এ ইওরোপ কি? কালো, আদকালা, হলদে, লাল, এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকার সমস্ত মানুষ এদের পদানত কেন? এরা কেনই বা এ কলিযুগের একাধিপতি?
এ ইওরোপ বুঝতে গেলে পাশ্চাত্য ধর্মের আকর ফ্রাঁস থেকে বুঝতে হবে। পৃথিবীর আধিপত্য ইওরোপে, ইওরোপের মহাকেন্দ্র পারি। পাশ্চাত্য সভ্যতা, রীতিনীতি, আলোক-আঁধার, ভাল-মন্দ, সকলের শেষ পরিপুষ্ট ভাব এইখানে—এই পারি নগরীতে।
এ পারি এক মহাসমুদ্র—মণি মুক্তা প্রবাল যথেষ্ট, আবার মকর কুম্ভীরও অনেক। এই ফ্রাঁস ইওরোপের কর্মক্ষেত্র। সুন্দর দেশ—চীনের কতক অংশ ছাড়া এমন দেশ আর কোথাও নেই। নাতিশীতোষ্ণ, অতি উর্বরা, অতিবৃষ্টি নাই, অনাবৃষ্টিও নাই, সে নির্মল আকাশ, মিঠে রৌদ্র, ঘাসের শোভা, ছোট ছোট পাহাড়, চিনার বাঁশ প্রভৃতি গাছ, ছোট ছোট নদী, ছোট ছোট প্রস্রবণ—সে জলে রূপ, স্থলে মোহ, বায়ুতে উন্মত্ততা, আকাশে আনন্দ। প্রকৃতি সুন্দর, মানুষও সৌন্দর্যপ্রিয়। আবালবৃদ্ধবনিতা, ধনী, দরিদ্র তাদের ঘোর-দোর ক্ষেত-ময়দান ঘষে মেজে, সাজিয়ে গুজিয়ে ছবিখানি করে রাখছে। এক জাপান ছাড়া এ ভাব আর কোথাও নাই। সেই ইন্দ্রভুবন অট্টালিকাপুঞ্জ, নন্দনকানন উদ্যান, উপবন—মায় চাষার ক্ষেত, সকলের মধ্যে একটু রূপ—একটু সুচ্ছবি দেখবার চেষ্টা এবং সফলও হয়েছে। এই ফ্রাঁস প্রাচীনকাল হতে গোলওয়া (Gauls), রোমক, ফ্রাঁ (Franks) প্রভৃতি জাতির সংঘর্ষভূমি; এই ফ্রাঁ জাতি রোমসম্রাজ্যের বিনাশের পর ইওরোপে একাধিপত্য লাভ করলে, এদের বাদশা শার্লামাঞন (Charlemagne) ইওরোপে ক্রিশ্চান ধর্ম তলওয়ারের দাপটে চালিয়ে দিলেন এই ফ্রাঁ জাতি হতেই এশিয়াখণ্ডে ইওরোপের প্রচার, তাই আজও ইওরোপী আমাদের কাছে ফ্রাঁকি, ফেরিঙ্গী, প্লাঁকি, ফিলিঙ্গ ইত্যাদি।
সভ্যতার আকর প্রাচীন গ্রীস ডুবে গেল। রাজচক্রবর্তী রোম বর্বর (Barbars) আক্রমণ-তরঙ্গে তলিয়ে গেল। ইওরোপের আলো নিবে গেল, এদিকে আর এক অতি বর্বরজাতি এশিয়াখণ্ডে প্রাদুর্ভাব হল—আরবজাতি। মহাবেগে সে আরব-তরঙ্গ পৃথিবী ছাইতে লাগল। মহাবল পারস্য আরবের পদানত হল, মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে হল, কিন্তু তার ফলে মুসলমান ধর্ম আর এক রূপ ধারণ করলে; সে আরবী ধর্ম আর পারসিক সভ্যতা সম্মিলিত হল।
আরবের তলওয়ারের সঙ্গে সঙ্গে পারস্য সভ্যতা ছড়িয়ে পড়তে লাগল, যে পারস্য সভ্যতা প্রাচীন গ্রীস ও ভারতবর্ষ হতে নেওয়া। পূর্ব পশ্চিম দুদিক হতে মহাবলে মুসলমান তরঙ্গ ইওরোপের উপর আঘাত করলে, সঙ্গে সঙ্গে বর্বর অন্ধ ইওরোপে জ্ঞানালোক ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রাচীন গ্রীকদের বিদ্যা বুদ্ধি শিল্প বর্বরাক্রান্ত ইতালীতে প্রবেশ করলে, ধরা-রাজধানী রোমের মৃত শরীরে প্রাণস্পন্দন হতে লাগল—সে স্পন্দন ফ্লরেন্স নগরীতে প্রবল রূপ ধারণ করলে, প্রাচীন ইতালী নবজীবনে বেঁচে উঠতে লাগল, এর নাম রেনেসাঁ (Renaissance)—নবজন্ম। কিন্তু সে নবজন্ম হল ইতালীর। ইওরোপের অন্যান্য অংশের তখন প্রথম জন্ম। সে ক্রিশ্চানী ষোড়শ শতাব্দীতে—যখন আকবর, জাহাঁগীর, শাজাহাঁ প্রভৃতি মোগল সম্রাট্ ভারতে মহাবল সাম্রাজ্য তুলেছেন, সেই সময় ইওরোপের জন্ম হল।
ইতালী বুড়ো জাত, একবার সাড়াশব্দ দিয়ে আবার পাশ ফিরে শুলো। সে সময় নানা কারণে ভারতবর্ষও জেগে উঠেছিল কিছু, আকবর হতে তিন পুরুষের রাজত্বে বিদ্যা বুদ্ধি শিল্পের আদর যথেষ্ট হয়েছিল, কিন্তু অতি বৃদ্ধ জাত নানা কারণে আবার পাশ ফিরে শুলো।
ইওরোপে ইতালীর পুনর্জন্ম গিয়ে লাগলো বলবান্ অভিনব নূতন ফ্রাঁ জাতিতে। চারিদিক হতে সভ্যতার ধারা সব এসে ফ্লরেন্স নগরীতে একত্র হয়ে নূতন রূপ ধারণ করলে; কিন্তু ইতালী জাতিতে সে বীর্যধারণের শক্তি ছিল না, ভারতের মত সে উন্মেষ ঐখানেই শেষ হয়ে যেত, কিন্তু ইওরোপের সৌভাগ্য, এই নূতন ফ্রাঁ জাতি আদরে সে তেজ গ্রহণ করলে। নবীন রক্ত, নবীন জাত সে তরঙ্গে মহাসাহসে নিজের তরণী ভাসিয়ে দিলে, সে স্রোতের বেগ ক্রমশই বাড়তে লাগল, সে এক ধারা শতধারা হয়ে বাড়তে লাগল; ইওরোপের আর আর জাতি লোলুপ হয়ে খাল কেটে সে জল আপনার আপনার দেশে নিয়ে গেল এবং তাতে নিজেদের জীবনীশক্তি ঢেলে তার বেগ, তার বিস্তার বাড়াতে লাগল, ভারতে এসে সে তরঙ্গ লাগল; জাপান সে বন্যায় বেঁচে উঠল, সে জল পান করে মত্ত হয়ে উঠল; জাপান এশিয়ার নূতন জাত।
পারি ও ফ্রাঁস
এই পারি নগরী সে ইওরোপী সভ্যতা-গঙ্গার গোমুখ। এ বিরাট রাজধানী মর্ত্যের অমরাবতী, সদানন্দ-নগরী। এ ভোগ, এ বিলাস, এ আনন্দ—না লণ্ডনে, না বার্লিনে, না আর কোথায়। লণ্ডনে, নিউ ইয়র্কে ধন আছে; বার্লিনে বিদ্যাবুদ্ধি যথেষ্ট, নেই সে ফরাসী মাটি, আর সর্বাপেক্ষা নেই সে ফরাসী মানুষ। ধন থাক, বিদ্যাবুদ্ধি থাক, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও থাক—মানুষ কোথায়? এ অদ্ভুত ফরাসী চরিত্র প্রাচীন গ্রীক মরে জন্মেছে যেন—সদা আনন্দ, সদা উৎসাহ, অতি ছ্যাবলা আবার অতি গম্ভীর, সকল কাজে উত্তেজনা, আবার বাধা পেলেই নিরুৎসাহ। কিন্তু সে নৈরাশ্য ফরাসী মুখে বেশীক্ষণ থাকে না, আবার জেগে ওঠে।
এই পারি বিশ্ববিদ্যালয় ইওরোপের আদর্শ। দুনিয়ার বিজ্ঞান সভা এদের একাডেমির নকল; এই পারি ঔপনিবেশ-সাম্রাজ্যের গুরু, সকল ভাষাতেই যুদ্ধ-শিল্পের সংজ্ঞা এখনও অধিকাংশ ফরাসী; এদের রচনার নকল সকল ইওরোপী ভাষায়; দর্শন বিজ্ঞান শিল্পের এই পারি খনি, সকল জায়গায় এদের নকল।
এরা হচ্ছে শহুরে, আর সব জাত যেন পাড়াগেঁয়ে। এরা যা করে তা ৫০ বৎসর, ২৫ বৎসর পরে জার্মান ইংরেজ প্রভৃতি নকল করে, তা বিদ্যায় হোক বা শিল্পে হোক, বা সমাজনীতিতেই হোক। এই ফরাসী সভ্যতা স্কটল্যাণ্ডে লাগল, স্কটরাজ ইংলণ্ডের রাজা হলেন, ফরাসী সভ্যতা ইংলণ্ডকে জাগিয়ে তুললে; স্কটরাজ স্টুয়ার্ট বংশের সময় ইংলণ্ডে রয়াল সোসাইটি প্রভৃতির সৃষ্টি।
আর এই ফ্রাঁস স্বাধীনতার আবাস। প্রজাশক্তি মহাবেগে এই পারি নগরী হতে ইওরোপ তোলপাড় করে ফেলেছে, সেই দিন হতে ইওরোপের নূতন মূর্তি হয়েছে। সে ‘এগালিতে, লিবার্তে, ফ্রাতের্নিতে’র (Egalite’, Liberte, Fraternite—সাম্য, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব) ধ্বনি ফ্রাঁস হতে চলে গেছে; ফ্রাঁস অন্য ভাব, অন্য উদ্দেশ্য অনুসরণ করছে, কিন্তু ইওরোপের অন্যান্য জাত এখনও সেই ফরাসী বিপ্লব মক্শ করছে।
একজন স্কটল্যাণ্ড দেশের প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক পণ্ডিত আমায় সেদিন বললেন যে, পারি হচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্র; যে দেশ যে পরিমাণে এই পারি নগরীর সঙ্গে নিজেদের যোগ স্থাপন করতে সক্ষম হবে, সে জাত তত পরিমাণে উন্নতি লাভ করবে। কথাটা কিছু অতিরঞ্জিত সত্য; কিন্তু এ-কথাটাও সত্য যে, যদি কারু কোন নূতন ভাব এ জগৎকে দেবার থাকে তো এই পারি হচ্ছে সে প্রচারের স্থান। এই পারিতে যদি ধ্বনি ওঠে তো ইওরোপ অবশ্যই প্রতিধ্বনি করবে। ভাস্কর, চিত্রকর, গাইয়ে, নর্তকী—এই মহানগরীতে প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারলে আর সব দেশে সহজেই প্রতিষ্ঠা হয়।
আমাদের দেশে এই পারি নগরীর বদনামই শুনতে পাওয়া যায়, এ পারি মহাকদর্য বেশ্যাপূর্ণ নরককুণ্ড। অবশ্য এ-কথা ইংরেজরাই বলে থাকে, এবং অন্য দেশের যে সব লোকের পয়সা আছে এবং জিহ্বোপস্থ ছাড়া দ্বিতীয় ভোগ জীবনে অসম্ভব, তারা অবশ্য বিলাসময় জিহ্বোপস্থের উপকরণময় পারিই দেখে!
কিন্তু লণ্ডন, বার্লিন, ভিয়েনা, নিউ ইয়র্কও ঐ বারবনিতাপূর্ণ, ভোগের উদ্যোগপূর্ণ; তবে তফাত এই যে, অন্য দেশের ইন্দ্রিয়চর্চা পশুবৎ, প্যারিসের—সভ্য পারির ময়লা সোনার পাতমোড়া; বুনো শোরের পাঁকে লোটা, আর ময়ূরের পেখমধরা নাচে যে তফাত, অন্যান্য শহরের পৈশাচিক ভোগ আর এ প্যারিস-বিলাসের সেই তফাত।
ভোগ-বিলাসের ইচ্ছা কোন্ জাতে নেই বল? নইলে দুনিয়ায় যার দু-পয়সা হয়, সে অমনি পারি-নগরী অভিমুখে ছোটে কেন? রাজা-বাদশারা চুপিসাড়ে নাম ভাঁড়িয়ে এ বিলাস-বিবর্তে স্নান করে পবিত্র হতে আসেন কেন? ইচ্ছা সর্বদেশে, উদ্যোগের ত্রুটি কোথাও কম দেখি না; তবে এরা সুসিদ্ধ হয়েছে, ভোগ করতে জানে, বিলাসের সপ্তমে পৌঁছেছে।
তাও অধিকাংশ কদর্য নাচ-তামাসা বিদেশীর জন্য। ফরাসী বড় সাবধান, বাজে খরচ করে না। এই ঘোর বিলাস, এই সব হোটেল কাফে, যাতে একবার খেলে সর্বস্বান্ত হতে হয়, এ-সব বিদেশী আহাম্মক ধনীদের জন্য। ফরাসীরা বড় সুসভ্য, আদব-কায়দা বেজায়, খাতির খুব করে, পয়সাগুলি সব বার করে নেয়, আর মুচকে মুচকে হাসে।
তা ছাড়া, আর এক তামাসা এই যে, আমেরিকান জার্মান ইংরেজ প্রভৃতির খোলা সমাজ, বিদেশী ঝাঁ করে সব দেখতে শুনতে পায়। দু-চার দিনের আলাপেই আমেরিকান বাড়ীতে দশ দিন বাস করবার নিমন্ত্রণ করে; জার্মান তদ্রূপ; ইংরেজ একটু বিলম্বে। ফরাসী এ বিষয়ে বড় তফাত, পরিবারের মধ্যে অত্যন্ত পরিচিত না হলে আর বাস করতে নিমন্ত্রণ করে না। কিন্তু যখন বিদেশী ঐ প্রকার সুবিধা পায়, ফরাসী পরিবার দেখবার জানবার অবকাশ পায়, তখন আর এক ধারণা হয়। বলি, মেছবাজার দেখে অনেক বিদেশী যে আমাদের জাতীয় চরিত্র সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করে—সেটা কেমন আহাম্মকি? তেমনি এ পারি। অবিবাহিতা মেয়ে এদেশে আমাদের দেশের মত সুরক্ষিতা, তারা সমাজে প্রায় মিশতে পায় না। বে-র পর তবে নিজের স্বামীর সঙ্গে সমাজে মেশে; বে-থা মায়ে বাপে দেয়, আমাদের মত। আর এরা আমোদপ্রিয়, কোন বড় সামাজিক ব্যাপার নর্তকীর নাচ না হলে সম্পূর্ণ হয় না। যেমন আমাদের বে পুজো—সর্বত্র নর্তকীর আগমন। ইংরেজ ওলবাটা-মুখ, অন্ধকার দেশে বাস করে, সদা নিরানন্দ, ওদের মতে এ বড় অশ্লীল, কিন্তু থিয়েটারে হলে আর দোষ নেই। এ-কথাটাও বলি যে, এদের নাচটা আমাদের চোখে অশ্লীল বটে, তবে এদের সয়ে গেছে। নেংটি নাচ সর্বত্র, ও গ্রাহ্যের মধ্যেই নয়। কিন্তু ইংরেজ আমেরিকান দেখতেও ছাড়বে না, আর ঘরে গিয়ে গাল দিতেও ছাড়বে না।
স্ত্রী-সম্বন্ধী আচার পৃথিবীর সর্বদেশেই একরূপ, অর্থাৎ পুরুষ-মান্ষের অন্য স্ত্রীসংসর্গে বড় দোষ হয় না, কিন্তু স্ত্রীলোকের বেলাটায় মুশকিল। তবে ফরাসী পুরুষ একটু খোলা, অন্য দেশের ধনী লোকেরা যেমন এ সম্বন্ধে বেপরোয়া, তেমনি। আর ইওরোপী পুরুষসাধারণ ও-বিষয়টা অত দোষের ভাবে না। অবিবাহিতের ও-বিষয়ে পাশ্চাত্য দেশে বড় দোষের নয়; বরং বিদ্যার্থী যুবক ও-বিষয়ে একান্ত বিরত থাকলে অনেক স্থলে তার মা-বাপ দোষাবহ বিবেচনা করে, পাছে ছেলেটা ‘মেনিমুখো’ হয়। পুরুষের এক গুণ পাশ্চাত্য দেশে চাই—সাহস; এদের ‘ভার্চু’ (virtue) শব্দ আর আমাদের ‘বীরত্ব’ একই শব্দ। ঐ শব্দের ইতিহাসেই দেখ, এরা কাকে পুরুষের সততা বলে। মেয়েমানুষের পক্ষে সতীত্ব অত্যাবশ্যক বটে।
এ সকল কথা বলবার উদ্দেশ্য এই যে, প্রত্যেক জাতির এক-একটা নৈতিক জীবনোদ্দেশ্য আছে, সেইখানটা হতে সে জাতির রীতিনীতি বিচার করতে হবে। তাদের চোখে তাদের দেখতে হবে। আমাদের চোখে এদের দেখা, আর এদের চোখে আমাদের দেখা—এ দুই ভুল।
আমাদের উদ্দেশ্য এ বিষয়ে এদের ঠিক উল্টা, আমাদের ব্রহ্মচারী (বিদ্যার্থী) শব্দ আর কামজয়িত্ব এক। বিদ্যার্থী আর কামজিৎ একই কথা।
আমাদের উদ্দেশ্য মোক্ষ। ব্রহ্মচর্য বিনা তা কেমনে হয়, বল? এদের উদ্দেশ্য ভোগ, ব্রহ্মচর্যের আবশ্যক তত নাই; তবে স্ত্রীলোকের সতীত্ব নাশ হলে ছেলেপিলে জন্মায় না এবং সমগ্র জাতির ধ্বংস। পুরুষ-মান্ষে দশ গণ্ডা বে করলে তত ক্ষতি নাই, বরং বংশবৃদ্ধি খুব হয়। স্ত্রীলোকের একটা ছাড়া আর একটা একসঙ্গে চলে না—ফল বন্ধ্যাত্ব। কাজেই সকল দেশে স্ত্রীলোকের সতীত্বের উপর বিশেষ আগ্রহ, পুরুষের বাড়ার ভাগ। ‘প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি।’১৬
যাক, মোদ্দা এমন শহর আর ভূমণ্ডলে নাই। পূর্বকালে এ শহর ছিল আর একরূপ, ঠিক আমাদের কাশীর বাঙালীটোলার মত। আঁকাবাঁকা গলি রাস্তা, মাঝে মাঝে দুটো বাড়ী এক-করা খিলান, দ্যালের গায়ে পাতকো, ইত্যাদি। এবারকার এগজিবিশনে একটা ছোট পুরানো পারি তৈরী করে দেখিয়েছি। সে পারি কোথায় গেছে, ক্রমিক বদলেছে, এক-একবার লড়াই-বিদ্রোহ হয়েছে, কতক অংশ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, আবার পরিষ্কার নূতন ফর্দা১৭ পারি সেই স্থানে উঠেছে।
বর্তমান পারি অধিকাংশই তৃতীয় ন্যাপোলেঅঁর (Napoleon III) তৈরী। তু-ন্যাপোলেঅঁর মেরে কেটে জুলুম করে বাদশা হলেন। ফরাসীজাতি সেই প্রথম বিপ্লব (French Revolution) হওয়া অবধি সতত টলমল; কাজেই বাদশা প্রজাদের খুশী রাখবার জন্য, আর পারি নগরীর সতত-চঞ্চল গরীব লোকদের কাজ দিয়ে খুশী করবার জন্য ক্রমাগত রাস্তা ঘাট তোরণ থিয়েটার প্রভৃতি গড়তে লাগলেন। অবশ্য—পারির সমস্ত পুরাতন মন্দির তোরণ স্তম্ভ প্রভৃতি রইল; রাস্তা ঘাট সব নূতন হয়ে গেল। পুরানো শহর—পগার পাঁচিল সব ভেঙে বুলভারের (boulevards) অভ্যুদয় হতে লাগল। এবং তা হতেই শহরের সর্বোত্তম রাস্তা, পৃথিবীতে অদ্বিতীয় শাঁজেলিজে (Champs Elypsees)। রাস্তা তৈরী হল। এ রাস্তা এত বড় চওড়া যে, মধ্যখানে এবং দুপাশ দিয়ে বাগান চলেছে এবং একস্থানে অতি বৃহৎ গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়েছে—তার নাম ‘প্লাস্ দ লা কনকর্দ’ (Place de la Concorde) এই ‘প্লাস্ দ লা কনকর্দে’র চারিদিকে প্রায় সমান্তরালে ফ্রাঁসের প্রত্যেক জেলার এক এক যান্ত্রিক নারীমূর্তি। তার মধ্যে একটি মূর্তি হচ্ছে ষ্ট্রাসবুর্গ নামক জেলার। ঐ জেলা এখন ডইচ১৮(জার্মান)-রা ১৮৭২ সালের লড়ায়ের পর হতে কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সে দুঃখ ফ্রাঁসের আজও যায় না, সে মূর্তি দিনরাত প্রেতোদ্দিষ্ট ফুলমালায় ঢাকা। যে রকমের মালা লোকে আত্মীয়-স্বজনের গোরের ওপর দিয়ে আসে, সেই রকম বৃহৎ মালা দিনরাত সে মূর্তির উপর কেউ না কেউ দিয়ে যাচ্ছে।
দিল্লীর চাঁদনি-চৌক কতক অংশে এই ‘প্লাস্ দ লা কনকর্দের’ মত এককালে ছিল বলে বোধ হয়। স্থানে স্থানে জয়স্তম্ভ, বিজয়তোরণ আর বিরাট নরনারী সিংহাদি ভাস্কর্যমূর্তি। মহাবীর প্রথম ন্যাপোলেঅঁর স্মারক এক সুবৃহৎ ধাতুনির্মিত বিজয়স্তম্ভ। তার গায়ে ন্যাপোলেঅঁর সময়ের যুদ্ধ-বিজয় অঙ্কিত। ওপরে তাঁর মূর্তি। আর একস্থানে প্রাচীন দুর্গ বাস্তিল (Bastille) ধ্বংসের স্মারক চিহ্ন। তখন রাজাদের একাধিপত্য ছিল, যাকে তাকে যখন তখন জেলে পুরে দিত। বিচার না, কিছু না, রাজা এক হুকুম লিখে দিতেন; তার নাম ‘লেটর দ ক্যাশে’ (Lettre de Cachet)—মানে, রাজ-মুদ্রাঙ্কিত লিপি। তারপর সে ব্যক্তি আর কি করেছে কিনা, দোষী কি নির্দোষ, তার আর জিজ্ঞাসা-পড়া নেই, একেবারে নিয়ে পুরলে সেই বাস্তিলে; সেখান থেকে বড় কেউ আর বেরুত না। রাজাদের প্রণয়িনীরা কারু উপর চটলে রাজার কাছ থেকে ঐ শীলটা করিয়ে নিয়ে সে ব্যক্তিকে বাস্তিলে ঠেলে দিত। পরে যখন দেশসুদ্ধ লোক এ সব অত্যাচারে ক্ষেপে উঠল, ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা’, ‘সব সমান’, ‘ছোট বড় কিছুই নয় ‘—এ ধ্বনি উঠল, পারির লোক উন্মত্ত হয়ে রাজারাণীকে আক্রমণ করলে, সে সময় প্রথমেই এ মানুষের অত্যাচারের ঘোর নিদর্শন বাস্তিল ভূমিসাৎ করলে, সে স্থানটায় এক রাত ধরে নাচগান আমোদ করলে। তারপর রাজা পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁকে ধরে ফেললে, রাজার শ্বশুর অষ্ট্রীয়ার বাদশা জামায়ের সাহায্যে সৈন্য পাঠাচ্ছেন শুনে, প্রজারা ক্রোধে অন্ধ হয়ে রাজারাণীকে মেরে ফেললে, দেশসুদ্ধ লোকে ‘স্বাধীনতা সাম্যের’ নামে মেতে উঠল, ফ্রাঁস প্রজাতন্ত্র (republic) হল; অভিজাত ব্যক্তির মধ্যে যাকে ধরতে পারলে তাকেই মেরে ফেললে, কেউ কেউ উপাধি-টুপাধি ছেড়ে প্রজার দলে মিশে গেল। শুধু তাই নয়, বললে ‘দুনিয়াসুদ্ধ লোক, তোমরা ওঠ, রাজা-ফাজা অত্যাচারী সব মেরে ফেল, সব প্রজা স্বাধীন হোক, সকলে সমান হোক!’ তখন ইওরোপসুদ্ধ রাজারা ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল—এ আগুন পাছে নিজেদের দেশে লাগে, পাছে নিজেদের সিংহাসন গড়িয়ে পড়ে যায় তাই তাকে নেবাবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে চারিদিক থেকে ফ্রাঁস আক্রমণ করলে। এদিকে প্রজাতন্ত্রের কর্তৃপক্ষেরা ‘লা পাত্রি আ দাঁজে’—জন্মভূমি বিপদে—এই ঘোষণা করে দিলে; সে ঘোষণা আগুনের মত দেশময় ছড়িয়ে পড়ল। ছেলেবুড়ো, মেয়েমদ্দ ‘মার্সাইএ’ মহাগীত (La Marseillaise) গাইতে গাইতে—উৎসাহপূর্ণ ফ্রাঁসের মহাগীত গাইতে গাইতে, দলে দলে, জীর্ণবসন, সে শীতে নগ্নপদ, অত্যল্পান্ন ফরাসী প্রজা-ফৌজ বিরাট সমগ্র ইওরোপীয় চমুর সম্মুখীন হল, বড় ছোট ধনী দরিদ্র—সব বন্দুক ঘাড়ে বেরুল, ‘পরিত্রাণায় … বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্’১৯ বেরুল। সমগ্র ইওরোপ সে বেগ সহ্য করতে পারলে না। ফরাসী জাতির অগ্রে সৈন্যদের স্কন্ধে দাঁড়িয়ে এক বীর—তাঁর অঙ্গুলি-হেলনে ধরা কাঁপতে লাগল, তিনি ন্যাপোলেঅঁর।
স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব—বন্দুকের নালমুখে, তলওয়ারের ধারে ইওরোপের অস্থিমজ্জার প্রবেশ করিয়ে দিলে, তিন-রঙা ককার্ডের (Cocarde) জয় হল। তারপর ন্যাপোলেঅঁ ফ্রাঁস মহারাজ্যকে দৃঢ়বদ্ধ সাবয়ব করবার জন্য বাদশা হলেন। তারপর তাঁর কার্য শেষ হল; ছেলে হল না বলে সুখ-দুঃখের সঙ্গিনী ভাগ্যলক্ষী রাজ্ঞী জোসেফিনকে ত্যাগ করলেন, অষ্ট্রীয়ার বাদশার মেয়ে বে করলেন। জোসেফিনের সঙ্গে সঙ্গে সে ভাগ্য ফিরল, রুশ জয় করতে গিয়ে বরফে তাঁর ফৌজ মারা গেল। ইওরোপ বাগ পেয়ে তাঁকে জোর করে সিংহাসন ত্যাগ করিয়ে একটা দ্বীপে পাঠিয়ে দিলে, পুরানো রাজার বংশের একজনকে তক্তে বসালে।
মরা সিঙ্গি সে দ্বীপ থেকে পালিয়ে আবার ফ্রাঁসে হাজির হল, ফ্রাঁসসুদ্ধ লোক আবার তাঁকে মাথায় করে নিলে, রাজা পালাল। কিন্তু অদৃষ্ট ভেঙেছে, আর জুড়ল না—আবার ইওরোপসুদ্ধ পড়ে তাঁকে হারিয়ে দিলে, ন্যাপোলেঅঁ ইংরেজদের এক জাহাজে উঠে শরণাগত হলেন; ইংরেজরা তাঁকে ‘সেণ্ট হেলেনা’ নামক দূর একটা দ্বীপে বন্দী রাখলে—আমরণ। আবার পুরানো রাজা এল, তার ভাইপো রাজা হল। আবার ফ্রাঁসের লোক ক্ষেপে উঠল, রাজা-ফাজা তাড়িয়ে দিলে, আবার প্রজাতন্ত্র হল। মহাবীর ন্যাপোলেঅঁর এক ভাইপো এ-সময়ে ক্রমে ফ্রাঁসের প্রীতি-পাত্র হলেন, ক্রমে একদিন ষড়যন্ত্র করে নিজেকে বাদশা ঘোষণা করলেন। তিনি ছিলেন তৃতীয় ন্যাপোলেঅঁ; দিন কতক তাঁর খুব প্রতাপ হল। কিন্তু জার্মান-যুদ্ধে হেরে তাঁর সিংহাসন গেল, আবার ফ্রাঁস প্রজাতন্ত্র হল। সেই অবধি প্রজাতন্ত্র চলেছে।