১১৬তম অধ্যায়
জমদগ্নির রেণুকা পরিণয়-পুত্র পরশুরামের জন্ম
অকৃতব্ৰণ কহিলেন, হে রাজন! মহাতপাঃ জমদগ্নি বেদাধ্যয়নে মনোনিবেশপূর্ব্বক তপানুষ্ঠান করিয়া নিয়মবলে বেদচতুষ্টয় সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিলেন। পরে রাজা প্রসেনজিৎ সন্নিধানে উপনীত হইয়া তৎকন্যা রেণুকাকে প্রার্থনা করিলে তিনি তাহাকে শুভলগ্নে রেণুকা সম্প্রদান করিলেন। তখন জমদগ্নি কৃতদার হইয়া আশ্রমে প্রবেশপূর্ব্বক পতিপরায়ণা পত্নীর সহিত তপানুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। কালসহকারে রেণুকাগর্ভে ক্রমে ক্ৰমে জমদগ্নির পঞ্চপুত্র উৎপন্ন হইল; তন্মধ্যে পরশুরামই সর্ব্বকনিষ্ঠ; কিন্তু তিনি সর্ব্বকনিষ্ঠ হইয়াও গুণপ্রভাবে সকলের জ্যেষ্ঠত্ব লাভ করিয়াছিলেন।
একদা কুমারগণ ফলাহরণার্থ প্রস্থান করিলে রেণুকা স্নান করিবার নিমিত্ত নিৰ্গত হইলেন। তিনি যদৃচ্ছাক্রমে গমন করিতেছেন, এই অবসরে চিত্ররাথনামক এক মহীপাল তাহার নেত্রপথে নিপতিত হইলেন। রেণুকা প্রভূতসম্পত্তিশালী কমলমাল্যধারী সেই ধরাপতিকে মহিষীর সহিত জলবিহার করিতে দেখিয়া অনঙ্গশরে ব্যথিত ও নিতান্ত অধীর হইয়া উঠিলেন। অনন্তর তিনি তদ্রূপ ব্যভিচার-দোষে দূষিত ও বিচেতন্যপ্ৰায় হইয়া শঙ্কিতমনে আশ্রমে প্রবেশ করিবামাত্র জমদগ্নি তাঁহাকে ধৈৰ্য্যচ্যুত ও ব্রাহ্মী লক্ষ্মী হইতে পরিভ্রষ্ট নিরীক্ষণ করিয়া সমস্তই অবগত হইলেন এবং ‘ধিক ধিক’ বলিয়া বারংবার নিন্দা ও তিরস্কার করিতে লাগিলেন।
অনন্তর জমদগ্নিনন্দন রুমন্বান, সুষেণ, বসু ও বিশ্বাবসু ইঁহারা আশ্রমে প্রত্যাগমন করিলে, মহামুনি জমদগ্নি ক্রমে ক্রমে তাঁহাদিগের মধ্যে সকলকেই মাতৃবিনাশ করিবার আদেশ প্রদান
পরাঙ্মুখ হইলেন। তখন জমদগ্নি ক্ৰোধাভরে একান্ত অধীর হইয়া তাহাদিগকে অভিশাপ প্ৰদান করিলেন; তাহারা শাপপ্রভাবে তৎক্ষণাৎ সংজ্ঞাবিহীন, পশুধৰ্মী ও জড়প্রায় হইয়া রহিলেন।
পরশুরামের মাতৃহত্যা
এই অবসরে পরশুরাম তথায় প্রত্যাগমন করিলে, মহাতপাঃ জমদগ্নি তাহাকে কহিলেন, “বৎস! তুমি অক্ষুব্ধচিত্তে ত্বদীয় পাপাচারিণী জননীকে এইক্ষণেই সংহার কর।” পরশুরাম তৎক্ষণাৎ পরশু গ্রহণপূর্ব্বক স্বীয় জননীর শিরশ্ছেদন করিলেন। অনন্তর ক্ৰোধশান্তি হইলে জমদগ্নি প্ৰসন্ন হইয়া কহিলেন, “বৎস! আমার নির্দেশানুসারে তুমি অতি দুষ্কর কর্ম্ম সম্পাদন করিলে, এক্ষণে অভিলাষানুসারে বর প্রার্থনা কর।” রাম কহিলেন, “হে তাত! যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তাহা হইলে জননীর পুনর্জীবন, আমি যে তাঁহাকে বধ করিয়াছি ইহা যেন তাহার স্মৃতিপথে উদিত না হয়, তাহার বধজনিত পাপ যেন আমাকে স্পর্শ করিতে না পারে, ভ্রাতৃগণের পুনঃপ্রকৃতি লাভ, সংগ্রামে অপ্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দীর্ঘায়ুঃপ্রাপ্তি, এই কয়েকটি বর প্রদান করুন।” জমদগ্নি ‘তথাস্তু।” বলিয়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে সেই সকল বর প্রদান করিলেন।
পরশুরামকর্ত্তৃক কার্ত্তবীৰ্য্য-সংহার
অনন্তর একদা জমদগ্নির পুত্ৰগণ পূর্ব্ববৎ আশ্রম হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন, এই অবসরে অনুপপতি মহাবীর কার্ত্তবীৰ্য্য তথায় উপস্থিত হইলেন। ঋষিপত্নী তাঁহাকে সমুচিত সৎকার করিলেও সেই যুদ্ধমদমত্ত কার্ত্তবীৰ্য্য তৎকৃত সৎকারে অনাদর প্রদর্শনপূর্ব্বক আশ্রম হইতে হোমধেনুর বৎসকে বলপূর্ব্বক আক্রমণ ও অপহরণ করিয়া তর্জ্জন-গর্জ্জনপূর্ব্বক আশ্রমের বৃহৎ বৃহৎ পাদপসকল চুৰ্ণ করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর রাম প্রত্যাগমন করিলে মহর্ষি এই বৃত্তান্তসকল তাঁহার কর্ণগোচর করিলেন। রাম পিতৃমুখে এই কথা শ্রবণ ও ধেনুকে দরদরিতধারে অনবরত রোদন করিতে অবলোকন করিয়া ক্ৰোধাভরে অধীর হইয়া উঠিলেন এবং তৎক্ষণাৎ ক্ষয়োম্মুখ অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইলেন। পরে রুচির শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক রণস্থলে বিক্রম প্রকাশ করিয়া শাণিত ভল্লাস্ত্ৰ দ্বারা কার্ত্তবীৰ্য্যের সহস্ৰসংখ্যক অৰ্গলতুল্য ভুজবন [বাহুসমূহ] ছেদন করিলে সে তৎক্ষণাৎ অভিভূত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইল।
অনন্তর কার্ত্তবীৰ্য্যের আত্মজ জাতক্ৰোধ হইয়া রামের অনুপস্থিতিকালে আশ্রমাভিমুখে জমদগ্নিকে লক্ষ্য করিয়া ধাবমান হইল এবং মহাবীৰ্য্য মহর্ষিকে সমরকার্যে পরাঙ্মুখ নিরীক্ষণ করিয়া অনবরত প্ৰহার করিতে লাগিল। তপস্বী জমদগ্নি অনাথের ন্যায় বারংবার আর্ত্তস্বরে “হা, রাম, হা রাম” বলিয়া প্রহারযন্ত্রণায় প্ৰাণ পরিত্যাগ করিলেন। তখন কার্ত্তবীৰ্য্য-পুত্রেরা স্বস্থানে প্রস্থান করিল। এই অবসরে পরশুরাম সমিধ হস্তে লইয়া আশ্রমে প্রত্যাগমন করিলেন এবং নিজ জনক জমদগ্নিকে মৃত ও তথ্যবিধ নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া দুঃখিত-মনে বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন।