লুতফরকে ধরে রেখে কোনও লাভ নেই। তাকে অনেক জেরা করে বোঝা গেল, সে কিছুই জানে না। সে নদীর ওপারের হাঁসখালি গ্রামের ছেলে। তাকে সত্যিই জোর করে ধরে আনা হয়েছে।
তাকে ভাল করে খাইয়েদাইয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হল পরদিনই।
তা হলে সুকোমলকে কোথায় রাখা হয়েছে?
টাকাগুলো নকল না হয়ে আসল পাঁচ লাখ টাকা হলেও কি ওরা সুকোমলকে ফেরত দিত না?
সুকোমলের মা দারুণ কান্নাকাটি শুরু করেছেন। নিখিল মাহাতোরও মুখোনা শুকনো। অনেকেরই ধারণা হয়েছে, নকল টাকা দিয়ে ওদের ঠকাবার চেষ্টা করার জন্য শঙ্খচূড় এমন রেগে যাবে যে, সুকোমলকে হয়তো খুন করে ফেলবে।
কেউ মুখে কিছু না বললেও সন্তুর মনে হচ্ছে, সবাই যেন তাকেই দোষ দিচ্ছে। সে যেন বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। নকল টাকা দিয়ে কি চোর-ডাকাতদের ঠকানো যায়?
কিন্তু পুলিশ তো এর মধ্যে শঙ্খচূড়ের দলবলের কোনও খোঁজই পায়নি। সুকোমলকে উদ্ধার করার আর কী উপায় আছে।
নিখিল মাহাতো অবশ্য সরে নামে একটুও দোষ দিচ্ছেন না। বার বার বলছেন, সন্তু যেরকম সাহস দেখিয়েছে, তার কোনও তুলনাই হয় না।
তিনি মামার বাড়িতে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করেছেন। ছোটমামা বলে দিয়েছেন, সন্তু একা একা বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না। ওর ওপরে শঙ্খচূড়ের দলের নিশ্চয়ই খুব রাগ হয়ে আছে। ওরা প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে।
এর মধ্যেই খবর এসে গেছে যে, কাকাবাবুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বারাসতের কাছাকাছি একটা ধানখেতের মধ্যে পড়ে ছিল দেবলীনাদের গাড়ি, তার মধ্যে দেবলীনা ও গাড়ির ড্রাইভার অজ্ঞান, কোনও চিহ্ন নেই কাকাবাবুর।
দেবলীনাকে ওই অবস্থায় ফেলে কাকাবাবু নিশ্চয়ই নিজে কোথাও চলে যাবেন না। তাঁকে কেউ ধরে নিয়ে গেছে।
সন্তু অবশ্য এটা জেনেও বিশেষ বিচলিত হয় না। তার ধারণা, কাকাবাবুকে আটকে রাখার সাধ্য পৃথিবীতে কারও নেই। তার বেশি চিন্তা সুকোমলের জন্য।
জোজো বলল, চল সন্তু, আমরা কলকাতায় ফিরে যাই। এখানে আর বসে থেকে কী করব?
সন্তু বলল, কাকাবাবু আমাদের এখানেই অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।
জোজো বলল, কাকাবাবু তো একদিন পরে ফিরে আসবেনও বলেছিলেন। ফিরে তো এলেন না! কলকাতায় গিয়ে বরং দেবলীনাকে জিজ্ঞেস করে শোনা যাক। গাড়িটা মাঠের মধ্যে গেল কী করে?
সন্তু বলল, পুলিশ নিশ্চয়ই সেসব খোঁজখবর নিয়েছে। তুই বরং কলকাতায় চলে যা জোজো। আমি এখানে থাকি।
জোজো বলল, আমরা হচ্ছি লরেল হার্ডির মতন। একজনকে বাদ দিলে চলে। ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল!
সন্তু বলল, চল, আমরা একবার নদীতে সাঁতার কেটে আসি।
জোজো বলল, ওরে বাবা, সাঁতার? এই নদীতে? হাঙর আছে, কুমির আছে। তুই খুব জোর প্রাণে বেঁচে গেছিস! কী করে বাঁচলি বল তো? রাত্তিরবেলা হাঙর-কুমিরেরা ঘুমোয়।
সন্তু বলল, তাই নাকি? আসল কথা, তুই সাঁতার জানিস না। তা হলেই বুঝতে পারতিস, সব কাজ আমরা একসঙ্গে করতে পারব না!
জোজো বলল, সব কাজ কি একসঙ্গে করা যায় রে? মনে কর, তুই হঠাৎ পা পিছলে আলুর দম হলি। তা বলে কি সঙ্গে সঙ্গে আমিও আছাড় খাব? তোর হাত ধরে টেনে তুলব। তুই সাঁতার কাটবি, আমি পাড় থেকে দেখব।
এইসময় গেটের কাছে একটা জিপগাড়ি থেকে নামলেন নিখিল মাহাতো।
কাছে এসে বললেন, তোমরা তৈরি হয়ে নাও। কলকাতা থেকে আমাদের থানায় ফোন এসেছে। তোমাদের দুজনকে পুলিশ পাহারায় পাঠিয়ে দিতে বলা হয়েছে কলকাতায়।
জোজো সন্তুকে বলল, দেখলি, দেখলি, আমি ঠিকই ভেবেছিলাম।
নিখিল মাহাতো হঠাৎ রাগে ফেটে পড়ে বললেন, পুলিশের ওপর মহল থেকে আমার ছেলের ব্যাপারে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হল না! কলকাতায় বড়কর্তারা আমাদের মতন মফসলের লোকদের নিয়ে মাথাই ঘামাতে চায় না!
জোজো বলল, আঙ্কল, আপনার ছেলে সুকোমল ভাল আছে।
ঝট করে তার দিকে ফিরে নিখিল মাহাতো চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, তাই নাকি? তুমি কী করে জানলে?
জোজো বলল, আমি একটা মন্ত্র জানি। সেই মন্ত্রটা পড়ে ধ্যান করলে আমি যে-কোনও মানুষকে দেখতে পাই। কাল রাত্তিরে আমি সুকোমলকে দেখেছি, তার সঙ্গে কথাও বলেছি!
নিখিল মাহাতো জোরে ধমক দিয়ে বললেন, চুপ করো! ওসব বাজে কথা শোনার সময় নেই আমার। এখন তোমাদের আঙ্কল মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী ধরা পড়েছেন, এখন গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তাঁকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়বে, আমার ছেলের কথা ভুলেই যাবে। কিন্তু আমার কাছে আমার ছেলের জীবনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সন্তু বলল, আমি এখন কলকাতায় যেতে চাই না।
নিখিল মাহাতো গলার আওয়াজ একটু নরম করে বললেন, তুমি আর থেকে কী করবে? তুমি খুবই চেষ্টা করেছিলে।
সন্তু বলল, আঙ্কল, আমি একবার নদীর ঘাটে যেতে চাই। সেদিন যেখান থেকে নৌকোয় উঠেছিলাম।
নিখিল মাহাতো বললেন, সেখানে গিয়ে আর কী হবে? লোকগুলো কি সেখানে বসে থাকবে?
সন্তু বলল, তবু একবার যাওয়া দরকার। একটা ব্যাপার যাচাই করে নিতে চাই।
জোজোর দিকে ফিরে বলল, জোজো, তুই এখানে থাক, যদি কোনও খবর আসে। আমি সাঁতার কাটতে যাচ্ছি না, অন্য কাজে যাচ্ছি।
সন্তু গিয়ে নিখিল মাহাতোর জিপে চড়ে বসল।
নদীর ঘাটে দিনেরবেলা অনেক লোকজন। বেশ কয়েকটি নৌকো রয়েছে, যাতায়াত করছে এপার থেকে ওপারে। কয়েকটি দোকানেও মানুষের বেশ ভিড়।
এক দোকান থেকে ভেসে আসছে জিলিপি ভাজার গন্ধ।
জিপ থেকে নেমে নিখিল মাহাতো জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কী করতে চাও, সন্তু?
সন্তু বলল, সেদিন আমি যে নৌকোয় উঠেছিলাম, তার মাঝির নামটা আমার মনে আছে। বদরু শেখ। তার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
নিখিল মাহাতো বললেন, সে তো তোমাকে অন্য নৌকোটায় তুলে দিয়ে ফিরে এসেছিল। আমি দেখেছি। সে কী জানবে?
সন্তু বলল, আমি তাকে একটা নাম জিজ্ঞেস করব।
কয়েকটি নৌকোর মাঝিরা বসে বসে বিড়ি খাচ্ছে। তাদের মধ্যে বদরু শেখ নেই।
অন্য মাঝিরা ঠিক কিছু বলতে পারে না। একজন বলল, এই তো ছিল এখানে। আর-একজন বলল, ওপারে চলে গেল মনে হয়। অন্য একজন বলল, বদরুর নৌকোটা তো রয়েছে দেখছি।
একটু পরে তাকে পাওয়া গেল একটা চায়ের দোকানে। সন্তুকে দেখেই সে বলল, আমি এখন ভাড়া যাব না! নিখিল মাহাতো পুলিশের পোশাক পরে আসেননি, এমনি প্যান্ট-শার্ট, তাঁকে কেউ চিনতে পারেনি। তিনি বললেন, কেন, ভাড়া যাবে না কেন?
বদরু শেখ বলল, আমার অন্য খদ্দের ঠিক করা আছে।
নিখিল মাহাতো আবার জিজ্ঞেস করলেন, সে খদ্দের কখন আসবে?
বদরু শেখ ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, সে যখনই আসুক। মোট কথা এখন ভাড়া যাব না। আমার মর্জি।
আশপাশে অনেক লোক দেখে সন্তু নিচু গলায় বলল, ভাড়া না যেতে চান, ঠিক আছে। আপনার নৌকোয় বসে একটু কথা বলতে পারি?
প্রবল বেগে দুদিকে মাথা নেড়ে সে বলল, না। ওসব হবে না। আমার সময় নেই!
নিখিল মাহাতো বললেন, তা হলে তো তোমায় একবার থানায় যেতে হয়!
এবারে বদরু শেখ ভয় পেয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, থানায়?
সন্তু তার হাত ধরে খুব নরম সুরে বলল, চলুন না, আপনার নৌকোয় গিয়ে একটু বসি!
এবারে আর বদরু আপত্তি করল না।
নৌকোয় ওঠার পর সন্তু বলল, দুদিন আগে রাত্তিরবেলা আমি আপনার নৌকো ভাড়া নিয়েছিলাম, মনে আছে?
বদরু বলল, কত মানুষে ভাড়া নেয়, সবার কথা কি মনে থাকে?
সন্তু বলল, মাত্র দুদিন আগেকার কথা।
বদরু এক হাত দিয়ে দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বলল, মনে আছে।
সন্তু বলল, আপনি আমাকে মাঝনদীতে নিয়ে গেলেন, তারপর খানিক বাদে একটা ভটভটি এল উলটো দিক থেকে!
বদরু বলল, আপনারে সে লৌকোয় লামায়ে দিয়ে আমি ফিরে এসেছি।
সন্তু বলল, তা ঠিক। অন্য নৌকোয় মাঝি ছাড়াও দুজন লোক ছিল, আপনি তাদের চেনেন?
বদরু বলল, আমি তাদের দেখি নাই, শুনি নাই, চিনব কী করে? অন্ধকার ছিল।
সন্তু বলল, তাদের মধ্যে একজন আপনার নাম ধরে ডেকেছিল। বলেছিল, এ তো বদরু শেখ। বলেনি?
বদরু বলল, কী জানি, শুনি নাই আমি। যদি বা ডেকেও থাকে, সে আমারে চিনলেও আমাকেও কি তাকে চিনতে হবে?
নিখিল মাহাতো বললেন, তুমি খুব বিখ্যাত লোক বুঝি? তোমাকে অন্য অনেকে চেনে, তুমি তাদের চেনো না! কে তোমার নাম ধরে ডেকেছিল?
এবারে বদরু হাউহাউ করে কেঁদে নিখিল মাহাতোর হাঁটু চেপে ধরে বলল, আমারে মাপ করেন সার। আমি কিছু জানি না। আমি কোনও কথা বললে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘর করি। আমারে ছেড়ে দ্যান সার।
সন্তু বলল, সেদিনের ঘটনা বার বার চিন্তা করতে করতে আমার এই খটকা লেগেছে। ওদের একজন এই মাঝির নাম জানে। তা হলে এই মাঝিও ওদের নাম জানতে পারে। এর কাছ থেকে ওদের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। একই দলেরও হতে পারে।
বদরু আবার বলল, আমি কোনও দলে নাই সার। আমি কিছু জানি না সার।
নিখিল মাহাতো বললেন, ওরা তোমাকে ভয় দেখিয়েছে। গুন্ডা-ডাকাতরা অনেক মানুষকে ভয় দেখিয়ে বেড়ায়। সবাই যদি ভয় পেয়ে মুখ না খোলে, তা হলে সমাজ-সংসার চলবে কী করে? ওরাই তো রাজত্ব করবে!
বদরু বলল, আমারে বিপদে ফেলবেন না সার। দয়া করুন সার।
নিখিল মাহাতো বললেন, আমিও তো তোমায় ভয় দেখাতে পারি। থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে তোমায় পেটাব। মারতে মারতে অজ্ঞান করে দেব। তাতেও যদি মুখ না খোল, তোমার নামে চুরি-ডাকাতির মিথ্যে কেস দিয়ে ভরে দেব হাজতে। তাতে তোমার বউ-ছেলেমেয়ে তো আরও বিপদে পড়বে!
বদরু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
নিখিল মাহাতো বললেন, বদরু, তুমি ভাল লোক, না খারাপ লোক?
বদরু মুখ তুলে বলল, সার, আমি নিরীহ মানুষ, জীবনে কখনও চুরিজোচ্চুরি, অন্যায়, পাপের কার্য করি নাই বিশ্বাস করেন। আল্লার দয়ায় এই নৌকো চালিয়ে যা রোজগার হয়, তাতেই আমি সন্তুষ্ট।
নিখিল মাহাতো বললেন, তোমার কথায় বিশ্বাস করলাম। তুমি যদি সৎ মানুষ হও, তবে যারা অসৎ, বদমায়েশ, তাদের ধরিয়ে দিয়ে শাস্তি দেওয়াও তোমার কর্তব্য। তোমার যাতে বিপদ না হয়, আমরা দেখব। এই ছেলেটিকে দ্যাখো, তোমার চেয়ে বয়েসে কত ছোট। ও যদি বিপদের ভয় না পায়, তুমি জোয়ান পুরুষ হয়ে এত ভয় পাচ্ছ কেন? কারা ছিল সেই নৌকোয়?
বদরু কাঁধের গামছা দিয়ে চোখ মুছে বলল, একজনকে চিনি। তার নাম বিশাই সামন্ত।
নিখিল মাহাতো বললেন, বিশাই সামন্ত! নামটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আগে কোনও একটা কেসে বোধ হয় ধরা পড়েছিল। এই বিশাই সামন্তর বাড়ি কোথায়?
বদরু বলল, কোথায় বাড়ি তা জানি না। তবে কবুতরডাঙায় তারে কয়েকবার দেখেছি।
নিখিল মাহাতো বললেন, কবুতরডাঙা? খুব বেশি দূর নয়। আমি এক্ষুনি সেখানে যেতে চাই। খোলো খোলো, নৌকো খোলো!
বদরু বলল, সে অতি সাঙ্ঘাতিক লোক সার। সঙ্গে বন্দুক-পিস্তল রাখে। এখন যাবেন না সার। আরও পুলিশ নিয়ে আসেন—
নিখিল মাহাতো অস্থিরভাবে বললেন, না, না, দেরি করার উপায় নেই। যত সময় নষ্ট হবে, ততই বিপদ বাড়বে। কী সন্তু, তুমি এক্ষুনি কবুতরডাঙায় যাওয়া উচিত মনে কর না? তুমি রাজি?
সন্তু বলল, হ্যাঁ, রাজি।