১১১তম অধ্যায়
পুরুষের প্রকৃতি-পরিচয়—শৃগাল-ব্যাঘ্র বৃত্তান্ত
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! অনেকানেক শান্ত প্রকৃতি পুরুষকে অশান্তের ন্যায় ও অনেকানেক অশান্তপ্রকৃতি পুরুষকে শান্তের ন্যায় বোধ হইয়া থাকে। আমি কিরূপে তাদৃশ ব্যক্তিদিগের যথার্থ প্রকৃতি অবগত হইব?”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি এই উপলক্ষে ব্যাঘ্রগোমায়ু সংবাদ নামে এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বকালে অতি সমৃদ্ধিশালী পুরিকানগরীতে পৌরিক-নামে এক পরশ্রীকাতর স্বভাব নরপতি ছিলেন। তিনি কিয়দ্দিন পরে দেহত্যাগপূর্ব্বক আপনার কর্ম্মফলে শৃগাল হইয়া জন্মগ্রহণ করিলেন। ঐ জন্মে তাঁহার পূৰ্ব্বজন্মের সমৃদ্ধি স্মরণ হওয়াতে যারপরনাই নিৰ্ব্বেদ উপস্থিত হইল। তখন তিনি সকল জীবের প্রতি দয়ালু, সত্যবাদী ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইয়া মাংসাহার পরিত্যাগপূর্ব্বক যথাকালে স্বয়ং নিপতিত ফল ভক্ষণ করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন। তিনি শ্মশানে শৃগাল হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং সেইখানেই অন্যান্য গোমায়ুগণের সহিত বাস করিতেন; জন্মভূমির স্নেহনিবন্ধন অন্য স্থানে গমন করিতে বাসনা করেন নাই। একদা তাঁহার স্বজাতীয় শৃগালেরা তাঁহার বিশুদ্ধভাব-দর্শনে ঈর্ষাপরবশ হইয়া তাঁহার বুদ্ধিবৈপরীত্য জন্মাইবার মানসে কহিল, ভাই! তুমি কি নিৰ্ব্বোধ! নরমাংসলোলুপ শৃগাল-যোনিতে জন্মগ্রহণপূৰ্ব্বক এই ঘোরতর শ্মশানভূমিতে বাস করিয়া শুদ্ধভাবে কালাতিপাত করিতে বাসনা করিতেছ? যাহা হউক, এক্ষণে বিশুদ্ধভাব পরিত্যাগ করিয়া আমাদিগের সমান-ধৰ্ম্ম অবলম্বনপূৰ্ব্বক মাংসভোজনে নিরত হও, আমরা তোমাকে আহারসামগ্রী প্রদান করিব।’
চরিত্রবলে চিত্তের উৎকর্য্য–শৃগালের উদার বুদ্ধি
“তখন সেই বিশুদ্ধস্বভাবসম্পন্ন শৃগাল স্বজাতীয়দিগের বাক্য শ্রবণ করিয়া সমাহিতচিত্তে [নিবিষ্টহৃদয়ে] যুক্তিযুক্তবচনে তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিল, বন্ধুগণ! আমার মতে কুৎসিত কুলে জন্মগ্রহণ করিলেই যে কুৎসিত কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে হইবে, ইহা ন্যায়ানুগত নহে। চরিত্রই লোকের সাধুতা ও অসাধুতা সম্পাদন করিয়া থাকে। এক্ষণে যাহাতে আমার যশঃ চারিদিকে বিস্তীর্ণ হয়, আমি তাহারই চেষ্টা করিতেছি বটে, কিন্তু ধর্ম্মবিষয়ে আমার যে স্থিরসিদ্ধান্ত আছে, তাহা শ্রবণ কর। আত্মা হইতে কৰ্ম্মফল সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। কেবল আশ্রমে অবস্থান করিলেই ধর্ম্মাচরণ করা হয় না। যদি কেহ আশ্রমমধ্যে অবস্থানপূৰ্ব্বক ব্রহ্মহত্যা করে, আর যদি কেহ আশ্রম ভিন্ন অন্য স্থানে গোদান করে, তাহা হইলে কি সেই ব্ৰহ্মহত্যাকারীকে পাপে লিপ্ত হইতে হইবে না এবং গোদানকৰ্ত্তার দান বৃথা হইবে? তোমরা লোভবশতঃ কেবল উদরপূরণের চেষ্টায় ব্যাপৃত থাকিয়া একেবারে বিমুগ্ধ হইয়া গিয়াছ। পরিণামে যেসকল দোষ ঘটিবে, মুগ্ধ ব্যক্তিরা তাহা কিছুই বুঝিতে পারে না। আমি এক্ষণে উভয় লোকে অসন্তোষজনক অতি নিন্দনীয় ধৰ্ম্মহানিকর অনিষ্টের আশঙ্কা করিয়াই দুষ্পবৃত্তি [অন্যায় আচরণ] হইতে বিরত হইয়াছি।
শৃগাল ব্যাঘ্রের অমাত্যপদে প্রতিষ্ঠিত
“হে ধৰ্ম্মরাজ! ঐ সময় এক প্রভূতপরাক্রমশালী শার্দ্দূল সেই শ্মশানে অবস্থান করিতেছিল। সে সেই বিশুদ্ধস্বভাব শৃগালের বাক্যশ্রবণে তাহাকে অতি সচ্চরিত্র ও পণ্ডিত বিবেচনায় সাধ্যানুরূপ অর্চ্চনা করিয়া অমাত্যপদে অভিষেকপূৰ্ব্বক কহিল, ‘মহাত্মন্! আমি তোমার প্রকৃতি অবগত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি স্বেচ্ছানুরূপ আহার বিহার করিয়া আমার সহিত রাজকাৰ্য্য পর্য্যালোচনা কর। আমরা অতি উগ্ৰস্বভাব, অতএব তুমি আমার নিকট মৃদুতা অবলম্বন করিলে অনায়াসেই মঙ্গললাভে সমর্থ হইবে।’
“তখন গোমায়ু সেই শার্দ্দূলের বাক্যে সমাদর করিয়া ঈষৎ নবদনে কহিল, ‘মৃগেন্দ্র! আপনি যে ধর্ম্মার্থকুশল বিশুদ্ধস্বভাব সহায়লাভের বাসনা করিয়াছেন, ইহা আপনার অনুরূপই হইয়াছে। আপনি অমাত্য ব্যতিরেকে অথবা প্রাণহন্তা দুষ্ট অমাত্যের সাহায্যে কখনই আধিপত্য-সংস্থাপনে সমর্থ হইবেন না। অনুরক্ত, নীতিজ্ঞ, দুরভিসন্ধিশূন্য, ছলগ্রাহী ও হিতসাধনতৎপর সহায়কগণকে আচাৰ্য্য ও পিতার ন্যায় পূজা করা কর্ত্তব্য। যাহা হউক, এক্ষণে আমি যাহাতে সন্তুষ্ট নহি, সেইরূপ কার্য্যানুষ্ঠানে আমার অভিরুচি নাই। আমি আপনার আশ্রমে থাকিয়া ঐশ্বৰ্য্য বা সুখভোগ করিতে বাসনা করি না। আপনার পুরাতন ভৃত্যগণের সহিত আমার স্বভাবে ঐক্য হইবে না। তাহারা আমার নিমিত্ত দুশ্চরিত্র হইয়া নিশ্চয়ই আপনার সহিত আমার ভেদোৎপাদন করিয়া দিবে। মহদব্যক্তির অধীনতাও শ্লাঘনীয় নহে। যে ব্যক্তি দীর্ঘদর্শিতা ও উৎসাহগুণে বিভূষিত হয় এবং অন্ধকে ভূরি ভূরি দান ও পাপাত্মাদিগের প্রতি অনৌদ্ধত্য [কোমল ভাব] প্রকাশ করে, সেই যথার্থ মহাত্মা। আমি মিথ্যাব্যবহারে পারদর্শী বা অল্পে সন্তুষ্ট নহি এবং কখন কাহারও সেবা করি নাই; সুতরাং তাহাতে অভিজ্ঞ নহি। চিরকাল স্বেচ্ছানুসারে বনে ভ্রমণ করিয়াছি। রাজসন্নিধানে অবস্থান করিলে অন্যকৃত নিন্দানিবন্ধন বিলক্ষণ কষ্টভোগ করিতে হয় আর বনবাসীদিগের সহিত বাস করিলে নির্ভয়ে ব্রতচাৰ্য্যাদি [ব্রত-নিয়মের অনুষ্ঠান] কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করা যায়। ভৃত্যগণ ভূপতির আহ্বানশ্রবণে যেরূপ ভয় অনুভব করে, সন্তুষ্টচিত্তে ফলমূলাহারী বনচারিগণ কখনই সেরূপ ভয়ে ভীত হয়েন না। অনায়াসলব্ধ জল ও ভয়সঙ্কুল সুস্বাদু অন্ন, এই উভয়ের মধ্যে আমার মতে যাহাতে ভয়ের বিষয় নাই, তাহাই সুখাবহ। ভৃত্যগণের মধ্যে অধিকাংশ লোকেই মিথ্যাপবাদে দূষিত হইয়া প্রাণত্যাগ করে। অতি অল্প লোকেই যথার্থ দোষে দূষিত হয়। যাহা হউক, যদি আপনি নিতান্তই আমাকে অমাত্যপদে অভিষিক্ত করেন, তাহা হইলে আমার প্রতি আপনার যেরূপ ব্যবহার করিতে হইবে, অগ্রে তাহা নির্দ্ধারিত করুন। রাজ! আমি যে হিতকর বাক্য প্রয়োগ করিব, আপনাকে তাহা সমাদরপূৰ্ব্বক শ্রবণ করিতে হইবে এবং আপনি যে বৃত্তিবিধান করিয়া দিবেন, কদাচ তাহার অন্যথা করিতে পারিবেন না। আমি কখনই আপনার অন্যান্য অমাত্যগণের সহিত মন্ত্রণা করিব না। তাহা হইলে তাহারা মহত্ত্বকামনায় আমার উপর বৃথা দোষারোপ করিবে। অতএব আমি কেবল নির্জ্জনে আপনার সহিত মিলিত হইয়া মন্ত্রণা করিব। আপনার জ্ঞাতিকাৰ্য্য উপস্থিত হইলে আপনি আমাকে হিতাহিত কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন এবং ক্রোধভরে আমার প্রতি বা আমার সহিত মন্ত্রণার পর অন্যান্য মন্ত্রিগণের প্রতি দণ্ডবিধান করিতে পারিবেন না।’
ব্যাঘ্রানুচরগণের শৃগাল-হিংসা—ষড়যন্ত্র
শৃগাল এইরূপ কহিলে শার্দ্দূল তাহার বাক্যে স্বীকার করিয়া তাহাকে অমাত্যপদে অভিষিক্ত করিল। তখন শার্দ্দূলের পূর্ধ্বতন ভৃত্যগণ শৃগালের সমাদর-দর্শনে সকলে সমবেত হইয়া পদে পদে তাহার বিদ্বেষাচরণ করিতে লাগিল। ঐ দুরাত্মারা গোমায়ুর মন্ত্রণাবলে মাংসহরণে অসমর্থ হইয়া আপনাদের উন্নতিবাসনায় প্রথমতঃ মিত্রভাবে তাহাকে সান্ত্বনা ও প্রসন্ন করিয়া প্রভূততর ঐশ্বৰ্য্য প্রদান ও বিবিধ প্রলোভনবাক্যদ্বারা প্রলোভিত করিতে চেষ্টা করিল; কিন্তু বহুদর্শী শৃগাল কোনরূপেই ধৈৰ্য্য হইতে বিচলিত হইল না। তখন তাহারা শৃগালের বিনাশবাসনায় একত্র হইয়া শার্দ্দূলের আহারার্থ সমাহৃত উৎকৃষ্ট মাংসরাশি লইয়া শৃগালের গৃহে অবস্থাপন করিল। ভেদবুদ্ধিপরাঙ্মুখ শৃগাল আপনার গৃহে সেই মাংস দর্শন করিয়া উহা কি নিমিত্ত সমানীত হইয়াছে, তাহা সবিশেষ অবগত হইয়াও বন্ধুবিচ্ছেদভয়ে প্রকাশ করিল না।
“অনন্তর শার্দ্দূল ক্ষুধিত হইয়া ভোজন করিবার নিমিত্ত গাত্রোত্থান করিল, কিন্তু আহার সম্পাদনার্থ সমাহৃত মাংসের কিছুমাত্র দেখিতে পাইল না। তখন সে ক্রোধভরে কহিল, ‘অমাত্যগণ ! যে দুরাত্মা আমার মাংস অপহরণ করিয়াছে, অবিলম্বে তাহার অনুসন্ধান কর।’ তখন ধূৰ্ত্তেরা শার্দ্দূলকে নিবেদন করিল, ‘মৃগরাজ! আপনার প্রজ্ঞাভিমানী [নিজেকে বুদ্ধিমান বলিয়া অহঙ্কারপ্রকাশকারী] মন্ত্রিই সেই মাংস অপহরণ করিয়াছেন।’ শার্দ্দূল তাহাদের মুখে শৃগালের সেই অবিবেচনার কাৰ্য্য শ্রবণ করিবামাত্র অতিমাত্ৰ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তাহাকে বিনাশ করিতে অভিলাষী হইল। শার্দ্দূলের পূর্ধ্বমন্ত্রিগণ তাহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিল, ‘মৃগরাজ! আপনার মন্ত্রী শৃগাল আমাদের সকলেরই জীবিকা বিলুপ্ত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। ঐ দুরাত্মা যখন আপনার সহিত এইরূপ ব্যবহার করিয়াছে, তখন সে সকল অকাৰ্য্যই করিতে পারে। আপনি আমাদের মুখে পূৰ্ব্বে তাহার স্বভাবের বিষয় যেরূপ শ্রবণ করিয়াছেন, তদ্বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ করিবেন না। তাহার বাক্য ধার্ম্মিকের ন্যায়, কিন্তু তাহার স্বভাব অতি ভয়ঙ্কর। ঐ কপটধর্ম্মপরায়ণ পাপস্বভাব দুরাত্মা স্বীয় ভোজন-ব্যাপার সমাধানের নিমিত্তই পরিশ্রম সহকারে ব্রতানুষ্ঠান করিয়াছিল। যদি এই উপস্থিত বিষয়ে আপনার অবিশ্বাস জন্মে, তবে আপনি ঐ বিষয় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করুন। শার্দ্দূলের পূর্ব্বমন্ত্রিগণ এই বলিয়া শৃগালের গৃহস্থিত মাংসভার আনয়নপূর্ব্বক রাজাকে প্রদর্শন করাইল। তখন শার্দ্দূল স্বচক্ষে সেই শৃগালের গৃহস্থিত মাংস অবলোকন করিয়া রোষাকুলিতলোচনে পূর্ধ্বতন মন্ত্রিগণকে কহিল, ‘তোমরা অবিলম্বে ঐ দুষ্ট শৃগালকে বিনাশ কর।’
“ঐ সময় শার্দ্দূল-জননী তাহার এই অনুজ্ঞা শ্রবণগোচর করিয়া তাহাকে হিতোপদেশ প্রদান করিবার নিমিত্ত তথায় আগমনপূর্ব্বক কহিল, ‘বৎস! তুমি তোমার এই সমস্ত পূৰ্ব্বমন্ত্রিদিগের কপটবাক্যে কদাচ বিশ্বাস করিও না। অসাধু ব্যক্তিরা সাধুদিগকে কাৰ্য্যদোষে দূষিত করিয়া থাকে। দুর্জ্জনের স্বভাবই এই যে, তাহারা অন্যের উন্নতি সহ্য করিতে পারে না। শত্রুতা স্বকার্য্যনিরত বিশুদ্ধস্বভাবসম্পন্ন ব্যক্তিরও দোষোৎপাদন করিয়া থাকে। তপঃপরায়ণ বনবাসী মুনিদিগেরও শত্রু, মিত্র ও উদাসীন এই তিন পক্ষ উৎপন্ন হয়। আর ভূমণ্ডলমধ্যে প্রায়ই নির্দোষ লোকেরা লুব্ধপ্রকৃতিদিগের, বলবানেরা দুৰ্ব্বলদিগের, পণ্ডিতেরা মুর্খদিগের, ধনিগণ দরিদ্রদিগের, ধার্ম্মিকেরা অধাৰ্মিকদিগের এবং সুরূপেরা বিরূপদিগের বিদ্বেষভাজন হইয়া থাকে। অনেকানেক লুব্ধস্বভাব কাণ্ডজ্ঞানশূন্য কপট পণ্ডিতেরা বৃহস্পতির ন্যায় বুদ্ধিমান নির্দোষ ব্যক্তিরও দোষোদ্ঘোষণ [উচ্চকণ্ঠে দোষকীৰ্ত্তন] করেন। তুমি তোমার মন্ত্রী শৃগালকে মাংস প্রদান করিলেও সে তাহা গ্রহণ করে না, আজি যে সে তোমার অসাক্ষাতে মাংস অপহরণ করিয়াছে, ইহা কি প্রকারে বিশ্বাসযোগ্য হইতে পারে? অতএব অগ্রে ইহার সবিশেষ অনুসন্ধান করা তোমার কর্ত্তব্য। এই জগতে অনেকানেক অসভ্য লোক সভ্যের ন্যায় এবং অনেকানেক সভ্যলোক অসভ্যের ন্যায় পরীক্ষিত হইয়া থাকে, সুতরাং বিজ্ঞ ব্যক্তিরা উহাদের স্বভাবের সবিশেষ পরীক্ষা করিবেন। নভোমণ্ডলকে কটাহের [কড়ার] ন্যায় এবং খদ্যোতকে [জোনাকী পোকাকে] হুতাশনের ন্যায় দীপ্তিশীল দেখা যায়; কিন্তু বস্তুতঃ আকাশে কটুাহ ও খদ্যোতে হুতাশন নাই। অতএব প্রত্যক্ষ বস্তুরও সবিশেষ পরীক্ষা করা কৰ্ত্তব্য। পরীক্ষা করিয়া যে বস্তুর যাথার্থ অবগত হওয়া যায়, তন্নিমিত্ত আর অনুতাপ করিতে হয় না।
‘হে বৎস! অধীনস্থ ব্যক্তিকে বিনাশ করা প্রভুর পক্ষে সুকঠিন নহে; কিন্তু তাহার ক্ষমাগুণই প্রশংসনীয় ও যশস্কর। তুমি তোমার সুহৃৎ শৃগালকে প্রধান মন্ত্রিত্বপদে সংস্থাপন করিয়াছ বলিয়া এক্ষণে সর্ব্বসাধারণে তোমার বিলক্ষণ খ্যাতি ও প্রতিপত্তিলাভ হইয়াছে; সৎপাত্র লাভ করা নিতান্ত সুকঠিন; অতএব তুমি কদাচ মন্ত্রীর প্রাণদণ্ড করিও না। যে ব্যক্তি নির্দোষ লোককে অন্যের আরোপিত দোষে দূষিত বলিয়া প্রতিপন্ন করে, সেই নির্ব্বোধকে অবিলম্বেই বিনষ্ট হইতে হয় এবং তাহার আশ্রিত অমাত্যগণও দোষে লিপ্ত থাকে।
ব্যাঘ্ৰকর্ত্তৃক শৃগালের চরিত্ৰপরীক্ষা—মুক্তিদান
“শার্দ্দূলের মাতা তাহাকে এইরূপে হিতোপদেশ প্রদান করিতেছে, এমন সময়ে শৃগালের এক পরমধার্ম্মিক চর উপস্থিত হইয়া, শৃগালের শত্রুপক্ষ যেরূপ কপটজাল বিস্তার করিয়াছিল, তৎসমুদয় শার্দ্দূলের নিকট নিবেদন করিল। তখন মৃগরাজ শার্দ্দূল গোমায়ুর সচ্চরিত্রতার বিষয়-শ্রবণে আহ্লাদিত হইয়া, যথোচিত উপচারে সৎকার করিয়া শৃগালকে স্নেহভরে আলিঙ্গন করিতে লাগিল। নীতিশাস্ত্রবিশারদ শৃগাল চৌরাপবাদনিবন্ধন একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া প্রায়োপবেশনবাসনায় শার্দ্দূলের অনুমতি প্রার্থনা করায়, শার্দ্দূল গোমায়ুর বাক্য-শ্রবণে প্রীতিপ্রফুল্ললোচনে তাহার প্রতি দৃষ্টিপাতপূৰ্ব্বক তাহাকে পুনরায় পূজা করিয়া বারংবার সেই অধ্যবসায় হইতে নিবারণ করিতে লাগিল। শৃগাল শার্দ্দূলকে আপনার উপর নিতান্ত স্নেহপরতন্ত্র দেখিয়া প্রণতিপুরঃসর বাষ্পগদ্গদবচনে কহিল, ‘মৃগরাজ! আপনি অগ্রে আমার বিলক্ষণ সমাদর করিতেন, এক্ষণে আমাকে যারপরনাই অবমানিত করিয়াছেন, সুতরাং আর আমি আপনার নিকট অবস্থান করিতে পারি না। যেসমস্ত ভৃত্যেরা অসন্তুষ্ট, স্বপদপরিভ্রষ্ট, অবমানিত, হৃতসৰ্ব্বস্ব, প্রতারিত, দুর্ব্বল, লুব্ধ, জ্বর, ভীত, অভিমানী, নির্দ্দয়, সতত সন্তপ্ত ও ব্যসনাসক্ত হয় এবং যাহারা নিরন্তর প্রভুর অন্তরালে অবস্থান করে, তাহারা সকলেই শত্ৰুতুল্য। তাহারা কখনই প্রভুর প্রতি প্রীত হয় না। আমি এক্ষণে অবমানিত ও স্বপদপরিভ্রষ্ট হইয়াছি, সুতরাং আপনি আমাকে আর কিরূপে বিশ্বাস করিবেন, আর আমিই বা কিরূপে আপনার নিকট অবস্থান করিব? আপনি আমাকে সবিশেষ পরীক্ষা করিয়া, কার্য্যদক্ষ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন; এক্ষণে আপনি আবার নির্দিষ্ট নিয়ম উল্লঙ্ঘন করিয়া আমার অবমাননা করিলেন। সত্যপ্রতিজ্ঞ ব্যক্তি সভামধ্যে একবার যাহাকে সচ্চরিত্র বলিয়া আদর করেন, তাহার দোষপ্রখ্যাপন করা তাঁহার কদাপি বিধেয় নহে। যাহা হউক, এক্ষণে আমি অবমানিত হইয়াছি, সুতরাং আপনি আর আমার প্রতি বিশ্বাস করিতে পারিবেন না। আপনি আমাকে বিশ্বাস করিলে আমারও বিলক্ষণ উদ্বেগ জন্মিবে। বিশেষতঃ আপনি আমা হইতে নিরন্তর শঙ্কিত থাকিলে, অনেকেই আমাদিগের রন্ধ্রান্বেষণে প্রবৃত্ত হইবে। দেখুন, একবার যে ব্যক্তি বিরক্ত হইয়াছে, তাহার সন্তোষসম্পাদন করা সহজ ব্যাপার নহে। বিরক্ত ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করিতে হইলে নানাবিধ ছল প্রকাশ করিতে হয়। ইহা প্রসিদ্ধই আছে যে, যাহার সহিত ভেদ উপস্থিত হইয়াছে, তাহাকে আয়ত্ত করা এবং যে ব্যক্তি একান্ত অনুরক্ত, তাহাকে বিয়োজিত করা উভয়ই সুকঠিন। বিরক্ত ব্যক্তিকে পুনরায় আয়ত্ত করিলে তাহার যে প্রীতি জন্মে, তাহা কপটতাপূর্ণ, সন্দেহ নাই। কোন ভৃত্যই স্বার্থশূন্য হইয়া ভর্ত্তার হিতসাধন করে না। সকলেই স্বার্থসাধনে তৎপর। ভৃত্যের প্রভুর প্রতি যথার্থ হিতবুদ্ধি নিতান্ত দুর্ল্লভ, সন্দেহ নাই। যে রাজার চিত্ত অতিশয় চঞ্চল, তিনি লোকের প্রকৃতি পরীক্ষা করিতে সমর্থ হয়েন না। একশত লোকের মধ্যে এক ব্যক্তিমাত্র কার্য্যক্ষম ও নির্ভীক হইয়া থাকে। লোকের বুদ্ধিলাঘবনিবন্ধন-ই [জ্ঞানের অল্পতার নিমিত্ত] অকস্মাৎ অধিকারলাভ, অধিকারপরিত্যাগ, শুভাশুভ কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ ও মহত্ত্বপ্রাপ্তির বাসনা হইয়া থাকে, সন্দেহ নাই। জ্ঞানবান্ শৃগাল শার্দ্দূলকে এইরূপে ধৰ্ম্মকামার্থসঙ্গত উপদেশ প্রদানদ্বারা প্রসন্ন করিয়া অরণ্যে প্রস্থানপূর্ব্বক প্রায়োপবেশনে কলেবরপরিত্যাগ ও স্বর্গলাভ করিল।”