১১৩তম অধ্যায়
ঋষ্যশৃঙ্গের অঙ্গরাজ্যে আগমন
বিভাণ্ডক কহিলেন, “বৎস! অমিত-পরাক্রমশালী রাক্ষসগণ অদ্ভুত রূপধারণ করিয়া তপোবিঘ্ন বাসনায় সর্ব্বদা ইতস্তত বিচরণ করিয়া থাকে। তাহারা অগ্ৰে অনুপম রূপমাধুরী প্রদর্শনপূর্ব্বক বিবিধ উপায়ে বনবাসী মুনিগণকে প্রলোভিত করে; পশ্চাৎ ভীষণমূর্ত্তি ধারণ করিয়া তাহাদিগকে সনাতন সুখ ও পুণ্যলোক হইতে ভ্ৰষ্ট করে। নিত্য-সুখাভিলাষী, জিতেন্দ্ৰিয় মুনিগণ কোনপ্রকারে তাহাদিগের সেবা করেন না। তাপসীগণকে বিপন্ন করাই সেই সকল পাপাচার্যপরায়ণ নিশাচরগণের ক্রীড়া; অতএব তপোধনগণ তাহাদিগের প্রতি ভ্রূক্ষেপও করেন না। সেই অসাধুজনোচিত অপেয় পাপময় মদ্য এবং বিচিত্ৰ উজ্জ্বল সুরভিমাল্য মুনিজনের ভৌগোচিত নহে। তাহারা রাক্ষস, ব্ৰহ্মচারী নহে।” বিভাণ্ডকমুনি এইরূপে নিজ পুত্রকে নিবারণ করিয়া বেশবনিতা [বেশভূষায় মনোহারিণী]-গণের অন্বেষণ করিতে গমন করিলেন; দিনত্রয় অনুসন্ধান করিয়াও যখন তাহাদিগকে প্রাপ্ত হইলেন না, তখন তিনি আপন আশ্রমে প্রত্যাগমন করিলেন।
যে সময়ে বিভাণ্ডক-ঋষি বৈদিকবিধি অনুসারে ফল আহরণ করিতে গমন করিলেন, সেই সময় সেই বেশযোষা ঋষ্যশৃঙ্গ-ঋষিকে প্রলোভিত করিবার নিমিত্ত আশ্রমে আগমন করিল। ঋষিকুমার বেশবিলাসিনীকে দর্শন করিবামাত্র প্রফুল্লচিত্তে সসম্ভ্রমে গাত্রোত্থান করিয়া কহিলেন, “হে ব্রহ্মন! চলুন, আমার পিতা প্রত্যাবৃত্ত হইতে না হইতেই আমরা আপনার আশ্রমে গমন করি।”
অনন্তর বারবিলাসিনীগণ এইরূপ কৌশলে কাশ্যপ ঋষির একমাত্ৰ কুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে নৌকায় প্রবেশিত করিয়া বিবিধ উপায়ে তাঁহার প্রমোদবৰ্দ্ধনপূর্ব্বক অঙ্গাধিপতি লোমপাদসমীপে উপস্থিত হইল। বেশ্যাগণ তাঁহাকে আশ্রম দর্শন করাইবার নিমিত্ত তরণীসংস্থাপনপূর্ব্বক সেই সকল কৃত্রিম তরুলতাদি দ্বারা নাব্যাশ্রম নামে একটি বিচিত্ৰ কানন প্রস্তুত করিল।”
ঋষ্যশৃঙ্গ আগমনে অঙ্গরাজ্যে বারিবর্ষণ—ঋষির অঙ্গরাজকন্যা শান্তা-পরিণয় রাজা লোমপাদ ঋষ্যশৃঙ্গ-ঋষিকে পুরমধ্যে প্রবেশিত করিবামাত্র জলদগণ সহসা এরূপ বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। যে, সমুদয় সংসার একেবারে জলে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। এইরূপে অঙ্গরাজের মনোরথ পরিপূর্ণ হইলে তিনি ঋষ্যশৃঙ্গঋষিকে স্বীয় তনয়া শান্তা সম্প্রদান করিলেন এবং বিভাণ্ডক-মুনির কোপোপশমের নিমিত্ত তাঁহার আগমনপথের মধ্যে গো, কৃষক প্রভৃতি ও পশুপালক বীরগণকে স্থাপন করিয়া কহিলেন, “যখন মহর্ষি বিভাণ্ডক পুত্রান্বেষী হইয়া তোমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিবেন, তখন তোমরা তাঁহাকে কৃতাঞ্জলিপুটে কহিবে যে, এই সমস্ত পশু ও কৃষক আপনার পুত্রের অধিকৃত; আমরা আপনার আজ্ঞাকারী দাস; অতএব কিরূপ প্রিয়কর্ম্ম সম্পন্ন করিতে হইবে, আজ্ঞা করুন।”
এদিকে প্রচণ্ডকোপ বিভাণ্ডক মুনি ফল-মূল আহরণপূর্ব্বক স্বীয় আশ্রমে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। তথায় পুত্রকে দর্শন না করিয়া অন্বেষণ করিতে করিতে নিতান্ত কোপরায়ণ হইয়া উঠিলেন। তখন তিনি পুত্রকে অপহরণ করা নৃপতির কাৰ্য্য বিবেচনা করিয়া রাজ্যের সহিত অঙ্গরাজকে ভস্মসাৎ করিবার নিমিত্ত চম্পানগরাভিমুখে গমন করিলেন। পথিমধ্যে শ্রান্ত ও ক্ষুধার উদ্রেক হওয়াতে তিনি সেই লোমপাদপ্রেরিত সমৃদ্ধ ঘোষগণের সমীপে উপস্থিত হইলেন। তথায় তিনি তাহাদিগের কর্ত্তৃক সমুচিতরূপে সৎকৃত হইয়া নৃপতির ন্যায় সুখস্বচ্ছন্দে যামিনীযাপন করিলেন। অনন্তর মহর্ষি তাহাদিগের নিকট সাতিশয় সৎকার প্রাপ্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে গোপগণ! তোমরা কাহার অধিকৃত?” তাহারা কহিল, “মহাশয়! আপনার তনয় এই সমস্ত ধনের অধিকারী।”
বোষগণের নিকটে অমৃতায়মান বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র পূজ্যপাদ মহর্ষি বিভাণ্ডকের প্রজ্বলিত কোপানল একেবারে প্রশান্ত হইয়া গেল। তখন তিনি চম্পানগরীতে প্রবেশ করিয়া অঙ্গ রাজসমীপে সমুচিত সৎকার প্রাপ্ত হইলেন। তখন পুত্রকে অমরনাথের ন্যায় বিরাজমান, গ্রামঘোষাদির [গ্রামনগরাদি] অধীশ্বর ও পুত্রবধূ শান্তাকে সৌদামিনীর ন্যায় শোভমানা অবলোকন করিয়া তাঁহার রোষানল একেবারে নির্ব্বাণ হইয়া গেল। তিনি নৃপতির প্রতি প্ৰসন্ন হইয়া ও পুত্রকে তথায় বাস করিতে অনুমতি প্ৰদান করিয়া কহিলেন, “হে পুত্ৰ! তোমার পুত্র উৎপন্ন হইলে ভূপতির প্রিয় কার্য্যসকল সর্ব্বপ্রযত্নে সম্পাদন করিয়া কাননে গমন করিবে।”
মহাতপাঃ ঋষ্যশৃঙ্গ পিতার অনুমতি প্রতিপালনপূর্ব্বক যথাসময়ে আশ্রমে গমন করিলেন; শান্তাও তাহার পরিচর্য্যায় নিযুক্ত হইলেন। রোহিণী যেমন শশধরের অনুকুলা, অরুন্ধতী যেমন বশিষ্ঠের প্রণয়িনী, লোপামুদ্রা যেমন অগস্ত্যের প্রিয়কারিণী, দময়ন্তী যেমন নলের প্ৰিয়তমা, শচী যেমন ইন্দ্রের বশবর্ত্তিনী, নারায়ণী ইন্দ্ৰসেনা যেমন মুদগলের সহাচারিণী, নৃপতনয় শান্তা সেইরূপ বনবাসী ঋষ্যশৃঙ্গের প্রিয়কারিণী প্ৰণয়িনী হইয়া পরিচর্য্যা করিতে লাগিলেন। হে রাজন! তাঁহার এই পবিত্র আশ্রম মহাহ্রদের সুষমা সম্পাদন করিয়া প্ৰদীপ্ত হইতেছে। এই তীর্থে স্নান করিয়া কৃতকৃত্য ও বিশুদ্ধ হইয়া অন্যান্য তীর্থে গমন করিবে।