রাজার আদেশে সব এল মন্ত্রিগণ।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্য্য দ্রোনের নন্দন।।
ভূরিশ্রবা সোমদত্ত বাহ্লীক বিদুর।
কুলে শীলে বুদ্ধিবলে খ্যাত তিনপুর।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, অবধান জ্যেষ্ঠতাত।
শুনি যে পাণ্ডব জীয়ে আছে কুন্তী সাথ।।
এতকাল কোথা ছিল, লুকাইয়া কেন।
কিছুত ইহার আমি না বুঝি কারণ।।
হেন বুঝি চিত্তে প্রায় আমারে আক্রোশ।
আমি সে সবার স্থানে নাহি করি দোষ।।
তবে কেন গুপ্তবেশে পাঞ্চালে থাকিয়া।
বিভা কৈল পঞ্চ ভাই মোরে না বলিয়া।।
কহ কি করিব এবে বিধান ইহার।
শুনিয়া কহেন তারে গঙ্গার কুমার।।
তব পুত্রাধিক তোমা সেবিত পাণ্ডব।
তুমি তায় পুত্রাধিক করিতে গৌরব।।
কি বুদ্ধি হইল তোমা না জানি কারণ।
বারণাবতেতে পাঠাইলা পুত্রগণ।।
না জানি তথায় কিবা কৈল পুরোচন।
জতুগৃহে দগ্ধ কৈল, বলে সর্ব্বজন।।
ত্রিভুবন যুড়ি মম অকীর্ত্তি হইল।
আপনি থাকিতে ভীষ্মে এতেক করিল।।
যদবধি জতুগৃহ হইল দাহন।
তোমাদিগে নাহি চাহি মেলিয়া নয়ন।।
জননী সহিত জীয়ে পাণ্ডুর কুমার।
ইহার অধিক রাজা কি ভাগ্য তোমার।।
অপযশ অধর্ম্ম সকল তব গেল।
তোমার পূর্ব্বের ধর্ম্ম উদয় হইল।।
এক্ষণেতে এই কর্ম্ম করহ রাজন।
কর পাণ্ডু-পুত্রগণ সঙ্গেতে মিলন।।
আমি একা নাহি বলি, সবার বিচার।
যেন তুমি, তেন পাণ্ডু নৃপতি আমার।।
যেন কুন্তী তেন বধূ গান্ধার-নন্দিনী।
যেন যুধিষ্ঠির তেন দুর্য্যোধনে মানি।।
ইথে ভেদাভেদ ভদ্র নাহিক রাজন্।
পাণ্ডুপুত্র সহ তব দ্বন্দ্ব কি কারণ।।
তার পিতা পাণ্ডু ছিল, পৃথিবীর রাজা।
তাঁহার সকল সৈন্য রাজ্য ধন প্রজা।।
সে জীয়ন্তে তাহারে ত্যজিবে কোন্ জন।
তব হিত হেতু তাই বলি হে রাজন।।
অর্দ্ধরাজ্য দিয়া কর পাণ্ডবেরে বশ।
পৃথিবী যুড়িয়া রাজা হৈবে তব যশ।।
কীর্ত্তি রাখ নৃপতি, কীর্ত্তি সে বড় ধন।
হতকীর্ত্তি অভাজন জীয়ন্তে মরণ।।
কীর্ত্তি রহে নরপতি যাবৎ ধরণী।
যত পূর্ব্বদোষ খণ্ডিবেক নৃপমণি।।
ভীষ্মের বচন অন্তে কহিলেন গুরু।
সর্ব্বগুণবাণ তুমি যেন কল্পতরু।।
আপনার হিতাহিত বিচার কারণ।
ধৃতরাষ্ট্র আনিয়াছে সব মন্ত্রিগণ।।
সে কারণে হিতকথা চাহি কহিবার।
শুনহ ক্ষত্রিয়গণ মম যে বিচার।।
ধর্ম্ম অর্থ যশ শ্রেয় সবার কল্যাণ।
সব কহিলেন গঙ্গাপুত্র মতিমান।।
এক্ষণেতে এই কর্ম্ম করহ ভূপাল।
প্রিয়ম্বদ একজন পাঠাও পাঞ্চাল।।
বিবাহ-সামগ্রী লৈয়া মঙ্গল-বাজন।
নানা অলঙ্কার দ্রব্য করিয়া সাজন।।
দ্রৌপদীরে তুষিবে অনেক অলঙ্কারে।
নানারত্নে তুষিবেক পঞ্চ সহোদরে।।
পুনঃপুনঃ সন্তোষিয়া কুন্তীরে কহিবে।
যেন পূর্ব্ব দুঃখ স্মরি রুষ্ট না হইবে।।
দ্রুপদ রাজার মান্য দেহ বহু ধন।
প্রত্যক্ষ করিবে তাহা সব পুত্রগণ।।
হেন জন পাঠাহ সুশীল সত্যবাদী।
পাণ্ডব তোমাতে যেন না হয় বিবাদী।।
এত বাক্য যদি বলিলেন ভীষ্ম দ্রোণ।
ক্রোধমুখে উত্তর করির বৈকর্ত্তন।।
ভাল মন্ত্রী আনিলা মন্ত্রণা করিবারে।
সবাই শত্রুর অংশ, খ্যাত এ সংসারে।।
মুখেতে সুহৃদ তব, অন্তরেতে আন।
যে কহিল, বুঝহ করিয়া অনুমান।।
ধন জন সম্পদ এ সবার ভিতরে।
সবাকারে দিয়াছ না দিয়াছ কাহারে।।
তাপি পাণ্ডব-অংশ, তোমার অহিত।
জিহ্বায় অন্তর-বার্ত্তা হতেছে বিদিত।।
রাজা হৈয়া যেই জন আপনা না বুঝে।
দুষ্ট-মন্ত্রী-মন্ত্রণাতে স্বংশেতে মজে।।
শুনি ক্রোধে বলে ভলদ্বাজের কুমার।
ওরে দুষ্ট, শুনি কহ তোর কি বিচার।।
কলহ হরিতে প্রায় চাহ তার সহ।
নিকট বাঞ্ছহ প্রায় যেতে যমগৃহ।।
ভালমতে জানি আমি তোর বীরপণা।।
দেখিল পাঞ্চালরাজ্যে তাহা সর্ব্বজনা।
লক্ষ রাজা সবে একা বেড়িল অর্জ্জুনে।।
পলাইয়া গেলা, তাই রহিলা জীবনে।
হেন জন সহ দ্বন্দ্ব চাহ কহিবারে।।
তোর মত নির্লজ্জ না দেখি এ সংসারে।
কিমতে কহিব আমি এমত বিচার।।
কুরু-কুল ক্ষয় হৈবে সবার সংহার।
এত শুনি বলিলা বিদুর মহামতি।।
কি হেতু নিঃশব্দ হৈয়া আছহ নৃপতি।।
আপনি না বুঝ কেন করিয়া বিচার।
ভীষ্ম দ্রোণ সম হিতকারী কে তোমার।।
এ দোঁহার গুণে কেবা আছে ভূমণ্ডলে।
বিচারে অমরগুরু, তেজে আখণ্ডলে।।
ধর্ম্মেতে সাক্ষাৎ ধর্ম্ম ত্রিভুবনে খ্যাত।
শীলতায় পূর্ব্বে যেন ছিল রঘুনাথ।।
কভু নাহি তব মন্দ ভীষ্ম মুখে ভাষে।
সর্ব্বদা তোমার হিত সর্ব্বলোকে ঘোষে।।
এ দোঁহার বাক্য ঠেলে দুষ্ট অধোগামী।
কি কারণে উত্তর না দেহ রাজা তুমি।।
ভীষ্ম দ্রোণ যে বলেন সবার স্বীকার।
ইহা না করিয়া চাহ কি করিতে আর।।
কলহ করিতে বুঝি চাহ নরপতি।
কে তোমার যুঝিবেক অর্জ্জুন-সংহতি।।
এই কর্ণ দুর্য্যোধন সসৈন্য সংহতি।
পাঞ্চালেতে ছিল এক লক্ষ্য নরপতি।।
সবারে করিল জয় পার্থ একেশ্বর।
শুনিয়া থাকিবা যে করিল বৃকোদর।।
অস্ত্রহীন, বৃক্ষ লয়ে প্রবেশিয়া রণে।
এক লক্ষ নৃপসৈন্য করিল মথনে।।
এক্ষণে সহায় হৈবে সেই রাজগণ।
স্ব-অস্ত্রে করিবে যুদ্ধ ভাই পঞ্চজন।।
সহায় সর্ব্বস্ব যার মন্ত্রী বিশ্বপতি।
আর যত যদুগণ বৈসে দ্বারাবতী।।
মাতুল-নন্দন বলভদ্র সখা যার।
শ্বশুর দ্রুপদ সহ যতেক কুমার।।
বিশেষ তোমার দেখ যত মন্ত্রীগণ।
ভালমতে জানহ কি সবাকার মন।।
আমি জানি সবে হৈবে পাণ্ডব-সহায়।
দ্বন্দ্ব ইচ্ছা কর তুমি কার ভরসায়।।
আর বার্ত্তা তুমি নাহি জান নরপতি।
রাজ্যের যতেক লোক করয়ে যুকতি।।
পাণ্ডুপুত্র জীয়ে আছে, শুনিয়া শ্রবণে।
দেখিতে তাঁদের বাঞ্ছা করে সর্ব্বজনে।।
সবে ইচ্ছা করে রাজা যুধিষ্ঠির -পতি।
তার সহ দ্বন্দ্বে ভদ্র নাহি নরপতি।।
সহজে এ শিশুগণ কি জানে বিচার।
মোর বাক্য শুন রাজা যে হিত তোমার।।
জতুগৃহে পোড়াইলা লজ্জিত অন্তরে।
সব দোষ গেল পুরোচনের উপরে।।
প্রিয়বাক্যে হেথায় আনহ পাণ্ডুসুতে।
ঘুচিবেক লজ্জা, যশ ঘুষিবে জগতে।।
বিদুরের বচনেতে ধৃতরাষ্ট্র কয়।
যা বলিলা বিদুর, আমার মনে লয়।।
পাণ্ডবে প্রবোধে হেন নাহি অন্য জন।
আপনি বিদুর তুমি করহ গমন।।
এতেক বলিল যদি অন্ধ নরপতি।
শুনিয়া যে সভাজন হৈল হৃষ্টমতি।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
কাশীরাম কহিছে শ্রবণে ভবে তরি।।