১১৬তম অধ্যায়
জাতিপরিবর্ত্তনে পূর্ব্বাভাস ত্যাগ
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! মহর্ষিগণ জমদগ্নিপুত্র পরশুরামের। নিকট এই ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, আমি তপোবনে উহা শ্রবণ করিয়াছি। এক্ষণে এই উপলক্ষে সেই সাধুদিগের নিদর্শনস্বরূপ পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বকালে কোন জনশূন্য নিবিড় অরণ্যমধ্যে এক ফলমূলাহারী জিতেন্দ্রিয় তপোধন বাস করিতেন। ঐ মহর্ষি দীক্ষানিরত, শান্তস্বভাব, স্বাধ্যায়সম্পন্ন ও উপবাসপরায়ণ ছিলেন। বনচারী জন্তুসমুদয় সেই অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন মহাত্মার সদ্ভাব-দর্শনে বিশ্বস্তচিত্তে নিয়ত তাঁহার সন্নিধানে সমুপস্থিত থাকিত। ক্রূর ব্যাঘ্র, মদমত্ত মাতঙ্গ, দ্বীপী, গণ্ডার, ভল্লুক প্রভৃতি অন্যান্য শোণিতলোলুপ ভীমদর্শন শ্বাপদগণ তাঁহার শিষ্যের ন্যায় দাসভূত [ভৃত্যবৎ] ও প্রিয়চিকীর্ষু হইয়া প্রত্যহ তাঁহার নিকট আগমনপূৰ্ব্বক কুশলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিত।
“ঐ আশ্রমে একটি গ্রাম্য কুক্কুর বাস করিত। ঐ কুক্কুর ফলমূলাহারী, উপবাসনিরত, দুর্ব্বল ও শান্তস্বভাব ছিল। সে কদাপি মহর্ষিকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অন্যত্র গমন করিত না; সতত ভক্তিশ্রদ্ধা প্রদর্শন করিয়া তাঁহার পাদমূলে উপবিষ্ট থাকিত। তপোধন তাহার ভক্তিদর্শনে পরিতুষ্ট হইয়া মনুষ্যের ন্যায় তাহার প্রতি স্নেহ করিতেন। একদা এক মহাবলপরাক্রান্ত শোণিতলোপ স্বার্থপরায়ণ ক্ষুদ্র ব্যাঘ্ৰ ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হইয়া আহারলাভার্থ সৃক্কণী লেহন, পুচ্ছ আস্ফোটন [উত্তোলনাদি] ও মুখব্যাদানপূর্ব্বক সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় আশ্রমাভিমুখে আগমন করিল। তখন সেই সারমেয় ক্ষুদ্র ব্যাঘ্রকে সমাগত দেখিয়া প্রাণরক্ষাৰ্থ তপোধনকে কহিল, ‘ভগবন্! ঐ দেখুন, কুক্কুরদিগের পরমশত্রু দ্বীপী আমাকে বিনষ্ট করিবার নিমিত্ত আগমন করিতেছে; আপনি সৰ্ব্বজ্ঞ, এক্ষণে প্রসন্ন হইয়া আমাকে অভয় প্রদান করুন।’
“তখন সৰ্ব্বজীবের ভাবজ্ঞ মহর্ষি কুক্কুরের ভয়ের কারণ অবগত হইয়া তাহাকে কহিলেন, ‘বৎস! ক্ষুদ্র ব্যাঘ্র হইতে আর তোমার মৃত্যুভয় থাকিবে না। অতঃপর তুমি স্বীয় রূপ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক দ্বীপীর আকার প্রাপ্ত হও।’ মহর্ষি এই কথা কহিবামাত্র সারমেয় ক্ষুদ্র ব্যাঘ্রের আকার ধারণপূৰ্ব্বক সুবর্ণসদৃশ সমুজ্জ্বল অঙ্গপ্রভায় সুশোভিত হইয়া অকুতোভয়ে অবস্থান করিতে লাগিল। তখন সেই ক্ষুধাতুর দ্বীপী সম্মুখে আপনার অনুরূপ পশু সন্দর্শন করিয়া তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতি বিদ্বেষভাব পরিত্যাগ করিল।
“কিয়ৎক্ষণ পরে এক শোণিতলোলুপ ভয়ঙ্কর শার্দ্দূল ক্ষুধার্ত্ত হইয়া জিহ্বালেহন ও মুখব্যাদানপূৰ্ব্বক, সেই ক্ষুদ্র ব্যাঘ্রের মুখে আগমন করিতে লাগিল। মহর্ষির প্রধান স্নেহভাজন দ্বীপী তদ্দর্শনে ভীত হইয়া প্রাণরক্ষাৰ্থ তপোধনের শরণাপন্ন হইল; তপোধনও তাহাকে ভীত দেখিয়া তপঃপ্রভাবে অচিরাৎ ভীষণ শার্দ্দূলত্ব প্রদান করিলেন। তখন সেই সমাগত ব্যাঘ্র দ্বীপীকে শার্দ্দূলের ন্যায় অবলোকন করিয়া তাহার বিনাশবাসনা পরিত্যাগ করিল।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! এইরূপে সেই সারমেয় মহর্ষির প্রভাবে ব্যাঘ্রত্ব লাভ করিলে পর তাহার ফলমূলভক্ষণের অভিলাষ এককালে তিরোহিত হইয়া গেল। তদবধি সে মৃগরাজ সিংহের ন্যায় বন্যজন্তুসমুদয় ভক্ষণ করিয়া কালাতিপাত করিতে লাগিল।”