প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

১০. ‘যজ্ঞ ভক্ষ্য-অন্নসমেত দেবগণের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন’

‘যজ্ঞ ভক্ষ্য-অন্নসমেত দেবগণের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন

যজ্ঞানুষ্ঠান অতীতের ঘটনা এবং ভক্ষ্য-অন্ন লাভই সে অনুষ্ঠানের আদি-উদ্দেশ্য। এই বিষয়গুলিরই ইংগিত পাওয়া যায় ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণ থেকে। ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণে(৬০) বলা হয়েছে :

যজ্ঞ দেবগণের নিকট হইতে, ‘আমি তোমাদের অন্ন হইব না,’ ইহা বলিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। দেবতারা বলিলেন-না, তুমি আমাদের অল্পই হইবে। দেবতারা তাঁহাকে (যজ্ঞকে) হিংসা করিয়াছিলেন। হিংসিত হইয়াও তিনি দেবগণের (অন্নরূপে) প্রভূত হন নাই। তখন দেবগণ বলিলেন, এইরূপে হিংসিত হইয়াও ইনি যখন আমাদের অন্ন হইলেন না, অহো, তখন আমরা এই (প্রবর্গ) যজ্ঞের সম্ভার (আয়োজন) করিব। তাহাই হউক বলিয়া, তাঁহারা যজ্ঞের সম্ভার করিয়াছিলেন।
সেই যজ্ঞের সম্ভা করিয়া (দেবতারা) বলিলেন, হে অশ্বিদ্বয়, (আমাদের কর্তৃক পীড়িত) এই যজ্ঞের চিকিৎসা কর। (কেননা) অশ্বিদ্বয়ই দেবগণের ভিষক্‌।  (আবার) অশ্বিদ্বয়ই অধ্বর্যু; সেইজন্য অধ্বর্যুদ্বয় ঘর্মের (প্রবর্গের) সম্ভার (আয়োজন) করেন।

অতীতের সেই হারিয়ে-যাওয়া যজ্ঞকে কী ভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, ঐতরেয়-ব্ৰাহ্মণে এর পর তারই সুদীর্ঘ বর্ণনা পাওয়া যায়।

ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণের এই উক্তিগুলির ইংগিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর থেকে কয়েকটি বিষয় অনুমান করা সম্ভব।

প্রথমত, ব্ৰাহ্মণ-বর্ণিত যজ্ঞ অতীতকালের যজ্ঞের বা যজ্ঞের আদিরূপের পুনরুল্লেখ নয়–পুনর্গঠন। আদি যজ্ঞ দেবতাদের কাছ থেকে চলে গিয়েছিলো। যজ্ঞ দেবতাদের দ্বারা হিংসিত হয়েছিলো। অশ্বিদায়-দ্বারা হিংসিত যজ্ঞের চিকিৎসা প্রয়োজন হয়েছিলো। এবং পুরাকালের কয়েকটি মন্ত্রকে অবলম্বন করে ব্ৰাহ্মণ-সাহিত্যে সেই আদি-যজ্ঞের বিভিন্ন অবয়ব ও প্ৰাণ পুনর্গঠন করবার প্রচেষ্টা হয়েছিলো।

দ্বিতীয়ত, পরবর্তী যুগে—ব্রাহ্মণ-সাহিত্যে-যজ্ঞের উদ্দেশ্য ঠিক কী এবিষয়ে আমাদের একটা ধারণা আছে। কিন্তু ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণের উদ্ধৃতি থেকে অনুমান করা যায়, আদি-পর্যায়েও যজ্ঞের উদ্দেশ্য হুবহু তাই নয়। আদি-পৰ্যায়ে উদ্দেশ্যটি ঠিক কী? ভক্ষ্য-অন্ন লাভ। কেননা, ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণে বলা হয়েছে, যজ্ঞ দেবগণের নিকট হইতে “আমি তোমাদের অন্ন হইব না’–ইহা বলিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। দেবতারা বলিলেন, না তুমি আমাদের অন্নই হইবে।

উত্তরকালের যজ্ঞ যে অতীত যজ্ঞের পুনর্গঠনমাত্র–এ-কথা যদি ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণে মাত্র একবার উল্লিখিত হতো, তাহলেও তার সাক্ষ্য নিশ্চয়ই লঘুমূল্য হতো না। কিন্তু বস্তুত ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণে বারবার এই বিষয়টিরই উল্লেখ দেখা যায়।

যজ্ঞ দেবগণের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন। তাহারা প্ৰৈযদ্বারা সেই যজ্ঞকে প্রৈষ (আহ্বান) করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, তাহাই প্রৈষের প্রৈষত্ব।  দেবগণ পুরোরুক্‌সমূহ দ্বারা সেই যজ্ঞকে রুচিসম্পন্ন করিয়াছিলেন;…সেই যজ্ঞকে বেদিতে অনুবেদন (অনুকূলভাবে লাভ) কারিয়াছিলেন;…সেই যজ্ঞ বেদিতে লব্ধ হইলে পর উহাকে গ্রহদ্বারা (উপাংশু প্রভৃতি দ্বারা) গ্রহণ করিয়াছিলেন;…তাহাকে লাভ করিয়া নিবিৎসমূহের দ্বারা (দেবতার উদ্দেশ্যে) নিবেদন করিয়াছিলেন…
নষ্ট দ্রব্য পাইতে ইচ্ছা করিয়া, কেহ বা অধিক পাইতে ইচ্ছা করে, কেহ বা অল্প পাইতে ইচ্ছা করে। উভয়েয় মধ্যে যে অধিক পাইতে ইচ্ছা করে, সেই ব্যক্তি উভয়ের মধ্যে ভালো ইচ্ছা করে। সেইরূপ যে-ব্যক্তি এই প্ৰৈষমন্ত্ৰসকলকে দীর্ঘ বলিয়া জানে, সেই ব্যক্তি তাহা ভালো জানে; কেননা এই যে প্ৰৈষমন্ত্ৰসকল, এতদ্দ্বারাই নষ্টযজ্ঞের অন্বেষণ হয়। সেইজন্য (মৈত্রাবরুণ) মাথা নোয়াইয়া দাঁড়াইয়া প্ৰৈষমন্ত্ৰ পাঠ করিবেন।(৬১)

অবশ্য এখানে নষ্ট যজ্ঞের পুনর্গঠন-পদ্ধতি বর্ণিত হলেও আদিকালে যজ্ঞ যে ভক্ষ্য-অন্ন লাভেরই কৌশল ছিলো—সে-কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। কিন্তু অন্যত্র তা বলা হয়েছে :

একদা যজ্ঞ ভক্ষ্য-অন্নসমেত দেবগণের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন। দেবগণ বলিলেন, যজ্ঞ ভক্ষ্য-অন্নসমেত আমাদের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছেন, এই যজ্ঞের অনুসরন করিয়া আমরা অন্নেরও অন্বেষণ করিব। তাঁহারা বলিলেন, কিরূপে অন্বেষণ করিব? ব্রাহ্মণদ্বারা ও ছন্দোদ্বারা (অন্বেষণ) করিব। এই বলিয়া তাঁহারা (দীক্ষণীয়েষ্টি) যজ্ঞকে সমাপ্তি পৰ্যন্ত বিস্তৃত করিয়াছিলেন; অপিচ (দেব-) পত্নীগণেরও সংযোগ করিয়াছিলেন। সেই হেতু এখনও দীক্ষণীয়া ইষ্টতে যজ্ঞকে সমাপ্তি পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয় ও (দেব-) পত্নীগণেরও সংযোগ করা হয়। (দেবগণকৃত) সেই কর্মের অনুসরণ করিয়া মনুষ্যরাও তদ্রুপ করিয়া থাকে।… এইরূপে উত্তরোত্তর সারবান কর্মের অনুষ্টান দ্বারা দেবগণ এই যজ্ঞকে পাইয়াছিলেন…
সেই যজ্ঞকে পাইয়া দেবগণ বলিলেন, (অহে যজ্ঞ), তুমি আমাদের ভক্ষণীয় আয়ের জন্য অবস্থান কর। যজ্ঞ বলিলেন, না, কেন আমি তোমাদের জন্য অবস্থান করিব? এই বলিয়া যজ্ঞ দেবগণের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করিলেন। দেবগণ তাঁহাকে বলিলেন, ব্রাহ্মণদ্বারা ও ছন্দোদ্বারা সংযুক্ত হইয়া তুমি ভক্ষণীয় অন্নের জন্য অবস্থিতি কর। (যজ্ঞ বলিলেন), তাহাই হইবে। সেইহেতু অদ্যাপি যজ্ঞ ব্রাহ্মণদ্বারা ও ছন্দোদ্বারা সংযুক্ত হইয়া দেবগণের নিকট হব্য বহন করিয়া থাকেন।(৬২)

শুধু তাই নয়। ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণেই এমন ইংগিত পাওয়া অসম্ভব নয় যে, পরবর্তী যুগে পুনর্গঠিত ওই যজ্ঞের সঙ্গে শ্রেণীসমাজের নির্দিষ্ট শ্রেণীরই সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো :

প্ৰজাপতি যজ্ঞের সৃষ্টি করিয়াছিলেন; যজ্ঞসৃষ্টির পর ব্ৰহ্ম ও ক্ষত্রের সৃষ্টি করিলেন ও ব্ৰহ্মক্ষত্রের পর এই দ্বিবিধ প্ৰজার সৃষ্টি করিলেন। ব্ৰহ্মের অনুরপ হুতাদ এবং ক্ষত্রের অনুরূপ অহুতাদ সৃষ্টি করিলেন। এই যে ব্রাহ্মণগণ, ইঁহারাই হুতাদ (হুতশেষভোজী) প্রজা; আর রাজন্য বৈশ্য ও শূদ্র, ইঁহারাই অহুতাদ। যজ্ঞ তাঁহাদের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিল; ব্ৰহ্ম ও ক্ষত্র যজের অনুগমন করিয়াছিলেন। ব্রহ্মের যে-সকল আয়ুধ তাহার সহিত ব্ৰহ্ম ও ক্ষত্রের যে-সকল আয়ুধ তাহার সহিত ক্ষত্র,—তাহার অনুগমন করিয়াছিলেন। যজ্ঞের যে-সকল আয়ুধ তাহাই ব্রহ্মের আয়ুধ; আর অশ্বযুক্ত রথ, কবচ ও বাণযুক্ত ধনু-ইহাই ক্ষত্রের আয়ুধ। ক্ষত্রের আয়ুধে ভয় পাইয়া যজ্ঞ না ফিরিয়া পলাইতে লাগিল; ক্ষত্র তাহাকে ধরিতে না পাইয়া ফিরিয়া আসিলেন। ব্ৰহ্ম তাহার অনুসরণ করিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিলেন ও তৎপরে তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাহার গতি (পথ) রোধ করিলেন। এইরূপে (পথ) রুদ্ধ হইলে যজ্ঞ দাঁড়াইল এবং ব্রহ্মের নিকট আপনারই আয়ুধসকল দেখিয়া তাহার নিকট উপস্থিত হইল। সেই হেতু অদ্যাপি যজ্ঞ ব্রহ্মস্বরূপ ব্রাহ্মণেই প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। তখন ক্ষত্র সেই ব্রহ্মের অনুগমন করিয়া তাহাকে বলিলেন, আমাকে এই যজ্ঞে আহ্বান কর। ব্ৰহ্ম বলিলেন আচ্ছা, তাহাই হইবে; কিন্তু তুমি আপনার আয়ুধসকল ফেলিয়া দিয়া ব্রহ্মের আয়ুধ লইয়া ব্রহ্মের রূপ ধরিয়া ব্রহ্মসদৃশ হইয়া যজ্ঞের নিকট উপস্থিত হও। “তাহাই হউক” বলিয়া ক্ষত্র আপন আয়ুধ ফেলিয়া ব্রহ্মের আয়ুধ গ্রহণ করিয়া ব্রহ্মের রূপ ধরিয়া ব্রহ্মসদৃশ হইয়া যজ্ঞের নিকট উপস্থিত হইলেন। সেইহেতু অদ্যাপি ক্ষত্রিয় যজমান আপন আয়ুধ ফেলিয়া ব্রহ্মের আয়ুধ গ্রহণ করিয়া ব্রহ্মের রূপ ধরিয়া ব্রহ্মসদৃশ হইয়া যজ্ঞের নিকট উপস্থিত হন।(৬৩)

ঐতরেয় ব্রাহ্মণের সামাজিক পটভূমিতে কীভাবে ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূত্র প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিভেদাদি প্রকট হয়ে পড়েছিলো তারই দৃষ্টান্ত হিসেবে এখানে কয়েকটি উদ্ধৃতি অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

যে যজমান যজ্ঞ আরম্ভ করে, সে ব্রাহ্মণেরই শরণ লয়; কেননা যজ্ঞ ব্রহ্মস্বরূপ।…ব্রহ্মের শরণাপন্ন সেই যজমানকে ক্ষত্র হিংসা করিতে পারে না। আর “ব্রহ্ম মা ক্ষত্রাদ্‌ গোপায়তু” এই মন্ত্রাংশ বলিলে ব্ৰহ্ম সেই যজমানকে ক্ষত্র হইতে রক্ষা করেন। আর “ব্রহ্মণে স্বাহা” বলিলে ব্রহ্মকে প্রীত করা হয়; ব্ৰহ্ম প্রীত হইয়া তাহাকে ক্ষত্র হইতে রক্ষা করেন।…(৬৪)

কিংবা

যে ব্যক্তি রাষ্ট্র লাভ করে সে ক্ষত্রের শরণ লয়; রাষ্ট্রই ক্ষত্রস্বরূপ। ক্ষত্রের শরণাপন্ন সেই যজমানকে ব্ৰহ্ম হিংসা করিতে পারেন না। আর ক্ষত্র তাহাকে ব্ৰহ্ম হইতে রক্ষা করিবে, এই উদেশে “ক্ষত্ৰং মা ব্রাহ্মণে গোপায়ুতু” বলা হয়; আর “ক্ষত্রায় স্বাহা” বলিলে ক্ষত্রকে প্রীত করা হয়; ক্ষত্র প্রীত হইয়া তাহাকে ব্ৰহ্ম হইতে রক্ষা করেন।…(৬৫)

কিংবা

ব্ৰহ্ম ক্ষত্রের পূর্ববর্তী; ব্ৰহ্ম পূর্ববর্তী থাকিলে ক্ষত্রিয় যজমানের রাষ্ট্রও উগ্র হইয়া অন্যের নিকট ব্যথা পায় না।…(৬৬)

কিংবা

ক্ষত্র নিশ্চয়ই ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত এবং ব্রহ্মও ক্ষত্রে প্রতিষ্ঠিত…(৬৭)

কিংবা

ব্ৰহ্ম ক্ষত্রের পূর্ববর্তী; ব্রহ্ম পূর্বে থাকিলে যজমানের রাষ্ট্র উগ্র হইবে না এবং অপরের নিকট ব্যথা পাইবে না। সপ্তদশ স্তোম বৈশ্বস্বরূপ এবং একবিংশ স্তোম শূদ্রবর্ণের অনুরূপ। এতদ্বারা বৈশ্যকে ও শূদ্ৰবৰ্ণকে ক্ষত্রিয়ের বর্ত্মানুগামী করা হয়।।…(৬৮)

ঐতরেয় ব্রাহ্মণের যুগে যে রাষ্ট্রশক্তির আবির্ভাব ঘটেছিলো, এ-বিষয়ে আধুনিক বিদ্বানেরা অবশ্যই নিঃসন্দেহ, যদিও সেগুলি খণ্ড ও সীমাবদ্ধ রাষ্ট্রমাত্র। অধ্যাপক কীথ্(৬৯) যেমন ঐতরেয় ব্রাহ্মণের রাজনৈতিক পটভূমি প্রসঙ্গে বলছেন,

The political references do not hint at any great kingdoms, but at a large number of petty princes, who, despite their titles and claims to sovereignty, were doubtless rulers of limited portions of territory.

কিন্তু এই রাষ্ট্রশক্তি যে প্রাক্-বিভক্ত প্রাচীন সমাজের ধ্বংসস্তুপের উপরই আবির্ভূত হয়, সে-বিষয়ে আধুনিক বিদ্বানের সচেতন হতে চান না বলেই ঋগ্বেদের সমাজ থেকে—ঋগ্বেদের প্রাচীনতর অংশে যে সাম্যজীবনের আভাস পাওয়া যায় তা থেকে—এই ব্রাহ্মণ-বর্ণিত রাষ্ট্রশক্তির উদ্ভব কাহিনী আজো আমাদের কাছে অস্পষ্ট। আর এই কারণেই অস্পষ্ট হয়ে থেকেছে বৈদিক যজ্ঞের ইতিহাসটুকুও।

আমাদের যুক্তি অনুসারে, বৈদিক সমাজে রাষ্ট্রশক্তির এই আবির্ভাব এবং বৈদিক যজ্ঞের উপরোক্ত রূপান্তর, উভয়ই হলো বৈদিক মানুষদের জীবনে একটি মূল পরিবর্তনের দ্বিবিধ পরিণাম। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের রচনাকালে এই মূল পরিবর্তনটি প্রকট হয়েছিলো, কেননা ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আমরা ওই দ্বিবিধ পরিণামেরই সুস্পষ্ট পরিচয় পাই।

ঋগ্বেদের সাক্ষ্য অনুসারে অনুমান করা যায়, অতীতে বৈদিক মানুষেরাও সমাজ-বিকাশের প্রাক্-বিভক্ত পর্যায়ে—আদিম সাম্যাবস্থায়—জীবন-যাপন করতেন। তখনো তারা লেখার হরফ আবিষ্কার করেননি; মুখেমুখে গান রচনা করতেন। পার্থিব সুখ-সম্পদের কামনাই সে-গানের প্রাণবস্তু। এ-সম্পদ কিন্তু একার জন্য নয়—সকলের জন্য, সমষ্টির জন্য : ‘আমার’ নিজের জন্য চাওয়া নয়, ‘আমাদের’ সকলের জন্য চাওয়া। এবং এ-সম্পদ কারুর একার নয় বলেই তাতে সকলের সমান অধিকার—সমান অংশ, সমান ভাগ, সমান ভগ। অতএব এ-পর্যায়ে সমবণ্টন বা অংশবণ্টনের প্রসঙ্গও স্বাভাবিক। কোথাও কোথাও দেখা যায় মানুষেরা নিজেরাই অংশবণ্টনের কাজে ব্যাপৃত হয়েছেন; কিন্তু প্রধানত দেবতাদের উপরই তার দায়িত্ব ছিলো। কিন্তু বৈদিক দেবতাদের তখনো আধুনিক আধ্যাত্মিক অর্থে দেবত্বপ্রাপ্তি ঘটেনি। তাই প্রায়ই তাদের ‘সখা’ বলে এবং কখনো বা নিরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ‘নর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং আদিম সাম্যসমাজের পরিচায়ক হিসেবে শুধুই যে ঋগ্বেদের মানুষেরাই পরস্পরের সঙ্গে সমান তাই নয়, দেবতারাও পরস্পরের সঙ্গে সমান; এমনকি অতীতে দেবতারাও যে মানুষের সঙ্গে সমান ছিলেন বা মানুষেরাও দেবতাদের সঙ্গে সমান হয়েছিলেন—তার স্মৃতিটুকুও ঋগ্বেদ থেকে বিলুপ্ত হয়নি। স্বভাবতই, দেবতারাও মানুষের মতো সচেতনভাবে একত্র তাদের ভাগ গ্রহণ করতেন এবং সভায় গমন করতেন।

অন্যান্য প্রাচীন সমাজের মতোই বৈদিক সমাজের প্রাচীন পর্যায়েও সমবণ্টনের কৌশল হিসেবে অক্ষের ব্যবহার হতো কিনা তা ভেবে দেখবার অবকাশ আছে। হয়তো বৈদিক সভাতে এই কৌশলে অংশ-বণ্টন হতে বলেই সভাস্থান এবং দূতগৃহ অনেকাংশেই অভিন্ন ছিলো। এই কারণেই অক্ষকে মহৎগণের সেনানী এবং ব্রাতর রাজা বলে কল্পনা করা হয়েছিলো কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এই সভা বা বিদথই ছিলো ধন-বিভাগ বা অংশ-বণ্টনের স্থান।

অতএব, ঋগ্বেদের অন্তত প্রাচীনতর অংশগুলিতে রাষ্ট্রশাসনের উল্লেখ অস্বাভাবিক হবে। এবং সে-উল্লেখ দেখা যায় না। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, সে-পর্যায়ে বৈদিক সমাজের শাসন পরিচালনের কাজ কী ভাবে চলতো? ট্রাইব্যাল সমাজে যে-ভাবে চলে—অর্থাৎ, সভা-সমিতির উপর নির্ভর করেই। এইদিক থেকেই আমরা ঋগ্বেদে সভা, সমিতি ও বিদধের অমন অসামান্য গৌরবকে বোঝবার চেষ্টা করেছি। ঋগ্বেদোত্তর সাহিত্যে সভা, সমিতি ও বিদখের এই অতীত গৌরব ম্লান হয়েছে এবং মহাভারতাদিতে তা বিলুপ্ত হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে দেখা যায়, সভা-সমিতির মহিমার পরিবর্তে জেগে উঠছে ব্ৰহ্মসমর্থিত ও ক্ষত্ৰ-শাসিত রাষ্ট্রশক্তির মহিমা। এ-রাষ্ট্রের উদ্ভব হলো কী করে? ঐতিহাসিক বিবর্তনের সাধারণ নিয়ম হিসেবে আমরা জানি, জ্ঞাতিভিত্তিক প্রাক্-বিভক্ত সমাজের ধ্বংসস্তূপের উপরই রাষ্ট্রের আবির্ভাব হয় :

…the state was built on the ruins of the gentile constitution.(৭০)

বৈদিক মানুষদেরও প্রাক্-বিভক্ত প্রাচীন জ্ঞাতিভিত্তিক সমাজ কালক্রমে ভেঙে গিয়েছিলো এবং তারই ধ্বংসস্তুপের উপর আবির্ভূত হয়েছিলো শ্রেণীবিভক্ত সমাজ। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের পরিভাষায় নবপর্যায়ের শাসক-শ্রেণী বলতে প্রধানতই ক্ষত্র এবং শাসন-যন্ত্রের নাম রাষ্ট্র—যদিও ওই ক্ষত্র ব্রহ্ম-সমর্থিত বা ব্রাহ্মণ-সমর্থিত।

আমরা দেখাবার চেষ্টা করেছি, বৈদিক মানুষদের জীবনে এই মৌলিক পরিবর্তনটিরই আর-এক পরিণাম হলো বৈদিক যজ্ঞের রূপান্তর। সে-রূপান্তরের মূল কথা কী? সংক্ষেপে : অতীতে অনুষ্ঠান-নির্ভরতা (ritual) সত্ত্বেও যা ছিলো লোকায়তিক কামনা-চরিতার্থতার—অন্ন-লাভের—যৌথ পদ্ধতি, কালক্রমে তা শুধুই যে লোকোত্তরের কল্পনায় অনুষ্ঠান-মাত্রে পরিণত হলো তাই নয়, সামগ্রিক স্বাৰ্থ থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে নিযুক্ত বলেও কল্পিত হলো।

অতীতে কী রকম ছিলো? ধনী যজমানের পক্ষে অর্থব্যয় করে ঋত্বিক নিয়োগের পরিচয় নেই; তার বদলে যজমান নিজেই যজ্ঞকর্মে অংশগ্রহণ করতেন। যজমান শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থই তার একমাত্র প্রমাণ নয়; ঋগ্বেদে দেখা যায় সোমসবন, হবিপ্রদান প্রভৃতি ঋত্বিক-কর্ম যজমান স্বয়ংই সম্পাদন করছেন। আরো উল্লেখযোগ্য হলো, যজমান বলতে ব্যক্তিবিশেষ নন—অনেকে; তাই ‘যজমানগণ’। কিন্তু ঋগ্বেদের সাক্ষ্য অনুসারেই দেখা যায়, যজমানের সঙ্গে হোতা, ঋত্বিক প্রভৃতির পার্থক্য ক্রমশই ফুটে উঠছে। তখনো কিন্তু অসিক্‌নীতীরে যজমান এবং হোতার মধ্যে প্রভেদ ফুটে ওঠেনি : অসিক্‌নীতীরে যজমানই যেন হোতা। ঋগ্বেদের অর্বাচীনতম অংশে আমরা দেখছি, যজ্ঞ কর্মের সঙ্গে এবং যজ্ঞকৰ্ম-সম্পকিত জ্ঞানের সঙ্গে যজমানের কোনো সম্পর্কই নেই : সমস্ত যজ্ঞকৰ্মই যখন ঋত্বিকের উপর নির্ভরশীল তখন আর যজমানের পক্ষে চৈতন্তের প্রয়োজন কী? এর সঙ্গে প্রাচীনকালের সোমসবনকারী যজমানগণের তুলনা করলে বৈদিক যজ্ঞে কতোখানি রূপান্তর ঘটেছিলো তার আভাস পাওয়া যেতে পারে।

অতএব, অনুমিত হয় উত্তরকালে যজ্ঞের যাই পরিণতি হোক না কেন, অতীতে তা যৌথ কর্মপদ্ধতিই ছিলো।

কিন্তু সেই যৌথ-কর্মপদ্ধতির উদ্দেশ্য তখন কী? লোকোত্তর নয়; লোকায়তিক। অয়লাভ। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে তার ইংগিত অস্পষ্ট নয়। “যজ্ঞ দেবগণের নিকট হইতে ‘আমি তোমাদের অন্ন হইব না’, ইহা বলিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন”। “একদা যজ্ঞ ভক্ষ্য-অন্নসমেত দেবগণের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন। দেবগণ বলিলেন, যজ্ঞ ভক্ষ্য-অন্নসমেত আমাদের নিকট হইতে চলিয়া গিয়াছেন, এই যজ্ঞের অনুসরণ করিয়া আমরা অন্নেরও অনুসরণ করিব”। যা চলে গেলে ভক্ষ্য-অন্নও চলে যায়, যাকে অনুসরণ করলে ভক্ষ্য-অন্নেরও অমুসরণ করা হয় তাকে অন্নলাভের পদ্ধতি বা উপায় হিসেবেই চেনবার চেষ্টা করা স্বাভাবিক। অতএব আমরা যজ্ঞের আদিরূপকে অন্ন-লাভের যৌথ কৌশল বা প্রাচীন প্রাক-বিভক্ত সমাজের যৌথ উৎপাদন-কৌশল বলেই গ্রহণ করতে চেয়েছি, যদিও কালক্রমে তা লোকোত্তরের মোহে এবং ব্যষ্টি-স্বার্থে নিযুক্ত হতে দেখা যায়। স্বভাবতই, আমাদের যুক্তি অনুসারে বৈদিক মানুষদের প্রাচীন প্রাক্-বিভক্ত সমাজ ভেঙে শ্রেণীসমাজের আবির্ভাবই এ-পরিবর্তনের মূল কারণ বলে প্রতীত হয়েছে।

————-
৬০. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (ত্রিবেদী) ৫৬।
৬১. ঐ ১৮৩-৪ ।
৬২. ঐ ২৩৮ ।
৬৩. ঐ ৪৫০ ।
৬৪. ঐ ৪৫১।
৬৫. ঐ ।
৬৬. ঐ ৪৬৭ ।
৬৭. ঐ ৪৬৯ ।
৬৮. ঐ ৪৭০-১ ।
৬৯. A. B. Keith RVB 45.
৭০. F. Engels OFPPS276.