য়ুহা শেষ পর্যন্ত আর অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে না, কারণ তাকে মহাকাশযানের দেয়ালে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার পাশেই রায়ীলা, তাকেও একইভাবে বাঁধা হয়েছে। কমান্ডের ছয়জন ক্রু তাদের দিকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তাক করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাপ্টেন ত্রুব কাছাকাছি একটা টেবিলের পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ক্যাপ্টেন ক্রর দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে শেষ পর্যন্ত একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি আমার দীর্ঘ জীবনে কখনোই এ রকম একটি ঘটনা ঘটতে দেখিনি। য়ুহা, তুমি আমার নির্দেশ পুরোপুরি উপেক্ষা করে আমাকে শারীরিকভাবে আঘাত করে অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে একজন বিদ্রোহীকে জাগিয়ে তুলেছ?
য়ুহা বলল, তুমি যদি আমার কথা শুনতে তাহলে আমার তোমাকে অচেতন করার প্রয়োজন হতো না। আর একটা বিদ্রোহীকে বিপজ্জনকভাবে জাগিয়ে তুলতে হতো না। তোমাকে আঘাত করার জন্যে আমি দুঃখিত। একজন মানুষকে অচেতন করার জন্যে তাকে কত জোরে আঘাত করতে হয় আমার জানা নেই তাই সম্ভবত, আঘাতটি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক জোরে হয়ে গিয়েছিল।
ক্যাপ্টেন ত্রুব দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তোমার দুঃসাহস দেখে আমি স্তম্ভিত হয়েছি য়ুহা। তোমাকে সে জন্যে শাস্তি পেতে হবে। অত্যন্ত কঠিন একটা শাস্তি।।
মহাকাশযানটিকে ধ্বংস করে সবাইকে মেরে ফেলবে, তুমি এর মাঝে আমাকে আলাদা করে কী শাস্তি দেবে?
এর মাঝেও তোমাকে আলাদা করে শাস্তি দেয়া সম্ভব। সময় হলেই তুমি সেটা দেখবে।
য়ুহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এ রকম চরম বিপদের মাঝেও তুমি একেবারে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার উপরে উঠতে পারছ না দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি। ক্যাপ্টেন ক্ৰব, আমি তোমার জন্যে করুণা অনুভব করছি, তুমি নিশ্চয়ই খুব অসুখী একজন মানুষ।
আমি আমার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ নিয়ে কথা বলতে আসিনি।
য়ুহা ক্যাপ্টেন ত্রুবকে বাধা দিয়ে বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করি আমার সিদ্ধান্তটি পুরোপুরি সঠিক। এগারোজন বিদ্রোহীকে জাগিয়ে তুলে তাদের সাথে পরামর্শ করে তোমার একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। তোমার নিজের নেয়া সিদ্ধান্তটি ভুল। পুরোপুরি ভুল।
ক্যাপ্টেন ক্রল ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি আমার সিদ্ধান্তটি নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নই।
তুমি অন্তত রায়ীনার সাথে কথা বল। মহাজাগতিক প্রাণীর বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে সে একজন বিশেষজ্ঞ। সে তোমাকে সাহায্য করতে পারে।
ক্যাপ্টেন ক্ৰব কোনো কথা না বলে য়ুহার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। য়ুহা আবার বলল, সে যেহেতু জেগেই গেছে তখন তার সাথে কথা বলার মাঝে কোনো সমস্যা নেই। আমি নিশ্চিত রায়ীনা তোমাকে সাহায্য করতে পারবে।
ক্যাপ্টেন ক্রব এবারে রায়ীনার দিকে তাকায়, জিব দিয়ে নিচের ঠোঁটটা ভিজিয়ে শুকনো গলায় বলে, য়ুহার কথা কি সত্যি? তুমি কি এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারবে?
রায়ীনা বলল, সবকিছু না জানলে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে এ কথাটি সত্যি আমি বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করি। একটা প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা কীভাবে বিকশিত হয়, সেই বুদ্ধিমত্তার কারণে একটা প্রাণী তার চারপাশের জগতের কাছে কী আশা করে সে সম্পর্কে আমার মৌলিক কিছু গবেষণা আছে।
ক্যাপ্টেন ক্রব কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, আমি যদি তোমাকে সব তথ্য দিই তাহলে তুমি কি আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবে? মহাজাগতিক প্রাণীটি কী চায় কেন চায় কীভাবে চায় সেটি ব্যাখ্যা করতে পারবে?
রায়ীনা কয়েক মুহূর্ত কিছু একটা চিন্তা করে বলল, খুব নিখুঁতভাবে পারব সেটা দাবি করি না। তবে সম্ভবত তোমাদের অনেকের চাইতে ভালো পারব।
ঠিক আছে। ক্যাপ্টেন ত্রুব মাথা নেড়ে বলল, আমি তোমাকে সব তথ্য দিচ্ছি, দেখি তুমি আমাদের কী দিতে পার।
রায়ীলা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল। ক্যাপ্টেন ক্ৰব ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি হাসছ কেন?
রায়ীনা হাসি থামিয়ে বলল, খানিকক্ষণ আগে আমি যখন জেগে উঠতে শুরু করি আমার নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমি অবান্তর কথা বলেছি, অসংলগ্ন ব্যবহার করেছি, অকারণে হেসেছি। সেগুলোর কোনো গুরুত্ব ছিল না, কিন্তু এখন আমার হাসিটুকু একেবারেই আমার নিজস্ব! আমি হাসছি তার সুনির্দিষ্ট একটা কারণ আছে।
ক্যাপ্টেন ক্রব ভুরু কুঁচকে বলল, কী কারণ?
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি তোমার কমান্ডের একজন অনুগত সদস্য! তুমি আমাকে একটা আদেশ দেবে আর আমি, হুঁকুম শিরোধার্য বলে তোমার আদেশ মেনে চলব! তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ আমাদের বিন্দুমাত্র সম্মান না দেখিয়ে মহাকাশযানের দেয়ালে বেঁধে রাখা হয়েছে?
ক্যাপ্টেন ত্রুবকে এক মুহূর্তের জন্যে একটু বিচলিত মনে হলো, সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি বিদ্রোহী দলের একজন সদস্য। আমাদের এই মহাকাশযানের নিরাপত্তার একটা বিষয় আছে। আমি তোমাকে ছেড়ে রাখতে পারি না।
রায়ীনা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কিন্তু তুমি যদি আমার সাহায্য নিতে চাও তাহলে আগে আমার কিছু কথাবার্তা শুনতে হবে।
তোমার কথাবার্তাগুলো কী?
প্রথমেই আমাকে যেভাবে বেঁধে রেখেছ সেটা খুলে দিতে হবে। মানুষ যখন একটা পশুকে বাধে তখনও চেষ্টা করে রক্ত সঞ্চালনের বিষয়টা নিশ্চিত করতে, তোমরা সেটা করনি। আমাকে যদি খুলে দাও তাহলে আমার পাশে বসে থাকা য়ুহা নামের এই বিচিত্র মানুষটির বাঁধনও খুলে দিতে হবে। আমি এর সম্পর্কে কিছুই জানি না। কিন্তু এর কথাগুলো এবং এর খাপছাড়া কাজগুলো আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। সত্যি জীবন সম্পর্কে এর বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, সে কারণে তার জন্যে একটু মায়াও হয়েছে। রায়ীনা একটু নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, তারপর আমার দলের বাকি এগারোজনকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাকে যেভাবে অসম্ভব বিপদের ঝুঁকি নিয়ে জাগানো হয়েছে—সেভাবে নয়। স্বাভাবিকভাবে জাগাতে হবে যেন জেগে ওঠার সাথে সাথে তারা পুরোপুরি কার্যক্ষম থাকে। আমার মতো অপ্রকৃতস্থ না থাকে।
য়ুহা কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, আসলে দোষটা আমার–
রায়ীনা য়ুহার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, তোমার কোনো দোষ নেই, তুমি যেটা করেছ সেটা অসাধারণ। তোমার কারণে আমি এই মহাকাশযানের ক্যাপ্টেনের কাছে আমার দাবিগুলোর কথা বলতে পারছি।
ক্যাপ্টেন ক্ৰব শক্ত মুখ করে বলল, তোমার কথা শেষ হয়েছে।
না। শেষ হয়নি। রায়ীনা বলল, আমার দলের সবাইকে জাগিয়ে তুললেই হবে না। তাদের নিরাপত্তার জন্য তাদের সবার হাতে একটা করে অস্ত্র দিতে হবে যেন ইচ্ছে করলেই তোমরা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে না পার। শুধুমাত্র তাহলেই আমি তোমার সাথে কথা বলতে পারি।
ক্যাপ্টেন ক্ৰব শীতল চোখে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে রইল। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তুমি নিশ্চয়ই একবারও বিশ্বাস করনি যে তোমার এই দাবিগুলো আমরা মেনে নেব।
স্বাভাবিক অবস্থা হলে বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু এখন অবস্থাটা খুব জটিল। হয়তো তোমার একটা সঠিক সিদ্ধান্তে এতগুলো মানুষের প্রাণ বেঁচে যাবে।
আমি দুঃখিত রায়ীনা। তোমার রক্তসঞ্চালনের জন্যে হাতের বাঁধনটা একটু ঢিলে করে দেয়া ছাড়া আমার পক্ষে তোমার আর কোনো দাবিই মেনে নেয়া সম্ভব না।
রায়ীনা আবার শব্দ করে হাসল। ক্যাপ্টেন ক্ৰব ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কেন হাসছ।
তোমার কথা শুনে। তোমার আশেপাশে তোমার কমান্ডের এত জন। মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত দেবার জন্যে একবারও তাদের সাথে কথা বললে না! আমি তোমার জায়গায় হলে তাদের সাথে একবার কথা বলতাম।
ক্যাপ্টেন জব ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি কীভাবে সিদ্ধান্ত নেব সেটি আমার ব্যাপার। আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি বলেই আমি এই মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন।।
য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, তোমার সিদ্ধান্ত দেখে সেটা মনে হচ্ছে না ক্যাপ্টেন ক্ৰব।
আমার সিদ্ধান্তটি কী সেটা তোমরা এখনো জান না। আমি এখনো সেটা বলিনি।
সবাই এবার উৎসুক দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের দিকে তাকাল। ক্যাপ্টেন ক্রব তার মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটা স্কাউটশিপে করে তোমাদের দুজনকে এই কালো কুৎসিত গ্রহটাতে পাঠাব। এই গ্রহতে মহাজাগতিক প্রাণীগুলো আছে, দেখা যাক তারা তোমাদের কীভাবে গ্রহণ করে!
য়ুহা চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?
আমি ঠিকই বলছি। দেখি তোমরা এই মহাজাগতিক প্রাণীকে পরাস্ত করে ফিরে আসতে পার কী না।
য়ুহা কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, পরাস্ত করতে হবে? আমাদের?
সেটা তোমাদের ইচ্ছে।
য়ুহা ভয়ার্ত চোখে রায়ীনার দিকে তাকালো। রায়ীনার চোখে-মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। সে য়ুহার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলল, আশা করি সঙ্গী হিসেবে তুমি ভালো হবে–তোমার সাথে অনেক সময় কাটাতে হবে আমার।
আসলে সঙ্গী হিসেবে আমি যাচ্ছেতাই! য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, এত বয়স হয়েছে এখনো আমার কোনো ভালো বন্ধু নেই!