১১৬তম অধ্যায়
বহু লোকবধে নির্বিণ্ন ভীষ্মের মরণোচ্ছা!
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! ভীষ্ম দশম দিবসে পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণের সহিত কিরূপ যুদ্ধ করিয়াছিলেন এবং কৌরবগণই বা কিরূপে পাণ্ডবদিগকে নিবারিত করিয়াছিলেন, তৎসমুদয় কীর্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! কৌরব ও পাণ্ডবগণের অদ্ভুত যুদ্ধবৃত্তান্ত শ্রবণ করুন। রোষাবিষ্ট কৌরবপক্ষীয় মহারথীগণ প্রতিদিন কিরীটীর অস্ত্ৰজালে প্রাণত্যাগ এবং ভীষ্ম স্বকৃত প্রতিজ্ঞানুসারে প্রতিদিন পাণ্ডবগণের বলক্ষয় করিতেন। কোন পক্ষেই জয়পরাজয় অবধারিত হয় নাই। কিন্তু দশম দিবসে ভীষ্ম ও অর্জ্জুন একত্র হইলে ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। পরমাস্ত্রবিৎ ভীষ্ম এই দিনে অজ্ঞাতনামগোত্ৰ শত শত মহাযোদ্ধার প্ৰাণ সংহার করিলেন। সেই ধর্ম্মাত্মা দশ দিন পাণ্ডবসৈন্যগণকে সন্তাপিত করিলে পর স্বীয় জীবনের উপর তাঁহার নির্ব্বেদ উপস্থিত হইল; সুতরাং আত্মজীবন-বিনাশে সমুৎসুক হইয়া আর অধিক মনুষ্য বধ করিবেন না ভাবিয়া সমীপবর্ত্তী যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, ‘হে যুধিষ্ঠির! তুমি মহাপ্রাজ্ঞ ও সর্ব্বশাস্ত্ৰে বিশারদ; এক্ষণে আমার ধর্ম্য [ধর্ম্মময়-হিতকর] ও স্বৰ্গ [দিব্য—স্বর্গজনক] বাক্য শ্রবণ কর; ভুরি ভুরি প্রাণীবধ করাতে এই দেহের উপর আমার নির্ব্বেদ [ঔদাসীন্য] উপস্থিত হইয়াছে; অতএব যদি আমার প্ৰিয়াচরণ তোমার অভিলষিত হয়, তাহা হইলে পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণসমভিব্যাহারে ধনঞ্জয়কে অগ্রসর করিয়া আমার প্ৰাণসংহারে যত্নবান হও।” সত্যদর্শী রাজা যুধিষ্ঠির ভীষ্মের অভিপ্ৰায় অবগত হইয়া ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সৃঞ্জয়গণসমভিব্যাহারে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলেন এবং সৈন্যগণকে এই বলিয়া প্রেরণ করিতে লাগিলেন যে, “হে সৈন্যগণ! ধাবমান হও এবং ভীষ্মের সহিত সমর করিয়া জয়লাভ কর; সত্যসন্ধ ধনঞ্জয়, সেনাপতি পাঞ্চালনন্দন ও ভীমসেন তোমাদিগকে রক্ষা করিবেন; হে সৃঞ্জয়গণ! ভীষ্ম হইতে কিছুমাত্র ভয় নাই। আমরা শিখণ্ডীকে অগ্রসর করিয়া ভীষ্মকে পরাজিত করিব।” ব্ৰহ্মলোকপরায়ণ পাণ্ডবগণ ক্ৰোধসহকারে এইরূপ প্ৰতিজ্ঞা করিয়া ভীষ্মকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত যত্নের পরাকাষ্ঠ অবলম্বনপূর্ব্বক শিখণ্ডী ও ধনঞ্জয়কে অগ্রসর করিয়া গমন করিলেন।
“সেই সময় সৈন্যসমবেত নানাদেশীয় মহাবল ভূপালগণ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা ও দুঃশাসনপ্রভৃতি সকল সহোদরগণ দুৰ্য্যোধনের আদেশানুসারে মধ্যগত ভীষ্মকে রক্ষা করিয়াছিলেন। অনন্তর তাঁহাকে অগ্রসর করিয়া শিখণ্ডী ও পাণ্ডবপ্রভৃতি সকলকে আক্রমণ করিলেন; ধনঞ্জয়ও শিখণ্ডীকে অগ্রসর করিয়া চেদি ও পাঞ্চলগণসমভিব্যাহারে ভীষ্মের, সাত্যকি অশ্বত্থামার, ধৃষ্টকেতু পৌরবের, যুধামন্যু অমাত্যসমবেত দুৰ্য্যোধনের, বিরাট সেনাসমভিব্যাহারে সসৈন্য জয়দ্রথের, যুধিষ্ঠির সসৈন্য শল্যের, ভীমসেন গজসৈন্যের এবং পাঞ্চালনন্দনগণ দ্রোণাচাৰ্য্যের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। এ দিকে রাজপুত্র বৃহদ্বল কণিকারধ্বজ সিংহকেতু অভিমন্যুর প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ জিঘাংসাপরবশ হইয়া ভূপতিগণসমভিব্যাহারে শিখণ্ডিসমেত ধনঞ্জয়কে আক্রমণ করিলেন।
“উভয়পক্ষ ভীষ্মকে অবলোকন করিয়া ভীষণ পরাক্রমপূর্ব্বক এইরূপে পরস্পর ধাবমান হইলে ধরামণ্ডল কম্পিত হইতে লাগিল এবং তাঁহাদিগের মহাশব্দ সিংহনাদে, শঙ্খ-দুন্দুভির নিস্বনে ও বাণরগণের বৃংহণে অতি ভয়ঙ্কর হইয়া চতুর্দ্দিকে ব্যাপ্ত হইল। নরেন্দ্রগণের সেই চন্দ্ৰসূৰ্য্যসদৃশ প্রভা বীরগণের অঙ্গদ ও কিরীটের প্রভায় মলিন হইয়া উঠিল। ধূলিপটল জলদাপটলের ন্যায়, শস্ত্ৰসকল বিদ্যুতের ন্যায় এবং শরাসনশব্দ মেঘ-গর্জ্জনের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। উভয়দলেই বাণ, শঙ্খ ও ভেরীর মহাশব্দ আরম্ভ হইল। প্রাস, শক্তি, ঋষ্টি ও শরসমূহে আকাশমণ্ডল আচ্ছাদিত হইয়া উঠিল। উভয় পক্ষের রথী, তুরঙ্গ পদাতিগণ পরস্পর সংহার করিতে লাগিল। উভয় পক্ষই পরস্পরকে বধ ও জয় করিবার নিমিত্ত অত্যন্ত সমুৎসুক হইয়া ছিলেন, সুতরাং দুই শ্যেনপক্ষী যেমন আমিষের নিমিত্ত পরস্পর যুদ্ধ করে, সেইরূপ কৌরব ও পাণ্ডবগণ ভীষ্মের নিমিত্ত ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন।”