১০. রাতের খাবার দেয়া হয়েছে

রাতের খাবার দেয়া হয়েছে।

রূপা বলল, আমি আগে আগে খোশ, নেব। আমার ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে। মিনু বলল, তুমি আমার সঙ্গে খাবে রূপা। সেকেন্ড ব্যাচে।

ভাবি তুমি তো খাও থার্ড ব্যাচে। রাত এগারোটা বাজে খেতে খেতে।

আজ তুমিও রাত এগারোটায় খাবে। এসো আমার ঘরে। তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কিছু কথা আছে।

ক্ষিধেয় তো মরে যাচ্ছি ভাবি।

মিনু গম্ভীর গলায় বলল, মানুষ এত সহজে মরে না রূপা।

রূপা মিনুর ঘরে ঢুকল। ভাবি কী বলবেন তা সে আঁচ করতে পারছে। তানভিব সব কিছুই প্ৰকাশ করেছে। সে নিশ্চয় জনে জনে বলে নি। প্রথমে বলেছে ভাইয়াকে, সেখান থেকে শুনেছে ভাবি, ভাবির কাছ থেকে শুনেছে মা। মার কাছ থেকে বাবা। সবাই অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকে দেখছে। বাবা তখন থেকে বাবান্দায় বসে আছেন। বাবার এমন গম্ভীর মুখ সে এর আগে কখনো দেখে নি।

মিনু ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। রূপা বলল, দরজা বন্ধ করছ, কেন ভাবি?

তোমার সঙ্গে যে-বিষয় নিয়ে কথা বলব আমি চাই না তা কেউ শুনুক, এই জন্যেই দরজা বন্ধ করছি। তুমি পা তুলে আরাম করে বিছানায় বস।

রূপা তাই করল। মিনু বলল, তুমি তানভির সাহেবকে কী বলেছ?

অনেক কিছুই তো বলেছি। তুমি কোনটা জানতে চাচ্ছি?

অনেক কিছু মানে কী?

অনেক কিছু মানে অনেক কিছু। আমি প্রচুর বকবক করেছি।!

তুমি যে প্রচুর বকবক করেছ তা বুঝতে পারছি। বকবক করতে গিযে ভয়ঙ্কর সব কথা বলেছ।

আমি কোনো ভয়ঙ্কর কথা বলি নি।

অবশ্যই বলেছি–তুমি কি বলে নি যে ঘাটের মরা ঐ বুড়ো মাস্টার সাহেবের প্রেমে তুমি হাবুড়ুবু খাচ্ছ?

বলেছি।

মিনু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি তুমি ঠাট্টা করে বলেছ। আমিও তানভিব সাহেবকে তাই বললাম। কিন্তু রূপা এই জাতীয় ঠাট্টা কবা কী উচিত? তানভির সাহেব বুদ্ধিমান মানুষ। তাকে যখন বলেছি–রূপা, ঠাট্টা করেছে, তিনি একসেপ্ট করেছেন। অন্য কেউ তো তা কববে না।

রূপা বলল, তোমাদের তানভিব সাহেব মোটেই বুদ্ধিমান নন। বুদ্ধিমান হলে তিনি বুঝতে পারতেন আমি তাঁর সঙ্গে মোটেই ঠাট্টা করি নি।

কী বলছ তুমি রূপা?

সত্যি কথা বলছি ভাবি।

সত্যি কথা বলছ?

হ্যাঁ, সত্যি কথা বলছি।

তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

হ্যাঁ ভাবি মাথা খারাপই হয়েছে। অব কিছু বলবে?

মিনু বলার মতো কিছু পেল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। রূপা বলল, তুমি কি আরো কিছু বলবে?

বলব।

বলো, আমি শুনছি…।

মিনু কিছু বলতে পারল না, কারণ তার মাথা পুরোপুরি গুলিয়ে গেছে। মাথায় কোনো কিছুই আসছে না। রূপাকে দেখে এখন তার মনে হচ্ছে কিছু বলে লাভ নেই। এই মেয়েটি এখন আর কিছুই শুনবে না। সে বাস করছে অন্য জগতে।

রূপা বলল, ভাবি, আমি এখন যাই। তুমি আমাকে কী বলবে ভেবে ঠিকঠাক করে রাখ। পরে শুনব।

বাইরের ঘরের বারান্দায় তানভির হাঁটাহঁটি করছে। তার হাতে জ্বলন্ত সিগাবেট। বাবান্দা অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জ্বলন্ত সিগারেটের উঠানামা থেকে বোঝা যায় এখানে একজন মানুষ আছে যে বারান্দার এ-মাথা থেকে ও-মাথায় যাচ্ছে।

কাঁপা বারান্দায় এসে তীক্ষ্ণ গলায় ডাকল, একটু শুনে যান তো! তানভির এগিয়ে এলো। রূপা বলল, আপনাকে বলেছিলাম কাউকে কিছু না বলতে। আপনি সবাইকে বলে বেড়িয়েছেন, তাই না?

তানভির বলল, বলা প্রয়োজন বোধ করেছি বলেই বলেছি।

প্ৰয়োজন বোধ করলেন কেন?

ভয়ঙ্কর কোনো ভুল কেউ করতে গেলে তাকে ভুল দেখিয়ে দিতে হয়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হয়।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ, তাই। তোমান বয়স কম। কাজেই তুমি বুঝতে পারছি না। তুমি কী বলছি কিংবা কী করছ।

আপনার ধারণা আমি ভয়ঙ্কর একটা ভুল করেছি?

অবশ্যই।

কেউ যদি ইচ্ছা কবে ভুল করতে চায় তাকে কি ভুল করতে দেয়া হবে না?

না।

কোনটা ভুল কোনটা শুদ্ধ তা আপনি নিজে জানেন?

সব জানি না। তবে তোমার চেয়ে বেশি জানি।

আপনার বয়স আমার চেসে বেশি, তাই বেশি জানেন?

বয়স একটা ফ্যাক্টব তো বটেই!

যে গাধা সে আশি বছবেও গাধা থাকে, বয়স কোনো ফ্যাক্টর না।

রূপা, আমি গাধা নাই।

তা নন। তবে আপনি খুব বুদ্ধিমানও নন।

খুব বুদ্ধিমান নই তা কেন বলছ?

খুব যারা বুদ্ধিমান তারা তাদের বুধিব ধার অন্যকে দেখাবার জন্যে ব্যস্ত থাকে না। অল্পবুদ্ধির মানুষরাই অন্যদের বুদ্ধির খেলা দেখাতে চায়। অন্যদের চমৎকৃত করতে চায়। বুদ্ধিমানরা তা চায় না। কারণ তারা জানে তার প্রয়োজন নেই।

আমি কী বুদ্ধির খেলা দেখাতে গিয়েছি?

অবশ্যই গেছেন। আপনার কিছু তৈরি গল্প আছে। যে সব গল্প বলে আপনি চমক লাগাবার চেষ্টা করেন। যেমন–মোনালিসার গল্প। গল্প বলার সাজ-সরঞ্জামও আপনার সঙ্গে থাকে। মানিব্যাগে থাকে ছোট্ট মোনালিসার ছবি। এই গল্প আমাদের বলার আগে আপনি শ খানেক লোককে আগে বলেছেন। সবাই চমৎকৃত হয়েছে।

তুমি হও নি?

আমিও হয়েছিলাম। কিন্তু যেই মুহুর্তে আপনি মানিব্যাগ থেকে ছবি বের করলেন। সেই মুহুর্তেই বুঝলাম মানুষ হিসেবে আপনি খুবই সাধারণ।

তোমার ঐ স্যার বুঝি মানুষ হিসেবে অসাধারণ।

হ্যাঁ। আমার কাছে অসাধারণ।

তোমার কাছে অসাধারণ হলেই সে মানুষ হিসেবে অসাধারণ হবে? আমার তো ধারণা সে এভারেজ ইন্টেলিজেন্সের একজন মানুষ। দুরবিন নিয়ে কিছু কায়দা-কানুন করছে যা দেখে তোমরা চমৎকৃত হচ্ছি।

রূপা চুপ করে রইল। যদিও তার ইচ্ছা করছে কঠিন কিছু বলে লোকটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। কিছু মনে পড়ছে না। তানভির হাতের সিগাবেট ফেলে দিয়ে আরেকটি ধরাল। তার ভাবভঙ্গিতে আগের অস্থিরতা নেই। তবে রূপা মেয়েটিকে এখন সে আগেব মতো তুচ্ছ বালিকা হিসেবে অগ্রাহ্য করছে না। সে বুঝতে পারছে এই মেয়েটিব সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হবে।

রূপা!

জি।

পাড়াগায় যারা থাকে তাদের জীবন মোটামুটি নিস্তরঙ্গ। বড় ধরনের কিছু চারপাশে ঘটে না। দুরবিন নিয়ে কেউ উপস্থিত হলে তাকেই মনে হয় গ্যালিলিও। আসলে তার প্ৰতিভা হয়তো ঐকিক নিয়মে ভালো অঙ্ক করায় সীমাবদ্ধ। কাউকে স্পেসিফিক্যালি মিন করে আমি বলছি না। তুমি রাগ করো না।

আমি রাগ করছি না। ব্যাপারটা সত্যিা হলে রাগ হতো। সত্যি না বলেই রাগের বদলে হাসি পাচ্ছে।

তোমার স্যার সম্পর্কে আমি এমন একটা কথা জানি যা শুনলে তুমি হয়তো রাগ করবে।

বলুন।

শুনেছি তিনি গম চুরি করেছেন। স্কুলের বরাদ্দ একশ মণ গম লোপাট করে দিয়েছে। তার নামে কেস হয়েছে।

কে বলেছে আপনাকে?

এটা কোনো গোপন ব্যাপার না। আমি তোমার বাবার কাছ থেকেই শুনেছি।

তিনি আপনাকে কখন বললেন, আজ?

হ্যাঁ।

বাবা খুব ভালো করেই জানেন এটা মিথ্যা। তার পরেও তিনি এটা আপনাকে কেন বলেছেন তা কি আপনি বুঝতে পারছেন?

না।

জানি বুঝতে পারবেন না। কারণ আপনার এত বুদ্ধি নেই। যদি আপনার খানিকটা বুদ্ধি থাকত তাহলে আপনি বুঝে ফেলতেন যে বাবা এটা আপনাকে বলছেন যাতে আপনার সব রাগ গিয়ে ঐ মানুষটার উপর পড়ে। যাতে আপনি ভাবতে শুরু করেন যে, সব দোষ ঐ চোর মানুষটার। রূপা নামের মেয়েটার কোনো দোষ নেই।

তানভিরের বিস্ময়ের সীমা রইল না। রূপা মেয়েটি তাকে অভিভূত করে ফেলেছে। গ্রামে বড় হওয়া বাচ্চা একটা মেয়ে এমন গুছিয়ে কথা বলছে–আশ্চর্য!

তানভিব বলল, এই চেয়ারটায় বস রূপা। মেজাজ ঠাণ্ডা কর, তারপর কথা বলি। রূপা বলল, আমার মেজাজ খুব ঠাণ্ডা আছে। কেন আমার মেজাজ এত ঠাণ্ডা তা জানেন?

না।

একদিন না একদিন এ-রকম একটা ব্যাপার ঘটবে তা আমি জানতাম! একদিন সবাই জানবে। তুমুল হৈচৈ শুরু হবে। মা ক্রমাগত কাঁদতে থাকবেন। বাবা স্তম্ভিত হয়ে বাবান্দায় ইজি চেয়ারে বসে থাকবেন। এটা আমি জানতাম। এই ঘটনার জন্যে আমার মানসিক প্ৰস্তৃতি ছিল বলেই আমি এত সহজভাবে সব কিছু নিতে পারছি।

তানভির বলল, আমি তাই দেখছি। এবং খানিকটা বিস্মিতও হচ্ছি। তোমার স্যার অসাধারণ কি-না জানি না, তবে তুমি অসাধারণ।

রূপা বাবান্দা থেকে চলে এলো। আসলেই তার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। মনে হচ্ছে এখনো কেউ খাদ্য নি। আজ রাতে কি এ বাড়িতে খাওয়া হবে না? রূপা রান্নাঘরে ঢুকাল। রূপার মা রান্নাঘরে মোড়ায় একা একা বসে আছেন। রূপা বলল, প্ৰচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে মা। আমাকে ভাত দিয়ে দাও। আজ কী রান্না?

রূপার মা দীর্ঘ সময় মেয়েব দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, বৌমা যা বলল তা-কি अऊिा शा?

হ্যাঁ, সত্যি। এখন তোমাবা কী কববে? বটি দিয়ে কুপিয়ে আমাকে কুচিকুচি কবে নদীতে ফেলে দেবে?

রূপার মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তুই ঠিক কবে বল তো মা ঐ হারামজাদা মাস্টার কি তোর গায়ে হাত দিয়েছে?

রূপা শান্ত গলায় বলল, তুমি আমাকে ছোট করতে চাও, কর। কিন্তু মা উনাকে ছোট করবে না। উনি এসব কিছুই জানেন না।

রূপার মা কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বললেন, হারামজাদা জানে না মানে? হারামজাদা ঠিকই জানে। জেনেশুনে সে তোকে জাদু করেছে। তুই হচ্ছিস গাধার গাধা। মহাগাধা। তুই কিছুই বুঝতে পারিস নি। তোর বাবা ভয়ঙ্কর রাগ করেছে। সে ঐ ছোটলোকটাকে এমন শাস্তি দেবে যে সে তার বাপ-মার নাম ভুলে যাবে।

কী শান্তি দিবে? খুন করবে?

কথা বলিস না তো। তোর কথা শুনে রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। তুই যা আমার সামনে থেকে।

তিনি শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। রূপা নিজের ঘরে চলে এলো। তার অসম্ভব ভয় লাগছে। বাবা মাস্টার সাহেবকে শাস্তি দেবেন। এটা নিশ্চিত। তার অপরাধে শান্তি পাবে অন্য একজন। কী শাস্তি কে জানে। মেরে ফেলবেন না নিশ্চয়ই। মানুষ এত নিচে নামতে পারে না। চেষ্টা করেও পারে না। স্কুলের চাকরি চলে যাবে। তাকে নীলগঞ্জ ছেড়ে চলে যেতে হবে। এটা হলে শাপে বর হয়। সেও স্যারের সঙ্গে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে কোথাও। যেখানে কেউ তাকে চিনতে পারবে না। কেউ না।

মিনু এসে ডাকল, খেতে আস রূপা।

রূপা বলল, ক্ষিধা মরে গেছে ভাবি। তোমরা খাও। আমি কিছু খাব না।

তোমার ভাই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে, খেয়ে আমার ঘরে আস।

আমি এখন কারো সঙ্গেই কথা বলব না ভাবি। আমার প্রচণ্ড মাথা ধবেছে। আমি দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকব।

তোমার ভাই কিন্তু রাগ করবে।

রাগ যা কবার করেছে। এখন দেখা করতে গেলেও সেই রাগের উনিশ-বিশ হবে না। আমি সকালে কথা বলব।

আফজাল সাহেব রাত এগারোটায় ভাত না খেয়েই জুতা-জামা পরে ঘর থেকে বেবোলেন। রফিক জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি জবাব দেন নি। কথা বলার মতো মানসিক অবস্থা এখন তার নেই। রফিক বলল, আমি কী সঙ্গে আসব বাবা?

তিনি হ্যাঁ-না কিছু বললেন না।

রফিক সঙ্গে চলল। বাবা প্ৰচণ্ড রেগে আছেন। তার হাই ব্লাড প্রেসার। এ রকম অবস্থায় তাকে একা ছাড়া উচিত না। তাছাড়া আকাশের অবস্তা ভালো না। যে৬াবে মেঘ ডাকছে তাতে মনে হয় ঝড়-টড় হবে।

রাস্তায় নেমেই রফিক বলল, যাচ্ছেন কোথায় বাবা?

থানায় যাচ্ছি।

থানায়?

হুঁ। ওসি সাহেবকে বলব, ঐ শুওরের বাচ্চাকে কাল যেন কোমরে দড়ি বেঁধে হজিতে নিয়ে ঢোকায়। নীলগঞ্জের সমস্ত মানুষ যেন তাকে দেখে।

ওসি সাহেব কি এটা করবেন?

অবশ্যই করবে। থানার বড় সাহেবরা যে কোনো অন্যায় আগ্রহ নিয়ে কবে। আর এটা কোনো অন্যায় না। ব্যাটার বিরুদ্ধে কেইস আছে। গম চুরির কেইস।

রফিক বলল, হাজতে নিয়ে ঢুকানোর আইডিয়াটা মন্দ না বাবা। রূপা যদি শোনে চুরির অপরাধে ব্যাটাকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাহলে তার মোহভঙ্গ হতে পাবে।‘

মোহভঙ্গ হোক আর না হোক, হারামজাদার বিষদাঁত আমি ভেঙে দেব। ন্যাংটো করে সারা নীলগঞ্জ আমি তাকে ঘুরাব। কুত্তা লেলিয়ে দেব। আমি খেজুরের কাটা দিয়ে ঐ কুত্তার চোখ গেলে দিব।

এত উত্তেজিত হবেন না বাবা। আমরা ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা ট্যাকল করব। খুব ঠাণ্ডা মাথায়।

রূপা ঘুমুতে গেল বৃষ্টি নামার পর। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর ধুয়েমুছে যাবে। রূপেশ্বর এবার বান ডাকবে। নিশ্চয়ই ডাকবে। ভাবতেই রূপার ভালো লাগছে। ডাকুক, ভয়াবহ বান ডাকুক। নীলগঞ্জ ধুয়ে-মুছে যাক রূপেশ্বরের জলে।

বাতি নেভাতেই জেবা ডাকল, ফুপু।

রূপা বলল, হুঁ।

বাড়িতে এখন দুটা দল হয়ে গেছে।

হুঁ, হয়েছে।

তোমার এক দল আর বাকি সবার দল।

রূপা কিছু বলল না। আসলে কোনো কিছুই সে শুনছে না। প্রচণ্ড জ্বরের সময় যেমন হয় এখন তার তাই হচ্ছে। কোনো কথা পরিষ্কার তার মাথায় ঢুকছে না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একটু যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে।

জেবা বলল, ওদের দলে এত মানুষ আর তোমার দলে আছি শুধু আমি। দুজনের দল–তাই না ফুপু?

হুঁ।

নদীর দিক থেকে শো-শো শব্দ আসছে। রাত যত বাড়ছে শব্দ ততই স্পষ্ট হচ্ছে।

রূপা বিছানায় উঠতে উঠতে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, এ বছর রূপেশ্বর নদীতে বান ডাকবে।

বান ডাকলে কি তুমি খুশি হও ফুপু?

হ্যাঁ হই। জলের তোড়ে ভেসে গেলে খুশি হই। জেবা হাসল। খিলখিল হাসি। অন্ধকারে তার হাসি অদ্ভুত শোনাল। মনে হচ্ছে সে হাসি যেন কলকল শব্দে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

ফুপু।

ফুপু ফুপু করবি না তো। ঘুমো।

একটা কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়ব। কথাটা হচ্ছে–কাল সকালটা তোমার জন্যে খুব কষ্টেব্য হলে। খুব কষ্টেল, তবে আমি তো তোমার সঙ্গে থাকব। তুমি সেই কষ্ট সহ্য করতে পারবে।

তোমার কথার আগা-মাথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না জেবা। তুমি কি সব সময় এরকম পাগলের মতো কথা বলে?

আমি কোনোদিনই পাগলের মতো কথা বলি না। কিন্তু সবাই মনে করে আমি পাগলের মতো কথা বলি।

ঠিক আছে, তুমি ঘুমাও।

ফুপু।

আর একটা কথাও না। ঘুমাও তো।

আমি কী আমার একটা হাত তোমার গায়ে রাখতে পারি?

না।

আচ্ছা আমি ঘুমুচ্ছি। তুমি ঘুমাও।

আমার ঘুম আসবে না।

আসবে। এক্ষুণি আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।

রূপা শুয়েছে। বৃষ্টির জন্যেই একটু শীত শীত লাগছে। গায়ে পাতলা চাদর দিতে পারলে ভালো হতো। আলসি লাগছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। ঘুমের মধ্যেই রূপা শুনতে পাচ্ছে, জেবা বলছে–দেখলে ফুপু, আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। ঘুম! ঘুম!!

 

নীলগঞ্জ এমনই এক জায়গা যেখানে কখনো নাটকীয় কিছু ঘটে না। কারো বড়শিতে বড় মাছ ধরা পড়লে অনেক দিন সেই মাছ ধরার গল্প হয়। আসরে গল্প হিসেবে মাছেব প্ৰসঙ্গ আসে–ধরেছিল একটা মাছ, পুব পাড়ার নীলমাধব। একটা জিনিসের মতো জিনিস…

সেই নীলগঞ্জে আজ ভোরবেলা ভয়াবহ এক নাটক হচ্ছে। অচিন্তনীয় একটা ঘটনা ঘটছে। নীলগঞ্জের মানুষ এতই হকচকিয়ে গেছে যে কিছু বলতে পারছে না। পাশের জনকে ফিসফিসিয়েও কিছু বলছে না। দৃশ্যটা হজম করতে সবারই সময় লাগছে। তাবা অবাক হয়ে দেখছে নীলগঞ্জ স্কুলের স্যার মবিনুর রহমানকে কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে। সবার আগে যাচ্ছেন ওসি সাহেব। তার চোখে সানগ্লাস। সানগ্লাস থাকাব কারণে তাঁর মুখের ভাব কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কোমরের দড়ি ধরে যে পুলিশটি যাচ্ছে তাকে খুব বিমর্ষ মনে হচ্ছে। সে হাঁটছে মাথা নিচু করে। মবিনুব রহমানের পেছনেও দুজন পুলিশ। তারাও মাথা নিচু করে হাঁটছে।

মবিনুর রহমানকে অত্যন্ত বিস্মিত মনে হচ্ছে। এই গরমেও তিনি একটা কোট গায়ে দিয়েছেন। তার হাতে টেলিস্কোপের বাক্সটা আছে। বাক্সটা কিছুক্ষণ পর পর এ হাত থেকে ও হাতে নিচ্ছেন।

ওসি সাহেব মবিনুর রহমানকে বললেন, সিগারেট খাবেন?

মবিনুর রহমান বললেন, জি না।

ওসি সাহেব বললেন, আপনার ঐ টেলিস্কোপটা কনষ্টেবলের হাতে দিয়ে দিন। হাঁটতে আপনার কষ্ট হচ্ছে।

কষ্ট হচ্ছে না। এর ওজন বেশি না। থ্রি পয়েন্ট টু কেজি।

সাবধানে পা ফেলুন, ভীষণ কাদা।

ওসি সাহেবরা আসামিদের সঙ্গে এই ভঙ্গিতে কথা বলেন না, বিশেষত যে আসামিকে কোমরে দড়ি বেধে নিয়ে যেতে হয়। এই আসামির বেলায় তিনি কিছু ব্যতিক্রম করেছেন। শুরুতেই আপনি বলে ফেলেছেন। শুরুতে আপনি না বললে এই যন্ত্রণা হতো না।

এই লোকটা গম চুরির সঙ্গে জড়িত না তা তিনি বুঝতে পাবছেন। এটা বোঝার জন্যে এগারো বছর ধরে ওসিগিরি করতে হয় না। লোকটাকে কায়দা করে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। আগে মনে হচ্ছিল পুরো ব্যাপারটার পেছনে আছে হেডমাস্টাব হাফিজুল কবির। এখন মনে হচ্ছে আরো অনেকেই আছে। বিশেষ করে আফজাল সাহেব আছেন।

একটা নিরপরাধ লোককে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আফজাল সাহেবের কারণে। তিনি বিশেষ করে বলে দিয়েছেন যেন কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার বাড়ির সামনে নিয়ে নেয়া হয়।

আফজাল সাহেব এই অঞ্চলের অত্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। এদের কথা শুনতে হয়। না শুনলে এ্যাডমিনিষ্ট্রেশন চালানো যায় না। বড়দারোগাগিরি সহজ জিনিস নয়। অনেকের মন রেখে চলতে হয়। এমন সব কাজ করতে হয় যার জন্যে মন ছোট হয়ে

ওসি সাহেব নিজের অস্বস্তি দূর করবার জন্যেই বললেন–আপনার এই যন্ত্র দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্র সব দেখা যায়?

মবিনুর রহমান আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, সব দেখা না গেলেও অনেক দেখা যায়। যেমন ধরুন শনি গ্রহের বলয় দেখা যায়।

দেখতে কেমন?

অপূর্ব।

ওসি সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, জিনিসটা একবার দেখলে হয়।

মবিনুর রহমান বললেন, টেলিস্কোপ সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে আপনাকে দেখাব।

ওসি সাহেব লজ্জিত বোধ করছেন। মানুষটা তো অদ্ভুত। তার কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে আর সে কী না বলছে তাকে টেলিস্কোপে শনি গ্রহের বলয় দেখাবে। মানুষটাকে এ্যাবেষ্ট করতে গিয়েও বিপত্তি। কাউকে এ্যাবেষ্ট করে নিয়ে আসা এমন কোনো মজাদার বিষয় নয়। বিশেষ করে যখন জানা থাকে লোকটা নিরপরাধ। হন্বিতম্বি তখনি বেশি করতে হয়। নিরপরাধ লোকের মনেও এই বিশ্বাস ধরিয়ে দিতে হয় যে সে আসলে নিরপরাধ না। কোনো একটা অপরাধ তার আছে যা সে নিজে তেমন ভালো জানে না। ওসি সাহেবও তাই করলেন। ভয়ঙ্কর মূর্তিতে উপস্থিত হলেন। খসখসে গলায় বললেন, ইউ আর আন্ডার এ্যারেস্ট।

ভদ্রলোক চায়ে পানি গরম কবছিলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, কেন বলুন তো?

গম চুরির মামলা–মিস এপ্রোপ্রিয়েশন অব পাবলিক ফান্ড। নব্বই বস্তা গম আপনি চুরি করেছেন।

নব্বই বস্তা গম দিয়ে আমি কী কবব?

আমার সঙ্গে কি রসিকতা করার চেষ্টা করছেন? নব্বই বস্তা গম দিয়ে আপনি কী করবেন তা জানেন না? স্ট্রেইট কথা বলুন। বাকা কথা বলবেন না।

বাঁকা কথা কী বললাম বুঝতে পারছি না।

বুঝতে না পারলে কথা বলবেন না। শুধু প্রশ্ন কবলেই জবাব দেবেন। নট বিফোর 179।

জি আচ্ছা।

আপনার ঘরও সার্চ হবে। সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। পাশের ঘরে কী আছে?

দুটা চন্দ্রবোড়া সাপ আছে আর তাদের একত্ৰিশটা ছানা আছে। সাবধানে যাবেন।

ওসি সাহেবের রাগে গা জ্বলে গেল। লোকটিকে সাদাসিধা ভালোমানুষ মনে হয়েছিল, আসলে সে তা না। খাকি পোশাকের সঙ্গে রসিকতা করতে চায়। যারা খাকি পোশাকের সঙ্গে রসিকতা করতে চায় তাদেরকে চোখে চোখে রাখতে হয়। বুঝিয়ে দিতে হয় যে খাকি পোশাক রসিকতা পছন্দ করে না।

কী বললেন? চন্দ্রবোড়া সাপ?

জি।

ভেরি গুড। আমার কিছু চন্দ্রবোড়া সাপই দরকার।

ওসি সাহেব নিজেই দরজা খুললেন এবং ছিটকে বের হয়ে এলেন। দুটি চন্দ্রবোড়াব একটি তিনি দেখতে পেয়েছেন। সেই দৃশ্য খুব সুখকর নয়। তখনই তিনি ঠিক করেছেন এই আসামির সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতে হবে। মবিনুর রহমান যখন বললেন, আমি কি আমার দুরবিনটা সঙ্গে নিতে পারি?

ওসি সাহেব তৎক্ষণাৎ বললেন, অবশ্যই পারেন। অবশ্যই। সঙ্গে আরো কিছু নিতে চাইলে তাও নিতে পারেন।

না, আর কিছু না। হাজতে কি আমাকে দীর্ঘদিন থাকতে হবে?

এখন বলা যাচ্ছে না। নির্ভর করে.

কীসেবা ওপর নির্ভর করে?

ওসি সাহেব তার জবাব দিলেন না। তার মন বলছে এই লোকটির সঙ্গে বেশি। কথাবার্তায় যাওয়া ঠিক হবে না।

রাস্তায় লোক জমছে। তারা অবাক হয়ে মবিনুর রহমানকে দেখছে। মবিনুর রহমান তাদের দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন। তাঁর সেই তাকানোয় লজ্জা-সংকোচ কিছুই নেই। বিব্রত একটা ভঙ্গি আছে, এর বেশি কিছু না।

কালিপদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে বালতি ভর্তি পানি নিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছিল। পুলিশের দল দেখে থমকে দাঁড়াল। উঁচু গলায় বলল, কী হইছে? মবিন্নুর রহমান বললেন, কেমন আছ কালিপদ?

আপনেরে কই নিয়া যায়?

থানায় নিয়ে যাচ্ছে।

কেন?

আমার বিরুদ্ধে গম চুরির কেইস আছে।

কালিপদ বালতি নামিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। পরবর্তী এক ঘণ্টা সে তার জায়গায় বসেই রইল, নড়ল না।

পুলিশের দলটা থামল আফজাল সাহেবের বাড়ির সামনে। ওসি সাহেব বাড়ির গেট খুলে বাইরের বাবান্দায় ঢুকলেন এবং গম্ভীর গলায় ডাকলেন, আফজাল সাহেব আছেন?

আফজাল সাহেব বের হয়ে এলেন।

ওসি সাহেব বললেন, এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পাবেন?

এদিকে কোথায় এসেছিলেন?

আসামি নিয়ে থানায় যাচ্ছি।

বসুন চা খেয়ে যান।

চা অবশ্যি এক কাপ খাওয়া যেতে পারে।

ওসি সাহেব পুলিশের দলটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এ্যাই, তোমরা একটু দাঁড়াও। পুলিশের দল মবিনুর রহমানকে নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।

এরকমই কথা ছিল। আফজাল সাহেব বলে দিয়েছিলেন কোমরে দড়িবাঁধা অবস্থায় মবিনুর রহমানকে গেটের বাইরে দাড়া করিয়ে ওসি সাহেব তার বাড়িতে চা নাশতা খবেন।

ওসি সাহেব এই কাজটিই এখন করছেন। তবে কাজটি করতে তাঁর খুব ভালো লাগছে না। লোক জমছে। অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। মানুষ বেশি জমলেই তারা একসঙ্গে এক জাতীয় চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। যার নাম মব সাইকোলজি। এই চিন্তা হঠাৎ কোন দিকে যাবে বলা মুশকিল। জড়ো হওয়া মানুষগুলি যদি মনে করে কাজটা অন্যায় হয়েছে তাহলে মুহুর্তের মধ্যে ক্ষেপে যাবে। ক্ষেপা জনতা— ভয়ঙ্কর।

রূপা বারান্দায় এসে শান্ত চোখে দৃশ্যটা দেখল। একবার মবিনুর রহমানের দিকে তাকিয়ে সে তাকাল তার বাবার দিকে। তারপর তাকাল ওসি সাহেবের দিকে।

ওসি সাহেব বললেন, আপনার মেয়ে?

আফজাল সাহেব বললেন, জি। এর নাম রূপা।

ওসি সাহেব বললেন, কেমন আছ মা?

রূপা বলল, ভালো আছি। আপনি স্যারকে কোমবে দড়ি বেঁধে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়া করিয়ে রেখেছেন কেন?

আসামিকে থানায় নিয়ে যাওয়ার এইটাই পদ্ধতি, আসামি যে-ই হোক না কেন তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যেতে হবে।

স্যারের বাড়ি থেকে থানায় যাবার রাস্তা তো এটা না। আপনি অনেকখানি ঘুরে আমাদের বাড়ির সামনে এসেছেন। কেউ নিশ্চয়ই এই কাজটা করার জন্যে আপনাকে বলেছে। তাই না?

ওসি সাহেব আফজাল সাহেবের দিকে তাকালেন।

আফজাল সাহেব কড়া গলায় বললেন, ভেতরে যাও রূপা।

রূপা কয়েক মুহুর্ত বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেল।

বাড়ির সামনে লোক বাড়ছে।

ওসি সাহেব চা শেষ না করেই উঠে পড়লেন। ব্যাপারটা আর ভালো লাগছে না। এত লোক জমছে কেন?

 

মবিনুর রহমানকে হাজতে ঢোকানোর তিন ঘণ্টার ভেতর থানার চারপাশে দুতিন হাজার মানুষ জমে গেল। তারা হৈচৈ, চিৎকার কিছুই করছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সবাই শান্ত। এই লক্ষণ ভালো না। খুব খারাপ লক্ষণ। এরা থানা আক্রমণ করে বসতে পারে। থানায় আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। থানায় টেলিফোন আছে–অতিরিক্ত ফোর্স চেয়ে টেলিফোন করা যায়। কিন্তু টেলিফোন গত এক সপ্তাহ থেকে নষ্ট।

ওসি সাহেব থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললেন, আপনারা সরকারি কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছেন। এর ফলাফল ভালো হবে না। আমরা আসামি ধরে এনেছি। আসামিকে কোর্টে চালান করে দেব। সেখান থেকে জামিন হবে। যান, আপনারা বাড়ি চলে যান। ভীড় বাড়বেন না।

কেউ নড়ল না।

দুপুর গড়িয়ে গেল। মানুষ বাড়তেই থাকল।

ওসি সাহেব সেকেন্ড অফিসারকে বললেন হেড অফিসে খবর দিতে। আসামিকে ছেড়ে দিলে এখন কোনো লাভ হবে না। হিতে বিপরীত হবে। লোকজন থানান্য আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। এই রিস্ক নেয়া যায় না।

সেকেন্ড অফিসার সাহেব থানা ছেড়ে বেরুতে গেলেন, লোকজন তাকে ঘিরে ফেলল। নিরীহ গলায় বলল, স্যার কোথায় যান?

তা দিয়ে আপনি কী করবেন?

যেতে পারবেন না স্যার।

যেতে পারব না। মানে? এটা কি মগের মুলুক নাকি?

সেকেন্ড অফিসার ভয়াবহ পুলিশী গর্জন দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। লোকজন কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এই দৃষ্টির সঙ্গে তিনি পরিচিত। এই দৃষ্টির নাম–উন্মাদ দৃষ্টি।

 

জেবা চা খাচ্ছে। পিরিচে করে চা খাচ্ছে।

পিরিচ ভর্তি চা নিয়ে চুকচুক করে চুমুক দিচ্ছে। তাকে কেন জানি খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে। রূপা ঘরে ঢুকে জেবাকে দেখল। জেবা বলল, ফুপু আমি চা খাচ্ছি। বলেই খিলখিল করে হাসল। চা খাওয়ার মধ্যে হাসির কী আছে রূপা বুঝতে পারছে না। আসলে এখন সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার কাছে সবই এলোমেলো হয়ে গেছে।

ফুপু।

কী?

তুমি চিন্তা কববে না। ফুপু, আমি তোমার দলে।

আমি কোনো চিন্তা করছি না। আর শোন, আমি কোনো দল কবছি না।

তোমার স্যারকে নিয়েও তুমি চিন্তা কববে না। আমি ব্যবস্থা করছি।

তুমি ব্যবস্থা করছি মানে?

সব মানুষ ক্ষেপে যাবে। ওলা থানা আক্রমণ করবে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। সাংঘাতিক মজার ব্যাপার হবে।

কী বলছ তুমি?

আমি কোনো মিথ্যা কথা বলি না ফুপু। সন্ধ্যার মধ্যে ভয়ঙ্কর কাণ্ড শুরু হবে।

জেবা হাসল খিলখিল করে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব আনন্দিত।

 

নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেব অস্থির বোধ করছেন। দুপুরে তিনি বাসায় ভাত খেতে যান নি। শুধু তিনি কেন, থানার কেউই দুপুরে খায় নি। সেপাইদের সবাইকে রাইফেল হাতে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। ওসি সাহেব বিপদের ঘাণ পাচ্ছেন। মানুষ ক্রমেই বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে দূর দূর থেকে মানুষ আসছে। অনেকের হাতেই বর্শা। বর্শা হলো এ অঞ্চলের যুদ্ধান্ত্র যার স্থানীয় নাম অলংগা। কারো কারো হাতে লম্বা বাঁশের লাঠিও আছে। এখনো সন্ধ্যা হয় নি। কিন্তু অনেকেই হারিকেন নিয়ে এসেছেন। মনে হয় তাদের সারারাত জেগে থাকার পরিকল্পনা। ওসি সাহেব মবিনুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। হাজতের দরজা খুলতেই মবিনুর রহমান বিস্মিত গলায় বললেন, এত লোক কেন চারদিকে?

ওসি সাহেবের প্রথমেই মনে হলো, ব্যাটা সব জেনেশুনে ঠাট্টা করছে। পরমুহুর্তেই মনে পড়ল। এই লোক মিথ্যা বলে না। ঠাট্টাও করে না। চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে সত্যি কথাই বলেছিল।

মবিন্নুর রহমান আবার বললেন, এত লোক কেন?

ওসি সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, জানি না। আপনি কি চা খাবেন?

জি-না।

সিগারেট? সিগারেট লাগবে? আনিয়ে দেব?

জি-না।

ওসি সাহেব কথা বলার আর কিছু পেলেন না। নিজের অফিস ঘরের দিকে ফিরে চললেন। লোক আরো বাড়ছে। দ্রুত কোনো একটা বুদ্ধি বেব কবে এদের দূর করতে হবে। ভয় দেখিয়ে দূর কবা যাবে না। এক মানুষ ভয প।ায়। জনতা ভয় পায় না। মবিনুর বহমানকে ছেড়ে দিলেও কোনো লাভ হবে না। এরা তাহলে নিজেদের বিজয়ী ভাববে। বিজয়ী মানুষদের জয় উল্লাসও ভয়াবহ হয়ে থাকে। আনন্দেই এরা হয়তো থানা জ্বালিয়ে দেবে। এমন কিছু করতে হবে যাতে মবিনুব রহমানের কোমরে দড়ি বেঁধে হাজতে নিয়ে আসা যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কীভাবে তা সম্ভব? অতি দ্রুত কিছু ভেবে বের করতে হবে। অতি দ্রুত। এমন কিছু বলতে হবে যাতে সবাই বলে কোমবে দড়ি বেঁধে থানায় আনার প্রয়োজন ছিল।

ওসি সাহেব তাঁর অফিসে ঢুকেই দেখলেন, নীলগঞ্জ হাই স্কুলের ধর্ম শিক্ষক জালালুদ্দিন বসে আছেন। জালালুদ্দিন সাহেবের মুখ অতিরিক্ত গম্ভীর।

কেমন আছেন জালালুদ্দিন সাহেব?

জি জনাব, ভালো। আপনার কাছ থেকে একটা বিষয় জানতে এসেছি।

অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। এর মধ্যে কী জানতে চান?

অবস্থা সম্পর্কেই একটা প্রশ্ন। মবিনুর বহমান সাহেবকে আপনারা কোমরে দড়ি বেঁধে হাজতে এনেছেন। কী জন্যে এনেছেন? গম চুরিব একটা মিথ্যা মামলার কারণে না অন্য কিহুচ?

অন্য কিছু।

বলুন শুনি।

ওসি সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন–অন্য ব্যাপার। সামান্য কারণে তার মতো লোককে তো এভাবে থানায় আনা যায় না। পুলিশ হয়েছি বলে তো আর আমরা অমানুষ না। মানী লোকের মান আপনারা যেমন বুঝেন আমরাও বুঝি। উনার বিরুদ্ধে অসামাজিক কাৰ্যকলাপের গুরুতর অভিযোগ আছে।

কী বললেন?

ওসি সাহেব নিজেকে গুছিয়ে নেবার জন্যে কিছুটা সময় নিলেন। সিগারেট ধরালেন। সুন্দর একটা গল্প ফাঁদতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য গল্প। সিগারেট টানতে টানতে কঠিন মুখে বললেন— একটা রেপ কেইস হয়েছে। ভিকটিমের জবানবন্দি অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।

রেপ কেইস?

জি, রেপ কেইস। এই কারণেই কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় এনেছি।

জালালুদ্দিন হতভম্ব মুখে তাকিয়ে আছেন।

ওসি সাহেব এই হতভম্ব দৃষ্টি দেখে খানিকটা সাত্ত্বিনা পেলেন। মনে হচ্ছে কাজ হবে। জালালুদ্দিন যখন তাঁর কথায় হকচকিয়ে গেছে তখন অন্যরাও যাবে। এই ঘটনায় লোকজন বুঝবে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় আনা উচিত ছিল। বাতাস ঘুরে যাবে। মবের চিন্তা-ভাবনা একদিন থেকে অন্যদিকে অতি দ্রুত ঘুরতে পারে। এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে মামলা সাজানো। একটা মেয়ে জোগাড় করতে হবে, যে হবে ফরিয়াদি। তেমন মেয়ে জোগাড় করা কঠিন হবে না। পুলিশের কাছে কোনো কাজই কঠিন নয়।

 

তানভির বাগানে একা একা বসে ছিল।

রূপা বারান্দায় আসতেই সে ডাকল, রূপা শুনে যাও তো।

রূপা শান্তমুখে বাগানে নামল। তানভির বলল, তোমার স্যারের কাণ্ড শুনেছ? রফিক ভাই এইমাত্র বলে গেলেন। তিনি বাজার থেকে শুনে এসেছেন। তুমি শুনতে চাও?

না।

না কেন? একটা মানুষকে ঠিকমতো জানতে হলে তার ভালো-মন্দ সবই জানতে হয়।

আপনার বলার ইচ্ছা খুব বেশি হলে বলুন, শুনব।

জোর করে শুনাতে চাচ্ছি না। তবুও আমি মনে করি তোমার শোনা উচিত। তোমার স্যার একটা মেয়েকে নির্জন বাড়িতে রেপ করেছেন, যে কারণে পুলিশ তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গেছে।

আপনি কি এটা বিশ্বাস করেন?

বিশ্বাস না করার তো কিছু দেখছি না। নারীসঙ্গবৰ্জিত একজন মানুষ নির্জন জায়গায় একা একা থাকে…।

নারীসঙ্গবৰ্জিত অনেক সাধক মানুষও নির্জন জায়গায় একা একা থাকে।

তোমার ধারণা উনি সাধক মহাপুরুষ?

হ্যাঁ।

তাহলে তো আর কিছু বলার নেই।

না। আর কিছু বলার নেই।

রূপা বাগান থেকে উঠে এলো। তানভির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেলল, এই বুদ্ধিমতী শক্ত ধাঁচের মেয়েটিকেই তার বিয়ে করতে হবে। জোর করে হলেও করতে হবে। মেয়েটির মনে সাময়িক যে মোহ আছে তা বিয়ের পর কেটে যাবে। অল্পবয়সের মোহ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এই মোহ অনেকটা শিশুদের হামের মতো, সবারই হবে। আবার সেরে যাবে।

ওসি সাহেবের পরিকল্পনা কাজ করেছে। লোকজন চলে যেতে শুরু করেছে। মানুষ অসত্যকে সহজে বিশ্বাস করে। মবিনুর রহমানের মেয়েঘটিত ব্যাপার তারা বিশ্বাস করেছে। এর নাম মিব সাইকোলজি–এই উত্তর এই দক্ষিণ। মাঝামাঝি কোনো ব্যাপার নেই।

ওসি সাহেব ডাকলেন, কবির মিয়া।

ডিউটির সেন্ট্রি বলল, জি স্যার।

দেখে আস তো মবিনুর রহমান কী করছে?

দেখে এসেছি স্যার। উনি ঘুমুচ্ছেন।

হারামজাদা।

হারামজাদা কাকে বলা হলো, কেন বলা হলো কবির মিয়া ঠিক বুঝতে পারল না। ওসি সাহেব বললেন, লোকজন এখনো আছে?

কিছু আছে স্যার।

হারামজাদা।

কিছু বললেন স্যার?

না কিছু বলি নাই। তুমি যাও ডিউটি দাও। আর শোন আমি এখন বেরুব! আমি ফিরে না। আসা পর্যন্ত যেন থানা ছেড়ে কেউ না যায়।

ওসি সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়েছে। ভয়ঙ্কর একটা দিন গিয়েছে। বিশ্রামের উপায় নেই। এখন যেতে হবে একটা মেয়ের সন্ধানে, যাকে ফরিয়াদি করে মামলা দাড়া করানো যায়,। নীলগঞ্জ বাজারে কয়েকঘর পতিতা থাকে। ওদের কাছ থেকেই সংগ্ৰহ করতে হবে। অল্পবয়সী হলে ভালো হয়। বয়স যত কম হবে ততই ভালো। নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

পাওয়া গেল। সাবিহা বেগম নামের পনেরো বছরের এক বালিকা দুদিন আগের তারিখে থানায় জি.ডি এন্ট্রি করাল। তার গল্পটি এককম–সে সকালে বাড়ি যাচ্ছিল। মবিনুর রহমানের বাড়ির কাছ দিয়ে যাবার সময় মবিনুর রহমান তাকে বলল, তুমি কি বাজারে যাও? সে বলল, হ্যাঁ।

তুমি আমার জন্যে কিছু লবণ কিনে আনবে? লবণের অভাবে কিছু রাঁধতে পারিছ না। আধা কেজি লবণ আনতে পারবে?

সে বলল, পারব।

পারব বলল কারণ সে জানে এই পাগল লোকটা একা একা থাকে। স্কুলের শিক্ষক। খুব ভালো মানুষ। আগেও কয়েকবার সে এই মানুষটাকে এটা-ওটা এনে দিয়েছে।

মবিনুর রহমান বলল, আস টাকা নিয়ে যাও। সে টাকা নেবার জন্যে ঘরে ঢুকতেই মবিনুর রহমান দরজা বন্ধ করে দিল। দরজায় খিল দিয়েছিল। সাবিহা কিছু বুঝবার আগেই সে তার হাত ধরল। সাবিহা তখন অনেক চিৎকার করল। কিন্তু তার চিৎকার কেউ শুনল না। তাছাড়া খুব বৃষ্টি হচ্ছিল।

মোটামুটিভাবে বিশ্বাসযোগ্য গল্প।

মিথ্যা গল্প অতি সহজেই বিশ্বাসযোগ্য করা যায়। সমস্যা হয়। সত্য গল্প নিয়ে।

 

জেবার জ্বর এসেছে।

সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ সমস্ত হাত-পা অবশ করে জ্বর এলো। সে দুবার বমি করে নেতিয়ে পড়ল। তার চোখ রক্তবর্ণ। রফিক ডাক্তার ডাকতে চাইল। সে কঠিন গলায় বলল, না।

রফিক বলল, আচ্ছা থাক, ডাকব না।

রফিকের মা বললেন, এসব কেমন কথা? মেয়ে না বললেই না? জ্বরে হাত-পা পুড়ে যাচ্ছে। তুই ডাক্তারের ব্যবস্থা কর। মেয়ের কথা শুনতে হবে?

বফিক ক্লান্ত গলায় বলল, ওর কথা না শুনে উপায় নেই। মা! তুমি বুঝবে না। ওব অমতে, কিছু করা যাবে না। ও যা বলবে আমাদের তাই করতে হবে।

এটা কোনো কথা হলো?

এটা কোনো কথা না। কিন্তু এটাই সত্যি।

জেবা বলল, কেউ যেন আমার ঘরে না আসে। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দাও। দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়া হলো। জেবা ভেতর থেকে সিটিকিনি দিয়ে দিল। তার জ্বর আরো বাড়ছে। ঠিকমতো পা ফেলে বিছানা পর্যন্ত যেতে পারছে না। ঘবের ভেতরটা গরম। তার শীত লাগছে। প্রচণ্ড শীত। শীতে তার সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। জেবা বিড়বিড় করে বলল, আমি পারছি না। আমার শক্তি কম। আমি পারছি না। জেবা বিছানায় শুয়ে আছে কুণ্ডুলি পাকিয়ে। তার ঘুম আসছে। প্রচণ্ড ঘুম। ঘুম প্রয়োজন। এই ঘুমের মধ্যেই সে নিদের দেখা পাবে। নিরা তাকে বলে দেবে কী করতে হবে। কারণ সেও একজন নি। রূপা ফুপুর স্যারও নি। তার ক্ষমতা অনেক বেশি। তিনি যা ইচ্ছা! তাই করতে পারেন, অথচ তিনি তা জানেন না। নিরা তাঁকে কিছু বলছে না কেন? সে কী তাঁকে বলে দেবে?

ঘুমুচ্ছেন মবিনুর রহমান। ঠিক ঘুম না–তন্দ্রভাব হয়েছে। হাজাতের ছোট্ট ঘবটায় তাবে বসার জন্য ইজিচেয়ার দেয়া হয়েছে। তিনি ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। কেন জানি তার বেশ ভালো লাগছে। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। চাবদিকে অন্ধকার। হাজত্ব; ঘরের ভেতরে কোনো বাতি নেই। বারান্দায় বাতি আছে। একশ পাওয়ারের বাতি। ইলেকট্রসিটি খুব দুর্বল। রাত এগারোটার আগে সবল হবে না। বারান্দার বাতি প্রদীপের আলোর মতো আলো দিচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঢালা বর্ষণ হচ্ছে। নদীর দিক থেকে শো-শো আওয়াজ আসছে। বোধহয় রূপেশ্বরে আবারো বান ডাকবে। এই নদী প্রতি সাত বছর পর পর যৌবনবতী হয়। দুকুল ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

মবিনুর রহমান আধো-ঘুম আধো-তন্দ্ৰায় রূপেশ্বরের গর্জন শুনতে পাচ্ছেন। এক সময় সেই গর্জনে কিছু কথা মিশে গেল। নদীর গর্জন কোলাহলের মতো শুনাতে লাগল। এক সঙ্গে অনেকেই যেন কথা বলছে। মবিনুর রহমান ঘুমের মধ্যেই অস্বস্তি বোধ করছেন। চেষ্টা করছেন, জেগে উঠতে পারছেন না। ঘুম আরো গাঢ় হচ্ছে। যে কোলাহল এতক্ষণ শুনছিলেন তা একটি নির্দিষ্ট স্বরধ্বনিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।

মবিনুব রহমান।

জি।

মবিনুর রহমান।

জি।

মবিনুর রহমান।

আমি তো জবাব দিচ্ছি। বারবাব ডাকছেন কেন?

কী বলছি শুনতে পাচ্ছ?

পাচ্ছি।

আমরা কে মনে আছে?

আপনারা ‘নি’।

হ্যাঁ, তোমার মনে আছে। তুমিও একজন ‘নি’।

বুঝিয়ে বলুন।

সবকিছু বুঝিয়ে বলা যায় না।

চেষ্টা করুন।

তুমি স্বপ্ন দেখতে পাব।

স্বপ্ন সবাই দেখে।

তোমার স্বপ্ন আব্ব অন্যদেব স্বপ্ন এক নয়। অন্যদের স্বপ্ন স্বপ্নই। তোমার স্বপ্ন স্বপ্ন নয়। তুমি যা স্বপ্ন দেখবে তাই হবে।

বুঝতে পারছি না।

মানুষ পৃথিবীতে এসেছে ছয়চল্লিশটি ক্রমোজম নিয়ে। তোমার ক্রমোজম সংখ্যা সাতচল্লি যারা ‘নি’ শুধু তারাই এই বাড়তি ক্রমোজম নিয়ে আসে।

বাড়তি ক্ৰমোজমটির কাজ কী?

বাড়তি ক্ৰমোজমটির জন্যেই তুমি স্বপ্নকে মুক্ত করতে পোর। কী অসীম তোমার ক্ষমতা তা তুমি জানো না, ক্ষুদ্র অর্থে তুমি স্রষ্টা।

সব মানুষই স্রষ্টা। সৃষ্টি করাই মানুষের কাজ।

তোমার সৃষ্টির ক্ষমতা অসাধারণ।

অসাধারণ?

হ্যাঁ অসাধারণ। নিদের জন্ম হয়েছে স্বপ্ন দেখার জন্যে। তারা স্বপ্ন দেখে–নতুন সৃষ্টি হয়। প্রকৃতি তাই চায়।

একদিকে সৃষ্টি মানেই অন্যদিকে ধ্বংস।

হ্যাঁ তাই ঠিক। প্রকৃতি তাই চায়। প্রকৃতি চায়। তার জগতে ক্ৰমাগত ভাঙাগড়াব খেলা চলুক।

কিছুই বুঝতে পারছি না।

তোমার কি মনে আছে তুমি একবার চিন্বজ্যোৎস্নাব একটি জগতেব কথা চিন্তা কবেছিলে, মনে আছে?

আছে।

সেই জগৎ তৈরি হয়েছে। অপূর্ব সেই জগৎ।

আমি কি সেই জগৎ দেখতে পাবি?

হ্যাঁ পাব। তবে কল্পনায়। তোমার পৃথিবী যে মাত্রায় আছে, তোমার জগৎ সেই মাত্রার নয়।

আমি কি আমার পৃথিবীতে কিছু সৃষ্টি করতে পারি?

পার। তবে ‘নি’দের সাবধান করে দেয়া হয় যেন এই কাজটি তারা না কবে।

অসুবিধা কী?

এতে প্রাকৃতিক নিয়মে অসুবিধা দেখা দেয়। প্রকৃতি তার আইনের ব্যতিক্রম সহ্য করে না। আইন অমান্যকারীকে প্রকৃতি কঠিন শাস্তি দেয়।

আমি এই পৃথিবীতেই কিছু একটা সৃষ্টি করে দেখতে চাই প্রকৃতি আমাকে কীভাবে শাস্তি দেয়।

প্রকৃতির শান্তি ভয়াবহ। আমরা তোমাকে সাবধান করবার জন্যেই আজ এসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার ইচ্ছা হবে প্রকৃতির নিয়ম ভাঙতে। সেটি যেন না হয় তাই বলতেই আমাদের আসা। তুমি তোমার কাজ কর। তোমার অসীম ক্ষমতা ব্যবহার কর।

আপনারা চলে যান। আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না।

আমরা চলে যাব। তোমাকে সাবধান করেই চলে যাব।

আমার প্রয়োজনে আবার কি আপনাদেব সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি?

হ্যাঁ পার।

ধন্যবাদ। এখন যান।

তুমি যে এখন এক সাময়িক অসুবিধাব মধ্যে আছ তা নিয়ে কি তুমি আলাপ করতে চাও?

হাজতবাসেব কথা বলছেন?

হ্যাঁ।

না। এটা কোনো সমস্যা নয়।

‘নি’দের যাবতীয় সমস্যা থেকে দূরে রাখার সব ব্যবস্থা প্রকৃতি করে রাখে। তোমার বেলাতেও তা করে রেখেছে। তুমি যখন যেখানে ছিলে সেখানেই তোমার পাশে রাখা হয়েছে দুজন করে অসাধারণ মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ, যারা মানসিকভাবে অন্যদের প্রভাবিত করতে পারে। ‘নি’রা প্রকৃতির প্রিয় সন্তান।

বুঝতে পারছি না।

নীলগঞ্জে তোমার দুজন সাহায্যকারী আছে। একজন কালিপদ, অন্যজন জালালুদ্দিন। এদের মানসিক ক্ষমতা অসাধারণ। তারা সব রকম বিপদে তোমাকে সাহায্য করবে। যদিও তারা তা জানে না। তোমাকে সাহায্য করার জন্যে আরো একজন সাহায্যকারীকে আনা হয়েছে। তার নাম জেবা। জেবাও তোমাকে সাহায্য করছে। ‘নি’ প্রকৃতির বিশেষ সৃষ্টি। এদের বক্ষা করার সব রকম দায়িত্ব প্রকৃতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে।

এইসব শুনতে আমার ভালো লাগছে না। ঘুম পাচ্ছে, আমাকে ঘুমুতে দিন।

স্বপ্ন ঝাপসা হয়ে গেল। মবিনুর রহমান গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেলেন। আরেকটি স্বপ্ন দেখলেন। সেই স্বপ্ন অপূর্ব ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ছে আকাশে। তাদের কলকাকলিতে চারদিক মুখরিত। তারা এক আনন্দময় সঙ্গীত সৃষ্টি করছে। আলো আঁধারী এক জগতে তাদের সঙ্গীত মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

হেড মাস্টার সাহেবেব গরুর জন্যে জাবনা তৈরি করা হচ্ছে। কালিপদ মাথা নিচু করে কাজটা করছে। হেড মাস্টার সাহেব পাশে এসে দাঁড়ালেন। তার চোখে-মুখে চিন্তিত ভাব। মবিনুর রহমানের গমের ব্যাপারটা এত দূর গড়াবে তা তিনি ভাবেন নি। এ তো বড়ই যন্ত্রণা হলো।

হেড মাস্টার সাহেব বললেন, গরু কিছু মুখে দিচ্ছে না, ব্যাপার কী কালিপদ?

কালিপদ চোখ তুলে তাকাল। চোখ নামিয়ে নিল না। তাকিয়েই রইল। এ রকম সে কখনো করে না। হেড মাস্টাব সাহেব অকারণেই খানিকটা অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। প্রথম প্রশ্নটি দ্বিতীয়বার করলেন, গরু কিছু মুখে দিচ্ছে না, ব্যাপার কী কালিপদ?

কালিপদ বলল, সেইটা গরুরে জিজ্ঞেস করেন।

হেড মাস্টাব সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। হারামজাদার এত বড় সাহস! কী কথা বলছে? তারপরেও তাকিয়ে আছে। চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না। জুতিয়ে হারামজাদার গাল ভেঙে দেওয়া দরকার।

কী বললা কালিপদ?

বললাম, গরু কেন খায় না সেইটা গরুরে জিজ্ঞাসা করেন। আমি গরুর ডাক্তার না।

তোমার সাহস অনেক বেশি হয়ে গেছে। তুমি কী বলছ তুমি নিজেও জানো না।

কালিপদ এইবার চোখ নামিয়ে নিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, আমার মাথার ঠিক নাই। নিরপরাধ একটা মানুষরে কোমরে দড়ি বাইন্দা নিয়া গেছে। আমার মাথার ঠিক নাই। কি বলতে কি বলছি, মনে কিছু নিয়েন না।

নিরপরাধ বলছি কেন? তুমি কি জানো না সে একটা মেয়ের সর্বনাশ করেছে? মেয়ের নাম সাবিহা।

এইগুলা দুষ্ট লোকের মিথ্যা রটনা।

তোমারে কে বলল মিথ্যা রটনা?

আমি জানি মিথ্যা রটনা। আফনেও জানেন, আফনে জানেন না। এমন না। অখনও সময় আছে স্যার।

কী বললা?

বললাম অখনো সময় আছে। সময় শেষ হইলে আফসোস করবেন।

কী বলছ তুমি?

অতি সত্য কথা বলতেছি। অতি সত্য কথা।

কালিপদ হাঁটা ধরল। বিস্মিত হেড মাস্টার বললেন, যাও কোথায় তুমি?

সাবিহা বেগমের কাছে যাই।

কালিপদ চলে গেছে। হেড মাস্টার সাহেবের পা কাঁপছে। ঠকঠক করে কাঁপছে। অকারণে ভয়ে সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করছে। এরকম কেন হচ্ছে তিনি বুঝতে পারছেন না। পিপাসায় বুক শুকিয়ে কাঠ। তিনি আস্তে আস্তে মাটিতে বসে পড়লেন। হড়হড় করে বমি হয়ে গেল। বমিতে লাল লাল কী দেখা যাচ্ছে। রক্ত না-কি? হেড মাস্টার সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন–ইয়া মাবুদ। ইয়া মাবুদ।

বাজারের একটা ঘরের সামনে কালিপদ দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে এক সময় বাইরে এসে বলল, কারে চান গো?

তোমারে চাই। তোমার নাম সাবিহা না?

হুঁ।

তুমি মিথ্যা মামলা কেন করছ?

কালিপদ তাকিয়ে আছে তীব্র দৃষ্টিতে। সাবিহা সেই দৃষ্টি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না। কালিপদ আবার বলল, কেন তুমি মিথ্যা মামলা করলা?

ওসি সাহেব বলছেন।

এখন ওসি সাহেবের কাছে আবার যাও। ওসি সাহেববে বলে–তুমি এইসবেব মধ্যে নাই।

জি আচ্ছা।

কখন যাইবা?

এখনই যাব।

যাও দিরং করবা না।

জে-না। আমি দিরং করব না।

সাবিহারও ঠিক হেড মাস্টার সাহেবের মতো হলো। গা হাত পা কাঁপছে। প্ৰচণ্ড বমি ভাব হচ্ছে। বুক ধড়ফড় করছে।

জালালুদ্দিন ওসি সাহেবের বাসায় উপস্থিত হয়েছেন। সমস্ত দিনের ভগাবহ ক্লান্তির পর ওসি সাহেব সবে ঘুমুতে গিয়েছেন। রাত বাজে নটা। এত সকাল সকাল তিনি ঘুমুতে যান না। আজ শরীরে কুলুচ্ছে না। এই সময় যন্ত্রণা। ওসি সাহেব বলে পাঠালেন, এখন দেখা হবে না।

জালালুদ্দিন বললেন, এখনই দেখা হওয়া দরকার। ওসি সাহেবের নিজের স্বার্থেই দেখা হওয়া দরকার।

ওসি সাহেব বের হয়ে এলেন। কঠিন গলায় বললেন, কী ব্যাপার?

গম চুরি মামলাটা নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।

আমার সঙ্গে কী কথা?

হেড মাস্টার সাহেব স্বীকার করেছেন যে গম চুরির মামলাটা মিথ্যা মামলা।

কী বললেন?

যা সত্য তাই বললাম। গম চুরি বিষয়ক সব দায়-দায়িত্ব উনি নিয়েছেন। কাজেই মবিনুর রহমান সাহেবকে ছেড়ে দিতে হয়।

উনাকে অন্য কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। কারণটা আপনাকে বলেছি… ।

হ্যাঁ বলেছেন। সাবিহা নামের ঐ মেয়ে বলছে যে, আপনি তাকে দিয়ে মিথ্যা মামলা কবিয়েছেন।

অনেকক্ষণ ওসি সাহেব কথা বলতে পারলেন না হচ্ছে কী এসব। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সে বললে তো হবে না?

হবে। সে বললেই হবে। নীলগঞ্জের সব মানুষ এসে ভেঙে পড়বে থানার সামনে। আপনার মহাবিপদ ওসি সাহেব।

ভয় দেখাচ্ছেন না কি?

না, ভয় দেখাচ্ছি না। যা হতে যাচ্ছে সেটাই আপনাকে বলছি। মানুষ ক্ষেপে গেলে ভযঙ্কব হয়ে যায় ওসি সাহেব। ক্ষ্যাপা মানুষ বন্দুক মানে না।

আপনি কি মবিনুব রহমান সাহেবকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছেন? সেটা করা যায়…

শুধু সেটা কবলে তো হবে না। আপনি যে অন্যায় করেছেন তার জন্যে সবার কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা কববেন। কানে ধরে দশবার উঠবোস করবেন।

কী বললেন?

অপমানসূচক একটা কথা বললাম, ওসি সাহেব। খুবই অপমানসূচক কথা। কিন্তু প্ৰাণে বাঁচতে হলে এ ছাড়া পথ নেই। হেড মাস্টার সাহেবও একই জিনিস কববেন। উনি রাজি হয়েছেন। বুদ্ধিমান লোক তো। বিপদ আঁচ করতে পেরেছেন। আপনার বুদ্ধি কম। আপনি বিপদ টের পাবেন শেষ সময়ে, যখন করার কিছু থাকবে না।

ওসি সাহেব জালালুদিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কম বুদ্ধির মানুষ না তিনি বিপদ টের পাচ্ছেন। ভালোই টের পাচ্ছেন। তার কপালে ঘাম জমছে। পা কাঁপছে। তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। প্রচণ্ড বমি ভাব হচ্ছে।

 

জেবার জ্বর অসম্ভব বেড়েছে।

জ্বর ঠিক কত তা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ তার গায়ে থার্মোমিটার ছুঁয়ানো যাচ্ছে না। সে কাউকেই তার কাছে আসতে দিচ্ছে না।

আফজাল সাহেব রফিককে বললেন, মেয়ে না করছে বলে কেউ তার কাছে যাবে না এটা কেমন কথা? মাথায় পানি ঢালতে হবে। ডাক্তার ডেকে চিকিৎসা করাতে হবে।

রফিক বলল, কোনো লাভ হবে না। বাবা। ওর অনিচ্ছায় কিছু করা যাবে না।

যাবে না কেন?

আপনি বুঝবেন না বাবা, অনেক সমস্যা আছে।

জ্বরে তোর মেয়ে পুড়ে যাচ্ছে আর তুই দেখবি না?

এরকম ভয়ঙ্কর জ্বর তার মাঝে মাঝে হয়, আবার আপনাতেই সারে। ডাক্তাব ডাকতে হয় না।

জেবা ক্ষিপ্ত গলায় বলল, তোমরা সবাই এখানে ভীড় করে আছ কেন? তোমরা যাও। যাও বললাম। আর ঘরে বাতি জ্বলিয়েছ কেন? বললাম না বাতি চোখে লাগে? বাতি নিভিয়ে দাও।

বাতি নিভিয়ে রফিক সবাইকে নিয়ে বেবী হয়ে এলো। তার মিনিট দিশেকের ভেতর জেবা বের হয়ে এলো। সহজ স্বাভাবিক মানুষ। জ্বর নেই। চোখে-মুখে ক্লান্তির কোনো ছোঁয়াও নেই। যেন ঘুমুচ্ছিল, ঘুম থেকে উঠে এসেছে। জেবা বলল, জ্বর সেবে গছে। ফুপু কোথায়?

রূপা বারান্দাতেই ছিল। সে চোখ তুলে তাকাল। কিছু বলল না। জেবা বলল, ফুপু তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আমার সঙ্গে এসো।

জেবা রূপাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। ঘর অন্ধকার। বাতি জ্বালাল। হাসতে হাসতে বলল, তোমার জন্যে খুব ভালো খবর আছে ফুপু।

কী খবর?

তোমার স্যারকে ওরা ছেড়ে দেবে। ছেড়ে না দিয়ে অবশ্যি উপায়ও নেই। হি-হি-হি।

তুমি কীভাবে জানো?

যেভাবেই হোক জানি। অনেক রাতে তিনি একা একা বাড়ি ফেবার সময। এই বাড়িতে আসবেন।

তাও তুমি জানো?

হ্যাঁ, তাও জানি। তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ না?

না।

আমি সব সময় সত্যি কথা বলি ফুপু। তবু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। তাতে কিছু অবশ্যি যায় আসে না।

তুমি মেয়েটা খুব অদ্ভুত জেবা।

সব মানুষই অদ্ভুত ফুপু। তুমিও অদ্ভুত। পৃথিবীটাও অদ্ভুত।

তুমি একেবারে বড়দের মতো কথা বলছি।

মাঝে মাঝে আমি বড়দের মতো কথা বলি। বড়রা যদি ছোটদেব মতো কথা বললে দোষ না হয় তাহলে ছোটরা বড়দের মতো কথা বললে দোষ হবে কেন? আমি ঘুমুতে যাচ্ছি ফুপু।

রাত এগারোটার দিকে এ বাড়ির সবাই ঘুমুতে গেল। ঘুমুতে যাবার আগে আফজাল সাহেব রূপাকে ডেকে বললেন, রূপা, তুমি আগামীকাল রফিকের সঙ্গে খুলনা চলে যাবে।

রূপা বলল, আচ্ছা।

ওখানেই থাকবে। পরীক্ষার সময় শুধু এখানে এসে পরীক্ষা দিয়ে যাবে।

আচ্ছা।

তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। এখন কিছুই বলব না। পরে বলব।

আচ্ছা।

তোমার মাকে বলেছি তোমার জিনিসপত্র সব গুছিয়ে দিতে।

ঠিক আছে বাবা।

বাইরে ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাস শো-শো করছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে একে একে। সবার শেষে ঘুমুতে গেল মিনু। সেও ঘুমুতে যাবার আগে রূপার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলল। এমনভাবে বলল যেন কিছুই হয় নি। সব স্বাভাবিক আছে। আগের মতোই আছে।

রূপা, আমাদের সঙ্গে যেতে তোমার আপত্তি নেই তো?

আপত্তি হবে কেন? খুলনা আমার খুব যেতে ইচ্ছা করে। আচ্ছা ভাবি, তোমাদের ওখান থেকে সুন্দরবন কী অনেক দূব?

না–কাছেই।

আমাকে সুন্দরবন দেখাবে না?

অবশ্যই দেখাব।

সুন্দরবনে ডাকবাংলা আছে? ডাকবাংলায় থাকতে ইচ্ছা করে ভাবি।

ফবেষ্টের ডাকবাংলা আছে। তোমার ভাইকে বলে ব্যবস্থা করে দেব।

ঠিক আছে। ভাবি, তুমি ঘুমুতে যাও। খুব রাত অবশ্যি হয় নি। এগারোটা বাজে। তবু কেন জানি মনে হচ্ছে নিশুতি রাত।। তাই না ভাবি?

মিনু ঘুমুতে গেল। রূপা নিজের ঘরে ঢুকে সুন্দর করে সাজল। চুল বেণী করল। শাড়ি পাল্টাল। অনেকদিন পব চোখে কাজল পরল।

সে অপেক্ষা করছে। জেবার কথ সে বিশ্বাস করছে। এই মেয়েটা কোনো এক বিচিত্ৰ উপায়ে ভবিষ্যতের কথা বলতে পাবে। কাঁপা তার প্ৰমাণ পেয়েছে।

 

মবিনুর রহমানকে ছেড়ে দিয়েছে রাত এগারোটায়।

ওসি সাহেব বললেন, চলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। মবিনুর রহমান বললেন, না না, পৌঁছাতে হবে না।

ওসি সাহেব বললেন, আপনি আমার ওপর রাগ করবেন না ভাই। ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দেবেন।

ঠিক আছে। মানুষ মাত্রেই ভুল করে।

বৃষ্টির মধ্যে যাবেন কী করে? একটা ছাতা আর টর্চ লাইট দিয়ে দি।

টর্চ লাইট লাগবে না। ছাতা দিতে পারেন।

মবিনুর রহমানকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবার জন্যে জালালুদ্দিন এবং কালিপদ ছিল। তিনি অনেক কষ্টে তাদের বিদেয় করলেন। তার কেন জানি একা একা বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা! করছে। থানার সামনে জড়ো হওয়া মানুষজন কেউই এখন নেই। সবাই ভীড় করেছে নদীর তীরে। নদী ভাঙতে শুরু করেছে। এমনভাবে নদী আগে কখনো ভাঙে নি। নদী ভাঙার দৃশ্য একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর এবং সুন্দর।

মবিনুর রহমান ভিজতে ভিজতে এগুচ্ছেন। বৃষ্টি ছাতা মানছে না। বাতাসের কারণেই খুব ভিজছেন। নিজে ভিজছেন তা নিয়ে তিনি চিন্তিত না। টেলিস্কোপটা ভিজে যাচ্ছে এই নিয়েই তিনি চিন্তিত।

রূপাদের বাড়ির কাছে আসতেই তার মনে হলো তাকে যে ছেড়ে দেয়া হয়েছেএই খবরটা রূপাদের দিয়ে যাওয়া উচিত। রাত অবশ্যি অনেক হয়েছে, তবু যাওয়া যায় কারণ বাতি জ্বলছে। এখনো কেউ না কেউ জেগে আছে। সম্ভবত রূপাই জেগে আছে। সে অনেক রাত পর্যন্ত জাগে। পড়াশোনা করে।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই তানভির দবাজা খুলল। টেলিস্কোপ বগলে মবিন্নুর রহমান দাঁড়িয়ে। মবিনুর রহমান অপ্ৰস্তুত গলায় বললেন, ওবা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। আপনারা চিন্তা করবেন। এই ভেবে খবরটা দিতে এলাম। ভালো আছেন?

জি ভালো আছি।

তানভির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার ইচ্ছা নয় মানুষটা ঘরে ঢুকুক। তানভির বলল, রফিক সাহেবের ছোটমেয়েটা অসুস্থ। সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত। এখন ঘুমুচ্ছে। কাউকে ডাকা যাবে না।

মবিনুব রহমান বললেন, আপনি খবর দিয়ে দিলেই হবে। বলবেন আমি এসেছিলাম।

আমি বলব।

কাল সন্ধ্যায় রূপাকে পড়াতে আসব। বেশ কিছুদিন মিস হলো। আর হবে না।

কাল আসতে হবে না। রূপা কাল চলে যাচ্ছে।

কোথায় যাচ্ছে?

খুলনা যাচ্ছে। রফিক সাহেব সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন।

এই সময় বেড়াতে যাওয়া কি ঠিক হবে? পরীক্ষার দেরি নেই।

সেটা ওদের ব্যাপার। ওরা যা ভালো বুঝে করবে।

শুধু ওদের ব্যাপার হবে কেন? আমারও ব্যাপার। আমি ওর শিক্ষক।

কথাবার্তার এই পর্যায়ে রূপা তানভিরের পেছনে এসে দাঁড়াল। শান্ত গলায় তানভিরকে বলল, আপনি স্যারকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছেন না কেন? দেখছেন না উনি ভিজছেন? দরজা ছেড়ে দাঁড়ান।

তানভির দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। রূপা বলল, স্যার ভেতরে আসুন।

এখন আর ভেতরে আসব না। রূপা। তোমাদের খবরটা দিতে এলাম। ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। ভুল করে ধরেছিল। মানুষ মাত্রেই ভুল করে। ওসি সাহেব খুব লজ্জা পেয়েছেন। আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক।

স্যার আপনি ভেতরে আসুন। আপনাকে আসতেই হবে।

মবিনুর রহমান ভেতরে ঢুকলেন। রূপা বলল, গামছা দিচ্ছি। মাথা মুছে আরাম করে বসুন। আপনি কি রাতে কিছু খেয়েছেন?

হ্যাঁ, ওসি সাহেব তার বাসা থেকে খাবার এনে খাইয়েছেন।

আমি চা এনে দিচ্ছি। আদা চা করে দেব?

দাও। বাসার আর মানুষজন কোথায়? সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?

জি।

তানভির দাঁড়িয়ে আছে। অপলক দেখছে রূপাকে। মেয়েটা আজ এত সুন্দর করে সাজল কেন? সে কি জানত তার স্যার আসবেন?

রূপা বলল, তানভিরের দিকে তাকিয়ে আপনি আপনার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। স্যারেব সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা আছে। আমি কাল খুলনায় চলে যাচ্ছি। কথাগুলি স্যারকে বলে যাওয়া দরকার।

কথাগুলি সকালে বললে হয় না?

না হয় না। আপনার কাছে হাত জোড় করছি।

মবিনুর রহমান বললেন, আমি না হয় সকালে আসব।

না। আপনি চুপ কবে বসে থাকুন।

তানভির ঘর ছেড়ে বারান্দায় গেল। তার মন বলছে এই দুজনকে এখানে রেখে বাইরে দাড়িয়ে থাকা ঠিক হচ্ছে না। ব্যাপারটা অন্যদের জানানো দরকার। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে একজন বাইরের মানুষ। তার কি উচিত অন্যদের জাগানো? তানভির সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করছে। বাবান্দায় প্ৰবল বাতাস। দেয়াশলাই ধরানো যাচ্ছে না।

মবিনুর বহমান বিস্মিত মুখে বসে আছেন। রূপার মধ্যে খানিকটা পবিবর্তন তিনি লক্ষ করছেন। কিন্তু পরিবর্তনের ধরনটা ঠিক ধরতে পারছেন না। মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে। অবশ্যি সুন্দর মেয়েকে সুন্দর তো লাগবেই।

রূপা তার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, স্যার আপনি কি এখন বাড়িতে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

নদী নাকি খুব ভাঙছে? আপনার বাড়ি ভেঙে পড়েছে কি-না কে জানে?

গিয়ে দেখি।

রূপা বলল, আমি কিন্তু স্যার আপনার সঙ্গে যাব।

আমার সঙ্গে যাবে মানে?

আপনার সঙ্গে আপনার বাড়িতে যাব। আমি এখন থেকে আপনার সঙ্গে থাকব। মবিনুর রহমান দীর্ঘ সময় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়েটাকে এখন অচেনা লাগছে। একেবারেই অচেনা। যেন কোনোদিন এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় নি।

আমার সঙ্গে থাকবে কীভাবে?

কীভাবে তা জানি না। আমি থাকব।

আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না রূপা।

আপনি সব কথা বুঝেন আর আমার সামান্য কথা বুঝেন না?

না কিছু বুঝতে পারছি না।

আমি এখন আপনার সঙ্গে যাব। গিয়ে যদি দেখি আপনার বাড়ি নদীতে তলিয়ে গেছে তাহলে নৌকায় রাতে থাকব। অবশ্যি এই অবস্থায় নৌকায় থাকা খুব বিপদজনক হবে। তাই না স্যার?

মবিনুর রহমান হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার মনে হতে লাগল পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নে ঘটছে। মাঝে মাঝে তিনি যেমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন এও তেমন কোনো অদ্ভুত স্বপ্ন।

স্যার।

বলো।

সবচে ভালো হয় যদি আমরা দুজন এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই যাতে কেউ আমাদের খুঁজে বের করতে না পারে।

মবিনুর রহমান থেমে থেমে বললেন, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে রূপা। তুমি কী বলছ নিজেও জানো না। তুমি খুলনায় যাও। বাইরে গেলে ভালো লাগবে।

স্যার, আপনার ধারণা আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

কিছু একটা গণ্ডগোল তো অবশ্যই হয়েছে। আমি উঠি, কেমন?

বাড়ি যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

যদি অনেক রাতে একা একা আপনার বাড়িতে উপস্থিত হই আপনি কী কববেন? আমাকে এখানে এনে দিয়ে যাবেন?

অবশ্যই দিয়ে যাব।

রূপা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেখতে দেখতে তার চোখ ভিজে উঠল। মবিন্নুর রহমান উঠে দাড়ালেন। তার ইচ্ছা করছে এই পাগলী মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে দুএকটা সান্ত্বনার কথা বলতে। তা বোধহয় ঠিক হবে না। এ কী ভয়াবহ সমস্যা! সমস্যার ধরন এখনো তার কাছে পরিষ্কার নয়। এই মেয়ে কী চায় তার কাছে?

রূপা যাই।

রূপা কিছু বলল না। চেয়ার ছেড়ে উঠেও দাঁড়াল না। মবিনুব বহমান বাবান্দায় এসে দেখেন তানভির দাঁড়িয়ে আছে। তিনি নিচু গলায় বললেন, আমি যাচ্ছি। আপনি রূপার দিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন। ও বড় ধরনের কোনো সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বলে আমরা ধারণা। আপনি লক্ষ্য রাখবেন রূপা যেন রাতে বাড়ি থেকে বের না হয়।

তানভির কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

মবিনুর রহমান অসহায় বোধ করছেন। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আপনি বরং রূপার বাবা-মাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলুন। ওদের বলুন মেয়েটার দিকে লক্ষ রাখতে।

লক্ষ্য রাখা হবে। আপনি আপনার বাড়িতে যান। রূপাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।

 

মবিনুর রহমান বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। নদী আশেপাশের পুরো অঞ্চল ভেঙে দ্রুতগতিতে এগুচ্ছে–আশ্চর্য তার বাড়িটি ঠিকই আছে। নৌকাও বাধা আছে। তিনি জানতেন কিছু হবে না। প্রকৃতি তাঁকে রক্ষা করবে। তিনি একজন নি। তাঁকে সব রকম সমস্যা থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রকৃতির। তিনি প্রকৃতির প্রিয় সন্তান।

ভেবেছিলেন রাতে নৌকায় ঘুমুবেন। নৌক যেভাবে দুলছে তাতে তা সম্ভব না। তিনি নিজের ঘরেই ঘুমুতে এলেন। যাবার সময় দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে গিয়েছিলেন, এখন তালা খোলা। কেউ ঘরে ঢুকেছিল নিশ্চয়ই। ঘরের জিনিসপত্র যেমন ছিল তেমনি আছে। যে এসেছিল সে কোনো কিছুতেই হাত দেয় নি।

চায়ের তৃষ্ণ হচ্ছে। তিনি চুলায় কেতলি বসিয়ে দিলেন। নদীর শো-শো শব্দের সঙ্গে স্টোভের শো শী শব্দ মিশে অন্য এক ধরনের শব্দ হচ্ছে। চুলার সামনে বসে থাকতে থাকতে তাঁর হঠাৎ মনে হলো, পৃথিবী শব্দময় হলে কেমন হতো? যদি এমন একটি জগৎ থাকত যেখানে সবই শব্দময়। গাছ। অনবরত শব্দ করে যাবে। একেক গাছ থেকে একেক ধরনের শব্দ আসবে। পাথর থেকে শব্দ হবে। বড় পাথরের এক ধরনের শব্দ, ছোট পাথরের এক ধবনের শব্দ। মানুষের শবীরে যেমন ঘাণ থাকে তেমনি শব্দও থাকবে। কারোর গা থেকে আসবে মধুর সঙ্গীতময় শব্দ। কারো গা থেকে আসবে বিরক্তিকর শব্দ। এ রকম একটি জগতে রূপার গা থেকে কেমন শব্দ আসবে? নূপুরে ছটফট ধরনের শব্দ?

ভাবতে ভাবতেই তার এক ধরনের ঘোবের মতো হলো। তিনি বিচিত্ৰ সব শব্দ শুনতে লাগলেন। কেরোসিনের ক্টোভ থেকে শো-শো শব্দ ছাড়াও ক্টোভেব নিজস্ব শব্দ আসছে। পানি ভর্তি গ্লাস থেকে এক ধবনের শব্দ আসছে, আবার কেতলির ফুটন্ত পানি থেকে অন্য ধরনের শব্দ। কী পাশ্চৰ্য্য। তিনি ঘোরের মধ্যেই শুনলেন–

হচ্ছে তোমার হচ্ছে! এই তো তুমি জগৎ তৈরি করেছ। শব্দময় জগৎ। অপূর্ব! অপূর্ব!

আপনারা কি নি?

হ্যাঁ আমরা নি।

আমরা তোমার ক্ষমতায় বিস্মিত।

আমি তাহলে একটি শব্দময় জগৎ তৈরি করেছি?

হ্যাঁ করেছ।

আমি আপনাদের এই রসিকতার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। পৃথিবী সব সময়ই শব্দময়। শব্দের উৎপত্তি কম্পনে। প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব কম্পনাংক আছে। সেই অর্থে প্রতিটি বস্তুই শব্দময়।

অবশ্যই প্রতিটি বস্তু শব্দময়। কিন্তু তুমি কল্পনা করেছ এমন মানুষের যারা এই শব্দ ধরতে পারে। সেই অর্থে তোমার জগৎটি নতুন।

কোথায় সেই জগৎ?

সেই জগতের অবস্থান তোমার মধ্যেই তবে ভিন্ন মাত্রায় বলেই তোমার ধরাছোয়ার বাইরে। তুমি আরো ভাব। কল্পনাকে আরো ছড়িয়ে দাও। নতুন নতুন জগৎ সৃষ্টি কর।

তাতে আমার লাভ?

তুমি সৃষ্টির আনন্দ পোচ্ছ। এই আনন্দই তোমার লাভ।

যে সৃষ্টি আমি দেখছি না। সেই সৃষ্টিতে কোনো আনন্দ থাকার কথা নয়।

তুমি কি কোনো আনন্দই পাচ্ছে না?

না।

তুমি যখন শব্দময় জগতের কথা ভাবছিলে তখন কি আনন্দ পাও নি?

পেয়েছি।

সেই আনন্দ কি অসম্ভব তীব্র ছিল না?

হ্যাঁ ছিল

ঐটিই তোমার লাভ। শব্দময় জগতের কথা ভাবতে ভাবতে তোমার নিজের জগৎও হয়ে গেল শব্দময়। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

বিচিত্ৰ!

শুধু বিচিত্র? আর কিছু না? আনন্দে কি তখন তোমার শরীর ঝনঝনি করছিল না?

করছিল।

তোমার কল্পনা যতই উন্নত হবে তোমার আনন্দের পরিমাণ হবে ৩তই তীব্ৰ। আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছি।

কেন?

কারণ তোমার আনন্দ আমাদেরও আনন্দ। আমরাও তো নি তোমার জন্ম থেকেই আমরা তোমার ওপর লক্ষ রাখছি। তোমার প্রতিটি কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করছি।

প্রতিটি কার্যকলাপ?

হ্যাঁ, প্রতিটি কার্যকলাপ। তুমি যেন নীলগঞ্জ আস সে জন্যে সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। তুমি যাতে এই ভাঙা বাড়িতে এসে উঠ সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কারণ তোমার ক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য নির্জন একটি বাড়ি প্রয়োজন ছিল।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ তাই। তুমি টেলিস্কোপের কথাই চিন্তা করে দেখ। একটি প্রথম শ্রেণীর এস্ট্রনোমিক্যাল টেলিস্কোপ তুমি ব্যবহার করছ। টেলিস্কোপটি তুমি কিনেছ একটি পুরানো ফার্নিচারের দোকান থেকে। তুমি সেখানে গিযেছিলে ইজিচেয়ার কিনতে। মনে আছে?

আছে। তাহলে কি আপনারা বলতে চান সব কিছুই পূর্ব নির্ধারিত?

হ্যাঁ।

রূপা মেয়েটির সঙ্গে আমার পরিচয়ও কি পূর্ব নির্ধারিত?

হ্যাঁ পূর্ব নির্ধারিত। বিশেষ প্রয়োজনেই রূপাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

কী প্রয়োজন?

তুমি যে সব জগৎ তৈরি করছ, সেসব জগতের মানুষ তোমার মতোই আবেগশূন্য। তীব্র আবেগের সঙ্গে তোমার পরিচয়ের প্রয়োজন হয়েছে সে কারণেই, যাতে তোমার জগতের মানুষদের তুমি অন্য রকম করে তৈরি করতে পোর।

আপনারা কি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন?

পারি না। আবার এক অর্থে পারি।

রূপা এখন কি করবে বলতে পারেন?

না, পারি না। প্রকৃতি খানিকটা অনিশ্চয়তা রেখে দেয়। রূপা ঝড়-বৃষ্টির রাতে এখানে ছুটে আসতে পারে, আবার আসতে নাও পারে, আবার অন্য কিছু করতে পারে।

তাহলে অনিশ্চয়তা সামান্য বলছেন কেন? অনেকখানি অনিশ্চয়তা।

হ্যাঁ, অনেকখানি।

আপনারা বলছেন নি-রা প্রচণ্ড ক্ষমতাসম্পন্ন। এই অনিশ্চয়তা তারা দূর করতে পারে না।

না। অনিশ্চয়তা প্রকৃতিরই নিয়ম। প্রকৃতি তার নিজের নিয়ম ভঙ্গ করে না।

মবিনুর রহমানেব ঘোর কেটে গেল। কেতলিতে পানি টগবগ করে ফুটছে। তিনি চা বানিয়ে খেলেন। হাওয়ার বেগ আরো বাড়ছে। তুমুল বর্ষণ। ধুপ ধুপ শব্দে নদী ভাঙতে ভাঙতে এগুচ্ছে। যে হারে এগুচ্ছে তাতে মনে হয় আজ রাতের মধ্যেই নদী তার বাড়ি গ্ৰাস করে নেবে। তিনি তেমন চিন্তিতবোধ করছেন না। বরং ভালোই লাগছে। তিনি রাত দুটোর দিকে ঘুমুতে গেলেন। চাদর মুড়ি দিয়ে সবে শুয়েছেন। হাত বাড়িয়েছেন হারিকেনের সালতা কমিয়ে দেবার জন্যে। এমন সময় দরজায় প্ৰবল ধাক্কার শব্দ হলো। তিনি বললেন, কে?

বাইরে থেকে তানভিরের গলা শোনা গেল।

দরজা খুলুন মাস্টার সাহেব।

কী ব্যাপার?

দরজা খুলুন। তারপর বলছি।

তিনি দরজা খুললেন। তানভির একা নয়। রূপার দুই ভাই–রফিক এবং জহিরও তার সঙ্গে এসেছে। রফিক কঠিন গলায় বলল, রূপা কি আপনার এখানে?

তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, না তো!

আপনি কী সত্যি কথা বলছেন মাস্টাব সাহেব?

মিথ্যা বলার প্রয়োজন কখনো বোধ করি নি। রূপাকে কী পাওয়া যাচ্ছে না?

তানভির বলল, আমরা আপনার নৌকাটা একটু দেখব। নৌকা কী ঘাটে বাধা আছে?

থাকার কথা। আসুন যাই।

নৌকা বাতাসের প্রবল ঝাণ্টায় উলট পালট খাচ্ছে। যে কোনো মুহুর্তে দড়ি ছিঁড়ে যাবে। রফিক বলল, আপনি রাতে আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন তখন রূপা আপনাকে কি বলেছে?

আমার এখানে আসতে চেয়েছিল, আমি নিষেধ করেছিলাম।

তিনজনই ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জহির হিসহিস করে চাপা গলায় বলল, রূপার যদি কিছু হয় তাহলে আমি আপনাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করব। কেউ আপনাকে রক্ষা করতে পারবে না। কেউ না।

তারা তিনজন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে।

মবিনুর রহমান একা নদীর পাড়ে দাঁড়িযে আছেন। অন্ধকার রাতে, ঠাণ্ডা হাওয়ায় বৃষ্টিতে ভিজতে তাঁর ভালো লাগছে। চোখের সামনে নদী। নদীর জল, সমুদ্রের জলের মতোই অন্ধকারে জ্বলছে। অদ্ভুত লাগছে তাকিয়ে থাকতে। তাঁর ভালো লাগছে। এক ধরনের তীব্র আনন্দবোধ করছেন।

সমস্ত রাত তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন। ভোরবেলা প্রবল জ্বর নিয়ে ঘরে ফিরলেন। হাত-পা অবশ হয়ে আছে। ভেজা কাপড় বদলাবার শক্তিও নেই। তিনি ভেজা কাপড়েই বিছানায় শুয়ে পড়লেন। জ্বর বাড়তেই থাকল। জ্বরের ঘোবে বেশ কয়েকবাব তাঁর মনে হলো অসংখ্য বুড়ো মানুষ তাঁর দিকে তাকিয়ে মিনতির সঙ্গে বলছে–তুমি অসম্ভব ক্ষমতাধর একজন নি। তোমার অকল্পনীয় ক্ষমতা। কিন্তু তুমি সীমা লজয়নের চেষ্টা করবে না। প্রকৃতি সীমা লঙ্ঘনকারীকে সহ্য করে না। প্রকৃতি কাউকে সীমা লজন করতে দেয় না। কাউকেই না। তোমাকেও দেবে না।

ভোববেলায় সূর্য উঠার আগেই কালিপদ এলো মবিনুর বহমান সাহেবেব খোঁজ নিতে। সে আগেই আসত, মহা সমস্যায় পড়ে আসতে পারে নি। সমস্যা তার একাব না, সবার সমস্যা। নদী ভাঙতে ভাঙতে এগুচ্ছে। অতি দ্রুত এগুচ্ছে। লোকজন সরিয়ে দিতে হচ্ছে। বাজারের পুরোটাই চলে গেছে নদীর ভেতর। ঘটনা ঘটেছে অন্ধকার রাতে। লোকজন বুঝতেই পারে নি এত দ্রুত নদী এগুবে। ছসাত জন মানুষ মারা গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধু একজনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আফজাল সাহেবের মেয়ে রূপা। তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। অন্য কারো কোনো চিহ্নই এখনো পাওয়া যায়

কালিপদ এসেছে ছুটতে ছুটতে, ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে। হয়তো দেখবে মবিন্নুর রহমান স্যারের শোনো চিহ্নই নেই। সে দূর থেকে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল–নদীর এই অংশটি মোটামুটি শান্ত। ভাঙা বাড়ি এখনো টিকে আছে। ঘাটে নৌকা বাঁধা। মনে হচ্ছে নদী খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে এগুচ্ছে।

ঘরে ঢুকে কালিপদ দেখল মবিনুর রহমান ভেজা কাপড়ে কুণ্ডুলি পাকিয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। তার চোখ রক্তবর্ণ। হাত-পা কাঁপছে।

কালিপদ বলল, কী হইছে স্যার?

মবিনুর রহমান জড়ানো গলায় বললেন, কে?

স্যার আমি কালিপদ।

তুমি কেমন আছ কালিপদ?

আপনের কী হইছে স্যার?

জ্বর আসছে বলে মনে হয়।

কালিপদ দ্রুত ঘরের জিনিসপত্র গুছাচ্ছে। মানুষটাকে সরিয়ে দিতে হবে। রাগী নদী কাউকে ক্ষমা করে না। যে কোনো মুহুর্তে এখানে চলে আসবে।

স্যার।

হুঁ।

এইখানে থাকা যাবে না স্যার।

অসুবিধা হবে না। কালিপদ তুমি চলে যাও।

আমি স্যার যাব না। আপনারে না নিয়া আমি যাব না।

মবিনুব রহমান ক্ষীণ গলায় বললেন, একটা খবর নিয়ে আসা। রূপা মেয়েটাকে পাওয়া গেছে কি-না জেনে আস।

কালিপদ ভেবে পেল না। দুঃসংবাদ স্যারকে দেয়া যাবে কি-না। শরীরের এই অবস্থায় কি দুঃসংবাদ দেয়া যায়? তবে মানুষটা খুব শক্ত। এবং রূপাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না তাও এই মানুষটা জানে।

কালিপদ।

জি।

খবর নিয়ে আস।

খবর স্যার জানি। উনার লাশ পাওয়া গেছে। বাকখালির কাছে। পরনে নীল শাড়ি। গা ভরতি গয়না।

ও আচ্ছা।

তাদের বাড়ির সবাই খুব কানতেছে।

মবিনুব রহমান চোখ বন্ধ করে ফেললেন। এই খবর শোনার জন্যে তিনি মানসিকভাবে প্ৰস্তৃত ছিলেন বলে ভেবেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে তিনি মানসিকভাবে প্ৰস্তুত না। নিজেকে এক লাগছে। মনে হচ্ছে একটি প্ৰকাণ্ড গ্রহে তিনি যেন একা জেগে। আছেন। বিশাল একটা গ্ৰহ–গাছ-পালা, ফুল-ফল, নদী, সাগর… ..কিন্তু একটিমাত্র মানুষ। দ্বিতীয় প্রাণী নেই। কল্পনা করতে ভালো লাগছে।

তিনি একজন নি। বলা হয়েছে অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন নি। সৃষ্টির আদিতে ঈশ্বর বললেন–হও। জগৎ তৈরি হলো শূন্য থেকে। এই জগৎ কোথায়? ছিল ঈশ্বরের কল্পনার। নিরাও কল্পনা থেকে জগৎ সৃষ্টি করতে পারে। অন্তত তাঁকে সে রকমই বলা হয়েছে।

রূপাকে কি তিনি সষ্টি করতে পারেন না? এই জগতেই কি তা সম্ভব?

মবিনুর বহমান উঠে বসলেন। এক ধবনের ঘোরে তাঁর শরীর আচ্ছন্ন। রূপা মেয়েটির প্রতি প্ৰচণ্ড রকম আবেগ তিনি বোধ করছেন। এই আবেগ এই তীব্র আকর্ষণ কোথায় লুকিয়ে ছিল।

কালিপদ বলল, আপনে স্যার চলেন। নদী ভাঙতেছে।

তিনি কিছুই শুনছেন না। তাঁর সমস্ত চিন্তা-চেতনা কেন্দ্রীভূত। রূপার কথা ভাবছেন গভীরভাবে ভাবছেন। তাঁর সমস্ত শরীর থরথর কবে কাঁপছে। তিনি কল্পনায় দেখছেন রূপা বসে আছে নৌকায়। রূপার গায়ে হালকা নীল রঙের শাড়ি। হাত ভর্তি কাচের চুড়ি। পান খেয়ে সে ঠোঁট লাল করেছে। গুনগুন করে গান গাইছে। নৌকায় গাদা করে রাখা বইপত্র গুছিয়ে রাখছে।

মবিনুর রহমান এখন আর চারপাশের কিছু স্পষ্ট দেখতে পারছেন না। সব ধোঁয়াটে হয়ে গেছে। কালিপদ ব্যাকুল হয়ে তাকে ডাকছে, তিনি সেই ডাক শুনতে পাচ্ছেন না। এর মধ্যেও তিনি স্পষ্ট শুনলেন

মবিন্নুর রহমান! মবিনুর রহমান।

তিনি জবাব দিলেন না। তাঁকে ডাকছে নি রা। অসংখ্য বৃদ্ধের মুখ এখন তিনি দেখতে পারছেন। তারা সবাই ভয়ানক উদ্বিগ্ন।

মবিনুর রহমান। মবিনুর রহমান।

বলুন।

তুমি এসব কী করছ? তুমি সীমা লঙ্ঘন করছি। তুমি মেয়েটিকে এই জগতেই সৃষ্টি করার চেষ্টা করছি। এই চেষ্টা তুমি করতে পার না।

আমি পারি। আমি একজন নি। নিদের ক্ষমতা অসাধারণ।

প্রকৃতি সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করে না।

যে প্রকৃতি সীমা বেঁধে দেয় তাকেও আমি পছন্দ করি না।

তুমি বিরাট ভুল করেছ মবিনুর রহমান। এই পৃথিবীতে দীর্ঘদিন পর পর একজন নি আসে। তুমি এসেছ। কল্পনাতীত ক্ষমতা তোমাকে দেয়া হয়েছে। এই ক্ষমতার অপব্যবহার করবে না।

আমি কথা বলতে চাচ্ছি না।

রূপাকে তোমার প্রয়োজন নেই।

কে বলল প্রয়োজন নেই।

আমরা বলছি।

তোমরা বললে তো হবে না। আমার প্রয়োজন আমি বুঝব। আমি এই মেয়েটিকে আমার জগতেই তৈরি করব।

মবিনুর রহমান।

আমাকে ডাকাডাকি করে কোনো লাভ হবে না। আমি আমার প্রচণ্ড ক্ষমতা অনুভব করছি। প্রতিটি রক্ত কণিকায় অনুভব করছি। আমি সেই ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করব।

মবিনুর রহমান কিছুক্ষণের জন্যে বাস্তবে ফিরে এলেন। কালিপদ চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

কালিপদ!

জি।

একটু বাইরে গিয়ে দেখ তো নৌকায় কি কাউকে দেখা যায়?

কালিপদ ঘর থেকে বের হয়ে চমকে উঠল। সে ছুটে নদীর কাছে এলো। নদী ভাঙতে শুরু করেছে। ভয়ঙ্কর গর্জন হচ্ছে নদীতে। নৌকা দুলছে কাগজের নৌকার মতো। আশ্চর্য ব্যাপার, নৌকার ভেতর কাকে যেন দেখা যায়। কালিপদ বলল, কে কে? কেউ জবাব দিল না। কিন্তু কালিপদ স্পষ্ট শুনল কেউ-একজন যেন গুনগুন করে গান গাইছে। মিষ্টি মেয়েগলা।

কালিপদ আবার ডাকল–কে? নৌকার ভেতরে কে? আশ্চৰ্য, কথা বলে না। মানুষটা কে?

মবিনুর রহমান বের হয়ে এলেন। কালিপদের দিকে তাকিয়ে বললেন–তুমি চলে যাও কালিপদ। এক্ষুণি যাও। এক্ষুণি।

মবিনুর রহমানের গলায় এমন কিছু ছিল যে কালিপদ ভয় পেয়ে ছুটে চলে গেল। সে দৌড়াতে দৌড়াতে যাচ্ছে। একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না।

নদী ভাঙতে ভাঙতে এগুচ্ছে মবিনুর রহমানের দিকে। তিনি তা দেখেও দেখছেন না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। তাকিয়ে আছেন নৌকার দিকে। আকাশ ঘন কৃষ্ণবর্ণ। মেঘেব পর মেঘা জমছে। ভয়াবহ দুর্যোগের আর দেরি নেই। মবিনুর বহমান উঁচু গলায় ডাকলেন–রূপা, রূপা! নৌকার ভেতব থেকে কাচের চুড়িব শব্দ হচ্ছে। নীল শাড়ির আভাস খানিকটা পাওয়া গেল। ফর্সা চুড়ি পরা হাত এক পলকের জন্যে বের হয়ে এলো। মবিনুর রহমান চোখ বন্ধ করে আছেন। তিনি তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করবেন।

তিনি জানেন প্রকৃতি এই অনিয়ম সহ্য করবে না। নদী কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে গ্ৰাস করবে। তিনি আবার ডাকলেন–রূপা, রূপা!

রূপা নৌকাব ভেতর থেকে বের হয়ে এলো।

তিনি কোমল গলায় বললেন, কেমন আছ রূপা?

রূপা বলল, স্যার আমার ভীষণ ভয় লাগছে।

নদী এগুচ্ছে। নদীব জল ফুলেফেপে উঠছে। মবিনুর বহমান দাঁড়িয়ে আছেন।

রূপা আবার বলল, স্যার আমার ভয় লাগছে। খুব ভয় পাচ্ছি স্যার।

মবিনুর রহমান হাসলেন। তাঁর পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে। প্রকৃতি আর তাঁকে সময় দেবে না। তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি হাসিমুখে রূপার দিকে তাকিয়ে আছেন।