ঘুম ভাঙল।
অভ্যাসবশে তাকালাম ঘড়ির দিকে–নটা দশ বাজে। জানালার ভাঙা কাচ দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে-পায়ের কাছে। দেয়াল ক্যালেন্ডারে এপ্রিল মাস, তার মানে ফিরে এসেছি পৃথিবীতে। আমার চেনা জায়গা, চেনা জগৎ।
উঠে গিয়ে জানালা খুললাম। অস্পষ্টভাবে মনে হল বাইরের এই পৃথিবী একটু যেন অন্য রকম। সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন এত সূক্ষ্ম যে ঠিক ধরা যাচ্ছে না। অথচ রাস্তাঘাট আগের মতোই আছে। দোকানপাট একই রকম। তবুও কেন জানি আলাদা।
প্রকৃতি তার জগতে অনিয়ম সহ্য করে না, কথাটা বোধ হয় ঠিক। দ্বিতীয় আমির দেখা পেলাম না। নিজের ঘরেই রাত এগারোটা পর্যন্ত বসে রইলাম। কেউ এল না। দ্বিতীয় আমি বলে কেউ থাকলে এর মধ্যে এসে পড়ত। প্রকৃতি এই ভয়াবহ অনিয়ম হতে দেয় নি। নিজেকে কোনো এক ভাবে বদলে ফেলেছে।
রাত বারোটার দিকে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নিকিকে টেলিফোন করলাম। আমি জানি মাঝরাতে টেলিফোন পেয়ে সে প্রথমে খানিকটা কপট বিরক্তি দেখালেও শেষটায় প্রচণ্ড খুশি হবে। সব সময় তাই হয়।
অনেকক্ষণ রিং হবার পর নিকির ঘুমন্ত গলা শোনা গেল, কে?
আমি।
আমিটা কে?
আমাকে চিনতে পারছ না নিকি?
না।
আমি আমার নাম বললাম। নিকি কঠিন স্বরে বলল, এখন চিনতে পারছি। কেন আপনি রাতদুপুরে বিরক্ত করেন?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। নিকি এসব কী বলছে!
হ্যালো নিকি?
আর একটি কথাও নয়। আর একটি কথা বললে আমি পুলিশে খবর দেব। শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা? আপনার যন্ত্রণা অনেক সহ্য করেছি।
আমি শুনলাম ঘুম জড়ান এক পুরুষ-কণ্ঠ বলছে, কে কথা বলছে নিকি? নিকি বলল, ঐ বদমাশটা। আবার রাতদুপুরে ফোন।
নিকি টেলিফোন নামিয়ে রাখল। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। প্ৰকৃতি তার জগতে অনিয়ম সহ্য করে না। প্রয়োজনে পুরো জগতটা বদলে দেয়। তাই সে করেছে।
সারা রাত আমার ঘুম হল না। ভোর বেলায় ত্রিভুজ চিহ্ন দেয়া চিঠি পেলাম।
জনাব,
আপনাকে অবিলম্বে মুহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সপ্তম শাখায় উপস্থিত হতে বলা হচ্ছে। অত্যন্ত জরুরি।
বিনীত
এস. মাথুর ডিরেক্টর,
মহাশূন্য গবেষণা কেন্দ্র-৭
আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। ভয়াবহ চক্রের ব্যাপারটি এখন বুঝতে পারছি। জুন মাসের ৩০ তারিখে আমি রওনা হব মহাকাশযানে। আবার ফিরে আসব এই পৃথিবীতে। এসে দেখব এপ্রিল মাস। দুমাস কাটবে, আবার আসবে জুন মাস মহাকাশযানে করে রওনা হব, আবার ফিরে আসব। অযুত নিযুত লক্ষ কোটি বছর ধরে এই চক্র চলতেই থাকবে। প্রকৃতি তার জগতের নিয়ম ভঙ্গকারীকে এমনি করেই শাস্তি দেবে।
চিঠি হাতে আমি রাস্তায় নেমে এলাম। বারবার ইচ্ছা হচ্ছে লাফিয়ে কোনো একটা দ্রুতগামী বাসের সামনে পড়ে যাই। চক্ৰ ভাঙার এই একটিমাত্রই পথ। তা অবশ্য করলাম না। হেঁটে হেঁটে উপস্থিত হলাম নিকির ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। সে এগোন গায়ে দিয়ে টিনের কৌটা সাজাচ্ছিল। আমাকে দেখতেই চিনতে পারল। কঠিন মুখে বলল, আবার জ্বালাতে এসেছেন? আপনার কাও কিছু বুঝি না, প্রতি বছর এপ্রিল মাসে রাত বারোটায় একবার টেলিফোন করবেন, তার পরদিন আসবেন দেখা করতে। বাকি বছরে আর আপনার কোনো খোঁজ নেই? কে আপনি বলুন তো?
আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, আমি কেউ না। তোমার সঙ্গে আগামী বছর আবার দেখা হবে।
ফিরে যেতে যেতে মনে হল–ভয়াবহ চক্রে শুধু যে আমি একা আটকা পড়েছি তাই নয়, এই পৃথিবীর সবাই আটকা পড়েছে। অনন্তকাল ধরে নিকিকে এপ্রিল মাসের এক রাতে টেলিফোন পেয়ে জেগে উঠতে হবে। অনন্তকাল ধরে এই পৃথিবী থেকে একটি মহাকাশযান জুন মাসের ৩০ তারিখ যাত্রা শুরু করবে অনন্ত নক্ষত্ৰবীথির দিকে। কোন দিন যা কোথাও পৌছবে না।