১০. রিদি রুহানের দিকে এগিয়ে এসে

রিদি রুহানের দিকে এগিয়ে এসে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব বিপদের মধ্যে পড়েছ।

রুহান একটু কষ্ট করে হেসে বলল, তোমার কী ধারণা?

আমার ধারণা তুমি এবং আমি দুজনেই খুব বিপদের মধ্যে পড়েছি। একজন মানুষের পুরো ব্যবসা তুমি লুট করে নিয়েছ সে কী এটা সহজভা। মেনে নেবে? নেবে না!।

আমি কিছু লুট করি নি। আমি এই মানুষগুলোকে মুক্ত করে দেবার চেষ্টা। করছিলাম।

রিদি শব্দ করে হেসে বলল, তুমি যাদেরকে মুক্ত করেছ তারাও তোমাকে বিশ্বাস করে নি, আর তুমি আশা করছ অন্যেরা বিশ্বাস করবে?

রুহান মাথা চুলকে বলল, কী করা যায় বুঝতে পারছি না।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে সরে যেতে হবে। সবাইকে নিয়ে।

কিন্তু সেটা কীভাবে করব?

ঠিক এরকম সময় তারা দেখতে পেল একজন মানুষ ভিড় ঠেলে তাদের দিকে আসছে। কাছাকাছি এলে তারা মানুষটিকে চিনতে পারল, এজেন্ট দ্রুচেন।

এজেন্ট দ্রুচেন কাছে এসে দুজনের হাত ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, অভিনন্দন। তোমাদের অনেক অনেক অভিনন্দন।

রুহান ভুরু কুঁচকে বলল, কেন? কীসের অভিনন্দন?

তোমরা দুজন মিলে এত বড় একটা সাপ্লাই লুট করে নিলে এটা কী সোজা কথা? কার কাছে বিক্রি করবে ঠিক করেছ কিছু? আমার পরিচিত কিছু খরিদ্দার আছে, খুব ভালো ব্যবসা করে। এখান থেকে পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটার দূরে থাকে, আমি তোমাদের সেখানে নিয়ে যেতে পারি। শতকরা দশ ভাগ কমিশন আমার, আমি আগে থেকে বলে রাখছি।

রুহান কিছু না বলে নিঃশব্দে এজেন্ট দ্রুচানের দিকে তাকিয়ে রইল। দ্রুচান বলল, কী হলো তুমি কথা বলছ না কেন?

রুহান তবু কোনো কথা বলল না। এজেন্ট দ্রুচান বলল, এর থেকে কম কমিশনে আমি কাজ করতে পারব না। অসম্ভব!

রুহান এবারেও কোনো কথা বলল না। দ্রুচান বলল, তোমাদের কী হয়েছে? তোমরা কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন? কত কমিশন দিতে পারবে?

রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা কোনো কমিশন দিতে পারব না এজেন্ট দ্রুচান। তার কারণ আমরা এই মানুষগুলোকে বিক্রি করার জন্যে লুট করি নি! তাদের যেখান থেকে ধরে আনা হয়েছে আমরা সেখানে গিয়ে তাদের রেখে আসব।

এজেন্ট দ্রুচান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী পাগল?

আমি বলেছি এই মানুষগুলোকে যেখান থেকে ধরে আনা হয়েছে আমরা তাদের সেখানে রেখে আসব।

এজেন্ট দ্রুচান একবার রিদির মুখের দিকে তাকাল তারপর মাথা ঘুরিয়ে আবার রুহানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা আমার সাথে ঠাট্টা করছ?

না, আমরা ঠাট্টা করছি না। আমরা সত্যি কথা বলছি।

এজেন্ট দ্রুচান তখনো বিষয়টা বুঝতে পেরেছে বলে মনে হলো না, মাথা চুলকিয়ে বলল, কিন্তু কেন?

রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তার কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে মানুষ কখনো পণ্য হতে পারে না, একজন মানুষকে কখনো পণ্য হিসেবে বেচাকেনা করা যায় না।

এজেন্ট দ্রুচান বাধা দিয়ে বলল, কে বলেছে করা যায় না। সবাই করছে।

তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা মনে করি একজন মানুষ কখনো অন্য মানুষকে বেচা-কেনা করতে পারে না।

এজেন্ট দ্রুচান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আসলেই সেটা যদি তোমাদের পরিকল্পনা হয়ে থাকে তাহলে তোমরা খুব বিপদের মধ্যে আছ!

তোমাদের নিরাপত্তা দেবার কেউ নেই–এই লোক ক্ৰিভনের খুব কাছের মানুষ। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকজন আসবে তোমাদের ধরতে।

রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমারও তাই ধারণা।

তোমাদের এক্ষুনি সরে পড়তে হবে। এই মুহূর্তে।

ঠিকই বলেছ।

কীভাবে পালাবে এখান থেকে?

আমরা ভাবছিলাম তুমি আমাদের নিয়ে যাবে।

আমি? এজেন্ট দ্রুচান অবাক হয়ে বলল, আমি কেন নিয়ে যা যেখানে এক ইউনিট কমিশন নেই সেখানে আমি কেন তোমাদের নিয়ে যাব?

রুহান এজেন্ট দ্রুচানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি নিয়ে যা। কারণ সেটা হবে এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে সাহায্য করার একটা সুযোগ। তুমি তাদের সাহায্য করবে।

এজেন্ট দ্রুচান অবাক হয়ে রুহানের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে যায়, চোখ মুছে নিজেকে। সামলে নিয়ে বলল, তুমি খুব মজার মানুষ। আমি বিশ্বাস করতে পারি না। কেউ একজন তোমার মতো করে কথা বলতে পারে।

রুহান বলল, আমি এমন কিছু বিচিত্র কথা বলি নি। পৃথিবীটা গড়ে উঠে মানুষের জন্যে মানুষের ভালোবাসার কারণে। তুমি যদি এই মানুষগুলো সাহায্য করো তাহলে সেই ভালোবাসাটা অনুভব করতে পারবে। মানুষের জন্যে। ভালোবাসার মতো সুন্দর জিনিস পৃথিবীতে আর কিছু নেই! বিশ্বাস করো।

এজেন্ট দ্রুচান এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না যে তুমি আমাকে এসব বলছ।

রুহান বলল, তুমি বিশ্বাস করবে কী না, সেটা তোমার ব্যাপার। কি আমি যেটা বলছি সেটা সত্যি বলছি।

এজেন্ট দ্রুচান মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, আমি গেলাম। তোমরা কী করবে তোমরাই জান। আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি যে তোমরা যদি এখনই এখান থেকে সরে না পড়ে তোমাদের কপালে দুঃখ আছে। অনেক বড় দুঃখ।

এজেন্ট দ্রুচান চলে যাবার পর রিদি রুহানের সামনে দাঁড়িয়ে বল, তাহলে কী করবে ঠিক করেছ?

আপাতত সরে পড়ি।

কোথায় সরে পড়বে?

পাহাড়ের দিকে যাই। জঙ্গলে ঢুকে পড়ি–সেখানে চট করে কেউ খুঁওে পাবে না।

রিদি মাথা নাড়ল, খুব ভালো একটা পরিকল্পনা হলো বলে মনে হচ্ছে না কিন্তু আর তো কিছু করার নেই। রিদি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, চল তাহলে রওনা দিই।

 

ঘণ্টাখানেক পরে পাহাড়ী পথে রুহান আর রিদি জনা ত্রিশেক নানা বয়সের তরুণ-তরুণী নিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। আবছা অন্ধকার, আকাশে একটা ভাঙ্গা দ, তার মৃদু আলোতে সবাই নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে। ছোট একটা উপত্যকা পার হলে তারা একটা পাহাড়ী রাস্তায় উঠতে পারবে। এই রাস্তা ধরে দক্ষিণে কয়েকশ কিলোমিটার যেতে হবে। কেমন করে যাবে তারা এখনো জানে না।

উপত্যকাটা পার হয়ে তারা পাহাড়ী রাস্তায় এসে ওঠে। কম বয়সী ছেলেমেয়েগুলো পথের পাশে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। আবছা অন্ধকারে তাদের চেহারা দেখা যায় না, শুধু ভাগ্যের উপর অসহায়ভাবে সবকিছু অসমর্পণ করে দেয়ার ভঙ্গিটুকু বোঝা যায়।

রুহান নিচু গলায় বলল, তোমরা বিশ্রাম নেবার জন্যে খুব বেশি সময় পাবে না। আমাদের এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে হবে।

অন্ধকারে বসে থাকা একজন তরুণ জিজ্ঞেস করল, কেন?

তোমাদের যাদের কাছ থেকে ছুটিয়ে এনেছি তারা তোমাদের আবার ধরে–তে আসতে পারে।

অন্ধকারে বসে থাকা তরুণটি বলল, তাতে কী আসে যায়? আমরা তোমাদের হাতে থাকি আর অন্যের হাতে থাকি তাতে কী আসে যায়?

রুহান কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন অনেক দূরে একটা লরির হেডলাইট দেখতে পেল।

রিদি নিচু গলায় বলল, সবাই পিছনে সরে যাও। বনের ভেতরে গিয়ে লুকিয়ে যাও।

আবছা অন্ধকারে বসে থাকা তরুণটি বলল, কেন? কেন আমাদের পিছনে সরে যেতে হবে?

কারা আসছে আমরা জানি না। তারা কী চায় সেটাও জানি না। যদি গোলাগুলি শুরু হয় তোমাদের নিরাপদে থাকা দরকার। মাথা নিচু করে মাটিতে শুয়ে থাক। যাও।

আবছা অন্ধকারে বসে থাকা তরুণ-তরুণীগুলো উঠে দাঁড়িয়ে হুঁটোপুটি করে বনের ভেতরে ছুটে যেতে থাকে। রিদি আর রুহান দুটি বড় গাছের মড়ালে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা লরিটির ইঞ্জিনের চাপা গুঞ্জন শুনতে পেল। দেখতে দেখতে সেটা তাদের কাছাকাছি চলে আসে। রিদি আর রুহান অবাক হয়ে দেখল তাদের কাছাকাছি এসে লরিটি থেমে যায়। তারা ভাবছিল লরির পিছন থেকে অস্ত্র হাতে অনেকগুলো মানুষ নামবে কিন্তু সেরকম কিছু হলো। তারা অবাক হয়ে দেখল শুধু ড্রাইভিং সীট থেকে একজন মানুষ নেমে এলে। আবছা অন্ধকারে তাকে স্পষ্ট দেখা যায় না, চোখে লাগানো ইফ্রারেড গগলসটা শুধু চোখে পড়ে। মানুষটি এদিকে সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ উচ্চস্বরে ডাক, রুহান, রিদি–

রুহান আর রিদি মানুষটির গলার স্বর চিনতে পারে, এজেন্ট দ্রুচান। গাছে। আড়াল থেকে দুজনে বের হয়ে এলো, রুহান বলল, কী ব্যাপার দ্রুচান? তুমি এখানে?

এজেন্ট দ্রুচান বলল, তোমার মানুষজন কোথায়? দেরি করো না, তাড়াতাড়ি ওঠো লরিতে। তোমাদের খোঁজে বিশাল বাহিনী রওনা দিচ্ছে।

রুহান এজেন্ট দ্রুচানের কাছে গিয়ে নরম গলায় বলল, আমি জানতাম তুমি আসবে।

এজেন্ট দ্রুচান বিরক্ত গলায় বলল, বাজে কথা বলো না। আমি নিজে জানতাম না আর তুমি কেমন করে জানতে?

তুমি না জানতে পার, কিন্তু আমি জানতাম। এই পৃথিবীটা টিকে যাণে কেন তুমি জান এজেন্ট দ্রুচান?

আমার এত বড় বড় জিনিস জানার কোনো সখ নেই রুহান। আমি শুধু জানি যদি এক্ষুনি এই লরিতে সবাই না ওঠো তাহলে কিন্তু কেউ পৌঁছাতে পারবে না।

রুহান এজেন্ট দ্রুচানের কথাটা না শোনার ভান করে বলল, এই পৃথিবীট। টিকে যাবে কারণ মানুষের ভেতরে এখনো মনুষ্যত্বটুকু বেঁচে আছে।

এজেন্ট দ্রুচান বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি যে কী বাজে বকতে পারো রুহা। সেটা অবিশ্বাস্য।

 

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় পাহাড়ী পথ দিয়ে লরিটি ছুটে যাচ্ছে। সামনের ড্রাইভিং সিটে এজেন্ট দ্রুচানের পাশে বসেছে রিদি। পিছনে অন্য সবার সাথে বসেছে রুহান। রুহান পিছনের খোলা অংশ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। লরির ভেতরে চুপচাপ বসে আছে অন্য সবাই।

বসে থাকতে থাকতে রুহানের চোখে হঠাৎ একটু ঘুমের মতো এসেছিল। হঠাৎ করে তার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল, তার কোলের উপর রাখা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা কেউ একজন হ্যাচকা টান দিয়ে সরিয়ে নিয়েছে। রুহান মাথা ঘুরিয়ে দেখে মানুষটি ক্রিটিনা। সে অস্ত্রটা তার দিকে তাক করে ধরে রেখেছে, আবছা অন্ধকারেও বোঝা যায় তার চোখ ধকধক করে জ্বলছে। রুহান কোনো কথা না বলে স্থির চোখে ক্রিটিনার দিকে তাকিয়ে রইল।

ক্রিটিনা হিংস্র গলায় বলল, লরি থামাও।

কেন?

আমরা নেমে যাব।

কোথায় নেমে যাবে?

সেটা তোমার জানার প্রয়োজন নেই।

রুহান বলল, ক্রিটিনা, আমরা তোমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করছি।

তোমাদের সাহায্যের কথা আমি খুব ভালো করে জানি! তোমরা হচ্ছ খুনে ৬াকাত ঠগ আর প্রতারক–

আমার কথা শোনো—

ক্রিটিনা চিৎকার করে বলল, আমি কোনো কথা শুনব না। লরি থামাও।

যদি না থামাই? তোমাকে আমি খুন করে ফেলব।

রুহান হাসার চেষ্টা করল, যদিও আবছা অন্ধকারে সেটা কেউ দেখতে পেল না। সে নরম গলায় বলল, খুন করে ফেলবে?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে। করো খুন।

ক্রিটিনা হিংস্র গলায় বলল, আমাকে রাগানোর চেষ্টা কর না–

রুহান বলল, আমি তোমাকে মোটেও রাগানোর চেষ্টা করছি না, ক্রিটিনা আমি তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। তুমি বুঝতে চাইছ না। আমি তোমাকে বলেছি, তোমাদের আমরা তোমাদের গ্রামে নিয়ে যেতে যাচ্ছি–

মিথ্যে কথা বলবে না। ক্রিটিনা চিৎকার করে বলল, আমার সাথে মিথ্যে কথা বলবে না।

ঠিক আছে, আমি আর কথাই বলব না।

খুন করে ফেলব তোমাদের সবাইকে।

কীভাবে খুন করবে?

গুলি করে খুন করব।

তুমি কী আগে কখনো এরকম অস্ত্র ব্যবহার করেছ? তুমি কী জান কেমন করে গুলি করতে হয়?

ক্রিটিনাকে এক মুহূর্ত একটু ইতস্তত করতে দেখা যায়। ইতস্তত করে বলে, সব অস্ত্রই এক। আমি জানি ট্রিগার টানলেই গুলি হয়।

না। রুহান মাথা নাড়ল, নিরাপত্তার কিছু ব্যাপার থাকে। ট্রি। টানলেই গুলি হয় না। আমার কথা বিশ্বাস না করলে তুমি ট্রিগার টেনে দেখতে পার।

ক্রিটিনা ইতস্তত করে অস্ত্রটা বাইরে তাক করে ট্রিগার টানল, ঘট করে একটা শব্দ হলো কিন্তু কোনো গুলি হলো না। রুহান বলল, এখন আমার বা বিশ্বাস হলো? তুমি অস্ত্রটা আমার কাছে নিয়ে এসো, আমি তোমাকে দেখি দেই কেমন করে সেফটি লিভারটা টানতে হয়।

আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।

ঠিক আছে, তাহলে অস্ত্রটা আমাকে দিতে হবে না। তুমি নিজেই কর। ডানপাশে উপরের লিভারটা টেনে নিজের দিকে আন।

ক্রিটিনা অনিশ্চিতের মতোন লিভারটি নিজের দিকে টেনে আনে। রুহান পরিতৃপ্তির মতো শব্দ করে বলল, চমৎকার! এখন তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে গুলি করে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারবে। বিশ্বাস না করলে পরীক্ষা করে দেখ!

ক্রিটিনা অস্ত্রটা বাইরে তাক করে ট্রিগার টানতেই ভয়ঙ্কর শব্দ করে অস্ত্রটি গর্জন করে ওঠে। লরির ভেতরে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলো ভয় পেয়ে চিৎকার করে পিছনে সরে যায়। সামনে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা রিদি এবং দ্রুচান গুলির শব্দ শুনে কারণটা বোঝার জন্যে রাস্তার পাশে লরি থামিয়ে নেমে আসে। রিদি চাপা গলায় বলে, কী হয়েছে রুহান?

বিশেষ কিছু না। রুহান হালকা গলায় বলল, কেমন করে অস্ত্র চালান হয় তার একটা ছোট ট্রেনিং হচ্ছে।

রিদি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, তোমার মাথা খারাপ রুহাব। এটা কী ট্রেনিং দেবার সময়?

রুহান শব্দ করে হেসে বলল, ট্রেনিংয়ের সময় অসময় বলে কিছু নেই রিদি। তোমরা সেটা নিয়ে চিন্তা কর না। যাও লরি চালাতে থাক।

কিছুক্ষণের মধ্যে আবার লরি চলতে শুরু করে। লরির পেছনে বসে থেকে কিছুই হয়নি এরকম একটা ভঙ্গি করে রুহান শিস দিয়ে একটা সুর তোলার চেষ্টা করতে থাকে। ক্রিটিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি কী লিভার আবার সামনে ঠেলে দেব?

তুমি যদি অস্ত্রটা এই মুহূর্তে ব্যবহার করতে না চাও তাহলে সেটাই নিরাপদ।

ক্রিটিনা লিভারটি ঠেলে দিয়ে অস্ত্রটা রুহানের দিকে এগিয়ে দেয়। বলে, নাও।

কী নেব?

এই অস্ত্রটা।

রুহান বলল, তোমার কাছে রাখ।

আমার কাছে রাখব?

হ্যাঁ।

কেন?

দুটি কারণে। এক, আমি চাই তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর, যে সত্যিই আমরা তোমাদেরকে তোমাদের এলাকায় ফিরিয়ে দিতে চাই। দুই, আমার কাছে আরো একাধিক অস্ত্র আছে, তুমি যেহেতু অস্ত্র চালাতে শিখেই গেছ, এটা তোমার কাছে থাকলে আমাদের নিরাপত্তা বেশি হয়। যদি দরকার হয় তাহলে তুমিও এটা ব্যবহার করতে পারবে।

ক্রিটিনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি দুঃখিত, রুহান আমি যে তোমার কোনো কথা বিশ্বাস করি নি।

এখন করেছ?

তোমাকে বিশ্বাস করেছি, তোমার কথা এখনো বিশ্বাস করি নি।

রুহান শব্দ করে হেসে বলল, আমাকে যদি বিশ্বাস কর তাহলে আগে হোক পরে হোক একদিন আমার কথাকেও বিশ্বাস করবে।

ক্রিটিনা অস্ত্রটা কোলের উপর রেখে রুহানের পাশে বসল। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা কেন আমাদের উদ্ধার করছ?

রুহান বলল, আমি জানি না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, উত্তরটা পছন্দ হয়েছে?

হ্যাঁ। পছন্দ হয়েছে।

কেন?

পৃথিবী থেকে ভালো উঠে গেছে। এটা আবার ফিরে আসবে। এভাবেই আসবে। কেউ জানবে না কেন আসছে। আসবে গোপনে।

রুহান ক্রিটিনার দিকে তাকাল, আবছা অন্ধকারে তার চেহারাটা ভালো। করে দেখা যায় না। চেহারায় এক ধরনের বিষাদের ছাপ।

 

খুব ভোরবেলা লরিটি থামল। পিছনের দরজা খুলে প্রথমে রুহান তার পিছু ক্রিটিনা নেমে এলো, তারপর অন্য সবাই লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকে। কয়েক ঘণ্টা আগেও সবার ভেতরে একটা চাপা আশঙ্কা কাজ করছিল। যখন বুঝতে পেরেছে যে আসলেই সবাইকে তাদের নিজের এলাকাতে নিয়ে যাও হচ্ছে তখন হঠাৎ করে সবার ভেতরে এক ধরনের নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার ফুরফুরে আনন্দ এসে ভর করেছে। লরি থেকে নেমে সবাই হৈ চৈ চেচামেচি করতে থাকে–যারা একটু ছোট তারা ছোটাছুটি শুরু করে দেয়।

এজেন্ট দ্রুচান লরির নিচে থেকে একটা বাক্স টেনে নামিয়ে আনে, সেটা খুলতেই ভেতর থেকে শুকনো খাবার আর পানীয় বের হয়ে আসে। সবার মধ্যে সেটা ভাগ করে দিতে দিতে বলল, তাড়াতাড়ি সবাই খেয়ে নাও, আমরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রওনা দেব।

কমবয়সী একটা মেয়ে বলল, কেন আমাদের এক ঘণ্টার মধ্যে রওনা দিতে হবে? আমরা কী জায়গাটা একটু ঘুরে দেখতে পারি না?

এখানে দেখার মতো কিছু নেই।

মেয়েটি বলল, কে বলেছে নেই? ঐ যে দূরে একটা কাচের ঘর দেখা যাচ্ছে।

এজেন্ট দ্রুচান বলল, এটা একটা পুরানো মান-মন্দির। ভেঙ্গে চুরে আছে, দেখার মতো কিছু নেই।

কে থাকে ওখানে?

কেউ থাকে না। সাপ খোপ থাকলে থাকতেও পারে।

মেয়েটি আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, আমার সাপখোপ দেখতে খুন। ভালো লাগে। আমি কী দেখতে যেতে পারি?

রুহান বলল, ঠিক আছে যাও। সাপ-খোপ বাঘ সিংহ যেটা ইচেছ দেখতে যেতে পার তবে এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসতে হবে। তোমরা জান তোমাদে: ধরার জন্যে পিছু পিছু অনেক মানুষ আসছে।

একটা ছেলে কঠিন মুখে বলল, আসুক না ধরতে! ওদের বারটা বাজি? ছেড়ে দেয়া হবে না?

রুহান জানতে চাইল। বলল, কে বারটা বাজাবে?

ছেলেটি এক গাল হেসে বলল, কেন? তুমি? তুমি আর রিদি। তোমরা পৃথিবীর সেরা খেলোয়াড়, তোমাদের কাছে কে আসবে?

আশেপাশে যারা ছিল সবাই আনন্দের মতো একটা শব্দ করল।

 

সবাই চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবার পর এজেন্ট দ্রুচান তার লরিটার কাছে 1য়ে বনেট খুলে ইঞ্জিনের দিকে উঁকি দেয়। কিছু একটা দেখে সে হঠাৎ শিস দেয়ার মতো শব্দ করে। রুহান জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

এজেন্ট দ্রুচান বলল, সমস্যা।

কী সমস্যা।

ইঞ্জিনের কুলেন্ট পাইপে লিক। সব কুলেন্ট পড়ে যাচ্ছে।

কীভাবে হলো?

পুরানো ইঞ্জিন সেটা হচ্ছে সমস্যা। ভালো কুলেন্ট পাওয়া যায় না, জোড়াতালি দিয়ে তৈরি হয় সেটা আরেকটা সমস্যা।

রুহান জিজ্ঞেস করল, তাহলে এখন কী করবে?

কুলেন্টের পাইপগুলো পাল্টাতে হবে।

কী দিয়ে পাল্টাবে?

আমার কাছে বাড়তি পাইপ আছে, কিন্তু ওয়েল্ডিং করতে হবে। একটু সময় নেবে।

রিদি পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, একটু কাছে এগিয়ে এসে বলল, এজেন্ট দ্রুচান, আমি তোমাকে সাহায্য করি?

এজেন্ট দ্রুচান বলল, তার চাইতে বেশি দরকার একটু রাস্তার দিকে লক্ষ্য এখা, হঠাৎ করে যদি আমাদের ধরতে চলে আসে তখন মহা বিপদ হবে।

রুহান বলল, ঠিক আছে আমি সেটা দেখছি।

রিদি জানতে চাইল, কীভাবে দেখবে?

রুহান পিছনে তাকিয়ে বলল, আমি ঐ মানমন্দিরটার উপরে গিয়ে দাঁড়াই, তাহলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাব।

রিদি মাথা নেড়ে বলল, যাও।

এজেন্ট দ্রুচান তার গলায় ঝোলানো বাইনোকুলারটি রুহানের হাতে দিয়ে বলল, এটা নিয়ে যাও।

ক্রিটিনা কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, রুহান, আমি কী তোমার সাথে যেতে পারি?

অবশ্যই যেতে পার ক্রিটিনা। মান-মন্দিরের উপরে একা একা দাঁড়িয়ে না থেকে দুজনে মিলে দাঁড়ালে সময়টা ভালো কাটবে। চল।

এক সময়ে এই এলাকায় জনবসতি ছিল এখন নেই। যে ছোট নুড়ি পাথরের রাস্তাটা ঘুরে ঘুরে মানমন্দির পর্যন্ত উঠে গেছে সেটা নানারকম ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে তারা মানমন্দিরের কাছে এসে দাঁড়ায়। ভাঙ্গা মানমন্দিরের ভেতর থেকে তারা ছেলে-মেয়েদের চেচামেচি শুনতে পায়। তাদের কলরব শুনলে মনে হয় তারা বুঝি কোনো একটা আনন্দোৎসবে এসেছে।

মানমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিটিনা কপালের ঘাম মুছে বলল, কে গরম দেখেছ?

হ্যাঁ। বেশ গরম। রুহান একটু অবাক হলো, তারা সরাসরি রোদে দাঁড়িয়ে নেই, তাছাড়া সূর্যের আলো এখনো এত প্রখর হয়নি, কিন্তু এখানে তবু বেশ গরম। রুহান কারণটা ঠিক বুঝতে পারে না। মানমন্দিরটা কাচ দিয়ে তৈরি। বিভিন্ন জায়গায় কাচ ভেঙ্গে আছে, ফেটে আছে। লতাগুল্ম দিত। মানমন্দিরটা স্থানে স্থানে ঢেকে আছে তবুও বোঝা যায় এটি এক সময় চমৎকার একটা বিল্ডিং ছিল। রুহান উপরে উঠার সিড়ি খুঁজে বের করার জন্যে মানমন্দিরের ভেতরে ঢুকে আবিষ্কার করে ভেতরে বেশ ঠাণ্ডা। রুহান ক্রিটিনার দিকে তাকিয়ে বলল, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ ক্রিটিনা?

কী?

এটা একটা কাচের ঘর, ভেতরে ঠাণ্ডা কিন্তু বাইরে গরম।

তার মানে কী?

মানমন্দিরের কাচ সূর্যের আলোর তাপের অংশটিকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না, এটা বাইরে প্রতিফলিত হচ্ছে, সেজন্য বাইরে গরম। শুধু দৃশ্যমান আলোটা ঢুকতে দিচ্ছে ভিতরে, সেজন্যে ভেতরে অনেক আলো কিন্তু গরম নেই, ঠাণ্ডা।

ভারি মজা তো।

হ্যাঁ। এলাকটা নিশ্চয়ই উষ্ণ। মানমন্দিরকে ঠাণ্ডা রাখার জন্যে এরকম কাচ লাগানো হয়েছে।

ঠিকই বলেছ।

রুহান আর ক্রিটিনা কথা বলতে বলতে মানমন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যেতে থাকে। অনেক উঁচু মানমন্দির, ছাদে পৌঁছানোর পর তারা আবিষ্কার করল এখানে দাঁড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। যে রাস্তা ধরে তারা এসে সেই রাস্তাটি পাহাড়কে ঘিরে ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে। চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে তারা প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে। রুহান চারদিকে তাকিয়ে দেখে–যতদূর দেখা যায়, ফাঁকা ধূ ধূ পাহাড়, জনমানবের চিহ্ন নেই। পুরো দৃশ্যটাতে এক ধরনের মন খারাপ করা বিষয় রয়েছে, ঠিক কী কারণে মন খারাপ হয় সেটা বুঝতে না পেরে রুহান এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে।

মানমন্দিরের ছাদে দাঁড়িয়ে তারা দেখতে পায় ছেলেমেয়েগুলো বাইরে ছুটোছুটি করছে। এখন তাদের দেখে বোঝাই যায় না যে সবাইকে মায়ের বুক থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পণ্য হিসেবে বিক্রি করার জন্যে। মনে হচ্ছে তারা বুঝি কোথাও পিকনিক করতে এসেছে।

মানমন্দিরের ছাদে দুজন ইতস্তত হাঁটে। চারপাশে বন জঙ্গল। এখানে জনবসতি কখনোই ছিল না, এক সময় হয়তো মানমন্দিরটা চালু ছিল তখন কিছু মানুষজন থাকত, আসত-যেত। এখন কেউ নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানে এখন মানুষের কোনো আগ্রহ নেই, উৎসাহ নেই।

রুহান–ক্রিটিনার গলার স্বর শুনে রুহান ঘুরে তাকাল। ক্রিটিনা বলল, তোমাকে আমার একটা কথা বলা হয়নি।

কী কথা?

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

রুহান হেসে বলল, কী জন্যে ধন্যবাদ?

আমাদের উদ্ধার করে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছ, সেজন্যে নয়। সেজন্যে কৃতজ্ঞতা। কিন্তু ধন্যবাদ অন্য কারণে–

কী কারণে?

এই যে আমি তোমাকে বলছি তোমাকে অনেক ধন্যবাদ—এই কথাটি বলার সুযোগ করে দেবার জন্যে। এরকম কথা বলাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে পৃথিবীটা হচ্ছে স্বার্থপর নিষ্ঠুর একটা জায়গা। এখানে সবাইকে হতে হবে হিংস্র আর স্বার্থপর। যার যেটা প্রয়োজন সেটা কেড়ে নিতে হবে। এখানে ভালোবাসা আর মমতার কোনো স্থান নেই।

ক্রিটিনা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমিও একজন হিংস্র মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। তুমি একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে সেটা ভুল। তুমি আবার আমার ভিতরে মানুষের উপরে বিশ্বাস ফিরিয়ে নিয়ে এসেছ। এই বিশ্বাসের কারণে আমি হয়তো খুব বিপদে পড়ব। হয়তো আমার দুঃখ হবে, কষ্ট হবে, যন্ত্রণা হবে, কিন্তু তবু আমি এই বিশ্বাসটা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।

কথা বলতে বলতে ক্রিটিনা দূরে তাকাল এবং হঠাৎ করে তার চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে যায়। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, রুহান!

কী হয়েছে?

ঐ দেখ–

রুহান ক্রিটিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে দূরে তাকায়, বহুদূরে পাহাড় ঘিরে রাস্তাটি উঠে এসেছে। সেই রাস্তায় অনেকগুলো গাড়ি একটা কনভর। গাড়িগুলো এইদিকে আসছে। ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে এগুলো এখানে পৌঁছে যাবে।

কেউ বলে দেয়নি কিন্তু তারা জানে এই কনভয়গুলো আসছে তাদের ধরে নেয়ার জন্যে।