১০. লাঞ্চের পর

লাঞ্চের পর কর্নেল কেয়ারটেকার ম্যাথুর অফিসে টেলিফোন গাইডের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন। ম্যাথু ক্ষোভের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটি শোনাচ্ছিল। সে এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছে না। কে কখন গেটে ক্রস এঁকেছে, তাই নিয়ে কলকাতার বাবু-বিবিরা কেন তাদের ধমক দেবেন? ম্যাথুর মতে, “আ লট অব স্ট্রেঞ্জ পিপল অ্যান্ড আ লট অব মিস্ট্রি।” কর্নেল নাম্বারটা খুঁজে পেয়ে একটু হেসে তাকে বললেন, “ফরগেট ইট। দে আর ফানি পিল্ল।”

এক্সচেঞ্জের অপারেটর সাড়া দিলে কর্নেল নাম্বারটা বললেন। একটু পরে রিং হতে থাকল। ফোনের কাছাকাছি কি কেউ নেই? প্রায় তিন মিনিট পরে রিং বন্ধ হয়ে সাড়া এল, “হেলো!”

কোনও মেয়ের গলা। কর্নেল বললেন, “ইভনিং ভিলা?”

“জি। আপ কিসকো মাংতা?”

‘বোসসাবকো।”

“ছোটসাব বাহার গেয়া। দো-টাই ঘণ্টেকি বাদ লোটেঙ্গে।”

 “মেমসাব হ্যায়?”

 “আপ কৌন হ্যায়? কাহাসে বাত করতা?”

 “পুলিশ অফসর। মেমসাবকি সাথ জরুরি বাত হ্যায়। জলদি বোলাও।”

 “হায় রাম! ছোটাসাবকা কৈ খতরনাক তো নেহি?”

কর্নেল একটু অবাক হলেন। সেই কাজের মেয়েটি বলেই মনে হচ্ছে, যে চায়ের ট্রে নিয়ে হলঘরে ঢুকেছিল এবং তার দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছিল। সে বোস সায়েবের বিপদের কথা কেন ভেবে বসল? কর্নেল বললেন, “কৈ খতরনাক হোনে কা বাত থা?”

“জি নেহি, জি নেহি। ঠারিয়ে। মেমসাবকো বোলাতি।”

একটু পরে মার্জিত উচ্চারণে, কিন্তু কাঁপা-কাঁপা গলায় সাড়া এল। “মিসেস বোস স্পিকিং। এনিথিং রং, অফিসার?”

কর্নেল বাংলায় বললেন, “নমস্কার মিসেস বোস। আমি কর্নেল নীলাদ্রি ‘; সরকার বলছি।”

“কর্নেল…কিন্তু মালতী বলল-”

“আমার নামটা কি পরিচিত মনে হচ্ছে না মিসেস বোস? আবার বলছি। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।”

“আই সি। আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তাই না?”

“সম্ভবত মিঃ বোস আমার কথা আপনাকে বলেছেন?”

“হ্যাঃ। আপনি মর্নিংয়ে ইনভেস্টিগেশনে এসেছিলেন। বলুন!”

“আমি আপনার সহযোগিতা চাই রত্না দেবী!”

 “বলুন, কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি?”

“মাত্র তিনটি প্রশ্নের উত্তর চাই। আশা করি, সঠিক উত্তর পাব। হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!”

একটু পরে সাড়া এল, “বলুন। বাট প্লিজ মেক ইট শর্ট।”

“ইভনিং ভিলার হলঘরে ফার্নিচারগুলো কি নতুন করে সম্প্রতি সাজানো হয়েছে?”

“নাহ? নেক্সট?”

“আপনি বসন্ত হাজরা নামে কোনও লোককে চেনেন?

 “সে তোহা। চিনি। চিনতুম। নেক্সট?”

 “আপনার গাড়ি কি চালু আছে?”

“বুঝলুম না।”

“আপনার কনটেসা গাড়ি কি বিগড়ে গেছে?”

“কেন এ প্রশ্ন?”

“আনসার দা কোয়েশ্চেন প্লিজ?”

 “ইজ ইট ইমপটান্ট কর্নেল সরকার?”

 “ভেরি ইমপর্টান্ট রত্না দেবী?”

“মাই কার ইজ অলরাইট।”

“চেক করে দেখেছেন কি?”

 “মাই কার ইজ অলরাইট।”

“লনের রাস্তায় কিন্তু প্রচণ্ড নুড়িপাথর!”

“কাজ এখনও শেষ হয়নি। রাস্তাটা রিপেয়ার করা হচ্ছে।”

“তার মানে আপনার গাড়ি ঠিক থাকলেও ইভনিং ভিলা থেকে বাইরে আনা যাবে না!”

“সো হোয়াট?”

 “থ্যাংকস রত্না দেবী! আজ সন্ধ্যায় ককটেল-ডিনারে দেখা হবে।”

কর্নেল তখনই ফোন নামিয়ে রাখলেন না। কারণ ও-পক্ষে ফোন নামিয়ে রাখার শব্দ শোনা গেল না।

একটু পরে দ্রুত সাড়া এল, “হ্যালো! আর য়ু দেয়ার?”

 “হ্যাঁ। বলুন।”

“আপনি কোথা থেকে ফোন করছেন? পোলিস স্টেশন?”

 “নাহ। ডাকবাংলো থেকে।”

 “স্টিফেনস বাংলো, আই থিংক?”

 “হ্যাঁ।”

 “আই ওয়ান্ট টু টক টু য়ু, কর্নেল সরকার!”

 “আপনি চাইলে এখনই যেতে পারি।”

“না। এখানে নয়। আপনার গাড়ি আছে?

“সরি রত্না দেবী। বাট আই ক্যান ম্যানেজ আ পোলিস কার। আপত্তি না। থাকলে আপনাকে ইভনিং ভিলার গেট থেকে পিকআপ করবে।”

“এখন একটা চল্লিশ প্রায়। মাই হাজব্যান্ড উইল কাম ব্যাক বাই ফোর ও’ক্লক, আমাকে তার আগেই ফিরতে হবে। ডু য়ু আন্ডারস্ট্যান্ড কর্নেল সরকার?”

“কোনও অসুবিধে হবে না। গাড়ির ব্যবস্থা করে আবার আপনাকে রিং করছি।”

“না, না। তার দরকার হবে না। আমি লক্ষ রাখব। পোলিস কার তো?”

“হ্যাঁ। আপনি নিশ্চয় আরিফ খানকে চেনেন? অ্যাডিশনাল এস পি। সে আপনাকে পিক আপ করবে।”

“দেন ইট ইজ অল রাইট। রাখছি। থ্যাংকস!…”

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে আরিফকে রিং করলেন তার কোয়ার্টারে। একটু পরে আরিফের সাড়া পেলেন। “হাই ওল্ড বস! আবার ডেডবডি পড়েছে নাকি?”

“তোমার বন্ধু সোমনাথবাবুর থিওরি অনুসারে আবার একটা বডি পড়বে।”

“সোমনাথ এসেছিল। এইমাত্র গেল। আমাকেও বোঝাচ্ছিল, আবার একটা ডেডবডি পড়বে।”

“তাই বুঝি? ওঁর কথা থেকে কী মনে হল তোমার?”

“আসলে হি ইজ টেরিবলি শক্ড়। ওর মাথায় আজকাল সেমিওটিকস না কী ঢুকেছে। সে-ও এক বিপদ। ইভনিং ভিলায় ঢুকতে গিয়ে পারেনি। গেট খোলেনি কেউ। ওবাড়িতে কুকুর আছে কি না জানতে গিয়েছিল।”

‘আরিফ! তুমি তোমার পুলিশ-জিপটি নিয়ে এখনই ইভনিং ভিলার গেটে চলে যাও। মিসেস বোস উইল বি ওয়েটিং দেয়ার। ওঁকে পিক আপ করে সোজা আমার কাছে চলে এস। ডার্লিং! এটা অত্যন্ত জরুরি। আর শোনো! তুমি একা ড্রাইভ করে আসবে।”

“আই সি! বাট”

 “ডার্লিং! মেক হে প্লিজ!”

“ওকে বস।…”

কর্নেল লবিতে ঢুকলেন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজের ঘরে গেলেন। দরজার কপাটের তলায় কয়েক কুচি রঙিন মার্বেল পেপার এখনও পড়ে আছে। সোমনাথ বলছিল, রাস্তার ধারে জঙ্গলে ওরা রঙিন কাগজ কুচি কুড়িয়ে পেয়েছে। কাজেই ওদেরই কারও দুষ্টুমি। দরজা খুলে কুচিগুলি এবার কুড়িয়ে নিলেন কর্নেল।

টেবিলে রাখা হ্যাভারস্যাকটার ভেতরের কুচির সঙ্গে মেলাতে গিয়ে একটু অবাক হলেন। এই কুচিগুলো পুরনো। তা ছাড়া কাঁচি দিয়ে কাটা নয়। ছেঁড়া। আতস কাঁচ দিয়ে পরীক্ষা করে মনে হল, বৃষ্টিখাওয়া কোনও ছেঁড়া ঘুড়ির অংশ হতেও পারে। অথবা ম্যাথু ক্রিসমাসে বাংলোটাকে রঙিন কাগজে সাজিয়েছিল। তারই কয়েকটা টুকরো বাতাসে ছিঁড়েখুঁড়ে গিয়ে জঙ্গলে পড়েছিল।

কথাটা ভাবতে ভাবতে একটু চমকে উঠলেন কর্নেল। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, চেজিং আ রেড হেরিং! লাল হেরিং মাছের পেছনে দৌড়ুনো! আসলে হেরিং মাছ কখনও লাল হয় না।

কেউ বা কারা কি তাকে লাল হেরিং মাছের পেছনে ছোটাচ্ছে? হয়তো সত্য জিনিসটাই এমন, যা অনেক ফালতু জিনিসের মধ্যে হেলাফেলায় পড়ে থাকে।

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে পা ছড়িয়ে হেলান দিলেন। রত্না বোস কেন হঠাৎ তাকে কিছু বলতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন? তার তিনটি প্রশ্ন কি কোনও গভীর গোপন স্পর্শকাতর জায়গা ছুঁয়ে ফেলেছে?

প্রতীক্ষা ব্যাপারটা জীবনে একটা নির্মমতার প্রতীক যেন। মুহূর্তগুলি ধীরে এগোতে থাকে। আরও একটা চুরুট প্রায় শেষ হয়ে এল। কতক্ষণ পরে বাইরে গাড়ির শব্দ, হর্ন। কর্নেল পুবের জানালার কাছে পা ছড়িয়ে বসে ছিলেন। সোজা হয়ে বসে মুখ তুলে জানালায় দেখলেন, চৌকিদার গেট খুলে সেলাম করে দাঁড়াল। আরিফের জিপ এসে বারান্দার কাছে থামল। কর্নেল উঠে গিয়ে দরজা খুলে অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। তারপর ওপরের করিডরে প্রথমে আরিফকে দেখা গেল। কর্নেলের দিকে একবার দ্রুত তাকিয়ে সে ঘুরল। যাকে সঙ্গে এনেছে, সে উঠতে দেরি করছে। সংকীর্ণ কাঠের সিঁড়িতে রঙিন নারকেলছোবড়ার কার্পেট পাতা আছে। দুধারে কাঠের মসৃণ রেলিং। প্রথমে রেলিংয়ের শেষপ্রান্তে একটি উজ্জ্বল হাত, তারপর তেমনই উজ্জ্বল একটি মুখ ভেসে উঠল। টানা বড়-বড় দুটি প্রতিমা-চোখের দৃষ্টিতে ঈষৎ আর্তি।

কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, “আসুন!”

 রত্না বোস করিডোরে উঠে নমস্কার করলেন কর্নেলকে।

আরিফ পুলিশের পোশাকে আসেনি। একটু হেসে বলল, “আমি লবিতে ওয়েট করছি।”

রত্না তার দিকে ঘুরে বললেন, “থ্যাংকস।” তারপর দ্রুত ঘরে এসে ঢুকলেন।

কর্নেল দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, “বসুন।”

রত্না বসলেন। তার হাতে একটা ছোট্ট পার্স। কর্নেল একটু অবাক হয়েছিলেন। রত্নার চেহারায় সৌন্দর্য এবং ব্যক্তিত্বেরও দীপ্তি আছে। কিন্তু তার বয়স এত কম, আঁচ করতে পারেননি। পরনে সাদাসিধে একটা আসমানি নীল শাড়ি। গয়নাগাটি নেই। নীলাভ ছোট্ট রিস্টওয়াচ কাঁকনের মতো শোভা পাচ্ছে। দেহের গড়ন হাল্কা, ছিপছিপে। মুখের আদল দেখে খাঁটি বাঙালি বলে মনে হয় না। কাশ্মীরি কিংবা রাজস্থানী যুবতীদের উদ্ধত তীক্ষ্ণ লাবণ্যের সঙ্গে বাঙালি যুবতীদের কোমলতা মেশালে যেমনটি দাঁড়ায়। কাধ অব্দি ছাঁটা এলোমেলো চুল। নিটোল দুটি বাহু কঁধ থেকে নগ্ন ও সাবলীল। আঙুলে আঙুল জড়ানো।

কর্নেল বললেন, “বলুন!”

রত্না আস্তে বললেন, “বসন্তবাবুর মৃত্যুর সঙ্গে আমার হাজবান্ডের কোনও সম্পর্ক নেই।”

কর্নেল হাসলেন। “পুলিশ তো মিঃ বোসকে জড়ায়নি সে ব্যাপারে। তাছাড়া মিঃ বোস একজন ভি আই পি, তার দিকে হাত বাড়ায় এমন ক্ষমতা কার আছে?”

রত্না শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, “তা হলে এই ঘটনার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী? আপনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনি ইনভেস্টিগেশনে নামলেন কেন? কে আপনাকে হায়ার করল?”

“আপনি কি এটাই জানার জন্য কথা বলতে চেয়েছেন?”

 রত্না আস্তে বললেন, “হ্যাঁ। আমি জানতে চাই। আমার এটা জানা দরকার।”

“সরি! আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই, রত্না দেবী! আমি একজন নেচারিস্ট। অবশ্য কোথাও মিসটিরিয়াস কিছু ঘটলে আমার একটু নাক গলানো স্বভাব আছে, এই যা।”

রত্না কর্নেলের চোখে চোখ রেখে বললেন, “বসন্তবাবুর মৃত্যু কোনও মিসটিরিয়াস ঘটনা নয়। লোকটা ভাল ছিল না।”

“বসন্তবাবুকে আপনি চিনতেন বলেছেন। কোন সূত্রে?”

“মাঝে মাঝে ইভনিং ভিলায় সাহায্য চাইতে যেত। লোকটা আমার ছোটবেলায় নাকি আমাদের কর্মচারী ছিল। শুধু এটুকু জানি।”

“আপনার কি মনে হয় সে মিঃ বোসকে ব্ল্যাকমেল করত?”

 রত্নার চোখ জ্বলে উঠল। “ইম্পসিবল। সে ভিক্ষে চাইতে যেত দাদার কাছে।”

 “আপনার দাদাকে ব্ল্যাকমেল করত কি সে?”

 রত্না উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ইউ আর টকিং ননসেন্স।”

 কর্নেল হাসলেন। “প্লিজ উত্তেজিত হবেন না। বসুন।”

রত্না বসলেন না। বললেন, “আমার হাজবন্ডকে অকারণ জড়ানোর জন্য আপনাকে কে হায়ার করেছে, আমি জানতে চাই। অ্যান্ড লেটস্ কাম টু টার্মস, কর্নেল সরকার!”

“আগে বলুন, আপনার কী ধারণা? কে হতে পারে সে?”

রত্না বললেন, “আমার কোনও ধারণা নেই বলেই আপনার কাছে জানতে এসেছি।”

কর্নেল বললেন, “জাস্ট আ মিনিট। দেখুন তো ওই হ্যাভারস্যাকটা চেনেন। কি না?”

হ্যাভারস্যাকটা রত্নার পেছনে টেবিলে রাখা ছিল। ঘুরে দেখে নিলেন। তারপর চমকানো স্বরে বললেন, “এটা আপনি কোথায় পেলেন? এতে

“ট্যক্সিডার্মির লোশন ছিল।” কর্নেল বললেন। “পয়জনাস লোশন। স্টাড় জন্তু-জানোয়ারের চামড়া মাঝে মাঝে পরিষ্কারের দরকার হয়। সেই লোশন।” কর্নেল উঠে গিয়ে হ্যাভারস্যাকটা তুলে ধরলেন। “বিষাক্ত লোশন। তাই এই সাইনটা আঁকা ছিল এতে। দুটো আড়াআড়ি হাড়। ওপরে একটা স্কাল। খুলি! খুলিটা ক্রমশ মুছে গেছে হাতের ঘষা খেয়ে। কিন্তু আতস কাঁচের সাহায্যে অস্পষ্ট দাগটা লক্ষ্য করেছি।”

“আপনি এটা নিয়ে এসেছেন কেন?”

 “আমি আনিনি। গত রাত্তিরে এই বাংলোতে কেউ পাচার করেছে।”

কর্নেল হ্যাভারস্যাকটার মুখটা খুলে রঙিন কাগজকুচিগুলো দেখালেন। “এর ভেতর জুয়েল ছিল। উদ্ধার করেছি।”

“ও মাই গড!” রত্না চেয়ারে বসে পড়লেন। মুখ সাদা। ঠোঁট কাঁপছিল। কামড়ে ধরলেন। একটু পরে মুখ নামিয়ে শ্বাস ছেড়ে আস্তে বললেন, “দাদা তা হলে ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন।”

“মিঃ সর্বেশ রায় আপনার দাদা। তো–বলুন!”

 রত্না বললেন, “দাদা অন্ধ। কথা বলতেও পারেন না। একটা হাত সম্পূর্ণ অবশ।” রত্নার চোখে জল এসেছিল। আলতো হাতে মুছে নিয়ে ফের বললেন, “দাদা আমাকে ইশারায় বলেছিলেন জুয়েল আলমারির দিকে লক্ষ্য রাখতে। দুমাস আগে আমার মায়ের জড়োয়া নেকলেসের হিরেটা উধাও হয়ে গেল!”

“মিঃ বোসকে বলেছিলেন সে-কথা?”

“নাহ্। হি ইজ আ ভেরি সেন্সিটিভ ম্যান। হয়তো রাগ করে চলে যেত। ও চলে গেলে আমরা হেল্পলেস। ও মাথার ওপর ছিল বলেই এখানে টিকে থাকতে পেরেছি। ফ্র্যাংকলি বলছি কর্নেল সরকার। আমার হাজবন্ড অত্যন্ত সাহসী দুর্দান্ত মানুষ। যে কেতন সিং ডাকু আমাকে তুলে নিয়ে যাবে বলে শাসাত, সে এখন ওর পায়ের তলায় কুকুর হয়ে আছে। আই লাভ মাই হাজবন্ড, কর্নেল সরকার!”

“বুঝেছি। তো ওই আলমারির চাবি কার কাছে থাকে?”

“আমার কাছেই থাকত। মায়ের হিরেটা চুরি গেলে চাবি আমার হাজবন্ডকে রাখতে বলেছিলুম। নেয়নি। তাই দাদাকে রাখতে দিয়েছিলুম। তার কাছেই আছে।” রত্না একটু চঞ্চল হয়ে বললেন, “কিন্তু তার পরও কী করে জুয়েল চুরি যেতে পারে?”

“সত্যি চুরি গেছে কি না আগে আপনার সে-বিষয়ে সিওর হওয়া দরকার, রত্না দেবী!”

“হ্যাঁ। এখনই গিয়ে দেখব। কিন্তু কী জুয়েল ছিল এতে?”

“পান্না।”

রত্না ভুরু কুঁচকে বললেন, “আর য়ু সিওর?”

 কর্নেল হাসলেন। “যতদূর জানি, পান্নার রং সবুজ হয়।”

 “আপনার কাছে আছে, নাকি পোলিস কাস্টডতে?”

কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর থেকে জিনিসটা বের করে দিলেন। রত্না সেটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে একটু বাঁকা হেসে বললেন, “আ ব্যাড জোক কর্নেল সরকার! এটা পান্না নয়। এটা সম্ভবত”।

“ঝাড়বাতির কাঁচ!” কর্নেল হাসলেন। “ইভনিং ভিলার হলঘরের ঝাড়বাতিতে ঝালর হিসেবে এগুলো শোভা পাচ্ছে। আমি দেখেছি। আর আপনি বললেন, ব্যাড জোক। কিন্তু এমনও তো হতে পারে, ধরা যাক, ইভনিং ভিলার জুয়েল চোর এই বাংলোতে কাকেও পান্না বলেই বেচতে চেয়েছিল? ধরা যাক্, কোনও বিদেশি স্মাগলিং গ্যাংয়ের কাউকে?

রত্না ভুরু কুঁচকে তাকাল। “বুঝলুম না।”

“আপনি কাল সন্ধ্যায় একটি ডেনিশ মেয়েকে দেখেছেন। তার নাম ক্রিস্নান। বীতশোকবাবুর বন্ধুরা তাকে কৃষ্ণা বলে ডাকে। এনিওয়ে, এর আগে কখনও তাকে দেখেছেন?”

রত্না জোর দিয়ে বললেন, “নাহ্। দেখিনি।”

“আমার ধারণা এই মার্বেল-পেপারগুলোও ইভনিং ভিলা থেকে পাচার হয়েছে। আপনার কী মনে হয়, বলুন?”

রত্না একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “লাস্ট ক্রিসমাসে ইভনিং ভিলায় আমরা পার্টি দিয়েছিলুম। হাথিয়াগড়ে এটা কতকটা য়ুরোপিয়ান–কী বলব, আ সট অব হ্যাংওভার। ট্র্যাডিশনাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও এখানে ক্রিশ্চিয়ান পপুলেশন কম। বিশেষ করে পুরনো এরিয়ার রাস্তাঘাট রঙিন মার্বেল পেপারে সাজানো হয়। অ্যান্ড এভরিহোয়্যার দা সিম্বলিক স্টারস, ইউ নো। উই এনজয়। ইট।”

রত্না শ্বাস ছেড়ে থামলে কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, “জুয়েল-চোর বলে কাকে সন্দেহ হয় আপনার?”

“আমি জানি না। আই কান্ট আন্ডারস্ট্যান্ড ইট।”

 “ইভনিং ভিলায় কি দারোয়ান থাকে না?”

“থাকে। রামবাহাদুর ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। গণেশের একটু অসুবিধে হচ্ছে। তাতে। কিন্তু আপনি যদি গণেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন, আমি বলব সে অত্যন্ত বিশ্বাসী লোক। ছোটবেলা থেকে আছে। তা ছাড়া কয়েকটা কুকুর আছে! ইভন আ বুলডগ, ইউ সি।”

“মালতী?”

রত্না একটু নড়ে বসলেন। “মালতীর পক্ষে জুয়েল চুরি সম্ভব নয়। একেবারে বোকা মেয়ে। একটুতেই কেঁদে ফেলে। শি ওয়জ অ্যান অরফ্যান। দাদা ওকে কোন অনাথ-আশ্রম থেকে এনেছিলেন। গণেশের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। দুটো বাচ্চা আছে।”

“আপনার হাজবান্ড মিঃ বোস?”

“ইমপসিবল!” রত্না ফুঁসে উঠলেন। “আমার প্রপার্টির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি তাকে দেওয়া হয়েছে। কিছু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সেই-ই অপারেট করে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট হয়েছে তার কোম্পানির। আমাকে বলেছে সে-কথা। আমি বলেছি, ডোন্ট ওয়ারি। তা ছাড়া দেখুন, এবার তার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি গভমেন্ট সেক্টরের একটা এক্সটেনশন-প্রজেক্ট হাতে নিতে চেষ্টা করছে। আমিই তাকে বলেছি, টেক দা চান্স হোয়াটেভার মে বি দা রিস্ক।”

“আপনি নিজে কেন কোম্পানির পার্টনার নন রত্না দেবী, টাকাটা যখন আপনারই?”

রত্না একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, “ফ্র্যাংকলি বলছি কর্নেল সরকার! ইভনিং ভিলার বাইরেকার কোনও কিছুর সঙ্গে আমি নিজেকে জড়ানো পছন্দ করি না। আই হেট দা ওয়র্ল্ড আউটসাইড মাই ওন সার্ক। এনিওয়ে, আমার লাইফহিস্টরি আপনাকে শোনাতে আসিনি। এটুকু বলতে পারি, আই লাভ মাই হাজবাড়। বিকজ আইম সোলোনলি ইন দিস উইকেড ওয়ার্ল্ড, কর্নেল সরকার!”

রত্না মুখ নামিয়ে হাতের পার্স নাড়াচাড়া করছিলেন। কর্নেল আস্তে বললেন, “আপনি কি মনে করছেন আপনার স্বামী বিপন্ন এবং সেজন্যই জানতে এসেছেন কে আমাকে হায়ার করেছে?”

 রত্না মুখ তুললেন। একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, “আই স্মেল আ ডেড র‍্যাট সামহোয়্যার।”

“প্লিজ এক্সপ্লেন ইট।”

রত্নার মুখে যুগপৎ আর্তি, হতাশা ও বিপন্নতার এলোমেলো ছায়া পড়ল। একটু পরে মাথা দুলিয়ে বললেন, “আই কান্ট এক্সপ্লেন ইট, কর্নেল সরকার!”

কর্নেল হাসলেন। “আমার ধারণা, আপনি মালতীর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন!”

“করেছি। তবে মালতী”।

রত্না হঠাৎ থেমে গেলে কর্নেল বললেন, “বলুন!”

রত্না একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “ওর তত বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। ও ব্যাপারটা অন্যভাবে দেখছে। ওর মতে, ডাকু কেতন সিংয়ের সঙ্গে আমার হাজবান্ডের মেলামেশাটা ঠিক হচ্ছে না। কেতন সিংই কোনও ক্ষতি করবে।”

“কিন্তু আপনি মিঃ বোসের বিপদের আশঙ্কা করছেন অন্যদিক থেকে। ইজ ইট?”

 রত্না আস্তে বললেন, “হ্যাঁ। সেজন্যই আমার জানা দরকার কে আপনাকে হায়ার করেছে।”

“তাহলে আপনি ভাবছেন আমার ক্লায়েন্টের নাম জানতে পারলেই আপনার কাছে সবটা স্পষ্ট হবে। আই মিন, আপনি ওই ‘ডেড র‍্যাটে’র ব্যাপারটা এক্সপ্লেন করতে পারবেন?”

“সম্ভবত।” বলে রত্না পার্স খুললেন। পার্সে একশো টাকার নোটের বান্ডিল ভর্তি।

কর্নেল দ্রুত বললেন, “সমস্যা হ’ল রত্না দেবী, আমি এখনও জানি না কে। আমার ক্লায়েন্ট। হ্যাঁ, আমি আপনার সঙ্গে একমত। আমার সত্যিই একজন ক্লায়েন্ট আছে। কিন্তু সে আছে আড়ালে। বিশ্বাস করুন, আমিও তাকে খুঁজছি। কারণ আপনার মতো আমারও বিশ্বাস, বসন্ত হাজরা আমার ক্লায়েন্ট ছিলেন না।”

রত্না তার চোখে নিষ্পলক চোখ রেখে বললেন, “ইউ আর আ ভেরি স্ফুড ম্যান কর্নেল সরকার! প্লেয়িং দা ক্যাট অ্যান্ড মাউস গেম।”।

“তা হলে আপনিই বলুন, কাকে আমার ক্লায়েন্ট বলে আপনি সন্দেহ করছেন?”

রত্না পার্স বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কর্নেলের দিকে রুষ্ট চোখে তাকিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন…