সহায়ক সূত্র
অধিকাংশ শ্রৌতসূত্র প্রণীত হওয়ার পরে পরিশিষ্ট হিসাবে কয়েকটি সহায়ক গ্ৰন্থ রচিত হয়েছিল। এগুলির মধ্যে কয়েকটি অনুষ্ঠান সংক্রান্ত ও এবং কয়েকটি যজ্ঞতত্ত্ববিষয়ক। পাঁচটি প্ৰপাঠকে বিন্যস্ত ‘ঋকতন্ত্র’ প্রকৃতপক্ষে একটি প্রাতিশাখ্য জাতীয় রচনা, যাতে মন্ত্রসমূহের পদে প্রয়োগকালীন পরিবর্তন সম্পর্কিত নির্দেশ বিবৃত হয়েছে। বৌয়ায়ন, ভারদ্বাজ ও গৌতম পৃথকভাবে কয়েকটি পিতৃমেধ সূত্র রচনা করেছিলেন; এদের মধ্যে মৃত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে পালনীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াসমূহ বিবৃত হয়েছে। এই বিষয়বস্তু যেহেতু শৌতি ও গৃহসূত্রের পক্ষে সমভাবে প্রয়োজ্য, এই উভয়বিধ সূত্র সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত রচনার সন্ধান এগুলিতে পাওয়া যায়। শাখায়ত ও মানব-শাখার পিতৃমেধ-সূত্রগুলি তৎসংশ্লিষ্ট শ্রৌত সূত্রগুলির অন্তর্গত, আবার কৌষীতক, আশ্বালায়ন, বৈখানস ও অগ্নিবেশ্য রচিত গ্রন্থগুলি এইসব শাখা সংশ্লিষ্ট গৃহ্য সূত্রগুলির অন্তর্ভুক্ত। আপস্তম্ব এবং এমনকি, বৈখানস ও আশ্বালায়ন নিজেদের পিতৃমেধ-সূত্রগুলিতে শৌতি ও গৃহ্য সূত্রের মধ্যে সমানভাবে স্থাপন করেছেন।
একটি নির্দিষ্টশ্রেণীর রচনা ‘পরিশিষ্ট’ রূপে অভিহিত; যে সমস্ত বিষয়বস্তু প্রচলিত শ্রৌতসূত্রগুলিতে অপর্যাপ্তভাবে আলোচিত হয়েছে কিংবা একটুও উল্লিখিত হয়নি সেসবই এখানে বিবৃত হয়েছে। আশ্বলায়ন, কাত্যায়ন ও বারাহ-শাখার পরিশিষ্টসমূহ এই প্রবনতার ফলেই রচিত। অন্যদিকে মানবশাখার রচনায় পুরোহিতদের দক্ষিণার কথাটি আলোচিত হয়েছে। বৌধায়ন ও আপস্তম্ব রচিত ‘হৌত্ৰসূত্র’ গ্রন্থে হােতা শ্রেণীর পুরোহিতদের দায়িত্ব বর্ণিত হয়েছে।
সামগানের বিধিসংক্রান্ত গৌণ সূত্রগুলি প্রচুর সংখ্যায় পাওয়া যায়। এদের মধ্যে প্রধান হলো ‘পুষ্প সূত্র’ বা ‘ফুল্ল সূত্র’। দশটি প্ৰপাঠকে বিন্যস্ত গ্রন্থটিতে গ্রাম ও অরণ্যগেয় গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সামমন্ত্রগুলিকে অন্য মন্ত্রসমূহের উপযোগী করে পুনর্বিন্যাসের নিয়মাবলী এবং অন্যান্য অনুরূপ প্রয়োগিক বিধি বিবৃত হয়েছে। এই নিয়মগুলি বিধিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত। পুস্পসূত্র এতে সম্পূর্ণ, যথাযথ ও সুশৃঙ্খল যে এতে উত্তরগানের অস্তিত্ব আভাসিত হয়েছে। এই রচনার পরিশিষ্ট সামমন্ত্ররূপে পরিচিত। এর তেরোটি প্ৰপাঠককে পুস্পসূত্রে অনুল্লিখিত দুটি বিষয়, অর্থাৎ উহগান ও উহ্যাগান আলোচিত হয়েছে।
দুটি প্ৰপাঠকে বিন্যস্ত ‘পঞ্চবিধ সূত্রে’ বর্ণিত হয়েছে কিভাবে সামমন্ত্র পাঁচটি অপরিহার্য উপাদানে বিভক্ত হয়—প্ৰস্তাব, উদগীথ, উপদ্রব, প্রতিহার ও নিধন। প্রতিহার-সূত্রও প্রস্তাবসূত্র প্রস্তোতা ও উদগাতার দ্বারা সোমমন্ত্রের নির্দিষ্ট অংশ গানের পদ্ধতি বিবৃত করেছে। তিনটি পটলে বিন্যস্ত ‘গায়ত্র বিধান” সূত্র গায়ত্র গানের বিধি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের মন্ত্রকে পুনর্বিন্যস্ত করার নির্দেশ দিয়েছে। তিনটি খণ্ড ও তেতাল্লিশটি শ্লোকে বিন্যস্ত “স্তোভানুসিংহার’ গ্রন্থে সামুমন্ত্রের সঙ্গে স্তোত্রকে যুক্ত করার নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। তিনটি খণ্ডিকার বিভক্ত মাত্রলক্ষণ সূত্র’ নামক সংক্ষিপ্ত রচনায় মন্ত্রের অক্ষরসমূহের দৈর্ঘ্য আলোচিত হয়েছে; সহায়ক শ্রৌতসূত্র অপেক্ষা একে প্রাতিশাখ্য রূপে গ্ৰহণ করাই সমীচীন।
শৌতসূত্রগুলি বৈদিক যজ্ঞচৰ্যার চূড়ান্ত পর্বের রচনা; এই পর্যায় প্রকৃতপক্ষে যজুর্বেদ ও ব্রাহ্মণের সঙ্গে শুরু হয়েছিল-প্রসারণশীল যজ্ঞতত্ত্ব তখন জীবন্ত শক্তিরূপে বিদ্যমান ছিল। ভৌগোলিক সীমার প্রসারণ, ক্রমবর্ধমান সংমিশ্রণ, নির্দিষ্ট কিছু পরিবার ও বিভিন্ন অঞ্চলে আনুষ্ঠানিক প্রয়োগবিধির বৈচিত্র্যের ফলে এইসব ক্ৰমাগত, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্যভাবে, পরিবর্তিত হল। যজ্ঞানুষ্ঠানগুলিকে সাংকেতিক ভাষায় লিপিবদ্ধ করা এবং এদের ব্যাখ্যাগম্য ও যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলা ছাড়াও ব্রাহ্মণসাহিত্যের অর্থবাদ অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত করার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। সূত্রসাহিত্যের প্রতি শাখা (যজতত্ত্ব, জ্যামিতি, জ্যোতিষ বা নিরুক্তনির্বিশেষে)-গৃহ্য ও ধর্মসূত্রের সম্ভাব্য ব্যতিক্রম ছাড়া-ব্ৰাহ্মণ সাহিত্য থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এই পর্যায়ের অন্য সীমায় যজ্ঞানুষ্ঠান যখন দ্রুত শক্তি হারিয়ে নিঃশেষিতপ্ৰায় হয়ে উঠেছিল, ক্ষীয়মান ধর্মচর্যাকে সংরক্ষিত করার নূতন ধরনের প্রয়োজন অনুভূত হল-গড়ে উঠল। সূত্রসাহিত্য। কোনো কোনো সূত্রের প্রাথমিক রূপ সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে নির্মিত হয়েছিল; কিন্তু সেই স্তরে তা ব্ৰাহ্মণ-সাহিত্যের অভিন্ন অংশ হিসাবে গণ্য হত। সূত্র ও ব্রাহ্মণের ভাষাগত নিবিড় সাদৃশ্যের কারণকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। আমাদের মনে হয়, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে সর্বাধিক সূত্রসাহিত্য রচিত হয়েছিল।
শৌতসূত্রগুলিতে আমরা এমন একটি সমাজের ছবি দেখতে পাই যেখানে যজ্ঞানুষ্ঠানের সমস্ত রকম জটিলতাসহ সম্পূর্ণ বিকশিত হয়েছিল এবং বেশ কিছু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন শাখার অস্তিত্ব জাগারুক ছিল।