১১২তম অধ্যায়
আলস্যের দোষ—উষ্ট্র-শৃগাল বৃত্তান্ত
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! কোন্ কোন্ কাৰ্য্য নরপতিদিগের কর্ত্তব্য? তাঁহারা কি করিলে সুখলাভ করিতে পারেন? তাহা আমার নিকটে কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! রাজাদিগের যে যে কার্য্য কর্ত্তব্য এবং যেকাৰ্য্য করিলে তাঁহাদিগের সুখলাভ হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করিবার উপলক্ষে আমি এক উষ্ট্রের ইতিহাস অবিকল কহিতেছি, শ্রবণ কর। সত্যযুগে এক জাতিস্মর [পূর্ব্বৰ্জন্মস্মরণসমর্থ] উষ্ট্র বিপুল অরণ্যমধ্যে কঠোর নিয়মধারণপূর্ব্বক তপস্যা করিত। অনন্তর সৰ্ব্বলোক পিতামহ ব্রহ্মা তাহার তপানুষ্ঠানদর্শনে প্রসন্ন হইয়া তাহাকে অভিলষিত বরপ্রদান করিতে অঙ্গীকার করিলেন। তখন উষ্ট্র কহিল, ‘ভগবন্! আপনার প্রসাদে আমার এই গ্রীবা শত যোজন বিস্তীর্ণ হউক।’ ভগবান্ কমলযোনি উষ্ট্রের প্রার্থনাশ্রবণে-তথাস্তু বলিয়া স্বীকার করিলেন; উষ্ট্রও প্রার্থিত বরলাভ করিয়া অরণ্যে প্রস্থানপূর্ব্বক নিশ্চিন্তচিত্ত হইয়া আলস্যে কালক্ষেপ করিতে লাগিল। বরলাভের দিন অবধি এক দিনও তাহার আহারের নিমিত্ত অন্য স্থানে গমন করিবার বাসনা হয় নাই।
“একদা সেই উষ্ট্র নিশ্চিন্তচিত্তে শতযোজন-বিস্তৃত গ্রীবা প্রসারণপূৰ্ব্বক বিচরণ করিতেছে, এমন সময়ে প্রবল বায়ু সমুত্থিত হইল। তখন ঐ নির্ব্বোধ পশু স্বীয় মস্তক ও গ্রীবা গিরিগুহায় সংস্থাপিত করিয়া রহিল। অনন্তর মেঘ হইতে অনবরত বারিধারা নিপতিত হওয়াতে সমুদয় জগৎ জলে প্লাবিত হইয়া গেল। ঐ সময় এক মাংসজীবী শৃগাল শীতার্ত্ত ও নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া পত্নীর সহিত সেই গুহামধ্যে প্রবেশপূৰ্ব্বক উষ্ট্রকে দেখিতে পাইয়া তাহার গ্রীবা ভক্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। তখন নির্ব্বোধ উষ্ট্র আপনার সেই দুর্দ্দশা-দর্শনে যারপরনাই দুঃখিত হইয়া উর্দ্ধে ও পুনরায় অধোভাগে গ্রীবা নিক্ষেপ করিয়া উহা সঙ্কুচিত করিবার নিমিত্ত অনেক যত্ন করিতে লাগিল, কিন্তু কোনমতেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিল না। শৃগাল ও শৃগালী স্বচ্ছন্দে তাহার মাংস ভক্ষণপূর্ব্বক প্রাণ সংহার করিয়া বৃষ্টিবর্ষাবসানে গুহা হইতে প্রস্থান করিল।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! সেই দুর্ব্বুদ্ধি উষ্ট্র এইরূপে আলস্যপরায়ণ হইয়া নিধন প্রাপ্ত হইয়াছিল; অতএব তুমি আলস্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ইন্দ্রিয়দমনে যত্নবান্ হও। মহাত্মা মনু বুদ্ধিকেই জয়লাভের মূল বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। কাৰ্য্যসাধনবিষয়ে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, বাহু মধ্যম ও পাদচার [পৃথিবী পর্য্যটন—হাঁটা] প্রভৃতি অধম উপায় বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে। জিতেন্দ্রিয় কার্য্যদক্ষ পুরুষেরাই রাজ্য রক্ষা করিতে পারেন। মনুর মতে গৃঢ়মন্ত্রণাশ্রবণনিরত, সহায়সম্পন্ন, অর্থলোলুপ ব্যক্তিরা বুদ্ধিবলেই জয়লাভ করিয়া থাকে। যাহারা বিশেষ বিবেচনা করিয়া কার্য্য করেন, ইহলোকে তাঁহাদিগেরই অর্থলাভ হয়। সহায়সম্পন্ন ব্যক্তি অনায়াসে সমুদয় পৃথিবী শাসন করিতে পারেন। হে ধৰ্ম্মরাজ! পূৰ্ব্বতন বিধিদর্শী সাধু লোকেরা যেরূপ কহিয়া গিয়াছেন, আমি শাস্ত্রানুসারে তোমাকে সেইরূপ উপদেশ প্রদান করিলাম; এক্ষণে তুমি বুদ্ধিপূৰ্ব্বক সমুদয় কার্য্যের অনুষ্ঠান কর।”