১১৪তম অধ্যায়
অর্জ্জুন-সাত্যকি ভীত ধৃতরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রশ্ন
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমার সৈন্যগণ মহাবল পরাক্রান্ত, লঘু, বৃত্ত ও আয়ত কলেবর, ব্যাধিশূন্য, বৰ্ম্মসমাচ্ছন্ন, বহুশস্ত্র ও পরিচ্ছদ সম্পন্ন, শস্ত্রগ্রহণে সুনিপুণ এবং ন্যায়ানুসারে ব্যূহিত। তাহারা অতিশয় বৃদ্ধ নয়, বালকও নয় এবং কৃশ নয় ও স্কুলও নয়। তাহারা আমাদিগের নিকট সৎকৃত হইয়া আমাদেরই অভিলাষানুসারে সতত কার্য্যনির্ব্বাহ করিয়া থাকে। তাহারা আরোহণ, অধিরোহণ, প্ৰসরণ, প্লতগমন, সম্যক্ প্রহার, প্রবেশ ও নির্গম বিষয়ে সুদক্ষ এবং হস্তী, অশ্ব ও রথচৰ্য্যায় পরীক্ষিত। তাহারা পরস্পর বিদ্যাশিক্ষাভিলাষ, সৎকার বা বিবাহাদি সম্বন্ধ নিবন্ধন আমার সৈন্য মধ্যে প্রবিষ্ট হয় নাই। তাহারা অনাহতও নহে। আমরা যথাবিধ পরীক্ষা গ্রহণপূর্ব্বক ন্যায়ানুসারে বেতন প্ৰদান করিয়া তাঁহাদিগকে সৈন্য মধ্যে সন্নিবিষ্ট করিয়াছি। তাঁহারা কুলীন, তুষ্ট, পুষ্ট ও অনুদ্ধত এবং সকলেই যশস্বী ও মনস্বী। লোকপালসম পুণ্যকৰ্ম্মা অনেকানেক প্রধান প্রধান সচিবেরা নিরন্তর তাহাদিগকে প্রতিপালন করিতেছেন। আমাদিগের হিতানুষ্ঠান পরতন্ত্র মহাবল পরাক্রান্ত বহুসংখ্য ভূপালগণ স্বেচ্ছানুসারে আমাদের নিতান্ত অনুগত হইয়া তাহাদিগকে সতত রক্ষা করিতেছেন। আমার সৈন্যগণ, সমন্তাৎ সমাগত নদী সমূহে পরিপূর্ণ মহাসাগরের ন্যায়, পক্ষশূন্য পক্ষিসঙ্কাশ রথ, অশ্ব, মদাবী মাতঙ্গগণে পরিপূর্ণ রহিয়াছে। কিন্তু সেই সমুদায় সৈন্য যখন বিনষ্ট হইতেছে, তখন আমার নিতান্ত দুর্ভাগ্য সন্দেহ নাই। যোদ্ধৃবর্গ ঐ সৈন্য সাগরের অক্ষয় সলিল; বাহন-সকল তরঙ্গ; অসি ক্ষেপণী; গদা, শক্তি, শর ও প্রাস সমুদায় মৎস্য; ধ্বজ ও ভূষণ সকল রত্ন ও উৎপল; দ্রোণ উহার গভীর পাতাল, কৃতবর্ম্মা মহাহ্রদ এবং জলসন্ধ মহাগ্ৰাহস্বরূপ। উহা কর্ণরূপ চন্দ্রের উদয়ে উচ্ছলিত ও ধাবমান এবং বাহন রূপ বায়ুবেগে বিকম্পিত হইয়া থাকে। হে সঞ্জয়! মহাবীর ধনঞ্জয় ও যুযুধান আমার সেই সৈন্যসাগর ভেদ করিয়া যখন গমন করিয়াছে, তখন বোধ হইতেছে, তাহার আর কিছুই অবশিষ্ট নাই। যাহা হউক, কৌরবগণ ঐ দুই বীর পুরুষকে সৈন্য মধ্যে প্রবেশ করিতে ও সিন্ধুরাজ জয়দ্রথকে গাণ্ডীবমুক্ত বাণের সমীপবর্তী হইতে দেখিয়া সেই ভয়ানক বিপৎকালে কি কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলেন? আমি তাঁহাদিগকে মৃত্যুগ্রস্ত বলিয়া অবধারিত করিয়াছি। তাঁহাদের বল, বিক্রম, আর পূৰ্ব্ববৎ অবলোকিত হইতেছে না। মহাবীর কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয় অক্ষত কলেবরে সৈন্য মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে, তাঁহাদিগকে নিবারণ করিতে পারে এমন আর কেহই নাই। হে সঞ্জয়! আমি বহুসংখ্য যোদ্ধাদিগকে পরীক্ষা করিয়া ন্যায়ানুসারে বেতন প্রদান ও কতকগুলিকে কেবল প্রিয়বাক্য দ্বারা নিযুক্ত করিয়াছি। আমার সৈন্য মধ্যে কেহই অসৎকৃত হইয়া অবস্থান করিতেছে না। সকলেই স্ব স্ব কার্য্যানুরূপ অন্ন ও বেতন প্রাপ্ত হইতেছে। তাহাদের মধ্যে কেহ যুদ্ধে অপটু, অল্প বেতনে নিযুক্ত অথবা অবৈতনিক নহে। আমি জ্ঞাতি, পুত্র ও বন্ধু বান্ধবগণের সহিত তাহাদিগকে দান, মান ও আসন প্রদান দ্বারা যথাসাধ্য সৎকার করিয়া থাকি; কিন্তু তাহারা সাত্যকির বাহুবলে বিমর্দ্দিত ও মহাবীর অর্জ্জুনের দর্শন মাত্রেই পরাজিত হইয়াছে। সুতরাং আমার নিতান্ত দুর্ভাগ্য, তাহার সন্দেহ নাই। আমি সংগ্রামস্থলে রক্ষ্য [সৈন্য] ও রক্ষক [সেনাপতি] এই উভয়ের গতি একই প্রকার দেখিতেছি।
হে সঞ্জয়! আমার মূঢ় পুত্র দুর্য্যোধন অর্জ্জুনকে জয়দ্রথের সম্মুখে অবস্থান ও সাত্যকিকে নিতান্ত নির্ভীকের ন্যায় রণস্থলে প্রবেশ করিতে নিরীক্ষণ করিয়া তৎকালোচিত কোন্ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিল এবং আমার পক্ষীয় বীরগণই বা কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয়কে সমস্ত অস্ত্র জাল নিবারণপূর্ব্বক সেনা মধ্যে প্রবেশ করিতে দেখিয়া কিরূপ অবধারণ করিলেন? বোধ হয়, আমার পুত্রেরা কৃষ্ণ ও সাত্যকিকে অর্জ্জুনের সাহায্যার্থ উদ্যত দেখিয়া সাতিশয় শোকাকুল হইতেছে এবং সাত্যকি ও অর্জ্জুনকে সেনা সকল অতিক্ৰমণ ও কৌরবগণকে পলায়ন করিতে দেখিয়া শোক সম্বরণ করিতে সমর্থ হইতেছে না। তাহারা অস্মৎপক্ষীয় রথীদিগকে শত্রুজয়ে উৎসাহ শুন্য ও পলায়নে সমুদ্যত, সাত্যকি ও ধনঞ্জয়ের শরে রথোপস্থ সমুদায় সারথি শূন্য ও যোদ্ধাদিগকে নিহত এবং অসংখ্য হস্তী, অশ্ব, রথ ও বীরগণকে ব্যগ্রমনে ধাবমান দেখিয়া যারপর নাই শোকসন্তপ্ত হইতেছে। তাহারা কতকগুলি মাতঙ্গকে অর্জ্জুনশরে পলায়িত ও কতকগুলিকে ভূতলে নিপতিত এবং সাত্যকি ও পার্থের শরে অশ্ব সকলকে আরোহিশুন্য ও মনুষ্যগণকে রথশূন্য নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত অনুতাপ করিতেছে। পদাতিগণকে সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক ধাবমান দেখিয়া বিজয়লাভপ্রত্যাশা তাহাদের অন্তঃকরণ হইতে একেবারে অন্তর্হিত এবং একান্ত দুর্জ্জয় মহাবীর ধনঞ্জয় ও কৃষ্ণকে ক্ষণমধ্যে দ্রোণসৈন্যগণকে অতিক্রম করিতে দেখিয়া তাহাদের শোকসাগর উচ্ছলিত হইয়াছে।
হে সঞ্জয়! আমি কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয়কে সাত্যকি সমভিব্যাহারে আমার সৈন্য মধ্যে প্রবিষ্ট হইতে শ্রবণ করিয়া একান্ত বিমোহিত হইতেছি। যাহা হউক, মহাবীর শৈনেয় ভোজ সৈন্য ভেদ করিয়া পৃতনা মধ্যে প্রবিষ্ট হইলে কৌরবগণ কি রূপ কাৰ্য্য করিলেন এবং পাণ্ডবেরা দ্রোণশরে নিতান্ত নিগৃহীত হইলে কিরূপ যুদ্ধ হইতে লাগিল? এক্ষণে তৎসমুদায় কীৰ্ত্তন কর। মহাবীর দ্রোণাচার্য্য বলবান্দিগের অগ্রগণ্য, কৃতাস্ত্র ও সমরবিশারদ, পাঞ্চালগণ কিরূপে তাঁহাকে শরনিকরে বিদ্ধ করিল? তাঁহারা অর্জ্জুনেরই জয়লাভার্থী, সুতরাং দ্রোণের সহিত তাঁহাদের শত্রুভাব বদ্ধমূল হইয়া রহিয়াছে। মহারথ দ্রোণও তাহাদিগের প্রতি বিদ্বেষভাব প্রদর্শন করিয়া থাকেন। হে সঞ্জয়! তুমি সমুদায় বৃত্তান্তই অবগত আছ। এক্ষণে এই সমুদায় বৃত্তান্ত এবং মহাবীর অর্জ্জুন সিন্ধুরাজ বধার্থ যেরূপ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, তাহাও কীৰ্ত্তন কর।”
সঞ্জয়ের সতিরস্কার যুদ্ধবৃত্তান্তবর্ণন
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনার অপরাধ বশতই এই দারুণ ব্যসন প্রাপ্ত হইয়া সামান্য লোকের ন্যায় শোক করা আপনার কর্ত্তব্য নহে। পূর্ব্বে প্রাজ্ঞতম বিদুর প্রভৃতি আপনার সুহৃদ্গণ পাণ্ডবগণকে পরিত্যাগ করিতে আপনাকে নিষেধ করিয়াছিলেন; যে ব্যক্তি হিতাভিলাষী সুহৃদগণের বাক্য শ্রবণ না করে তাঁহাকে অতিশয় দুঃখ প্রাপ্ত হইয়া আপনার ন্যায় শোক করিতে হয়। পূর্ব্বে সর্ব্বলোক তত্বজ্ঞ বাসুদেব সন্ধিস্থাপন করিবার নিমিত্ত আপনার নিকট প্রার্থনা করিয়াছিলেন। কিন্তু আপনি তাঁহার মনোরথ পরিপূর্ণ করেন নাই। তিনি আপনার নির্গুণত্ব, পুত্রগণের প্রতি পক্ষপাত, ধর্মের দ্বৈধভাব, পাণ্ডবগণের প্রতি মৎসরতা ও কুটিল অভিপ্রায় এবং আর্ত্ত প্রলাপ এই সমস্ত অবগত হইয়া কৌরবগণের বিপক্ষে সমরানল প্রজ্বলিত করিয়াছেন। হে মহারাজ! আপনার অপরাধেই এই বিপুল লোকক্ষয় উপস্থিত হইয়াছে। এ বিষয়ে রাজা দুৰ্য্যোধনকে দোষী করা আপনার উচিত হইতেছে না। প্রথমে, মধ্যে বা শেষে আপনার কোন সৎকাৰ্য্যই নিরীক্ষিত হয় না। ফলত আপনিই এই পরাজয়ের মূল কারণ। অতএব এক্ষণে স্থিরচিত্তে লোকের অনিত্যতা অবগত হইয়া এই দেবাসুরোপম ঘোরতর যুদ্ধ বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করুন।
পাণ্ডবগণসহ কৃতবর্ম্মার তুমুল যুদ্ধ
সত্যবিক্রম সাত্যকি সৈন্য মধ্যে প্রবিষ্ট হইলে ভীমসেন-প্রমুখ পাণ্ডবগণও আপনার সৈন্যাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। তখন একমাত্র মহারথ কৃতবর্ম্মা ক্রোধ পরবশ অনুচরগণ সমবেত পাণ্ডবগণকে সহসা আগমন করিতে দেখিয়া তাঁহাদের নিবারণে প্রবৃত্ত হইলেন। যেমন বেলাভূমি উচ্ছলিত অর্ণবকে অবরোধ করিয়া থাকে, তদ্রূপ মহাবীর কৃতবর্ম্মা পাণ্ডব সৈন্যগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবগণ সমবেত হইয়াও হার্দ্দিক্যকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হইলেন না। তদ্দর্শনে আমরা সকলেই চমৎকৃত হইলাম। অনন্তর ভীমসেন তিন শরে কৃতবর্ম্মানে বিদ্ধ করিয়া পাণ্ডবগণকে পুলকিত করত শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। তখন সহদেব বিংশতি, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির পাঁচ, নকুল এক শত, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র ত্রিসপ্ততি, ঘটোৎকচ সাত ও ধৃষ্টদ্যুম্ন তিন বাণে কৃতবর্ম্মাকে নিতান্ত নিপীড়িত করিলেন। তৎপরে বিরাট ও দ্রুপদ তিন তিন শরে হার্দ্দিক্যকে বিদ্ধ করিলে শিখণ্ডী তাঁহাকে প্রথমে পাঁচ শরে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় হাস্যমুখে বিংশতি বাণে বিদ্ধ করিলেন।
তখন মহাবীর কৃতবর্ম্মা তাঁহাদিগের প্রত্যেকের উপর পাঁচ পাঁচ শর নিক্ষেপ পূর্ব্বক ভীমসেনকে সাত শরে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার ধনু ও ধ্বজ ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তৎপরে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া সত্বরে সেই ছিন্ন কার্ম্মুক ভীমের বক্ষস্থলে সপ্ততি নিশিত শর প্রহার করিলেন। মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেন হার্দ্দিক্য শরে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া ভূমিকম্প কালীন অচলের ন্যায় একান্ত বিচলিত হইতে লাগিলেন। যুধিষ্ঠির প্রমুখ মহাবীর সকল ভীমকে তদবস্থ অবলোকনপূর্ব্বক তাঁহাকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত কৃতবর্ম্মাকে রথসমূহে অবরুদ্ধ করিয়া শরনিকরে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন।
অনন্তর মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেন সংজ্ঞা লাভ করিয়া হেমদণ্ড মণ্ডিত লৌহময়ী শক্তি গ্রহণ পূর্ব্বক সত্বরে কৃতবর্ম্মার রথাভিমুখে নিক্ষেপ করিলেন। সেই নির্মোক মুক্ত উরগসদৃশ ভীমভুজ-নির্মুক্ত অতিভীষণ শক্তি কৃতবর্ম্মার অভিমুখে প্রজ্বলিত হইতে লাগিল। মহাবীর হার্দ্দিক্য সেই যুগান্তানল সঙ্কাশ কনক ভূষণ শক্তি দুই শরে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন সেই কৃতবর্ম্ম বিশিখ-বিচ্ছিন্ন শক্তি নভোমণ্ডল পরিভ্রষ্ট উল্কার ন্যায় দশ দিক্ উদ্ভাসিত করিয়া ভূতলে নিপতিত হইল। ভীম পরাক্রম ভীমসেন শক্তি নিস্ফল হইল দেখিয়া ক্রোধভরে অন্য মহাস্বন শরাসন গ্রহণ পূর্ব্বক হার্দ্দিক্যকে নিবারণ করিয়া পাঁচ বাণে তাঁহার বক্ষস্থল আহত করিলেন। ভোজরাজ কৃতবর্ম্মা ভীমশরে ক্ষতবিক্ষতকলেবর হইয়া বিকসিত রক্তাশোকের ন্যায় শোভমান হইলেন। অনন্তর তিনি ক্রোধাবিষ্ট হইয়া হাস্য মুখে ভীমকে তিন শরে বিদ্ধ করিয়া সেই সমস্ত যত্নবান্ মহারথগণকে তিন তিন বাণে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তাঁহারাও সাত সাত শরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহারথ কৃতবর্ম্মা রোষপরবশ হইয়া হাস্য মুখে ক্ষুরপ্ৰাস্ত্র দ্বারা শিখণ্ডীর কার্মুক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। মহাবীর শিখণ্ডী তদ্দর্শনে ক্রোধে একান্ত অধীর হইয়া অসি ও সুবর্ণ-সমলঙ্কৃত ভাস্বর চর্ম্ম গ্রহণপূর্ব্বক সত্বরে চর্ম্ম বিঘূর্ণিত করিয়া কৃতবর্ম্মার রথাভিমুখে অসি নিক্ষেপ করিলেন। সেই ভীষণ অসি কৃতবর্ম্মার সশর শরাসন ছেদন পূর্ব্বক অঙ্গুরতল পরিভ্রষ্ট জ্যোতির ন্যায় ধরণীতলে নিপতিত হইল। ইত্যবসরে মহারথগণ সায়ক দ্বারা কৃতবর্ম্মাকে গাঢ়তর বিদ্ধ করিতে লাগিলেন।
শিখণ্ডিপ্রমুখ-পাণ্ডবগণের পরাজয়
তখন মহাবীর কৃতবর্ম্মা সেই বিশীর্ণ কাৰ্ম্মুক পরিত্যাগ পূর্ব্বক অন্য ধনু গ্রহণ করিয়া তিন তিন শরে পাণ্ডবগণকে ও আট বাণে শিখণ্ডীকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর শিখণ্ডী কৃতবর্ম্মার শরে বিদ্ধ হইয়া সত্বরে অন্য ধনু গ্রহণপূর্ব্বক কূৰ্ম্মনখ শর দ্বারা তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। হৃদিকাত্মজ কৃতবর্ম্মা তদ্দর্শনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া শার্দ্দূল যেমন কুঞ্জরের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ মহাত্মা ভীষ্মের মৃত্যুর নিদান মহাবীর শিখণ্ডীর প্রতি বল প্রদর্শন পূর্ব্বক মহাবেগে ধাবমান হইলেন। তখন সেই দিগ্গজ সঙ্কাশ প্রজ্বলিত পাবক সদৃশ বীরদ্বয় পরস্পরের প্রতি শরনিকর বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা কখন শরাসন আস্ফালন, কখন সায়ক সন্ধান এবং কখন বা সূর্য্যকিরণ সন্নিভ বহুসংখ্যক শর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। এই রূপে সেই যুগান্তকাল প্রতিম বীরদ্বয় পরস্পরকে সুতীক্ষ্ণ শরে সন্তাপিত করিয়া ভাস্করদ্বয়ের ন্যায় শোভমান হইলেন। মহাবীর কৃতবর্ম্মা মহারথ শিখণ্ডীকে ত্ৰিসপ্ততি শরে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় সাত বাণে বিদ্ধ করিলেন। শিখণ্ডী হার্দ্দিকের বাণে গাঢ়বিদ্ধ, নিতান্ত ব্যথিত ও মোহে অভিভূত হইয়া সশর শরাসন পরিত্যাগপূর্ব্বক রথোপস্থে উপবিষ্ট হইলেন। কৌরবপক্ষীয় বীরগণ শিখণ্ডীকে বিষণ্ন দেখিয়া কৃতবর্ম্মাকে যথোচিত সৎকার করিয়া পতাকা সকল কম্পিত করিতে লাগিলেন। তখন শিখণ্ডীর সারথি তাঁহাকে তদবস্থ অবলোকন করিয়া সত্বরে রণস্থল হইতে অপসারিত করিল।
হে মহারাজ! পাণ্ডবগণ শিখণ্ডীকে নিতান্ত অবসন্ন দেখিয়া অবিলম্বে রথ সমুদায়দ্বারা কৃতবর্ম্মারে অবরোধ করিলেন; কিন্তু মহারথ কৃতবর্ম্মা একাকী হইয়াও অদ্ভুত বল প্রকাশপূর্ব্বক সানুচর পাণ্ডবগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। তৎপরে তাঁহাদিগকে পরাজয় করিয়া চেদী, পাঞ্চাল, সৃঞ্জয় ও কৈকেয়দিগকে পরাজয় করিলেন। পাণ্ডবগণ কৃতবর্ম্মার শরে একান্ত তাড়িত হইয়া ইতস্তত ধাবমান হইতে লাগিলেন; কোন ক্রমেই ধৈৰ্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক যুদ্ধ করিতে সমর্থ হইলেন না। তখন মহাবীর কৃতবর্ম্মা ভীমসেন প্রমুখ পাণ্ডবগণকে পরাজয় করিয়া বিধূম-পাবকের ন্যায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! এই রূপে পাণ্ডবেরা হার্দ্দিক্য শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া সমর পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন।