।
অন্ধকার সুরুঙ্গ দিয়ে টুকি এবং ঝা নিচে নামতে শুরু করে। সুরুঙ্গের বাইরে স্কাউটশীপ নিয়ে রোবি অপেক্ষা করছে। বের হয়ে এলেই তাদের নিয়ে পালিয়ে যাবে। স্কাউটশীপের মাথায় ছোট আলো লাগানো রয়েছে। সেটা দিয়ে সামনে পথ আলোকিত করে তারা হাঁটতে থাকে। গাঢ় অন্ধকার, ছোট আলোতে সেটা দূর না হয়ে মনে হয় আরো জমাট বেঁধে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, সুরুঙ্গ যত গভীরে নামতে থাকে অন্ধকার আরো গাঢ় হতে শুরু করে। অন্ধকারে হাতড়ে আরো কিছুদূর নেমে ঝা বলল, কিছু একটা গোলমাল আছে মনে হয়। এত অন্ধকার কেন? ভুল জায়গায় চলে এসেছি নাকি?
টুকি শুকনো গলায় বলল, ভুল জায়গা ন, ঠিক জায়গাতেই এসেছি। দেখছ না কী মসৃণ দেয়াল, নিখুঁত সিঁড়ি। হাত ধরার রেলিং।
কিন্তু আলো নেই কেন? লোড শেডিং হচ্ছে নাকি?
কী বল বোকার মত? লোড শেডিং কেন হবে?
অন্ধকারে যদি আছাড় খেয়ে যাই। পড়ে হাত-পা ভেঙে গেলে একটা কেলেংকারি হয়ে যাবে।
সাবধানে হাঁট।
সাবাধানে হাঁটতে হাঁটতে তারা এক সময় হারিয়ে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার তার মাঝে নানা রকম গলি ঘুজি, কোনটার মাঝে ঢুকবে বুঝতে না পেরে ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করতে করতে এক সময় তাদের আর বোঝার কোন উপায় রইল না তারা কোথায় আছে। ঝা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কোথায় চলে এসেছি? এতো দেখছি গোলক ধাঁধার মত।
টুকি বলল, চিন্তার ব্যাপার হল। আমাদের পোশাকের পাওয়ার সাপ্লাই তো শেষ হতে চলল। একটু পরে তো আলো নিভে যাবে।
সর্বনাশ। ডাকাতির কাজ নেই। চল ফিরে যাই।
চল।
টুকি এবং ঝা উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে, ঘণ্টা খানেক হেঁটেও তারা কোন পথ খুঁজে পেল না এবং অবস্থা আরো খারাপ করে দেবার জন্যে প্রথমে টুকির এবং তারপর ঝায়ের মাথায় লাগানো বাতি দুটি নিভে গিয়ে তারা গাঢ় অন্ধকারে ড়ুবে গেল।
ঝা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, সর্বনাশ!
টুকি শুকনো গলায় বলল, চিন্তার বিষয় হল।
ঠিক তখন তাদের কানের কাছে থেকে কে যেন বলল, চিন্তার কোন ব্যাপার নেই ভাই। আমরা আছি?
ঝা ভয় পেয়ে একটা আর্ত চিৎকার করে বলল, কে? কে কথা বলে?
আমরা এই গ্রহের বাসিন্দা। আমার নাম রু। তোমাদের নাম কী ভাই?
ঝা কাঁপা গলায় বলল, আমার নাম ঝা।
টুকি বলল, আমার নাম টুকি।
কী সুন্দর নাম। আহা। টুকি এবং ঝ। ঝা এবং টুকি।
টুকি এতক্ষণে একটু সাহস ফিরে পেয়েছে, সে গলা উঁচিয়ে বলল, এখানে এত অন্ধকার কেন?
এতক্ষণ যে কথা বলছিল সে হঠাৎ চুপ করে গেল। টুকি আবার বলল, কী হল? রু—কথা বলছ না কেন? এখানে এত অন্ধকার কেন?
রু নরম গলায় বলল, অন্ধকার বড় আপেক্ষিক কথা। তোমাদের জন্যে যেটা অন্ধকার আমাদের জন্যে সেটা আলো।
তার মানে কী? আর তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?
আমি তোমাদের কাছেই আছি সারাক্ষণ। এতক্ষণ তোমাদের মাথার ঐ বিদঘুটে আলোর জন্যে কিছু দেখতে পারছিলাম না বলে কথাবার্তা বলিনি। এখন ওটা নিভেছে তাই দেখতে পাচ্ছি–
দেখতে পাচ্ছ? এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছ?
ঐ যে বললাম ভাই, তোমাদের কাছে যেটা অন্ধকার আমাদের কাছে সেটা আলো। আমাদের চোখ হচ্ছে অবলাল সংবদী—যার অর্থ আমরা ইনফ্রারেড আলো দেখতে পারি। তোমার যেই আলো দেখতে পারো আমাদের চোখের রেটিনাকে সেটা নষ্ট করে দেয়। তাই এখানে তোমাদের আলো নেই।
তার মানে তুমি আমাদের দেখতে পাচ্ছ?
পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। এই যে তুমি শুকনো মত, ছোট ছোট গোফ। আর এই যে আরেকজন ছোটখাট পাহাড়ের মতন মাথায় ছোট ছোট চুল-হা হা হা। রাগ করলে না তো ভাই?
ঝা মাথা নেড়ে বলল, না, রাগ করি নাই।
তোমাদের ঘাড় থেকে কালো লম্বা মতন ঐ সব কী ঝুলছে ভাই? দেখে মনে হচ্ছে অনেক ভারী?
জিনিসগুলো ছোট, মাঝারী এবং বড় রেঞ্জের অস্ত্র কিন্তু সেই কথাটা এখন বলে কেমন করে? টুকি আমতা আমতা করে বলল, ইয়ে মানে এটা হচ্ছে যাকে বলে—
যাই হোক এটা কী সেটা নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। এখন চল আমার সাথে তোমাদের নিয়ে যাই। আমাদের এই ছোট গ্রহে অতিথি খুব একটা আসে না, কেউ এলে তাই আমাদের খুব আনন্দ হয়।
ঝা কাতর গলায় বলল, কোনদিকে যাব? কিছুই তো দেখি না।
এসো, আমার হাত ধর— বলে অন্ধকারে একজন তার হাত শক্ত করে ধরল।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে একজন ঝায়ের হাত ধরে এগিয়ে নিতে থাকে, ঝায়ের হাত ধরে ধরে এগিয়ে আসে টুকি। কিছুক্ষণের মাঝে তারা আরো মানুষের কথাবার্তা শুনতে পায়, সবাই তাদের দেখছে কিন্তু তারা কিছু দেখছে না ব্যাপারটা চিন্তা করেই টুকি এবং ঝায়ের গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে তারা এগিয়ে যেতে থাকে তাদের সামনে এবং পিছনে আরো মানুষ একত্র হয়েছে শব্দ, কথাবার্তা শুনে বোঝা যায়। একজন এগিয়ে এসে বলল তোমাদের পিঠে এ ভারী বোঝা তাই কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই। বলে কিছু বোঝার আগেই তাদের ছোট, মাঝারী এবং বড় রেঞ্জের অস্ত্রগুলো খুলে নিয়ে নিল। টুকি আমতা আমতা করে বলল, খুব সাবধান, মানে ইয়ে চাপ না পড়ে যায় তাহলে কিন্তু মানে ইয়ে
কী জিনিস এটা? টেলিস্কোপ নাকি?
আরেকজন বলল, নলটা চোখে লাগিয়ে ঐ ট্রিগারটা টেনে দিলে নিশ্চয়ই কিছু একটা দেখা যাবে, তাই না?
টুকি হা হা করে উঠে বলল, না না না—খবরদার ওরকম কাজ করো না। ভুলেও ট্রিগারে হাত দেবে না।
কী হয় হাত দিলে?
টুকি উত্তর না দিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে।
টুকি এবং ঝা হাত ধরাধরি করে জবুথবু হয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। ঘুটঘুটে অন্ধকার, একটি বিন্দুও দেখা যাচ্ছে না। মানুষ পরিপূর্ণ অন্ধকার দেখে অভ্যস্ত নয়, সব সময়েই যত অন্ধকারই হোক একটু আলো থাকে, তার উপর চোখের রেটিনাও কম আলোতে সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে কাজেই কিছু না কিছু তারা সব সময়েই দেখতে পারে। এই প্রথম তারা একটি পুরোপুরি অন্ধকার জগতে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রাণপণে চোখ খোলা রেখেও তারা কিছু দেখতে পাচ্ছে না, নিকষ কালো অন্ধকারে সবকিছু ঢেকে আছে। এই অন্ধকার এত ভয়াবহ যে তাদের মনে হতে থাকে বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে। ঝা টুকিকে টেনে বলল, টুকি।
কী হল?
আমাদের দাও মারার পরিকল্পনাটা একেবারে মাঠে মারা গেল।
তাইতো মনে হচ্ছে।
কী মনে হয়? জ্যন্ত ফিরে যেতে পারব?
অস্ত্রগুলো হাতছাড়া হয়েই তো বিপদ হল। কখন ভুল করে গুলি করে দেয়।
কী করব এখন?
করার কিছু নাই। যা করতে বলে তাই করতে হবে।
কাজেই টুকি আর ঝা ঘুটঘুটে অন্ধকারে একজন আরেকজনের হাত ধরে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে যেতে থাকে। প্রতি মুহূর্তে তাদের মনে হয় এই বুঝি কোন অতল খাদে হুঁমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে কিংবা অসতর্ক কোন তরুণ মাঝারী রেঞ্জের অস্ত্র দিয়ে গুলি করে তাদের ধ্বংস করে দেবে। ঝা মনে মনে বলতে লাগল, হে ঈশ্বর, হে সৃষ্টিকর্তা—তোমার কাছে এন্ড্রোমিডার দোহাই লাগে, মিল্কিওয়ের দোহাই লাগে এই যাত্রা আমাদের উদ্ধার করে দাও। আর কোনদিন প্রয়োজন ছাড়া কোথাও হামলা করব না। সত্যিকারের বড় একটা দাও না পেলে দাও মারার চেষ্টা করব না। বাড়াবাড়ি লোভ করব না, অল্পতে সন্তুষ্ট থাকব—
টুকি এবং ঝাকে ধরে ধরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে একটা ঘরে এনে হাজির করা হল। তারা কিছুই দেখছে না শুধু শব্দ শুনে বুঝতে পারছে তাদেরকে ঘিরে অনেক মানুষ। বয়স্ক একজন বলল, ভিন দেশের অতিথি, আমাদের এই ছোট গ্রহে তোমাদের শুভ আমন্ত্রণ।
টুকি শুকনো গলায় বলল, অনেক ধন্যবাদ তোমাদের আতিথিয়েতার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ঝা সাথে সাথে মাথা নেড়ে বলল, তোমাদের দেখতে পারছি না বলে ঠিক করে কথা বলতে পারছি না।
আমরা তোমাদের গ্রহ সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। তাই ভাবলাম দেখে যাই।
ঝা যোগ করল, কিন্তু দেখতে এসে আবিষ্কার করলাম, এখানে আলো নেই তাই দেখা যায় না।
বয়স্ক মানুষটি বলল, আহা। তোমাদের কথা শুনে এত দুঃখ হচ্ছে কী বলব। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কিন্তু তোমরা দেখতে পাচ্ছ না।
মেয়ে গলার একজন বলল, প্রাচীন কালে যারা দেখতে পেত না তারা নাকি হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখত। আমাদের এই অতিথিরা ইচ্ছা করলে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আমাদের গ্রহটা দেখতে পারে।
হাত বুলিয়ে?
হ্যাঁ। তারা এত দেখতে চাচ্ছেন যখন। তাই না ভাই টুকি?
টুকি শুকনো গলায় বলল, হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়।
সাথে সাথে অন্ধকারে সবাই কথা বলতে থাকে, তাদেরকে অবশ্যি আমাদের ঘূর্ণায়মান পার্কটা দেখতে হবে। হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখতে হবে।
কিন্তু সেটা একটু বিপদজনক মনে নাই বড় রোলারটা যখন ঘুরে আসে তখন সময় মত সরে না গেলে মাথা ফেটে ঘিলু বের হয়ে যায়?
সেটা আর কঠিন কী? রোলারের শব্দ শুনেই সরে যেতে পারবে।
আর আমাদের সেন্ট্রাল অফিসঘরটা দেখতে হবে।
অবশ্যি অবশ্যি দেখতে হবে, মানে হাত বুলাতে হবে।
অনেক উঁচু অফিসঘর, উঠতে একেবারে জান বের হয়ে যাবে কিন্তু তবু। জায়গাটাতে হাত বুলিয়ে না গেলে হবে না।
ওঠার সময় হতে ফসকে গেলে জান শেষ হয়ে যাবে কিন্তু—
হাত ফসকাবে কেন? ভাল কাজে কেন খারাপ কথা বলছ?
আর আমাদের রি একটরের রাস্তাটা—
হ্যাঁ। হ্যাঁ। রি-এক্টরের রাস্তা। রেডিয়েশান থেকে দূরে থাকতে হবে কিন্তু।
তা তো বটেই—
ঝায়ের ইচ্ছে হল সে ডাক ছেড়ে কাঁদে। কিন্তু তারা এখন যে ঝামেলায়। পড়েছে ডাক ছেড়ে কেঁদে এর থেকে রক্ষা পাবার উপায় নেই। মুখ শুকনো করে দুজন বসে রইল। গ্রহের মানুষ জনেরা তাদের দুজনকে সমাদর করার নানা ধরনের আয়োজন শুরু করছিল, টুকি তার মাঝে বলল, আমাদের খুবই ভাল লাগছে এখানে এসে কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী হাতে মোটে সময় নেই।
ঝা বলল, তাছাড়া এরকম ঘুটঘুটে অন্ধকার চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছি, কেমন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
বয়স্ক গলার মানুষটি বলল, কথাটি সত্যি। পুরোপুরি অন্ধকার থাকলে স্নায়ুর উপর খুব চাপ পড়ে।
রিনরিনে গলার একজন মেয়ে বলল, কী করা যায়?
তাদেরকে দেখানোর একটা ব্যবস্থা করা যায় না?
কিভাবে দেখাবে?
মাথার পিছনে আচমকা লাঠি দিয়ে মারলে চোখের সামনে লাল নীল। তারা দেখা যায়।
সত্যি?
সত্যি।
দেখব নাকি মেরে। লাঠি আছে কারো কাছে?
টুকি এবং ঝা একসাথে চিৎকার করে জানাল তাদের কিছু না দেখেই বেশ চলে যচ্ছে।
টুকি এবং ঝায়ের কাকুতি মিনতি শুনে শেষ পর্যন্ত গ্রহের অধিবাসীরা তাদের দুজনকে যেতে দিতে রাজী হল। এখন হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখার সেই বিশাল কাজটি শুরু হবে। শুকনো মুখে তারা মাত্র শুরু করেছে তখন রিনরিনে গলার একজন মেয়ে বলল, আমাদের এই গ্রহে বেড়াতে এসেছেন, তাদেরকে কী কোন। উপহার দেয়া যায় না?
একসাথে বেশ কয়েকজন বলল, সত্যিই তো!
কী উপহার দেয়া যায়?
সোনা?
হ্যাঁ। তাদেরকে দশ কেজি সোনা দেয়া যাক।
এই প্রথমবার টুকি এবং ঝায়ের বুকের মাঝে রক্ত ছলাৎ করে উঠে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই গ্রহটিতে একটা ডাকাতি করার। ডাকাতি করে সোনা দানা নেবার কথা ছিল, যদি এমনিতেই সেই সোনা দানা পাওয়া যায় তাহলে মন্দ কী?
যখন দশ কে.জি. সোনা দেয়া নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে তখন আরেকজন বলল, সোনার চাইতে ভাল হবে প্রাটিনাম।
সোনা ভাল না প্লাটিনাম ভাল যখন সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তখন আরেকজন বলল, রুবি পাথরের কথা। অন্যান্য মূল্যবান পাথর নিয়েও আলোচনা শুরু হল। যখন নানারকম মূল্যবান পাথর বা ধাতু নিয়ে বাদানুবাদ হতে থাকে তখন বয়স্ক ব্যক্তিটি বলল, একজনকে উপহার দিতে হলে সবসময় সবচাইতে মূল্যবান জিনিসটি উপহার দিতে হয়।
আমাদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কী?
নানা জনে নানা কথা বলতে থাকে এবং সেই আলোচনা শুনে প্রথমবার টুকি এবং ঝা এক ধরনের আনন্দ অনুভব করতে থাকে। অস্ত্র দেখিয়ে ডাকাতী করে তারা যে পরিমাণ সোনাদানা নিতে পারত এই গ্রহের মানুষগুলো উপহার হিসেবে তার চাইতে অনেক বেশি জিনিস দিয়ে দিচ্ছে। তাদের এই ভ্রমণটি শেষ পর্যন্ত বৃথা হয় নি তাহলে।
ভ্রমণটি বৃথা না হলেও খুব কষ্টকর হল। ঘাড়ের মাঝে দশ কেজি, উপহারের বাক্স এবং অস্ত্রগুলো নিয়ে গ্রহের বিপজ্জনক ঘূর্ণায়মান পার্কে হাত বুলিয়ে সেন্ট্রাল অফিসঘর এবং রি-এক্টর ভবনের রাস্তার উপর দিয়ে যখন শেষ পর্যন্ত গ্রহের বাইরে স্কাউটশীপে তারা ফিরে এল তখন তাদের সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়ে গেছে। বাইরে এসে প্রথমবার আলো দেখতে পেয়ে তারা হাঁপ চেড়ে বাঁচল। দীর্ঘ সময় এক বিন্দু আলো না দেখে কেন জানি তাদের মনে। হচ্ছিল যে আর বুঝি কোনদিন তারা আলো দেখতে পারবে না।
রোবি তাদের দুজনকে স্কাউটশীপে তুলে নেয়, সাথে উপহারের বাক্স এবং ভারী অস্ত্রসস্ত্র। সবকিছু তুলে নিয়ে স্কাউটশীপটা নিয়ে উড়তে শুরু করার আগে রোবি জিজ্ঞেস করল, আপনাদের ভ্রমণ কী সফল হয়েছে মহামান্য টুকি এবং ঝা?
টুকি দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যে উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম সেটা সফল হয়েছে, তবে যেভাবে চেয়েছিলাম সেভাবে হয় নি।
উদ্দেশ্য সফল হওয়াই বড় কথা। আপনারা কী সোনা-দানা কিছু আনতে পেরেছেন?
ঝা উৎফুল্ল গলায় বলল, পেরেছি। দশ কে. জি. একটা বাক্স বোঝাই মূল্যবান জিনিস এনেছি। তারা উপহার দিয়েছে।
জিনিসটা কী?
সোনা হতে পারে, প্লাটিনাম হতে পারে, রুবি বা মুক্তো হতে পারে—ঠিক কী দিয়েছে জানি না। সবচেয়ে মূল্যবান যেটা সেটাই দিয়েছে।
রোবি গলার স্বর উঁচু করে বলল, আপনি কী বলেছেন সবচেয়ে মূল্যবান?
হ্যাঁ। সবচেয়ে মূল্যবান।
ব্যাপারটা মনে হয় ভাল হল না।
ঝা শংকিত গলায় বলল, কেন?
আপনারা যখন গ্রহটিতে গিয়েছিলেন আমি তখন স্কাউটশীপে বসে এই গ্রহটি সম্পর্কে পড়াশোনা করেছি। জানতে পেরেছি তাদের চোখের রেটিনা অবলাল সংবেদী। আর–
আর কী?।
এই গ্রহের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিষ হচ্ছে গরু নামের চতুষ্পদ এক ধরনের প্রাণীর বিষ্ঠা। এক কথায় যাকে বলে গোবর।
ঝা চোখ কপালে তোলে বলল, সে কী! এই জিনিস মূল্যবান হয় কেমন করে?
রোবি স্কাউটশীপের গতিবেগ এবং দিক নিশ্চিত করতে করতে বলল, এই গ্রহটিতে প্রাকৃতিক খাদ্য খুব মূল্যবান। সেখানে প্রাকৃতিক সার দেওয়ার কথা। গোবর নামক এই বিশেষ জিনিসটি নাকি এক ধরনের সার–
টুকি থমথমে মুখে উঠে গিয়ে বাক্সটা খুলতে চেষ্টা করে হঠাৎ লাফিয়ে পিছনে সরে এল। রোবির আশংকা সত্য এই গ্রহ থেকে ঘাড়ে করে দশ কেজি ওজনের যে বাক্সটি তারা এনেছে তার ভিতরে রয়েছে দুর্গন্ধযুক্ত কালচে থিকথিকে পাংশুটে এক ধরনের জিনিস। সেটা তারা আগে কখনো দেখেনি কিন্তু জিনিসটা কী হতে পারে সে বিষয়ে তার কোন সন্দেহ নেই।
স্কাউটশীপ থেকে ছুঁড়ে ফেলা গোবরের বাক্সটি ছোট গ্রহটিকে প্রায় দুইশত বছর ধরে ঘুরপাক খাওয়ার কথা। সম্ভবত এটি মানুষের সৃষ্টি একমাত্র কৃত্রিম উপগ্রহ যেটির জন্ম হয়েছে এক ধরনের ঘৃণা এবং আক্রোশের কারণে।