১১০তম অধ্যায়
উত্তরদিকের উৎকর্ষ কথন
“গরুড় কহিলেন, “হে সুহৃৎ! এই দিকের প্রভাবে লোকে পাপ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া মুক্তিলাভ করে; এই নিমিত্ত ইহার নাম উত্তরদিক হইয়াছে। এই দিকে উত্তমোত্তম সুবর্ণখনির পথ প্রতিষ্ঠিত আছে। এই সর্বোৎকৃষ্ট উত্তরদিকে কুৎসিত দর্শন, অজিতাত্মা বা অধাৰ্মিক ব্যক্তি বাস করে না। নারায়ণ কৃষ্ণ, নরোত্তম বিষ্ণু ও সনাতন ব্ৰহ্মা এই দিকস্থ বদরিকানামে আশ্রমপদে বিদ্যমান আছেন। এই দিকে যুগান্তকালীন অগ্নির ন্যায় প্রভাবসম্পন্ন মহেশ্বর প্রকৃতির সহিত হিমালয়ের পশ্চাদ্ভাগে প্রতিনিয়ত বাস করেন; নর ও নারায়ণ ব্যতিরেকে ইন্দ্রাদি দেবতা, মুনি, গন্ধৰ্ব, যক্ষ ও সিদ্ধগণ তাঁহাকে অবলোকন করিতে সমর্থ হয়েন না। এই দিকে অবিনাশী শ্ৰীমান বিষ্ণু একাকী সহস্রাক্ষ [হাজার চক্ষু], সহস্রপাৎ [হাজার পদ] ও সহস্রামস্তক হইয়া এই মায়াময় সমুদয় জগৎ অবলোকন করিতেছেন। এই দিকে চন্দ্ৰমা বিপ্ররাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন [বিপ্ররাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ায় চন্দ্রের এক নাম দ্বিজরাজ]। এই দিকে মহাদেব গগন হইতে নিপতিত গঙ্গাকে গ্রহণ করিয়া মর্ত্যলোকে প্রদান করিয়াছিলেন। এই দিকে দেবী পার্ব্বতী মহেশ্বরকে লাভ করিবার নিমিত্ত তপস্যা করিয়াছিলেন। এই দিকে কাম, রোষ, শৈল ও উমা [হিমালয়ে উমার সহিত হরের বিবাহ বাসনায় তদীয় তপস্যাভঙ্গ করিতে তারকাসুর পীড়িত ইন্দ্রের ইঙ্গিতে গমন করে কাম, তাহাতে হরের হয় কোপ। ইহাই কাম, হরকোপ, হিমালয় ও উমার মিলন জন্য ঔজ্জ্বল্য] দীপ্তি পাইয়াছিলেন। এই দিকে কৈলাসপর্ব্বতে কুবের [রাবণের ভ্রাতা] রাক্ষস, যক্ষ ও গন্ধৰ্বরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন। এই দিকে চৈত্ররথ [দেবগণের উদ্যান-বাগান] উদ্যান, বৈখানসের [বনবাসী মুনির] আশ্রম, মন্দাকিনী ও পারিজাতবৃক্ষ প্রতিষ্ঠিত আছে। এই দিকে রাক্ষসগণ সৌগন্ধিক বন রক্ষা করিতেছে। এই দিকে হরিদ্বর্ণ কদলীস্কন্ধ [কলাগাছ] ও কল্পবৃক্ষসকল প্রতিষ্ঠিত আছে। এই দিকে সংযত ও কামচারী সিদ্ধগণের কামভোগ্য অনুরূপ বিমানসকল বিদ্যমান আছে। বশিষ্ঠপ্রভৃতি সপ্তঋষি ও দেবী অরুন্ধতী এই দিকে অবস্থান করেন। এই দিকে স্বাতী নক্ষত্র অবস্থিতি করে এবং উদিত হয়; এই দিকে পিতামহ ব্ৰহ্মা যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া অবস্থিতি করিয়াছেন। এই দিকে জ্যোতিষ্কমণ্ডলসকল, চন্দ্র ও সূৰ্য্য প্রতিনিয়ত পরিবর্ত্তিত হইতেছেন। এই দিকে মহাত্মা সত্যবাদী মুনিগণ ব্যস্তসমস্ত হইয়া গঙ্গা-দ্বার রক্ষা করিতেছেন। তাঁহাদিগের মূর্ত্তি আকৃতি, তপশ্চৰ্য্যা, গমনাগমন, পরিবেশন পাত্র [আজ এটা কাল ওটা-এইরূপ ভোগ্য বস্তুর নানা রকমের পরিবর্ত্তম] ও কামভোগসকল অবগত হওয়া যায় না। মনুষ্য এই উত্তরদিকে প্রবেশ করিবামাত্র বিনাশপ্ৰাপ্ত হয়। নারায়ণ ও নর ব্যতীত আর কেহই এ দিকে গমন করিতে সমর্থ হয় না। এই দিকে কুবেরের অধিকৃত কৈলাসনামক স্থান প্রতিষ্ঠিত আছে। এ দিকে সৌদামিনীর ন্যায় প্রভাবসম্পন্ন দশটি অন্সর জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। এই দিকে ভগবান বিষ্ণু ত্ৰিলোক-পরিভ্রমণ সময়ে আকাশে পদবিক্ষেপ করিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত আকাশ বিষ্ণুপদ বলিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছে। এই দিকে রাজা মরুত যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন। এই দিকে উশীরবীজনামক স্থানে জাম্বুনদনামে সরোবর
সিন্নবেশিত আছে। এই দিকে অতি পবিত্র নি
র্ম্মল হিমালয়ের সুবর্ণখনি ব্রহ্মর্ষি মহাত্মা জীমূতের নিকট প্রকাশিত হইয়াছিল। তিনি ব্রাহ্মণগণের নিকট প্রার্থনা করিয়াছিলেন যে, এ স্থানে যেসমুদয় ধন বিদ্যমান আছে, তাহা জৈমূত বলিয়া প্রসিদ্ধ হইবে। এই দিকে দিকপালগণ প্রতিদিন, প্রভাত ও সায়ংকালে সমুপস্থিত হইয়া কাহার কি কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিতে হইবে, ইহা মুক্তকণ্ঠে ব্যক্ত করিয়া থাকেন।
“ ‘হে ব্ৰাহ্মণ! এই দিক এইরূপ ও অন্যান্যরূপ নানাপ্রকার গুণে সর্বোত্তর [সর্ব্বশ্রেষ্ঠ] হইয়াছে; এই নিমিত্ত ইহা উত্তরদিক বলিয়া বিখ্যাত। আমি এই চতুর্দ্দিকের বৃত্তান্ত যথাক্রমে বর্ণনা করিলাম; এক্ষণে বল কোন দিকে গমন করা তোমার অভিপ্রেত? আমি তোমাকে সমুদয় দিক ও সমুদয় মেদিনীমণ্ডল প্রদর্শন করিতে উদ্যত হইয়াছি; অতএব কোন দিকে গমন করা তোমার অভিপ্রেত বল এবং আমার পৃষ্ঠে আরোহণ কর।’ ”