গণেশ! কিরীটী ডাকে।
গণেশ নিঃশব্দে একপাশে ঘরের মধ্যেই তখনো দাঁড়িয়ে ছিল। গণেশ কিরীটীর ডাকে ফিরে তোকাল তার মুখের দিকে!
তুমি একবার নীচে যাও, গানের আসর থেকে জগদীন্দ্ৰ, মণীন্দ্র ও ফণীন্দ্রবাবুকে ডেকে নিয়ে এস।
কি বলব তাদের? গণেশ জিজ্ঞাসা করে।
কি বলবে? বল-বল-হ্যাঁ বল, তাদের বড়মার বিশেষ জরুরী ব্যাপার, তাদের ডাকছে। হ্যাঁ শোন, একসঙ্গে নয়, পাঁচ-ছ মিনিট পর পর এক একজনের কাছে গিয়ে কথাটা বলবে, বুঝলে?
আজ্ঞে।
যাও ওদের ডেকে দিয়ে সরকারমশাইকে ডেকে দেবে। সুরতিয়া, আপাতত তুমি এ ঘরে থাক।
গণেশ বের হয়ে গেল।
কিরীটী আবার জয়ন্তর দিকে ফিরে তাকাল।
মিস্টার চৌধুরী!
বলুন।
ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলুন পাশের ঘরে যাই, ওখানেই কথাবার্তা হবে। চলুন।
মৃতদেহ যেমন ছিল তেমনই পড়ে রইল, সুরতিয়াকে ঘরে রেখে দুজনে মধ্যবর্তী দরজার দিকে অগ্রসর হল।
ঘর ছেড়ে যাবার আগে কিরীটী আর একবার চিত্রাঙ্গদা দেবীর শয়ন—ঘরটার চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল।
নিভাঁজ শয্যা-বোঝা গেল সেরাত্রে খাটের ওপরে বেচারী শয়নেরও আর সুযোগ পাননি। ঘরের মেঝেতে কেবল খাটের কাছে দামী পুরু একটা কর্পেট বিছানো, বাকি মেঝেটা এমনি-আ-ঢাকা।
এক কোণে একটা বিরাট দু-পাল্লার আলমারি-সেকেলে সেগুন কাঠের তৈরী এবং কারুকার্য করা। তার পাশেই একটা গোলাকার বেশ বড় সাইজের শ্বেতপাথরের টপ টেবিল—টেবিলের ওপরে নানা টুকিটাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
উল্টোদিকে ঘরের সংলগ্ন বাথরুম।
কিরীটী ইতিমধ্যে বাতিরুমটাতে পরীক্ষা করে দেখছিল। বাথরুমের দরজা, যেটার বাইরের ঘোরানো লোহার সিঁড়ির সঙ্গে যোগাযোগ আছে, সেটা ভেতর থেকে বন্ধই ছিল। বাথরুমটাও বেশ প্রশস্ত। আগাগোড়া ইটালিয়ান গ্লেজটাইলের দেওয়াল-মেঝেও ইটালিয়ান মোজাকের। বাথটাব, শাওয়ার, বেসিন—সব ঝকঝকে তকতকে।
ঘরের মধ্যে শ্বেতপাথরের গোলাকার টেবিলটা ছাড়াও একটা মাঝারি আকারের টেবিল আছে। কিছু বই ও নানা ধরনের ফাইল খাতপত্র টেবিলের ওপরে সাজানো।
সামনে একটা দামী কুশন মোড়া চেয়ার। একটা আরাম-কেদারাও ধরের মধ্যে আছে। আর একটা লোহার দেওয়ালে গাঁথা সিন্দুক। সিন্দুকটার একেবারে গা থেকে শোবার খাটটা।
আগে আগে চলেছিল জয়ন্ত-পিছনে কিরীটী, হঠাৎ কিরীটীর নজরে পড়ে ঘরের মেঝেতে মধ্যবতী দরজার একেবারে গা থেকে কি একটা পড়ে আছে-চিকচিক করছে।
কিরীটী কুঁকে নীচু হয়ে জিনিসটা মেঝে থেকে তুলে নিল। রঙিন কাচের চুড়ির একটা ভাঙা টুকরো।
কি হল? জয়ন্ত ঘুরে দাঁড়ায়।
না, কিছু না। চলুন।
দুজনে এসে পাশের ঘরে ঢুকল।
সুধন্য একা একা ঘরের মধ্যে বসেছিল—ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকাল।
আমি নীচে যেতে পারি? সুধন্য জিজ্ঞাসা করে।
পালাবার চেষ্টা করবে না তো?
না।
তাহলে যাও। ডাকলেই যেন পাই।
হ্যাঁ, নীচে গেস্টরুমের পাশের ঘরেই আমি থাকব।
যাও তাহলে। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
সুধন্য ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মনে হল সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ওকে যেতে দিলেন মিস্টার রায়, যদি পালিয়ে যায়? জয়ন্ত চৌধুরী বলে কিরীটীকে।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, না, পালাবে না। তাছাড়া পালালে তো ক্ষতি নেই কিছু।
ক্ষতি নেই!
না। সুধন্য হত্যা করেনি।
কি করে বুঝলেন?
স্বর্ণডিম্বপ্রসূ হংসীকে হত্যা করবে নিজের হাতে, অন্তত এত বড় গদর্ভ সুধন্য নয়।
স্বর্ণডিম্বপ্রসূ হংসী!
হ্যাঁ-চিত্রাঙ্গদা দেবী তো ওর কাছে তাই ছিলেন। এলেই টাকা পেত-তা সে যে কারণেই হোক। আর সেই টাকাই যে ওর ভরসা, সেও আমি জানি।
কিন্তু—
না মিস্টার চৌধুরী, হত্যাকারী শুধু ক্ষিপ্ৰগতিসম্পন্নই নয়, অসম্ভব তার নার্ভ এবং বুদ্ধি। এবং তার হত্যার পিছনে বড় রকমের কোন মোটিভ রয়েছে জানবেন।
কিন্তু—
হ্যাঁ—আপাততঃ যা আমার মনে হচ্ছে, হত্যাকারী পূর্ব হইতে প্রস্তুত হয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র এতটুকুও দেরি করেনি। আর —সঙ্গে সঙ্গে চরম আঘাত হেনেছে, তারপর সরে পড়েছে।
বাইরে ওই সময় পদশব্দ পাওয়া গেল।
দেখুন তো কে এল!
জয়ন্তকে উঠে দেখতে হল না, থানার অফিসার মিঃ চৌবে ও চিত্রাঙ্গদা দেবীর সরকার যোগেন বা যোগীন মিত্র ঘরে এসে ঢুকল।
এই যে জয়ন্তবাবু,-যোগেন মিত্ৰই প্রথমে কথা বলে, কি ব্যাপার? আমাকে ডেকেছেন কেন? আর মিস্টার চৌবেই বা–
কথা বললে এবারে কিরীটী, প্রয়োজন ছিল মিত্রমশাই।
কি বলুন তো? একটু যেন বিস্মিত হয়েই যোগেন মিত্র কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
বিস্ময়ের তার কারণ ছিল, কারণ কিরীটীর সত্যি পরিচয়টা সে জানে না এখনো। অথচ এত রাত্রে এ ঘরে–
কিরীটী আবার বলে, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।
দুর্ঘটনা!
হ্যাঁ। মিসেস চৌধুরী অর্থাৎ আপনাদের রাণীমা—
কি-কি হয়েছে তার? ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করে যোগেন মিত্র।
তিনি খুন হয়েছেন।
সে কি!
হ্যাঁ।
কিরাটাই তখন সংক্ষেপে ব্যাপারটা বিবৃত করে।
চৌবেজী এবার বলে, কিন্তু আপনি কে?
এবারে জয়ন্ত তার পরিচয় দিল, উনি বিখ্যাত রহস্যসন্ধানী কিরীটী রায়।
সত্যি! নমস্তে—নমস্তে বাবুজী। চৌবেজীর কণ্ঠস্বর শ্রদ্ধায় একেবারে বিগলিত, কি সৌভাগ্য, আপনার দেখা পেলাম!
যোগেন মিত্র বলে, তাহলে আপনি যে বলেছিলেন জয়ন্তবাবু—
জয়ন্তবাবু তখন সংক্ষেপে কিরীটীর এখানে আসার ব্যাপারটা বলে গেল, বড়মার ইচ্ছাক্রমেই সব ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মৃতদেহ পরীক্ষা করল চৌবে।
চেয়ে বললে, তাজ্জব কি বাত— এইসা কেইসে হো সেকতা মেরে সমঝ মে নেহি আতা রায় সাহাব! আপকে রায় কেয়া হ্যায়?
কিরীটী বলে, যতদূর বুঝতে পারছি, আততায়ী মিসেস চৌধুরীর কোন অপরিচিত জন নন—কোন বাইরের লোকও নয়।
তব কৌন হো সেকতা?
সেটা এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না—সকলের সঙ্গে কথাবার্তা না বললে—
কিরীটীর কথা শেষ হল না, জগদীন্দ্ৰ প্ৰথমে ও তার পশ্চাতে মেজ মণীন্দ্র এসে ঘরে ঢুকল, এবং ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই যুগপৎ ওদের কণ্ঠ হতে একটা অস্ফুট আর্তচিৎকার নিৰ্গত হয়, এ কি!
তারপরই যেন দু ভাই বোবা হয়ে গেল। প্রস্তরমূর্তির মত ভূপতিত প্রাণহীন রক্তাক্ত দেহতার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
গানের আসর। তখনো ভাঙেনি। গানের সুর তখনো শোনা যাচ্ছে।
একপাশে সুরতিয়া তখনো পাথরের মত নিশ্চল দাঁড়িয়ে।
চৌবেজীই কথা বলে, চলিয়ে সাব, ও কামরামে চলিয়ে।
চৌবেজীর সঙ্গে সঙ্গে জগদীন্দ্ৰ, মণীন্দ্র, যোগেন মিত্র ও জয়ন্ত পাসের ঘরে চলে গেল। কিরীটী চৌবেজীকে সম্বোধন করে বললে, আপ যাইয়ে চৌবেজী, ম্যায় আতা হুঁ।