ষুন দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে পা ছড়িয়ে বসেছে রিশান আর নিডিয়া। ঘরের মাঝামাঝি হলোগ্রাফিক একটা দৃশ্যে হান এবং বিটি বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। সুন সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই জান সব মহাকাশচারীর ভিতরেই একটা স্বপ্ন থাকে যে সে একবার পঞ্চম মাত্রার মহাকাশ অভিযানের নেতৃত্ব দেয়। লি–রয় মারা যাবার পর অভিজ্ঞতার দিক থেকে বিচার করে পঞ্চম মাত্রার অভিযান নয় নয় শূন্য তিনের নেতৃত্ব আমাকে দেয়া হয়েছে; কিন্তু এর নেতৃত্বের জন্যে আমার বিন্দুমাত্র মোহ নেই। আমি কখনো এভাবে নেতৃত্ব পেতে চাই নি। কিন্তু যেহেতু এভাবে এটা আমার হাতে এসেছে আমাকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে কী করতে হবে সেটা আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে না, সেই সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে নেয়া হয়ে গেছে। আমাকে শুধুমাত্র সেটা কার্যকর করতে হবে। আমি তোমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমি সেই কাজটি খুব সুচারুভাবে করব।
রিশান ষুনকে থামিয়ে বলল, তুমি এই গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করার কথা বলছ?
হ্যাঁ, তোমরা সেটা নিয়ে যত ইচ্ছে তর্ক–বিতর্ক করতে পার তাতে আর কিছু আসে যায় না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।
ঠিক এ রকম সময়ে চারটি রবোট ঘরে এসে ঢুকল। সবার সামনে যে দাঁড়িয়েছিল সে নিচু গলায় বলল, মহাকাশকেন্দ্রের মহাপরিচালকের কাছে থেকে তোমাদের জন্যে একটি নির্দেশ এসেছে।
ষুন অবাক হয়ে বলল, আমাদের জন্যে? নির্দেশ?
হ্যাঁ।
সেটি কী করে সম্ভব?
রবোটটি কোনো কথা বলল না, সামনে হেঁটে কোথায় জানি স্পর্শ করতেই দেয়ালের বড় স্ক্রিনে মহাকাশকেন্দ্রের সদর দফতরের মহাপরিচালকের ক্রুদ্ধ একটা ছবি ভেসে আসে। কোনোরকম ভূমিকা ছাড়া সে কঠোর গলায় প্রায় চিৎকার করে বলে, আমি তোমাদের নির্দেশ দিয়েছিলাম এই গ্রহটিকে জীবাণুমুক্ত করতে—তোমরা কর নি এবং শুধুমাত্র সেই কারণে তোমরা তোমাদের একজন সহকর্মীকে হারিয়েছ। তোমাদের হাতে সময় নেই, যদি আর কোনো সহকর্মী এই গ্রহে প্রাণ হারায় সেটি হবে সপ্তম মাত্রার অপরাধ এবং সেজন্যে তোমাদের প্রচলিত নিয়মে বিচার করা হবে।
মহাপরিচালক যেভাবে হঠাৎ করে কথা বলতে শুরু করেছিল ঠিক সেভাবে হঠাৎ করে কথা শেষ করে দেয় এবং স্ক্রিন থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। রিশান রবোটগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাদের কাছে এ রকম কয়টি নির্দেশ আছে?
পাঁচটা।
আমাদের একজন করে মারা গেলে একটি করে দেখানোর কথা?
রবোটগুলো মাথা নাড়ল।
অন্যগুলোতে কী আছে দেখতে পারি?
না। দেখানোর নিয়ম নেই।
রিশান অন্যমনস্কভাবে তার এটমিক ব্লাস্টারটি হাতে তুলে নিতে গিয়ে থেমে গেল, সে অস্ত্রটি সানির কাছে দিয়েছিল এবং সেটি এখনো ফিরিয়ে নেয়া হয় নি।
ষুন গলা উঁচিয়ে বলল, মহাপরিচালকের কথা তোমরা শুনেছ। কাজেই আমাদের কী করতে হবে তোমরা সবাই জান। আমি এখন নিজেদের মাঝে দায়িত্ব ভাগ করে দিতে চাই। কেউ কিছু বলতে চাও?
রিশান মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। আমার একটা প্রশ্ন আছে।
বল।
তুমি জান এখানে একটা বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে। তারা খুব কৌশলে স্কাউটশিপকে অকেজো করে দিতে পারে। তারা মানুষের রূপ নিয়ে দেখা দিতে পারে। আমি নিজের চোখে দেখেছি, তোমাদেরকেও তার ছবি দেখিয়েছি। আমরা জানি এই বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে নির একটা সম্পর্ক আছে। গুনি জীবাণু, তাই সম্ভবত এই প্রাণীর নির্দেশে সানিকে স্পর্শ করে নি। এখন আমরা যদি গ্রুনিকে ধ্বংস করে দিই, সম্ভবত এই বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে আমাদের একমাত্র যোগসূত্রটি কেটে দেব–আমরা সম্ভবত এই বুদ্ধিমান প্রাণীরও একটি বড় ক্ষতি করব–হয়তো তাদেরও ধ্বংস করে দেব। তুমি কি মনে কর একটা বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে আমরা আরেকটা বুদ্ধিমান প্রাণীকে এভাবে ধ্বংস করতে পারি?
ষুন গম্ভীর গলায় বলল, তুমি কী করতে চাও?
এই পুরো রহস্যটির সমাধান লুকিয়ে আছে সানির মাঝে। সে কিছু ব্যাপার জানে যেটা আমরা কেউ জানি না। সে আমাদের এমন কিছু বলতে পারে যেটা থেকে পুরো রহস্যের সমাধান বের হতে পারে। আমি নিদের ধ্বংস করার আগে সানির সাথে কথা বলতে চাই।
আমি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি।
সে কী বলেছে?
কিছু বলতে রাজি হয় নি।
আমি জানি সে এত সহজে কিছু বলবে না। সে মাত্র দশ বছরের বাচ্চা কিন্তু একা এ রকম একটা ভয়ঙ্কর পরিবেশে থেকে থেকে কিছু কিছু ব্যাপারে সে অসম্ভব কঠিন। তাকে কথা বলানোর আগে আমাদের নিজেদের তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে।
আমি লক্ষ করেছি তুমি তার চেষ্টা করছ–তোমার নিজের এটমিক ব্লাস্টারটি তার হাতে তুলে দিয়েছ!
রিশান এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমি তোমার কথায় এক ধরনের শ্লেষ শুনতে পাচ্ছি।
তুমি ভুল শুনছ না।
তাহলে আমি ধরে নেব তুমি আমার কথাকে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছ না?
না, সেটি সত্যি না। আমি তোমার কথায় যেটুকু গুরুত্ব দেবার কথা ঠিক ততটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি। সানি কী জানে সেটা আমিও জানতে চাই। তবে আমি তার জন্যে অনির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করে থাকব না। আমাদের সময় নেই। আমি গ্রুনিকে ধ্বংস করার যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে চাই, একই সাথে সানির থেকে সবকিছু জানতে চাই
সেটা তুমি কীভাবে করবে?
ষুন রিশানের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। রিশান হঠাৎ চমকে উঠে ষুনের দিকে তাকাল, চিৎকার করে বলল, তুমি সানির মস্তিষ্ক স্ক্যান করবে?
আমার আর কোনো উপায় নেই।
কী বলছ তুমি? মস্তিষ্ক স্ক্যান করলে সমস্ত স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায়। একজন মানুষের নিজস্ব সত্তা হচ্ছে তার স্মৃতি। তার স্মৃতি নষ্ট করা হচ্ছে মানুষকে ধ্বংস করা–
আমি জানি। বড় প্রয়োজনে বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়—
তোমার এই সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো অধিকার নেই।
আমি অভিযান নয় নয় শূন্য তিনের দলপতি। আমার কী কী করার অধিকার আছে শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
রিশান উঠে দাঁড়াল। ষুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, রিশান তুমি কি আমার সিদ্ধান্তের সাথে একমত?
না।
তুমি জান আমার সিদ্ধান্তের সাথে একমত না হলে কী হবে?
রিশান কোনো কথা বলল না। ষুন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমার মনে আছে রিশান আমরা এই অভিযানে আসার আগে তুমি কী বলেছিলে?
রিশান কোনো কথা বলল না। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তুমি বলেছিলে আমাদের এই দলটির প্রত্যেকে খুব কঠোর প্রকৃতির। তুমি ঠিকই বলেছিলে। আমরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত কঠোর। একজন খুব কঠোর মানুষ যদি তার দলের একজন অবাধ্য মহাকাশচারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সে কী করবে বলে তোমার মনে হয়?
আমি জানি সে কী করতে চাইবে। কিন্তু কেমন করে করবে সেটা আমি জানি না।
ষুন প্রায় কোমল গলায় বলল, তুমি জান তোমার কাছে এটমিক ব্লাস্টারটি নেই। তুমি জান তোমার চারপাশে চারটি রবোট দাঁড়িয়ে আছে। মহাকাশ অভিযানের দলপতি হিসাবে এই চারটি রবোট সোজাসুজি আমার নিয়ন্ত্রণে
তুমি–তুমি আমাকে বন্দি করছ?
হ্যাঁ। তোমাকে আপাতত বন্দি করছি। তোমার কাছে কোনো সহযোগিতা আশা করছি, কাজেই তোমাকে অচেতন করে শীতলকক্ষে ভরে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেব। পৃথিবীর কর্তৃপক্ষ তোমাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
রিশান মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল। সবাই স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ষুনও মাথা ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকাল, তোমরা আমার সিদ্ধান্তকে অপছন্দ করতে পার, তার কারণ আছে এবং তোমাদের তার অধিকারও আছে। কিন্তু আশা করছি কেউ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে না।
কেউ কোনো কথা বলল না। ষুন একটা নিশ্বাস ফেলে রবোটগুলোকে বলল, রিশানকে নিয়ে যাও তোমরা।
রিশান একবার ভাবল সে রবোটগুলোকে বাধা দেবে, কিন্তু অপ্রকৃতিস্থদর্শন এই রবোটগুলোকে যতই নির্জীব এবং দুর্বল মনে হোক না কেন, তাদের ধাতব শরীরে নিশ্চয়ই অমানুষিক জোর। তাদের বাধা দেয়া সম্ভবত খুব বড় ধরনের নির্বুদ্ধিতা। রিশান ষুনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সত্যি এটা করছ?
ষুন মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি আমার জায়গায় হলে তুমিও করতে।
নিডিয়া ক্লান্ত গলায় বলল, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমার সামনে এটা ঘটছে।
ষুন নিডিয়ার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এটা সত্যি ঘটছে। বিশ্বাস কর।