শ্যালক্স গ্রুনের সময়-পরিভ্রমণ যানটির একপাশে নিচু হয়ে নেমে গেছে শেষ মাথায় একটি গোল দরজা। আমি এই দরজা দিয়ে ঢুকেছি, ত্রিশাও এই দরজা দিয়ে ঢুকবে। আমি দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছি, এখনো পুরো ব্যাপারটি আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
ক্যাচক্যাচ শব্দ করে হঠাৎ গোল দরজাটা খুলে গেল। ত্রিশাকে কি ধরে এনেছে এখন? সে কি চিৎকার করে কাঁদছে? আমার বুকের ভিতর যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে উঠতে থাকে। আমি কেমন করে ত্রিশার মুখের দিকে তাকাব?
গোল দরজায় একজন মানুষের ছায়া পড়ল, আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম। ত্রিশা পায়ে পায়ে ভিতরে এসে দাঁড়াল। একটি লাল রুমাল দিয়ে মাথার চুলগুলো শক্ত করে বাধা, হালকা নীল রঙের একটা পোশাক। পায়ে বিবর্ণ একজোড়া জুতো।
দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ত্রিশা মাথা ঘুরে তাকায়। তার মুখে এক ধরনের অসহনীয় আতঙ্ক। সে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থেকে কাঁপা গলায় বলল, রিকি, তুমি কোথায়?
এই যে আমি এখানে।
ত্রিশা মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, কিন্তু আমার কাছে ছুটে এল না। সেখানে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে ওরা এখানে এনেছে কেন?
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ত্রিশা আবার জিজ্ঞেস করল, রিকি, তুমি কথা বলছ না কেন? এটি কোন জায়গা, এখানে এ রকম আবছা অন্ধকার কেন?
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, ত্রিশা, তুমি আমাকে ক্ষমা কর, ত্রিশা।
তুমি এ কথা কেন বলছ?
তোমার ওপরে খুব বড় একটা অবিচার করা হবে ত্রিশা।
ত্রিশার গলার স্বর হঠাৎ কেঁপে যায়, কী অবিচার?
আমি ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকি, ত্রিশার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না।
ত্রিশা হঠাৎ আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, তুমি কথা বলছ না কেন? কী হয়েছে রিকি?
আমি তবু কোনো কথা বলতে পারি না
ত্রিশা দুই পা এগিয়ে এসে হঠাৎ শ্যালক্স গ্রুনকে দেখতে পেল। সাথে সাথে সে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, কে ওটা?
শ্যালক্স গ্রুন প্রায় হাসি–হাসি মুখে বলল, আমার নাম শ্যালক্স গ্রুন, তুমি সম্ভবত আমার নাম শুনে থাকবে।
ত্রিশা একটা চিৎকার করে ভয়ঙ্কর আতঙ্কে পিছনে ছুটে যেতে থাকে। সে দরজার কাছে। পৌঁছানোর আগেই ক্যাচক্যাচ করে গোল দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সে দুই হাতে দরজায় আঘাত করতে করতে হঠাৎ আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল।
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেললাম। হায় ঈশ্বর, তুমি কেন পৃথিবীতে এত অবিচার জন্ম দাও? কেন?
আমি আবার মাথা তুলে তাকালাম, শ্যালক্স গ্রুন শান্তমুখে তাকিয়ে আছে, মুখে এক ধরনের কোমল স্মিত হাসি। শুধুমাত্র সে-ই মনে হয় এ রকম হৃদয়হীন একটি পরিবেশেও এক ধরনের শান্তি খুঁজে পেতে পারে। শ্যালক্স গ্রুন হয়ে জন্ম নিতে হলে একজন মানুষকে কতটুকু নিষ্ঠুর হতে হয়?
আমি উঠে দাঁড়ালাম, তারপর পায়ে পায়ে হেঁটে ত্রিশার দিকে এগিয়ে গেলাম। ত্রিশা বিকারগ্রস্তের মতো কাঁদছে, আমি পিছন থেকে তাকে ধরে সোজা করে দাঁড় করালাম, সে। ঘুরে দুই হাতে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেলল। আমার বুকে মাথা গুঁজে সে হঠাৎ আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, রিকি তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না রিকি। আমাকে তুমি ছেড়ে যেয়ো না।
আমি দুই হাতে তার মুখ স্পর্শ করে নিজের দিকে টেনে আনি, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে আমি তার দিকে তাকালাম।
কান্নাভেজা চোখে সে আকুল হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম এই মেয়েটি ত্রিশা নয়। এই মেয়েটি অবিকল ত্রিশার মতো দেখতে একটি রবোট। শ্যালক্স গ্রুনের নিষ্ঠুর পরীক্ষাটি কী হবে য়োমি সেটি বুঝতে পেরেছিল, ঠিক ত্রিশার মতো দেখতে একটি রবোট তৈরি করে রেখেছিল আগে থেকে। আমাকে জানায় নি ইচ্ছে করেই। হঠাৎ করে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে।
ত্রিশার মতো দেখতে রবোটটি আমার বুকের কাপড় ধরে আবার আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে। তার দুঃখে ভেজা ব্যথাতুর আতঙ্কিত মুখটি দেখে কেন জানি না হঠাৎ আমার চোখে পানি এসে যায়। এই মেয়েটি হয়তো সত্যিকারের মানুষ নয়, কিন্তু তার কষ্টটি সত্যি, তার দুঃখ হতাশা আর আতঙ্কটুকু সত্যি। আমার জন্যে তার ভালবাসাটুকুও সত্যি। মানুষ হয়ে জন্ম হয় নি বলে তার দুঃখ কষ্ট হতাশা আর ভালবাসাকে পায়ে দলে একজন দানবের হাতে তুলে দেয়া হবে।
আমি রবোট মেয়েটির মুখটি ধরে নিজের কাছে টেনে এনে তাকে গভীর ভালবাসায় চুম্বন করলাম। তাকে ফিসফিস করে বললাম, ত্রিশা, সোনামণি আমার, আমি আছি, আমি তোমার কাছে আছি। আমি সবসময় তোমার কাছে আছি–সবসময়–
আমার বড় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল যে আমি সত্যিই বুঝি থাকব ত্রিশার কাছে। হোক না সে রবোট তবুও তো সে ত্রিশা! আমার ভালবাসার ত্রিশা। কিন্তু আমি ত্রিশার কাছে থাকতে পারলাম না। শ্যালক্স গ্রুন পায়ে পায়ে আমাদের কাছে হেঁটে এল, ত্রিশাকে শক্ত করে ধরে রেখে সে গোল দরজাটি খুলে দিল। আমাকে বলল, যাও, শীতলঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। এক শ বছর পর এসো, আমি তোমাকে তোমার ত্রিশাকে ফিরিয়ে দেব।
ত্রিশা চিৎকার করে কাঁদছে। আমি তার দিকে পিছন ফিরে এগিয়ে গেলাম। আমার শরীর কাঁপছে, আমার চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসছে, ইচ্ছে করছে পিছনে ছুটে গিয়ে ত্রিশাকে আঁকড়ে ধরে বলি, এস ত্রিশা তুমি আমার সাথে এস।
কিন্তু আমি সোজা সামনে হেঁটে গেলাম, ফিসফিস করে নিজেকে বললাম, না, ওই মেয়েটি ত্রিশা নয়। ওই মেয়েটি একটি রবোট। রবোট। তুচ্ছ রবোট। আমি শুনতে পেলাম কাঁচক্যাচ শব্দ করে পিছনের দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল।
আমি সামনে তাকালাম, আবছা অন্ধকারে চার জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, দূর থেকে ভালো বোঝা যায় না, কিন্তু আমি জানি তারা কে। ইগা হিশান, য়োমি আর নুবা। আমাকে দেখে তারা আমার কাছে ছুটে এল। য়োমি আমার হাত ধরে বলল, কী হয়েছে রিকি? তোমার চোখে পানি কেন?
আমি চোখ মুছে বললাম, জানি না কেন। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার ত্রিশার জন্যে। সে মানুষ নয় তবু আমার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।
য়োমি আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখল
আমরা পাঁচ জন একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে শ্যালক্স গ্রুনের কদাকার সময়–পরিভ্রমণ যানটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কুরু ইঞ্জিন দুটি এখনো চালু করা হয় নি, আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে আছি। যেই মুহূর্তে কুরু ইঞ্জিন দুটি চালু করা হবে সাথে সাথে সুপ্ত গোপন প্রোগ্রামটি জীবন্ত হয়ে উঠে খুব ধীরে ধীরে সময়–পরিভ্রমণ যানটির নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করবে।
প্রথমে একটা চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলাম, তারপর কুরু ইঞ্জিন দুটিতে মৃদু কম্পন শুরু হল। আমি বুকের মাঝে আটকে রাখা একটা নিশ্বাস খুব সাবধানে বের করে দিই, শ্যালক্স গ্রুন ইঞ্জিন দুটিকে চালু করেছে। প্রতি মুহূর্তে এখন একটু একটু করে সময়–পরিভ্রমণ যানের নিয়ন্ত্রণ তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে কুরু ইঞ্জিনের ভয়ঙ্কর গর্জন শোনা যেতে থাকে। থরথর করে মাটি কাঁপতে থাকে, আয়োনিত গ্যাস প্রচণ্ড বেগ বের হতে শুরু করেছে পিছন দিয়ে। আগুনের লেলিহান শিখায় চারদিক ঢেকে যেতে শুরু করেছে, কালো ধোঁয়া পাক খেয়ে খেয়ে উপরে উঠছে।
সময়–পরিভ্রমণ যানটি আস্তে আস্তে মাটি থেকে উপরে উঠে আসছে, মনে হতে থাকে বিশাল একটি কীট বুঝি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যায়, তার মাঝে সময়–পরিভ্রমণ যানটি আস্তে আস্তে উপরে উঠে যাচ্ছে, গতিবেগ বেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি। আর কয়েক মুহূর্ত পর সময় পরিভ্রমণ যানটি পৃথিবীর আকর্ষণ ছিন্ন করে মহাকাশে ছুটে যাবে। শ্যালক্স গ্রুন এখনো জানে না সে সময়–পরিভ্রমণ করবে না–তার পরিভ্রমণ হবে দূরত্বে। সে পৃথিবী, সৌরজগৎ পার হয়ে চলে যাবে দূর কোনো এক নক্ষত্রের দিকে। তার বুকের ভিতর সিলাকিত ক্যাপসুলে থাকবে এক ভয়াবহ ভাইরাস। তার কাছাকাছি থাকবে তিশা। রবোটের অবয়বে তৈরী আমার ভালবাসার ত্রিশা। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, সময়–পরিভ্রমণ যানের কুরু ইঞ্জিন থেকে আয়োনিত গ্যাস বের করে সেটা উপরে উঠে যাচ্ছে, খুব ধীরে ধীরে দিক পরিবর্তন করতে শুরু করেছে, পৃথিবীর আবর্তনের সাথে সাথে গতিবেগের সামঞ্জস্য আনার জন্যে। আকস্মিক কোনো বিস্ফোরণে ধ্বংস না হয়ে গেলে আর কেউ এখন শ্যালক্স গ্রুনকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কোনোদিন ফিরিয়ে আনতে পারবে না। পৃথিবীর একটা অশুভ স্বপ্ন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে মহাকাশে।
আমরা সবাই খুব সাবধানে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিলাম। সত্যিই কি পৃথিবীকে রক্ষা করা হয়েছে? নুবা দেয়াল স্পর্শ করে খুব সাবধানে ঘাসের উপর বসে পড়ল। মাথা ঘুরিয়ে আমাদের সবার দিকে তাকাল, তারপর কাঁপা গলায় বলল, আমরা কি বেঁচে গেছি?
ইগা তার ঘড়ির দিকে তাকাল, তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, হা নুবা আমরা বেঁচে গেছি।
আমরা তাহলে পৃথিবীকে রক্ষা করেছি?
হ্যাঁ। আমরা পৃথিবীকে রক্ষা করেছি।
তাহলে আমরা আনন্দ করছি না কেন?
কেউ কোনো কথা বলল না। য়োমি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, নুবা, আমি জানি না কেন আমরা আনন্দ করছি না।
ইগা একটু হেসে বলল, চল কন্টোলঘরে যাই। নিজের চোখে যদি শ্যালক্স গ্রুনকে দেখতে পাই হয়তো তখন সত্যি সত্যি বিশ্বাস হবে। তখন হয়তো আমরা আনন্দ করতে পারব।
কাছাকাছি একটা ছোট সেলে তাড়াহুড়া করে কন্ট্রোলঘরটি তৈরি হয়েছে। স্বচ্ছ দেয়াল সরিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকে গেলাম। দেয়ালে একটি বড় স্ক্রিন ছাড়া কিছু নেই। হঠাৎ করে দেখে এটাকে কন্ট্রোলঘর মনে হয় না। ইগা ছোট একটা সুইচ স্পর্শ করতেই স্ক্রিনটা আলোকিত হয়ে আসে, মাঝামাঝি একটা লাল বিন্দু জ্বলছে এবং নিভছে। নুবা জিজ্ঞেস করল, এটা কী?
শ্যালক্স গ্রুনের সময়–পরিভ্রমণ যান।
ভিতরে কি দেখা যাবে?
পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর দেখা যাবে।
যোগাযোগের জন্যে কী ব্যবহার করা হবে?
য়োমি এগিয়ে এসে বলল, ত্রিশার মতো দেখতে যে রবোটটি পাঠিয়েছি তার সাথে রয়েছে মাইক্রো কমিউনিকেশন মডিউল। যেসব ছবি পাঠানো হবে তার রিজলিউশন খুব ভালো হবে না আগেই বলে রাখছি।
আমরা স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, হঠাৎ সেখানে কিছু তরঙ্গ খেলা করতে থাকে। য়োমি চাপা গলায় বলল, এখন ভিতরে দেখা যাবে। কমিউনিকেশন মডিউল কাজ করতে শুরু করেছে।
নুবা বলল, রিকি তুমি সামনে যাও। কথা বল।
আমি?
হ্যাঁ। শুধু তুমিই শ্যালক্স গ্রুনের সাথে কথা বলেছ। যাও।
আমি স্ক্রিনের সামনে এগিয়ে গেলাম, খুব ধীরে ধীরে সেখানে একটা ছবি ভেসে উঠেছে। আমি বড় একটা করিডোর দেখতে পেলাম, সামনে কিছু ছোট ছোট স্ক্রিনের সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে শ্যালক্স গ্রুন। তার ভুরু কুঞ্চিত, মুখে গভীর একটা উদ্বেগের ছাপ। সে কিছু একটা স্পর্শ করে কয়েকটা বোতাম টিপতে থাকে, ছোট মাইক্রোফোনে কিছু একটা কথা বলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, আমি দেখতে পেলাম তার মুখ রক্তশূন্য, সেখানে এক ধরনের অমানুষিক আতঙ্ক। আমি ডাকলাম, শ্যালক্স গ্রুন।
পৃথিবী থেকে বহুদূরে চলে গেছে, আমার কথা পৌঁছুতে একটু সময় লাগল কিন্তু যখন আমার কথা শুনতে পেল সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে চিৎকার করে বলল, কে?
আমি।
আমি কে?
রিকি।
রিকি? রিকি!
হ্যা শ্যালক্স গ্রুন, তুমি হেরে গেছ। আমাদের কাছে তুমি হেরে গেছ। তোমাকে ত্রিনিত্রি রাশিমালা দেয়া হয় নি। অর্থহীন কিছু সংখ্যা নিয়ে তুমি এখন মহাকাশে উড়ে যাচ্ছ। বৃহস্পতি গ্রহের কাছে দিয়ে তুমি উড়ে যাবে সৌরজগতের বাইরে।
না। শ্যালক্স গ্রুন ছুটে গিয়ে তার কন্ট্রোল প্যানেলে ঝুঁকে পড়ে। হাত দিয়ে আঘাত করতে করতে চিৎকার করতে থাকে। আমরা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম, ভয়ঙ্কর মুখ করে সে ঘুরে তাকায়। তারপর হিসহিস করে বলল, ত্রিশা, ত্রিশাকে অষ্টম তোমার সামনে খুন করব। খুন করব।
আমরা প্রথমবার ত্রিশাকে দেখতে পেলাম। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে আর ভয় নেই। তার কপোট্রনে পুরোনো স্মৃতি মুছে ফেলে এখন নতুন স্মৃতি লেখা হচ্ছে। ভালবাসাহীন এক স্মৃতি। আতঙ্কহীন এক স্মৃতি। নিষ্ঠুর প্রতিশোধের এক স্মৃতি। আমি ফিসফিস করে বললাম, শ্যালক্স গ্রুন! তুমি ত্রিশাকে স্পর্শ করবে না। তুমি স্পর্শ করতে পারবে না।
শ্যালক্স গ্রুন ঘুরে ত্রিশার দিকে তাকায় এবং হঠাৎ করে তার মুখ আতঙ্কে কদর্য হয়ে যায়। সে নিজের বুক স্পর্শ করে এক পা পিছিয়ে যায়। একটু আগে যে ত্রিশা ছিল সে আর ত্রিশা নয়, তার চোখ জ্বলছে, হাত থেকে বের হয়ে এসেছে ধারালো ধাতব ছোরা। ছায়ামূর্তিটি শ্যালক্স গ্রুনের দিকে এগিয়ে যায়–
না না না_শ্যালক্স গ্রুন আতঙ্কে চিৎকার করে পিছনে সরে যেতে থাকে। মানুষটি নিষ্ঠুর অমানবিক, তার ভিতরে ভালবাসার কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু মানুষের প্রাচীনতম অনুভূতি ভীতি তার বুকের ভিতর লুকিয়েছিল সে জানত না।
আমি স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম, আমি আর দেখতে পারছি না, তোমরা কেউ স্ক্রিনটি বন্ধ করে দেবে?
ইগা হাত বাড়িয়ে কী একটা স্পর্শ করতেই স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে গেল। য়োমি চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ স্ক্রিনটা বন্ধ করে দাও। রবোটের ওপর নির্দেশ দেয়া আছে শ্যালক্স গ্রুনের শরীর থেকে ভাইরাসের এম্পুলটা বের করার দৃশ্যটি মনে হয় না আমি সহ্য করতে পারব।
নুবা একটা নিশ্বাস নিয়ে পিছনে সরে গিয়ে বলল, মানুষটিকে হত্যা না করে কি এম্পুলটা বের করা যেত না?
হয়তো যেত। য়োমি নুবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তার চেষ্টা করি নি। আমি খুব প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ। মানুষের জগতে এই দানবটির বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।
আমরা ছোট কন্ট্রোলঘর থেকে বের হয়ে এলাম। দূরে একটা বাই ভার্বাল নেমেছে। তার ভিতর থেকে বেশ কয়েকজন মানুষ হেঁটে হেঁটে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, সবার সামনে ইয়োরন রিসি। আমরা তার দিকে হেঁটে যেতে থাকি।
মহামান্য ইয়োরন রিসি এক জন এক জন করে আমাদের প্রত্যেককে আলিঙ্গন করে বললেন, পৃথিবীর পক্ষ থেকে তোমাদের অভিনন্দন। এই পৃথিবী যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তোমাদের কাছে ঋণী হয়ে থাকবে।
নুবা নরম গলায় বলল, আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন মহামান্য ইয়োরন রিসি, কিন্তু আপনি একটু অতিরঞ্জন করেছেন। আপনার আদেশে আমরা কয়েকটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তার বেশি কিছু নয়! সব কাজ করেছে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ। অসংখ্য বিজ্ঞানী, অসংখ্য ইঞ্জিনিয়ার, অসংখ্য প্রতিভাবান শ্রমিক।
য়োমি মাথা নেড়ে বলল, নুবা একটুও বাড়িয়ে বলে নি। আটচল্লিশ ঘণ্টার মাঝে আমাকে একটা রবোট তৈরি করে দিয়েছে। নিখুঁত রবোট, রিকির মতো মানুষ সেই রবোট দেখে বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল!
ইগা মাথা নেড়ে বলল, আর কুরু ইঞ্জিনের সেই ব্যাপারটা। আমরা নিজেরা কি সেটা কখনো করতে পারতাম? সময়–পরিভ্রমণকে পাল্টে দূরত্ব–পরিভ্রমণ করে ফেলা? আমি নিজে তো বিজ্ঞান শিখেছি গত দু দিনে!
নুবা বলল, তার ওপর একটি নকল ত্রিনিত্রি রাশিমালা তৈরি করে দেয়া–যেটি সত্যিকারের রাশিমালার কাছাকাছি কিন্তু সত্যিকারের নয়।
হিশান হেসে বলল, সবচেয়ে চমৎকার হয়েছে কৃত্রিম পারমাণবিক বিস্ফোরণ, একেবারে তেজস্ক্রিয়তা থেকে শুরু করে শক ওয়েভ, বাতাসের ঝাঁপটা, শ্যালক্স গ্রুন এতটুকু সন্দেহ করে নি!
ইয়োররন রিসি মাথা নাড়লেন, তোমাদের কথা সত্যি। পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ তোমাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সত্যিকারের কাজটি করেছ তোমরা। আমি সেটা জানি, তোমরাও সেটা জান!
কিন্তু–
আমি পৃথিবীর বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক, আমার আদেশ তোমরা আমার সাথে এই ব্যাপারটি নিয়ে তর্ক করবে না!
আমরা তার কথায় হেসে ফেললাম, মানুষটির মাঝে এক ধরনের বিস্ময়কর সারল্য রয়েছে যেটা অন্য কোনো মানুষের মাঝে দেখি নি।
ইয়োরন রিসি নরম গলায় বললেন, পুরো ব্যাপারটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তোমাদের স্নায়ুর উপর নিশ্চয়ই অসম্ভব চাপ পড়েছে। এখন তোমাদের প্রয়োজন বিশ্রাম। আমি কি তোমাদের কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?
আমি ইয়োরন রিসির দিকে তাকালাম। বললাম, পারেন মহামান্য ইয়োরন রিসি।
তুমি বল রিকি, তুমি কী চাও।
আমি আমার পকেটে হাত দিয়ে লাল কার্ডটি বের করে ইয়োরন রিসির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, আমার এই কার্ডটি আপনি ফিরিয়ে নেবেন।
ইয়োরন রিসি কোমল চোখে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে রিকি, সেটাই যদি তোমার ইচ্ছে।
ইয়োরন রিসি কার্ডটি নেবার জন্যে হাত বাড়ালেন। সাথে সাথে ইগা, হিশান, য়োমি আর নুবা তাদের নিজেদের লাল কার্ডগুলো বের করে তার দিকে এগিয়ে দেয়। ইয়োরন রিসি খানিকক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসতে হাসতে বললেন, পৃথিবীর একেক জন মানুষ এই লাল কার্ডের জন্যে নিজেদের প্রাণ দিয়ে দেবে আর তোমরা অবহেলায় সেটা ফিরিয়ে দিচ্ছ?
ইগা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা হয়তো এই পৃথিবীর উপযুক্ত মানুষ নই মহামান্য রিসি। হয়তো কিছু গোলমাল আছে আমাদের!
ইয়োরন রিসি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কিছু একটা গোলমাল আছে।
১১.
দীর্ঘ লিফটে করে আমি মাটির নিচে সুড়ঙ্গে নেমে এসেছি। শেষবার যখন এসেছিলাম আমার কাছে লাল কার্ড ছিল, আমি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারতাম। এখন আমার কাছে সেই লাল কার্ড নেই, মানুষের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে আমাকে নিচে নামতে হয়েছে। আমি প্রোগ্রামিং ফার্মের বাইরে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভিতরে এক শিফটের কাজ শেষ হয়েছে, শ্রমিকেরা একে একে বের হয়ে আসছে। তাদের চোখেমুখে ক্লান্তি, তাদের পোশাক ধুলায় ধূসর। আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে ত্রিশাকে খুঁজতে থাকি। দাঁড়িয়ে থেকে–থেকে আমি যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম ঠিক তখন ত্রিশা বের হয়ে এল, তার পরনে হালকা নীল পোশাক, তার মাথায় একটা লাল রুমাল শক্ত করে বাঁধা।
আমি ভিড় ঠেলে সামনে ছুটে গেলাম, চিৎকার করে ডাকলাম, ত্রিশা ত্রিশা—
ত্রিশা চমকে ঘুরে তাকাল, আমাকে দেখে এক মুহূর্ত দ্বিধা করে সে হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, রিকি। তুমি?
হ্যাঁ, ত্রিশা আমি। তুমি ভালো আছ?
ত্রিশা মাথা নাড়ল, ভালো। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ করে বলল, আমি কয়দিন থেকে তোমার কথা ভাবছিলাম।
সত্যি?
হ্যাঁ। খুব একটা অবাক ব্যাপার হয়েছিল দুদিন আগে।
কী অবাক ব্যাপার?
চার জন মানুষ এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। দুজন পুরুষ দুজন মহিলা। বয়স খুব বেশি নয়, সবাই প্রায় আমাদের বয়সী। কিন্তু তারা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
সত্যি?
হ্যাঁ। তুমি বিশ্বাস করবে না তাদের কী আশ্চর্য ক্ষমতা! যেটা করতে চায় সেটাই তারা করতে পারে। যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে।
আমি আমার মুখে অবাক হবার একটা চিহ্ন ফোঁটাতে চেষ্টা করতে থাকি। ত্রিশা চোখ বড় বড় করে বলল, তারা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল একটা রবোটের ফার্মে।
সত্যি?
হ্যাঁ। সারারাত কথা বলল আমার সাথে। তোমার কথা জিজ্ঞেস করল অনেকবার। যখন আমি চলে আসছিলাম তখন ফার্মের লোকজন এসে আমার অনেকগুলো ছবি তুলল, আমার শরীরের মাপ নিল। সবশেষে আমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করল।
আমি আমার মুখে বিস্ময় ফোঁটানোর চেষ্টা করতে থাকি। ত্রিশা মাথা নেড়ে বলল, একটা ব্যাপার জান?
কী?
ওই চার জন মানুষের সাথে আর তোমার সাথে কী একটা মিল রয়েছে।
মিল?
হ্যাঁ, আমি ঠিক ধরতে পারছি না মিলটুকু কোথায় কিন্তু কিছু একটা মিল আছে। সেই থেকে আমার কেন জানি শুধু তোমার কথা মনে হচ্ছে!
ত্রিশা হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে তাকাল, খানিকক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ওই চার জন মানুষকে চেন রিকি?
আমি খানিকক্ষণ ত্রিশার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, হ্যাঁ ত্রিশা। আমি তাদের চিনি।
তুমি–তুমি ঠিক ওদের মতো একজন?
হ্যাঁ ত্রিশা, আমি ঠিক তাদের মতো একজন।
ত্রিশা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি আমাকে কখনো তোমার নিজের কথা বল নি, তাই না?
আমি বলি নি কারণ আমি জানতাম না ত্রিশা। আর জানলেও বিশ্বাস করতাম না।
ত্রিশা আমার হাত ধরে বলল, তুমি বলবে তোমার কথা?
তুমি শুনবে?
শুনব।
আমি ত্রিশাকে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে বললাম, ঠিক আছে আমি বলব। তুমি বিশ্বাস করবে না তবু আমি বলব।
আমি সবসময় তোমার কথা বিশ্বাস করব রিকি।
ত্রিশা আমার দিকে তাকিয়ে খুব সাবধানে তার চোখের পানি মুছে নেয়।
.
দক্ষিণের পাহাড়ি অঞ্চলের একটি ছোট স্কুলে বাচ্চাদের পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে আমি আর ত্রিশা শহর ছেড়ে চলে এসেছি। ছোট কাঠের একটা বাসা আছে আমাদের। শীতের বিকেলে যখন তুষার পড়তে থাকে জানালার পাশে, আগুনের উষ্ণতায় বসে আমরা জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকি। আমাদের ছোট ছেলেটি ঘরে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে থাকে– অসম্ভব দুরন্ত একটি শিশু হয়ে বড় হচ্ছে সে।
নুবা, য়োমি, ইগা আর হিশানের সাথে আমার ভালো যোগাযোগ নেই। শুধু বছরে একবার আমরা কোথাও এসে একত্র হই, নুবা তার ভালোমানুষ হাসিখুশি স্বামীটিকে নিয়ে আসে। হিশানের সাথে আসে তার কমবয়সী বান্ধবী। য়োমি এখনো একা, আমার কেন জানি মনে হয় সারাজীবন সে একাই থাকবে। ইগার সাথে একেকবারে একেকজন আসে, কমবয়সী অপূর্ব সুন্দরী কোনো মেয়ে! আমি ত্রিশাকে নিয়ে যাই।
ত্রিশাকে তারা সবাই খুব ভালো করে চেনে, মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝি আমার থেকেও ভালো করে।