এজেন্ট দ্রুচান বলল, না, আমি এক ঘণ্টার ভেতর রওনা দিতে পারব না। এখনো সবগুলো কুলেন্ট টিউব ওয়েল্ড করে লাগানো হয়নি। সময় লাগবে।
রিদি গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, তাহলে আমাদের করার বিশেষ কিছু নেই। কনভয়টাকে মাঝখানে থামাতে হবে।
রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অস্ত্র নিয়ে আমরা মাত্র দুইজন। ক্রিটিনাকে ধরলে তিনজন। তাদের গাড়িই আছে চারটা। কিছু একটা করা যাবে বলে মনে হয় না।
রাস্তার ভালো একটা জায়গা দেখে এমবুশ করতে হবে। রিদি বলল, প্রথম গাড়িটা থামাতে পারলে অন্যগুলোও থেমে যাবে।
রুহান কোনো কথা না বলে অন্যমনস্কভাবে মাথা ঘুরিয়ে দূরের মানমন্দিরটার দিকে তাকাল। রিদি বলল, তাহলে দেরি করে কাজ নেই, চলো
এখনই বের হয়ে পড়ি।
রুহান বলল, আমি অন্য একটি কথা ভাবছিলাম।
কী কথা?
ঐ যে মানমন্দিরটা দেখছ, তার কাচগুলো তাপ প্রতিরোধক। সূর্যের আলোর ভেতর যেটুকু দৃশ্যমান সেটা ঢুকতে দেয় কিন্তু তাপের অংশটুকু প্রতিফলিত করে দেয়। আমরা এই কাচগুলো ব্যবহার করে একটা কাজ করতে পারি।
কী কাজ?
আমাদের মধ্যে প্রায় তিরিশজন ছেলে-মেয়ে আছে। সবার কাছে যদি একটা কাচ দিই তারা সেটা হাতে নিয়ে সূর্যের আলোটা প্রতিফলিত করে ঐ গাড়িগুলোর উপরে ফেলে তাহলে গাড়িগুলোতে আগুন ধরে যাবে। আমরা অনেক দূর থেকে গাড়িগুলো জ্বালিয়ে দিতে পারব।
রিদি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে বলল, সত্যি?
কয়েক হাজার বছর আগে আর্কিমিডিস নামে একজন বিজ্ঞানী এভাবে শত্রুদের জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
তুমিও সেটা করবে?
হ্যাঁ। একটু প্র্যাকটিস করতে হবে, কিন্তু আমার মনে হয় আমরা পারব। সবচেয়ে বড় কথা কাজটা করা যাবে গোপনে, তারা বুঝতেই পারবে না কী হচ্ছে।
রিদি বলল, ঠিক আছে, তাহলে দেরি করে লাভ নেই। কাজ শুরু করে দেয়া যাক।
মানমন্দিরের কাচগুলো খুলে নেয়ার কাজটুকু সহজ হলো না, কিন্তু কাচগুলো অক্ষত রেখে খোলারও প্রয়োজন ছিল না তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় বড় গোটা চল্লিশেক কাচ খুলে ফেলা হলো। সূর্যটা এতক্ষণে বেশ উপরে উঠে তার প্রখর আলোতে এখন যথেষ্ট উত্তাপ। বড় কাচগুলো দিয়ে তার প্রায় সবখানি প্রতিফলিত করা যায়।
এর মধ্যে ক্রিটিনা সবাইকে ডেকে এনেছে। তাদেরকে একটা জরুরি কাজ করতে হবে বলে সে সবাইকে একটা লম্বা সারিতে দাঁড়া করাল। সবাই উশখুশ। করছিল, রুহান হাত তুলে তাদের শান্ত করে বলল, আজ তোমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে হবে।
একজন জানতে চাইল, কী কাজ?
তোমরা সবাই নিশ্চয়ই অনুমান করেছ তোমাদের আবার ধরে নেবার জন্যে কিছু মানুষজন আসার কথা। বাজে মানুষ। খারাপ মানুষ। জঘন্য মানুষ।
সবাই মাথা নাড়ল। রুহান বলল, তারা আসছে।
সাথে সাথে সবার ভেতরে একটা আতঙ্কের ছাপ পড়ল। রুহান হাত ও বলল, তোমাদের ভয় পাবার কিছু নেই। সেই জঘন্য মানুষগুলোকে আমরা কাছে আসতে দেব না। দূর থেকে আমরা তাদের ধ্বংস করে দেব।
কীভাবে ধ্বংস করবে?
এই কাচগুলো দিয়ে। তোমরা সবাই নিশ্চয়ই কখনো না কখনো আয়না দিয়ে সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করেছ, দূরে কোথাও পাঠিয়েছ। তাই না?
সবাই মাথা নাড়ল। রুহান বলল, এখানেও তাই করবে, এই বড় কাচগুলো আয়নার মতো তবে–আলো নয় তাপকে প্রতিফলিত করে।
রুহান সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে গলা উঁচু করে বলল, আম সবাই যদি আলাদা আলাদাভাবে আয়নাগুলোকে দিয়ে এক জায়গায় সব তাপ কেন্দ্রীভূত করতে পারি, প্রচণ্ড তাপে সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠবে। তোমরা যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর এখনই সেটা পরীক্ষা করে দেখতে পার। আমি তোমাদের সবাইকে একটা করে কাচ দেব, তোমরা সূর্যের আলোকে এই কাচ দিয়ে প্রতিফলিত করে এক জায়গায় ফেলবে। পারবে না?
সবাই চিৎকার করে বলল, পারব।
চমৎকার! রুহান তখন পাশে সাজিয়ে রাখা কাচগুলো একজন একজনকে দিতে শুরু করে। চেষ্টা করা হয়েছে যথাসম্ভব বড় টুকরো দিতে, ভারী কাচগুলো নিচে রেখে সবাই দুই পাশে ধরে দাঁড়ায়। রুহান একপাশে সরে গিয়ে বলল, সাবধান, কারো যেন হাত না কাটে। ভাঙ্গা কাচ খুব ধারালো হয়।
সবাই মাথা নেড়ে জানাল তারা সবাধান থাকবে।
রুহান তখন বেশ খানিকটা দূরে একটা শুকনো গাছের গুড়ি দেখিয়ে বলল, সবাই চেষ্টা কর সূর্যের আলোটাকে এখানে প্রতিফলিত করতে। যখন প্রতিফলিত হবে তখন স্থিরভাবে ধরে রাখবে। ঠিক আছে?
সবাই মাথা নাড়ল।
চমৎকার! রুহান সামনে থেকে সরে গেল। বলল, শুরু কর।
ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে করতে হবে বুঝতে একটু সময় লাগল, সবাই তাদের কাচটা ঠিক করে ধরার চেষ্টা করতে থাকে। আলোটাকে গাছের গুড়িতে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করতে থাকে। যখন সবাই সূর্যের আলোকে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীভূত করতে পারল তখন গাছের গুড়িটা থেকে প্রথমে ধোঁয়া বের হতে থাকে তারপর হঠাৎ ধক করে আগুন ধরে ওঠে। সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে সাথে সাথে।
রুহান হাততালি দিয়ে বলল, চমৎকার! এসো, এবারে আরো দূরে কোথাও চেষ্টা করি।
দেখতে দেখতে সবাই ব্যাপারটা ধরে ফেলল, কোনো একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দিলে সবাই মিলে সেখানে আগুন ধরিয়ে দিতে পারছে। বেশ সহজেই।
রিদি প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করে নি যে এটা সম্ভব যখন দেখল সত্যি সত্যি সবাই মিলে অনেক দূরে একটা জায়গায় আগুন লাগিয়ে দিতে পারছে সে হতবাক হয়ে গেল। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এটি কেমন করে সম্ভব? কী। আশ্চর্য!
রুহান অবশ্যি কথাবার্তায় আর সময় নষ্ট করল না। রাস্তাটার পাশে পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় এই জনা ত্রিশেক ছেলেমেয়েদের সবার কাছে বড় একটা কাচের টুকরো দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। সবাই ঝোপঝাড়ের আড়ালে নিজেদের আড়াল করে রাখল, হঠাৎ করে তাকালেও যেন কাউকে দেখা না যায়।
গাড়িগুলোতে আগুন ধরানোর জন্যে সেগুলো থামানো দরকার। তাই রুহান আর রিদি মিলে পাহাড় থেকে বেশ কিছু বড় বড় পাথর গড়িয়ে রাস্তার উপর নামিয়ে নিয়ে এলো। দেখে মনে হয় পাহাড়ের উপর থেকে এমনি বুঝি গড়িয়ে নেমেছে। এ জায়গায় এসে পাথরগুলো সরানোর জন্যে গাড়ি থামিয়ে সবাইকে গাড়ি থেকে নামতেই হবে।
সবরকম প্রস্তুতি নিয়েও রুহান সন্তুষ্ট হলো না। রাস্তার পাশে বড় পাথরের আড়ালে অস্ত্র নিয়ে তারা নিজেরা লুকিয়ে রইল। যদি কোনোভাবে দলটা থামানো না যায় তখন গোলাগুলি করে থামাতে হবে! রাস্তার এক পাশে থাকল রুহান আর ক্রিটিনা, অন্য পাশে রইল রিদি। এবারে শুধু অপেক্ষা করা।
অপেক্ষা করতে করতে যখন সবাই অধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছেচে ঠিক তখন তারা পাহাড়ী রাস্তায় গাড়িগুলোর ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেল। পাহাড় রাস্তার ঠিক কোথায় আছে তার উপর নির্ভর করে শব্দটা হঠাৎ হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছিল আবার হঠাৎ করে কমে আসছিল। এক সময় শব্দটা একটা নিয়মিত শব্দে পরিণত হলো এবং ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর দূরে গাড়িগুলোকে দেখা যেতে লাগল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সেগুলো রাস্তায় পড়ে থাকা পাথরগুলোর সামনে এসে দাঁড়াল।
গাড়ির দরজা খুলে খুব সাবধানে একজন অস্ত্র হাতে নেমে আসে, সে সতর্ক চোখে চারদিকে দেখে অন্যদের নামতে ইঙ্গিত করল। অস্ত্র হাতে তখন বেশ অনেকগুলো মানুষ নেমে গাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে সতর্কভাবে এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। নেতাগোছের একজন বলল, কী মনে হয়? এটা কী কোন ট্রাপ?
অন্য একজন উত্তর করল, বুঝতে পারছি না। কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ করে রাস্তার মাঝে পাথর পড়ে আছে? আমার মনে হয় কেউ এনে রেখেছে।
সাবধান! দুইজনই কিন্তু খেলোয়াড়। মনে নাই এরা ক্ৰিভনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল!
সেটা অন্য ব্যাপার। এখন তার সাথে ত্রিশ পঁয়ত্রিশজন ছেলে-মেয়ে! আর যাই করুক এখন এরা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করবে না।
নেতাগোছের মানুষটি বলল, দেরি করে লাভ নেই। রাস্তা থে পাথরগুলো সরাও। অন্যেরা কভার দাও।
হঠাৎ একজন বলল, কী ব্যাপার এখানে এত গরম কেন?
হ্যাঁ! কী ব্যাপার? মানুষগুলো অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকায়। উত্তাপটুকু দেখতে দেখতে সহ্যের বাইরে চলে যায় তখন তারা যন্ত্রণায় ছটফট করে এদিকে সেদিকে ছুটতে শুরু করে।
রুহান, ক্রিটিনা আর রিদি নিঃশব্দে বসে থাকে। ছেলেমেয়েগুলো একজন একজন করে করে তাদের কাচ দিয়ে সূর্যের আলোর তাপ কেন্দ্রীভুত করতে শুরু করছে আর দেখতে দেখতে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তারা গাড়ির ইঞ্জিন থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখল এবং হঠাৎ করে একটা বিস্ফোরণ করে গাড়ির ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। দাউ দাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ল এবং মানুষগুলো চিৎকার করে ছুটে সরে যেতে থাকে। কীভাবে কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে কয়েকজন ইতস্তত গুলি করল কিন্তু তার কোনো প্রত্যুত্তর এলো না বলে নিজেরাই আবার অস্ত্র নামিয়ে নিল।
রুহান, ক্রিটিনা আর রিদি তাদের অস্ত্র তাক করে নিঃশপে বসে থাকে। শাইকে বলা আছে প্রথম গাড়িটা জ্বালিয়ে দিতে পারলে দ্বিতীয়টা এবং সেটা করতে পারলে তার পরেরটা জ্বালিয়ে দিতে হবে। ছেলেমেয়েগুলো সত্যি সত্যি দ্বিতীয়টাতেও আগুন ধরিয়ে দিল, তখন হঠাৎ করে পিছনের দুটো গাড়ি পিছনে সরে যেতে থাকে। অন্য মানুষগুলোকে গাড়িতে তুলে নিয়ে হঠাৎ করে গাড়িগুলো যে পথে এসেছিল সেই পথে ফিরে যেতে থাকে। পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সবাই যে যার জায়গায় লুকিয়ে রইল। গাড়িগুলোর ইঞ্জিনের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর প্রথমে রিদি এবং তার দেখাদেখি রুহান আর ক্রিটিনা পাথরের আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। তাদের দেখাদেখি অন্যেরাও তখন পাহাড় থেকে ছুটে নিচে নেমে আসতে থাকে। রাস্তার উপর দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা গাড়ি দুটো ঘিরে সবাই লাফালাফি করে আনন্দে চিৎকার করতে থাকে। সাধারণ একটা কাচের টুকরো দিয়ে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা এভাবে গাড়িগুলো জ্বলিয়ে সবাইকে তাড়িয়ে দিয়েছে এই বিষয়টা এখনো তারা বিশ্বাস করতে পারছে না।
ঘণ্টাদুয়েক পরে যখন আবার সবাই রওনা দিয়েছে তখন কারো ভেতরেই চাপা ভয় আর আতঙ্কটুকু নেই, নিজেদের ভেতরে তখন বিচিত্র এক ধরনের আত্মবিশ্বাস। লরির ভেতরে তারা হাততালি দিয়ে গান গাইতে থাকে। দেখতে দেখতে পাহাড়ী এলাকা পার হয়ে তারা একটা উপত্যকায় নেমে আসে, সেখান থেকে একটা নদীর তীর ধরে এগোতে থাকে। রাস্তা ভালো নয়, যেতে হচ্ছে খুব ধীরে ধীরে, যখন অন্ধকার হয়ে গেল তখন তারা রাত কাটানোর জন্যে এক জায়গায় থেমে গেল। নদীর পানিতে হাত মুখ ধুয়ে তারা কিছু শুকনো খাবার খেয়ে বিশ্রাম নেয়। এজেন্ট দ্রুচান তার লরির নিচে শুয়ে শুয়ে সেটা মেরামত করতে থাকে। রাত বিরেতে কী হয় কেউ জানে না, তাই রুহান, রিদি আর ক্রিটিনা পালা করে পাহারা দেবে বলে ঠিক করল। ভোর রাতের দিকে তার পালা শেষ করে শুতে গিয়েছে, চোখে একটু ঘুম নেমে এসেছিল হঠাৎ করে ক্রিটিনা তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, রুহান!
রুহান মুহূর্তে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে, কী হয়েছে?
একটা গাড়ি।
গাড়ি?
হ্যাঁ।
কোথায়? ক্রিটিনা অন্ধকারে হাত দিয়ে দেখায়, ঐ যে, আসছে?
রুহান আবছা অন্ধকারে গাড়িটাকে দেখতে পেল। হেড লাইট নিভিয়ে চুপি চুপি আসছে। মুহূর্তের মধ্যে ওরা প্রস্তুত হয়ে যায়। লরিটির পাশে আড়াল নিয়ে ওরা ওদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ট্রিগারে আঙ্গুল দিয়ে বসে থাকে।
গাড়িটি রাস্তার পাশে দাঁড়া করিয়ে রাখা লরিটির কাছাকাছি এসে থেমে গেল। দরজা খুলে জনা দশেক মানুষ নেমে আসে, আবছা অন্ধকারেও দেখা যায় মানুষগুলো সশস্ত্র। কাছাকাছি আসার পর রিদি হঠাৎ উচ্চস্বরে বলল, থাম।
মানুষগুলো থেমে গেল। রুহান বলল, তোমরা আমাদের অস্ত্রের আওতার ভেতর আছ, কোনোরকম বোকামী করতে চাইলেই কিন্তু মারা পড়বে।
অন্ধকারে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ভেতর থেকে একজন বলল, ভয় নেই। আমরা তোমাদের আক্রমণ করতে আসিনি।
তাহলে কী জন্যে এসেছ?
তোমাদের দলে যোগ দিতে এসেছি।
আমাদের দলে যোগ দিতে এসেছ?
হ্যাঁ।
রিদি আর রুহান প্রায় একই সাথে বিস্ময়ের এক ধরনের শব্দ করল। রুহান বলল, তোমরা কারা?
আমরা দক্ষিণের গ্রুজনীর দলের মানুষ।
রিদি তার হাতের আলো জ্বালায়, সেই আলোতে সামনে দাঁড়িয়ে। মানুষগুলোকে বেশ স্পষ্ট দেখা যায়। মানুষগুলোর বয়স খুব বেশি নয়, দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি ছাড়া সেখানে চোখে পড়ার মতো কিছু নেই। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা পাকা বাদামী চুলের একজন বলল, তোমরা দুজন নিশ্চয়ই রিদি আর রুহান?
রিদি আর রুহান মাথা নাড়ল, মানুষটি বলল, আমরা তোমাদের অনেক গল্প শুনেছি, তোমাদের দেখে খুব খুশি হলাম।
রিদি বলল, ঠিক কী গল্প শুনেছ জানি না! তবে আমরাও তোমাদের দেখে খুব খুশি হয়েছি।
রুহান বলল, এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলার প্রয়োজন নেই। তোমরা এসে বস। হাতের অস্ত্রগুলো ঐ গাছের উপর হেলান দিয়ে রাখতে পার।
বাদামী চুলের মানুষটি অস্ত্রটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, পুরো এলাকায় তোমাদের কথা সবাই জানে। আমার কী মনে হয় জান? আরো অনেকেই এখন তোমাদের সাথে যোগ দিতে আসবে।।
রিদি আর রুহান একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। বাদামী চুলের মানুষটি বলল, আমার মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি তোমরা শক্তিশালী একটা দল তৈরি করে ফেলতে পারবে। পার্বত্য এলাকার ওপাশে বিশাল একটা এলাকায় এখনো কেউ যায় নি। আমরা সবাই মিলে সে এলাকাটা আক্রমণ করতে পারি।
মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা একজন মানুষ তার গাল ঘষতে ঘষতে বলল, ঐ এলাকার মানুষগুলো খুব শক্ত সমর্থ। ধরে আনতে পারলে অনেক ইউনিটে বিক্রি করতে পারবে।
রিদি আর রুহান একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, রুহান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তাকে বাধা দিয়ে বাদামী চুলের মানুষটি বলল, প্রথমে ভালো কিছু অস্ত্র দরকার। গ্রুজনির অস্ত্র কিছু লুট করে আনা যায়–
রুহান এবার হাত তুলে বাধা দিয়ে বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও, তোমরা আরো কিছু বলার আগে আমাদের কথা একটু শুনো।
রুহানের গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, মানুষটি থেমে গিয়ে থতমত খেয়ে রুহানের দিকে তাকাল। রুহান শান্ত গলায় বলল, তোমরা খুব একটা বড় ভুল করেছ।
কী ভুল করেছি?
তোমরা যেরকম ভাবছ ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়।
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, ব্যাপারটি মোটেও কী রকম নয়?
আমরা একটা দল তৈরি করছি না। দল তৈরি করে আশেপাশের এলাকায় ডাকাতি করতে যাচ্ছি না। মানুষ ধরে ধরে তাদের বিক্রি করতে যাচ্ছি না।
বাদামী চুলের মানুষটি অসহিষ্ণু গলায় বলল, তুমি কী বলছ? আমরা খুব ভালো করে জানি তুমি ত্রিশজন ছেলে-মেয়েকে লুট করে নিয়ে এসেছ। এজেন্ট দ্রুচান দশ পার্সেন্ট কমিশনে তাদেরকে পৌঁছে দিচ্ছে–
না, না, না। রুহান মাথা নাড়ল, আমরা তাদেরকে মুক্ত করে এনে। মুক্ত করে তাদেরকে তাদের এলাকায় ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছি।
এজেন্ট দ্রুচান-
এজেন্ট দ্রুচান আমাদের সাহায্য করছে। সে একটি ইউনিটও নিচ্ছে না।
বাদামী চুলের মানুষটি বিস্ফারিত চোখে বলল, এজেন্ট দ্রুচান কোন ইউনিট নিচ্ছে না?
না।
কেন?
রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না তোমাকে এটা কেমন কে বোঝাব।
চেষ্টা কর!
আমরা মনে করি, মানুষ হয়ে মানুষকে বেচা-কেনা করা যায় না। সা! পৃথিবী এখন যেরকম স্বার্থপর হয়ে গেছে, লোভী হয়ে গেছে, হিংস্র হয়ে গেu. এটা ঠিক না। আমাদে একজনের অন্যজনকে সাহায্য করতে হবে, ভালোবাসতে হবে। আমাদের নিঃস্বার্থ হতে হবে। এজেন্ট দ্রুচান আমাদের কথা বিশ্বাস করে আমাদের সাহায্য করছে।
মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তারা এখনও রুহানের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি তোমরা আমার কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছ না, কিন্তু আমি যেটা বলছি সেটা সত্যি। পৃথিবীটা ঠিক দিকে যাচ্ছে না, আমি আর রিদি মিলে পৃথিবীটা ঠিক করতে পারব না। কিন্তু যেটা ঠিক সেটা করার চেষ্টা করতে পারব। আমাদের কথা শুনে অন্যেরা হয়তো সেটা বিশ্বাস করবে। কোথাও কেউ হতে। সত্যিকারভাবে চেষ্টা করবে।
বাদামী চুলের মানুষটির মুখে বিদ্রুপের এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল। হেঁটে গাছে হেলান দিয়ে রাখা অস্ত্রটি তুলে নিয়ে বলল, আমরা ভেবেছিলাম তোমরা দুঃসাহসী মানুষ। এখন দেখছি সেটা পুরোপুরি ভুল ধারণা। তোম্রা ভীতু আর কাপুরুষ। শুধু যে ভীতু আর কাপুরুষ তাই নয় তোমাদের কোনো বাস্তব জ্ঞান পর্যন্ত নেই।
রিদি ক্রুদ্ধ হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, রুহান তাকে থামাল। বলল, আমি দুঃখিত, তোমরা ভুল একটা ধারণা করে এত কষ্ট করে এখানে এসেছ!
হ্যাঁ। সেটা সত্যি, তোমাদের খুঁজে বের করে এখানে আসতে আমাদের খুব কষ্ট হয়েছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট!
আমরা খুব দুঃখিত।
মানুষগুলো কোনো কথা বলল না। রুহান বলল, তোমরা তাহলে ফিরে যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
তোমাদের ফেরত যাত্রা শুভ হোক।
মানুষগুলো এবারেও কোনো কথা না বলে কঠোর মুখে তাদের গাড়িতে ফিরে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইঞ্জিন গর্জন করে ওঠে এবং গাড়িটি যে দিক দিয়ে এসেছিল সেই দিকে ফিরে যেতে শুরু করে।
কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ফিরে আসবে। গলার স্বর শুনে রুহান আর রিদি মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, এজেন্ট দ্রুচান ঘুম ঘুম চোখে দাঁড়িয়ে আছে। রুহান জিজ্ঞেস করল, কে ফিরে আসবে?
এই মানুষগুলো?
কেন?
তোমাদের সাথে যোগ দিতে।
রুহান অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে জান?
এজেন্ট দ্রুচান অবাক হয়ে বলল, আমি জানি। কেমন করে জানি সেটা জানি না। কিন্তু আমি জানি। আমিও এসেছিলাম মনে নেই?
ক্রিটিনা নরম গলায় বলল, আমি কারণটা জানি।
কী কারণ?
কারণটা খুব সহজ। মানুষ আসলে ভালো। তারা ভালো থাকতে চায়। যখন ভালো থাকার সুযোগ পায় তারা ভালো হয়ে যায়। ভালো থাকার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে।
কী ব্যাপার?
এটাকে মনে হয় বলে শান্তি। পৃথিবীর সবাই শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে। অথচ শান্তি খুঁজে পাওয়া কী সহজ। অন্যের জন্যে কিছু একটা করাই হচ্ছে শান্তি। মানুষ কেন যে এটা বোঝে না কে জানে?
রুহান আর রিদি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ক্রিটিনার দিকে তাকিয়ে রইল।
গাড়িটি সত্যি সত্যি ফিরে এলো ঘণ্টা দুয়েক পরে। গাড়িতে অবশ্যি সবাই ছিল না, দশজনের ভেতর তিনজন ফিরে আসতে রাজি হয় নি, তাদের ধারণা ব্যাপারটা একটা হাস্যকর নির্বুদ্ধিতা। তারা নিজের এলাকায় ফিরে গেছ বাদামী চুলের মানুষটা সেই তিনজনের একজন।
অন্যেরা জানাল তারা হঠাৎ করে বুঝতে পেরেছে যে তারা আসবে। অসুখী। তারা একটু সুখ চায়। সুখ আর শান্তি। ভালো হয়ে থাকার শান্তি।