১০. রাজ-পদবী

রাজ-পদবী

দেবতাদের অধিরাজরূপে ইন্দ্রের নির্বাচনকে প্রতীকীভাবে উপস্থাপিত করে রাজপদবীর উৎস নির্দেশ করা হয়েছে। শতপথ ব্ৰাহ্মণের একটি প্রাসঙ্গিক দেবকাহিনী (৩ : 8 : ২ : ২) বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয়, তার সঙ্গে রাজপদ বিষয়ক ‘সামাজিক চুক্তি’ তত্ত্বের সাদৃশ্য খুব বেশি; প্রাথমিক স্তরে একটি প্রয়োজন অনুভূত হয়, পরে তার থেকে উদ্ভূত সমস্যাকে পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে সমাধান করা হয়। রাজপদবী তখন অভিষেকের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত। অভিষেকে সমবেত জনসাধারণের উদ্দেশ রাজপুরোহিত যে ঘোষণা করে : “হে জনগণ, ইনিই তোমাদের রাজা; ব্ৰাহ্মণের রাজা সোম; এর দ্বারা রাজা সোমের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠেন”। তবে, রাজকীয় ক্ষমতা অভিষেকের ফলে স্বতঃস্ফুর্তভাবে অভিব্যক্ত হয় না, পার্থ নামক অনুষ্ঠান করেই রাজা ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন [তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মণ ১: ৭ : ৪৪ ]। বহু স্তবকে ব্ৰাহ্মণ ও পুরোহিতের কাছে রাজার সম্পূর্ণ অধীনতা প্ৰকাশিত। এও বলা হয়েছে যে, রাজপদবী লাভ করেই রাজন্য নর-ঋষভ (তাণ্ড্য মহাব্ৰাহ্মণ ১৯ : ১৭ : ৭) বা নরশার্দূল (তৈত্তিরীয় ২ : ৭ : ১৫ : ৪৯) হয়ে ওঠেন।

অভিষেকের সময়ে রাজা দুটি দীক্ষা-অনুষ্ঠান পালন করেন–উগ্রী ও বশিণী; প্ৰথম অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য তাঁর প্রজাদের নিয়ন্ত্রণ, আর দ্বিতীয়টি শক্ৰদের পর্যুদস্ত করার জন্য পরিকল্পিত। রাজপদের আদি তাৎপৰ্যগুলির অন্যতম ছিল রাজস্ব-সংগ্ৰহ; কয়েকটি দেবকাহিনীতে এই সত্য আভাসিত হয়েছে। রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করে ‘রাজা’ পদবী লাভ করা যেত, অন্যদিকে বাজপেয় যজ্ঞের মাধ্যমে পাওয়া যেত উচ্চতর পদ সম্রাট । রাজার অন্যান্য উপাধি যেমন : ক্ষত্রপতি, বলপতি, ব্ৰহ্মাপতি, রাষ্ট্রপতি, বিট্‌পতি–তাঁর গৌণ বিশেষণ। অন্যান্য বিশেষণগুলি, যেমন, পরমেষ্ঠী, মহারাজ, সার্বভৌম ও একরাজ–এগুলি ‘ইন্দ্রের’ মহান অভিষেক অনুষ্ঠানের অনুসরণে অর্জন করতে হত [ ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণ ৮ : ১৫ ]। এই ঐতরেয় ব্রাহ্মণেই আমরা আঞ্চলিক নামসহ নির্দিষ্ট কিছু উপাধি ব্যবহৃত হতে দেখি। পূর্বাঞ্চলের রাজা ‘সম্রাট’ রূপে অভিষিক্ত হতেন, দক্ষিণাঞ্চলের রাজারা ‘ভোজ’ (অন্যান্যদের নিয়ন্ত্রণকারী সার্বভৌম শাসক) নামে অভিহিত, উত্তরাঞ্চলের রাজা বিরাট (যুক্তরাষ্ট্ৰীয় অরাজতন্ত্রী রাজ্যগুলির অধিপতি), পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের রাজারা ‘স্বরাট (স্বাধীন নৃপতি) এবং সুস্থিতিশীল মধ্যাঞ্চল অর্থাৎ কুরু, পাঞ্চাল, বাশা ও উশীনার-এর শাসকরা ‘রাজা’ রূপে চিহ্নিত হতেন। আবার ‘পুনরাভিষেক’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজা আধিপত্যসূচক সমস্ত উপাধি লাভ করতে পারতেন।

কখনো কখনো রাজন্য, ক্ষত্ৰিয়, এমন কি বৈশ্যদের মধ্য থেকেও অমাত্য ও পুরোহিত মণ্ডলী রাজাকে নির্বাচন করতেন। তত্ত্বগতভাবে কোনো অনাৰ্যও রাজা হতে পারতেন; রাজা জনশ্রুতি তার দৃষ্টান্ত। ছান্দোগ্য উপনিষদে পৌত্রায়ণ শূদ্ৰ বলে উল্লিখিত; তেমনি মরুত্ত আবিক্ষিত ছিলেন আয়োগবি জাতির অন্তর্গত অর্থাৎ শূদ্র পিতা ও বৈশ্য মাতার সন্তান। রাজপদবী প্রধানত নির্বাচনের মাধ্যমে নিণীত হত বলেই মনে হয়, তবে বংশগত রাজপদ সংক্রান্ত কিছু কিছু নিদর্শনও পাওয়া যায়। এই নির্বাচন কখনো কখনো সমগ্ৰ জনগোষ্ঠী বা তাদের প্রতিনিধিমণ্ডলী এবং কখনো অমাত্যদের দ্বারা সম্পাদিত হ’ত; আবার শতপথে এমন একটি রাজ্যের কথা বলা হয়েছে, যেখানে একই রাজবংশ দশ প্রজন্ম ধরে শাসন করেছে।

আদর্শ রাজা তার প্রজাদের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন [তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ২ : ৭ : ১৬ : ৫৮]। আবার, কোথাও কোথাও রাজাকে নরখাদক হত্যাকারী রূপেও বর্ণনা করা হয়েছে। [ শতপথ ১৩ : ২ : ৯ : ৬; কৌষীতকি ২ : ৬ ]। অনিয়ন্ত্রিত রাজকীয় ক্ষমতার দ্বারা স্বেচ্ছাচারিতার বিপদ তখনো ছিল, এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তাকে সংযত করার চেষ্টা সত্ত্বেও তা নিঃসন্দেহে প্ৰায়ই আত্মপ্ৰকাশ করত। প্রথমত, এই নিয়ন্ত্রণশক্তি ব্ৰাহ্মণদের হাতেই ছিল, অভিষেকের মুহুর্ত থেকে তারা রাজার কাছে নিজেদের স্বতন্ত্র্য ঘোষণা করতেন। মন্ত্রী ও পরামর্শদাতারা একক ও সঙ্ঘবদ্ধভাবে রাজার স্বেচ্ছাচারিতাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। অন্যদিকে গ্রামণী, সমাহর্তা ও সমিধাতার মতো কাৰ্যনির্বাহকরাও প্রয়োগিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ স্বাধীনতা ভোগ করতেন। রাজাও সাধারণত তাদের ওপরে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করতেন না। রাজ্যের বিচক্ষণ ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত সভা এবং সমিতি, জন, মহাজন বা পরিষদ (বৌদ্ধ সাহিত্যে পরিস্‌স বা পরিসা) জনগণের আকাঙক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য হ’ত; এমন কি, কোনো রাজার শাসনপদ্ধতিতে স্বৈরতন্ত্রের লক্ষণ দেখা গেলে সে সম্পর্কে কঠিন ব্যবস্থা গ্ৰহণ করতে পারত। শতপথে (১২ : ৯ : ৩ : ১) তাই দেখা যায় যে, সৃঞ্জয় বা কিছু কিছু অবাঞ্ছিত রাজাদের নির্বাসনদণ্ড দিয়েছিলেন : যেমন–রেবোত্তরস, পতিব, চক্ৰ, স্থপতি ও দুষ্টরীষ্টু পৌংসায়ন। তেমনি ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও সিংহাসনচ্যুত রাজাদের নাম পাওয়া যায় [৮ : ১০]।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্যের প্রতি জনকের উক্তিকে [৪ : ৪ : ২৩ ] এবং বিশেষত শতপথ ব্ৰাহ্মণের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশে [ ১৩ : ৭ : ১ : ১৫ ] আমরা এমন একটি যুগের পরিচয় পাই যখন কৌম বা গোষ্ঠীর সম্পত্তিরূপে ভূমির প্রচলিত তাৎপৰ্ম্ম দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে এবং রাজা ও সম্রাটরা ভাবতে শুরু করেছেন যে, তারা ইচ্ছামতো ভূমি দান করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ জনমানসে এই ভূমিদািন প্রথার বিরুদ্ধে অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠছিল। এর পরবর্তী পর্যায়েই ভূমি ইচ্ছামতো ক্রয়বিক্রয়যোগ্য ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হ’ল। নূতন নূতন কৃষিযোগ্য জমি প্ৰস্তুতির এবং পতিত ও গোষ্ঠীভোগ্য জমিতে পশুচারণের সাধারণ অধিকারগুলি ক্রমাগত বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে, সাধারণ কৌম অধিকারগুলির পরিবর্তে কোনো নির্দিষ্ট জমিতে প্ৰত্যেকটি কৃষক পরিবারের পৃথকভাবে স্থায়ী অধিকারের সূচনা তৎকালীন ঘটনাপ্রবাহের অন্যতম একটি সূত্র। এর ফলে কৃষিব্যবস্থার কাঠামো ক্রমশ এমনভাবে পরিবর্তিত হ’ল যে, ভূমির ব্যক্তিগত সত্ত্বাধিকারই সমাজের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠল। সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনের অন্য বড় কারণ হ’ল ক্রমশ অর্থবিনিময় ব্যবস্থা গ্রামগুলিতে অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছিল। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে নগরায়ণের প্রবণতার অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ রয়েছে। এ-সময়ই কৌম সমাজগুলি ভেঙে যাচ্ছিল; কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে বা গ্রামে বসতি স্থাপনকারী গোষ্ঠী বা কৌমের অন্তর্ভুক্ত জনসাধারণ স্বাভাবিকভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠত, যদি কখনো কোনো বহিরাগত ব্যক্তি এসে তাদের মধ্যে বাস করতে চাইত,-কেননা এতে একই গোত্রসভূত স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ অর্থনীতি ও গোষ্ঠী-জীবনের ছন্দ বিপর্যন্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।