১১. উপসাগর ছাড়িয়ে
পঁচিশে ফেব্রুয়ারি সকালের দিকেই আবহাওয়া বেশ শান্ত হ’য়ে গেলো। কন্গ্রে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠিক করলে সেদিনই সে সদলবলে দ্বীপ ছেড়ে চলে যাবে। বিকেলবেলার মধ্যেই যাতে নোঙর তুলতে পারে, তার জন্যে জোর প্রস্তুতি চলতে লাগলো। তবে সন্ধে ছ-টা নাগাদে জোয়ার বইবে : জোয়ারের সময়ই রওনা হওয়া সুবিধের।
যদি পারতো, তবে সকালবেলাতেই জাহাজ ছাড়তো কন্গ্রে। কিন্তু এত ঘন হ’য়ে কুয়াশা পড়েছিলো যে তার সেই আশা সফল হয়নি। জাহাজে এত মাল বোঝাই করা হয়েছিলো যে, জাহাজটি সাধারণ অবস্থায় জলের নিচে যতটুকু ডুবে থাকতো, তার চেয়েও কয়েক ইঞ্চি বেশি ডুবে গিয়েছিলো।
দুপুরবেলায় বাতিঘরের সামনেটায় হাঁটতে-হাঁটতে সের্সান্তে কনগ্রেকে বললে : ‘কুয়াশা ক্রমেই স’রে যাচ্ছে। একটু বাদেই সমুদ্র পরিষ্কার হ’য়ে যাবে। সাধারণত এ-রকম কুয়াশা পড়লে ঝড় থেমে যায়, আবহাওয়া শান্ত হ’য়ে ওঠে, আর জোয়ার একটু তাড়াতাড়ি শুরু হয়।’
——জোয়ারের সময়ই আমরা জাহাজ ছাড়বো। আর একবার যদি এখানকার উপসাগর ছাড়িয়ে যেতে পারি, তবে আর আমাদের কে আটকায়?’ কন্গ্রের গলায় শুধু আশাই নেই, হর্ষও ছিলো।
——তা ঠিক। তবে রাতটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হবে ব’লে মনে হচ্ছে। আজ সবে প্রতিপদ কি না, তাই চাঁদও উঠবে ভোরবেলার দিকে।’
—’তাতে কিছুই এসে-যায় না। চাঁদ-তারা গ্রহ-নক্ষত্র এদের আমি থোড়াই তোয়াক্কা করি। এ-অঞ্চলটা আমার নখদর্পণে।’
–’কালকের মধ্যেই আমাদের অনেক দূরে সটকে-পড়া চাই, ওস্তাদ।’ –’কাল আমরা সেন্ট বার্থোলোমিউ পেছনে ফেলে দূর সমুদ্দুরে গিয়ে পড়বো। আশা করি সন্ধের আগেই কুড়ি মাইল এগিয়ে যেতে পারবো।’
—’এখানে কিন্তু ভয়ানক দেরি হয়ে গেলো, ওস্তাদ।’
——সেজন্যে তোমার আপশোশ হচ্ছে?’
——আপশোশ আর কীসের? এখানে বরং আমাদের প্রচুর লাভই হয়েছে।…তবে একটা খটকাও আছে বৈ-কি। ঐ তিন নম্বর আলোকরক্ষীটি যে কোথায় উধাও হ’য়ে গেলো তার আর কোনোই হদিশ মিললো না। এই দু-মাসে নিশ্চয়ই লোকটা না-খেতে পেয়েই মরেছে। তবে যদি ম’রে না-গিয়ে থাকে—’
–’সান্তা-ফে আসার আগেই যে আমরা রওনা হ’তে পারছি, এটা কিন্তু আমাদের মস্ত সৌভাগ্য।’
—’বাতিঘরের কাগজপত্তর অনুযায়ী আর হপ্তা খানেকের মধ্যেই তার এসে পড়ার কথা।’
——সেই এক হপ্তায় আমরা এখান থেকে অনেক দূরে চ’লে যাবো।’
——যা বলেছো, ওস্তাদ। হ্যাঁ, ভালো কথা। একবার বরং লণ্ঠনঘরে গিয়ে শেষবারের মতো সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে নিই। যদি কোনো জাহাজ চোখে পড়ে – ‘
কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে কন্গ্রে বললে—’যদি চোখেও পড়ে, তাতে আমাদের কিছুই এসে যাবে না। সের্সান্তে জাহাজের কাগজপত্র সব ঠিক আছে। প্রশান্ত আর অতলান্তিক মহাসাগর সকলের কাছেই অবাধ, মুক্ত। সুতরাং মিথ্যে ভয় পাবার কিচ্ছু নেই। আমরা নিশ্চিন্তে সে-জাহাজকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারবো।’
তার উদ্দেশ্য যে সিদ্ধ হবে, এ-সম্বন্ধে কন্গ্রের মনে কোনোই সন্দেহ বা সংশয় ছিলো না। আর সব দেখে-শুনে এও মানতে হয় যে এ-যাবৎ সবকিছুই তার পক্ষে গেছে।
সের্সান্তে আলোকস্তম্ভের লণ্ঠনঘরে গিয়ে হাজির হলো। চারপাশে ভালো ক’রে নজর বোলালো সে। প্রায় ঘণ্টাখানেক সে সেখানে কাটিয়ে দিলে। ধীরে-ধীরে তারই মধ্যে কুয়াশা কেটে গিয়েছে। নীল আকাশ এসে যেখানে সমুদ্রের সুনীলে মিশেছে, সেই দুই-নীলে-মেশা দিগন্তের দিকে বার-কয়েক তাকালে সের্সান্তে। সমুদ্র যদিও এখনও বেশ দামাল, তবু ভয়ের কিছু নেই—তার টালমাটাল ভাবটা ক্রমেই শান্ত হ’য়ে আসছে। অনেক দূরে, একেবারে দিগন্তের কাছে, সের্সান্তে একটা জাহাজ দেখতে পেলে। তখন বেলা প্রায় দুটো বাজে। টেলিস্কোপ ছাড়াই খালি চোখেই জাহাজটাকে দেখা যাচ্ছিলো। জাহাজটি প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে চলেছে। যতক্ষণ-না সেটা দৃষ্টির বাইরে চ’লে গেলো সের্সান্তে সারাক্ষণ সেটার ওপর চোখ রাখলে।
কিন্তু এরই ঘণ্টাখানেক বাদে উত্তর-পুব দিকে কী-একটা দেখে বেশ-একটু উদ্বিগ্নই হ’য়ে পড়লো সে। অনেক দূরে একটা স্টীমারের কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। এও বোঝা গেলো, স্টীমারটির লক্ষ্য স্টটেন আইল্যাণ্ড। সের্সান্তে বেশ অস্বস্তি বোধ করলে। সান্তা-ফে নয়তো? না, তা-ই বা কী করে হয়? আজ সবে পঁচিশে ফেব্রুয়ারি, আর সান্তা ফের আসবার কথা তো সেই মার্চের প্রথম সপ্তাহে। তাহ’লে কি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সান্তা ফে চ’লে আসছে দ্বীপে? তা যদি হয় তাহ’লে মুশকিল। শেষটায় কি তাহ’লে কূলে এসে তরী ডুববে?
লণ্ঠনঘর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলে সে। তাদের জাহাজ দিব্যি নিশ্চিন্ত হ’য়ে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে। যাত্রার জন্যে তৈরি হ’য়েই আছে, শুধু নোঙর তোলবার যা দেরি। কিন্তু জোয়ার আসার আগে প্রতিকূল হাওয়ার সঙ্গে যুঝে বারদরিয়ায় গিয়ে পড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই ঐ স্টীমারটি আসার আগে তাদের জাহাজ রওনা হ’তে পারবে না। আর স্টীমারটি সান্তা ফে হয় –
সের্সান্তে ভাবনায় প’ড়ে গেলো। কিন্তু কনগ্রেকে বিরক্ত করতে না-গিয়ে সে একাই লণ্ঠনঘরে বসে রইলো। স্টীমারটি খুব দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে। যে-রকম দ্রুত আসছে, তাতে সান্ হুয়ান অন্তরীপে পৌঁছুতে তার খুব বেশি দেরি হবে না। টেলিস্কোপ থেকে সে আর চোখ সরালে না। স্টীমারটি ক্রমেই যত কাছে আসছে, ততই তার উদ্বেগও বাড়ছে। কিন্তু একটু বাদে সে যখন স্টীমারটিকে দেখতে পেলে তখনই তার ভয়ডর সব উবে গেলো। খুবই ছোটোখাটো একটা স্টীমার। সান্তা ফে কিছুতেই নয়। সান্তা-ফে যখন স্টটেন আইল্যাণ্ডে ছিলো, তখন সেটাকে সে ভালো ক’রেই লক্ষ ক’রে দেখেছে।
আহ্! সে একটা নিশ্চিন্ত আরামের নিশ্বাস ফেললে। কী ভাবনাই যে হয়েছিলো! ভাগ্যিশ আর কাউকে স্টীমারটির খবর দিয়ে মিথ্যেমিথ্যি ঘাবড়ে দেয়নি! আরো এক ঘণ্টা লণ্ঠনঘরে থেকে গেলো সে। দেখতে পেলে, জাহাজটা স্টটেন আইল্যাণ্ডের উত্তরে তিন-চার মাইল দূর দিয়ে চ’লে গেলো। এত দূর থেকে জাহাজটার নাম সে টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়েও পড়তে পায়নি। শেষটায় জাহাজটা কলনেট অন্তরীপের আড়ালে অদৃশ্য হ’য়ে গেলো। সমুদ্রে আর কোনোকিছুরই চিহ্ন নেই। অবশেষে সন্তুষ্ট হ’য়ে হৃষ্ট মনে সের্সান্তে নিচে নেমে এলো।
ক্রমে জোয়ারের সময় এগিয়ে এলো। এবার সের্সান্তে জাহাজের যাত্রার সময় এসেছে। প্রস্তুতি বেশ ভালো হয়েছে। এখন শুধু নোঙর তোলা বাকি।
ছ-টার সময় কন্গ্রে সদলবলে গিয়ে জাহাজে উঠলো। জলে জোয়ারের প্রথম চাঞ্চল্য জেগেছে। কন্গ্রে জাহাজ চালাবার জন্যে তৈরি হ’য়ে নিতে হুকুম দিলে। ঘড়ঘড় ক’রে নোঙর উঠলো। তারপর তুলে দেয়া হ’লো পাল। সের্সান্তে নড়তে শুরু করলো। আস্তে-আস্তে এখন বারদরিয়ার দিকে চলেছে। দক্ষিণ-পুব থেকে হাওয়া বইছিলো। এলাকাটা সত্যি কিন্তু কন্গ্রের নখদর্পণে। তাই সাড়ে-ছটার সময় দেখা গেলো তাদের জাহাজ অন্তরীপের একেবারে শেষমুখে এসে পৌঁছেছে। এখন জাহাজের সামনের দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র। আস্তে-আস্তে তখন সূর্য ডুবছে।
সের্সান্তে কন্গ্রের কাছে এগিয়ে এসে খুশি গলায় বললে—’শেষ অব্দি উপসাগর প্রায় ছাড়িয়ে এলুম।’
কন্গ্রে বললে—হ্যাঁ। আর মিনিট কুড়ির মধ্যেই সান্ হুয়ান অন্তরীপ আমাদের পেছনে প’ড়ে থাকবে।’
এমন সময় মাল্লাদের একজন এগিয়ে এসে বললে— ‘সামনে তাকিয়ে দেখুন, ওস্তাদ।’
–’কী ব্যাপার?’ কন্গ্রে জানতে চাইলে।
সের্সান্তে লোকটার কাছে দৌড়ে চ’লে এলো। রেলিঙ ধ’রে জলের দিকে ঝুঁকে পড়লো। জাহাজ তখন বোম্বেটে-গুহার পাশ দিয়ে চলেছে। সের্সান্তে দেখতে পেলে, বিধ্বস্ত জাহাজ মউল-এর বেশকিছু ভাঙা টুকরো তখনও জলে ভাসছে। এটা বুঝতে তার দেরি হ’লো না যে এগুলোর সঙ্গে ধাক্কা লাগলে তাদের জাহাজের বেশ ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু তখন আর ঐ ভাসন্ত জিনিশগুলোকে সরাবার সময় নেই। তক্ষুনি সে কনগ্রেকে ডেকে এনে জিনিশগুলো দেখালে।
কন্গ্রে তক্ষুনি জাহাজটাকে একেবারে তীরে: কাছে নিয়ে এলো। ভাঙাচোরা লোহালক্কড় ইত্যাদি জাহাজের পাশ দিয়ে ভাসতে-ভাসতে চ’লে গেলো। এবার সে আবার সের্সান্তেকে উপসাগরের মাঝখানে নিয়ে এলো। আর পঞ্চাশ-ষাট গজ এগুলেই অন্তরীপের পাহাড়ের কোনা ছাড়িয়ে যাওয়া যাবে।
ঠিক এখন সময় হঠাৎ হাওয়ায় একটা শোঁ-শোঁ আওয়াজ উঠলো, আর তৎক্ষণাৎ একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনে চমকে উঠলো বোম্বেটেরা। কীসের এক প্রচণ্ড আঘাতে কেঁপে উঠলো তাদের জাহাজ! দেখা গেলো, তীরের একটা জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠছে।
কন্গ্রে চীৎকার ক’রে উঠলো।—’এ কী-ব্যাপার, সের্সান্তে?’
–’আমাদের লক্ষ্য ক’রে কেউ কামান ছুঁড়েছে। সের্সান্তে জবাব দিলে। যেখানে গোলা পড়েছিলো, সেখানে তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলো কন্গ্রে।
জলরেখার চাইতে ফিট দু-এক ওপরে জাহাজের গায়ে মস্ত একটা গহ্বর।
সের্সান্তে যখন উপসাগর প্রায় পেরিয়েই এসেছে, ঠিক সেই সময় দ্বীপ থেকে আরেকটা গোলা এসে পড়লো। সর্বনাশ! গোলাটা আরেকটু নিচে লাগলেই হয়েছিলো আর-কি!
কী করবে এখন কন্গ্রে? ডিঙি ক’রে নেমে দ্বীপে গিয়ে গোলন্দাজদের একহাত দেখিয়ে দেবে? যদি তারা সংখ্যায় ভারি হয়? তার চেয়ে কামানের পাল্লার বাইরে নিয়ে গিয়ে জাহাজটাকে মেরামত করবার চেষ্টা করাই ভালো।
আবারও এক কামানের নিনাদে কন্গ্রের ভাবনায় বাধা পড়লো। আবার তার স্কুনার থরথর করে কেঁপে উঠেছে। এবার গোলাটা এসে পড়েছে আগের গোলাটার চাইতে কয়েক ইঞ্চি নিচে।
কন্গ্রে তখন প্রাণপণে চেষ্টা করছে যে-করেই হোক স্কুনারটাকে কামানের পাল্লার বাইরে নিয়ে যেতে। সে ভেবেছিলো, কোনোরকমে একবার উপসাগরের মুখ থেকে বেরিয়ে পড়তে পারলেই আর-কোনো ভয় থাকবে না।
ভাগ্যিশ আর-কোনো কামানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। একটু পরেই তারা দ্বীপের শেষ পাহাড়টা পেরিয়ে চ’লে এলো। কনগ্রে ভাবলে, আর-কোনো ভয় নেই। জাহাজ এখন পাহাড়ের আড়ালে এসে গিয়েছে।
কতটুকু ক্ষতি হলো তা এক্ষুনি পরীক্ষা ক’রে দেখা দরকার। কিন্তু মালপত্র না-নামালে ভেতর থেকে তা বোঝবার কোনো উপায় ছিলো না। জাহাজ থেকে তক্ষুনি একটা ডিঙি নামানো হ’লো। কনগ্রে আর ভার্গাস ডিঙিতে ক’রে ঘুরে-ঘুরে সব খতিয়ে দেখে ক্ষতির বহরটা আন্দাজ করবার চেষ্টা করতে লাগলো।
না, তেমন-কোনো গুরুতর কিছু ক্ষতি হয়নি। কিন্তু তাও, যতটুকু ক্ষতি হয়েছে তাতে এই স্কুনার নিয়ে এখন সাগরপাড়ি দেওয়া অসম্ভব। ঠিক জলরেখার কাছে একটা গর্ত তৈরি হয়েছে : কোনোরকমে তা দিয়ে যদি একবার জল ঢোকে তাহ’লে আর রেহাই নেই, একেবারে পাতালে সমাধি। যে-ক’রেই হোক এক্ষুনি তা মেরামত ক’রে নিতে হবে।
—’কিন্তু কুকুরগুলো কে? একবার হাতের কাছে পেলে মুণ্ডুগুলো চিবিয়ে খেতুম,’ দাঁত কিড়মিড় ক’রে সের্সান্তে বললে।
—’সম্ভবত সেই তৃতীয় আলোকরক্ষীটি।’ ভার্গাস তার অনুমানটি জানালে। ‘বা এমনও হ’তে পারে সেনচুরির কোনো লোককে আলোকরক্ষীটি উদ্ধার করেছে, আর তারা দুজনে মিলে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
–’আমারও তা-ই মনে হচ্ছে।’ সের্সান্তে সায় দিলে। ‘এ-কামানটা নিশ্চয়ই সেনচুরির। অথচ, আশ্চর্য, ভাঙা জাহাজটার আশপাশে তো আমরা কোনো কামান দেখতে পাইনি।’
কন্গ্রে বাধা দিয়ে বললে——সে নিয়ে এখন মাথা না ঘামালেও চলবে। এখন আমাদের সবচেয়ে আগে সব ক্ষতিটতি সারিয়ে নেয়া দরকার।’
—’নিঃসন্দেহে। মেরামতের কাজে লেগে-পড়াটাই এখন সবচাইতে জরুরি। কিন্তু তার চেয়েও আগে দরকার পয়েন্ট দিয়েগোর অন্য তীরে জাহাজটি নিয়ে ভেড়ানো, কারণ, তা না-করলে আমরা সমুদ্রের জোরালো হাওয়ার পাল্লায় প’ড়ে যাবো—আর তাইতে বিপদ আরো বেশি। আবহাওয়া যদি বেগড়বাই করে তাহ’লে এই অবস্থায় স্কুনারটি একেবারে টুকরো-টুকরো হ’য়ে ভেঙে যাবে। না, তার চেয়ে পুরোনো গোয়ালেই ফিরে-যাওয়া ভালো।’
কন্গ্রে ঠিক করলে রাত গাঢ় হ’য়ে নেমে পড়ার আগেই ইগোর উপসাগরে ফিরে যাবে। সেখানে নিরাপদ আশ্রয়ে সবাই মিলে কাজে লেগে-যাওয়া যাবে।
কিন্তু এখন-যে জোয়ার! স্রোতের উলটো মুখে জাহাজ চালানো এখন প্ৰায় অসম্ভব। কী করা যায় তবে? এখানেই তাহ’লে অপেক্ষা করতে হবে? কিন্তু ঢেউয়ের মধ্যে স্কুনারটি যেভাবে দোল খাচ্ছে তা তো সর্বনাশের লক্ষণ। যে-কোনো মুহূর্তে একটু বেশি কাৎ হ’লেই ঐ ফুটোগুলো দিয়ে জাহাজে জল ঢুকে যেতে পারে। কাজেই শেষটায় পয়েন্ট দিয়েগোর কাছাকাছিই নোঙর ফেলতে বাধ্য হ’লো কন্গ্ৰে।
রাত আসছে। একটু পরেই জমাট হ’য়ে নেমে আসবে ঘন অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারে তাদের স্কুনার যে-কোনো মুহূর্তে ডাঙায় আছড়ে পড়তে পারে।
অবশেষে, রাত প্রায় দশটার সময়, একটু সুবিধে পাওয়া গেলো। মাঝরাতের আগেই অনেক বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে ইগোর উপসাগরের পুরোনো জায়গাতেই ফিরে এলো বোম্বেটেরা। এই দ্বীপে একদিন তারা আইনের চোখে ধুলো দিয়ে আস্তানা গেড়েছিলো, এখন যেন দ্বীপ আর তাদের ছাড়তে চাচ্ছে না।