১০. রাত দুটার মতো বাজে

রাত দুটার মতো বাজে।

মহসিন খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামলেন। দীপা অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই সে তৃপ্তির একটা শব্দ করল। খানিকক্ষণের জন্যে তিনি অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। একবার মনে হল আবার বিছানায় ফিরে আসবেন। পরমুহূর্তেই সেই পরিকল্পনা বাতিল করে খালি পায়ে সিড়ি বেয়ে একতলায় নেমে গেলেন। খুব সাবধানে দরজা খুলে বারান্দায় এলেন। যদিও এত সাবধানতার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি হাঁটছেন নিজের বাড়িতে। কেউ তাঁকে দেখলেও কিছু যায় আসে না। তিনি যাচ্ছেন নিশানাথের ঘরে। এর মধ্যেও অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। তিনি তো যেতেই পারেন। নিশানাথ একজন রুগী মানুষ। রাত-বিরেতে তাঁকে দেখতে যাওয়াই তো স্বাভাবিক।

নিশানাথের ঘরে ঢোকাও কোনো সমস্যা নয়। তাঁর ঘরের দরজা খোলা থাকে, যাতে সময়ে-অসময়ে তাঁর ঘরে যাওয়া যায়।

মহসিন ছোট-ঘোট পা ফেলে এগোচ্ছেন। আকাশ মেঘলা। তাঁর শীতশীত করছে। পায়েও ঠাণ্ডা লাগছে। চটি জোড়া পরে নিলে হত। নিশানাথ বাবুর ঘরের কাছাকাছি আসতেই তিনি কপালের বাঁ দিকে ভেতা এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করলেন। হালকা যন্ত্ৰণা। তিনি ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। যন্ত্রণাটা কেমন করে জানি সারা মাথায় ছড়িয়ে পড়ছে। এর মানে কী? নিশানাথ কি তার মাথায় ঢুকে পড়েছে? এও কি সম্ভব! এটা কি বিশ্বাস্য?

অসম্ভব নয়। এই অদ্ভুত পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়। ইস্ত্রির কথা দীপাকে বলা হয়েছে যখন, তখন সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। মহসিন দ্রুত এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন। তাঁর হাতে সময় নেই।

সময় নেই নিশানাথের হাতেও। নিশানাথ মহসিনের মাথার ভেতর ঢুকে গেছেন। তাঁকেও অতিদ্রুত কাজ করতে হচ্ছে। মহসিনের মাথা থেকে মুশরাত জাহান নামের মেয়েটির সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলতে হবে। কঠিন কাজ। একটি স্মৃতি দশটি স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। অন্যগুলি নষ্ট না করে সেই স্মৃতি নষ্ট করা যায় না। স্মৃতির জাল দীর্ঘ ও সূক্ষ্ম। মাকড়সার জালের মতো তা ছড়ানো। এই জাল থেকে একটি সুতো ছিঁড়ে ফেলতে হবে। এমন ভাবে ছিড়তে হবে যেন জালের কোনো ক্ষতি না হয়। কঠিন কাজ। অতি কঠিন কাজ হাতে সময় এত অল্প। মহসিনের মনের ভেতর থেকে কুটিল ক্রোধ, ভয়ঙ্কর ঘৃণাও নষ্ট করে দিতে হবে, যেন প্রবল ভালোবাসা জেগে ওঠে দীপা নামের অসাধারণ মেয়েটির দিকে। যে মেয়েটির জন্ম দেবী অংশে। সময় নেই। মোটেই সময় নেই। কঠিন কাজ। ভয়ঙ্কর কঠিন কাজ।

 

মহসিন নিশানাথের ঘরে ঢুকে পড়েছেন। নিশানাথ কাত হয়ে শুয়ে আছেন। পায়ের কাছে কোলবালিশ। মহসিন কোলবালিশ হাতে তুলে নিলেন। তাঁর হাত একটু কাঁপছে। মাথায় যন্ত্রণা প্রবল হয়ে উঠছে। উঠুক। তিনি তাঁর কাজ শেষ করবেন। সারা জীবন তিনি তাঁর পরিকল্পনা অক্ষরে অক্ষরে কাজে খাটিয়েছেন। আজও খাটাবেন। এর কোনো নড় চড় হবে না। কিন্তু মাথা যেন এলোমলো হয়ে যাচ্ছে। বড় অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। বমি-বমি ভাব হচ্ছে। হোক। যা ইচ্ছা হোক। তিনি নিচু হয়ে নিশানাথের মুখের উপর বালিশ চেপে ধরলেন।

 

সময় শেষ হয়ে এসেছে। আর মাত্র কয়েক মুহূর্ত। নিশানাথ মৃত্যুর স্বরূপ বুঝতে পারছেন। বড়োই আফসোস, কাউকে তা জানাতে পারছেন না। কারণ তাঁর কাজ শেষ হয় নি। এখনো কিছু কাজ বাকি আছে। মহসিন এই মুহূর্তে একটি খুন করছে। এই খুনের স্মৃতিও তার মাথা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এই ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে সে স্বাভাবিক মানুষের জীবন যাপন করতে পারবে না। এই স্মৃতিও নষ্ট করতে হবে। সময় নেই। এক অণুপল সময়ও নষ্ট করা যাবে না। আহ্, যদি কিছু সময় থাকত, তাহলে মৃত্যুর স্বরূপ অন্য কাউকে বলে যেতে পারতেন পুধু একটি কথা যদি বলতে পারতেন যদি জানিয়ে যেতে পারতেন ভয়াবহ নয়, কুৎসিত নয়। মৃত্যুর সৌন্দর্য জন্মের চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। কাকে জানাবেন? মহসিনকে? মন্দ কি? কেউ এক জন জানুক।

 

মহসিন সাধারণত খুব ভোরবেলায় জাগেন। আজ ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। দীপা ডেকে তুলে বললেন,–তোমার একটা জরুরি টেলিফোন। মহসিন আধো ঘুমে টেলিফোন রিসিভারে মুখ লাগিয়ে বললেন, কে?

ওপার থেকে মধুর স্বরে বলা হল আমি।

আমিটা কে?

আমি নুশরাত জাহান–নুশা।

নুশা মানে–নুশা কে?

ওপাশ থেকে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলা হল, আমি তোমার নুশা।

মহসিন বিস্মিত ও বিরক্ত হলেন।

তুমি এমন করছ কেন? আমি নুশা।

মহসিন টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। বিছানার পাশে দীপা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখ জলে ভেজা। সেই দিকে তাকিয়ে মহসিনের মন মায়ায় ভরে গেল। এত গভীর মায়া, এত গভীর মমতা তার ভেতর আছে, তা তিনি কখনো বোঝন নি। এই মমতার উৎস কী? তিনি হাত বাড়িয়ে দীপাকে স্পর্শ করলেন। দীপা নিচু গলায় বলল, নিশানাথ চাচা কাল রাতে মারা গেছেন।

দীপার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে। মহসিনের চোখ ভিজে উঠল। তিনি গভীর বেদনা বোধ করলেন। ফিসফিস করে বললেন, মৃত্যু নিয়ে মন খারাপ করতে নেই দীপা। মৃত্যুও আনন্দময়। আমরা জানি না বলেই ভয় পাই।

এইটুকু বলেই তিনি চমকে উঠলেন। কেন এ রকম একটা অদ্ভুত কথা বললেন, ভেবে পেলেন না। তাঁর মনে হল, এই কথাগুলি স্বপ্নে পেয়েছেন। হ্যাঁ, অদ্ভুত একটা স্বপ্ন তিনি কাল রাতে দেখেছেন। যেন খুব একটা শীতের রাত খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে কোথায় যেন যাচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছেন?

দীপা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তাঁর গাল অশ্রুতে ভেজা। মহসিন সেই অঞ মুছিয়ে দিতে চেষ্টা করছেন। তিনি গাঢ় স্বরে ডাকলেন, দীপা।

দীপা কিছু বলল না।

তিনি বললেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি, দীপা। এরকম করে কেঁদো না। আমার কষ্ট হচ্ছে। সত্যি কষ্ট হচ্ছে।

বলতে-বলতে সত্যি-সত্যি তাঁর চোখে জল এসে গেল। এই পৃথিবীতে চোখের জলের মতো পবিত্র তো আর কিছু নেই। এই পবিত্র জলের স্পর্শে সব গ্লানি—সব মালিন্য কেটে যায়।