১০. স্বচ্ছ নীলাভ পরদাটি

রুখ স্বচ্ছ নীলাভ পরদাটি স্পর্শ করতেই মনে হল কিছু একটা যেন হঠাৎ করে প্রবল আকর্ষণ করে তাকে টেনে নিল। রুখের মনে হল কেউ তাকে একটি নিঃসীম অতল গহ্বরে ছুঁড়ে দিয়েছে। সে দুই হাত–পা ছড়িয়ে আর্তচিৎকার করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে কিন্তু সে কিছুই আঁকড়ে ধরতে পারে না। অতল শূন্যতার মাঝে সে পড়ে যেতে থাকে। তার মনে হতে থাকে যে কোনো মুহূর্তে সে বুঝি কোথায় আছড়ে পড়বে, কিন্তু সে আছড়ে পড়ে না—গভীর শূন্যতায় নিমজ্জিত হতে থাকে।

রুখ চোখ খুলে তাকায়। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার, মনে হয় আলোর শেষ বিন্দুটিও কেউ যেন শুষে নিয়েছে। সে প্রাণপণে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু কোথাও কিছু নেই, কোনো আলো নেই, রূপ নেই। কোনো আকার নেই অবয়ব নেই, কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি কি আসলে অন্ধকার? নাকি এটি আলোহীন অন্ধকারহীন এক অস্তিত্ব? রুখের হঠাৎ মনে হয় তার নিশ্চয়ই মৃত্যু হয়েছে। হয়তো এটিই মৃত্যু। যখন কোনো আদি নেই অন্ত নেই শুরু নেই শেষ নেই আলো নেই অন্ধকার নেই শুধু এক অবিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব সেটাই হয়তো মৃত্যু।

রুখ সেই আদিহীন অন্তহীন অস্তিত্বে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়। তার বুকের মাঝে এক শূন্যতা খেলা করতে থাকে। গভীর বেদনায় কী যেন হাহাকার করে ওঠে। সে নিজেকে ফিসফিস করে বলে, বিদায়।

কিন্তু সেই কথা সে শুনতে পারে না। রুখ আবার চিৎকার করে ওঠে, বিদায়।

এক অমানবিক নৈঃশব্দ্য তাকে ঘিরে থাকে। রুখ নিজেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে কিন্তু সে তার দেহকে খুঁজে পায় না। সে কোথায়? তার চারপাশে রূপ–বর্ণ–গন্ধহীন এক অতিপ্রাকৃত জগৎ। তার চেতনা ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে। শুধু তার চেতনা। এটাই কি মৃত্যু?

না এটা মৃত্যু নয়।

কে? কে কথা বলে?

আমি।

আমি কে?

আমি। আমি হচ্ছি আমি।

আমি কোথায়?

তুমি এখানে।

এখানে কোথায়?

এখানে আমার কাছে।

কেন?

আমি দেখতে চাই। বুঝতে চাই।

কী দেখতে চাও?

তোমাকে।

কিন্তু এত অন্ধকার। তুমি কেমন করে দেখবে?

কে বলেছে অন্ধকার?

রুখ অবাক হয়ে তাকাল, সত্যিই কি অন্ধকার? চারদিকে কি হালকা নরম একটা আলো নেই? সমস্ত চেতনা উনখ করে সে তাকাল, দেখল কোমল একটা আলো ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু শুধুমাত্র সেই হালকা নরম আলো, আর কিছু নেই। শুরু নেই, শেষ নেই, আদি নেই, অন্ত নেই, এক কোমল নরম আলোর বিস্তৃতি। রুখের হঠাৎ মনে হয় আসলে সব মায়া, সব কল্পনা, সব এক অতিপ্রাকৃত স্বপ্ন।

না। এটি স্বপ্ন নয়।

রুখ চমকে উঠল, কে? কে কথা বলে?

আমি।

তুমি কি সত্যি?

তুমি যদি ভাব আমি সত্যি তবে আমি সত্যি।

আমি কি সত্যি?

হ্যাঁ, তুমি সত্যি।

তা হলে আমি নিজেকে দেখতে পাই না কেন? আমার দেহ কই? হাত–পা–চোখ–মুখ কই?

আছে।

কোথায় আছে?

আমার কাছে।

কেন?

কৌতূহল। আমি দেখতে চাই বুঝতে চাই। নতুন রূপ দেখলে আমার কৌতূহল হয়।

তুমি কি একা?

আমি একা। আবার আমি অনেক। একা এবং অনেক।

তুমি দেখতে কেমন?

আমার কাছে দেখার কোনো অর্থ নেই

তোমার অবয়ব কেমন? আকৃতি কেমন?

এই কথার কোনো অর্থ নেই। আমি রূপহীন আকৃতিহীন।

আমাকে নিয়ে তুমি কী করবে?

দেখব।

কেমন করে দেখবে?

তোমাকে খুলে খুলে দেখব। একটি একটি পরমাণু খুলে খুলে দেখব।

দেখে কী করবে?

বুঝব।

কেন?

কৌতূহল। বুদ্ধিমত্তার আরেক নাম হচ্ছে কৌতূহল।

রুখের চেতনা ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে আসে। সে কি আছে না নেই সেটিও অস্পষ্ট হয়ে আসে। তার মনে হতে থাকে যুগ যুগ থেকে সে আদিহীন অন্তহীন এক অসীম শূন্যতায় ভেসে আছে। সময় যেন স্থির হয়ে আছে তাকে ঘিরে।

এভাবে কতকাল কেটে গেছে কে জানে? রুখের মনে হতে থাকে সে বুঝি তার পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। এক অসীম শূন্যতা থেকে তার বুঝি আর মুক্তি নেই। তখন হঠাৎ কে যেন বলল, চল।

রুপের মনে হল এখন আর কিছুতেই কিছু আসে যায় না।

কে যেন আবার বলল, চল।

কোথায়?

ফিরে যাই।

ফিরে যাবে?

হ্যাঁ।

কে ফিরে যাবে? কোথায় ফিরে যাবে?

তুমি। তুমি আর আমি।

আমি? আমি আর তুমি?

হ্যাঁ।

তুমিও আমার সাথে যাবে?

হ্যাঁ।

কেমন করে যাবে?

তোমার চেতনার সাথে।

ও।

রুখের হঠাৎ মনে হতে থাকে সে বুঝি ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। মনে হতে থাকে তার দেহ সে ফিরে পেয়েছে। হাত দিয়ে সে নিজেকে স্পর্শ করে, হাত–পা–মুখ নতুন করে আবিষ্কার করে। চিৎকার করে সে ধ্বনি শুনতে পায়। চোখ খুলে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের মাঝে সূক্ষ্ম আলোর রেখা দেখতে পায়। হঠাৎ করে সেই আলো হঠাৎ তীব্র ঝলকানি হয়ে তাকে প্রায় দৃষ্টিহীন করে দেয়। রুখ চিৎকার করে ওঠে– প্রচণ্ড এক অমানবিক শক্তি যেন তাকে ছিন্নভিন্ন কর দিয়ে দূরে ছিটকে দেয়। রুখ কোথায় যেন আছড়ে পড়ল, প্রচণ্ড আঘাতে তার দেহ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে। কাতর চিৎকার করে সে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করে, শক্ত পাথরকে সে খামচে ধরে। মুখের মাঝে সে রক্তের লোনা স্বাদ অনুভব করে।

সমুদ্রের গর্জনের মতো চাপা কলরব শুনতে পায়–চোখ খুলে সে দেখে তার পরিচিত জগৎ। সে ফিরে এসেছে। মেতসিসে ফিরে এসেছে।

রুখ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে, নিজের ভিতরে হঠাৎ সে একটা ভয়ের কাপুনি অনুভব করে।

সে একা ফিরে আসে নি। তার সাথে আরো কেউ আছে।