সিন্ধুয়োল
পরের দিন সকালে জেগে উঠতেই দেখি শরীরটা বেশ হালকা আর ঝরঝরে লাগছে। প্ল্যাটফর্মের উপরে গিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখলুম। স্বচ্ছ সুন্দর আবহাওয়া, দিগন্তে কোনো জাহাজের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ফেনিল নীল জলের উপর সূর্যের আলো পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে। শান্ত সমুদ্রের মধ্যে কোন অনন্ত ছন্দে ঢেউ উঠছে আর পড়ছে, খানিকক্ষণ পরেই যে-ছন্দ রক্তের মধ্যে নেশা ধরিয়ে দেয়।
সমুদ্রের এই নেশা ধরানো ছন্দ যেন আমার বুকের মধ্যেই ঢেউ তুলে দিলে। সমুদ্রের এই অনন্ত কলরোল শুনছি কান পেতে, এমন সময় ক্যাপ্টেন নেমে এসে দেখা দিলেন। আমার উপস্থিতি তাঁর চোখেই পড়লো না। সমুদ্র পর্যবেক্ষণ করে কী-এক দুর্বোধ ভাষায় তিনি কতগুলো নির্দেশ দিলেন।
ডেকের চারধারে আগের রাতে জাল পেতে রাখা ছিলো-সকালে তাতে অনেক মাছ ধরা পড়েছে। বিশজন নাবিক উঠে এসে সেগুলি তুলে নিতে লাগলো। এই নাবিকদের মধ্যে পৃথিবীর সব জাতের লোকই বোধ করি আছে। আইরিশ, ফরাশি, স্লভ, গ্রীক-ইয়োরোপের প্রায় সব দেশের লোকই দেখতে পেলুম আমি। কিন্তু তারা সবাই কথা বলে সেই দুর্বোধ বিদঘুটে ভাষায়, যার একবর্ণও আমি বুঝি না; আর তার ফলে এদের জাগিত পরিচয়ও বুঝে-ওঠা মুশকিল। নাবিকরা কেউ আমাকে যেন লক্ষই করলে না, সবাই নিজেদের কাজেই ব্যস্ত হয়ে রইলো।
নটিলাস একটানা দক্ষিণ-পুব দিকে ছুটে চলেছে। পয়লা ডিসেম্বর আমরা বিষুবরেখা পেরিয়ে এলুম। মাঝে-মাঝে কেবল প্রশান্ত মহাসাগরের অরণ্যময় অজ্ঞাত দ্বীপ ছাড়া আর কোনো চেনাঅচেনার ভূখণ্ডই কখনো চোখে পড়ে না। সমুদ্র এখন মরা পাহাড়ে বিপজ্জনক। জলের তলায় কত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ যে দেখা গেলো, তার সংখ্যা নেই। কামানে-বন্দুকে শ্যাওলা গজিয়েছে; জাহাজের, কামরায় কাকড়ার রাজত্ব, পাটাতনের খোলে হাঙর ঘুরে বেড়ায়। দক্ষিণ সমুদ্রের রক্তলাল প্রবাল দ্বীপ পেরিয়ে আসার সময় দেখতে পেলুম অনেক বছর আগে ড়ুবেযাওয়া বহু জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। কাঠের খোল আর পাটাতন পচে গিয়েছে, জীর্ণ ও নরম হয়ে আছে তারা। মাঝে মাঝে ওই সব জাহাজের উদ্দেশ্যে নটিলাস-এর বাহিনী বেরোয়; জীর্ণ জাহাজের মধ্য থেকে যাবতীয় মূল্যবান সম্পত্তি উদ্ধার করে নিয়ে এসে জাহাজে তোলে।
শেষকালে প্রবাল সমুদ্রও পেরিয়ে গেলো নটিলাস। আমার এখন আর। ক্যাপ্টেন নেমোর সঙ্গে বেশি দেখা হয় না। মাঝে-মাঝে আসেন তিনি, অল্পক্ষণ কথাবার্তা হয়, তারপরেই আবার তিনি নটিলাস-এর পরিচালনায় ব্যস্ত হয়ে চলে যান। একদিন ক্যাপ্টেন নেমোর কাছ থেকে শোনা গেলো, অষ্ট্রেলিয়া আর নিউগিনির মধ্যকার টোরেজ প্রণালী দিয়ে আবার আমরা ভারত মহাসাগরে গিয়ে পড়বে। এখানে চোরা পাহাড়ের সংখ্যা এত বেশি যে যে-কোনো মুহূর্তে বিষমকোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। নিজের হাতে নটিলাস চালাবার ভার নিলেন ক্যাপ্টেন নেমো। নটিলাস জলের উপর ভেসে উঠলো। যেন তিনি ইন্দ্রজাল জানেন, এমনিভাবে ভোজবাজির মতো চোরা পাহাড়ের বিপদসংকুল রন্ধ্রপথ দিয়ে অত বড়ো ড়ুবোজাহাজটিকে সন্তর্পণে পার করে নিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। একটা দ্বীপের কাছ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ কিসের সঙ্গে যেন প্রচণ্ড ধাক্কা লাগলো, আমি ছিটকে পড়ে গেলুম ডেকের একপাশে।
আসলে চোরা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়েছিলো নটিলাস; পাহাড়ের খাজে আটকে গিয়েছে ওই ধাক্কায়। এমনিতে কোনো বিপদ হয়নি, তবে পুরো ভরা জোয়ারের সময় ছাড়া এই খাজ থেকে উদ্ধার পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। পাঁচদিন পরে পূর্ণিমা; তখন জোয়ারের জলে নটিলাস ভেসে উঠবে। ততদিন এখানে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
ক্যাপ্টেন নেমোর সঙ্গে দেখা হলে জিগেস করেছিলুম, কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে বুঝি?
না, দুর্ঘটনা নয়, ঘটনা—
এমন ঘটনা যে আপনাকে তার ফলে ডাঙায় আশ্রয় নিতে হবে?
অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন নেমো। তারপর আস্তে বললেন, নটিলাসকে আপনি এখনো চেনেননি, প্রফেসর।
তক্ষুনি আমি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেললুম! নেড আর কোনসাইলের বড় ইচ্ছে এই কটা দিন জাহাজে না-থেকে সামনের দ্বীপটায় ঘুরে আসে। কত দিন ডাঙায় পা দেয়নি ওরা। আপনার কোনো আপত্তি আছে কি?
আসলে প্রবল আপত্তিরই প্রত্যাশা করছিলুম আমি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ক্যাপ্টেন নেমে বললেন, নিশ্চয়ই না। ইচ্ছে করলে আপনিও যেতে পারেন, মঁসিয় আরোনা।
পরের দিন নটিলাস-এর কুলুঙ্গি থেকে নৌকো নামানো হলো। আটটার সময় বন্দুকে কুড়লে সজ্জিত হয়ে রওনা হলুম আমরা। নেড হাল ধরে বসলো, আমি আর কোনসাইল প্রাণপণে দাঁড় টানলুম। নেড ল্যাণ্ডের ফুর্তির আর শেষ নেই। এতদিনে ওই জেলখানা থেকে সে মুক্তি পেয়েছে, আর কোনদিন সেখানে ফিরে যাবার মতলব তার নেই।
জিলবোয়া দ্বীপের বালিতে নটিলাস-এর নৌকো গিয়ে যখন ঠেকলো, তখন সাড়ে-আটটা বাজে।