উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

১১. গজেশ্বরের পাল্লায়

গজেশ্বরের পাল্লায়

অজ্ঞান হয়ে থাকাটা মন্দ নয়—যতক্ষণ কাঠপিঁপড়েতে না কামড়ায়। আর যদি একসঙ্গে একঝাঁক পিঁপড়ে কামড়াতে শুরু করে তখন? অজ্ঞান তো দূরের কথা, মরা মানুষ পর্যন্ত তিড়িং করে লাঝিয়ে ওঠে।

আমিও লাফ মেরে উঠে বসলুম।

কেমন আবছা-আবছা অন্ধকার গোড়াতে কিছু ভালো বোঝা গেল না। চোখে ধোঁয়া-ধোঁয়া ঠেকছিল। খামকা বাঁকানের ওপর কটাৎ করে আর-একটা কাঠপিঁপড়ের কামড়।

বাপ রেবলে আমি কান থেকে পিঁপড়েটা টেনে নামালাম।

আর ঠিক তক্ষণাৎ কটকটে ব্যাঙের মতো আওয়াজ করে কে যেন হেসে উঠল। তারপর, ঘোড়ার নাকের ভেতর থেকে যেমন শব্দ হয় তেমনি করে কে যেন বললে, কাঠপিঁপড়ের কামড় খেয়ে বাপ রে বাপ রে বলছ, এর পরে যখন ভীমরুলে কামড়াবে, তখন যে মেসোমশাই-মেসোমশাই বলে ডাক ছাড়তে হবে।

তাকিয়ে দেখি–

ঠিক হাত দুয়েক দূরে একটা মুশকো জোয়ান ভাম-বেড়ালের মতো থাবা পেতে বসে আছে। কথাটা বলে সে আবার কটকটে ব্যাঙের মতো শব্দ করে হাসল।

আমার তখন সব কিরকম গোলমাল ঠেকছিল। বললুম, আমি কোথায়?

আমি কোথায়—লোকটা একরাশ বিচ্ছিরি বড় বড় দাঁত বের করে আমায় ভেংচে দিলে। তারপর ঝগড়াটে প্যাঁচার মতো খ্যাঁচখেচিয়ে বললে, আহা-হা, ন্যাকা আর কি। যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। হঠাৎ ওপর থেকে দুড়ুম করে পাকা তালের মতো আমার পিঠের ওপর এসে নামলে, আর এখন সোনামুখ করে বলছ আমি কোথায়? ইয়ার্কির আর জায়গা পাওনি?

আমার সব মনে পড়ে গেল। সেই পাকা কামরাঙা-গুটি গুটি পায়ে সেদিকে এগোনো, গোবরে পা পিছলে–পড়া তারপরে–

আমি হাঁউ-মাউ করে বললুম, তবে কি আমি দস্যু ঘচাং ফুঃ আচ্ছায় এসে পড়েছি?

—ঘচাঃ ফুঃ? সে আবার কী?বলেই লোকটা সামলে নিল : হ্যাঁ–হ্যাঁ, ঠিক বটে। বাবাজী অমনি একটা কী লিখেছিল বটে চিঠিতে।

বাবাজী? কে বাবাজী?

একটু পরেই টের পাবে। —লোকটা দাঁত খেচিয়ে বললে, চালাকি পেয়েছ? এত করে চলে যেতে বললুমভূতের ভয় দেখানো হল সারা রাত মশার কামড় খেয়ে ঝোপের মধ্যে বসে মড়ার মাথা-ফাতা ছুঁড়লুম-অট্টহাসি হেসে-হেসে গলা ব্যথা হয়ে গেল—তবু তোমাদের। গেরাহ্যি হয় না? দাঁড়াও এবার! একটাকে ভোগা দিয়ে এনেছি তুমিও এসে ফাঁদে পড়েছ; এবার তোমায় শিককাবাব বানিয়ে খাব!

—অ্যাঁ—শিককাবাব!

—ইচ্ছে হলে আলুকাবলিও বানাতে পারি। কিংবা ফাউল কাটলেট। চপও করা যায় বোধহয়। কিন্তু লোকটা চিন্তিতভাবে একবার মাথা চুলকাল, কিন্তু তোমাদের কি খাওয়া যাবে? এ-পর্যন্ত অনেক ছোকরা আমি দেখেছি, কিন্তু তোমাদের মতো অখাদ্য জীব কখনও দেখিনি।

শুনে আমার কেমন ভরসা হল। মরতেই তো বসেছি—তবু একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি।

বললুম, সেকথা ভালো! আমাদের খেয়ো না—অন্তত আমাকে তো নয়ই। খেলেও হজম করতে পারবে না। কলেরা হতে পারে, গায়ে চুলকুনি হতে পারে, ডিপথিরিয়া হতে পারে—এমনকি সর্দি-গর্মি হওয়াও আশ্চর্য নয়!

লোকটা বললে, থামো ছোকরা—বেশি বকবক কোরো না। আপাতত তোমায় নিয়ে যাব। ঠাণ্ডী গারদে—তোমার দোস্ত হাবুল সেনের কাছে। সেইখানেই থাকো এখন। ইতিমধ্যে বাবাজী ফিরে আসুন, তোমার বাকি দুটো দোস্তকেও পাকড়াও করিতারপর ঠিক করা যাবে তোমাদের দিয়ে মোগলাই পরোটা বানানো হবেনা ডিমের হালুয়া।

আমি বললুম, দোহাই বাবা, আমাকে খেয়ে না খেয়ে কিছু সুখ পাবে না–তা বলে। দিচ্ছি। আমি পালাজ্বরে ভুগি আর পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খাই কিছু রসকস নেই। আমাদের অঙ্কের মাস্টার গোপীবাবু বলেন, আমি যমের অরুচি। আমাকে খেয়ে বেঘোরে মারা যাবে বাবা ঘচাং ফুঃ—

লোকটা রেগে বললে, আরে দেখে দাও তোমার ঘচাং ফুঘচাং ফুঃর নিকুচি করেছে। কেন বাপু, রাঁচির গাড়িতে বসে গুরুদেবের রসগোল্লা আর মিহিদানা খাওয়ার সময় মনে ছিল না? তাঁর যোগসর্পের হাঁড়ি সাবাড় করার সময় বুঝি একথা খেয়াল ছিল না যে আমাদেরও দিন আসতে পারে? নেহাত মুরি স্টেশনে কলার খোসায় পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলুম–নইলে—

আমি ততক্ষণে হাঁ হয়ে গেছি। আমার চোখ দুটো ছানাবড়া নয়—একেবারে ছানার ডালনা!

-অ্যাঁ, তা হলে তুমি—

চিনেছ এতক্ষণে? আমি গুরুদেবের অধম শিষ্য গজের গাড়ুই।

—অ্যাঁ।

গজেশ্বর মিটমিট করে হেসে বললে, ভেবেছিলে মুরি স্টেশন পার হয়ে গাড়ি চলে গেল, আর তোমরাও পার পেলে। আমরা যে তার পরের গাড়িতেই চলে এসেছি, সেটা তো আর টের পাওনি! এবারে বুঝবে কত ধানে কত চাল হয়।

ভয়ে আমার বুকের রক্ত জল হয়ে গেল। বেশ বুঝতে পারলুম, পটলডাঙার প্যালারামের এবার বারোটা বেজে গেছে—ওই গজের ব্যাটা এবার আমায় নির্ঘাত সামী কাবাব বানিয়ে খাবে। নেহাত যখন মরবই, তখন ভয় করে কী হবে? বরং গজেশ্বরের সঙ্গে একটু ভালো করে আলাপ করি।

—কিন্তু তোমরা এখানে কেন? ক্যাবলার মেসোমশাইয়ের বাংলোতে তোমাদের কী দরকার? এমন করে পাহাড়ের গর্তের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছই বা কী জন্যে? আর যদি বসেই থাকো—গর্তের মধ্যে একতাল অত্যন্ত বাজে গোবর রেখে দিয়েছ কেন?

গজেশ্বর বিরক্ত হয়ে বললে, গোবর কি আমরা রেখেছি নাকি? রেখেছে গোরুতে। তোমাদের মত গোবর-গণেশ তাতে পা দিয়ে সুড়ৎ করে পিছলে পড়বে—সেইজন্যেই বোধহয়।

—সে তো হল কিন্তু আমাদের তাড়াতে চাও কেন? এবাড়িতে তোমাদের কী দরকার?

—অত কথা দিয়ে তোমার কাজ কী হে চিংড়িমাছ? এখনও নাক টিপলে দুধ বেরোয়-ও-সব খবরে তোমার কী হবে?ব্যাজার মুখে গজেশ্বর একটা হাই তুলল।

আমাকে চিংড়িমাছ বলায় আমার ভীষণ রাগ হল। ডান কানের ওপর আর একটা কাঠপিঁপড়ে পুটুস করে ইনজেকশন দিচ্ছিল, উঃ করে সেটাকে টেনে ফেলে দিয়ে বললুম, আমাকে চপ-কাপলেট করে খেতে চাও খাও, কিন্তু খবরদার বলছি, চিংড়িমাছ বোলো না!

-কেন বলব না? চিংড়ির কাটলেট বলব! গজেশ্বর মিটিমিটি হাসল।

না, কক্ষনো বলবে না। আমি আরও রেগে গিয়ে বললুম, তা ছাড়া এখন আমার নাক টিপলে দুধ বেরোয় না। আমি দু-দুবার স্কুল ফাইন্যাল দিয়েছি।

ইঃ—স্কুল ফাইন্যাল দিয়েছে!—গজেশ্বর ট্যাঁক থেকে একটা বিড়ি বের করে ধরাল : আচ্ছা বলল তো–ক্যাটাক্লিজম মানে কী?

ক্যাটাক্লিজম? ক্যাটাক্লিজম? আমি নাক-টাক চুলকে বললুম, বেড়ালের বাচ্চা হবে বোধহয়?

বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে গজেশ্বর বললে, তোমার মুণ্ডু! আচ্ছা বলল তোসেনিগেম্বিয়ার রাজধানী কী?

বললুম, নিশ্চয় হনোলুলু? নাকি, ম্যাডাগাস্কার?

—ভুগোলকে একেবারে গোলগপ্পার মতো খেয়ে নিয়েছ দেখছি।—গজেশ্বর নাক বেঁকিয়ে বললে, আচ্ছা বলল দেখি, জাড্যাপ মানে কী? অনিকেত কাকে বলে?

কী বললে—অনিমেষ? অনিমেষ আমার মামাতো ভাই।

হয়েছে, আর বিদ্যে ফলিয়ে কাজ নেই। গজেশ্বর আবার ঝগড়াটে প্যাঁচার মতো খ্যাঁচখেচিয়ে বললে, স্কুল-ফাইন্যাল কেন—তুমি ছাত্রবৃত্তিও ফেল করবে। নাঃসত্যিই দেখছি তুমি একদম অখাদ্য! বোধহয় শুক্তো করে এক-আধটু খাওয়া যেতে পারে। এখন উঠে পড়ো।

—কোথায় যেতে হবে?

বললুম তো, ঠাণ্ডী গারদে। সেখানে তোমার ফ্রেন্ড হাবলু সেন রয়েছে তার সঙ্গেও মমালাকাত হবে। ওদিকে আবার গুরুদেব গেছেন দলবল নিয়ে একটুখানি বিষয়কর্মে, তিনিও ফিরে আসুন—তারপর দেখা যাক—

ইতিমধ্যে আমি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলুম। বিপদে পড়ে পটলডাঙার প্যালারামের মগজও এক-আধটু সাফ হয়ে এসেছে। কোথায় এসে পড়েছি সেটাও একটু ভালো করে জানা দরকার।

যতটা বোঝা গেল, হাত সাত-আষ্টেক নীচে পাহাড়ের গর্তের মধ্যে পড়েছি। যদি গজেশ্বরের পিঠের ওপর সোজা ধপাস করে না পড়তুম, তা হলে হাত-পা নির্ঘাত ভেঙে থেঁতলে যেত। যেখানে বসে আছি, সেটা একটা সুড়ঙ্গের মতো সামনের দিকে চলে গেছে। কোথায় গেছে কতটা গেছে বোঝা গেল না। তবে ওরই কোথাও ঠাণ্ডী গারদ আছে—সেইখানেই আপাতত বন্দি রয়েছে হাবুল সেন।

হাবুলের ব্যবস্থা পরে হবে কিন্তু আমি কি এখান থেকে পালাতে পারি না? কোনওমতেই না?

মাথার ওপর গোল কুয়ার মতো গর্তটা দেখা যাচ্ছে—যেখান দিয়ে আমি ভেতরে পড়েছি। লক্ষ্য করে আরও দেখলুম, গর্তের পাশ দিয়ে পাথরে পাথরে বেশ খাঁজকাটা মতো আছে। একটু চেষ্টা করলেই ঠকাৎ করে ওপরে–

এসব ভাবতে বোধহয় মিনিট দুই সময় লেগেছিল। এর মধ্যে বিড়িটা শেষ করেছে। গজেশ্বর মিটমিট করে তাকাচ্ছে আমার দিকে।

-বলি, মতলবটা কী হে? পালাবে? সে-গুড়ে বালি চাঁদ—স্রেফ বালি! বাঘের হাত থেকে ছাড়ান পেতে পারো, কিন্তু এই গজেশ্বর গাড়ইয়ের হাত থেকে তোমার আর নিস্তার নেই! তার ওপর তুমি আবার আমার গুরুদেবের দাড়ি ছিড়ে দিয়েছ—তোমার কপালে কী যে আছে—একটা যাচ্ছেতাই মুখ করে গজেশ্বর উঠে দাঁড়াল।

অ্যাঁ! তা হলে সেই তামাকখেকো ভূতুড়ে দাড়িটা স্বামী ঘুটঘুটানন্দের। স্বামীজীই তবে ঝোপের মধ্যে বসি আড়ি পাতছিলেন, আর আমি কাঠবেড়ালির ল্যাজ মনে করে সেই স্বর্গীয় দাড়ি–

আমি কাতর হয়ে বললুম, আমি কিন্তু ইচ্ছে করে দাড়ি ছিড়িনি। আমি ভেবেছিলুম–

—থাক—থাক! তুমি কী ভেবেছ তা আমার জেনে আর দরকার নেই। গালের ব্যথায় গুরুদেব দুঘণ্টা ছটফট করেছেন। তিনি ফিরে এলে—যাক সে কথা, ওঠো এখন–

গজেশ্বর হাতির শুড়ের মতো প্রকাণ্ড একটা হাত বাড়িয়ে আমায় পাকড়াও করতে যাচ্ছিল—হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল : বাপ রে গেলুম-আরে বাপ রে গেছি–

ততক্ষণে আমিও দেখেছি, কালো কটকটে একটা কাঁকড়া বিছে, গজেশ্বরের পায়ের কাছে তখনও দাঁড়া উঁচু করে যমদূতের মত খাড়া হয়ে আছে।

—গেলুম—গেলুম—ওরে বাবা–জ্বলে গেলুম—

বলতে বলতে সেই ষাঁড়ের মত জোয়ানটা মেঝের ওপর কুমড়োর মতো গড়াতে লাগল : গেছি—গেছি—একদম মেরে ফেলেছে—

আর আমি? এমন সুযোগ আর কি পাব? তক্ষুনি লাফিয়ে উঠে পাহাড়ের খাঁজে পা লাগালুম—এইবার এসপার কি ওসপার।