১০.
স্যান বারনাডিনোতে এসে পৌঁছলাম, সময়টা তখন মধ্যাহ্ন ভোজের। রেস্তোরাঁয় ভোজনরত অবস্থায় হেলেনকে দেখতে পেয়ে চুপিসাড়ে এগিয়ে গিয়ে ওর কানের কাছে মুখ এনে বললাম, খেয়ে নাও, এটাই হয়তো তোমার জীবনের দামী মূল্যের শেষ খাওয়া।
ও এমনভাবে লাফিয়ে উঠল যেন আমি চেয়ারের তলায় কোন বাজি ফাটিয়েছি। পরক্ষণেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুহাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরল। স্টিভ! তুমি!কখন এলে গো?
এই তো, এইমাত্র। আরে ছাড়ো ছাড়ো, তুমি কী হোটেলের বদনামে উঠে পড়ে লেগেছ নাকি? ওর হাতের বাঁধনমুক্ত করে চেয়ারে বসে পড়লাম।
তারপর তোমার নিজের খরচ খরচা কেমন চলছে? আমারটাও চালানোর ক্ষমতায় কুলোবে কি?
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ও। কী ব্যাপার, স্টিভ? কিছু গণ্ডগোল হয়েছে নাকি?
দাঁড়াও দাঁড়াও, আগে আমার জঠর জ্বালাটা ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করি, তারপর তোমাকে আজ একটা বেদনাদায়ক কাহিনী শোনাব।
খাদ্য তালিকা থেকে সবচেয়ে কম মূল্যের খাবারটা অর্ডার দেয়ার পর হেলেনকে অল্প কথায় সব খুলে বললাম। সব শুনে হেলেনের চোখদুটো ধক করে জ্বলে উঠল।
ম্যাডক্সের এতখানি সাহস এল কোথা থেকে? তার কোন অধিকার নেই আমার স্বামীকে এভাবে অপমান করার। আমি এখুনি তাকে ফোন করে…
এসবের আর কোন প্রয়োজন নেই হেলেন, আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি। তোমার সামর্থনেই আমাদের দুজনের খরচ চালাবার?
তুমি কি সত্যি সত্যি এই চাকরি ছেড়ে এসেছ?অবাক বিস্ময়ে হেলেনের চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে গেল।
কোন উপায় ছিল না। হারমাস পরিবার অন্যায়ের সঙ্গে কোনদিন আপোস করেনি। আমি মাইনের চেকটাও ওর মুখের ওপর ছুঁড়ে এসেছি। বলেছি ওটা ওর নাক মোছর কাজে আসবে।
তুমি মনে করো তুমি যা করেছ সেটা বুদ্ধিমানের কাজ?
মাথা নাড়ি। না, তা করিনি আমি স্বীকার করছি। হোটেলে ফিরে এসে দেখি আমার কাছে আর মাত্র পঁয়ত্রিশ ডলার পড়ে আছে, কিন্তু এতেও আমার মনে স্বস্তি আছে।
ওয়েটার খাবার দিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি আহারে মন দিলাম, কিন্তু হেলেন নিজের প্লেটটা স্পর্শ না করে থমথমে মুখে বসে রইল।
আমি হলেও হয়তো এই কাজই করতাম,আমার ভোজন সমাপ্ত হলে ধীরে ধীরে মুখ খুলল ও।
ঐ মেয়েটাই যে সুসান সে সম্বন্ধে আগে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে। ম্যাডক্সের মোটা মাথায় এই সহজ কথাটা ঢুকলো না?
তুমি তো তাকে চেনো। তার মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরপাক খায় তা হল, যেন-তেন প্রকারে টাকার দাবি নস্যাৎ করে কেসটাকে কোর্টে তুলে সংগ্রাম করা। ব্যাপারটা নিয়ে আমি যতই ভাবছি ততই আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে, কী ধুরন্ধর ওরা। ভেবে পাচ্ছি না, কী করে মেয়েটার প্রাণ নিল। শেরিফ তো জোর গলায় বলছে, মেয়েটা মারা যাবার সময় ঐ দ্বীপে সে ছাড়া দ্বিতীয় কোন প্রাণী ছিল না। একমাত্র তার সাক্ষাতেই ওরা রেহাই পেয়ে যাবে। তাই, ওকে যে খুন করা হয়েছে এটা যে করেই হোক আমাদের প্রমাণ করতে হবে। তাহলে আমাদের সামনে এখন একটা রাস্তাই খোলা আছে, ওরা যে মেয়েটাকে খুন করেছে সেটা যেভাবেই হোক প্রমাণ করতে হবে। ম্যাডক্স হয়তো এই ভাবছে, টাকার দাবি, আসলে সে মামলা লড়বে। কিন্তু আমার মনে হয় এরকম একটা নিখুঁত চক্রান্ত ফাস করার কোন আশাই বোধহয় নেই।
দুর্ঘটনাটা পরিকল্পিত নয়তো? তবে এটা হয়তো একটু বেশী কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়ে যাচ্ছে। ধরো, এমন যদি হয়, কনি ইচ্ছে করেই ব্যবহারের জন্য তার হাতের কাছে ভাঙাচোরা মইটা রেখে এসেছিল, যদি সে মই-এ ওঠার চেষ্টা করে তাহলে সে জানালার কাঁচের ওপর পড়ে যাবে?
আমি সজোরে মাথা নাড়লাম। তা হতে পারে না। ও হয়তো তাতে জানালা স্পর্শ না করেই লাফিয়ে পড়লে প্রাণে বেঁচে যেত। আমি নিশ্চিত কেউ তার-কজির শিরা কেটে দিয়েছিল। সে পুরুষই হোক আর স্ত্রী লোকই হোক। কিন্তু শেরিফের পৌঁছবার আগে দ্বীপ থেকে সে হাওয়া হলো কীভাবে, এটাই আমার মাথায় ঢুকছে না।
সাঁতরে যেতে পারে না?
সাঁতরে গেলেও যেতে পারত তবে দিনের আলোয় কখনোই সম্ভব নয়, রাতে হলেও একটা কথা ছিল। ওকলের কথা অনুযায়ী সে সারাক্ষণ ওখানে বসেছিল। সোয়া মাইল ফাঁকা জায়গা কেউ সাঁতরে পার হবার চেষ্টা করবেন তার নজরে পড়তেই।
তাহলে সে দ্বীপের আশেপাশে কোথাও ঘাপটি মেরে বসেছিল।
শেরিফের বক্তব্য দ্বীপে সে ছাড়া আর কোন জনমানুষ ছিল না। তাছাড়া.তার ধারণা গিয়ে। পড়েছিল কনির ওপর, এই কাজটা তার মনে করে। তাই সে কেবিনটা বিশেষভাবে পরীক্ষা করিয়েছিল।
আচ্ছা স্টিভ, তুমি কী মনে করো এর মধ্যে ডেনির হাত আছে?
না। সে তখন নিউইয়র্ক ছিল। আমি নিশ্চিত, কারণ সে সরল মনে আমার হাতে পলিসিগুলো তুলে দিতে চেয়েছিল। সে মেয়েটাকে হত্যা করলে কখনোই ওগুলো ফিরিয়ে দিতে আসত না। তাছাড়া সে জানতো না যে আমি ওগুলো গ্রহণ করব না। যদি ওগুলো নিয়ে নিতাম, তাহলে সব ব্যাপারটার পরিসমাপ্তি ওখানেই ঘটে যেত। আমার অনুমান, তাকে শুধু শিখণ্ডি হিসেবে খাড়া করা হয়েছিল–এসব বিষয়ে তার কিছুই জানা ছিল না।
উঠে দাঁড়ালাম। চলো লাউঞ্জে বসে কফি পান করতে করতে তোমার সংগ্রহ করা খবরগুলো শোনা যাক। তুমি এ কাজে কতদূর এগোলে?
হেলেনও উঠে পড়ল। আমি এখানে পা রেখেই প্রথমেই সমস্ত হোটেলের নামগুলো যোগাড় করে একে একে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করে দিলাম। সংখ্যায় যে কত ছিল তা তোমার ধারণাতেই আসবে না। পথ চলতে চলতে আর বক বক করতে করতে আমার হাল হয়েছিল শোচনীয়, তবু ভাগ্যে কিছুই জুটল না। সবাই-এর বক্তব্যই এক যে জোইস শ্যারম্যান নামে তাদের কোন রিসেপশনিস্ট ছিল না। ভেবে দেখলাম, সিনেমায় নামার সময় ও নিশ্চয়ই নাম বদল করেছিল। সেই অনুযায়ী পাঁচবছর আগে যত রিসেপশনিস্ট কাজ করেছে তাদের সম্বন্ধে অনুসন্ধান শুরু করলাম। কিন্তু এবারও সফল হলাম না। ওঃ স্টিভ, আমার অবস্থাটা তখন কী রকম আকার ধারণ করেছিল একবার ভেবে দেখ।..আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, জোইস শারম্যান এখানে একদিনের জন্যও রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজ করেনি।
যাক, এটাও তো একটা কাজের কথা। একেবারে যে শূন্য হস্তে ফিরছে একথা নিশ্চয়ই বলতে পার না। রাইস যে হোটেলে ছিল সেটার খোঁজ পেয়েছ?
তা পেয়েছি বটেপআমার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে নিল ও। হোটেলটার নাম রিজেন্ট। রাইস সেখানে দুসপ্তাহ মতো ছিল, কিন্তু হোটেল ছেড়ে আসার সময় বিলের টাকা মিটিয়ে যায়নি। হোটেলের ডিটেকটিভের মুখ থেকেই শোনা, একবার রাইসকে সে ঘরে একটা মেয়ে এনে তোলার জন্য ধরেছিল। মেয়েটার বর্ণনা শুনে মনে হল এই মেয়ে সম্ভবতঃ কোরিন হবে।
কোরিন কি তখন স্যান বারনাডিনোতে ছিল?
মাথা নাড়ল, হেলেন। হ্যাঁ, সুসান আর কোরিন দুজনেই তখন একটা নাইট ক্লাবে স্ট্রিপটিজ দেখছিল। সেই নাইট ক্লাবটাও খোঁজ করে সেখানকার ম্যানেজারের সঙ্গে আমি দেখাও করেছিলাম। ওদের দু-বোন আর রাইসকে তার ভালোই মনে হয়। তার বক্তব্য অনুযায়ী, রাইসের নাকি কোরিন সম্বন্ধে একটু উৎসাহ ছিল। প্রায়ই সে স্টেজের পেছনে কোরিনের সঙ্গে দেখা করতে যেত।
সুসান আর জোইস শ্যারম্যান একসঙ্গে ছিল কিনা জানতে পারল না?
একসঙ্গে ওরা ছিল না–অন্ততঃ এখানে নয়। তুমি ঠিক জানো?
হ্যাঁ। সুসান আর কোরিন যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকত, নাইটক্লাবের ম্যানেজার সেখানকার ঠিকানা দিয়েছিল। আজ সকালের দিকে সেখানে একবার ঢু মেরেছিলাম। বাড়িটা হাত বদল হয়েছে, তবে সেই সময়ের মালিকের ঠিকানা পেয়ে গেছি। আজ বিকেলে ওখানে যাবার কথা। জায়গাটার নাম বারমডেল–এখান থেকে শখানেক মাইলের মতো দূর হবে।
তুমিও যাবে নাকি?
কথা বলার সময় সারাক্ষণ আমি ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম। কেন জানি না মনে হচ্ছিল ও একটু অস্বস্তি বোধ করছে। শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, কী ব্যাপার হেলেন? তোমাকে আজ অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে। এতদিন ধরে খুব পরিশ্রম করেছ নাকি?
জবাব দেবার আগে সামান্য ইতস্ততঃ করল ও।
জানি না হঠাৎ করে আমার মধ্যে কল্পনাপ্রবণ শক্তি জেগে উঠেছে কিনা, কিন্তু গত দুদিন ধরে আমার কেবলই মনে হচ্ছে, আমি যেখানে যেখানে যাচ্ছি কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। কাল রাত্তিরে মনে হল, কেউ.যেন আমার শোবার ঘরের দরজা খোলার চেষ্টা করেছে। আমি কে, বলে ডেকেও উঠেছিলাম কিন্তু প্রত্যুত্তরে কোন সাড়া পাইনি। অবশ্য শয্যা ছেড়ে উঠে দেখার চেষ্টা আমার দিক থেকেও হয়নি।
তোমাকে অনুসরণ করা হচ্ছে বুঝলে কী করে?
মনে হল। দেখিনি কাউকে, তবু এই অনুভূতিটা মন থেকে তাড়াতেও পারছি না, আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে, স্টিভ।
আমি ওর হাতে মৃদু চাপড় দিলাম। আরে তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছ, ভয়ের কোন কারণ নেই। সেই বাড়ির মালিকের কাছে আমরা দুজনে এক সঙ্গেই যাব। অকারণ চিন্তা করো না, কেমন?
তা করবো না, তবে তুমি আর নতুন করে কোন ঝামেলার সৃষ্টি করো না, স্টিভ দোহাই তোমার? বুঝতে কষ্ট হল না, ও মুখে যাই বলুক, মনে ওর ভয় ধরেছে।
তাই বললাম, শোনো, তুমি বরং সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে পরম নিশি বাড়ি ফিরে যাও।
ঘরের সব জিনিসপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা সেগুলো দেখার জন্যেও এসময়ে একজ, সেখানে যাওয়া দরকার।
প্রবল ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠল ও। না স্টিভ, তোমাকে একা ফেলে আমি এক পাও কোথাও নড়ব না। আমার কেবলই চোখে জ্যাক কনির মুখটা ভেসে উঠছে আর সেই সঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে তার আওড়ানো বুলি। নৌকোয় বসে সে যেন আমাদের উদ্দেশ্যে বলছে : প্রথমে আমি গুলি মারি পরে ক্ষমা চাই। লোকটা অতিরঞ্জিত কিছু বলেনি ওর দ্বারা সবই সম্ভব।
নিজের স্ত্রীর সুরক্ষার প্রশ্ন উঠলে ওটা আমিও পারি,আমি মৃদু হাসি হেসে উঠি। তুমি শুধু দেখে যাও। প্রথমে একটা ডবল রুম নেওয়া যাক। ব্যাগটা ওখানে রেখে আমরা বেড়িয়ে পড়ব। ফিরে গিয়ে যদি কিছু পেয়ে যাই তবে রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেব আর নয়তো দুজনেই একই পথের পথিক হয়ে লস এঞ্জেজেলস-এ রওনা দেব। ওদের টাকা দাবি করার সেই লগ্নে আমি ওখানে থাকতে চাই।
মুচকি হাসল হেলেন। তুমি যে কাজ ছেড়ে এসেছ এর মধ্যেই ভুলে গেলে?
আমি ম্যাডক্সকে ছেড়েছি ঠিকই, কেসনয়। তুমিও কী এই চাও জ্যাকসন আমার ওপর টেক্কা মারুক? আমি একাই এই কেসের সব দায়িত্ব নিতে চাই, আর যদি অঘটন কিছু ঘটাতে পারি ম্যাডক্সকে তার জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হবে। স্বাধীন অনুসন্ধানকারী হিসেবে ইসিওর মূল্যের একশ অংশ দিতে তখন সে বাধ্য থাকবে। দেড় লক্ষ ডলারের একশ শতাংশ কত হয় হিসেব করে তোমার মিঙ্ক কোটটার কথা বরং এখন থেকেই ভাবতে শুরু করে দাও।
কেসটা তোমার হাতে ফয়সালা হবার পরই ওটা নিয়ে ভাবতে বসবো,হাসতে হাসতে বলে উঠল ও। এখন থেকেই ভবিষ্যতের কল্পনার জাল বোনা উচিত নয়।
তুমি দেখে নিও,আমি উঠে দাঁড়ালাম, ওরা এক চুল সামান্য ভুল পদক্ষেপ নিলেই কেসটা ফাঁস হয়ে যাবে। পরে আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে নিও।..
.
বারমডেল জায়গাটা উইলিংটনের থেকেও ছোট। একটা বড়োসড়ো দোকান, গোটা দুই পেট্রল পাম্প, একটা সেলুন আর একটা বাস ডিপো সম্বল করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এই শহরটা।
হেলেনের মুখে শুনলাম বাড়ির মালকিনের নাম মিসেস পেইসলে। দোকানটায় ঢুকে ভদ্রমহিলার বাড়ির নির্দেশ জেনে নেবার পর দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে উঠলাম, আপনি কী ওঁকে চেনেন?
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়ে বসল, হা হা, কেন চিনবো না। উনি তো প্রায়ই আমার এখানে পদধূলি দেন। তবে আপনাদের কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি। বছর দুই আগে স্বামী মারা যাবার পর থেকে মস্তিষ্কের ভারসাম্য হারিয়ে উনি কেমন যেন ছিটগ্রস্ত হয়ে গেছেন।
হেলেন আর আমি উভয়েই দৃষ্টি বিনিময় করলাম।
একেবারে উন্মাদ নাকি?
আরে না না, মাঝে মাঝেই মাথার গণ্ডগোল দেখা যায় আরকি। সেই মুহূর্তে উনি ওনার স্বামীকে জীবন্ত দেখতে পান। তবে ভয়ের কিছু নেই।
দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আমি বলে উঠলাম, আশা করি ভদ্রমহিলার স্মৃতি শক্তি এখনও নষ্ট হয়ে যায়নি। ভাগ্যিস তোমার সঙ্গে এসেছিলাম।
ধুলো ভর্তি অপরিষ্কার রাস্তা ধরে মাইল দুই এগোনোর পর দোকানদারের নির্দেশ মতো একটা ফাঁকা জমিতে এসে পড়লাম আমরা। দেখেই বোঝা যায় জমিটা বহুদিন ধরে অযত্নে পড়ে আছে। আগাছায় ভরা একটা বাগানের মাঝে কাঠের যে বাংলোটা দাঁড়িয়ে আছে সেটা বোধহয় একটু জোরে ফুঁ দিলেই ধসে পড়বে।
এটাই হবে, বলে আমি দরজার পাশে গাড়িটাকে দাঁড় করালাম।
পর্দাহীন একটা জানালার ভেতরে টিমটিম করে আলো জ্বলছিল। আগাছা মাড়িয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল, একটা ছায়ামূর্তি জানালায় দাঁড়িয়েই মুহূর্তের মধ্যে আবার সরে পড়ল।
যাক, একটাই সান্ত্বনা, ভদ্রমহিলা বাড়িতে আছে।কয়েক পা এগিয়ে ভাঙা কাঠের দরজাটার ওপর বারকয়েক টোকা মারলাম।
দড়াম করে মুখের ওপর দরজা খুলে দীর্ঘকায় এক মহিলা সামনে এসে দাঁড়ালেন। বয়স পঁচাত্তরের কাছাকাছি। অপরিচ্ছন্ন কোঁচকানো মুখ মণ্ডল। বিরাট একটা ঘড়ের টুপির পাশ দিয়ে সাদা কেশগুলো বেরিয়ে এসে মুখের কাছে গুটিয়ে গেছে। গভীর জোড়া চক্ষুতে অস্পষ্ট চাউনি। গাঢ় সবুজ রঙের ভেলভেটের পোষাকটার বহু জায়গায় বিশেষ তালি লাগানো। কিছু চাইতে এখানে হাজির হয়েছ তোমরা? হেলেনের সুদৃশ্য পোযাকের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাতে তাকাতে ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করলেন। আমার নাম হারমাস, আমার সঙ্গে ইনি আমার স্ত্রী। আমরা শুনেছি কয়েক বছর আগে স্যান বারনাডিনোতে আপনার নাকি বিরাট একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউস ছিল?
ভুরু কুঁচকে তীৰ্ষক দৃষ্টিতে তাকালেন বৃদ্ধা। ছিল নাকি? আমার অত মনে নেই বাপু। তবে তোমাদের কি প্রয়োজন তাতে?
আমি সুসান গেলার্ট সম্বন্ধে কিছু জানার জন্য এখানে এসেছি। শুনলাম তিনি নাকি একসময় আপনাদের সঙ্গেই থাকতো? ভাবলেশহীন চোখ দুটো কৌতূহলে জ্বলজ্বল করছে। ও কি কোন ঝামেলায় পড়েছে? একবার মনে হল হ্যাঁ বললেই ভদ্রমহিলা বোধহয় বেশি খুশি হবেন। আমি দুদিক বজায় রেখেই উত্তর দিলাম, খুব সম্ভব তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।
ও, মরেছে তাহলে! স্থির দৃষ্টিতে তাকাল তিনি। দেখেছো, আমার স্বামী অনেক আগেই বলে দিয়েছিল ওর শেষ পরিণতি মোটেই সুখের হবে না। তোমরা বরং ভেতরে এসো। আমার স্বামী শুনে খুব খুশি হবে। বহুবার ও আমায় বলেছে,দেখো, মেয়েটা বেঘোরে মরবে। আর আশ্চর্য শেষ পর্যন্ত তার কথাই সত্যি হল! অবশ্য আজ পর্যন্ত এমন হয়নি যে ও যা বলেছে তা ভুল বলেছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন উঠোনের মধ্যে দিয়ে বাংলোর পেছনের দিককার একটা ঘরের দিকে এগিয়ে চললেন তিনি।
.
পাগলামি শুরু হয়ে গেছে, ফিসফিস কণ্ঠে আমি হেলেনকে বলে উঠলাম।
ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে রান্নার সরঞ্জাম আর বাকি অর্ধেক বসার। মাঝে জ্বলছিল তেলের একটা কুপি। ফাঁকা তাপ চুল্লীর পাশে একটা বিরাট আকারের আরামকেদারা। একজোড়া শতছিদ্র চটি রাখা আছে তার পায়ার সামনে। ঘরে ঢুকেই মিসেস পেইসলে আরাম কেদারার কাছে গিয়ে বলতে শুরু করে দিলেন, উঠে পড়ো হোবেস। এক ভদ্রলোক তোমার সঙ্গে দেখা করতে এতদূর এসেছেন। সেই গেলার্ট নামের মেয়েটা মারা গেছে গো–ঠিক যেমনটি তুমি বলেছিলে। ঘুরে দাঁড়ালেন আমার দিকে।
তোমরা মনে কিছু করোনা, বাবা, আমার স্বামীর ওঠার ক্ষমতা নেই। ভীষণ অসুস্থ। মৃত্যু পথযাত্রী ছিলেন প্রায়। চোখ দুটো বড় বড় করে এগিয়ে এলেন, তারপর যতটা সম্ভব কণ্ঠ চেপে বলে উঠলেন, হার্টের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। অবশ্য এবিষয়ে কিছুই জানে না। আমাকে তাই খুব সাবধানে রাখতে হয়।
ও! সত্যি শুনে খুব খারাপ লাগছে। আমার সমস্ত শরীর দিয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করেছিল।
থাক, ওঁকে আর বিরক্ত করে প্রয়োজন নেই।
তুমি বরং একটু বোসো। ও তমার সব কথা শুনুক–কিন্তু ভুল করেও কোন প্রশ্ন করতে যেওনা যেন! উত্তর না হয় আমি দেবো।
অসংখ্য ধন্যবাদ। একটা খাড়া পিঠওয়ালা চেয়ারে বসে পড়লাম। ব্যাপারটা তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে, মিস গেলার্ট অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। যতদূর জানা গেছে, জানলা পরিষ্কার করতে করতে মই ভেঙে তিনি পড়ে যান, সেই সময় কাঁচের টুকরোর আঘাতে, তার কব্জির শিরা কেটে যায়। আমি ইনসিওরেন্স কোম্পানির একজন গোয়েন্দা। মিস গেলার্ট আমাদের কাছে ইনসিওর করিয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন কিছু প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে, যাতে আমরা নিশ্চিত যে তার মৃত্যু হঠাৎ হয়নি, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তাই কাজে লাগার মতো তথ্যের সন্ধানে ঘুরে ফিরছি আমরা।
শুনলে তো হোবেস? ফাঁকা আরাম কেদারাটাকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন বৃদ্ধা। পরক্ষণেই খরখরে কণ্ঠে উচ্চঃস্বরে এমনভাবে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লেন যে আমার মতো গোয়েন্দারও দেহের সারা লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। জানলা পরিষ্কার! ঐ খুঁড়ি জানালা পরিষ্কার করছিল। উই এ বিশ্বাস আমার মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। কোন কিছু পরিস্কার করার মেয়ে ও নয়। ওরা দুজনেই ছিল কুঁড়ের বাদশা। নোংরার মধ্যেই ছিল ওদের বাস। এ নিয়ে আমার কত্তার মাথাব্যথা কিছু কম ছিল? এ ব্যাপারে তিনি ওদের কিছু কম বলেননি।
মারা যাবার সময় উনি জ্যাক কনি নামে এক ভদ্রলোকের কাছে ছিলেন, আমি বলে উঠলাম। সেই ভদ্রলোক সম্প্রতি কোরিন গেলার্টকে বিবাহ করেছেন। চেনেন নাকি তাকে?
সম্প্রতি বিয়েও করেছে? এই ভুয়ো খবর তোমায় দিল কে? বহু বছর আগে ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। আর তার সঙ্গে চেনা পরিচিতি আমার আছে কিনা? ই! ও হাড়বজ্জাত দাগী আসামীকে ভোলা সম্ভব কখনও! ধরা পড়ার আগে সে প্রায়ই ও বাড়িতে ধর্না দিত। কোরিনকে সেই তো এজেন্ট ছোকরাটার সঙ্গে পাকড়াও করেছিল। কি যেন নামটা ছিল তার? ভুলে গেলাম। আরাম কেদারাটার দিকে তাকালেন তিনি। কোরিনের সঙ্গে সদাসর্বদা যে ছোকরা তার পিছু পিছু ঘুরঘুর করতে তার নামটা যেন কী….
ঐ যে গো, খুব ভালো পোষাক পরতো আর ক্যাডিলাক গাড়ি চেপে এখানে হাজিরা দিত?
পেরি রাইস কি? আমি বলে উঠলাম।
হা, হ্যাঁ, ঠিক। ওঃ, সেই দৃশ্য কি ভোলার! আমার কত্তা উপরে উঠে গিয়েছিলেন এই বলতে যে ওরা যেন ওদের গোলমাল এখানেই থামিয়ে দেয়। কনি তো ঘাড় ধরে এক ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল ওঁকে। আমি চুপচাপ বসে তামাসা দেখছিলাম। কোরিনের গায়ে একচিলতে সুতো পর্যন্ত নেই। চকের মতো সাদা মুখ নিয়ে দরজার পাশেই দাঁড়িয়েছিল রাইস। কনির হাতে ধরা ছিল একটা বন্দুক। উনি যে কোন সাহসে উপরে গিয়েছিলেন তা চিন্তা করলে আমি কোন উত্তর পাই না। পরে অবশ্য পুলিস এসে পড়লে কনিকে ধরা দিতেই হয়।
কনিকে ধরা কোন সহজ ব্যাপার নয় অনেক গুলিগোলা চলার পর তবে সে হার স্বীকার করে নিজেকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ওঃ, সেই ভয়ঙ্কর রাতের কথা ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। এই অভিজ্ঞতার কথা আমি জীবন ভোর ভুলতে পারব না।
আমি আর হেলেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো বৃদ্ধের মুখ থেকে নিঃখুঁত কথাগুলো শুনছিলাম। ওঁর বক্তব্য শেষ হলে পর আমি প্রশ্ন করি, জ্যাক কনি আর কোরিন তাহলে তখন থেকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিল? নিশ্চয়ই। ও লোকটা ছিল রীতিমতো এক ডাকাত। নির্জন দোকান পাট, পেট্রল পাম্প এইসব লুঠ করে বেড়াতে। পুলিস কয়েক সপ্তাহ ধরে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আর যখন সে পুলিশের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে, তখন সে গলা ফাটিয়ে সবার উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলে যায় যে কোরিনই তাকে ধরিয়ে দিয়েছ। আমি অবশ্য এব্যাপারে তেমন আশ্চর্য হইনি। ওর ধান্দাই ছিল স্ত্রীর টাকায় ফুর্তি করা। রাইসকে কাছে পেয়ে মেয়েটাও বোধহয় স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বেঁচে ছিল।
কোরিনই যে তাকে পুলিসের হাতে তুলে দিয়েছিল এমন কোন অকাট্য প্রমাণ আছে?
প্রমাণ-ট্রমাণ বুঝি না বাপু, তবে এ ব্যাপারে সুসানকে ওর বোনের সঙ্গে ঝগড়া করতে শুনেছি। ঝগড়া বলে ঝগড়া! আমার তো মনে হয়েছিল সুসান বোধহয় ওকে মেরেই ফেলবে। শেষে নিরূপায় হয়েই আমার কত্তাটিকে পাঠালাম ওদের দুজনের মধ্যে মধ্যস্থতা করাতে। সেই ঘটনা থেকেই ওরা আলাদা হয়ে যায়।
ওরা মারামারি করেছিল কেন? আমি জানতে চাইলাম। এই কেসের তদন্তে হাত দেবার পর থেকে এই প্রথমবার কাজ মতো কিছু শুনছি।
ওমা! সুসান যে কনির সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি চালাচ্ছিল। কোরিন এই কথাটা জানত না, কিন্তু আমি জেনেছিলাম। বহুদিন আমার চোখে পড়েছে, কোরিন না থাকাকালীন ও ছোকরা হুট-হাট করে এ বাড়িতে এসে উপস্থিত হতো আর ঐ খুঁড়ির সঙ্গে ঘন্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে যেতো।
সুসান তাহলে জেনে গিয়েছিল যে, তার বোনই কনিকে পুলিসের হাতে তুলে দিয়েছে?
সুসান তো এই বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল।বলছিল ও নাকি মেরেই ফেলবে। শেষে আমার কত্তাটি গিয়ে তাদের গোযোগ থামায়। এর ঘণ্টা খানেক পরে দেখি, কোরিন হাতে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে। এরপর তাকে আর কোনদিন দেখিনি। এর ঠিক দুসপ্তাহ পরে সুসানও চলে যায়। ই, দুষ্ট গরুর থেকে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো!
তারপর কী হল ওদের? আমি সাগ্রহে প্রশ্ন করলাম।কোরিনের কথা ঠিক বলতে পারি না। তবে শুনেছিলাম সে নাকি বুয়েনস এয়ারস-এ গেছে। সুসান গিয়েছিল লস-এঞ্জেলস। একজনের মুখে থেকে শোনা সে নাকি স্টেজে উলঙ্গ নৃত্য প্রদর্শন করে, জনসাধারণকে আনন্দ দেয়। মরুকগে ওঁরা ও দুটো বাড়ি থেকে বিদায় হতে আজ আমি সত্যি খুশি।
ওদের দুজনের চেহারার মধ্যে এক অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে,আমি বললাম। কেবল একজনের মাথার কেশ সোনালী আর অন্যজনের কালো। একসময় আমার মনে হয়েছিল,সুসান যদি কালো পরচুলা মাথায় তোলে তাহলে ওদের আলাদা করা কারো পক্ষেই বোধহয় সম্ভব হবে না। আপনি চিনতে পারবেন, মিসেস পেইসলে?
আমি যে কোন সময়ে ওদের চিনে ফেলব, মাড়ি বিকশিত করে হাসলেন মিসেস পেইসলে। ও দুটোই ছিল বেহায়া প্রকৃতির। গায়ে সুতোটিও না রেখে ওরা স্বচ্ছন্দে বাড়িতে ঘোরাফেরা করত। কতবার যে আমার কত্তাটি ঐ বেহায়া দুজনের সামনে পড়েছেন ঐ বিশ্রী অবস্থায়, তার ঠিক নেই। আমি ওদের এ ব্যাপারে বকাঝকা কম করিনি, কিন্তু ফল কিছু হয়নি।…
কোরিনের একটা জড়ুল ছিল। ওটা দেখেই আমি ওদের তফাৎ ধরে ফেলব। ছোট্ট একটা চৌকোনা দাগ, ঠিক এখানে, হাড্ডিসার একটা আঙুল নিজের সমতল বুকের ওপর ঠেকিয়ে দেখালেন মিসেস পেইসলে।
জডুলটা সুসানের গায়েই ছিল বলছেন?
সুসান নয়, কোরিন। কি শুনছোটা কি তুমি?
আমি কিন্তু জানি সুসানের গায়ে একটা জন্ম চিহ্ন আছে।
তোমার শুনতে একটু ভুল হয়েছে। বহুবার ওটার দর্শন লাভ হয়েছে আমার। ছোট্ট একটা দাগ। আর আশ্চর্যের কথা এই যে ঐ মেয়েটা তার জন্য মনে মনে গর্বিত ছিল। ও একদিন নিজে থাকতেই আমাকে জডুলটা দেখিয়েছিল। এখন তোমার নাকটা আমার চোখের সামনে যেন পরিষ্কার ঠিক তেমনি ভাবেই জডুলটাও পরিষ্কার দেখতে আমার ভুল হয়নি।…
প্রাণপণে উত্তেজনা মনে দমন করে বাংলো ছেড়ে নিঃশব্দে বেড়িয়ে এলাম দুজনে। মিসেস পেইসলেকে আমি দীর্ঘ একঘণ্টা ধরে এটাই বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে, জন্মচিহ্নটা সুসানের দেহে মজুত, কোরিনের নয়। তার এই বিশ্বাস থেকে একচুলও তাকে নাড়ানো সম্ভব হয়নি।
তবে তার সঙ্গে কথা বলে মনে হল তিনি যা বলছেন তার সবটাই সত্য। অর্থাৎ নিখুঁত মাপের এই কেসটায় এই প্রথম ফাটলের সূত্রপাত হল। মৃত মেয়েটা যদি কোরিন কনি হয়, তাহলে ক্ষতিপূরণের দাবি আপনা থেকেই নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে, আর পলিসিটাকে আমরা অনায়াসেই জালিয়াতির গহ্বরে ফেলে মামলা লড়ার সুযোগ পেয়ে যাব।
ঐ বুড়ীর থেকেও নির্ভরযোগ্য সাক্ষী যোগাড় করতে হবে, গাড়ির চালক আসনে বসা হেলেনকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বললাম। এঁকে সাক্ষীর কাঠগোড়ায় দাঁড় করানো মানে শুধু শুধুই সময়ের অপচয়। বিরোধী পক্ষের যে কোন উকিল খুব সহজেই এঁকে কাবু করে ফেলবে তাদের কথাবলার মারপ্যাঁচে। আমার মনে হয় বুড়িকে বাদ দিয়েও এমন কাউকে পাওয়া যাবে সে কোরিনের জডুল চিহ্নটার কথা জানে।
পলিসির ওপর আঙুলের ছাপের রহস্যটাও আমাদেরই উদ্ধার করতে হবে, হেলেন উত্তরে বলে। কোরিনের যে ছাপ আমরা পেয়েছি তার সঙ্গে ওটা মিলছে না।
বেশ, ওটা নিয়ে না হয় ভাবা যাক। ও ছাপটা প্রথম থেকেই আমাদের মনে সন্দেহ জাগিয়েছিল। আচ্ছা, সুসান যদি কোরিন সেজে ওটা করে থাকে?
সম্ভাবনাটা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, উইলিংটনে সে উপযাচক হয়েই কোরিনের ঠিকানাটা দিয়েছিল। ও জানত, কোরিনের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবেই। এখন কে বলতে পারে, ও সেই রাত্রেই ডেড লেকে চলে গিয়ে পরের দিন সকালে একটা কালো পরচুলা পরে আমাদের সঙ্গে কোরিন পরিচয় দিয়ে সাক্ষাৎ করেনি? তোমার সাথে থাকবে, আমি কত সহজে ওর আঙুলের ছাপ নিতে পেরেছিলাম?তুমিও তো সে সময় বলেছিলে, ও যেন ছাপটা আমাদের নিতেই বলছিল!
কিন্তু সুসানের আঙুলের ছাপও আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে। যে আয়নাটা আমি ওর ড্রেসিং টেবিল থেকে গোপনে তুলে এনেছিলাম, তার ছাপের সঙ্গে পলিসির ছাপটাও মিলে গেল!
কিন্তু আমরা তাকে আয়নাটা ব্যবহার করতে দেখেছি কি? ওটা যে ওখানে আমাদের কথা ভেবেই রাখা হয়নি তা তুমি কেমন করে জানতে পারছ? ধরো, ওটা যদি কোরিনেরই আয়না হয়ে থাকে?
ঠিক বলেছো, স্টিভ, হেলেনের কণ্ঠ বোবা উত্তেজনায় ভরা। কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে কোরিন ছিল কোথায়?
বুয়েনস এয়ারসে থাকতে পাবে! আর সব ব্যবস্থা পাকা করার পরেই সুসান আর কনি তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দ্বীপে ডেকে এনে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে! এরপর যা ঘটেছে তা জলের মতো পরিষ্কার। সুসান, কোরিন সেজে বুয়েনস এয়ারসে ফিরে নিজের অ্যালবি ঠিক করে নেবে। সহসা একটা কথা মনে পড়ে যায়। দাঁড়াও, আমি তোমায় বলছি কে মিসেস পেইসলের বক্তব্য সমর্থন করতে পারে। মসি ফিলিপস! সে সুসান আর কোনির দুজনেরই ফটো তুলে রেখেছিল। জন্মচিহ্নটার কথা তার মনে থাকলেও থাকতে পারে। রাত ভোর গাড়ি চালানোর মতো শক্তি আছে কি? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা লস-এঞ্জেলসে ফিরতে পারবো, তত তাড়াতাড়ি এই কেসের যবনিকা টানা যাবে।
ঠিক আছে, তোমাকে আমি প্রথমে ঘুমের সুযোগ দিচ্ছি। অর্ধেক রাস্তা যাবার পর আমি তোমায় ডেকে দেবো।
নিদ্রা নেবার বিন্দুমাত্র বাসনা আমার ছিলনা। গাড়ির পেছনের সীটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে আমি এতোদিন ধরে আবিষ্কৃত তথ্যগুলো এক করে চিন্তায় ডুবে গেলাম।
সব শুনে মনে হচ্ছে, জ্যাক কনিকে কোরিন বিয়ে করেছিল পাঁচ থেকে দুবছর আগে। সেই সময়ে সুসান আর কোরিন একটা নাইট ক্লাবে কাজ করতো। সম্ভবতঃ বিয়ের বছরখানেক বাদেই কোরিনকে ছেড়ে কনি নিজের মতো করে বসবাস করছিল।
কিন্তু একসঙ্গে সহবাস না করলেও কনি সময় সময় টাকার অভাব দেখা দিলে স্ত্রীর কাছে হাত পাততেও কুণ্ঠিত হতোনা। দুই বোন যখন স্যান বারনাডিনাতে একসঙ্গে থাকতো, সেই সময় থেকেই কনির সঙ্গে সুসানের ঘনিষ্ঠতা জন্মায়। কোরিন এ খবর রাখতো না, বা রাখলেও হয়তো এ ব্যাপারে তোয়াক্কা করত না। কারণ ও তখন পেরি রাইসের প্রেমে মশগুল।
কিন্তু কনির টাকা চাওয়ার ব্যাপারে, মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠছিল কোরিন।
টাকার জন্য বারংবার হাত পাততো কোরিনের কাছে, মনে মনে কোরিন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া অবৈধ প্রেম ধরা পড়ে যাবার ভয়ও তার অন্তরে ছিল। তাই পুলিসকে দিয়ে তার স্বামীকে ধরিয়ে দেয়।
সুসান তার বোনের কীর্তির খবরটা কানে যেতেই কনিকে সতর্ক করার চেষ্টাও করেছিল কিন্তু তার আগেই কনি পুলিসের ফঁদে আটকে পড়ে। মামলায় চার বছর হাজতবাসের সাজা জুটেছিল ওর ভাগ্যে।প্রেমিককে হারিয়ে রাগে অন্ধ হয়ে সুসান ওর বোনকে হত্যা করার চেষ্টাও করেছিল, তাই নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে কোরিন বুয়েনস এয়ারস-এ পালিয়ে যায়। আর আমার অনুমান, কনির হাজতবাসের পুরো মেয়াদটাই ও সেখানে কাটিয়েছিল।
দুয়ে দুয়ে চার করলে ব্যাপারটা ঠিক এইভাবে দাঁড়াবে, তাতে দশলক্ষ ডলারের বীমা করার মতলবটা প্রথমে সুসানের মাথা থেকেই রেড়িয়েছিল। ও ঠিক করেছিল, এই টাকাটা বীমা কোম্পানীর থেকে আদায় করে ও কোরিনের ওপর প্রতিশোধের যে আগুনে জ্বলছিল তা নেবাবে সেই অনুযায়ী কনি জেল থেকে পারাখতেই ও তার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের পরিকল্পনাটা। তার কাছে খুলে বলে। ওরা ডেড লেকে গিয়ে ওঠে, আর সুসান একটা গাঢ়রঙের পরচুলা পরে মাঝে মাঝেই স্প্রিংভিলেতে হাজির হতে শুরুকরল, যাতে লোকে ধরে নেয় কোরিনই দ্বীপে বাস করছে। ঐ ধরনের জনবিরল একটা জায়গায় একাজটা ছিল অত্যন্ত সহজ এবং নিরাপদ। কাজটা পাকাঁপোক্ত ভাবে সমাধা করার পর সুসান যেভাবেই হোক কোরিনকে ছলে-বলে কৌশলে ওখানে ডেকে আনে, আর আসামাত্র তাকে বন্দী বানানো হয় জনমানবশূন্য ঐ দ্বীপেই।
এ পর্যন্ত চিন্তার জাল বোনারপর ঘুমে চোখ একেবারে খুঁজে আসছে। গাড়ির ঝাঁকুনি, মধ্য রাত্রির উষ্ণ হাওয়া আর সারাদিনের গাড়ি চালানো ধকল আমার সারা অঙ্গ একেবারে অবশ করে দিচ্ছে, এই ধকল আমার পক্ষে এখন সহ্য করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।…
ঘণ্টাখানেক মতো ঘুমোবার সুযোগ পেয়েছিলাম, তারপরেই হেলেন আমার হাতে আঁকুনি দিতেই ঘুম ভেঙে গেল।
এর মধ্যেই সময় হয়ে গেল? আমি হাই তুলতে তুলতেই বলে উঠলাম। আমরা এখন ঠিক কোন জায়গায়?
কোথায় বলতে পারব না, তবে আমাদের যা পেট্রল ছিল সব শেষ।
হতেই পারে না, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসি, বারমডেল থেকে আমরা যখন বেড়োই ট্যাঙ্কটা তখনও অর্ধেক ভর্তি ছিল।
কিন্তু এখন আর নেই, অর্ধেক অনেকক্ষণ আগেই শেষ হয়ে গেছে। তুমি ডায়ালটা একবার দ্যাখা।
আমি ওর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালাম। ঘুমটার বারোটা অনেক আগেই বেজে গিয়েছিল।
আশ্চর্য তো! নিশ্চয়ই ট্যাঙ্ক ফুটো হয়েছে! এজায়গাটার নাম বলতে পারবে?
নাম-টাম জানি না স্যান বারনাডিনো থেকে মাইল কুড়ি দূরে এটুকু শুধু বলতে পারি।
গাড়ি থেকে নেমে টর্চ জ্বালিয়ে ইঞ্জিনের ঢাকনাটা খুললাম। যা ভেবেছি ঠিক তাই, ফুটো হয়েছে। কার্বরেটরের ফিড পাইপটা গর্ত করে দিয়েছে কেউ।
দেখে যাও। এখানে কেউ কারসাজি করে ফুটো করে দিয়ে গেছে।
হেলেন আমার পাশটিতে এসে দাঁড়াল। কিন্তু করল কখন? কিন্তু কেন?
হয়তো আমরা যখন বারমডেলে দাঁড়িয়েছিলাম, ঠিক তখন এই কাণ্ডটা করে গেছে। কেন করেছে তা ঠিক বলতে পারব না।
হেলেন অস্বক্তির সঙ্গে ঘাড় ঘুড়িয়ে অন্ধকার রাস্তাটার দিকে একবার তাকাল।
আমাদের থেকে একটু পেছনে একটা গাড়ি ছিল। এখানে দাঁড়ানোর আগে পর্যন্ত আমি ওটার হেডলাইট স্বচক্ষে দেখেছি।
পরস্পর-পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করার পর আমি বলে উঠলাম, আমরা বরং কোথাও লুকিয়ে পড়ি। মনে হচ্ছে আমাদের জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছে।
কথাটা শেষও করতে পারিনি। সহসা অন্ধকার ভেদ করে নিঃশব্দে একটা কালোগাড়ি তেড়ে এল আমার দিকে।
সাবধান! চিৎকার করে উঠে হেলেন আমায় সজোরে একধাক্কা দিয়ে হেডলাইটের সামনে থেকে সরিয়ে নিল। গাড়ির ফেন্ডারের সঙ্গে হাঁটু ঠুকে আমি একপাশে ছিটকে পড়লাম।
গাড়িটা পাশ দিয়ে যাবার সময় চালক আসনের কাছ থেকে একটা অগ্নি শিখা ছুটে এল আমাকে লক্ষ্য করে। শর্টগানের শব্দটা কানে তালা লাগিয়ে দেবার যোগাড়। গুলিটা আমাদের গাড়িতে লেগে ছিটকে রাস্তার ওপর গিয়ে পড়ল–আমার থেকে তফাত ছিল মাত্র কয়েক ইঞ্চি। হেলেনের কণ্ঠ দিয়ে তীক্ষ্ণ আর্ত চিৎকার বেড়িয়ে এল, তার চিৎকার শোনার মতো জ্ঞান তখন আমার অক্ষত ছিল। পরক্ষণেই কালোরঙের গাড়িটা ইঞ্জিনে গর্জন তুলে অন্ধকারের পথে ছুটে চলল।
হেলেনের দিকে দুচোখ মেলে তাকালাম। বুক ঠাণ্ডা হয়ে গেছে আমার। অবিন্যস্ত পায়ে আমার দিকে দু-পা এগিয়েই মাটিতে মুখ থুবড়ে আছড়ে পড়ল।
হেলেন!
গগনভেদী চিৎকারে ভুবন কাঁপিয়ে ওর দিকে ছুটে গেলাম। ভয় পেয়েছি জীবনে বহুবার, কিন্তু ভয়ের এরকম শিক্ষা জীবনে এই প্রথম।
আমি ঠিক আছি গো, ককিয়ে উঠল হেলেন। কাঁধের পেছনে লেগেছে। চোট তেমন কিছু নয় তবে রক্ত ঝরছে।
মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম, মাথাটা ঘুরে উঠল। ওকে স্পর্শ করতে বাসনা জাগলেও সাহস পাচ্ছিলাম না, পাছে ও ব্যথা অনুভব করে।
স্টিভ,আমার দিকে ঝুঁকে পড়ল ও। আমাদের গাড়িটার আর কোন অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। দেখো, ও আবার ফিরে না আসে।
চকিতে হারিয়ে যাওয়া সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ফিরে তাকে আসতে হবেই–এটাই তো স্বাভাবিক। যাবার সময় আমার ওপর গুলি চালাতে একটুর জন্য সে ব্যর্থ হয়েছে। তার ফিড পাইপে ফুটো করা আর আমাদের হত্যা করার মরিয়া প্রচেষ্টা দেখলেই বোঝা যায় আমাদের লস এঞ্জেলসে ফিরে যাবার সব রাস্তাতেই তারা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। সে বদ্ধপরিকর, আমাদের লস-এঞ্জেলসে ফিরতে দিচ্ছে না।
আমি তোমায় আড়ালে রেখে আসি, বলেই পাঁজাকোলা করে হেলেনকে তুলে ধরলাম। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে। যতটা সম্ভব সতর্কতার সঙ্গে নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে রাস্তার পাশে জঙ্গলের দিকে ওকে নিয়ে এগিয়ে চললাম। কিন্তু দশ পা এগোতে না এগোতেই আবার ধাকা–এবার অবশ্য গাছের সঙ্গে।
কিছু দেখতে পাচ্ছি না! দাঁড়িয়ে পড়ে ফিসফিস করে বলে উঠি।
আমাদের গাড়ির হেডলাইটের আলো রাস্তার ওপর পড়তেই জঙ্গলের ধার পর্যন্ত, আলোয় আলো করে রেখেছিল। আমি জঙ্গলে প্রবেশের বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে খুব সাবধানে রাস্তার ধার ঘেঁষে হাঁটতে লাগলাম।
মনে ক্ষীণ আশা ছিল গা ঢাকা দেবার মতো একটা জায়গা নিশ্চয়ই পেয়ে যাব, কিন্তু হেলেনের কাঁধ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝড়ে পড়া রক্ত আমার কোট রক্তে ভাসিয়ে দিচ্ছে দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলছিল সে অত্যন্ত শ্লথ গতিতে। সামান্য বেসামাল হয়ে পা একটু এদিক ওদিক হলেই তার শরীর কেঁপে কেঁপে ককিয়ে উঠছিল।
গাড়ি থেকে কুড়ি গজ মতো সামনে হাঁটার পর একটা রাস্তায় এসে পড়েছিল। রাস্তাটা জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেছে। সামনের ঘন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ঐ রাস্তা ধরে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই কানে এল গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। চকিতে ঘুরে দাঁড়ালাম। শব্দটা এসেছে খুব কাছ থেকেই, অথচ চোখে কিছুই পড়ছে না। গাড়িটা আলো নিভিয়ে রাস্তা ধরে পিছু হটছিল।
দ্রুতগতিতে পা চালালাম। আবার ভুল পদক্ষেপ নিয়ে বসলাম। ভেঙে পড়া একটা গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেলাম, আমার হাত থেকে ছিটকে গিয়ে সজোরে মাটিতে আছাড় খেলো রক্তাক্ত হেলেন। কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বালালাম। আমার আর হেলেনের মধ্যে ব্যবধান ছিল মাত্র কয়েক গজ। চকের মতো সাদা মুখ, চোখ দুটো বন্ধ সম্ভবতঃ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সে। ডান কাঁধ আর হাত রক্তে মাখামাখি।
ওকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে ক্রমাগত হিমতে নামতে লাগল।
আমি ওর দিকে এগোবার জন্য পাবাড়াব আর কি, ঠিক সেই সময়ে পেছন থেকে ছুটে আসা স্বয়ংক্রিয় পিস্তলের একটা গুলি আমার মুখের প্রায় পাশ ঘেঁষে সাঁইসাঁই শব্দ তুলে বেড়িয়ে গেল। টর্চ নিভিয়ে তাড়াতাড়ি করে মাটি আঁকড়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। সেই মুহূর্তে আরও বেশ কয়েকটা গুলির শব্দ জঙ্গলের নিস্তব্ধতা খানখান করে ভেঙে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল। আমার মাথার ঠিক ওপর দিয়ে বেড়িয়ে গেল একটা গুলি।
এতক্ষণে নিজের রিভলভার বের করে ফেলেছি। পেছনে পিস্তলের আলোর ঝলকানি লক্ষ্য করে একটা গুলি ছুঁড়েই মাটিতে শুয়ে থাকা গাছটার ওপর উঠে হেলেনের দিকে হাত বাড়ালাম। সবেমাত্র ওকে স্পর্শ করেছি এমন সময় জঙ্গলের কাছে গাড়ির আলোটা জ্বলে উঠে মুহূর্তের মধ্যে ধাধিয়ে দিল আমার চোখ।
ভাগ্য ভালো যে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়িটা আমাদের আলো থেকে আড়াল করে রেখেছিল। কিন্তু পিস্তলধারীরা ঘুরপথে পেছনদিক থেকে এসে আক্রমণ করলে আমাদের শেষ করার পক্ষে আপাততঃ দুটো গুলিই যথেষ্ট। অতএব প্রাণে বাঁচতে হলে আমার এক্ষুণি হেডলাইট-দুটোর বারোটা বাজাতে হবে।
অসতর্কতার সঙ্গে মাথা তুলে রিভলভারের নিশানা করলাম। আমার প্রথম গুলিটা ব্যর্থ হল। দ্বিতীয়বার গুলি ছুঁড়তেই গাড়ির কাছ থেকে একটা বুলেট ছুটে এসে আমার মুখ থেকে মাত্র ছইঞ্চি দূরত্বে আঘাত করল গাছের গুঁড়িটায়। ততক্ষণে আমার গুলিটা চুরমার করে দিয়েছিল হেডলাইটের একটাকে। চকিতে বসে পড়ে গাছের গুঁড়ির আড়ালে বুকে হেঁটে কিছু দূর গিয়ে আবার রিভালভার তাক করলাম।
লোকটা বোধহয় আমাকে দেখতে পেয়ে গিয়েছিল। আমার মাথার সিথে কেটে একরকম বেড়িয়ে গেল গুলিটা। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম, ততক্ষণে দ্বিতীয় হেডলাইটও নিভে গেছে।
আমার মাথায় ঝিমঝিমে ভাব আবার ফিরে এল। হামাগুড়ি দিয়ে আমি হেলেনের কাছটিতে ফিরে এলাম। অন্ধের মতো শুধুমাত্র অনুমানের ওপর নির্ভর করেই চলতে হচ্ছিল। পায়ের তলায় শুকনো খসখসে পাতাগুলো মড়মড় ধ্বনি তুলে আমার গতিপথ ঘোষণা করে চলেছে? আমার মনে আশা এটাই, কোন একটা আচ্ছাদন খুঁজে পেলে হেলেনের ক্ষতস্থানটা একবার পরীক্ষা করার সুযোগ পাওয়া যাবে। চলতে চলতে আর একটা কথা মনে পড়ে গেল। আমার রিভালভারে এখন বুলেটের সংখ্যা মাত্র চার, সঙ্গে অতিরিক্ত কোন গুলির ক্লিপ পর্যন্ত নেই।
কয়েক মিনিট হাঁটার পর কান খাড়া করলাম। পেছনে আবার কোথাও পাতা মাড়ানোর শব্দ শুনতে আমার ভুল হয়নি, কিন্তু আমি থামার সঙ্গে সঙ্গে অনুসরণকারীর পদধ্বনির শব্দ আপনা থেকেই থেমে গেল। পিস্তলধারী নির্ঘাৎ আমার অভিসন্ধি বুঝে গেছে।
আমার দুহাত জুড়ে হেলেনের অসাড় দেহ শায়িত, আর এতক্ষণ ধরে অতটা পথ বহন করার পর আমিও ক্লান্ত, তবু আমার থামাথামি সম্ভব নয়। আবার পথচলা শুরু, এবার সামনে গাছের ফাঁক দিয়ে আসা চন্দ্রমার আবছা আলোর দর্শন পেয়ে বুকে বল পেলাম। মনে হচ্ছে ফাঁকা জায়গার কাছাকাছি এসে হাজির হয়েছি আমি।
আর কিছুদূর চলার পর আলো আরো স্পষ্ট হল, রাস্তাও এখন অনেক পরিষ্কার। কিন্তু সেইসঙ্গে মনে একটা শঙ্কা জাগল–যদি কারো চোখে পড়ে যাই এ যাত্রায় আর রক্ষে নেই। তাই অনেক ভেবে-চিন্তে রাস্তার মাঝখান ঘেঁষে এগোতে লাগলাম।
সহসা পেছন থেকে একটা বন্দুক আবার গর্জে উঠল, সেই সঙ্গে একটা গুলি শব্দের আলোড়ন তুলে বেড়িয়ে গেল আমার মাথার ওপর দিয়ে। তাড়াতাড়ি করে একটা গাছের আড়ালে সরে এলে হেলেনকে নামিয়ে রাখলাম, তারপর এক ঝটকায়, নিজের রিভলভার বার করে বাগিয়ে ধরলাম ছায়াচ্ছন্ন রাস্তাটার দিকে। চোখেও পড়ল না, কানেও শুনলাম না কিছু তবু আমি জানি, সে ধারে পাশেই কোথাও বিরাজমান।
দু-এক মিনিট অপেক্ষা করেও তেমন কিছু নতুন করে সেখানে না দেখে রিভালভার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। হেলেনের জন্য বড় চিন্তা হচ্ছে। ওর ক্ষতস্থানের ব্যবস্থা একটা করতেই হবে। কাঁধে হাত রেখে মনে হয় রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে
যদিও নিশ্চিত করে এই মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।
ইতিমধ্যে ঘন কালো অন্ধকার আমার চোখে সয়ে গেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে একটা রাস্তাও আমার চোখ আবিষ্কার করে ফেলেছে। রাস্তায় পা না দিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতেই আজ ভাগ্যটা পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়ে যাব। মনে মনে স্থির করলাম।
হেলেনকে তুলে নিয়ে আবার পথ চলা শুরু। নিঃশব্দে এগান একেবারেই অসম্ভব। শুকনো, ডালপালাগুলো আমার পায়ের তলায় পিষে ঠিক পটকা ফোঁটার শব্দ ফাটতে লাগল।
চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো মর্মর শব্দের আর্তনাদ তুলে যোগ দিল তাদের সঙ্গে তবুও আমি একে-বেঁকে চলতে থাকলাম। সবসময়েই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি পেছন থেকে গুলি না ছুটে আসে।
শখানেক গজ এগোনোর পর হঠাৎ একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লাম। মাঝখানে দাঁড়ানো ছোট্ট একটা কাঠের কুটিরের ওপর পরিপূর্ণ ভাবে চাঁদের আলো এসে পড়ছিল। ধসে পড়া ছাদ আর ভাঙা জানলগুলো দেখেই বুঝতে অসুবিধে হলনা, ওটা পরিত্যক্ত, কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে যায় না। ঐ পর্যন্ত কোনরকমে পৌঁছতে পারলেই হেলেনের মাথা গোঁজার মতো একটা আশ্রয় অন্ততঃ মিলে যাবে।
ফাঁকা জায়গাটার এক প্রান্তে এসে অন্ধকার ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে কান পাতলাম। ডানদিকে কিছুক্ষণ দূর থেকে মাঝে-মধ্যে ডাল-পাতা মর্মরশব্দ ভেসে আসছিল। খানিকটা পিছনে পড়ে গেছে পিস্তলধারী, সম্ভবতঃ আমার প্রতীক্ষায় এখনও সে ঘুরছেকুটিরের দরজায় যদি তালা ঝোলে তাহলে আমি গেছি। তবু লোকটার পিস্তলের নিশানায় আসার আগেই তালা ভেঙে ঢুকতে পারবো ভেবে মনে সাহস সঞ্চয় করলাম।
হেলেনের শিথিল দেহটা বাঁকাঁধের ওপর ফেলে ভাল হাতে রিভলভার বাগিয়ে ধরে, ফাঁকা জায়গাটার মাঝ দিয়ে কুটিরের অভিমুখে দৌড় লাগালাম। কুড়ি গজের এই দূরত্বটাই যেন অন্তহীন রূপে ধরা দিচ্ছিল, কিন্তু দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলাম। চার দেয়ালের ঘুটঘুট অন্ধকারাচ্ছন্ন আশ্রয়ের পথে পা বাড়ালাম আমি।
হেলেনকে মেঝেতে নামিয়ে রেখে দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম, তারপর পকেট থেকে টর্চ বার করে টর্চের আলো ফেললাম চারপাশে।
ভেতরে ঘর একটাই, তবে আয়তনে বিরাট। আমি যে পথে ঢুকেছি সেইদিক বরাবর সরে একটি মাত্র জানলা।কুঠিরটার অবস্থা ভর দেখালেও দেয়াল কিন্তু যথেষ্ট মজবুত। জানালা দিয়ে এক পলক তাকিয়ে নিশ্চিত হবার পর হেলেনের ওপর ঝুঁকে পড়ে তাকে দেখার অবকাশ পেলাম।
ও এখনও অজ্ঞান তবে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আরও একবার জানালার কাছ থেকে ঘুরে এসে আমি ছুরি দিয়ে ওর পোষাকের রক্তে ভেজা আস্তিনটা কেটে ফেললাম।
অন্ততঃ পক্ষে আধডজন সীসের ছররা ওর কাঁধে বিধে আছে। হাড়গোড় না ভাঙলেও রক্ত ঝরেছে অনেক। আমার এখন কিছু করণীয় নেই দেখে এক ফাঁকে জানালার পাশে ফিরে গেলাম। আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল, একটা ছায়ামূর্তি গাছের পেছনে নিজের দেহের অর্ধেক অংশ আড়ালে রেখে কুটিরের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে।
চকিতে রিভলভার বার করে আমি আন্দাজে একটা গুলি ছুঁড়লাম। নিশানাটা নেহাৎ মন্দ হয়নি–লোকটা যে গাছের পেছনে গোপনে দাঁড়িয়েছিল তার কিছুটা ছাল ছিটকে যেতেও চেয়ে দেখলাম। সে গুলির প্রত্যুত্তর দেবার পর আমি আর একবার তাকে লক্ষ্য করে ঘোড়া টিপলাম।
এবার লোকটা এক ছুটে জঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। ঠিক কটা গুলি আমার রিভলভারে আছে তা নিজেই মনে করতে পারছিলাম না। থাকার কথা কিন্তু দুটো, কিন্তু তবু নিশ্চিত নই।
স্টিভ।
চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে হেলেনের কাছে এগিয়ে গেলাম।
কি হয়েছিল গো? আমি কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম?
হ্যাঁ, আমার হাত থেকে তুমি ছিটকে পড়েছিলে। আমি ওর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম।
এখন কেমন লাগছে?
মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছে, আর সব ঠিক আছে। কি হয়েছিল, আমার স্টিভ?
লোকটা আমাদের অনুসরণ করে এতোটা পথ এসেছিল। আমি কোনরকমে তোমাকে এর মধ্যে এনে তুলেছি। জায়গাটা ভালো নয়, তবে দিনের আলো না ওঠা পর্যন্ত ওকে যদি ওর জালে আটকাতে পারি তাহলে আর কোন ভয় নেই।
আবার জানালার কাছটিতে এসে দাঁড়ালাম, লোকটার টিকি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। আমি হলে কুটিরটা চক্কর মেরে পেছন দিক দিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়তাম।এদিকে জানালা আছে, কিন্তু পেছনটা সবই ঢাকা। আমি যা ভেবেছিলাম লোকটাও তাই করল।
রিভালভারটা খুলে দেখি, তাতে একটা গুলি এখনও আছে। সহসা হেলেন পাশ থেকে ফিসফিস কণ্ঠে বলে উঠল, ও বোধহয় পেছন দিক দিয়ে আসার চেষ্টা করছে। আমার কানে আওয়াজ আসছে।
আমি জানালা থেকে এক পাও নড়লাম না। ভেতরে প্রবেশ করতে হলে তাকে হয় জানলা নয়তো দরজা যে কোন একটা পথ বেছে নিতে হবে।
শুকনো পাতার মচমচ শব্দ অনেক পরিষ্কার ভাবে শোনা যাচ্ছিল। রিভালভারটা উঁচিয়ে ধরে আমি প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। একটা একটা করে মিনিট অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ কুটিরের দেয়ালে লাথি মারার আওয়াজ এল বেশ কয়েকবার। পরক্ষণেই বিশৃঙ্খল কিছু পদধ্বনি শুনে চকিতে ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। আমার বুকের ভেতরে হাতুড়ি পিটছে।
ছাদে উঠছেফিসফিস কণ্ঠে বলে উঠল হেলেন। আমি ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম, ও এখানে আসার সাহস পাবে না।
মনে মনে ভাবছিলাম : হে ভগবান! তাই যেন হয়, হেলেনের মনে আর নতুন করে ভয় ঢোকাতে চাই না।
ধপ করে মেঝেতে একটা কি পড়ল! কী ওটা?ভয়ে আমার হাত আঁকড়ে ধরল হেলেন। সঙ্গে সঙ্গে টর্চ জ্বেলে চারপাশটা একবার ঘুরিয়ে নিলাম। চোখে কিছু পড়ল না। ছাদে আলো ফেললাম। ওখানে কোন ফোকর পর্যন্ত ছিল না।
চিমনি দিয়ে নামছে, হেলেন চাপা কণ্ঠস্বরে বলে উঠল। স্টিভ, তোমার কী মনে হচ্ছে…?
ধীরে-সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের অপর প্রান্তে মরচে পড়া স্টোভটার কাছে গিয়ে টর্চ জ্বালোম। প্রথমটায় মাকড়সার জাল আর জমাটবাঁধা ধুলো ছাড়া আর কিছু নজরে আসছে না, কিন্তু পরে পরেই ধুলোর মধ্যে থেকে মাথা তুলে দাঁড়াল ফুট-য়েক লম্বা একটা গোখরোর দেহ। আলো পড়তেই ওটা চকিতে শরীর মুচড়ে পাকার করে রাখা কয়েকটা চটের থলির আড়ালে নিজেকে গোপন রাখলো।
চমকে পিছু হটে এলাম। সারা পিঠে আমার আতঙ্কে ঘামে ভিজে জবজব করছে।
কোথায় গেল ওটা? হেলেন ভীত কণ্ঠস্বরে কোন রকমে জানতে চাইল।
আমি ওর কাছে সরে এলাম। বস্তাগুলোর পাশে। আমার কাছে সর্বসাকুল্যে গুলি একটাই আছে।
তাহলে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। কিছু করতে যেও না। তাহলে ওটা হয়তো চলে যাবে।
একবার ভাবলাম, হেলেনকে তুলে নিয়ে ঘর থেকে এক ছুটে পালিয়ে যাই, পরক্ষণেই মনে হল, আমার এই কাজটার প্রতীক্ষায় কনি হয়তো অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে। তাই ও চিন্তা ছেড়ে আলোটা ঘোরাতে লাগলাম। রিভালভারটা সামনে তাক করা। আমার চোখ দুটো জানালা থেকে সরে থলে গুলোর মধ্যে ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আমি সাপটাকে লক্ষ্য করছি ভেবে কনি জানালা দিয়ে উঁকি দেবার ঝুঁকি দিলেও দিতে পারে, তাই দুদিক থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম। ঐ আসছে! হেলেন আর্তনাদ চেপে রাখার চেষ্টা করল।
লম্বা আঁশওয়ালা প্রকাণ্ড শরীরটা দেয়ালের গা ঘেঁষে গুটি গুটি পায়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল। আমি আলো ফেলতেই স্যাৎ করে সরে গেল আবার। গুলি করার সাহস হল না। হাত ভীষণভাবে কাঁপছিল। লক্ষ্য ব্যর্থ হলে আর রক্ষে নেই।
টর্চটা ধরতে পারবে?আমি দাঁতে দাঁত চেপেবলে উঠলাম। হেলেন টর্চটা আমার হাত থেকে নিয়ে নিল।
আমি কোট খুললাম। আলোটা সোজাসুজি ধরো। আমি কোট দিয়ে ওটাকে আক্রমণ করব!
না স্টিভ–ওর কাছে যেও না!
কিছু হবে না। ঘাবড়িও না, মন শক্ত করা।
রিভালভারটা পেছনের পকেটে গুঁজে আমি বুল ফাইটারের ভঙ্গিমায় পায়ে পায়ে এগোতে থাকলাম।
হেলেন এতো কাঁপছিল যে আলোটা হাতে স্থির থাকছিল না। সাপটা কুন্ডলি পাকিয়ে তার ইস্কাবনের মতো মাথাটা উচিয়ে ধরল।
আতঙ্কে আমি হিম হয়ে গেলাম।
আর এক পাও এগোনোর ক্ষমতা আমার নেই, হতচ্ছাড়াটা যেন আমার সারা শরীরে পক্ষাঘাত এনে দিয়েছিল। কোটটা দু-হাতে চেপে ধরে আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার হাঁটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগে যাচ্ছিল আর সাপটা ফণা উঁচিয়ে এগিয়ে আসছিল ক্ৰমশঃ। হাতের নাগালের মধ্যে সে যেতেই আমি ঝপাত করে কোটটা তার মাথায় ফেলে দিয়ে একলাফে পিছিয়ে এসে রিভলভারটা তাক করলাম।
সাপটা আবার কুণ্ডলি পাকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু হাত স্থির রাখা আমার পক্ষ কোন মতেই সম্ভব হচ্ছিল না। একটা অশ্রাব্য গালি বর্ষণ করে রিভালভারটা ফেলে আবার কোটটা তুলে ধরলাম।
আর ঠিক এই মুহূর্তে একটা ছায়ামূর্তি জানালার পাশে সরে এসে গুলি চালাল। মুহূর্তের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়লেও, পরক্ষণেই মাটিতে সটান হয়ে শুয়ে পড়ে রিভালভারটা তুলে নিয়ে জানালার দিকে ঘুরলাম।
থেমে যাও হে! গমগমিয়ে উঠল একটি কণ্ঠস্বর।
গুলি করো না স্টিভ, হেলেন চিৎকার করে উঠল।
ওরা অন্য কেউ নয়, চেয়ে দেখ পুলিস। সঙ্গে সঙ্গে রিভালভারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমি আস্তে আস্তে সোজা হয়ে বসে পড়লাম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বন্দুক হাতে এক পুলিস।
হাত ওপরে ওঠাও।
আমি হাত তুলেই সাপটার দিকে তাকালাম। কুণ্ডলি পাকিয়ে পড়ে আছে সেটা, তবে মাথাটা উড়ে গেছে। বাঃ, দারুণ হয়েছে তো,এরকম অভাবনীয় দৃশ্য ভাবাই যায় না, আমি বলে উঠলাম। বাইরে গাড়ি স্টার্ট করার শব্দ পেয়েও আমরা পরোয়া করলাম না। সত্যিই কি গুলি না চালিয়েছেন, দাদা।