[সান ফ্রান্সিস্কোর বে-অঞ্চলে ১৯০০ খ্রীঃ ২৫ মার্চ প্রদত্ত বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত অনুলিপির অনুবাদ]
কৃষ্ণের প্রাচীন বাণী—বুদ্ধ, খ্রীষ্ট ও মহম্মদ—এই তিন মহাপুরুষের বাণীর সমন্বয়। এই তিন জনের প্রত্যকেই এক একটি মত প্রবর্তন করিয়া তাহা চূড়ান্তভাবে প্রচার করিয়াছেন। কৃষ্ণ এই মহাপুরুষগণের পূর্ববর্তী। তবুও আমরা বলিতে পারি, কৃষ্ণের পুরাতন ভাবসমূহ গ্রহণ করিয়া সেগুলির সমন্বয় সাধন করিয়াছেন, যদিও তাঁহার বাণী প্রাচীনতম। বৌদ্ধধর্মের প্রগতি-তরঙ্গে তাঁহার বাণী সাময়িক ভাবে নিমজ্জিত হইয়াছিল। আজ কৃষ্ণের বাণীই ভারতের বিশিষ্ট বাণী। আপনারা যদি ইচ্ছা করেন, আজ সায়াহ্নে আরবের মহাপুরুষ মহম্মদের বিশেষ কর্মধারা সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করিব।
মহম্মদ যৌবনে ধর্মবিষয়ে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করিতেন বলিয়া মনে হয় না; অর্থোপার্জনেই তাঁহার ঝোঁক ছিল। তিনি সৎস্বভাব ও অতিশয় প্রিয়দর্শন বলিয়া পরিগণিত হইতেন। এক ধনী বিধবা এই যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া তাঁহাকে বিবাহ করেন। পৃথিবীর বিস্তৃত ভূখণ্ডের উপর যখন মহম্মদ আধিপত্য লাভ করেন, তখন রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য তাঁহার দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাঁহার একাধিক পত্নী ছিলেন। পত্নীদিগের মধ্যে কে তাঁহার সর্বাপেক্ষা প্রিয়, জিজ্ঞাসিত হইয়া তিনি প্রথমা পত্নীর কথা উল্লেখ করিয়া বলেন, ‘তিনিই আমাকে প্রথম বিশ্বাস করেন। মেয়েদের মন বিশ্বাসপ্রবণ। … স্বাধীনতা লাভ কর, সব কিছু লাভ কর, কিন্তু নারী চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যটি যেন হারাইও না!’
পাপারণ, পৌত্তলিকতা, উপাসনার নামে ভণ্ডামি, কুসংস্কার, নরবলি প্রভৃতি দেখিয়া মহম্মদের হৃদয় ব্যথিত হইল। খ্রীষ্টানদের দ্বারা য়াহুদীরা অবনমিত হইয়াছিল। পক্ষান্তরে খ্রীষ্টানেরা মহম্মদের স্বদেশীয়গণ অপেক্ষা আরও অধঃপতিত হইয়াছিল।
আমরা সর্বদা তাড়াহুড়া করি। কিন্তু মহৎ কাজ করিতে গেলে বিরাট প্রস্তুতির প্রয়োজন। … দিবারাত্র প্রার্থনার পর মহম্মদ স্বপ্নে অনেক কিছু দর্শন করিতে থাকেন। জিব্রাইল (Gabriel) স্বপ্নে আবির্ভূত হইয়া মহম্মদকে বলেন যে, তিনি সত্যের বার্তাবহ। দেবদূত তাঁহাকে আরও বলেন—যীশু, মুশা ও অন্যান্য প্রেরিত পুরুষগণের বাণী লুপ্ত হইয়া যাইবে। তিনি মহম্মদকে ধর্ম প্রচারের আদেশ করেন। খ্রীষ্টানেরা যীশুর নামে রাজনীতি এবং পারসীকরা দ্বৈতভাবে প্রচার করিতেছিলেন দেখিয়া মহম্মদ বলিলেন, ‘আমাদের ঈশ্বর এক, সব কিছুরই প্রভু তিনি। ঈশ্বরের সঙ্গে অন্য কাহারও তুলনা হয় না।’
‘ঈশ্বর ঈশ্বরই; এখানে কোন দার্শনিক বা নীতিশাস্ত্রের জটিল তত্ত্ব নাই। আমাদের আল্লা এক অদ্বিতীয়, এবং মহম্মদই তাঁহার রসুল’—মক্কার রাস্তায় রাস্তায় মহম্মদ ইহা প্রচার করিতে লাগিলেন। … মক্কার লোকেরা তাঁহাকে নির্যাতন করিতে থাকে, তখন তিনি মদিনা শহরে পলাইয়া গেলেন। তিনি যুদ্ধ করিতে লাগিলেন, এবং সমগ্র আরবজাতি ঐক্যবদ্ধ হইল। আল্লার নামে মহম্মদের ধর্মজগৎ প্লাবিত করিল। কী প্রচণ্ড বিজয়ী শক্তি!
আপনাদের ভাবসমূহ খুব কঠোর, আর আপনারা খুবই কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বশবর্তী! এই বার্তাবহগণ নিশ্চয়ই ঈশ্বরের নিকট হইতে আসেন, নতুবা তাঁহারা কিভাবে এত মহান্ হইতে পারিয়াছিলেন? আপনারা প্রতিটি ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষ্য করিয়া থাকেন। আপনাদের প্রত্যেকেরই দোষ-ত্রুটি আছে। কাহার না আছে? য়াহুদীদের অনেক দোষ আমি দেখাইয়া দিতে পারি। দুর্জনেরা সর্বদাই দোষ-ত্রুটি খোঁজে। … মাছি ক্ষত অন্বেষণ করে, আর মধুমক্ষিকা শুধু ফুলের মধুর জন্য আসে। মক্ষিকা-বৃত্তি অনুসরণ করিবেন না, মধুমক্ষিকার পথ ধরুন।
পরবর্তী জীবনে মহম্মদ অনেক পত্নী গ্রহণ করেন। মহাপুরুষেরা প্রত্যেকে দুই শত পত্নী গ্রহণ করিতে পারেন। আপনাদের মত ‘দৈত্য’কে এক পত্নী গ্রহণ করিতেও আমি অনুমতি দিব না। মহাপুরুষদের চরিত্র রহস্যাবৃত। তাঁহাদের কার্যধারা দুর্জ্ঞেয়। তাঁহাদিগকে বিচার করিতে যাওয়া আমাদের অনুচিত। খ্রীষ্ট বিচার করিতে পারেন মহম্মদকে। আপনি আমি কে?—শিশুমাত্র। এইসকল মহাপুরুষকে আমরা কি বুঝিব?
মহম্মদের ধর্ম আবির্ভূত হয় জনসাধারণের জন্য বার্তারূপে। … তাঁহার প্রথম বাণী ছিল—‘সাম্য’। … একমাত্র ধর্ম আছে—তাহা প্রেম। জাতি বর্ণ বা অন্য কিছুর প্রশ্ন নাই। এই সাম্যভাবে যোগ দাও! সেই কার্যে পরিণত সাম্যই জয়যুক্ত হইল। … সেই মহতী বাণী ছিল খুব সহজ সরলঃ স্বর্গ ও মর্ত্যের স্রষ্টা এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী হও। শূন্য হইতে তিনি কিছু সৃষ্টি করিয়াছেন। কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিও না।
মসজিদগুলি প্রোটেষ্টাণ্ট গীর্জার মত, … সঙ্গীত, চিত্র ও প্রতিকৃতি এখানে নিষিদ্ধ। এককোণে একটি বেদী; তাহার উপর কোরান রক্ষিত হয়। সব লোক সারিবদ্ধ হইয়া দাঁড়ায়। কোন পুরোহিত, যাজক বা বিশপ নাই। … যে নমাজ পড়ে, সেও শ্রোতৃমণ্ডলীর একপার্শ্বে দণ্ডায়মান থাকিবে। এই ব্যবস্থার কতকাংশ সুন্দর।
এই প্রাচীন মহাপুরুষেরা সকলেই ছিলেন ঈশ্বরের দূত। আমি নতজানু হইয়া তাঁহাদের পূজা করি, তাঁহাদের পদধূলি গ্রহণ করি। কিন্তু তাঁহারা মৃত! … আর আমরা জীবিত। আমাদের আগাইয়া যাইতে হইবে! … যীশু অথবা মহম্মদের অনুকরণ করাই ধর্ম নহে। অনুকরণ ভাল হইলেও তাহা কখনও খাঁটি নহে। যীশুর অনুকরণকারী হইবেন না, কিন্তু যীশু হউন। আপনারা যীশু বুদ্ধ অথবা অন্য কোন মহাপুরুষের মতই মহান্। আমরা যদি তাঁহার মত না হই, তবে চেষ্টা করিয়া আমাদিগকে সেরূপ হইতে হইবে। আমি ঠিক ঠিক যীশুর মত নাও হইতে পারি। য়াহুদী হইয়া জন্মগ্রহণ করার প্রয়োজনও আমার নাই।
নিজ নিজ প্রকৃতির নিকট খাঁটি হওয়াই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ধর্ম। নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন। যদি আপনাদের নিজের অস্তিত্ব না থাকে, তবে ঈশ্বর অথবা অন্য কাহারও অস্তিত্বই বা কিরূপে থাকিবে? যেখানেই থাকুন, এই মনই অসীম অনন্ত ঈশ্বরকে পর্যন্ত অনুভব করে। ঈশ্বরকে আমি অনুভব করি, তাই তিনি আছেন। আমি যদি ঈশ্বরকে চিন্তা করিতে না পারি, তবে আমার কাছে তাঁহার অস্তিত্ব নাই। ইহাই মানব-প্রকৃতির বিরাট জয়যাত্রা।
এই মহাপুরুষগণ পথনির্দেশক চিহ্ন। ইহাই তাঁহাদের একমাত্র পরিচয়। তাঁহারা বলেন, ‘ভাতৃগণ, আগাইয়া যাও।’ আর আমরা তাঁহাদিগকে আঁকড়াইয়া থাকি; নড়িতে চাহি না; আমরা চিন্তা করিতে চাহি না, আমরা চাই অন্যে আমাদের জন্য চিন্তা করুক। ঈশদূতগণ তাঁহাদের ব্রত উদ্যাপন করেন। পূর্ণোদ্যমে কর্মপথে চলিবার জন্য তাঁহারা আমাদিগকে উপদেশ দেন। শত বৎসর পরে তাঁহাদের বাণী আমরা আঁকড়াইয়া ধরি এবং নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাই।
ধর্ম, বিশ্বাস ও মতবাদ সম্বন্ধে কথা বলা সহজ, কিন্তু চরিত্রগঠন ও ইন্দ্রিয়সংযম খুব কঠিন। এ বিষয়ে আমরা পরাভূত হই, কপট হইয়া পড়ি।
ধর্ম কোন মতবাদ নহে, কতকগুলি নিয়মও নহে। ধর্ম একটি প্রক্রিয়া। মতবাদ ও নিয়মগুলি অনুশীলনের জন্যই আবশ্যক। সেই অনুশীলনের দ্বারা আমরা শক্তি সঞ্চয় করি এবং অবশেষে বন্ধন ছিন্ন করিয়া মুক্ত হই। মতবাদ ব্যায়ামবিশেষ—ইহা ছাড়া তাহার অন্য কোন উপকারিতা নাই। … অনুশীলনের দ্বারা আত্মা পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়। যখন আপনি বলিতে পারেন, ‘আমি বিশ্বাস করি’—তখনই সেই অনুশীলনের পরিসমাপ্তি।
‘যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি মনুষ্য-দেহ ধারণ করি। সাধুদের পরিত্রাণ, দূষ্কৃতকারীদের বিনাশ ও ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।’২৫
জ্ঞানালোকের মহান্ বার্তাবহগণের ইহাই পরিচয়। তাঁহারা আমাদের মহান্ আচার্য, আমাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা; কিন্তু আমাদিগকে নিজ নিজ পথে চালিত হইবে।