শেষ পর্যন্ত জনের বিচারের দিন এগিয়ে এল। দুমাস ইতিমধ্যে কেটে গেছে। সত্মাকে হত্যার অভিযোগ মাথায় নিয়ে জন ক্যাভেণ্ডিস হাজির হল পুলিশ আদালতের আসামীর কাঠগড়ায়। এই সুদীর্ঘ দুটি মাস শুধু মেরী ক্যাভেণ্ডিসের বেদনা আর যন্ত্রণারই ইতিহাস। অবাক বিস্ময়ে শুধু ওর অদ্ভুত ধৈৰ্য্য আর মানসিক দৃঢ়তা দেখলাম। স্বামীর বিপদের সঙ্গে সঙ্গে মেরী ক্যাভেণ্ডিস পাশে এসে দাঁড়ালেন। স্বামীকে সম্পূর্ণ নিরপরাধ ভেবেই জীবনপণ করে তার মুক্তির চেষ্টা করতে লাগলেন।
জন যে দোষী হতে পারে একথা বিশ্বাস করতে মন সায় দিল না। সে আমার এতদিনের পুরনো বন্ধু। পোয়ারো আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল প্রত্যেক খুনীই তো কারও আত্মীয় আবার কারও বা বন্ধু। ভাব প্রবণতার সঙ্গে যুক্তিকে মিশিয়ে ফেললে চলবে না।
পোয়ারোর দার্শনিক তত্ত্ব মানতে মন চাইল না। জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হবে কিনা জানতে চাইলাম। পোয়ারোর উত্তর শুনে খুবই অবাক হলাম। ও বলল জন ছাড়া পাবে বলেই ওর ধারণা।
আমি পোয়ারোকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কোনোদিন জনকে সন্দেহ করেছিল কিনা। সে উল্টে আমার সন্দেহ হয়েছিল কিনা জিজ্ঞাসা করল। আমি মাথা নাড়লাম। পোয়ারো বলতে লাগল সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল–মিসেস ক্যাভেণ্ডিস আর ওঁর শাশুড়ীর কথাবার্তার টুকরো অংশগুলো শুনে বা মেরী ক্যাভেণ্ডিস তদন্তের সময়ে যে অনেক কিছু গোপন করে গেছেন এটা দেখে। পোয়ারো আমাকে বুঝিয়ে বলল, ঝগড়াটা যদি অ্যালফ্রেডের সঙ্গে মিসেস ইঙ্গলথর্পের না হয়ে থাকে, যেটা অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প জোরের সঙ্গে অস্বীকার করেছেন–তাহলে সেটা হয়েছিল লরেন্স বা জানের সঙ্গে ওদের মা মিসেস ইঙ্গলথর্পের। এখন ঐ ঝগড়া যদি লরেন্সের সঙ্গে হয়ে থাকে তাহলে কিছু বলার নেই, কিন্তু যদি ঝগড়াটা জনের সঙ্গে হয়ে থাকে তাহলে মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের ঐ রকম ব্যবহারের একটা সুন্দর অর্থ পাওয়া যায়।
আমি বেশ জোরেই বলে উঠলাম ঝগড়াটা তাহলে সেদিন জনের সঙ্গে হয়েছিল।
পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল তার ধারণা তো তাই। পুলিশের আদালতে অভিযোগের বয়ান শোনা যাবে। পোয়ারো একটা অদ্ভুত কথা আমাকে শোনাল যে সে এ ব্যাপারে আর থাকছে না।
কথাটা শুনে আমি চমকে গেলাম। পোয়ারো বলল সরকারীভাবে এতে তার আর কিছু করণীয় নেই। শেষের সূত্রটা না পাওয়া পর্যন্ত সে আড়ালেই থাকতে চায়। এছাড়াও আরো একটা কারণ আছে। সেটা হল মিসেস ক্যাভেণ্ডিস যেন মনে করতে না পারেন যে তার স্বামীর বিরুদ্ধে সে কাজ করছে।
একথাটা শুনে আমার একটুও ভালো লাগল না। পোয়ারো আমাকে আশ্বস্ত করে বলল একটা প্রচণ্ড চালাক লোককে খুঁজে বের করতে হবে। জ্যাপ সব সূত্রই খুঁজে পেয়েছে। আর তাকে যদি সাক্ষ্য দিতে হয় তাহলে সেটা আসামীর পক্ষেই দেবে সে। আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। পোয়ারো বলতে লাগল যে সে এমন একটা সাক্ষ্য দিতে পারে যাতে অন্ততঃ একটা ব্যাপারে জনের নির্দোষিতা প্রমাণ হবে।
আমি সেটা কি জানতে চাইলাম। পোয়ারো বলল ঐ উইলটা জন ক্যাভেণ্ডিস নষ্ট করেনি।
পুলিশ আদালতের দৈনিক শুনানির বিরক্তিকরণ বিবরণ শুনতে শুনতে পাগল হওয়ার উপক্রম হল। যাই হোক শেষ পর্যন্ত জন আত্মসমর্থন করে নিজেকে নির্দোষ বলল। শেষে ওকে বিচারের জন্য উচ্চ আদালতে পাঠান হল।
সেপ্টেম্বর মাস এগিয়ে এল। আমরা সবাই মিলে লণ্ডনে চলে এলাম–মেরী কেনসিংটনে বাড়ি ভাড়া করলেন। পোয়ারোও আমাদের সঙ্গে রইল। আমার একটা চাকরি জুটে গেল যুদ্ধসংক্রান্ত অফিসে-সময় কেটে যেতে লাগল।
কিন্তু পোয়ারো অস্থির হয়ে পড়ল। শেষ সূত্রটা মনে হয় ও এখনও খুঁজে পায়নি।
১৫ই সেপ্টেম্বর জন ক্যাভেণ্ডিস ওল্ড বেইলীর আদালতের কাঠগড়ার এসে দাঁড়াল। জন নিজেকে নির্দোষ বলে জানাল।
জনের পক্ষ সমর্থন করতে লাগলেন বিখ্যাত আইনজ্ঞ স্যার আর্নেস্ট হেভীওয়েদার কে, সি.। সরকার পক্ষে রইলেন মিঃ ফিলিপস।
সরকার পক্ষের অভিযোগে জানান হল হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত ও পৈশাচিক। এক মাতৃসমা স্নেহশীলা সৎমাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করার ঘটনা এটা। শৈশব থেকেই ভদ্রমহিলা যাকে মানুষ করেছিলেন সেই-ই হত্যা করেছে। হত্যাকারী আর তার স্ত্রী স্টাইলসে দারুণ বিলাস ব্যাসনে বাস করছে–আর এসবই হয়েছে মৃতার দয়ায় আর সাহচর্যে।
এরপর সরকারী উকিল বললেন আসামী একজন দুশ্চরিত্র এবং অমিতব্যয়ী। বর্তমানে চূড়ান্ত অর্থকষ্টের মধ্যে সে পড়েছিল। গ্রামের একজন চাষীর স্ত্রী রেইকসের সঙ্গে তার গোপন অভিসারও চলছিল। কথাটা তার সম্মার কানে যেতেই তিনি তাকে চেপে ধরলে ঝগড়ার সূত্রপাত হয় মিসেস ইঙ্গলথর্প মারা যাওয়ার দিন বিকেলবেলা। ঐ ঝগড়ায় কিছু কিছু জানাও গেছে। এর আগের দিন আসামী গ্রামের এক ওষুধের দোকান থেকে ছদ্মবেশে স্ত্রিকনিন কেনে, সে মিঃ ইঙ্গলথর্পের ছদ্মবেশ নিয়েছিল। কারণ তার প্রতি আসামী খুবই ঈর্ষাপরায়ণ ছিল। মিঃ ইঙ্গলথর্প সৌভাগ্যবশতঃ কিছু অভেদ্য অজুহাত দেখাতে পেরেছেন।
সরকারী উকিল আরও জানালেন ১৭ই জুলাই ঝগড়ার পরেই মিসেস ইঙ্গলথর্প একটি নতুন উইল করেন। উইলটা পরদিন তাপচুল্লীর মধ্যে পোড়া অবস্থায় পাওয়া যায়। উইলটা পোড়ানো হলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে যে ঐ উইলটা মৃতা তার স্বামীর অনুকূলেই করেছিলেন। মিসেস ইঙ্গলথর্প বছর খানেক আগে আসামীর পক্ষেও একটা উইল করেছিলেন। সরকারী উকিল বললেন তিনি উপযুক্ত সাক্ষ্যের সাহায্যে প্রমাণ করবেন ঐ রাত্রে আসামীই তার সত্মাকে কফির কাপটা পৌঁছে দেয়, সেই সময় তার যথেষ্ট সুযোগ ছিল নতুন উইলটা নষ্ট করে ফেলার, কারণ তাহলে ওর পক্ষে করা পুরনো উইলটাই আইনসিদ্ধ থাকতে পারে। এই কথা বলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সরকারী উকিল মিঃ ফিলিপস আসন গ্রহণ করলেন।
করোনারের তদন্তের সময় যাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল এখনও তাদেরই ডাকা হল। ডঃ বরস্টিনও সাক্ষ্য দিলেন।
এবার স্যার আর্নেস্ট হেভীওয়েদার উঠে দাঁড়ালেন। ইনি আসামী পক্ষের উকিল। সারা ইংল্যাণ্ডেই ওঁর খুব সুনাম। তিনি মাত্র দুটি প্রশ্ন করলেন। বললেন, তিনি শুনেছেন স্ট্রিকনিন ওষুধ হিসাবে খুব দ্রুত কাজ করে। ডঃ বরস্টিন মাথা নেড়ে সায় দিলেন। এবার উকিল জানতে চাইলেন তাহলে এক্ষেত্রে এত দেরি হওয়ার কারণ কি হতে পারে। ডাঃ বরস্টিন বললেন তিনি জানেন না। এখানেই তাদের প্রশ্নোত্তরের পালা শেষ হল।
এরপর মিঃ মেস স্ট্রিকনিনের শিশিটা দেখে সনাক্ত করলেন। ঐ শিশিই মিঃ ইঙ্গলথর্পের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। মিঃ মেস একথাও জানালেন মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে তিনি দূর থেকেই দেখেছিলেন। কোনোদিন কথা বলেননি।
অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পপকে প্রশ্ন করা হলে তিনি স্ট্রিকনিন কেনার কথা দৃঢ় স্বরে অস্বীকার করলেন। স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার কথাও অস্বীকার করলেন। কয়েকজনের সাক্ষ্যে এটা সত্যি বলে জানা গেল। বাগানের মালীদেরও সাক্ষ্য নেওয়া হল। শেষ পর্যন্ত ডরকাসের ডাক পড়ল।
ডরকাস জেরার মুখে জানাল ঘরে যে কথাবার্তা সে শুনেছিল তা মিঃ ইসলথর্পেরই। কখনও সেটা জন বলেননি। কথাটা শুনে জনের মুখে যেন একটু দুঃখের হাসিই খেলে গেল।
আরও নানা প্রশ্নের পর মিঃ ফিলিপস ডরকাসকে জিজ্ঞাসা করলেন গত জুন মাসে পার্কসনের কাছ থেকে মিঃ লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের নামে কোনো পার্শেল এসেছিল কিনা।
ডরকাস মাথা নেড়ে বলল তার ঠিক মনে পড়ছে না। তবে জুন মাসে মিঃ লরেন্স বাইরে ছিলেন। এরকম ক্ষেত্রে কোনো পার্শেল এলে কি করা হয় জানতে চাইলে ডরকাস বলল মিঃ লরেন্সের ঘরে কোনো সময় রাখা হয় আবার কখনও ডাকে ওঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
উকিল জিজ্ঞাসা করলেন ডরকাসই পার্শেলগুলো পাঠায় কিনা। ডরকাস জানাল তার কাজ শুধুমাত্র পার্শেলগুলো টেবিলের ওপর রেখে দেওয়া। মিস হাওয়ার্ডই ওগুলো দেখেন।
এবার ইভিলিন হাওয়ার্ডের ডাক পড়ল। পার্শেলের ব্যাপারে জেরা করা হলে উনি জানালেন এত পার্শেল আসে যে কোনো বিশেষ পার্শেলের কথা বলা কঠিন।
এবার সরকারী উকিল একখণ্ড বাদামী কাগজ বের করলেন। কাগজটা সেদিন পোয়ারোর কাছে মিস হাওয়ার্ড দিয়েছিলেন। উকিল জিজ্ঞাসা করলেন মিস ওয়ার্ড কেন এটার খোঁজ করছিলেন। হাওয়ার্ড জানালেন বেলজিয়ান গোয়েন্দা মশাই অর্থাৎ পোয়ারো তাকে এটা খুঁজতে অনুরোধ করেছিলেন। উকিল এবার প্রশ্ন করলেন এটা কোথা থেকে তিনি খুঁজে পেয়েছেন। ইভি জানালেন একটা কাপড়ের আলমারীর মাথায় কাগজটা ছিল। আসামীর আলমারীর মাথায় সেটা পাওয়া গেছিল কিনা উকিল প্রশ্ন করলেন। ইভি মাথা নেড়ে সায় জানালেন।
এরপর নাটকের পোশাক সরবরাহকারী পার্কসন কোম্পানীর একজন কর্মচারীকে জেরা করা হল। জেরার উত্তরে লোকটা জানাল ২৯শে জুন তারিখে মিঃ লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের পাঠানো অনুরোধের উত্তরে ওরা একখণ্ড কালো দাড়ির গোছ ডাকে পাঠায়। সেই চিঠিটা ওরা রেখে দেয়নি।…খাতায় লেখা আছে। এল ক্যাভেণ্ডিস স্টাইলস কোর্ট এই ঠিকানাতে ওটা পাঠান হয়।
এবার ধীরে ধীরে স্যার আর্নেস্ট হেভী ওয়েদার উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন চিঠিটা কোথা থেকে লেখা হয়েছিল। ইভি জানালেন স্টাইলস কোর্ট থেকে। উকিল জিজ্ঞাসা করলেন যেখানে পার্শেল পাঠান হয় সেখান থেকে কিনা। ইভি মাথা নেড়ে সায় জানালেন। উকিল এবার জানতে চাইলেন ওখান থেকে চিঠিটা এসেছে কিনা। ইভি এবারও মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালেন।
হঠাৎ যেন মিঃ হেভীওয়েদার শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। জানতে চাইলেন ইভি এই কথাটা কি করে জানলেন। মিস হাওয়ার্ড আমতা আমতা করতে লাগলেন। হেভীওয়েদার জিজ্ঞাসা করলেন ইভি কিভাবে জানলেন যে চিঠিটা স্টাইলস কোর্ট থেকেই লেখা হয়েছিল। তিনি কি ডাকঘরের ছাপ দেখেছিলেন। ইভিলিন মাথা নেড়ে না বললেন। এবার উকিল বললেন ডাকঘরের ছাপ না দেখেই ইভিলিন বললেন ওটা স্টাইলস থেকে লেখা হয়েছিল ওটা তো যে কোনো জায়গা যেমন ওয়েলস্ থেকেও লেখা হতে পারে।
সাক্ষী শেষ পর্যন্ত কথাটা স্বীকার করতে বাধ্য হলে স্যার আর্নেস্ট হেভীওয়েদার জানালেন তার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।
এরপর পরিচারিকা এলিজাবেথ ওয়েলসকে ডাকা হল। জেরার উত্তরে সে জানাল শুতে যাওয়ার আগে ও বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। মিঃ ইঙ্গলথর্প দরজাটা ভেজিয়ে রাখতে বলেছিলেন সেটা ওর একেবারেই মনে ছিল না। পরে মনে পড়লে সে নিচে নেমে আসতেই একটা শব্দ শুনে বারান্দার দিকে তাকায়। মিঃ জন ক্যাভেণ্ডিস তখন মিসেস ইঙ্গলথর্পের দরজায় টোকা দিচ্ছিলেন।
স্যার আর্নেস্টের এই জেরার মুখে অবশ্য পরিচারিকা ওয়েলস বেশ ঘাবড়ে গেল। ওর অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে স্যার আর্নেস্টের মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল। এরপর অ্যানীর সাক্ষ্যও নেওয়া হল। ওই জনকে কফি নিয়ে যেতে দেখেছিল।
সেদিন এখানেই শুনানী মুলতুবি রাখা হল পরের দিনের জন্য।
বাড়ি ফেরার পথে মেরী ক্যাভেণ্ডিস সরকারী উকিলের সমালোচনা করতে লাগল। আমি তাকে সান্ত্বনা জানিয়ে বললাম পরদিন আবার অন্য রকম হয়ে যাবে।
আমি নিজেই ঘটনার গতি দেখে আশ্চর্য হয়ে পড়লাম। পোয়ারোর সঙ্গে দেখা হতেই তাকে জিজ্ঞাসা করলাম স্যার আর্নেস্টের উদ্দেশ্য কি, তিনি কি লরেন্সকে দোষী মনে করছেন?
পোয়ারো বলল আর্নেস্ট যে বিশেষ কিছু মনে ভেবেছেন তা নয়। আসলে উনি জুরীদের মনের মধ্যে একটা এলেমেলো ভাব আনতে চাইছেন যাতে ওরা কিছুতেই একমত হতে না পারেন। উনি বোঝাতে চাইছেন জনের চেয়ে লরেন্সের বিরুদ্ধেও প্রমাণ নেহাত কম নয়।
পরদিন শুনানী আরম্ভ হতেই ইনসপেক্টর জ্যাপকে ডাকা হল। নানা কথার পর জ্যাপ জানালেন খবর অনুযায়ী তিনি ও সুপারিনটেনডেন্ট সামারহে আসামীর ঘর থানাতল্লাশি করেন। আসামী তখন বাড়িতে অনুপস্থিত ছিলেন। একটা আলামারীর মধ্যে পোশাকের নিচে মিঃ ইঙ্গলথর্পের চশমার মত একটা সোনার ফ্রেমে আঁটা পাঁশনে খুঁজে পান। সেটা আদালতে দাখিল করা হয়েছে। আর তিনি একটা শিশিও খুঁজে পান।
শিশিটা আগেই সনাক্ত করা হয়েছিল ওটার গায়ে লেবেলে লেখা ছিল স্ট্রিকনিন হাইড্রোক্লোরাইড-বিষ।
একটা নতুন প্রমাণ আদালতে উপস্থিত করা হল। পুলিশের গোয়েন্দারাই এটা আবিষ্কার করেছেন, জিনিসটা হল একখণ্ড নতুন ব্লটিং কাগজ। কাগজটা মিসেস ইঙ্গলথর্পের চেক বইয়ের মধ্যে পাওয়া গেছে। একটা আয়নার সামনে উল্টে ধরতেই লেখাগুলো পড়া গেছে…মার যা কিছু আছে সবই আমার স্বামী অ্যালফ্রেড ইঙ্গ…এই লেখাটা দেখেই বোঝা যায় মৃতা তার সব কিছু তার স্বামীকে উইল করে গেছেন।
এরপর ইনসপেক্টর জ্যাপ পোড়া উইলের টুকরোটা আর সিন্দুকে রাখা দাড়ির গোছাটা আদালতে পেশ করলেন।
এরপর স্যার আর্নেস্ট হেভীওয়েদার উঠে দাঁড়ালেন। তিনি প্রশ্ন করলেন আসামীর ঘর যেদিন থানাতল্লাশী করা হয়েছিল সেদিন কি বার ছিল। ইনসপেক্টর জানালেন দিনটা ছিল মঙ্গলবার, ২৪শে জুলাই। স্যার আর্নেস্ট বললেন তাহলে দুর্ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ পরে থানাতল্লাশী চালান হয়েছিল।
স্যার আর্নেস্ট প্রশ্ন করলেন ইনসপেক্টরের মাথায় কি এই কথাটা একবারও আসেনি যে আসামী নিশ্চয়ই এরকম একটা মারত্মক প্রমাণ সরিয়ে না ফেলে কখনও খুঁজে পাবার জন্য রাখতে পারে না, তাও আবার একটা খোলা দেরাজের মধ্যে।
ইন্সপেক্টর বললেন হয়ত আসামী তাড়াহুড়োতে এটা করেছিল।
স্যার আর্নেস্ট বললেন ইনসপেক্টরের কথানুসারে খুনের পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে। সুতরাং আসামী ঐ প্রমাণ সরিয়ে ফেলার বা নষ্ট করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিল।
ইনসপেক্টর মাথা নেড়ে সায় জানালেন।
এরপর স্যার আর্নেস্ট প্রশ্ন করলেন যে পোশাকের নিচে শিশিটা পাওয়া গেছিল সেগুলো ভারী পোশাক না হাল্কা। ইনসপেক্টর জানালেন সামান্য ভারী। স্যার আর্নেস্ট বললেন তাহলে পোশাকগুলো শীতকালের উপযোগী। গ্রীষ্মকালের একটা প্রচণ্ড গরমের দিনে আসামীর পক্ষে ঐ শীতের পোশাক ভর্তি দেরাজে হাত দেওয়া সম্ভব নয়। ইনসপেক্টর মাথা নাড়লেন।
এবার আর্নেস্ট বললেন এরকমও তো হতে পারে যে অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তি ঐ শিশিটা আসামীর অজান্তে ওখানে রাখতে পারে। ইনসপেক্টর বললেন তার এরকম মনে হয় না। আর্নেস্ট বললেন এরূপ সম্ভাবনাকে তো অস্বীকার করা যায় না। ইনসপেক্টর বললেন হতে পারে। স্যার আর্নেস্ট বললেন তার আর কোনো জিজ্ঞাসা নেই।
এরপর আরও সাক্ষ্য নেওয়া হল। আসামীর অর্থকষ্ট চরমে উঠেছিল একথাও বলা হল। মিসেস রেইকসের সঙ্গে আসামীর অন্তরঙ্গতার বিবরণও দেওয়া হল।
এবার লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের কাঠগড়ায় দাঁড় করান হল। মিঃ ফিলিপসের জেরার উত্তরে লরেন্স বলল পার্কসন কোম্পানীকে ২৯শে জুন সে কোনো বায়না দেয়নি। কারণ ঐ সময় সে ওয়েলসে ছিল।
স্যার আর্নেস্ট এরপর অন্য প্রসঙ্গে গেলেন, জানতে চাইলেন গত ১৭ই জুলাই তারিখে লরেন্স তার এক বন্ধুর সঙ্গে ট্যাডমিনস্টারের রেড ক্রস হাসপাতালের ডাক্তারখানা দেখতে গেছিলেন কিনা। লরেন্স মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন। স্যার আর্নেস্ট জিজ্ঞাসা করলেন লরেন্স যখন কিছুক্ষণের জন্য একাকী ছিলেন তখন কি, বিষ রাখার আলমারী খুলে তিনি কোনো বোতল পরীক্ষা করছিলেন? লরেন্স একটু আমতা আমতা করতে লাগলেন। স্যার আর্নেস্ট এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটা ছুঁড়লেন, জানতে চাইলেন লরেন্স একটা বিশেষ বোতল পরীক্ষা করছিলেন কিনা। লরেন্স বললেন তিনি তা করেননি। স্যার আর্নেস্ট জানতে চাইলেন তাহলে একটা বিশেষ বোতলে তার হাতের ছাপ এল কিভাবে।
লরেন্স বলল তার ধারণা কোনো এক সময় সে হয়ত বা বোতলটা ধরেছিল। আর্নেস্ট বললেন বোতল থেকে হয়ত তিনি কিছু বের করেছেন। লরেন্স মাথা নেড়ে অস্বীকার করলেন। আর্নেস্ট বললেন তাহলে লরেন্স বোতলটা কেন হাতে নিয়েছিলেন।
লরেন্স বললেন তিনি একসময় ডাক্তারী পড়তেন। তাই ওগুলোর প্রতি তার একটা স্বাভাবিক আগ্রহ আছে। স্যার আর্নেস্ট ব্যঙ্গ করে বললেন ঐ দিন বিকালে লরেন্স অল্প সময়ের জন্য একা হওয়া মাত্রই তার বিশেষ আগ্রহটা চরিতার্থ করেন। আর আগ্রহের বিষয়টাও হল চমৎকার–স্ট্রিকনিন হাইড্রোক্লোরাইড।
লরেন্স কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
স্যার আর্নেস্টের মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল। তিনি বললেন তার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।
জেরার অবস্থা দেখে সারা আদালতেই একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। বিচারক সকলকে শান্ত হতে বললেন, না হলে আদালত কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হবে বলে জানালেন।
এরপর সাক্ষ্য নেওয়ার বিশেষ কিছুই রইল না। হাতের লেখা বিশেষজ্ঞরা এরপর রায় দিলেন ডাক্তারখানার খাতার পাতায় মিঃ অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পের যে সই আছে সেটা ওঁর নয়। লেখাটা আসামীরও হতে পারে। তবে মনে হয় লেখাটা কৌশলে গোপন করা হয়েছে। এ বিষয়ে সঠিক মতামত দেওয়া কঠিন।
স্যার আর্নেস্ট হেভীওয়েদার এবার আসামী পক্ষ সমর্থন করে খুব স্বল্প কথায় তার বক্তব্য জানালেন। বললেন, এরকম বিচিত্র ঘটনা তিনি কখনও দেখেননি। সাক্ষ্য প্রমাণগুলো সবই সম্পূর্ণ অবস্থাঘটিত। স্ট্রিকনিনের শিশিটার বিষয় ধরলে দেখা যায় ওটা আসামীর পক্ষে অজানা থাকাই স্বাভাবিক। দেরাজটা সবসময় ভোলা থাকত, সুতরাং অন্য যে কোনো অত্যন্ত শয়তান প্রকৃতির তৃতীয় ব্যক্তির পক্ষেই ওটা ওখানে রাখা সম্ভব। তার উদ্দেশ্য খুনের দায় আসামীর ওপর চাপানো। অভিযোগকারী আইনজ্ঞ এমন কোনো প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি যে আসামী পার্কসন কোম্পানীর কাছ থেকে ঐ দাড়ি আনিয়েছিল। মৃতার সঙ্গে আসামীর ঝগড়ার ব্যাপারটা সকলেই স্বীকার করেছেন বটে, তবে ঐ ব্যাপারটা এবং আসামীর অর্থকষ্টের কথাটা দুটোই অত্যন্ত অতিরঞ্জিত করেই বলা হয়েছে।
স্যার আর্নেস্ট এবার তাচ্ছিল্যভাবে সরকারী উকিলের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন যে মিঃ ফিলিপস বলেছেন আসামী যদি নিরপরাধ হয়ে থাকে তাহলে তদন্তের সময়ই তার বলা উচিৎ ছিল যে ঝগড়াটা মৃতার সঙ্গে তারই হয়েছিল–মিঃ ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে নয়। আসল ব্যাপারটা ভুল বোঝান হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিল তা ছিল আসামী মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শুনতে পায় মিঃ আর মিসেস ইঙ্গলথর্পের মধ্যে খুব ঝগড়া হয়ে গেছে। আসামী নিশ্চয়ই ধারণা করেনি যে ওর গলাকে কেউ মিঃ ইসলথর্পের গলা বলে ভাবতে পারে। স্বভাবতই আসামী ভাবে তার মার সাথে সত্যি সত্যি ইঙ্গলথর্পের ঝগড়া হয়েছে।
অভিযোগকারী বলেছেন ১৬ই জুলাই, সোমবার গ্রামের এক ডাক্তারখানা থেকে আসামী মিঃ ইঙ্গলথর্পের ছদ্মবেশে স্ট্রিকনিন কেনে। প্রকৃতপক্ষে সেই সময় আসামী জনমানবশূন্য স্থান মারস্টনস্পিনেতে ছিল। আসামীকে কেউ ভয় দেখিয়ে ওখানে যাবার জন্য চিরকুট পাঠিয়েছিল–না গেলে কিছু গোপনীয় ব্যাপার তার স্ত্রীকে জানান হবে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। আসামী সেই অনুসারে ঐ জায়গায় উপস্থিত হয়ে আধঘণ্টা অপেক্ষা করে কিন্তু কাউকে দেখতে না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসে। দুর্ভাগ্যবশতঃ পথে কারও সঙ্গে আসামীর দেখা হয়নি। তবে চিরকুটটা আসামীর কাছে আছে যা প্রমাণ হিসাবে দাখিল করা হবে।
এরপর স্যার আর্নেস্ট বললেন উইলটা নষ্ট করার ব্যাপারে বোধ হয় এটুকু বলাই যথেষ্ট যে আসামী নিজেও এককালে আইনজ্ঞ হিসাবে কাজ করেছেন সুতরাং তিনি অবশ্যই জানেন যে তার সম্মার পুনর্বিবাহের ফলে আগের উইলটা স্বভাবতই নাকচ হয়ে গেছে। সাক্ষ্য প্রমাণের সাহায্যে এটাও প্রমাণ করা যাবে যে উইলটা নষ্ট করেছে অন্য কেউ আর এর দ্বারাই ঘটনার মোড় অন্যদিকে ফিরবে।
জুরীদের দিকে তাকিয়ে স্যার আর্নেস্ট বললেন জন ক্যাভেণ্ডিস ছাড়াও অন্য আরও অনেকের বিরুদ্ধেই প্রমাণ আছে বিশেষতঃ লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের বিরুদ্ধে কোনো অংশে তার ভাইয়ের চেয়ে কম প্রমাণ নেই।
এবার স্যার আর্নেস্ট জনের সাক্ষ্য নিতে চাইলেন। জন সাক্ষীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াল। জেরার মুখে জন চমৎকারভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করল। নিজের আর্থিক অনটনও সত্মার সঙ্গে মনোমালিন্যের কথা যেভাবে স্বীকার করল তাতে ফলটা ভালোই হল।
সাক্ষ্যের শেষে জন বলল একটা ব্যাপার পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। সে স্যার আর্নেস্টের অভিযোগের বিরুদ্ধে বলতে চায় যে তার ভাই লরেন্স তার মতই নিরপরাধ।
কথাটা শুনে স্যার আর্নেস্ট শুধুমাত্র হাসলেন। জুরীদের মনে কথাটা ভালো ধারণারই সৃষ্টি করেছে বলে মনে হল।
এবার সরকার পক্ষের জেরা শুরু হল।
মিঃ ফিলিপস আক্রমণ হানলেন অন্য দিকে থেকে, জিজ্ঞাসা করলেন। জন বেশ সুযোগ বুঝেই তাহলে চিরকুটটা দাখিল করেছেন। উকিল বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন ঐ হাতের লেখাটা জনের। তার ধারণা একটা অজুহাত তৈরি করার জন্য। জন নিজেই সেই চিরকুট লিখেছিলেন। জন বললো এ কাজ সে করেনি।
ফিলিপস বললেন তিনি চিরকুট, খাতা ও জনের হাতের লেখা কিছু নমুনা জুরীদের বিবেচনার জন্য দাখিল করছেন। মিঃ ফিলিপস একথা বলে বিজয়ীর ভঙ্গীতে আসন গ্রহণ করলেন।
সেদিনের মত আদালতে স্থগিত ঘোষিত হল।
পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখে একরাশ বিরক্তি আর চিন্তা। আমি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পেলাম না।
বাড়িতে পৌঁছতেই মেরী চা দিতে এলেন। পোয়ারো চা খেলো না। সে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। পোয়ারোর দুশ্চিন্তা তখনও কাটেনি দেখলাম। ও দেরাজ খুলে এক প্যাকেট তাস বের করল। তারপর টেবিলে বসে তাসের ঘর তৈরি করতে লাগল।
আমি অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। পোয়ারো আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেই বলল সে তার স্নায়ুগুলোকে স্থির করার জন্য তাসের বাড়ি বানাচ্ছে। আঙ্গুলগুলো স্থির হলেই মস্তিষ্কের অস্থিরতাও দূর হবে, তখন ঠিকমত চিন্তাভাবনা করা যাবে।
অবাক হয়ে পোয়ারোর তাসের ঘর তৈরি দেখতে লাগলাম। একের পর এক ঘরগুলো উঁচু হয়ে উঠতে লাগল। মনে হল যেন কোনো যাদুর খেলা দেখছি। আমি হঠাৎ বলে উঠলাম পোয়ারোর হাত দুটো তো বেশ স্থির হয়ে গেছে। অনেকদিন আগে একবার শুধু তার হাত কাঁপতে দেখেছিলাম।
পোয়ারো বলল, প্রচণ্ড রাগ হলেই তার হাত কাঁপে।
আমি বললাম, ঠিক তাই।মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে যখন নথীব্যাগটার তালাটা কেউ জোর করে খুলেছে বলে পোয়ারো বলেছিল, তখন তাপচুল্লীর তাকের উপর জিনিষগুলো গুছিয়ে রাখার সময় তার হাত ভীষণভাবে কঁপতে দেখেছিলাম।
আমার কথা মাঝপথেই থেমে গেল। পোয়ারো হঠাৎ খুব জোরে আর্তনাদ করে তাসের ঘরগুলো ভেঙে ফেলল। তারপর দুচোখে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়ল। আমি তার কি হয়েছে জানতে চাইলে পোয়ারো বলল তার একটা কথা মনে পড়েছে। আর সেটা নাকি আমি তাকে মনে পড়িয়ে দিয়েছি।
আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই পোয়ারো লাফিয়ে উঠল। দৌড়ে এসে আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরল, তারপর ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। আমি ছুটে জানলায় গিয়ে দেখলাম রাস্তা দিয়ে পোয়ারো আপন মনে বকবক করতে করতে ছুটছে। বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। রাত গড়িয়ে যেতে লাগল কিন্তু পোয়ারোর দেখা মিলল না।