১১. অজগরের চোখের সম্মোহন

অজগরের চোখের সম্মোহনে যেমন শিকার সামনের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে, ঠিক তেমনি করেই ছট্টুলাল এগিয়ে গিয়ে মাটিতেই বসে পড়লো।

হাত বাড়িয়ে লোকটা ঘরের কোণে প্ৰজ্বলিত প্রদীপের শিখাটা একটু উসকে দিল।

আলোর তাতে করে বিশেষ উনিশ-বিশ হল বলে মনে হয় না, তবে প্রদীপের সেই আলোয় এবার ছট্টুলাল যেন নিজের অজ্ঞাতেই লোকটার মুখের দিকে তাকাল। অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে লোকটার চেহারা।

মুখভর্তি কাঁচা-পাকা দাড়িগোঁফ। বয়েস হলেও লোকটার শরীরের বঁধুনি যেন এখনও অটুটাই আছে। পরিধানে একটা লাল রংয়ের কাপড়। খালি গা। গলায় একটা রুদ্রাক্ষের মালা। দেহের সমস্ত পেশী এখনও সজাগ ও স্পষ্ট। লোকটা দৈর্ঘ্যে প্রায় ছ। ফুটের কাছাকাছি হবে। চওড়া বক্ষপট। উন্নত সুদৃঢ় স্কন্ধ। কিন্তু চোখ দুটো হিংস্র জন্তুর মত যেন ঝকঝকে করে জ্বলছে দু খণ্ড জ্বলন্ত অঙ্গারের মত।

সে চোখের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।

ছট্টুলাল দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশে একবার তাকাল। ঘরের মধ্যে আসবাব বিশেষ কিছু নেই। এক কোণে একটা টিনের রং-ওঠা সুটকেস। একটা মলিন সতরঞ্চি জড়ানো বিছানা। একটা মাটির কুঁজে ও গোটা দুই অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাস ও থালা।

হঠাৎ ছট্টুলাল পুনরায় লোকটার ভারী গলার প্রশ্নে চমকে উঠল, তোর নাম কি?

ছট্টুলাল যেন প্রশ্নটা শোনেনি এমনি ভাব দেখাবার চেষ্টা করল।

এই শুনছিস, তোর নাম কি?

আমার!

তোর নয় তো কি আমার?

আমার নাম গোবিন্দলাল।

মুহুর্তে হাত বাড়িয়ে বজ্রমুষ্টিতে ছট্টুলালের সামনেকার চুলের ঝুঁটি চেপে ধরে প্রবলভাবে দুটো ঝাঁকুনি দিল লোকটা।

সেই ঝাঁকুনির চোটে ছট্টুর মনে হল তার মাথাটাই বুঝি দেহ থেকে আলগা হয়ে এল। দু, চোখের তারায় যেন একরাশ সর্ষের ফুল ঝিকমিক করে উঠল।

ধাপ্পা দেওয়ার আর জায়গা পাসনি বেটা! তোর নাম আমি জানতে পারব না ভেবেছিস!

আমার নাম তো গোবিন্দলালই। তবু পুনরাবৃত্তি করে ছট্টুলাল।

নাম তোর আমি ঠিক জেনে নেব। রত্নমঞ্জিলের চারপাশে ক’দিন ধরে ঘুরঘুর করছিস কেন বল!

ঘুরঘুর তো আমি করিনি।

ফের মিথ্যে কথা!

আর একটা ধমক দিয়ে ওঠে লোকটা।

মিথ্যে কথা বলব কেন?

মিথ্যে কথা বলবি কেন! হুঁ, তোর চেহারা দেখেই মালুম হচ্ছে তুই জীবনে কটা সত্যি বলেছিস! শোন, সত্যি কথা বলিস তো তোকে ছেড়ে দেব। আর যদি মিথ্যে ধাপ্পা দেবার চেষ্টা করিস, খুন করে তোকে রত্নমঞ্জিলের ঐ রাণীদিঘির পাঁকের তলে পুতে রাখব। বল এখনো সত্যি কথা!

ছট্টুলাল সত্যি এবারে রীতিমতই ভাবিত হয়ে ওঠে।

লোকটার চেহারা ও কথাবার্ততেই মালুম হচ্ছে লোকটা মোটেই সুবিধার নয়।

মুখে যা বলছে কাজে করতেও হয়ত ওর বাধবে না। কিন্তু ছট্টুলালও জাত সাপ। যার কাজের ভার নিয়ে ছট্টুলাল এখানে এসেছে সেই রতনলাল রানাও খুব সহজ ব্যক্তি নয়।

তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে সেও ছেড়ে কথা বলবে না। বিশেষ করে তার অনুচর পিয়ারী একেবারে সাক্ষাৎ শয়তান বললেও অত্যুক্তি হবে না। পিয়ারীর অসাধ্য কিছুই নেই।

রতনলালের সামান্য ইঙ্গিতেই তার হাতের গুপ্ত ছোরা ঝিকমিকিয়ে উঠবে এবং নির্ভুলভাবেই ছট্টুর কলিজাটা ফাঁসিয়ে দেবে।

জলে বাঘ, ডাঙায় কুমীর।

তাছাড়া রতনলালকে এই জব্বর খবরটা দিতে পারলে মোটামত কিছু বকশিশও মিলত। তা সেও তো এখন সুদূরপরাহত। এই দুশমনটার হাত থেকে আপাততঃ কোন মুক্তির পথও ছট্টু ভেবেই পাচ্ছে না। চকিতে একটার পর একটা চিন্তাগুলো ছট্টুর মাথার মধ্যে খেলে যায়।

কিন্তু রতনলালের কথা পরে ভাবলেও চলবে, আপাততঃ এই দিকটা সামলতে হবে।

কিন্তু ছট্টুলাল ভেবে পাচ্ছে না, ঠিক কোন পথে এগুলে বর্তমানের এই সঙ্কটকে সে কাটিয়ে উঠতে পারে।

শক্তির প্রথম পরিচয়েই ছট্টুলাল বুঝতে পেরেছে, গায়ের শক্তিতে এই লোকটার সঙ্গে ছট্টু পেরে উঠবে না।

কি রে, জবাব দিচ্ছিস না কেন?

ছট্টুলাল জবাব দেবে কি, তখনও ভাবছে। সে চুপ করেই থাকে। লোকটাও বুঝতে পারে সহজে ছট্টুর মুখ থেকে জবাব বের করা যাবে না।

সেও এতক্ষণে মনে মনে অন্য উপায়ই ভাবছিল। ঘরের কোণে একটা মোটা দড়ি পড়ে ছিল, উঠে গিয়ে সেই দড়িটা যেমন লোকটা আনতে যাবে ছট্টু দেখল। এই সুযোগ, চক্ষের পলকে সে দাঁড়িয়ে উঠেই এক লাফে ঘরের বাইরে চলে এল এবং অন্ধকারে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুট দিল।

অন্ধকারে কাঁটাঝোপে শরীর ও হাত-পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতে লাগল ছট্টুর, কিছুতেই খেয়াল নেই। যেমন করে হোক পালাতে হবে। সে প্রাণ-পণে ছুটতে লাগল।

ঘরের মধ্যে সেই দাড়িগোঁফওয়ালা লোকটা কল্পনাও করতে পারেনি যে ছট্টু হঠাৎ উঠে পালাতে সাহস পাবে।

ছট্টু হঠাৎ উঠে লাফিয়ে ঘরের বাইরে যেতে সেই লোকটাও সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে ঘরের বাইরে এল, কিন্তু অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারল না কোন দিকে ছট্টু ছুটে পালিয়েছে।

তথাপি আন্দাজের উপর নির্ভর করে কিছুদূর এগিয়ে গেল, কিন্তু পলাতক ছট্টুর সন্ধান করতে পারলে না। অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে।

 

ঐ ঘটনার দিন-দুই বাদে সন্ধ্যার দিকে রতনলালের অফিসে আবার ছট্টুলালকে দেখা গেল। রতনলাল চেয়ারে বসে, থমথম করছে তার মুখটা। সামনে দাঁডিয়ে ছট্টুলাল।

রতনলালের পাশেই অন্য একটা চেয়ারে উপবিষ্ট পিয়ারী নিঃশব্দে একটা সিগারেট টেনে চলেছে। হাতে ধরা একটা মার্কোভিচের টিন।

ছট্টুর মুখে সবই শুনেছে রতনলাল। বামদেব বিনয় প্রভৃতির রত্নমঞ্জিলে যাওয়াটার মধ্যে রতনলাল তেমন বেশী গুরুত্ব দেয়নি। চিন্তিত বিশেষভাবেই হয়ে উঠেছে সে কোন এক তৃতীয় দাড়িগোঁফওয়ালা শক্তিশালী লোকের সংবাদটা পেয়ে।

লোকটা কে? কেনই বা সেখানে গিয়ে আডিডা নিয়েছে? ঐ লোকটাও কি তবে ঐ রত্নমঞ্জিলের আশা নিয়েই ওখানে গিয়ে আড্ডা নিয়েছে, না ঐ লোকটাই সেই দুনম্বর পার্টি যে বেশী টাকার লোভ দেখিয়ে তার হাত থেকে রত্নমঞ্জিল ছিনিয়ে নিতে চায়!

পিয়ারীর দিকে তাকাল রতনলাল। পিয়ারী বুঝতে পারে রতনলাল তার সঙ্গে একটা কিছু পরামর্শ করেতে চায়। গুজরাটি বুদ্ধিতে আর কুলোচ্ছে না।

পিয়ারী ছট্টুর দিকে তাকিয়ে বললে, আচ্ছা ছট্টু তুই এখন যা। কাল এই সময় একবার দেখা করিস।

ছট্টু সেলাম দিল, যাচ্ছি। কিন্তু বহরমপুরে আর যেতে পারব না। শালা একেবারে সাক্ষৎ দুশমন।

ছট্টু চলে গেল।

কিছুক্ষণ অতঃপর দুজনেই চুপচাপ বসে থাকে। কারো মুখেই কোন কথা নেই।

রতনলালই প্রথমে স্তব্ধতা ভঙ্গ করলে, পিয়ারী, তোমার কি মনে হচ্ছে?

দাঁড়াও, একটু ভাবতে দাও। ক্রমেই সব জটিল হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে?

যত জটিলই হোক—একটা কথা, যেমন করে যে উপায়ে হোক আমার কিন্তু পিয়ারী ঐ রত্নমঞ্জিল চাই-ই। শালা জান কবুল। তবু ঐ রত্নমঞ্জিল আমি কাউকে নিতে দেব না।

তা যেন হল, কিন্তু মাঝখান থেকে ঐ বেটা দাড়ি কোথা থেকে এল। তাই তো ভাবছি।

চল না পিয়ারী, একবার বহরমপুর ঘুরে আসা যাক।

উঁহু। সেখানে গিয়ে ভিড় করে কোন লাভ হবে না। তার চাইতে আমি বলি কি, এ গোলমালে কাজ কি বাবা! দাও না বাড়িটা ছেড়ে।

ছেড়ে দেব! কভি না। বললাম তো জান কবুল, শেষ পর্যন্ত দেখব।

শোন রতনলাল, এসব ব্যাপারে জলের মত টাকা খরচ করতে হবে। পারবে? রাজী আছ?

নিশ্চয়ই।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়িটা উদ্ধার করে যদি দেখা যায়, ওসব গুপ্তধন-টন স্রেফ সব ধাপ্পা, কিছুই নেই, তখন সে টাকার শোক সামলাতে পারবে তো বন্ধু!

মরদবাচ্চা আমি। টাকা বহু কামিয়েছি। জীবনে পিয়ারী—এক দু লাখ যদিই যায় তো পরোয়া করি না। মোদা কথা রত্নমঞ্জিল আমার চাই–

ঠিক?

ঠিক। রানা সজোরে টেবিলের উপরে একটা ঘুষি বসাল।

হুঁ, তাহলে শোন রানা। এসব ব্যাপারে টাকা তো খরচ করতেই হবে, কৌশলেরও দরকার, ওসব ছট্টুলালদের দ্বারা হবে না। আমি নিজে যাব বহরমপুর। সেখানে গিয়ে আগে সব ব্যাপারটা ভাল করে বুঝে দেখি, তারপর—

কবে যাবে?

যত তাড়াতাড়ি পারি যাব। কিছু টাকা দাও।

টেবিলের টানা চাবি দিয়ে খুলে একমুঠো নোট বের করে পিয়ারীর সামনে রাখলে রানা। একান্ত নির্বিকারভাবেই পিয়ারী নোটগুলো নিয়ে পকেটে রাখল।

পিয়ারী রানার বহুদিনকার পরিচিত।

পিয়ারীর ক্ষমতার উপরেও রানার যথেষ্ট আস্থা আছে।

যুদ্ধের সময়ে ব্যবসার একটা অংশ যখন চোরাপথে বাঁকাভাবে চলছিল, সেই বাঁকাপথেই পিয়ারীর সঙ্গে আলাপ হয় রতনলাল রানার এবং সেই আলাপ ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়।

পিয়ারীর পদবী কি এবং কোথায় তার দেশ, কি তার জাত, কি মাতৃভাষা—কেউ কোনদিন জানতে পারেনি।

উর্দু, হিন্দি, বাংলা ও ইংরাজী চার-চারটে ভাষায় পিয়ারী এত সহজভাবে কথাবার্তা চালাতে পারে যে ওর মধ্যে কোনটা তার মাতৃভাষা বোঝাই দুষ্কর।

অত্যন্ত ঢ্যাঙ, রোগ। পরিধানে কখনো থাকে দামী সুট। প্রত্যেকটা ক্রিজ তার স্পষ্ট। আবার কখনো থাকে পায়জামা-পাঞ্জাবি, সেরওয়ানি অথবা ধূতি-পাঞ্জাবি ও তার উপরে জহরকেট। হাতে সর্বদা একটি মার্কোভিচের টিন ও সিগারেট-লাইটার।

কথাবার্তা বলে খুব কম। এমন একটা কঠিন গাম্ভীর্যের আবরণ দিয়ে সর্বদা নিজেকে আবৃত রাখে। যে আপনা হতেই তাকে যেন এড়িয়ে চলবার ইচ্ছা হয় সকলের।

পিয়ারী বা মিঃ পিয়ারী নামেই সে সর্বত্র পরিচিত।

পিয়ারীকে বিশ্বাস করবার রতনলালের কারণও ছিল, যেহেতু দু-তিনবার অত্যন্ত দুরূহ জটিল ব্যাপারে পিয়ারী তাকে উদ্ধার করে দিয়েছে।

তবে পিয়ারীর পলিসি হচ্ছে ফেল কড়ি মাখ তেল!

সেই পিয়ারী যখন স্বেচ্ছায় রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারটা নিজহাতে তুলে নিল, রতনলাল সত্যিই অনেকটা আশ্বস্ত বোধ করল।

অর্থব্যয় হবে ঠিক, কিন্ত যাহোক একটা ফয়সালা পিয়ারী করে দেবেই শেষ পর্যন্ত একটা কিছু।

রতনলালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পিয়ারী তার অফিস-কামরা হতে বের হয়ে এল। সিঁড়ির সামনে এসে তার সর্বোচ্চ ধাপের ওপরে দাঁড়িয়ে হাতের টিন থেকে একটা সিগারেট বের করল।

ওষ্ঠ্যপ্রান্তে সিগারেটটা চেপে ধরে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। লাইটারের সাহায্যে। তারপর ধীরমন্থর পদে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল।

এতদিন রানার রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারটা তার মাথার মধ্যে ভাল করে থিতোয়নি।

রানার মুখে দু-চারবার শুনেছে মাত্র। অবশ্য রত্নমঞ্জিলের মোটামুটি ইতিহাস তার অজ্ঞাত না।

রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে এতদিন সে বেশী মাথা ঘামায়নি, কারণ ওই ব্যাপারে তার এতদিন ততটা ইন্টারেস্ট ছিল না। কিন্তু এবারে তাকে ভাবতেই হবে।

রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারে খণ্ড খণ্ড ভাবে এতদিন যা সে শুনেছে এখন সেগুলো সব একত্রে গ্রথিত করে অখণ্ডভাবে চিন্তা করবার চেষ্টা করে। এ পর্যন্ত রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে যা জানা গিয়েছে। সে সব কিছু একত্রে দেখলে দাঁড়াচ্ছে, যে কোন কারণেই হোক। ঐ পুরনো বাড়ি রত্নমঞ্জিলের একটা সিক্রেট বা রহস্য আছে। এবং সেই কারণেই রতনলাল ছাড়াও রত্নমঞ্জিলের দ্বিতীয় খরিদ্দার মাথা তুলেছে।

এই দ্বিতীয় খরিদ্দারটি কে?

তবে এও ঠিক লোকটা যে সম্পদশালী তা বোঝাই যাচ্ছে, নচেৎ রানার সঙ্গে টেক্কা দেবার সাহস হত না। এই হচ্ছে প্রথম কথা।

দ্বিতীয়তঃ বামদেব অধিকারী হঠাৎ ব্যবহমপুরে গেলেন কেন?

তৃতীয়তঃ শ্ৰীমান দাড়িটি কে?

একটা দিন ও রাত পুরো নিজের মনে মনে চিন্তা করল। পিয়ারী এবং নিজের কার্যপদ্ধতিও ছকে ফেলল একটা।