১১৪তম অধ্যায়
অসার তিরস্কারবাক্যে উপেক্ষার ফল—সহ্যগুণ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মৃদুস্বভাবসম্পন্ন বিদ্বান্ ব্যক্তি সভামধ্যে প্রগল্ভ মূখকর্ত্তৃক তিরস্কৃত হইলে কিরূপ ব্যবহার করিবেন?”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি তোমার নিকট এই বিষয়ের যাথার্থ কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। যদি বুদ্ধিমান ব্যক্তি রোষাবিষ্ট না হইয়া নির্ব্বোধের তিরস্কারবাক্যে উপেক্ষা প্রদর্শন করেন, তাহা হইলে তিনি তাহার সমুদয় পুণ্যলাভ এবং তাহাতে আপনার সমুদয় পাপ সঞ্চার করিতে পারেন; অতএব মন্দ ব্যক্তিকে টিট্টিভের ন্যায় রুক্ষস্বরে তিরস্কার করিতে দেখিয়া উপেক্ষাপ্রদর্শন করাই বুদ্ধিমানের কর্ত্তব্য। যে ব্যক্তি লোকের বিরাগভাজন হয়, তাহার জীবন নিষ্ফল। ‘আমি সভামধ্যে অমুক মান্য ব্যক্তিকে এই কথা কহিয়া তিরস্কার করিলে সে লজ্জিতভাবে বিষণ্ণবদনে মৃতকল্প হইয়া রহিল’ মূঢ় ব্যক্তিরা এই বলিয়া নিয়ত আপনাদিগের পাপকর্ম্মের প্রশংসা করিয়া থাকে। ঐরূপ নীচাশয় নির্লজ্জ ব্যক্তির বাক্যে যত্নপূৰ্ব্বক উপেক্ষা প্রদর্শন করাই উচিত। নির্ব্বোধেরা যাহা বলুক না কেন, পণ্ডিত ব্যক্তির তাহা সহ্য করাই অবশ্য কর্ত্তব্য। অরণ্যমধ্যে কাকের নিরর্থক চীৎকারের ন্যায় সামান্য লোকের নিন্দা বা প্রশংসায় মহতের কিছুমাত্র লাভ বা ক্ষতির সম্ভাবনা নাই। পাপাত্মারা যদি বাক্যপ্রয়োগদ্বারাই লোককে দূষিত করিতে পারিত, তাহা হইলে তাহার বাক্য ক্ষতিকারক বলিয়া স্বীকার করা যাইত। কিন্তু যেমন একজনকে ‘তুমি মৃত্যুগ্রাসে নিপতিত হও’ বলিলেই সে প্রাণত্যাগ করে না, তদ্রূপ দুরাত্মারা কাহার প্রতি মিথ্যা দোষারোপ করিলে তাঁহার দুষিত হইবার সম্ভাবনা নাই। ময়ূর যেমন আপনার গুহ্যপ্রদেশ প্রদর্শনপূৰ্ব্বক নৃত্য করিয়া লজ্জিত হয় না, তদ্রূপ নিচাশয় ব্যক্তি সাধুগণের প্রতি দুৰ্ব্বাক্য প্রয়োগপূর্ব্বক আপনার জারজত্ব প্রকাশ করিয়াও লজ্জা বোধ করেন না।
“যাহার পক্ষে কিছুই অবাচ্য ও অকাৰ্য্য নাই, তাহার সহিত বাক্যালাপ করাও সাধুব্যক্তির কর্ত্তব্য নহে। যে ব্যক্তি প্রত্যক্ষে লোকের গুণব্যাখ্যান ও পরোক্ষে নিন্দা করিয়া থাকে, সে কুকুরের ন্যায় জ্ঞানহীন ও ধৰ্ম্মপরিভ্রষ্ট, তাহার দান ও হোমকাৰ্য্য কোনক্রমেই ফলোপধ্যায়ক হয় না। বিচক্ষণ ব্যক্তি অখাদ্য কুক্কুরমাংসের ন্যায় ঐরূপ পাপাত্মা নীচাশয় ব্যক্তির সংস্রব অবিলম্বেই পরিহার করিবেন। দুরাত্মারা মহতের অপবাদ ঘোষণা করিয়া আপনারই দোষ প্রত্যাখ্যান করে। যে ব্যক্তি ঐরূপ নিন্দুকের প্রতিকার করিবার প্রত্যাশা করে, তাহাকে ভস্মরাশিমধ্যে নিপতিত গর্দ্দভের ন্যায় দুঃখে নিমগ্ন হইতে হয়। যে ব্যক্তি সতত লোকাপবাদে নিরত থাকে, অশান্তপ্রকৃতি উন্মত্ত মাতঙ্গের ন্যায়, ভয়ঙ্কর শালবৃকের ন্যায় ও প্রচণ্ড কুকুরের ন্যায় তাহার সংসর্গ পরিত্যাগ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। উদ্ধৃঙ্খল, অবিনয়ী, পাপপরায়ণ, শত্রুতাচরণে তৎপর অশুভ কার্য্যে নিরত পাপাত্মাকে ধিক্! যদি কোন সাধুব্যক্তি ঐ দুরাত্মাদিগের কর্ত্তৃক তিরস্কৃত হইয়া প্রত্যুত্তরপ্রদানে প্রবৃত্ত হয়েন, তাহা হইলে ‘তুমি উহাদিগের বাক্যে প্রত্যুত্তর প্রদান করিও না’ বলিয়া তৎকালে তাঁহাকে নিবারণ করা কৰ্ত্তব্য। স্থিরবুদ্ধি ব্যক্তিরা মহতের সহিত নীচের সমাগম নিতান্ত দূষণীয় বলিয়া অশ্রদ্ধা করিয়া থাকেন। মূর্খ ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হইলে লোকের গাত্রে চপেটাঘাত, ধূলি ও তুয নিক্ষেপ এবং দশনে দর্শন নিপীড়নপূৰ্ব্বক তাহাকে ভয়প্রদর্শন করিয়া থাকে। যে মহাত্মা লোকসমাজে দুৰ্জ্জনকৃত ভৎসনায় উপেক্ষা করিতে পারেন এবং যিনি এই সমস্ত হিতোপদেশ সতত পাঠ করেন, তাঁহাকে কখনই। পরনিন্দাজনিত ক্লেশ সহ্য করিতে হয় না।”