অভিযানের আরম্ভ
গাছের উপর বসে আমরা তিন মূর্তি একসঙ্গে কেঁদে ফেললুম।
টেনিদা—আমাদের লিডার—পটলডাঙার চার মূর্তির সেরা মূর্তি—এমনি করে বুনন হাতির পিঠে চেপে বিদায় নিলে! এ আমরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না—কেউ না।
টেনিদা আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক মিষ্টি আর বিস্তর ডালমুট খেয়েছে। চাঁটি গাঁট্টা লাগিয়েছে যখন-তখন। কিন্তু টেনিদাকে নইলে আমাদের যে একটি দিনও চলে না। যেমন চওড়া বুক—তেমনি চওড়া মন! হাবুল সেবার যখন টাইফয়েড হয়ে মরোেমরো তখন সারারাত জেগে, নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে টেনিদাই তাকে নার্স করেছে বাঁচিয়ে তুলেছে বলা চলে। পাড়ার কারও বিপদ-আপদ হলে টেনিদাই গিয়ে দাঁড়িয়েছে সকলের আগে। লোকের উপকারে এক মুহূর্তের জন্য তার ক্লান্তি নেই—মুখে হাসি তার লেগেই আছে। ফুটবলের মাঠে সেরা খেলোয়াড়, ক্রিকেটের ক্যাপ্টেন। আর গল্পের রাজা। এমন করে গল্প বলতে কেউ জানে না!
সেই টেনিদা আমাদের ছেড়ে চলে যাবে? এ হতেই পারে না! এ অসম্ভব।
ক্যাবলাই চোখের জল মুছে ফেলল সকলের আগে। ডাকলে, হাবল!
–কী কও?–ধরা গলায় হাবুল জবাব দিলে।
–কেঁদে লাভ নেই। টেনিদাকে খুঁজে বের করতে হবে।
—কোথায় পাবে?—আমি জিজ্ঞেস করলুম।
–যেখানেই হোক।
ফোঁসফোঁস করতে করতে হাবুল বললে, বুনো হাতি—কোথায় যে লইয়া গেছে–
ক্যাবলা ততক্ষণে নেমে পড়েছে গাছ থেকে। বললে, পৃথিবীর বাইরে তো কোথাও নিয়ে যায়নি। দরকার হলে দুনিয়ার শেষ পর্যন্ত খুঁজে দেখব। নেমে আয় তোরা।
আমরা নামলুম।
ক্যাবলা বললে, শোনো বন্ধুগণ! আমরা পটলডাঙার ছেলে, ভয় কাকে বলে কোনও দিন জানিনি। তোমরা নিশ্চয়ই এর মধ্যে ভুলে যাওনি সেই ঝর্ণিপাহাড়ির অভিযানকাহিনী নিশ্চয় ভুলে যাওনি, স্বামী ঘুটঘুটানন্দের চক্রান্ত আমরা কেমন করে ফাঁস করে দিয়েছিলুম! মানুষের শয়তানিকে ঠাণ্ডা করতে পেরেছি, আর বুনো জানোয়ারকে ভয়? জানোয়ার মানুষের চাইতে নিচুদরের জীব—তাকে হারিয়ে, হটিয়েই মানুষ এগিয়ে চলেছে। আমরাও টেনিদাকে ফিরিয়ে আনবই।
–যদি হাতি তাকে মেরে ফেলে থাকে?
—আমি তা বিশ্বাস করি না। সে আমাদের লিডার–বিপদে পড়লে যেমন বেপরোয়া তেমনি সাহসী হয়ে ওঠে—সে তো তোমরা জানোই। সে ঠিকই বেঁচে আছে। তবু আমাদের কর্তব্য আমরা করব। আর—আর যদি দেখি সত্যিই হাতি তাকে মেরে ফেলেছে, তা হলে আমরাও মরব। টেনিদাকে ফেলে আমরা কিছুতেই কলকাতায় ফিরে যাব না। কী বল তোমরা?
আমরা দুজনে বুক চিতিয়ে উঠে দাঁড়ালুম।
—ঠিক। আমিও তাই কই।–হাবুল বললে।
—চারজন এসেছিলুম—তিনজন কিছুতেই ফিরে যাব না। মরলে চারজনেই মরব।–আমি বললুম।
ক্যাবলা বললে, তা হলে এখনি আমরা বেরিয়ে পড়ি।
—কিন্তু কুট্টিমামা আর রোশনলালকে খবর দিতে পারলে–
—কোথায় খবর দিবি, আর পাবিই বা কোথায়? তা ছাড়া এক সেকেন্ডও আমরা সময় নষ্ট করতে পারব না। চল, এগোনো যাক—
—কোনদিকে যাবি?—হাবুল জানতে চাইল।
—হাতির পায়ের দাগ নিশ্চয় পাওয়া যাবে। তাই ধরেই এগোব।
আমি বললুম, একটা বন্দুক-টন্দুক যদি থাকত—
ক্যাবলা রাগ করে বললে, তুই আর এখন জ্বালাসনি প্যালা! বন্দুক থাকলেই বা কী হত শুনি—কোনও জন্মে আমরা কেউ ছুঁড়েছি নাকি ওসব? বন্দুক আমাদের দরকার নেই, মনের জোরই হল সবচেয়ে বড় অস্ত্র। আয়–
–চল—
আমরা এগিয়ে চললুম। বুক এক-আধটু দুর-দুর না করছিল তা নয়, মনে হচ্ছিল পটলডাঙায় ফিরে গিয়ে বাবা-মা ভাইবোনদের মুখও হয়তো কোনওদিন আর দেখতে পাব না। হয়তো এ-জঙ্গলেই বাঘ ভালুক হাতির পাল্লায় আমার প্রাণ যাবে। যদি যায়ক। দুনিয়ায় ভীরু আর স্বার্থপরদের কোনও জায়গা নেই। ও-ভাবে বাপমার কোলে আহ্বাদে পুতুল হয়ে বেঁচে থাকার চাইতে বীরের মতো মরা ভালো। আর, একবার ছাড়া তো দুবার মরব না!
ক্যাবলা ঠিকই বুঝেছিল। ডালপালা ভেঙে, গাছপালা মাড়িয়ে হাতিটা যেভাবে এগিয়ে গেছে আমরা তা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলুম। কোথাও কোথাও নরম মাটিতে তার পায়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে আমরা বনের পথ বেয়ে চলতে লাগলুম। কিন্তু তখনও হাতির দেখা নেই, টেনিদারও চিহ্নমাত্রও না।
শেষে এক জায়গায় এসে আমাদের থমকে দাঁড়াতে হল।
চারধারে জঙ্গল কেমন তচনচ। চার পাশেই হাতির পায়ের দাগ। মনে হয়, পাঁচ-সাতটা হাতি জড়ো হয়েছিল এখানে তারপর নানা দিকে যেন তারা ঘুরে বেড়িয়েছে। এর মধ্যে কোন্ হাতিটার পিঠে টেনিদা গদিয়ান হয়ে বসে আছে—সে কথা কে বলবে!
ক্যাবলা বললে, তাই তো! কোন্ দিকে যাই?
হাবুল ভেবেচিন্তে বলল, এইভাবে ঘুরা খুব সুবিধা হইব না। চল ক্যাবলা, আবার ভ্যানের কাছে ফিরা যাই। মামারে সঙ্গে কইর্যা—
ক্যাবলা বললে, না।
কী করবি তা হলে?—আমি জিজ্ঞেস করলুম।
—তিনজনে তিনদিকে যাব।
—একা-একা?
—হ্যাঁ—একলা চল রে।
আমার পালাজ্বরের পিলেটা অবশ্য এতদিনে অনেক ছোট হয়ে গেছে, কিন্তু যেটুকু আছে তা-ও চড়াৎ করে লাফিয়ে উঠল।
–একা যাব?
ক্যাবলা দুটো জ্বলজ্বলে চোখ মেলে আমার দিকে চাইল।
—তুই ভ্যানে ফিরে যা প্যালা। আমি আর হাবুল চললুম খুঁজতে।
আমার রক্ত গরম হয়ে উঠল। আমি ভীরু! একা আমারই প্রাণের ভয়। কখনও না।
বললুম, তোর ইচ্ছে হয় তুই ফিরে যা। আমি টেনিদাকে খুঁজব।
ক্যাবলা আমার পিঠ চাপড়ে দিলে। খুশি হয়ে বললে, ব্যস, ঠিক হ্যায়। ই হ্যায় মরদকা বাত! এবার তিনজন তিনমুখে। বন্ধুগণ, হয়তো আমাদের এই শেষ দেখা। হয়তো আমরা
আর কেউ বেঁচে ফিরব না। তাই যাওয়ার আগে একবার বল
—পটলডাঙা—
—জিন্দাবাদ!
–চার মূর্তি—
–জিন্দাবাদ!
তারপরেই দেখি, ওরা দুজনে দুদিকে বনের মধ্যে সুট করে কোথায় চলে গেল। আমি এখন একা। এই বাঘ-সাপ-হাতির জঙ্গলে একেবারে একা। নিজেকে বললুম, বুকে সাহস আনো পটলডাঙার প্যালারাম! তুমি যে কেবল শিঙিমাছ দিয়েই পটোলের ঝোল খেতে এক্সপার্ট তা নও, তার চাইতে আরও অনেক বেশি। আজ তোমার চরম পরীক্ষা। তৈরি হও সেজন্যে।
একটা শুকনো ডাল পড়ে ছিল সামনে। সেইটে কুড়িয়ে নিয়ে আমিও চলতে শুরু করলুম। মরবার আগে অন্তত কষে এক ঘা তো বসাতে পারব! সে হাতিই হোক আর বাঘই হোক।
কিন্তু বেশিদূর যেতে হল না আমাকে।
একটা ঝোপের ওপর যেই পা দিয়েছি, অমনি—
সড়াক্–ঝরঝরাৎ–
পায়ের তলার থেকে মাটি সরে গেল। আর তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলুম, মহাশূন্য বেয়ে আমি কোথায় কোন পাতালের দিকে পড়ে যাচ্ছি।
-মা-
তারপরেই আমার চোখ বুজে এল।