[মান্দ্রাজের ভিক্টোরিয়া হলে প্রদত্ত]
সেদিন অত্যধিক লোকসমাগমের দরুন বক্তৃতায় বেশী অগ্রসর হইতে পারি নাই, সুতরাং আজ এই অবসরে আমি মান্দ্রাজবাসিগণের নিকট বরাবর যে সদয় ব্যবহার পাইয়াছি, সেজন্য তাঁহাদিগকে ধন্যবাদ দিতেছি। অভিনন্দনপত্রগুলিতে আমার প্রতি যে-সকল সুন্দর সুন্দর বিশেষণ প্রযুক্ত হইয়াছে, তাহার জন্য আমি কিভাবে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিব জানি না, তবে প্রভুর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাকে ঐ বিশেষণগুলির যোগ্য করেন, আর আমি যেন সারা জীবন আমাদের ধর্ম ও মাতৃভূমির সেবা করিতে পারি। প্রভু যেন আমাকে এই কার্যের যোগ্য করেন।
ভদ্রমহোদয়গণ, আমার মনে হয়, অনেক দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও আমার কিছুটা সাহস আছে। ভারত হইতে পাশ্চাত্যদেশে বহন করিবার জন্য আমার একটি বার্তা ছিল—আমি নির্ভীকচিত্তে মার্কিন ও ইংরেজ জাতিকে সেই বার্তা, সেই বাণী শ্রবণ করাইয়াছি। অদ্যকার বিষয় আরম্ভ করিবার পূর্বে আমি তোমাদের সকলের নিকট সাহসপূর্বক কয়েকটি কথা বলিতে চাই। কিছুদিন যাবৎ কতকগুলি ব্যাপার এমন দাঁড়াইতেছে যে, ঐগুলির জন্য আমার কাজে বিশেষ বিঘ্ন ঘটিতেছে। এমনকি সম্ভব হইলে আমাকে একেবারে পিষিয়া ফেলিয়া আমার অস্তিত্ব উড়াইয়া দিবার চেষ্টাও চলিয়াছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এই-সব চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে—আর এইরূপ চেষ্টা চিরদিনই বিফল হইয়া থাকে। গত তিন বৎসর যাবৎ দেখিতেছি, জনকয়েক ব্যক্তির আমার ও আমার কার্য সম্বন্ধে কিছুটা ভ্রান্ত ধারণা হইয়াছে। যতদিন বিদেশে ছিলাম, ততদিন চুপ করিয়াছিলাম, এমন কি একটি কথাও বলি নাই। কিন্তু এখন মাতৃভূমিতে দাঁড়াইয়া এ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বুঝাইয়া বলা আবশ্যক বোধ হইতেছে। এ কথাগুলির কি ফল হইবে, তাহা আমি গ্রাহ্য করি না; এ কথাগুলি বলার দরুন তোমাদের হৃদয়ে কি ভাবের উদ্রেক হইবে, তাহাও গ্রাহ্য করি না। লোকের মতামত আমি কমই গ্রাহ্য করিয়া থাকি। চার বৎসর পূর্বে দণ্ড-কমণ্ডলু-হস্তে সন্ন্যাসিবেশে তোমাদের শহরে প্রবেশ করিয়াছিলাম—আমি সেই সন্ন্যাসীই আছি। সারা দুনিয়া আমার সামনে এখনও পড়িয়া আছে। আর অধিক ভূমিকার প্রয়োজন নাই—এখন আমার বক্তব্য বিষয় বলিতে আরম্ভ করি।
প্রথমতঃ থিওজফিক্যাল সোসাইটি (Theosophical Society) সম্বন্ধে আমার কিছু বলিবার আছে। বলাই বাহুল্য যে, উক্ত সোসাইটির দ্বারা ভারতে কিছু কাজ হইয়াছে। এ কারণে প্রত্যেক হিন্দুই ইহার নিকট, বিশেষতঃ মিসেস বেস্যাণ্টের নিকট কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। মিসেস বেস্যাণ্ট সম্বন্ধে যদিও আমার অল্পই জানা আছে, তথাপি আমি যতটুকু জানি, তাহাতেই নিশ্চয় বুঝিয়াছি যে, তিনি আমাদের মাতৃভূমির একজন অকপট শুভাকাঙ্ক্ষিণী, আর সাধ্যানুসারে তিনি প্রাণপণ আমাদের দেশের উন্নতির জন্য চেষ্টা করিতেছেন। ইহার জন্য প্রত্যেক যথার্থ ভারতসন্তান তাঁহার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকিবেন; তাঁহার ও তৎসম্পর্কীয় সকলের উপরেই ঈশ্বরের আশীর্বাদ চিরকাল বর্ষিত হউক। কিন্তু এ এক কথা, আর থিওজফিস্টদের সোসাইটিতে যোগ দেওয়া আর এক কথা। ভক্তি-শ্রদ্ধা- ভালবাসা এক কথা, আর কোন ব্যক্তি যাহা কিছু বলিবে তর্কযুক্তি না করিয়া, বিচার না করিয়া বিনা বিশ্লেষণে সবই গিলিয়া ফেলা আর এক কথা।
একটা কথা চারিদিকে প্রচারিত হইতেছে যে, আমি আমেরিকা ও ইংলণ্ডে যে সামান্য কাজ করিয়াছি, থিওজফিস্টগণ তাহাতে আমার সহায়তা করিয়াছিলেন। আমি তোমাদিগকে স্পষ্ট ভাষায় বলিতেছি, এ-কথা সর্বৈব মিথ্যা। এই জগতে উদার ভাব এবং ‘মতভেদ সত্ত্বেও সহানুভূতি’ সম্বন্ধে আমরা অনেক লম্বা লম্বা কথা শুনিতে পাই। বেশ কথা, কিন্তু আমরা কার্যতঃ দেখিতে পাই, যতক্ষণ একজন অপর ব্যক্তির সব কথায় বিশ্বাস করে, ততক্ষণই ঐ ব্যক্তি তাহার প্রতি সহানুভূতি করিয়া থাকে। যখনই কেহ কোন বিষয়ে ভিন্ন মত অবলম্বন করিতে সাহস করে, তখনই সেই সহানুভূতি চলিয়া যায়, ভালবাসা উড়িয়া যায়।
আরও অনেক আছে, তাহাদের নিজেদের এক-একটা স্বার্থ আছে। যদি কোন দেশে এমন কিছু ব্যাপার ঘটে যাহাতে তাহাদের স্বার্থে আঘাত লাগে, তবে তাহাদের ভিতর প্রভূত ঈর্ষা ও ঘৃণার আবির্ভাব হয়; তাহারা তখন কি করিবে, কিছুই ভাবিয়া পায় না। হিন্দুরা নিজেদের ঘর নিজেরা পরিষ্কার করিবার চেষ্টা করিতেছে, তাহাতে খ্রীষ্টান মিশনারীদের ক্ষতি কি? হিন্দুরা প্রাণপণে নিজেদের সংস্কার-সাধনের চেষ্টা করিতেছে—তাহাতে ব্রাহ্মসমাজ ও অন্যান্য সংস্কার-সভাগুলির কি অনিষ্ট হইবে? ইঁহারা কেন হিন্দুদের সংস্কার-চেষ্টায় বিরোধী হইবেন?ইঁহারা কেন এই-সব আন্দোলনের প্রবল শত্রু হইয়া দাঁড়াইবেন? ‘কেন?’—আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি। আমার বোধ হয়, তাঁহাদের ঘৃণা ও ঈর্ষার পরিমাণ এত অধিক যে, এ-বিষয়ে তাঁহাদের নিকট কোনরূপ প্রশ্ন করা সম্পূর্ণ নিরর্থক।
প্রথমে থিওজফিস্টদের কথা বলি। চার বৎসর পূর্বে যখন থিওজফিক্যাল সোসাইটির নেতার নিকট গমন করি—তখন আমি একজন দরিদ্র অপরিচিত সন্ন্যাসী মাত্র, একজনও বন্ধু-বান্ধব নাই, সাত সমুদ্র তের নদী পার হইয়া আমাকে আমেরিকায় যাইতে হইবে, কিন্তু কাহারও নামে লিখিত কোনপ্রকার পরিচয়পত্র নাই। আমি স্বভাবতই ভাবিয়াছিলাম, ঐ নেতা যখন একজন মার্কিন এবং ভারতপ্রেমিক, তখন সম্ভবতঃ তিনি আমাকে আমেরিকায় কাহারও নিকট পরিচয়পত্র দিতে পারেন। কিন্তু তাঁহার নিকট গিয়া ঐরূপ পরিচয়পত্র প্রার্থনা করায় তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কি আমাদের সোসাইটিতে যোগ দিবে?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘না, আমি কিরূপে আপনাদের সোসাইটিতে যোগ দিতে পারি? আমি আপনাদের অনেক মতই যে বিশ্বাস করি না।’ তিনি বলিলেন, ‘তবে যাও, তোমার জন্য আমি কিছু করিতে পারিব না।’ ‘ইহাই কি আমার পথ করিয়া দেওয়া? আমার থিওজফিষ্ট বন্ধুগণের কেহ যদি এখানে থাকেন, তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, ইহাই কি আমার পথ করিয়া দেওয়া?
যাহা হউক, আমি মান্দ্রাজের কয়েকটি বন্ধুর সাহায্যে আমেরিকায় পৌঁছিলাম। তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই এখানে উপস্থিত আছেন, কেবল একজন অনুপস্থিত দেখিতেছি—বিচারপতি সুব্রহ্মণ্য আয়ার। আর আমি এই সভায় উক্ত ভদ্রমহোদয়ের উদ্দেশে আমার গভীরতম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি, তাঁহার মধ্যে প্রতিভাশালী পুরুষের অন্তর্দৃষ্টি বিদ্যমান, আর এ জীবনে তাঁহার ন্যায় বিশ্বাসী বন্ধু আমি পাই নাই—তিনি ভারতমাতার একজন যথার্থ সুসন্তান। যাহা হউক, আমি আমেরিকায় পৌঁছিলাম। টাকা আমার নিকট অতি অল্পই ছিল—আর ধর্মমহাসভা বসিবার পূর্বেই সব খরচ হইয়া গেল। এদিকে শীত আসিতেছে। আমার শুধু গ্রীষ্মোপযোগী একখানি পাতলা পরিধেয় ছিল। একদিন আমার হাত হিমে আড়ষ্ট হইয়া গেল। এই ঘোরতর শীতপ্রধান দেশে আমি যে কি করিব, তাহা ভাবিয়া পাইলাম না। কারণ যদি রাস্তায় ভিক্ষায় বাহির হই, তবে আমাকে জেলে পাঠাইয়া দিবে। তখন আমার নিকট শেষ সম্বল কয়েকটি ডলার মাত্র ছিল। আমি মান্দ্রাজে কয়েকজন বন্ধুর নিকট তার করিলাম। থিওজফিস্টরা এই ব্যপারটি জানিতে পারিলেন; তাঁহাদের মধ্যে একজন লিখিয়াছিলেন, ‘শয়তানটা শীঘ্রই মরিবে—ঈশ্বরেচ্ছায় বাঁচা গেল।’ ইহাই কি আমার জন্য পথ করিয়া দেওয়া?
আমি এখন এ-সব কথা বলিতাম না, কিন্তু হে আমার স্বদেশবাসিগণ, আপনারা জোর করিয়া ইহা বাহির করিলেন। আমি তিন বৎসর এ বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য করি নাই। নীরবতাই ছিল আমার মূলমন্ত্র, কিন্তু আজ ইহা বাহির হইয়া পড়িল। শুধু তাহাই নহে, আমি ধর্মমহাসভায় কয়েকজন থিওজফিস্টকে দেখিলাম। আমি তাঁহাদের সহিত কথা কহিতে— তাঁহাদের সহিত মিশিতে চেষ্টা করিলাম। তাঁহারা প্রত্যেকেই যে-অবজ্ঞাদৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিলেন, তাহা এখনও আমার স্মরণ আছে। তাঁহাদের সেই অবজ্ঞাদৃষ্টিতে যেন প্রকাশ পাইতেছিল—‘এ একটা ক্ষুদ্র কীট; এ আবার দেবতার মধ্যে কিরূপে আসিল?’ ইহাতে কি আমার পথ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল—বলুন, হইয়াছিল কি?
অতঃপর ধর্মমহাসভায় আমার নামযশ হইল। তখন হইতে প্রচণ্ড কার্যের সূত্রপাত হইল। যে-শহরেই আমি যাই, সেখানেই এই থিওজফিস্টরা আমাকে দাবাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। তাহাদের সদস্যগণকে আমার বক্তৃতা শুনিতে নিষেধ করা হইত, আমার বক্তৃতা শুনিতে আসিলেই তাহারা সোসাইটির সহানুভূতি হারাইবে। কারণ ঐ সোসাইটির এসোটেরিক (গুপ্তসাধনা) বিভাগের মত এইঃ যে-কেহ উহাতে যোগ দিবে, তাহাকে কেবলমাত্র ‘কুথুমি ও মোরিয়ার’—তাঁহারা যাহাই হউন, তাঁহাদের নিকট হইতেই শিক্ষা লইতে হইবে। অবশ্য ইঁহারা অপ্রত্যক্ষ, আর ইঁহাদের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি—মিঃ জজ্ ও মিসেস বেস্যাণ্ট। সুতরাং এসোটেরিক বিভাগে যোগ দেওয়ার অর্থ এই যে, নিজের স্বাধীন চিন্তা একেবারে বিসর্জন দিয়া সম্পূর্ণভাবে ইঁহাদের নিকট আত্মসমর্পণ করা। অবশ্য আমি কখনই এরূপ করিতে পারিতাম না, আর যে-ব্যক্তি এরূপ করে, তাহাকে হিন্দু বলিতেও পারি না।
তারপর থিওজফিস্টদের নিজেদের ভিতরই গণ্ডগোল আরম্ভ হইল। পরলোকগত মিঃ জজের উপর আমার খুব শ্রদ্ধা আছে। তিনি একজন গুণবান, সরল, অকপট প্রতিপক্ষ ছিলেন; আর তিনি থিওজফিস্টদের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। তাঁহার সহিত মিসেস বেস্যাণ্টের যে বিরোধ হইয়াছিল, তাহাতে আমার কোনরূপ রায় দিবার অধিকার নাই, কারণ উভয়েই নিজ নিজ ‘মহাত্মা’র বাক্যকে সত্য বলিয়া দাবী করিতেছেন। সমগ্র ব্যাপারের মধ্যে আশ্চর্য এই যে, উভয়ে একই মহাত্মাকে দাবী করিতেছেন। ঈশ্বর জানেন সত্য কী; তিনিই একমাত্র বিচারক, আর যেখানে উভয়ের পক্ষেই যুক্তিপ্রমাণ সমতুল্য, সেখানে একদিকে বা অন্যদিকে ঝুঁকিয়া রায় দিবার অধিকার কাহারও নাই। এইরূপে তাঁহারা দুই বৎসর ধরিয়া সমগ্র আমেরিকায় আমার জন্য পথ প্রস্তুত করিয়াছিলেন! তারপর তাঁহারা—অপর বিরুদ্ধপক্ষ খ্রীষ্টান মিশনারিদের সহিত যোগ দিলেন। এই শেষোক্তেরা আমার বিরুদ্ধে এরূপ ভয়ানক মিথ্যা সংবাদ রটাইয়াছিল, যাহা কল্পনাতেও আনিতে পারা যায় না। তাহারা আমাকে প্রত্যেক বাড়ি হইতে তাড়াইবার চেষ্টা করিতে লাগিল এবং যে-কেহ আমার বন্ধু হইল, তাহাকেই আমার শত্রু করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। আমাকে তাড়াইয়া দিতে এবং অনশনে মারিয়া ফেলিতে তাহারা আমেরিকাবাসী সকলকে বলিতে লাগিল।
আর আমার বলিতে লজ্জা হইতেছে যে, আমার একজন স্বদেশবাসী ইহাতে যোগ দিয়াছিলেন—তিনি ভারতের সংস্কারকদলের একজন নেতা। ইনি প্রতিদিনই প্রচার করিতেছেন, খ্রীষ্ট ভারতে আসিয়াছেন। খ্রীষ্ট কি এইরূপেই ভারতে আসিবেন? ইহাই কি ভারত সংস্কারের উপায়? আমি ইঁহাকে অতি বাল্যকাল হইতেই জানিতাম, তিনি আমার একজন পরম বন্ধু ছিলেন। অনেক বৎসর যাবৎ আমার সহিত এই স্বদেশবাসীর সাক্ষাৎ হয় নাই, সুতরাং তাঁহাকে দেখিয়া আমার বড়ই আনন্দ হইল, আমি যেন হাতে স্বর্গ পাইলাম। কিন্তু তাঁহারই নিকট আমি এই ব্যবহার পাইলাম! যেদিন ধর্ম-মহাসভায় আমি প্রশংসা পাই, যেদিন চিকাগোয় আমি সকলের প্রিয় হই, সেই দিন হইতে তাঁর সুর বদলাইয়া গেল; তিনি প্রচ্ছন্নভাবে আমার অনিষ্ট করিতে, আমাকে অনশনে মারিয়া ফেলিতে, আমেরিকা হইতে তাড়াইয়া দিতে সাধ্যমত চেষ্টা করিতে লাগিলেন। জিজ্ঞাসা করি, খ্রীষ্ট কি এইরূপেই ভারতে আসিবেন? জিজ্ঞাসা করি, বিশ বৎসর খ্রীষ্টের পদতলে বসিয়া তিনি কি এই শিক্ষাই পাইয়াছেন? আমাদের বড় বড় সংস্কারকগণ যে বলিয়া থাকেন, খ্রীষ্টধর্ম এবং খ্রীষ্টশক্তি ভারতবাসিগণের উন্নতিবিধান করিবে, তাহা কি এইরূপে হইবে? অবশ্য যদি ঐ ভদ্রলোককে উহার দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরা যায়, তবে বড় আশা আছে বলিয়া বোধ হয় না।
আর এক কথা। আমি সমাজ-সংস্কারকগণের মুখপত্রে পড়িলাম যে, তাঁহারা বলিতেছেন, আমি শূদ্র, আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেনঃ শূদ্রের সন্ন্যাসী হইবার কি অধিকার আছে? ইহাতে আমার উত্তর এইঃ যদি তোমরা তোমাদের পুরাণ বিশ্বাস কর, তবে জানিও—আমি সেই মহাপুরুষের বংশধর, যাঁহার পদে প্রত্যেক ব্রাহ্মণ ‘যমায় ধর্মরাজায় চিত্রগুপ্তায় বৈ নমঃ’ মন্ত্র উচ্চারণসহকারে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করেন, আর যাঁহার বংশধরগণ বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয়। এই বাঙালী সংস্কারকগণ জানিয়া রাখুন, আমার জাতি অন্যান্য নানা উপায়ে ভারতের সেবা ব্যতীত শত শত শতাব্দী ধরিয়া ভারতের অর্ধাংশ শাসন করিয়াছিল। যদি আমার জাতিকে বাদ দেওয়া যায়, তবে ভারতের আধুনিক সভ্যতার কতটুকু অবশিষ্ট থাকে? কেবল বাঙলা দেশেই আমার জাতি হইতে সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক, সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক, সর্বশ্রেষ্ঠ প্রত্নতত্ত্ববিৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মপ্রচারকগণের অভ্যুদয় হইয়াছে। আমার জাতি হইতেই আধুনিক ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকের অভ্যুদয় হইয়াছে। উক্ত সম্পাদকের আমাদের দেশের ইতিহাস কতকটা জানা উচিত ছিল। আমাদের তিন বর্ণ সম্বন্ধে তাঁহার কিছু জ্ঞান থাকা উচিত ছিল; তাঁহার জানা উচিৎ ছিল যে, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য—তিন বর্ণেরই সন্ন্যাসী হইবার সমান অধিকার, ত্রৈবর্ণিকেরই বেদে সমান অধিকার। এ-সব কথা প্রসঙ্গক্রমে উপস্থিত হইল বলিয়াই বলিলাম। আমি পূর্বোক্ত শ্লোকটি উদ্ধৃত করিয়াছি মাত্র, কিন্তু আমাকে শূদ্র বলিলে আমার বাস্তবিক কোন দুঃখ নাই। আমার পূর্বপুরুষগণ দরিদ্রগণের উপর যে অত্যাচার করিয়াছেন, ইহা তাহারই কিঞ্চিৎ প্রতিশোধস্বরূপ হইবে।
যদি আমি অতি নীচ চণ্ডাল হইতাম, তাহা হইলে আমার আরও অধিক আনন্দ হইত; কারণ আমি যাঁহার শিষ্য, তিনি একজন অতি শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হইলেও এক অস্পৃশ্য মেথরের গৃহ পরিষ্কার করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন। ঐ ব্যক্তি অবশ্য ইহাতে সম্মত হয় নাই—কি করিয়াই বা হইবে? এই ব্রাহ্মণ আবার সন্ন্যাসী, তিনি আসিয়া তাহার ঘর পরিষ্কার করিবেন—ইহাতে কি সে কখনও সম্মত হইতে পারে? সুতরাং গভীর রাত্রে অজ্ঞাতভাবে তাহার গৃহে প্রবেশ করিয়া তিনি পায়খানা পরিষ্কার করিতেন এবং তাঁহার বড় বড় চুল দিয়া সেই স্থান মুছিতেন। দিনের পর দিন এইরূপ করিতেন, যাহাতে তিনি নিজেকে সকলের দাস—সকলের সেবক করিয়া তুলিতে পারেন। সেই ব্যক্তির শ্রীচরণ আমি মস্তকে ধারণ করিয়া আছি। তিনিই আমার আদর্শ—আমি সেই আদর্শ পুরুষের জীবন অনুকরণ করিতে চেষ্টা করি।
হিন্দুরা এইরূপেই তোমাদিগকে ও সর্বসাধারণকে উন্নত করিবার চেষ্টা করেন এবং তাঁহারা ইহাতে বৈদেশিক ভাবের কিছুমাত্র সহায়তা গ্রহণ করেন না। বিশ বৎসর পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসিয়া এমন চরিত্র গঠিত হইয়াছে যে, কেবল বন্ধুর কিছু মানযশ হইয়াছে বলিয়া, সে তাহার অর্থোপার্জনের বিঘ্নস্বরূপ দাঁড়াইয়াছে মনে করিয়া বিদেশে তাহাকে অনাহারে মারিয়া ফেলিবার চেষ্টা করে! আর খাঁটি পুরাতন হিন্দুধর্ম কিরূপে কাজ করে, অপরটি তাহার উদাহরণ। আমাদের সংস্কারকগণের মধ্যে কেহ সেই জীবন দেখান, নীচজাতির পায়খানা সাফ ও চুল দিয়া উহা মুছিয়া ফেলিতে প্রস্তুত হউন, তবেই আমি তাঁহার পদতলে বসিয়া উপদেশ গ্রহণ করিব, তাহার পূর্বে নহে। সামান্য এতটুকু কাজ হাজার হাজার লম্বা কথার সমতুল।
এখন আমি মান্দ্রাজের সংস্কার-সভাগুলির কথা বলিব। তাঁহারা আমার প্রতি বড়ই সদয় ব্যবহার করিয়াছেন। তাঁহারা আমার প্রতি অনেক সহৃদয় বাক্য প্রয়োগ করিয়াছেন এবং বাঙলা ও মান্দ্রাজের সংস্কারকগণের মধ্যে যে একটা প্রভেদ আছে, সেই বিষয়ে তাঁহারা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন, আর আমি এ বিষয়ে তাঁহাদের সহিত একমত। তোমাদের মধ্যে অনেকের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে যে, তোমাদিগকে আমি অনেকবার বলিয়াছি—মান্দ্রাজের এখন বড়ই সুন্দর অবস্থা। বাঙলায় যেমন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলিয়াছে, এখানে সেরূপ হয় নাই। এখানে বরাবর ধীর অথচ নিশ্চিতভাবে সর্ববিষয়ে উন্নতি হইয়াছে, এখানে সমাজের ক্রমশঃ বিকাশ হইয়াছে, কোনরূপ প্রতিক্রিয়া হয় নাই। অনেক স্থলে এবং কতক পরিমাণে বাঙলা দেশে পুরাতনের পুনরুত্থান হইয়াছে বলা যাইতে পারে, কিন্তু মান্দ্রাজের উন্নতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিকভাবে হইতেছে। সুতরাং এখানকার সংস্কারকগণ দুই প্রদেশের সমাজ-সংস্কার ব্যাপারে যে প্রভেদ দেখান, সে-বিষয়ে আমি তাঁহাদের সহিত সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু আমার সহিত তাঁহাদের এক বিষয়ে মতভেদ আছে—সেটি তাঁহারা বুঝেন না।
আমার আশঙ্কা হয়, কতকগুলি সংস্কার-সমিতি আমাকে ভয় দেখাইয়া তাঁহাদের সহিত যোগ দিতে বাধ্য করিবার চেষ্টা করিতেছেন। তাঁহাদের পক্ষে এরূপ চেষ্টা বড় আশ্চর্যের বিষয় বলিতে হইবে। যে-ব্যক্তি চতুর্দশ বৎসর ধরিয়া অনাহারে মৃত্যুর সহিত যুদ্ধ করিয়াছে, যে-ব্যক্তি এতদিন ধরিয়া কাল কি খাইবে, কোথায় শুইবে—তাহার কিছু ঠিক ছিল না, তাহাকে এত সহজে ভয় দেখানো যাইতে পারে না। যে ব্যক্তি [বিদেশে] একরূপ বিনা পরিচ্ছদে হিমাঙ্কের ৩০ ডিগ্রী নীচে বাস করিতে সাহসী হইয়াছিল, যাহার সেখানেও কাল কি খাইবে—কিছুই ঠিক ছিল না, তাহাকে ভারতে এত সহজে ভয় দেখানো যাইতে পারে না। আমি তাঁহাদিগকে প্রথমেই বলিতে চাই যে, তাঁহারা জানিয়া রাখুন—আমার নিজের একটু দৃঢ়তা আছে, আমার নিজের একটু অভিজ্ঞতাও আছে, আর জগতের নিকট আমার কিছু বার্তা বহন করিবার আছে; আমি নির্ভয়ে ও ভবিষ্যতের কিছুমাত্র চিন্তা না করিয়া সেই মঙ্গলবার্তা মানুষকে দিয়া যাইব।
সংস্কারকগণকে আমি বলিতে চাই, আমি তাঁহাদের অপেক্ষা একজন বড় সংস্কারক। তাঁহারা একটু-আধটু সংস্কার করিতে চান—আমি চাই আমূল সংস্কার। আমাদের পার্থক্য কেবল সংস্কারের প্রণালীতে। তাঁহাদের প্রণালী—ভাঙিয়া-চুরিয়া ফেলা, আমার পদ্ধতি—সংগঠন। আমি সাময়িক সংস্কারে বিশ্বাসী নই, আমি স্বাভাবিক উন্নতিতে বিশ্বাসী। আমি নিজেকে ঈশ্বরের স্থানে বসাইয়া সমাজকে এই বলিয়া আদেশ করিতে সাহস করি না যে, ‘তোমায় এদিকে চলিতে হইবে, ওদিকে নয়।’ আমি কেবল সেই কাঠবিড়ালের মত হইতে চাই, যে রামচন্দ্রের সেতুবন্ধনের সময় যথাসাধ্য এক অঞ্জলি বালুকা বহন করিয়াই নিজেকে কৃতার্থ মনে করিয়াছিল—ইহাই আমার ভাব।
এই অদ্ভুত জাতীয় যন্ত্র শত শতাব্দী যাবৎ কাজ করিয়া আসিতেছে, এই অদ্ভুত জাতীয় জীবন-নদী আমাদের সম্মুখে প্রবাহিত হইতেছে—কে জানে, কে সাহস করিয়া বলিতে পারে, উহা ভাল কি মন্দ বা কিরূপে উহার গতি নিয়মিত হওয়া উচিত? সহস্র ঘটনাচক্র উহাকে বিশেষরূপে বেগবিশিষ্ট করিয়াছে, তাই কখনও উহা মৃদু—কখনও-বা দ্রুত গতি-বিশিষ্ট হইতেছে। কে উহার গতি নিয়মিত করিতে সাহস করে? গীতার উপদেশ অনুসারে আমাদিগকে কেবল কর্ম করিয়া যাইতে হইবে, ফলাফলের চিন্তা একেবারে পরিত্যাগ করিয়া শান্তচিত্তে অবস্থান করিতে হইবে। জাতীয় জীবনের পুষ্টির জন্য যাহা আবশ্যক তাহা করিয়া যাও, কিন্তু জাতীয় জীবন স্বীয় প্রকৃতি অনুযায়ী বিকশিত হইবে, কাহারও সাধ্য নাই—‘এইরূপে বিকশিত হও’ বলিয়া উপদেশ দিতে পারে।
আমাদের সমাজে যথেষ্ট দোষ আছে; অন্যান্য সমাজেও আছে। এখানে বিধবার অশ্রুপাতে সময় সময় ধরিত্রী সিক্ত হয়, সেখানে—পাশ্চাত্যদেশে অনূঢ়া কুমারীগণের দীর্ঘনিঃশ্বাসে বায়ু বিষাক্ত। এখানে জীবন দারিদ্র্যবিষে জর্জরিত, সেখানে বিলাসিতার অবসাদে সমগ্র জাতি জীবন্মৃত; এখানে লোক না খাইতে পাইয়া আত্মহত্যা করিতে যায়, সেখানে খাদ্যদ্রব্যের প্রাচুর্যে লোক আত্মহত্যা করিয়া থাকে। দোষ সর্বত্র বিদ্যমান। ইহা পুরাতন বাতরোগের মত, পা হইতে দূর করিলে মাথায় ধরে; মাথা হইতে তাড়াইলে উহা আবার অন্যত্র আশ্রয় লয়। কেবল এখান হইতে ওখানে তাড়াইয়া বেড়ানো মাত্র—এইটুকুই করা যায়।
হে বালকগণ, অনিষ্টের মূলোচ্ছেদই প্রকৃত উপায়। আমাদের দর্শনশাস্ত্র শিক্ষা দেয়—ভাল ও মন্দ নিত্যসংযুক্ত, এক জিনিসের এপিঠ-ওপিঠ। একটি লইলে অন্যটিকে লইতেই হইবে। সমুদ্রে একটা ঢেউ উঠিল—বুঝিতে হইবে কোথাও-না-কোথাও জল খানিকটা নামিয়াছে। শুধু তাই নয়, সমুদয় জীবনই দুঃখময়। কাহারও প্রাণনাশ না করিয়া নিঃশ্বাস- প্রশ্বাস গ্রহণ পর্যন্ত অসম্ভব; কাহাকেও বঞ্চিত না করিয়া এক টুকরা খাদ্যও গ্রহণ করা যায় না। ইহাই প্রকৃতির বিধান, ইহাই জীবন-দর্শন।
এই কারণে আমাদিগকে এইটুকু বুঝিতে হইবে যে, সামাজিক ব্যাধির প্রতিকার বাহিরের চেষ্টা দ্বারা হইবে না, মনের উপর কার্য করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। আমরা যতই লম্বা লম্বা কথা বলি না কেন, বুঝিতে হইবে সমাজের দোষ সংশোধন করিতে হইলে প্রত্যক্ষভাবে চেষ্টা না করিয়া শিক্ষাদানের দ্বারা পরোক্ষভাবে উহার চেষ্টা করিতে হইবে। সমাজের দোষ সংশোধন সম্বন্ধে প্রথমে এই তত্ত্বটি বুঝিতে হইবে; এই তত্ত্ব বুঝিয়া আমাদের মনকে শান্ত করিতে হইবে, ইহা বুঝিয়া আমাদের রক্ত হইতে ধর্মান্ধতা একেবারে দূর করিয়া আমাদিগকে শান্ত—উত্তেজনাশূন্য হইতে হইবে। পৃথিবীর ইতিহাসও আমাদিগকে শিক্ষা দিতেছে যে, যেখানেই এইরূপ উত্তেজনার সহায়তায় কোন সংস্কার করিবার চেষ্টা হইয়াছে, সেইখানেই এই মাত্র ফল দাঁড়াইয়াছে যে, যে-উদ্দেশ্যে সংস্কার-চেষ্টা, সেই উদ্দেশ্যেই বিফল হইয়াছে। আমেরিকায় দাস-ব্যবসায় রহিত করিবার জন্য যে যুদ্ধ হইয়াছিল, মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ইহা অপেক্ষা বৃহত্তর আন্দোলন কল্পনা করা যাইতে পারে না; তোমাদের সকলেরই উহা জানা আছে। কিন্তু ইহার ফল কি হইয়াছে। দাস-ব্যবসায় রহিত হইবার পূর্বে দাসদের যে অবস্থা ছিল, পরে তাহাদের অবস্থা পূর্বাপেক্ষা শতগুণ মন্দ হইয়াছে। দাস-ব্যবসায় রহিত হইবার পূর্বে এই হতভাগ্য নিগ্রোগণ ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হইত—নিজ সম্পত্তিরনাশের আশঙ্কায় অধিকারিগণকে দেখিতে হইত, যাহাতে তাহারা দুর্বল ও অকর্মণ্য হইয়া না পড়ে। কিন্তু এখন তাহারা কাহারও সম্পত্তি নয়, তাহাদের জীবনের এখন কিছুমাত্র মূল্য নাই; এখন সামান্য ছুতা করিয়া তাহাদিগকে জীবন্ত পুড়াইয়া ফেলা হয়, গুলি করিয়া মারিয়া ফেলা হয়; কিন্তু হত্যাকারীর শাস্তির জন্য কোন আইন নাই, কারণ নিহত ব্যক্তি যে ‘নিগার’—ইহারা মানুষ নহে, এমন কি পশু-নামেরও যোগ্য নহে। আইনের দ্বারা অথবা প্রবল উত্তেজনাপূর্ণ আন্দোলনের দ্বারা কোন সামাজিক দোষ প্রতিকার করিবার চেষ্টার ফল এইরূপই হইয়া থাকে।
কোন কল্যাণসাধনের জন্য এইরূপ উত্তেজনাপ্রসূত আন্দোলনের বিরুদ্ধে ইতিহাসের এই সাক্ষ্য বিদ্যমান। আমি ইহা দেখিয়াছি, নিজ অভিজ্ঞতা হইতে আমি ইহা শিখিয়াছি। এই কারণেই আমি এইরূপ দোষারোপকারী কোন সমিতির সহিত যোগ দিতে পারি না। দোষারোপ বা নিন্দাবাদের প্রয়োজন কি? সকল সমাজেই দোষ আছে; সকলেই তাহা জানে। আজকালকার ছোট ছেলে পর্যন্ত তাহা জানে। সেও মঞ্চে দাঁড়াইয়া হিন্দুসমাজের গুরুতর দোষগুলি সম্বন্ধে আমাদিগকে রীতিমত একটি বক্তৃতা শুনিয়া দিতে পারে। যে-কোন অশিক্ষিত বৈদেশিক এক নিঃশ্বাসে ভূপ্রদক্ষিণ করিবার পথে ভারতে আসিয়া থাকেন, তিনিই তাড়াতাড়ি রেলভ্রমণের পর ভারতবর্ষের মোটামুটি একটা ধারণা করিয়া লইয়া ভারতের ভয়াবহ অনিষ্টকর প্রথাসম্বন্ধে খুব পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা দিয়া থাকেন। আমরা তাঁহাদের কথা স্বীকার করিয়া থাকি। সকলেই দোষ দেখাইয়া দিতে পারে; কিন্তু যিনি এই সমস্যা হইতে উত্তীর্ণ হইবার পথ দেখাইয়া দিতে পারেন, তিনিই মানবজাতির যথার্থ বন্ধু। সেই জলমগ্ন বালক ও দার্শনিকের গল্পে—দার্শনিক যখন বালককে গম্ভীরভাবে উপদেশ দিতেছিলেন, তখন সেই বালক যেমন বলিয়াছিল, ‘আগে আমাকে জল হইতে তুলুন, পরে আপনার উপদেশ শুনিব,’ সেইরূপ এখন আমাদের দেশের লোক চীৎকার করিয়া বলিতেছে, ‘আমরা যথেষ্ট বক্তৃতা শুনিয়াছি, অনেক সমিতি দেখিয়াছি, ঢের কাগজ পড়িয়াছি; এখন আমরা এমন লোক চাই, যিনি আমাদের হাত ধরিয়া এই মহাপঙ্ক হইতে টানিয়া তুলিতে পারেন। এমন লোক কোথায়? এমন লোক কোথায়, যিনি আমাদিগকে যথার্থ ভালবাসেন? এমন লোক কোথায়, যিনি আমাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন?’ এইরূপ লোক চাই। এইখানেই আমার এই-সকল সংস্কার-আন্দোলনের সহিত সম্পূর্ণ মতভেদ। প্রায় শত বর্ষ ধরিয়া এই সংস্কার-আন্দোলন চলিতেছে। কিন্তু উহা দ্বারা অতিশয় নিন্দা ও বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্যবিশেষের সৃষ্টি ব্যতীত কী উপকার হইয়াছে? ঈশ্বরেচ্ছায় ইহা না হইলেই ভাল ছিল। তাঁহারা প্রাচীন সমাজের কঠোর সমালোচনা করিয়াছেন, উহার উপর যথাসাধ্য দোষারোপ করিয়াছেন, উহার তীব্র নিন্দা করিয়াছেন; শেষে প্রাচীন সমাজের লোকেরা তাঁহাদের সুর ধরিয়াছেন, ঢিলটি খাইয়া পাটকেলটি মারিয়াছেন; আর তাহার ফল হইয়াছে এই যে, প্রত্যেকটি দেশীয় ভাষায় এমন এক সাহিত্যের সৃষ্টি হইয়াছে, যাহাতে সমগ্র জাতির—সমগ্র দেশের লজ্জিত হওয়া উচিত! ইহাই কি সংস্কার? ইহাই কি সমগ্র জাতির গৌরবের পথ? ইহা কার দোষ?
অতঃপর আর একটি গুরুতর বিষয় বিবেচনা করিতে হইবে। এখানে—ভারতে আমরা বরাবর রাজশাসনাধীনে কাটাইয়াছি—রাজারাই আমাদের জন্য চিরদিন বিধান প্রস্তুত করিয়াছেন। এখন সেই রাজারা নাই, এখন আর এ বিষয়ে অগ্রসর হইয়া পথ দেখাইবার কেহ নাই। সরকার সাহস করেন না। সরকারকে সাধারণের মতামতের গতি দেখিয়া নিজ কার্যপ্রণালী স্থির করিতে হয়। কিন্তু নিজেদের সমস্যাপূরণে সমর্থ, সাধারণের কল্যাণকর, প্রবল জনমত গঠিত হইতে সময় লাগে—অনেক সময় লাগে। এই মত গঠিত হইবার পূর্ব পর্যন্ত আমাদিগকে অপেক্ষা করিতে হইবে। সুতরাং সমুদয় সমাজসংস্কার-সমস্যাটি এইরূপ দাঁড়ায়—সংস্কার যাহারা চায়, তাহারা কোথায়? আগে তাহাদিগকে প্রস্তুত কর। সংস্কারপ্রার্থী লোক কই? অল্পসংখ্যক কয়েকটি লোকের নিকটই কোন বিষয় দোষযুক্ত বলিয়া বোধ হইয়াছে, অধিকাংশ ব্যক্তি কিন্তু তাহা এখনও বুঝে নাই। এখন এই অল্পসংখ্যক ব্যক্তি যে জোর করিয়া অপর সকলের উপর নিজেদের মনোমত সংস্কার চালাইবার চেষ্টা করেন, তাহা তো অত্যাচার; ইহার মত প্রবল অত্যাচার পৃথিবীতে আর নাই। অল্প কয়েকজন লোকের নিকট কতকগুলি বিষয় দোষযুক্ত হইলেই সেগুলি সমগ্র জাতির হৃদয় স্পর্শ করে না। সমগ্র জাতি নড়ে-চড়ে না কেন? প্রথমে সমগ্র জাতিকে শিক্ষা দাও, ব্যবস্থা-প্রণয়নে সমর্থ একটি দল গঠন কর; বিধান আপনা-আপনি আসিবে। প্রথমে যে শক্তিবলে—যাহার অনুমোদনে বিধান গঠিত হইবে, তাহা সৃষ্টি কর। এখন রাজারা নাই; যে নূতন শক্তিতে—যে নূতন সম্প্রদায়ের সম্মতিতে নূতন ব্যবস্থা প্রণীত হইবে, সে লোকশক্তি কোথায়? প্রথমে সেই লোকশক্তি গঠন কর। সুতরাং সমাজসংস্কারের জন্য প্রথম কর্তব্য—লোকশিক্ষা। এই শিক্ষা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিতেই হইবে।
গত শতাব্দীতে যে-সকল সংস্কারের জন্য আন্দোলন হইয়াছে, সেগুলির অধিকাংশ পোশাকী ধরনের। এই সংস্কার-চেষ্টাগুলি কেবল প্রথম দুই বর্ণ (জাতি)-কে স্পর্শ করে, অন্য বর্ণকে নহে। বিধবাবিবাহ-আন্দোলনে শতকরা সত্তর জন ভারতীয় নারীর কোন স্বার্থই নাই। আর সর্বসাধারণকে বঞ্চিত করিয়া যে-সকল ভারতীয় উচ্চবর্ণ শিক্ষিত হইয়াছেন, তাঁহাদেরই জন্য এ ধরনের সকল আন্দোলন। নিজেদের ঘর পরিষ্কার করিতে এবং বিদেশীদের চোখে সুন্দর প্রতীয়মান হইবার জন্য তাঁহারা কিছুমাত্র চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই। ইহাকে তো সংস্কার বলা যায় না। সংস্কার করিতে হইলে উপর উপর দেখিলে চলিবে না, ভিতরে প্রবেশ করিতে হইবে, মূলদেশ পর্যন্ত যাইতে হইবে। ইহাকেই আমি ‘আমূল সংস্কার’ বা প্রকৃত সংস্কার বলিয়া থাকি। মূলদেশে অগ্নিসংযোগ কর, অগ্নি ক্রমশঃ ঊর্ধ্বে উঠিতে থাকুক, [আবর্জনা পুড়িয়া যাক] এবং একটি অখণ্ড ভারতীয় জাতি গঠিত হউক।
আর সমস্যা বড় সহজও নহে। ইহা অতি গুরুতর সমস্যা; সুতরাং ব্যস্ত হইবার প্রয়োজন নাই! এটিও জানিয়া রাখো যে, গত কয়েক শতাব্দী যাবৎ এই সমস্যা সম্বন্ধে আমাদের দেশের মহাপুরুষগণ অবহিত ছিলেন। আজকাল বিশেষতঃ দাক্ষিণাত্যে বৌদ্ধধর্ম ও উহার অজ্ঞেয়বাদ সম্বন্ধে আলোচনা করা একটা ঢঙ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আলোচনাকারীরা স্বপ্নেও কখনও ভাবে না যে, আমাদের সমাজে যে-সকল বিশেষ দোষ রহিয়াছে, সেগুলি বৌদ্ধধর্ম-জাত। বৌদ্ধধর্মই আমাদিগকে তাহার উত্তরাধিকারস্বরূপ এই অবনতির ভাগী করিয়াছে। যাঁহারা বৌদ্ধধর্মের উন্নতি ও অবনতির ইতিহাস কখনও পাঠ করেন নাই, তাঁহাদের লিখিত পুস্তকে তোমরা পড়িয়া থাক যে, গৌতমবুদ্ধ-প্রচারিত অপূর্ব নীতি ও তাঁহার লোকোত্তর চরিত্র-গুণে বৌদ্ধধর্ম এরূপ বিস্তার লাভ করিয়াছিল। ভগবান্ বুদ্ধদেবের প্রতি আমার যথেষ্ট ভক্তি ও শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু আমার বাক্য অবহিত হইয়া শ্রবণ করঃ বৌদ্ধধর্মের বিস্তার উহার মতবাদের জন্য বা উক্ত মহাপুরুষের চরিত্রগুণে ততটা হয় নাই—বৌদ্ধগণ যে-সকল মন্দির নির্মাণ করিয়াছিলেন, যে-সকল প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, সমগ্র জাতির সমক্ষে যে-সকল আড়ম্বরপূর্ণ ক্রিয়াকলাপ ধরিয়াছিলেন, সেগুলির জন্য যতটা হইয়াছিল। এইরূপেই বৌদ্ধধর্ম বিস্তারলাভ করে। এই-সকল বড় বড় মন্দির ও ক্রিয়াকলাপের সহিত সংগ্রামে গৃহে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র হোমকুণ্ডগুলি দাঁড়াইতে পারিল না। ঐ সকল ক্রিয়াকলাপ-অনুষ্ঠান ক্রমশঃ অধঃপতিত হইল; অনুষ্ঠানগুলি পরিশেষে এরূপ ঘৃণিত ভাব ধারণ করে যে, শ্রোতৃবর্গের নিকট আমি তাহা বলিতে অক্ষম। যাঁহারা এ সম্বন্ধে জানিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহারা নানাপ্রকার কারুকার্যপূর্ণ দক্ষিণ ভারতের বড় বড় মন্দিরগুলি দেখিয়া আসিবেন। বৌদ্ধগণের নিকট হইতে দায়স্বরূপ আমরা ইহাই মাত্র পাইয়াছি। অতঃপর সেই মহান্ সংস্কারক শঙ্করাচার্য ও তাঁহার অনুবর্তিগণের অভ্যুদয় হইল, আর তাঁহার অভ্যুদয় হইতে আজ পর্যন্ত কয়েক শত বর্ষ যাবৎ ভারতের সর্বসাধারণকে ধীরে ধীরে সেই মৌলিক বিশুদ্ধ বৈদান্তিক ধর্মে লইয়া আসিবার চেষ্টা চলিতেছে। এই সংস্কারকগণ সমাজের দোষগুলি বিলক্ষণ জানিতেন, তথাপি তাঁহারা সমাজকে নিন্দা করেন নাই। তাঁহারা এ কথা বলেন নাই—তোমাদের যাহা আছে সব ভুল, তোমাদিগকে সব ফেলিয়া দিতে হইবে। তাহা কখনই হইতে পারে না। আমি সম্প্রতি পড়িতেছিলাম—আমার বন্ধু ব্যারোজ সাহেব বলিতেছেন, ৩০০ বৎসরে খ্রীষ্টধর্ম গ্রীক ও রোমক প্রভাবকে একেবারে উল্টাইয়া দিয়াছিল। যিনি ইওরোপ—গ্রীস ও রোম দেখিয়াছেন, তিনি কখনও এ-কথা বলিতে পারেন না। রোমক ও গ্রীক ধর্মের প্রভাব—এমন কি প্রোটেস্টাণ্ট দেশসমূহে পর্যন্ত রহিয়াছে, নামটুকু বদলাইয়াছে মাত্র; প্রাচীন দেবগণই নূতন বেশে বিদ্যমান—কেবল নাম বদলানো। দেবীগণ হইয়াছেন মেরী, দেবগণ হইয়াছেন সাধুবৃন্দ (Saints) এবং নূতন নূতন অনুষ্ঠান-পদ্ধতি প্রবর্তিত হইয়াছে। এমন কি, প্রাচীন উপাধি ‘পণ্টিফেক্স্ ম্যাক্সিমাস’৮ পর্যন্ত রহিয়াছে। সুতরাং সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইতেই পারে না, ইহা বড় সহজ নহে—আর শঙ্করাচার্য এ তত্ত্ব জানিতেন, রামানুজও জানিতেন, এরূপ পরিবর্তন হইতে পারে না। সুতরাং তদানীন্তন প্রচলিত ধর্মকে ধীরে ধীরে উচ্চতম আদর্শের অভিমুখে গড়িয়া তোলা ব্যতীত তাঁহাদের আর কোন পথ ছিল না। যদি তাঁহারা অন্য প্রণালী অবলম্বন করিতে চেষ্টা করিতেন, অর্থাৎ যদি তাঁহারা একেবারে সব উল্টাইয়া দিবার চেষ্টা করিতেন, তবে তাঁহাদিগকে কপট হইতে হইত; কারণ তাঁহাদের ধর্মের প্রধান মতই ক্রমোন্নতিবাদ—এই-সকল নানাবিধ সোপানের মধ্য দিয়া আত্মা তাঁহার উচ্চতম লক্ষ্যে পৌঁছিবে—ইহাই তাঁহাদের মূল মত। সুতরাং এই সোপানগুলি সবই আবশ্যক এবং আমাদের সহায়ক। কে এই সোপানগুলিকে নিন্দা করিতে সাহসী হইবে?
আজকাল একটি কথা চালু হইয়া গিয়াছে, এবং সকলেই বিনা আপত্তিতে এটি স্বীকার করিয়া থাকেন যে, পৌত্তলিকতা অন্যায়। আমিও এক সময়ে ঐরূপ ভাবিতাম, এবং ইহার শাস্তিস্বরূপ আমাকে এমন একজনের পদতলে বসিয়া শিক্ষালাভ করিতে হইয়াছিল, যিনি পুতুলপূজা হইতে সব পাইয়াছিলেন। আমি রামকৃষ্ণ পরমহংসের কথা বলিতেছি। হিন্দুগণ, যদি পুতুলপূজা করিয়া এইরূপ রামকৃষ্ণ পরমহংসের আবির্ভাব হয়, তবে তোমরা কি চাও?—সংস্কারকগণের ধর্ম চাও, না পুতুলপূজা চাও? আমি ইহার একটা উত্তর চাই। যদি পুতুলপূজা দ্বারা এইরূপ রামকৃষ্ণ পরমহংস সৃষ্টি করিতে পার, তবে আরও হাজার পুতুলের পূজা কর। ঈশ্বরেচ্ছায় তোমরা সাফল্য লাভ কর। যে-কোন উপায়ে হউক, এইরূপ মহান্ চরিত্র সৃষ্টি কর। আর পুতুলপূজাকে লোকে গালি দেয়! কেন?—তাহা কেহই জানে না। কারণ কয়েক সহস্র বৎসর পূর্বে জনৈক য়াহুদী-বংশসম্ভূত ব্যক্তি পুতুলপূজাকে নিন্দা করিয়াছিলেন অর্থাৎ তিনি নিজের পুতুল ছাড়া আর সকলের পুতুলকে নিন্দা করিয়াছিলেন। সেই য়াহুদী বলিয়াছিলেন, যদি কোন বিশেষ ভাব-প্রকাশক বা পরমসুন্দর মূর্তি দ্বারা ঈশ্বরের ভাব প্রকাশ করা হয়, তবে তাহা ভয়ানক দোষ, মহা পাপ; কিন্তু যদি একটি সিন্দুকের দুইধারে দুইজন দেবদূত, তাহার উপরে মেঘ—এইরূপে ঈশ্বরের ভাব প্রকাশ করা হয়, তবে তাহা মহা পবিত্র। ঈশ্বর যদি ঘুঘুর রূপ ধারণ করিয়া আসেন, তবে তাহা মহা পবিত্র; কিন্তু যদি গভীর রূপ ধারণ করিয়া আসেন, তবে তাহা হিদেনদের কুসংস্কার! অতএব উহার নিন্দা কর।
দুনিয়া এইভাবেই চলিয়াছে। তাই কবি বলিয়াছেন, ‘আমরা মর্ত্যমানব কি নির্বোধ!’ পরের চক্ষে দেখা ও বিচার করা কি কঠিন ব্যাপার! আর ইহাই মনুষ্যসমাজের উন্নতির অন্তরায়স্বরূপ। ইহাই ঈর্ষা ঘৃণা বিবাদ ও দ্বন্দ্বের মূল। বালকগণ, অর্বাচীন শিশুগণ, তোমরা মান্দ্রাজের বাহিরে কখনও যাও নাই; তোমরা সহস্র সহস্র প্রাচীনসংস্কার-নিয়ন্ত্রিত ত্রিশকোটি লোকের উপর আইন চালাইতে চাও—তোমাদের লজ্জা করে না? এরূপ বিষম দোষ হইতে বিরত হও এবং আগে নিজেরা শিক্ষা লাভ কর। শ্রদ্ধাহীন বালকগণ, তোমরা কেবল কাগজে গোটাকতক লাইন আঁচড় কাটিতে পার, আর কোন আহাম্মককে ধরিয়া উহা ছাপাইয়া দিতে পার বলিয়া নিজদিগকে জগতের শিক্ষক—ভারতের মুখপাত্র বলিয়া মনে করিতেছ! তাই নয় কি?
এই কারণে আমি মান্দ্রাজের সংস্কারকগণকে এইটুকু বলিতে চাই যে, তাঁহাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা আছে; তাঁহাদের বিশাল হৃদয়, তাঁহাদের স্বদেশপ্রীতি, দরিদ্র ও অত্যাচারিত জনগণের প্রতি তাঁহাদের ভালবাসার জন্য আমি তাহাদিগকে ভালবাসি। কিন্তু ভাই যেমন ভাইকে ভালবাসে অথচ তাহার দোষ দেখাইয়া দেয়, সেইভাবে আমি তাঁহাদিগকে বলিতেছি—তাঁহাদের কার্যপ্রণালী ঠিক নহে। শত বৎসর যাবৎ এই প্রণালীতে কার্য করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে কোন ফল হয় নাই। এখন আমাদিগকে অন্য কোন নূতন উপায়ে কাজ করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। এইটুকুই আমার বক্তব্য। ভারতে কি কখনও সংস্কারকের অভাব হইয়াছিল? তোমরা তো ভারতের ইতিহাস পড়িয়াছ? রামানুজ কি ছিলেন? শঙ্কর ? নানক? চৈতন্য? কবীর ? দাদু? এই যে বড় বড় ধর্মাচার্যগণ ভারতগগনে অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রের মত একে একে উদিত হইয়া আবার অস্ত গিয়াছেন, ইঁহারা কি ছিলেন?রামানুজের হৃদয় কি নীচজাতির জন্য কাঁদে নাই? তিনি কি সারাজীবন পারিয়াদিগকে৯ পর্যন্ত নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থান দিতে চেষ্টা করেন নাই? তিনি কি হিন্দু মুসলমানকে পর্যন্ত গ্রহণ করিতে চেষ্টা করেন নাই? নানক কি হিন্দু মুসলমান উভয়ের সহিত আলোচনা ও পরামর্শ করিয়া সমাজে নূতন অবস্থা আনয়ন করিবার চেষ্টা করেন নাই? তাঁহারা সকলেই চেষ্টা করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের কাজ এখনও চলিতাছে। তবে প্রভেদ এই—তাঁহারা আধুনিক সংস্কারকগণের মত চীৎকার ও বাহ্যাড়ম্বর করিতেন না। আধুনিক সংস্কারকগণের মত তাঁহাদের মুখ হইতে কখনও অভিশাপ উচ্চারিত হইত না, তাঁহাদের মুখ হইতে কেবল আশীর্বাদ বর্ষিত হইত। তাঁহারা কখনও সমাজের উপর দোষারোপ করেন নাই। তাঁহারা বলিতেন, হিন্দুজাতিকে চিরকাল ধরিয়া ক্রমাগত উন্নতি করিতে হইবে। তাঁহারা অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিতেন—হিন্দুগণ, তোমরা এতদিন যাহা করিয়াছ, তাহা ভালই হইয়াছে; কিন্তু হে ভ্রাতৃগণ, আমাদিগকে আরও ভাল কাজ করিতে হইবে। তাঁহারা এ-কথা বলেন নাই যে, তোমরা এতদিন মন্দ ছিলে, এখন তোমাদিগকে ভাল হইতে হইবে। তাঁহারা বলিতেন, তোমরা ভালই ছিলে, কিন্তু এখন তোমাদিগকে আরও ভাল হইতে হইবে। এই দুই প্রকার কথার ভিতর বিশেষ পার্থক্য আছে। আমাদিগকে আমাদের প্রকৃতি অনুযায়ী উন্নতির চেষ্টা করিতে হইবে। বৈদেশিক সংস্থাগুলি জোর করিয়া আমাদিগকে যে প্রণালীতে চালিত করিবার চেষ্টা করিতেছে, তদনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা বৃথা; উহা অসম্ভব। আমাদিগকে যে ভাঙিয়া-চুরিয়া অপর জাতির মত গড়িতে পারা অসম্ভব, সেজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমি অন্যান্য জাতির সামাজিক প্রথার নিন্দা করিতেছি না। তাহাদের পক্ষে উহা ভাল হইলেও আমাদের পক্ষে নহে। তাহাদের পক্ষে যাহা অমৃত, আমাদের পক্ষে তাহা বিষবৎ হইতে পারে। প্রথমে এইটিই শিক্ষা করিতে হইবে। এক ধরনের বিজ্ঞান, ঐতিহ্য ও পদ্ধতি অনুযায়ী গঠিত হওয়ায় তাহাদের আধুনিক সমাজব্যবস্থা একরূপ দাঁড়াইয়াছে। আমাদের পশ্চাতে আবার একপ্রকার ঐতিহ্য এবং সহস্র সহস্র বৎসর কর্ম রহিয়াছে, সুতরাং আমরা স্বভাবতই আমাদের সংস্কার অনুযায়ী চলিতে পারি, এবং আমাদিগকে সেইরূপ করিতে হইবে।
তবে আমি কি প্রণালীতে কাজ করিব? আমি প্রাচীন মহান্ আচার্যগণের উপদেশ অনুসরণ করিতে চাই। আমি তাঁহাদের কাজ বিশেষভাবে আলোচনা করিয়াছি এবং তাঁহারা কি প্রণালীতে কাজ করিয়াছিলেন, ঈশ্বরেচ্ছায় তাহা আবিষ্কার করিয়াছি। সেই মহাপুরুষগণ সমাজদেহ সংগঠন করিয়াছিলেন, তাঁহারা উহাতে বিশেষভাবে বল, পবিত্রতা ও জীবনীশক্তি সঞ্চারিত করিয়াছিলেন। তাঁহারা অতি বিস্ময়কর কাজ করিয়াছিলেন। আমাদিগকেও ঐরূপ কার্য করিতেই হইবে। এখন অবস্থাচক্রের কিছু পরিবর্তন হইয়াছে, সেজন্য কার্যপ্রণালীর সামান্য পরিবর্তন করিতে হইবে, আর কিছু নয়।
আমি দেখিতেছি—ব্যক্তির পক্ষে যেমন, প্রত্যেক জাতির পক্ষেও তেমনি জীবনের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। উহাই তাহার জীবনের কেন্দ্রস্বরূপ। উহাই যেন তাহার জীবনসঙ্গীতের প্রধান সুর, অন্যান্য সুর যেন সেই প্রধান সুরের সহিত সঙ্গত হইয়া ঐক্যতান সৃষ্টি করিতেছে। কোন দেশের—যথা ইংলণ্ডের জীবনীশক্তি রাজনীতিক ক্ষমতায়। কলাবিদ্যার উন্নতিই হয়তো অপর কোন জাতির জীবনের মূল লক্ষ্য। ভারতে কিন্তু ধর্মই জাতীয় জীবনের কেন্দ্রস্বরূপ, উহাই যেন জাতীয় জীবন-সঙ্গীতের প্রধান সুর। আর যদি কোন জাতি তাহার এই স্বাভাবিক জীবনীশক্তি—শত শতাব্দী ধরিয়া যেদিকে উহার নিজস্ব গতিধারা চলিয়াছে, তাহা পরিত্যাগ করিতে চেষ্টা করে এবং যদি সেই চেষ্টায় কৃতকার্য হয়, তবে তাহার মৃত্যু নিশ্চয়। সুতরাং যদি তোমরা ধর্মকে কেন্দ্র না করিয়া, ধর্মকেই জাতীয় জীবনের প্রাণশক্তি না করিয়া রাজনীতি, সমাজনীতি বা অন্য কিছুকে উহার স্থলে বসাও, তবে তাহার ফলে তোমরা একেবারে লুপ্ত হইয়া যাইবে। যাহাতে এরূপ না ঘটে, সেজন্য তোমাদিগকে তোমাদের প্রাণশক্তি—ধর্মের মধ্য দিয়া সব কাজ করিতে হইবে। তোমাদের স্নায়ুতন্ত্রীগুলি তোমাদের ধর্মরূপ মেরূদণ্ডে দৃঢ়সম্বন্ধ হইয়া নিজ নিজ সুরে বাজিতে থাকুক। আমি দেখিয়াছি, সামাজিক জীবনের ক্ষেত্রে ধর্ম কিভাবে কাজ করিবে—ইহা না দেখাইয়া আমি আমেরিকায় ধর্মপ্রচার করিতে পারিতাম না। বেদান্তের দ্বারা কিরূপ অদ্ভুত রাজনীতিক পরিবর্তন সাধিত হইবে, ইহা না দেখাইয়া আমি ইংলণ্ডে ধর্মপ্রচার করিতে পারিতাম না। এইভাবে ভারতে সমাজসংস্কার প্রচার করিতে হইলে দেখাইতে হইবে, সেই নূতন সামাজিক ব্যবস্থা দ্বারা জীবন কতটা আধ্যাত্মিকভাবে ভাবিত হইবে। রাজনীতি প্রচার করিতে হইলেও দেখাইতে হইবে, উহা দ্বারা আমাদের জাতীয় জীবনের প্রধান আকাঙ্ক্ষা—আধ্যাত্মিক উন্নতি কত অধিক পরিমাণে সাধিত হইবে।
এই পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ পথ বাছিয়া লয়; প্রত্যেক জাতিও সেইরূপ। আমরা শত শত যুগ পূর্বে নিজেদের পথ বাছিয়া লইয়াছি, এখন আমাদিগকে তদনুসারে চলিতে হইবে। আর এই পন্থা-নির্বাচন এমন কিছু খারাপ হয় নাই। জড়ের পরিবর্তে চৈতন্য, মানুষের পরিবর্তে ঈশ্বরের চিন্তাকে কি বিশেষ মন্দ পথ বলিতে পার? তোমাদের মধ্যে পরলোকে দৃঢ়বিশ্বাস, ইহলোকের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা, প্রবল ত্যাগশক্তি এবং ঈশ্বরে ও অবিনাশী আত্মায় দৃঢ়বিশ্বাস বিদ্যমান। কই, এই ভাব ত্যাগ কর দেখি! তোমরা কখনই ইহা ত্যাগ করিতে পার না। তোমরা জড়বাদী হইয়া কিছুদিন জড়বাদের কথা বলিয়া আমাকে ভুল বুঝাইবার চেষ্টা করিতে পার, কিন্তু আমি তোমাদের স্বভাব জানি। যখনই তোমাদিগকে ধর্ম সম্বন্ধে একটু ভুল করিয়া বুঝাইয়া দিব, অমনি তোমরা পরম আস্তিক হইবে। স্বভাব বদলাইবে কিরূপে? তোমরা যে ধর্মগতপ্রাণ।
এই জন্য ভারতে যে-কোন সংস্কার বা উন্নতির চেষ্টা করা হউক, প্রথমতঃ ধর্মের উন্নতি আবশ্যক। ভারতকে সামাজিক বা রাজনীতিকভাবে প্লাবিত করার আগে প্রথমে আধ্যাত্মিক ভাবে প্লাবিত কর। প্রথমেই এইটি করা আবশ্যক। প্রথমেই আমাদিগকে এই কাজে মন দিতে হইবে যেঃ আমাদের উপনিষদে—আমাদের পুরাণে, আমাদের অন্যান্য শাস্ত্রে যে-সকল অপূর্ব সত্য নিহিত আছে, সেগুলি ঐ-সকল গ্রন্থ হইতে, মঠ হইতে, অরণ্য হইতে, সম্প্রদায়বিশেষের অধিকার হইতে বাহির করিয়া সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়াইয়া দিতে হইবে, যেন ঐ-সকল শাস্ত্রনিহিত সত্য আগুনের মত উত্তর হইতে দক্ষিণ, পূর্ব হইতে পশ্চিম—হিমালয় হইতে কুমারিকা, সিন্ধু হইতে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত সারা দেশে ছুটিতে থাকে। সকলকেই এই-সকল শাস্ত্রনিহিত উপদেশ শুনাইতে হইবে; কারণ শাস্ত্র বলেন—প্রথমে শ্রবণ, পরে মনন, তারপর নিদিধ্যাসন কর্তব্য। প্রথমে লোকে শাস্ত্রবাক্যগুলি শুনুক, আর যে ব্যক্তি জনসাধারণকে তাহাদের ধর্মগ্রন্থের ও শাস্ত্রের অন্তর্গত মহান্ সত্যগুলি শুনাইতে সাহায্য করে, সে আজ এমন এক কাজ করিতেছে, যাহার সঙ্গে অন্য কোন কাজের তুলনা হইতে পারে না। মনু বলিয়াছেন, ‘এই কলিযুগে মানুষের একটি কাজ করিবার আছে। আজকাল আর যজ্ঞ ও কঠোর তপস্যায় কোন ফল হয় না। এখন দানই একমাত্র কর্ম।১০ দানের মধ্যে ধর্মদান—আধ্যাত্মিক জ্ঞানদানই শ্রেষ্ঠ দান; দ্বিতীয় বিদ্যাদান, তৃতীয় প্রাণদান, চতুর্থ অন্নদান। এই অপূর্ব দানশীল হিন্দুজাতির দিকে দৃষ্টপাত কর। এই দরিদ্র—অতি দরিদ্র দেশে লোকে কি পরিমাণ দান করে, লক্ষ্য কর। এখানে লোকে এমন অতিথিপরায়ণ যে, যে-কোন ব্যক্তি বিনাসম্বলে ভারতের উত্তর হইতে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়া আসিতে পারেন। লোকে পরমাত্মীয়কে যেমন যত্নের সহিত নানা উপচারের দ্বারা সেবা করে, সেইরূপ তিনি যেখানেই যাইবেন, লোকে সেই স্থানের সর্বোৎকৃষ্ট বস্তুসমূহের দ্বারা তাঁহার সেবা করিবে। এখানে কোথাও যতক্ষণ পর্যন্ত এক টুকরা রুটি থাকে, ততক্ষণ কোন ভিক্ষুককেই না খাইয়া মরিতে হয় না।
এই দানশীল দেশে আমাদিগকে প্রথম দুই প্রকার দানে সাহসপূর্বক অগ্রসর হইতে হইবে। প্রথমতঃ আধ্যাত্মিক জ্ঞানদান। এই জ্ঞানদান আবার শুধু ভারতেই সীমাবদ্ধ রাখিলে চলিবে না—সমগ্র বিশ্বে ইহা প্রচার করিতে হইবে। ইহাই বরাবর হইয়া আসিয়াছে। যাঁহারা তোমাদিগকে বলেন ভারতীয় চিন্তারাশি কখনও ভারতের বাহিরে যায় নাই—যাঁহারা তোমাদিগকে বলেন, ভারতের বাহিরে ধর্মপ্রচারের জন্য আমিই প্রথম সন্ন্যাসী গিয়াছি, তাঁহারা নিজেদের জাতির ইতিহাস জানেন না। এই ধর্মপ্রচারের ব্যাপার অনেকবার ঘটিয়াছে। যখনই প্রয়োজন হইয়াছে, তখনই এই আধ্যাত্মিকতার অফুরন্ত বন্যা সমগ্র জগৎ প্লাবিত করিয়াছে। অগণিত সৈন্যদল লইয়া উচ্চরবে ভেরী বাজাইতে বাজাইতে রাজনীতিক শিক্ষা বিস্তার করা যাইতে পারে; লৌকিক জ্ঞান বা সামাজিক জ্ঞান বিস্তার করিতে হইলেও তরবারি বা কামানের সাহায্যে উহা হইতে পারে; শিশিরবিন্দু যেমন অশ্রুত ও অদৃশ্যভাবে পতিত হইয়াও রাশি রাশি গোলাপ-কলিকে প্রস্ফুটিত করে, আধ্যাত্মিক জ্ঞানদান তেমনি নীরবে—সকলের অজ্ঞাতসারেই হওয়া সম্ভব।
ভারত বার বার জগৎকে এই আধ্যাত্মিক জ্ঞান উপহার দিয়া আসিতেছে। যখনই কোন শক্তিশালী দিগ্বিজয়ী জাতি উঠিয়া জগতের বিভিন্ন জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করিয়াছে, যখনই তাহারা পথঘাট নির্মাণ করিয়া বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত সুগম করিয়াছে, অমনি ভারত উঠিয়া সমগ্র জগতের উন্নতিকল্পে তাহার যাহা দিবার আছে—অর্থাৎ আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিতরণ করিয়াছে। বুদ্ধদেব জন্মিবার বহুদিন পূর্ব হইতেই ইহা ঘটিয়াছে। চীন, এশিয়া-মাইনর ও মালয়-দ্বীপপুঞ্জের মধ্যভাগে এখনও তাহার চিহ্ন বর্তমান। যখন সেই প্রবল গ্রীক দিগ্বিজয়ী তদানীন্তন পরিচিত জগতের সমগ্র অংশ একত্র গ্রথিত করিলেন, তখনও এই ব্যাপার ঘটিয়াছিল—তখনও ভারতীয় ধর্মভাব সেই-সকল স্থানে ছুটিয়া গিয়াছিল। আর পাশ্চাত্য দেশ এখন যে-সভ্যতার গর্ব করিয়া থাকে, তাহা সেই মহাবন্যারই অবশিষ্ট চিহ্নমাত্র। এখন আবার সেই সুযোগ উপস্থিত। ইংলণ্ডের শক্তি পৃথিবীর জাতিগুলিকে সংযুক্ত করিয়াছে; এরূপ আর পূর্বে কখনও হয় নাই। ইংরেজদের রাস্তা ও যাতায়াতের অন্যান্য উপায়গুলি জগতের একপ্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছে, ইংরেজ-প্রতিভায় জগৎ আজ অপূর্বভাবে একসূত্রে গ্রথিত। আজকাল যেরূপ নানাস্থানে বাণিজ্যকেন্দ্রসমূহ স্থাপিত হইয়াছে, মানবজাতির ইতিহাসে পূর্বে আর কখনও এরূপ হয় নাই। সুতরাং এই সুযোগে ভারত জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কালবিলম্ব না করিয়া জগৎকে আধ্যাত্মিকতা দান করিতেছে। এখন এই-সকল পথ অবলম্বন করিয়া ভারতীয় ভাবরাশি সমগ্র জগতে ছড়াইতে থাকিবে।
আমি যে আমেরিকায় গিয়াছিলাম, তাহা আমার ইচ্ছায় বা তোমাদের ইচ্ছায় হয় নাই। ভারতের ভগবান্, যিনি তাহার ভাগ্যবিধাতা, তিনিই আমায় পাঠাইয়াছেন এবং তিনিই এইরূপ শত শত ব্যক্তিকে জগতের সকল জাতির নিকট প্রেরণ করিবেন। পার্থিব কোন শক্তিই ইহাকে বাধা দিতে পারে না। সুতরাং তোমাদিগকে ভারতের বাহিরে অন্যান্য দেশেও ধর্মপ্রচারে যাইতে হইবে। এই ধর্মপ্রচারের জন্য তোমাদিগকে ভারতের বাহিরে যাইতেই হইবে; জগতের সকল জাতির নিকট, সকল ব্যক্তির নিকট প্রচার করিতে হইবে। প্রথমেই এই ধর্মপ্রচার আবশ্যক।
ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই লৌকিক বিদ্যা ও অন্যান্য বিদ্যা যাহা কিছু আবশ্যক, তাহা আপনি আসিবে। কিন্তু যদি ধর্মকে বাদ দিয়া লৌকিক জ্ঞানবিস্তারের চেষ্টা কর, তবে তোমাদিগকে স্পষ্টই বলিতেছি, ভারতে তোমাদের এ চেষ্টা ব্যর্থ হইবে—লোকের হৃদয়ে উহা প্রভাব বিস্তার করিবে না। এমন কি, এত বড় যে বৌদ্ধধর্ম, তাহাও কতকটা এই কারণেই এখানে প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই।
হে বন্ধুগণ, এই জন্য আমার সঙ্কল্প এই যে, ভারতে আমি কতকগুলি শিক্ষালয় স্থাপন করিব—তাহাতে আমাদের যুবকগণ ভারতে ও ভারত-বহির্ভূত দেশে আমাদের শাস্ত্র-নিহিত সত্যসমূহ প্রচার করিবার কাজে শিক্ষালাভ করিবে। মানুষ চাই, মানুষ চাই; আর সব হইয়া যাইবে। বীর্যবান্, সম্পূর্ণ অকপট, তেজস্বী, বিশ্বাসী যুবক আবশ্যক। এইরূপ একশত যুবক হইলে সমগ্র জগতের ভাবস্রোত ফিরাইয়া দেওয়া যায়। অন্য কিছু অপেক্ষা ইচ্ছাশক্তির প্রভাব অধিক। ইচ্ছাশক্তির কাছে আর সবই শক্তিহীন হইয়া যাইবে, কারণ ঐ ইচ্ছাশক্তি সাক্ষাৎ ঈশ্বরের নিকট হইতে আসিতেছে। বিশুদ্ধ ও দৃঢ় ইচ্ছার শক্তি অসীম। তোমরা কি বিশ্বাস কর না? সকলের নিকট তোমাদের ধর্মের মহান্ সত্যসমূহ প্রচার কর, প্রচার কর; জগৎ এই-সকল সত্যের জন্য অপেক্ষা করিতেছে।
শত শত শতাব্দী যাবৎ মানুষকে তাহার হীনত্বজ্ঞাপক মতবাদসমূহ শেখানো হইতেছে; তাহাদিগকে শেখানো হইয়াছে—তাহারা কিছুই নয়। সর্বত্র জনসাধারণকে চিরকাল বলা হইয়াছে—তোমরা মানুষ নও। শত শত শতাব্দী যাবৎ তাহাদিগকে এইরূপে ভয় দেখানো হইয়াছে—ক্রমশঃ তাহারা সত্যসত্যই পশুস্তরে নামিয়া গিয়াছে। তাহাদিগকে কখনও আত্মতত্ত্ব শুনিতে দেওয়া হয় নাই। তাহারা এখন আত্মতত্ত্ব শ্রবণ করুক; তাহারা জানুক যে, তাহাদের মধ্যে—নিম্নতম ব্যক্তির হৃদয়েও আত্মা রহিয়াছেন; সেই আত্মার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই; তরবারি তাঁহাকে ছেদন করিতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করিতে পারে না, বায়ু শুষ্ক করিতে পারে না; তিনি অবিনাশী অনাদি অনন্ত শুদ্ধস্বরূপ সর্বশক্তিমান্ ও সর্বব্যাপী।
অতএব আত্মবিশ্বাসী হও। ইংরেজ জাতির সঙ্গে তোমাদের এত প্রভেদ কিসে?তাহারা তাহাদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রবল কর্তব্যজ্ঞান ইত্যাদির কথা যাহাই বলুক না কেন, আমি জানিয়াছি, উভয় জাতির মধ্যে প্রভেদ কোথায়। প্রভেদ এই—ইংরেজ নিজের উপর বিশ্বাসী, তোমরা বিশ্বাসী নও। ইংরেজ বিশ্বাস করে—সে যখন ইংরেজ, তখন সে যাহা ইচ্ছা করে তাহাই করিতে পারে। এই বিশ্বাসবলে তাহার অন্তর্নিহিত ব্রহ্ম জাগিয়া উঠেন, সে তখন যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারে। তোমাদিগকে লোকে বলিয়া আসিতেছে ও শিক্ষা দিতেছে যে, তোমাদের কোন কিছু করিবার ক্ষমতা নাই—কাজেই তোমরা অকর্মণ্য হইয়া পড়িয়াছ। অতএব আত্মবিশ্বাসী হও।
আমাদের এখন প্রয়োজন—শক্তিসঞ্চার। আমরা দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি। সেইজন্যই আমাদের মধ্যে এই-সকল গুপ্তবিদ্যা, রহস্যবিদ্যা, ভুতুড়েকাণ্ড—সব আসিয়াছে। ঐগুলির মধ্যে কিছু মহৎ তত্ত্ব থাকিতে পারে, কিন্তু ঐগুলি আমাদিগকে প্রায় নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে। তোমাদের স্নায়ু সতেজ কর। আমাদের আবশ্যক—লৌহের মত পেশী ও বজ্রদৃঢ় স্নায়ু। আমরা অনেক দিন ধরিয়া কাঁদিয়াছি; এখন আর কাঁদিবার প্রয়োজন নাই, এখন নিজের পায়ে ভর দিয়া দাঁড়াইয়া মানুষ হও। আমাদের এখন এমন ধর্ম চাই, যাহা আমাদিগকে মানুষ করিতে পারে। আমাদের এমন সব মতবাদ আবশ্যক, যেগুলি আমাদিগকে মানুষ করিয়া গড়িয়া তোলে। যাহাতে মানুষ গঠিত হয়, এমন সর্বাঙ্গ সম্পূর্ণ শিক্ষার প্রয়োজন। কোন বিষয় সত্য কি অসত্য—জানিতে হইলে তাহার অব্যর্থ পরীক্ষা এইঃ উহা তোমাকে শারীরিক মানসিক বা আধ্যাত্মিকভাবে দুর্বল করে কিনা; যদি করে তবে তাহা বিষবৎ পরিহার কর—উহাতে প্রাণ নাই, উহা কখনও সত্য হইতে পারে না। সত্য বলপ্রদ, সত্যই পবিত্রতা-বিধায়ক, সত্যই জ্ঞানস্বরূপ। সত্য নিশ্চয়ই বলপ্রদ, হৃদযের অন্ধকার দূর করিয়া দেয়, হৃদয়ে বল দেয়। এই-সকল রহস্যময় গুহ্য মতে কিছু সত্য থাকিলেও সাধারণতঃ উহা মানুষকে দুর্বল করিয়া দেয়। আমাকে বিশ্বাস কর, সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতা হইতে আমি ইহা বুঝিয়াছি। আমি ভারতের প্রায় সর্বত্র ভ্রমণ করিয়াছি, এদেশের প্রায় সকল গুহা অন্বেষণ করিয়া দেখিয়াছি, হিমালয়েও বাস করিয়াছি। এমন অনেককে জানি, যাহারা সারা জীবন সেখানে বাস করিতেছে। আমি ঐ-সকল গুহ্য মত সম্বন্ধে এই একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, ঐগুলি মানুষকে কেবল দুর্বল করিয়া দেয়। আর আমি আমার স্বজাতিকে ভালবাসি; তোমরা তো এখনই যথেষ্ট দুর্বল হইয়া পড়িয়াছ, তোমাদিগকে আর দুর্বলতর—হীনতর হইতে দেখিতে পারি না। অতএব তোমাদের কল্যাণের জন্য এবং সত্যের জন্য, আমার স্বজাতির যাহাতে আর অবনতি না হয় সেজন্য উচ্চৈঃস্বরে চীৎকার করিয়া বলিতে বাধ্য হইতেছিঃ আর না, অবনতির পথে আর অগ্রসর হইও না—যতদূর গিয়াছ, যথেষ্ট হইয়াছে।
এখন বীর্যবান্ হইবার চেষ্টা কর। তোমাদের উপনিষদ্—সেই বলপ্রদ আলোকপ্রদ দিব্য দর্শনশাস্ত্র আবার অবলম্বন কর, আর এই-সকল রহস্যময় দুর্বলতাজনক বিষয় পরিত্যাগ কর। উপনিষদ্রূপ এই মহত্তম দর্শন অবলম্বন কর। জগতের মহত্তম সত্য অতি সহজ। যেমন তোমার অস্তিত্ব প্রমাণ করিতে অন্য কিছুর প্রয়োজন হয় না, ইহাও সেইরূপ সহজবোধ্য। তোমাদের সম্মুখে উপনিষদের এই সত্যসমূহ রহিয়াছে। ঐ সত্য-সমূহ অবলোকন কর, ঐগুলি উপলব্ধি করিয়া কার্যে পরিণত কর—তবে নিশ্চয় ভারতের উদ্ধার হইবে।
আর একটি কথা বলিলেই আমার বক্তব্য শেষ হইবে। লোকে স্বদেশহিতৈষিতার আদর্শের কথা বলিয়া থাকে। আমিও স্বদেশহিতৈষিতায় বিশ্বাস করি। স্বদেশহিতৈষিতায় বিশ্বাসী আমারও একটা আদর্শ আছে। মহৎ কার্য করিতে গেলে তিনটি জিনিষ প্রয়োজন প্রথমতঃ হৃদয়বত্তা—আন্তরিকতা আবশ্যক। বুদ্ধি, বিচারশক্তি আমাদিগকে কতটুকু সাহায্য করিতে পারে? উহারা আমাদিগকে কয়েক পদ অগ্রসর করাইয়া দেয় মাত্র, কিন্তু হৃদয়দ্বার দিয়াই মহাশক্তির প্রেরণা আসিয়া থাকে। প্রেম অসম্ভবকে সম্ভব করে—জগতের সকল রহস্যই প্রেমিকের নিকট উন্মুক্ত।
হে ভাবী সংস্কারকগণ, ভাবী স্বদেশহিতৈষিগণ! তোমরা হৃদয়বান্ হও, প্রেমিক হও। তোমরা কি প্রাণে প্রাণে বুঝিতেছ যে, কোটি কোটি দেব ও ঋষির বংশধর পশুপ্রায় হইয়া দাঁড়াইয়াছে? তোমরা কি প্রাণে প্রাণে অনুভব করিতেছ—কোটি কোটি লোক অনাহারে মরিতেছে, কোটি কোটি লোক শত শতাব্দী ধরিয়া অর্ধাশনে কাটাইতেছে? তোমরা কি প্রাণে প্রাণে বুঝিতেছ—অজ্ঞানের কৃষ্ণমেঘ সমগ্র ভারতগগনকে আচ্ছন্ন করিয়াছে? তোমরা কি এই-সকল ভাবিয়া অস্থির হইয়াছ? এই ভাবনায় নিদ্রা কি তোমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়াছে?এই ভাবনা কি তোমাদের রক্তের সহিত মিশিয়া তোমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত হইয়াছে—তোমাদের হৃদয়ের প্রতি স্পন্দনের সহিত কি এই ভাবনা মিশিয়া গিয়াছে? এই ভাবনা কি তোমাদিগকে পাগল করিয়া তুলিয়াছে? দেশের দুর্দশার চিন্তা কি তোমাদের একমাত্র ধ্যানের বিষয় হইয়াছে এবং ঐ চিন্তায় বিভোর হইয়া তোমরা কি তোমাদের নামযশ, স্ত্রীপুত্র, বিষয়সম্পত্তি, এমন কি শরীর পর্যন্ত ভুলিয়াছ? তোমাদের এরূপ হইয়াছে কি? যদি হইয়া থাকে, তবে বুঝিও তোমরা প্রথম সোপানে—স্বদেশহিতৈষী হইবার প্রথম সোপানে মাত্র পদার্পণ করিয়াছ। তোমরা অনেকেই জান, আমেরিকায় ধর্মমহাসভা হইয়াছিল বলিয়া আমি সেখানে যাই নাই, দেশের জনসাধারণের দুর্দশা দূর করিবার জন্য আমার ঘাড়ে যেন একটা ভূত চাপিয়াছিল। আমি অনেক বৎসর যাবৎ সমগ্র ভারতবর্ষে ঘুরিয়াছি, কিন্তু আমার স্বদেশবাসীর জন্য কাজ করিবার কোন সুযোগ পাই নাই। সেই জন্যই আমি আমেরিকায় গিয়াছিলাম। তখন তোমাদের মধ্যে যাহারা আমাকে জানিতে, তাহারা অবশ্য এ-কথা জান। ধর্মমহাসভা লইয়া কে মাথা ঘামায়? এখানে আমার নিজের রক্তমাংস-স্বরূপ জনসাধারণ দিন দিন ডুবিতেছে, তাহাদের খবর কে লয়?
ইহাই স্বদেশহিতৈষী হইবার প্রথম সোপান। মানিলাম, তোমরা দেশের দুর্দশার কথা প্রাণে প্রাণে বুঝিতেছ; কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, এই দুর্দশা প্রতিকার করিবার কোন উপায় স্থির করিয়াছ কি? কেবল বৃথাবাক্যে শক্তিক্ষয় না করিয়া কোন কার্যকর পথ বাহির করিয়াছ কি? দেশবাসীকে গালি না দিয়া তাহাদের যথার্থ কোন সাহায্য করিতে পার কি? স্বদেশবাসীর এই জীবন্মৃত অবস্থা দূর করিবার জন্য তাহাদের এই ঘোর দুঃখে কিছু সান্ত্বনাবাক্য শুনাইতে পার কি?—কিন্তু ইহাতেও হইল না। তোমরা কি পর্বতপ্রায় বাধাবিঘ্ন তুচ্ছ করিয়া কাজ করিতে প্রস্তুত আছ? যদি সমগ্র জগৎ তরবারি হস্তে তোমাদের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হয়, তথাপি তোমরা যাহা সত্য বলিয়া বুঝিয়াছ, তাহাই করিয়া যাইতে পার কি? যদি তোমাদের স্ত্রী-পুত্র তোমাদের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হয়, যদি তোমাদের ধন-মান সব যায়, তথাপি কি তোমরা উহা ধরিয়া থাকিতে পার? রাজা ভর্তৃহরি যেমন বলিয়াছেন, ‘নীতিনিপুণ ব্যক্তিগণ নিন্দাই করুন বা প্রশংসাই করুন, লক্ষ্মীদেবী গৃহে আসুন বা যথা ইচ্ছা চলিয়া যান, মৃত্যু—আজই হউক বা যুগান্তরেই হউক, তিনিই ধীর, যিনি সত্য হইতে একবিন্দু বিচলিত হন না।১১ সেইরূপ নিজ পথ হইতে বিচলিত না হইয়া তোমার কি তোমাদের লক্ষ্যাভিমুখে অগ্রসর হইতে পার?তোমাদের কি এইরূপ দৃঢ়তা আছে? যদি এই তিনটি জিনিষ তোমাদের থাকে, তবে তোমরা প্রত্যেকেই অলৌকিক কার্য সাধন করিতে পার। তোমাদের সংবাদপত্রে লিখিবার অথবা বক্তৃতা দিয়া বেড়াইবার প্রয়োজন হইবে না। তোমাদের মুখ এক অপূর্ব স্বর্গীয় জ্যোতিঃ ধারণ করিবে। তোমরা যদি পর্বতের গুহায় গিয়া বাস কর, তথাপি তোমাদের চিন্তারাশি ঐ পর্বতপ্রাচীর ভেদ করিয়া বাহির হইবে। হয়তো শত শত বৎসর যাবৎ উহা কোন আশ্রয় না পাইয়া সূক্ষ্মাকারে সমগ্র জগতে ভ্রমণ করিবে। কিন্তু একদিন না একদিন উহা কোন না কোন মস্তিষ্ককে আশ্রয় করিবেই করিবে। তখন সেই চিন্তানুযায়ী কার্য হইতে থাকিবে। অকপটতা, সাধু উদ্দেশ্য ও চিন্তার এমনই শক্তি।
আর এক কথা—আমার আশঙ্কা হয়, তোমাদের বিলম্ব হইতেছে; হে আমার স্বদেশবাসিগণ, আমার বন্ধুগণ, আমার সন্তানগণ, এই জাতীয় অর্ণবপোত লক্ষ লক্ষ মানবাত্মাকে জীবন-সমুদ্রের পারে লইয়া যাইতেছে। ইহার সহায়তায় অনেক শতাব্দী যাবৎ লক্ষ লক্ষ মানব জীবন-সমুদ্রের অপর পারে অমৃতধামে নীত হইয়াছে। আজ হয়তো তোমাদের নিজ-দোষেই উহাতে দু-একটি ছিদ্র হইয়াছে, উহা একটু খারাপও হইয়া গিয়াছে। তোমরা কি এখন উহার নিন্দা করিবে? জগতের সকল জিনিষ অপেক্ষা যে-জিনিষ আমাদের অধিক কাজে আসিয়াছে, এখন কি তাহার উপর অভিশাপ বর্ষণ করা উচিত? যদি এই জাতীয় অর্ণবপোতে—আমাদের এই সমাজে ছিদ্র হইয়া থাকে, তথাপি আমরা তো এই সমাজেরই সন্তান। আমাদিগকেই ঐ ছিদ্র বন্ধ করিতে হইবে। আনন্দের সহিত আমাদের হৃদয়ের শোণিত দিয়াও বন্ধ করিবার চেষ্টা করিতে হইবে; যদি আমরা বন্ধ করিতে না পারি, তবে মরিতে হইবে। আমরা আমাদের বুদ্ধিসহায়ে ঐ অর্ণবপোতের ছিদ্রগুলি বন্ধ করিব, কিন্তু কখনই উহার নিন্দা করিব না। এই সমাজের বিরুদ্ধে একটা কর্কশ কথা বলিও না। আমি ইহার অতীত মহত্ত্বের জন্য ইহাকে ভালবাসি। আমি তোমাদের সকলকে ভালবাসি, কারণ তোমরা দেবতাদের বংশধর, তোমরা মহামহিমান্বিত পূর্বপুরূষগণের সন্তান। তোমাদের সর্বপ্রকার কল্যাণ হউক। তোমাদিগকে কি নিন্দা করিব বা গালি দিব?—কখনই নয়। হে আমার সন্তানগণ, তোমাদের নিকট আমার সমুদয় পরিকল্পনা বলিতে আসিয়াছি। যদি তোমরা আমার কথা শোন, আমি তোমাদের সঙ্গে কাজ করিতে প্রস্তুত আছি। যদি না শোন, এমন কি আমাকে ভারতভূমি হইতে তাড়াইয়া দাও, তথাপি আমি তোমাদের নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিব—আমরা সকলে ডুবিতেছি। এই জন্যই আমি তোমাদের ভিতর তোমাদেরই একজন হইয়া তোমাদের সঙ্গে মিশিতে আসিয়াছি। আর যদি আমাদিগকে ডুবিতেই হয়, তবে আমরা যেন সকলে একসঙ্গে ডুবি, কিন্তু কাহারও প্রতি যেন কটূক্তি প্রয়োগ না করি।