১১২তম অধ্যায়
অর্জ্জুন-সাহায্যার্থ সাত্যকির গমনেচ্ছা
সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! যুদ্ধদুৰ্ম্মদ শিনিপুঙ্গব সাত্যকি ধর্ম্মরাজের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া মনে মনে আশঙ্কা করিতে লাগিলেন যে, যদি আমি যুধিষ্ঠিরকে পরিত্যাগ করি, তাহা হইলে অর্জ্জুনের নিকট অপরাধী হইব এবং লোকেও আমাকে ধনঞ্জয়ের নিকট গমন করিতে দেখিয়া ভীত বলিয়া অপবাদ প্ৰদান করিবে। তিনি মনে মনে বারংবার এইরূপ চিন্তা করিয়া ধর্ম্মরাজকে কহিলেন, হে মহারাজ! যদি আপনি আপনার রক্ষা বিষয়ে কৃতনিশ্চয় হইয়া থাকেন, তবে আপনার মঙ্গল হউক; আমি আপনার আজ্ঞানুসারে মহাবীর ধনঞ্জয়ের অনুগমন করি। এই ত্রিলোক মধ্যে অর্জ্জুন অপেক্ষা আমার প্রিয়তর আর কেহই নাই। অতএব আমি সত্য বলিতেছি, আপনার আদেশক্রমে প্রিয়তম পার্থের নিকট গমন করিব। আপনার হিতসাধনের নিমিত্ত আমার কিছুমাত্র অকর্ত্তব্য নাই। গুরুজনের বাক্য রক্ষার ন্যায় আপনার বাক্য বক্ষা করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য; আপনার ভ্রাতা কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন আপনার প্রিয়ানুষ্ঠানে যেরূপ নিরত, আমিও তদ্রূপ তাঁহাদের প্রিয়কাৰ্য্য সাধনে তৎপর। অতএব হে প্রভো? আমি আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য্য করিয়া অর্জ্জুনের নিমিত্ত ক্রুদ্ধ মৎস্য যেরূপ অগাধ জলধি জলভেদ করিয়া গমন করে, তদ্রূপ এই দুর্ভেদ্য দ্রোণসৈন্য ভেদ করিয়া যে স্থানে দুরাত্মা জয়দ্রথ ধনঞ্জয় ভয়ে ভীত হইয়া অশ্বত্থামা, কর্ণ ও কৃপাচার্য্য প্রভৃতি মহারথগণ এবং অসংখ্য সৈন্যগণে সংরক্ষিত হইয়া অবস্থান করিতেছে, সেই স্থানে গমন করিব। মহাবীর অর্জ্জুন জয়দ্রথ বধের নিমিত্ত যে স্থলে অবস্থিতি করিতেছেন, বোধকরি এখান হইতে সে স্থান তিন যোজন অন্তর হইবে। কিন্তু আমি দৃঢ়ান্তঃকরণে বলিতেছি যে, ধনঞ্জয় যোজনত্রয় দূরবর্তী হইলেও আমি তাঁহার নিকট গমন করিয়া সিন্ধুরাজ বধ পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিব। হে মহারাজ! গুরুজনের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন্ বীরপুরুষ যুদ্ধে গমন করিয়া থাকেন? আর তাঁহাদের অনুমতি প্রাপ্ত হইলে মাদৃশ কোন্ ব্যক্তিই বা যুদ্ধ বিমুখ হয়?
হে রাজন্! যে স্থানে আমাকে গমন করিতে হইবে, সে স্থান আমি বিশেষ রূপে অবগত আছি। আজি আমি হল, শক্তি, গদা, প্রাস, চৰ্ম্ম, খড়্গ, ঋষ্টি, তোমর ও শর সমুদায়ে সংকীর্ণ এই অগাধ জলধি সদৃশ সেনাসমূহ বিক্ষোভিত করিব। এই যে, রণশৌণ্ড বহুতর ম্লেচ্ছাধিষ্ঠিত অঞ্জনকুলসম্ভূত বারি বর্ষণকারী মেঘের ন্যায় সহস্র সহস্র মাতঙ্গ সাদিগণ কর্ত্তৃক সঞ্চালিত হইতেছে, উহারা আর প্রতিনিবৃত্ত হইতে সমর্থ হইবে না; উহাদিগকে বিনাশ না করিলে আমরা জয়ী হইতে পারিব না। আর এই যে, সুবর্ণ মণ্ডিত রথারূঢ় মহারথ রাজপুত্রগণকে দেখিতেছেন, ইহারা সকলেই ধনুর্ব্বেদ পারদর্শী এবং রথযুদ্ধ, অস্ত্ৰযুদ্ধ, নাগযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ, বাহুযুদ্ধ, গদাযুদ্ধ ও মুষ্টি যুদ্ধে বিশেষ নিপুণ। এই সকল কৃতবিদ্য বীর পুরুষেরা কর্ণ ও দুঃশাসনের নিতান্ত অনুগত। ইহারা প্রতিনিয়ত সমরস্থলে জয়লাভেচ্ছা করেন। মহাত্মা বাসুদেবও ইঁহাদিগকে মহারথ বলিয়া প্রশংসা করিয়া থাকেন। ঐ শ্রমক্লমবিহীন বীরবরেরা সতত কর্ণের হিতাভিলাষ করেন এবং তাঁহারই বাক্যানুসারে পার্থ হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া সুদৃঢ় বৰ্ম্ম ধারণ পূর্ব্বক দুর্য্যোধনের অনুমতিক্রমে আমার নিবারণাৰ্থ অবস্থিতি করিতেছেন। হে কুরুকুলোদ্ভব! আমি আজি আপনার হিতসাধনাৰ্থ এই বীরগণকে রণস্থলে প্ৰমথিত করিয়া অর্জ্জুনের পদবীতে পদ বিক্ষেপ করিব। এই যে, কিরাতাধিষ্ঠিত দিব্য ভূষণ ভূষিত, বৰ্ম্মসংচ্ছন্ন অন্য সপ্ত শত হস্তী অবলোকন করিতেছেন, পূর্ব্বে কিরাতরাজ স্বীয় জীবন রক্ষার্থ মহাবীর অর্জ্জুনকে ঐ সমুদায় প্রদান করেন। পূর্ব্বে ইহারা আপনার কার্য্যেই নিযুক্ত ছিল; কিন্তু কালের কি আশ্চর্য্য গতি! এক্ষণে ইহারা আপনার বিপক্ষে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াছে। ইহাদের মহামাত্র ম্লেচ্ছ কিরাতগণ সকলেই গজযুদ্ধ বিশারদ ও সমর দুৰ্ম্মদ। উহারা পূর্ব্বে সব্যসাচীর নিকট পরাভূত হইয়াছিল কিন্তু আজি দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের বশবর্তী হইয়া আপনার বিপক্ষে আমার সহিত যুদ্ধ করিবার অভিলাষে অবস্থান করিতেছে। আজি আমি ঐ যুদ্ধদুৰ্ম্মদ কিরাতগণকে শরনিকরে নিপাতিত করিয়া সিন্ধুরাজ বধার্থী ধনঞ্জয়ের অনুগমন করিব।
হে মহারাজ! এই যে, সুবর্ণময় বৰ্ম্মবিভূষিত অঞ্জন কুলোদ্ভব সুশিক্ষিত কর্কশগাত্র ঐরাবত সদৃশ মত্ত মাতঙ্গ সকল অবলোকন করিতেছেন, এই সকল গজে অতি কর্কশ স্বভাব লৌহ বৰ্মধারী দস্যুগণ আরোহণ পূর্ব্বক উত্তর পর্ব্বত হইতে সমাগত হইয়াছে। ঐ দস্যুদলে গোযোনি, বানরযোনি, মানুষযোনি প্রভৃতি অনেক যোনিসম্ভূত লোক অবস্থিতি করিতেছে। ঐ সকল হিমদুর্গ নিবাসী পাপকৰ্ম্মা ম্লেচ্ছদল সমবেত থাকাতে সমস্ত সৈন্য ধূম্রবর্ণ বোধ হইতেছে। হে মহারাজ! কালপ্রেরিত দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন এই সকল রাজমণ্ডল এবং কৃপ, সৌমদত্তি, রথিশ্রেষ্ঠ দ্রোণ, সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ ও কর্ণকে সহায় করিয়া আপনাকে কৃতার্থ বোধ ও পাণ্ডবদিগকে অবমাননা করিতেছে; কিন্তু ঐ সকল বীর যদি মনের ন্যায় বেগগামী হয়, তথাপি আজি আমার নারাচ মুখে নিপতিত হইলে আর পলায়ন করিতে সমর্থ হইবেন না। পরবীৰ্য্যোপজীবী দুৰ্য্যোধন সতত তাঁহাদিগকে সম্মান করিয়া থাকেন। কিন্তু আজি তাঁহারা আমার শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করিবেন। আর এই যে, সুবর্ণধ্বজ মহারথিগণকে অবলোকন করিতেছেন, উহারা কাম্বোজ দেশীয় মহারথ; উহারা সকলেই কৃতবিদ্য ও ধনুর্ব্বেদ পারগ; এক্ষণে উহা দিগকে নিবারণ করা নিতান্ত সুকঠিন; আপনি উহাঁদের বল বিক্রমের বিষয় শ্রবণ করিয়া থাকিবেন। উহারা পরস্পরের হিতার্থ সমবেত হইয়াছেন। ঐ সকল মহাবীর এবং কৌরবগণ রক্ষিত দুর্য্যোধনের অনেক অক্ষৌহিণী সেনা ক্রুদ্ধ ও অপ্রমত্তচিত্তে আমাকে নিবারণ করিবার নিমিত্ত অবস্থান করিতেছেন; কিন্তু হুতাশন যেরূপ তৃণরাশি ভস্মসাৎ করিয়া ফেলে, তদ্রূপ আমি উহাদিগকে প্ৰমথিত করিব। অতএব রথসজ্জাকারিগণ অবিলম্বে বাণপূর্ণ তূণীর ও অন্যান্য উপকরণ সকল আমার রথের যথাস্থানে সংস্থাপিত করুক। এই সংগ্রামে বহুবিধ অস্ত্র গ্রহণ করাই বিধেয়। আচার্য্য রথসজ্জায় যেরূপ উপদেশ প্রদান করিয়াছেন, তদপেক্ষা পঞ্চগুণে রথ সুসজ্জিত করা আবশ্যক। কারণ অত্যুগ্ৰ আশীবিষ সদৃশ কাম্বোজগণ, নানাস্ত্রধারী বিষকল্প কিরাতগণ, সতত দুৰ্য্যোধন প্রতিপালিত ও তাঁহার হিতৈষী। ইন্দ্রতুল্য পরাক্রম শকগণ এবং দীপ্ত পাবক সদৃশ, দুর্জেয়, কালপ্রতিম, যুদ্ধদুৰ্ম্মদ অন্যান্য বহুবিধ যোধগণের সহিত আজি সমরস্থলে সম্মিলিত হইতে হইবে। এক্ষণে রথপরিচারকগণ সুলক্ষণাক্রান্ত বিখ্যাত অশ্বগণকে বারিপান ও ভ্রমণ করাইয়া পুনরায় আমার রথে সংযোজিত করুক।’
সাত্যকির সামরিক রথসজ্জা – অভিযান
হে মহারাজ! মহাবীর সাত্যকি এই কথা বলিলে রাজা যুধিষ্ঠির তূণীর, নানাবিধ অস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ সকল তাঁহার রথের যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিতে আদেশ করিলেন, পরিচারকগণ তাঁহার রথযোজিত সদশ্বচতুষ্টয়কে যুক্ত করিয়া মত্তকর মদ্যপান এবং স্নান ভক্ষণ ও ভ্রমণ করাইয়া তাহাদের শল্যোদ্ধার করিল। তখন সাত্যকির প্রিয়সখা সারথি দারুকানুজ সেই সংহৃষ্টমনা, স্বর্ণবর্ণাভ, হেমমাল্যবিভূষিত দ্রুতগামী তুরগগণকে মণি, মুক্তা, প্রবাল বিভূষিত, পাণ্ডুর বর্ণ পতাকায় সমলঙ্কৃত, উচ্ছিত ছত্র দণ্ড সমাযুক্ত, সিংহধ্বজ সম্পন্ন, হেমভূষণ ভূষিত রথে যোজিত করিয়া সাত্যকিকে নিবেদন করিল, ‘মহাশয়! রথ সুসজ্জিত হইয়াছে।’ তখন শ্রীমান সাত্যকি স্নানানন্তর পবিত্র হইয়া সহস্র স্নাতককে সুবর্ণ মুদ্রা প্রদান করিলেন। ব্রাহ্মণেরা তাঁহাকে আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন। পরে মহাবীর যুযুধান কিরাতদেশোদ্ভব মদ্যপানে বিহ্বলিত ও লোহিত লোচন হইয়া দর্পণ স্পর্শপূর্ব্বক সশর শরাসন গ্রহণ করিয়া অত্যন্ত আহ্লাদিত ও প্রজ্বলিত পাবক তুল্য দ্বিগুণতর তেজস্বী হইয়া উঠিলেন। ব্রাহ্মণেরা তাঁহার স্বস্ত্যয়ন করিতে লাগিলেন। লাজ, গন্ধ ও মাল্য প্রভৃতি বিবিধ মাঙ্গল্য দ্রব্যের অনুষ্ঠান হইল। তখন রথিশ্রেষ্ঠ মহাবীর সাত্যকি সম্নদ্ধকবচ হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে যুধিষ্ঠিরের চরণ বন্দন পূর্ব্বক আরোহণ করিলেন। হৃষ্ট পুষ্টাঙ্গ বায়ুবেগগামী সিন্ধুদেশোদ্ভব ঘোটক সকল তাঁহাকে বহন করিতে লাগিল ঐ সময় মহাবীর ভীমসেন যুধিষ্ঠির কর্ত্তৃক সৎকৃত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদন পূর্ব্বক সাত্যকির সহিত গমনে প্রবৃত্ত হইলেন। হে মহারাজ! তখন দ্রোণ প্রভৃতি কৌরব পক্ষীয়েরা সেই শক্রতাপন বীরদ্বয়কে সেনা মধ্যে প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া সকলেই অবহিত চিত্তে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।
ভীমের প্রতি যুধিষ্ঠির রক্ষার ভারার্পণ
অনন্তর মহাবীর সাত্যকি বৰ্মধারী ভীমসেনকে আপনার অনুগমন করিতে দেখিয়া তাঁহাকে অভিবাদন পূর্ব্বক হৃষ্টচিত্তে কহিলেন, হে বৃকোদর! আমার মতে ধর্ম্মরাজকে রক্ষা করাই তোমার কর্ত্তব্য। আমি স্বয়ং কৌরবসৈন্য ভেদ করিয়া ইহার মধ্যে প্রবেশ করিব। তুমি আমার বল বিক্রমের বিষয় সবিশেষ অবগত আছি; তোমার বল বিক্রমও আমার নিকট অবিদিত নাই। অতএব যদি আমার হিত কামনা কর, তাহা হইলে তুমি প্রতিনিবৃত্ত হইয়া রাজার রক্ষায় নিযুক্ত হও, ধর্ম্মরাজকে রক্ষা করাই তোমার প্রধানতম কার্য্য। মহাবীর ভীমসেন সাত্যকির বাক্য শ্রবণানন্তর কহিলেন, ‘হে পুরুষোত্তম! তুমি যাহা বলিলে আমি তাহাই করিব। তুমি শীঘ্র গমন কর, তোমার কাৰ্য্য সিদ্ধি হউক।’ তখন সাত্যকি পুনৰ্ব্বার বৃকোদরকে কহিলেন, হে ভীমসেন! তুমি যুধিষ্ঠিরের রক্ষার্থ শীঘ্র গমন কর। আজি যখন তুমি আমার বশবর্তী হইয়াছ এবং সুলক্ষ্মণ সকল লক্ষিত হইতেছে, তখন অবশ্যই আমার সমরে জয়লাভ হইবে। হে বৃকোদর! আজি দুরাত্মা সিন্ধুরাজ নিহত হইলেই মহাবীর পার্থের সহিত আগমন পূর্ব্বক ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠিরকে আলিঙ্গন করিব। মহাবীর সাত্যকি এই বলিয়া ভীমসেনকে বিদায় করিরা ব্যাঘ্র যেরূপ মৃগগণকে অবলোকন করে, সেইরূপ কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে আরম্ভ করিলেন। কোরবসৈন্যগণ সাত্যকিকে প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া পুনরায় হতজ্ঞান ও কম্পিত হইতে লাগিল। তখন ধর্ম্মরাজের নির্দেশানুবর্তী সাত্যকি অর্জ্জুন দর্শন মানসে অবিলম্বে সেই সৈন্যগণ মধ্যে প্রবেশ করিলেন।