মঙ্গলগ্রহে গিয়ে নামবার পর সে কিন্তুর ওপর ভরসা কিন্তু আর রাখা গেল না।
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত অনেক প্যাঁচ কযে মঙ্গলগ্রহে গিয়েই নামলাম। প্যাঁচের মধ্যে আসল হল লুটভিককেই কখনও রাগিয়ে কখনও ভয় দেখিয়ে শূন্যযানের কলা-কৌশল একটু বুঝে নেওয়া।
ভাগ্যি ভাল যে তখনও শূন্যযানের আসল রহস্য কিছু জানতে পারিনি। শুধু চালাবার কৌশলটাই শিখে নিয়েছি। চালাবার কায়দা কানুন তার অতি সোজা। বোতাম টেপো, হাতল টানো, চাকতি ঘোরাও ডাইনে বাঁয়ে, আর নজর রাখো ক-টা আলোর ওপর। আমাদের ট্রাফিক সিগন্যালের উলটো নিশান সেখানে। যতক্ষণ লাল ততক্ষণ কামাল। হলদে কি নীল হলেই হুঁশিয়ার হয়ে এদিকে বোতাম টেপো কি ওদিকের হাতল টানো।
সৃষ্টিছাড়া কী সর্বনাশা জিনিস নিয়ে যে কারবার করছি তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি বলে অকুতোভয়ে কলকবজা নেড়ে-চেড়ে শূন্যযান মঙ্গলের পিঠে গিয়ে নামিয়েছি।
ধুলোর ঝড় তখন থিতিয়ে এসেছে! তবু চারিদিকে বেশ কিছুটা ঝাপসা।
শূন্যযান থেকে বার হতে তখনও সাহস করিনি। বাইরে আমাদের নিশ্বাস নেবার জন্য হাওয়া তো থাকবারই কথা। যদি বা থাকে তা পৃথিবীর প্রাণীর পক্ষে বিষও তো হতে পারে।
মঙ্গলগ্রহে এসে পৌঁছেছি তাই যথেষ্ট। সেখানে নেমে কোনও লাভ হবে কিনা তাই তখন ভাবছি।
জানলা দিয়ে গ্রহের যা চেহারা চোখে পড়ছে তা নামবার উৎসাহ বাড়াবার মতো নয়। বিচক্ষণ বৈজ্ঞানিকেরা যা অনুমান করেছেন—সেই ধু ধু মরু।
যন্ত্রঘরে টাঙানো মানচিত্র দেখে বুঝলাম, মঙ্গলগ্রহের ইলেকট্রিস যার নাম দেওয়া হয়েছে সেই জায়গাটাতেই নেমেছি।
হাওয়ার অস্তিত্ব মাপার যন্ত্রটা বিকল, কিন্তু জলীয় বাষ্প মাপবার যন্ত্রটায় দেখলাম পৃথিবীর থেকে যা ধারণা হয় মঙ্গলগ্রহ তার চেয়েও অসম্ভব রকম শুকনো। পৃথিবীর মরুপ্রদেশের হাওয়াতে যা জলীয় বাষ্প আছে, মঙ্গলগ্রহের আবহাওয়ায় বাষ্পের পরিমাণ তার প্রায় দু-হাজার ভাগের মতো।
হাওয়ার ব্যাপারটা না-ই জানা যাক, এত শুকনো আবহাওয়ায় কোনও প্রাণের অস্তিত্ব অসম্ভবই ধরে নিতে হয়।
মিছিমিছি এ শ্মশান প্রান্তরে নেমে তাহলে লাভ কী। মঙ্গলগ্রহে নামতে পেরেছি। সেই গর্বটুকু নিয়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করাই তো ভাল।
অক্সিজেন মুখোশ নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য নেমে একটু ঘুরে আসা অবশ্য যায়। কিন্তু তাতেও অজানা ভয়ংকর কোনও বিপদ যে নেই তা-ই বা কে বলতে পারে!
অন্য কিছু না হোক, এখানকার নামমাত্র হাওয়ার ছাঁকনিতে অবারিত আলট্রাভায়োলেট আর কসমিক রে অর্থাৎ মহাজাগতিক রশ্মির বৃষ্টিই মানুষের পক্ষে মারাত্মক হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়।
জানলায় দাঁড়িয়ে এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম হঠাৎ বটুকের কথায় চমকে গেলাম।
বটুক অবশ্য উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে কিছু বলেনি। তার সেই নিজস্ব মার্কামারা মুখস্থ-পড়া-বলার ধরনের কথা।
কিন্তু কথা যা বলেছে তা সত্যিই চঞ্চল করে তোলবার মতো। আর কেউ হলে যে কথাটা বলতে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে একাকার করত বটুকেশ্বর তা-ই বলেছে নেহাত যেন কলকাতার বাড়িতে বসে বাজারে যাচ্ছি বলার মতো। কথাটা কিন্তু হল—বেরিয়েই লুকোল।
বেরিয়েই লুকোল! সে কী! কী লুকোল? কোথা থেকে বেরিয়ে? কোথায় লুকোল?
আমি আর সুরঞ্জন দুজনেই তার দিকে ফিরে ব্যাকুল উত্তেজিত অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করেছি।
ওই একটা জাঁতার কাছে। বটুকেশ্বরের ভাবান্তর নেই।
জাঁতার কাছে! জাঁতা! আমরা আরও হতভম্ব।
তার পরই অবশ্য খেয়াল হয়েছে যে বটুকেশ্বর তার নিজের বুদ্ধিতে একরকম বুঝিয়ে যা বলতে চেয়েছে তা খুব ভুল নয়। এই মরুভূমির ভেতর বেশ দূরে দু-তিনটে যে পাথরের চাঁই দেখা যাচ্ছে সেগুলোকে দেখতে খানিকটা যেন দৈত্যদানোর বিরাট জাঁতার মতো চ্যাপ্টা গোল গোছের।
কিন্তু সেই জাঁতার কাছে বেরিয়েই লুকোলটা কী?
এ প্রশ্নের উত্তরে বটুক সামান্য একটু যেন অবাক হয়েছে আমাদের দৃষ্টিশক্তির অভাবে।
আপনারা দেখতে পাননি? ওই যে ছোটবড় মাথায় মাথায় বসানো কটা জালা!
ক-টা জালা—তাও আবার বেরিয়েই লুকিয়ে গেল! বলছে কী বটুকেশ্বর!
জাঁতার উপমাটা ঠিকই একরকম দিয়েছিল, কিন্তু এই জালার ওপর জালা দেখা তো নির্ঘাত মাথা খারাপের লক্ষণ।
শেষে বটুকেশ্বরেরও মাথা খারাপ হল দেখে তখন সত্যি দুঃখ হচ্ছে। যে-কোনও অবস্থায় একেবারে বরফের মতো ঠাণ্ডা বটুকেরই যখন মাথা খারাপ হল তখন আমাদের আর হতে কতক্ষণ বাকি!
মাথা খারাপ হওয়ার অবশ্য অপরাধ বা কী? থর-এর মরুর ঝড়ে প্লেন থেকে নামার পর থেকে যা আমাদের ওপর দিয়ে যাচ্ছে তাতে মাথা যে এতক্ষণ ঠিক ছিল সেইটেই ভাগ্য।
কারওর মাথায় গোলমাল শুরু হলে তখন তাকে ঘাঁটিয়ে অসুখ বাড়াবার সুযোগ দিতে নেই।
বটুকের কথাটাই তাই যেন মেনে নিয়ে তাকে একটু খুশি করবার জন্য বললাম, জালাগুলো কারও মাথায় ছিল বুঝি?
না, বটুক মাথা নেড়ে জানাল, পর পর ক-টা যেন জালা, ওপরেরটা ছোট, মাঝেরটা বড়, আর তার নীচের দুটো কলসি। সেগুলো নিজে থেকেই বেরিয়ে আবার জাঁতার আড়ালে চলে গেল।
তা যদি গিয়ে থাকে তাহলে আবার দেখা যাবে নিশ্চয়।বটুককে উৎসাহ দিলাম, চোখের দোষ তোমার নেই যে বলব ভুল দেখছ।
বটুক জবাব দিলে না। কিন্তু মনে মনে আমি তখন ওই সম্ভাবনাটাই সঠিক বলে। ধরে নিয়েছি। বটুকের চোখের দৃষ্টি খুব প্রখর, কিন্তু মাথা খারাপ যদি না-ও হয়ে থাকে, দেখতে এবার তার ভুল যে হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
সুরঞ্জনও ব্যাপারটা বুঝেছে নিশ্চয়। তবু চোখের ইশারায় তাকে বটুককে একটু সামলে রাখতে বলার জন্য তার দিকে চাইতে গিয়ে একটু অবাক হলাম।
সুরঞ্জন যেভাবে চোখ দুটো জানলায় প্রায় সেঁটে ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে তাতে বটুকের কথায় তার খুব অবিশ্বাসের লক্ষণ তো নেই।
তার সম্বন্ধে একটু ভাবিত হয়ে আধা-ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমিও জালা-টালা দেখতে পাচ্ছ নাকি?
এখনও পাইনি। আমার দিকে মুখ ফিরিয়েই সুরঞ্জন উত্তর দিলে, কিন্তু বটুক যখন দেখেছে তখন তা একেবারে ভুল হতে পারে না।
এবারে হেসে ফেলে বললাম, বটুকের দেখা ঠিক হলে তো পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকেরা সব বিস্ময়ে বোবা হয়ে যাবেন। হাওয়া নেই, জল নেই এমন যমের অরুচি মরুভূমির দেশ, অতি বড় আশাবাদী বৈজ্ঞানিকও যেখানে ভাইরাস কি লিচেন-এর চেয়ে উঁচু ধাপের প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে বলে মনে করেন না, সেখানে একেবারে জালা-প্রমাণ জানোয়ার! তা-ও আবার পর পর সাজানো জালা।
একটু থেমে আবার বলেছি, দেখো, জালা-জন্তুর অস্তিত্ব যদি প্রমাণ করতে পারো তো পৃথিবীতে ফিরে বিজ্ঞান-জগতে একটা হুলুস্থুল বাধিয়ে তুলতে পারবে। তা পৃথিবীতে ফেরার ব্যবস্থা করার জন্যই লুটভিক-এর একবার খবর নিয়ে আসা দরকার।
তখনই যদি লুটভিক-এর খোঁজে যাবার জন্য অত ব্যস্ত না হই তাহলে জর্জ বিশ্বাস আর পঙ্কজ মল্লিক, মান্না দে আর তালাত মামুদের সঙ্গে আরেকটা ভারত-জোড়া নাম আজ গানের জগতের গর্ব হয়ে থাকে। সুরঞ্জন সরকার নামটা আজ মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু তা হবার নয়। ও নামটা পৃথিবীর গানের জগতে আর লেখাই হল না।
ঘনাদা একটু ছোট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে থামলেন।
তার মানে হল কী সুরঞ্জন সরকারের? উতলা হয়ে উঠলেন কার্ডিওগ্রাম সান্যাল।
মারা গেলেন নাকি? ব্লাডপ্রেশার সোম দারুণ উদ্বিগ্ন।
ওই কাঠপোড়া ছাইতেও কাজ হল না? ব্লাডটেস্ট গুপ্তের বেয়াদবি আশঙ্কা।
কাঠপোড়া ছাইয়ে কাজ হবে না কেন? তারই জোরে সব তো তখন চাঙ্গা। আহম্মকদের বেওকুফি বেচাল বাধ্য হয়ে তাড়াতাড়ি শুধরে দিতে হল আমাদের সুরঞ্জন সরকার বোধ হয় হঠাৎ গায়েব হয়ে গেল, না ঘনাদা?
কাঠপোড়া ছাইয়ের অপমানে বিপজ্জনক ভাবে কোঁচকানো ভুরুটা কিছুটা সরল হতে দেখে সাহস করে আবার একটু ন্যাকা সাজলাম—মঙ্গলগ্রহের ওই ইলেকট্রিসিটিতে শেষ পর্যন্ত নামতে হল বুঝি?
ইলেকট্রিসিটি নয়, ইলেকট্রিস, ঘনাদা সানন্দে সংশোধন করে আবার শুরু করলেন, ইলেকট্রিস হল মঙ্গলের দক্ষিণ গোলার্ধের একটা জায়গা। সেখানে নামবার সত্যিই বিন্দুমাত্র বাসনা ছিল না। নামতে যদি হয় মঙ্গলের উত্তর মেরুর কাছাকাছি নামলেই লাভ কিছু হতে পারে। সেখানকার মেরুর আইসক্যাপ অর্থাৎ হিমমুকুট জল নয়, জমানো কার্বন ডায়ক্সাইড দিয়ে তৈরি বলে অনেক জ্যোতিষী বৈজ্ঞানিকের ধারণা, কিন্তু সে ধারণা বাতিল করবার মতো প্রমাণও আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। পৃথিবীর মেরু প্রদেশের মতো মঙ্গলেরও গ্লেসিয়ার অর্থাৎ হিমবাহ আছে বলে জানা গেছে। কার্বন ডায়ক্সাইডের শুকনো তুষার থেকে কিন্তু হিমবাহ সৃষ্টি হয় না। হিমবাহের অস্তিত্ব থেকেই সেখানে জল আছে বলে সুতরাং ধরে নেওয়া যায়। আর জল থাকলে সেখানেই অন্তত প্রাণের চিহ্ন পাবার আশা কিছুটা করা যেতে পারে।
ইলেকট্রিস থেকে শূন্যযান উড়িয়ে আবার উত্তর মেরু অঞ্চলে নামতে হলে অবশ্য আরও অনেক হাঙ্গামা করতে হত। সে হাঙ্গামা পোহাবার উৎসাহ শেষ পর্যন্ত হত কিনা জানি না—কিন্তু তার অবসরই আর হল না।
কন্ট্রোল রুমে লুটভিককে দেখে আসতে গিয়ে তার একটা গালাগাল শুনে এসে আমাদের কামরায় ঢুকে একটু অবাক হলাম।
সুরঞ্জন আর বটুক গেল কোথায়?
এতদিন বাদে নিজেদের বানানো কয়েদ-ঘর খুলে বার হবার সুবিধে পেয়ে শূন্যযানটা ভাল করে ঘুরে দেখতে গেছে নাকি! তাই যাওয়াই সম্ভব।
বটুক যে জালা-জন্তুর আভাস দেখেছিল, তা আর দেখতে পায়নি নিশ্চয়। তা পেলে এ জানলা থেকে সুরঞ্জনকে কি নড়ানো যেত?
বটুকের চোখের জোর সত্যিই যে অসাধারণ তার প্রমাণ আগেও পেয়েছি, কিন্তু এবারে তার অমন দৃষ্টিবিভ্রম কী থেকে হল তা জানলায় একবার দেখতে গিয়ে একেবারে থ হয়ে গেলাম।
এ আমি কী দেখছি!
শেষকালে আমারও চোখে ধাঁধা লাগল নাকি!
সত্যিই বড় বড় পাথর ছড়ানো রাঙা বালির প্রান্তর দিয়ে ও কী রকম দুটো কিম্ভুতকিমাকার মূর্তি চলে যাচ্ছে।
কিন্তু বটুক যা বলেছিল সে রকম কিছু তো এ মূর্তিগুলো নয়। বটুক জালার ওপর জালা বসানো এক রকম অদ্ভুত চেহারা চকিতে দেখবার কথা বলেছিল।
আমি যা দেখছি তার সঙ্গে জালা কি কলসির কোনও মিল কিন্তু নেই।
এগুলো যেন–
ওই পর্যন্ত ভাবতে গিয়ে যেন বিদ্যুতের শক খেয়ে চমকে আমাদের কামরার বাইরের একটা ছোট কুঠুরিতে ছুটে গেলাম।
দরজা খুলে সেখানে গিয়ে দাঁড়াবার পরই চক্ষুস্থির। ঠিক যা ভয় পেয়েছিলাম তা-ই।
এ কুঠুরিটা শূন্যযানের কিছু খুঁটিনাটি দরকারি জিনিসের সঙ্গে অক্সিজেন মুখোশ, স্পেস স্যুট ইত্যাদি রাখবার জায়গা।
লুটভিক সেই প্রথম দিন এ কুঠুরি আর তার সাজ-সরঞ্জাম আমাদের দেখিয়ে আনতে ভোলেনি।
অন্য জিনিসপত্রের মধ্যে সেদিন এক সারিতে দাঁড় করানো গোটা পাঁচেক একটু অদ্ভুত ধরনের স্পেস-স্যুট দেখার কথা স্পষ্টই মনে আছে।
সেই স্পেস-স্যুটের সারির দিকে চেয়ে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল।
দুটো পোশাক সেখানে নেই। কেন যে নেই তা আর বুঝতে দেরি হল না।
ছুটে গিয়ে আবার জানলার কাছে দাঁড়ালাম।
স্পেস স্যুট পরা চেহারা দুটো তখন অনেক দূরে চলে গেলেও একেবারে অদৃশ্য হয়নি। বটুক যেগুলোকে জাঁতা বলে বোঝাতে চেয়েছিল দূরের সেই রকম একটা চ্যাপটা পাথরের চাঁইয়ের দিকেই সে দুটো যাচ্ছে।
মূর্তি দুটো যে স্পেস স্যুট পরা সুরঞ্জন আর বটুকেশ্বরের সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ তখন অবশ্য মনে নেই।
কিন্তু ওদের দুজনের হঠাৎ এ সর্বনাশা খেয়াল হল কেন? বটুক যা বলেছিল তারপর সুরঞ্জন জানলা থেকে সে রকম কোনও জালা-মুর্তি কি দেখতে পেয়েছে? তা পেয়ে থাকলে আমাকে তা জানাবার ফুরসুতটুকুও তাদের হয় না কেন? আমি তাদের এ সংকল্পে বাধা দেব এই ভয়ে? কিন্তু বটুক যা দেখেছে সুরঞ্জনও সে রকম কিছু দেখে থাকলে আমি বাধা দিতে যাব কেন? ভেবে দেখতে গেলে মনে হয়, তাদের এমনভাবে বেরিয়ে পড়াটা কি খেয়াল বলেই আমায় কিছু জানাতে তারা চায়নি।
বটুক যা দেখেছে বলেছে, তা-ই বিশ্বাস করার দরুন একবার বেরিয়ে খোঁজ করবার লোভ সুরঞ্জন সামলাতে পারেনি।
কাজটা ওদের খুবই অন্যায় হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি এখন কী করব?
আরেকটা স্পেস স্যুট পরে তাদের পেছনে বেরিয়ে পড়ব?
কিন্তু তখন তাহলে শূন্যযানটায় একা লুটভিককে রেখে তো চলে যেতে হয়।
লুটভিক অবশ্য বাঁধা আছে। কিন্তু তাকে বিশ্বাস কিছু তো নেই। চোখে চোখে না রাখলে কী যে সে করবে কে বলতে পারে। একবার কোনও উপায়ে বাঁধনগুলো খুলতে পারলে তো আমাদের সর্বনাশ। পৃথিবীতে ফেরার আশা তাহলে তো নেইই, এখানে, এই মঙ্গলগ্রহেই কী পৈশাচিক প্রতিশোধ সে নেবার চেষ্টা করবে কে জানে।
তাকে একলা ছেড়ে যেতে তাই রীতিমত দ্বিধা হয়।
সে দ্বিধাও অবশ্য শেষ পর্যন্ত আটকে রাখতে পারলে না।
জানলা দিয়ে সারাক্ষণই বাইরে নজর রেখেছিলাম। সুরঞ্জন ও বটুকের মূর্তি দুটো ক্রমশ ছোট ও অস্পষ্ট হয়ে এলেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত দেখতে পেয়েছি। কিন্তু তারপর একটা জাঁতা-পাথরের আড়ালে তারা অদৃশ্য হয়ে যাবার পর অস্থির।
জাঁতা-পাথরের আড়ালে মূর্তি দুটো একেবারে মিলিয়ে গেল নাকি?
তা না গেলে, যত ছোটই হোক, মূর্তিগুলোকে জাঁতা-পাথরের পেছন থেকে বার হবার পর দেখতে পাওয়ার কথা।
ওরা দুজনে ওখানেই থেমে গেছে তাহলে। থেমে যাওয়ার কারণটা কী?
জালা গোছের চেহারা তো বটুকের কথা মতো ওই রকম একটা জাঁতা-পাথরের ধার থেকেই বেরিয়ে আবার লুকিয়ে পড়েছিল।
এখন ওখানে গিয়ে সে জালা-জন্তুর নতুন কোনও চিহ্ন ওরা কি তাহলে পেয়েছে?
ধৈর্য ধরে আর থাকা গেল না। কন্ট্রোল রুমে গিয়ে লুটভিককে আর একবার দেখে এসেই স্পেস স্যুট পরে শূন্যযানের বাইরে বেরিয়ে এলাম।
শূন্যযানের এয়ার-লকটা বন্ধ করে বাইরে লালচে বালির ওপরে এসে দাঁড়াবার পর বুকটা একবার যে ছাঁৎ করে উঠল সে কথা অস্বীকার করতে পারব না। মনে হল শূন্যযান ছেড়ে এসে নিজেদের নিয়তি কি নিজেরাই শিলমোহর করে এলাম।
ও শূন্যযানে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার ভাগ্য কি আর হবে?
সে বিষয়ে আশঙ্কা উদ্বেগ যতই থাক, সুরঞ্জন আর বটুকের খোঁজ আগে না করলে নয়।
যে জাঁতা-পাথরের কাছে তাদের শেষ দেখেছিলাম দেরি না করে সেদিকেই পা বাড়ালাম তাই।
মঙ্গলগ্রহ পৃথিবীর তুলনায় ছোট। চাঁদের মতো অত অল্প না হলেও তার মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর চেয়ে অনেক কম। অত ভারী স্পেস-স্যুট পরেও হাত-পা চালাতে তাই কোনও কষ্টই হল না। পৃথিবীতে যা কমপক্ষে পনেরো মিনিটের পথ, মিনিট দশেকের আগেই সেখানে পৌঁছে গেলাম।
শূন্যযান থেকে যা মনে হয়েছিল, কাছে যাবার পর দেখা গেল জাঁতা-পাথরের টিবিটা তার চেয়ে অনেক বড়।
পাথরের চাংড়ার আড়ালে সুরঞ্জনকেও দেখতে পেলাম। ঠিক দেখতে পেলাম বলা অবশ্য ভুল। লম্বা-চওড়া আকারটা দেখে বুঝলাম স্পেস স্যুটটার ভেতর বটুক নয়, সুরঞ্জনই আছে।
কিন্তু সে একা কেন? বটুক কোথায় গেল?
স্পেস স্যুটের স্পিকিং টিউব দিয়ে সেই কথাই জিজ্ঞাসা করলাম সুরঞ্জনকে।
তুমি এখানে বসে বসে করছ কী? বটুক তো তোমার সঙ্গেই এসেছিল। সে গেল কোথায়?
উত্তরে কোনও কথা না বলে সুরঞ্জন শুধু সামনের জাঁতার মতো পাথুরে ঢিবিটা হাত বাড়িয়ে দেখালে।
পাথুরে ঢিবিটা কী দেখাচ্ছে সুরঞ্জন? স্পেস-স্যুটের মুখোশে ঢাকা না থাকলে তার মুখটা দেখবার চেষ্টা করতাম।
অবাক হয়ে ঢিবিটা একবার দেখে আবার সুরঞ্জনের দিকে ফিরলাম—কী হল কী তোমার? ও ঢিবি কী দেখাচ্ছ? বটুক কোথায় গেল তাই তো জিজ্ঞাসা করছি।
এবার সুরঞ্জনের গলাই শোনা গেল, বটুক ওখানেই গেছে।
ওখানেই গেছে মানে কী? বটুক ওই পাথুরে ঢিবির মধ্যে গেছে? এ কি ভোজবাজি নাকি! না, মঙ্গলগ্রহের মাটিতে মাথা খারাপ করবার কোনও কিছু আছে?
সুরঞ্জনকে রহস্যটা একটু বুঝিয়ে দেবার কথা বলতে যাচ্ছি, এমন সময় চোখটা দূরে একটা জায়গায় আটকে গেল।
যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানকার মতোই আরেকটা চ্যাপ্টা গোল ধরনের পাথুরে ঢিবির কাছে কী ওগুলো?
বটুক যা বলেছিল হুবহু তো তাই।
গোল গোল পর পর সাজানো ক-টা যেন কলসি আর জালা।
সেগুলো তো ওই ঢিবির ভেতর থেকেই বেরিয়ে এসেছে ও আসছে।
প্রথমে দুটো, তারপর একটা একটা করে আরও তিনটে।
এ কী ধরনের জানোয়ার?
সত্যিই জানোয়ার, না ভৌতিক কিছু?
ভৌতিক না হলে ওই পাথরের ঢিবির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে কী করে?
শুধু যে বেরিয়ে আসে তা নয়, সুরঞ্জনের কথা বিশ্বাস করতে হলে তো জলজ্যান্ত অন্য কাউকে ওই পাথরের মধ্যে মিশিয়ে দিতেও পারে বলে মানতে হয়!
সুরঞ্জনও তখন জালা-মূর্তিগুলোর দিকে চেয়ে আছে।
স্পেস-স্যুটের ভেতর দিয়েই চাপা উত্তেজিত গলায় বললে, দেখতে পেয়েছেন? বিশ্বাস হয়েছে এবার বটুকের কথা?
বিশ্বাস তো হয়েছে, কিন্তু এখন কী করা উচিত তাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এই অদ্ভুত মূর্তিগুলোর ভাল করে একটু পরিচয় নেবার চেষ্টা করব? বটুক কি সেই রকম কিছু করতে গিয়েই পাথরের ঢিবির মধ্যে মিশিয়ে গেছে?
মুর্তিগুলো কী ধরনের জীব তাও তো জানা নেই! নিরীহ, নির্দোষ, না হিংস্র নিষ্ঠুর?
মঙ্গলগ্রহে এরকম কোনও জীবের অস্তিত্বও তো কেউ কখনও কল্পনা করেনি।
কোনও আজগুবি বৈজ্ঞানিক গল্পেও এরকম প্রাণীর কল্পনা আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।
এদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাই বা কীভাবে করা যায়?
মূর্তিগুলো দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের যে লক্ষ করছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু দাঁড়ানোটা তাদের ধীর স্থির নয়, পাঁচটা মূর্তি অনবরতই নড়ছে চড়ছে।
ওটা কি উত্তেজনার লক্ষণ?
উত্তেজিত হওয়া আশ্চর্য তো কিছু নয়। আমরা তাদের দেখে যদি তাজ্জব হয়ে থাকি তো তাদেরও তো আমাদের দেখে তাই হওয়ার কথা।
প্রথমত, তাদের এই মঙ্গলগ্রহে এ রকম অচেনা অদ্ভুত এক রকম প্রাণীর আবির্ভাবই তাদের কাছে অবিশ্বাস্য ব্যাপার। দ্বিতীয়ত, স্পেস-স্যুটে আমাদের যা চেহারা হয়েছে কিছু না জেনে তা প্রথম দেখলে পৃথিবীর কোনও সরল পাহাড়-জঙ্গলের মানুষও ভয়েই ভিরমি যেত নাকি?
আমরা যেমন তাদের সম্বন্ধে কী করা উচিত ঠিক করতে পারছি না, তাদেরও অবস্থা নিশ্চয় তথৈবচ।
অবশ্য যাদের দেখছি, তারা মানুষের মতো বুদ্ধিমান মঙ্গলগ্রহের কোনও জীব যদি হয় তাহলে এসব কথাই ওঠে না।
বুদ্ধিশুদ্ধি আছে বলে ধরে নিয়ে প্রথমে কীভাবে তাদের বোঝানো যায় যে আমরা শুধু তাদের সঙ্গে ভাব করতেই চাই?
গলার স্বর তো এখানে কোনও কাজে লাগবে না। বেটপ স্পেস স্যুটের ভেতর থেকে কোনও ইঙ্গিত করাও শক্ত। হাত-পাগুলো একটু নেড়েচেড়ে ভাব করবার কোনও ভঙ্গি দেখানো যায় কিনা তাই ভাবতে হয়।
ভাববার কিন্তু আর দরকার হল না।
জালা-মূর্তিগুলো হঠাৎ দেখলাম সেই পাথরের ঢিবির দিকেই নড়তে শুরু
করেছে।
শিগগির আসুন, বলে সেই মুহূর্তেই সুরঞ্জন তার বেঢপ স্পেস স্যুট নিয়েই মূর্তিগুলোর দিকে ছুট লাগাল।
ও কী করছ কী? বলেও তাকে তখন অনুসরণ না করে পারলাম না।
জালা-মূর্তিগুলো আমাদের ছুটতে দেখে চঞ্চল যে হয়ে উঠেছে তা চোখেই দেখতে পাচ্ছিলাম।
ওই বিদঘুটে ঢাউস শরীর নিয়েই তারা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি চ্যাপটা ঢিবিটার আড়ালে চলে যাচ্ছে।
কিন্তু সেখানে যাচ্ছে কোথায়?
আর সুরঞ্জনই বা সেদিকে অমন পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছে কেন?
মূর্তিগুলো এখন যেন পালাতেই ব্যস্ত মনে হলেও বেকায়দায় পড়ে ফিরে দাঁড়াতেও তো পারে!
তারা তখন কীরকম শত্রু হয়ে দাঁড়াবে তার ঠিক কী? তাদের অস্ত্র শস্ত্র ক্ষমতার কথা কিছুই না জেনে এমন বেপরোয়া হয়ে তাদের ওপর চড়াও হওয়া কি উচিত?
কিন্তু সে কথা কাকে বলব!
স্পেস-স্যুটের স্পিকিং টিউবে বৃথাই দুবার সুরঞ্জনকে সাবধান করবার চেষ্টা করলাম। সে তখন যেন বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে।
পাঁচটা জালা-মূর্তির চারটেই ইতিমধ্যে জাঁতা-পাথরের আড়ালে অদৃশ্য।
শেষেরটাও সেখানে গা-ঢাকা দেবার আগেই সুরঞ্জন সেখানে গিয়ে পৌঁছল!
কিন্তু পৌছেও লাভ কিছু হল না। ওই ঢাউস জালা-মূর্তির একটাকে খালি হাতে ধরতে গেলেও হাতের বেড় কুলোত না। স্পেস স্যুটের গাবদা ফোলা হাতে তাও অসম্ভব।
সুরঞ্জনকে অবশ্য সে চেষ্টা করতেও দেখলাম না! শেষ জালা-মূর্তিকে ধরবার চেষ্টা করে তার পেছন নেওয়া জন্যই সে যেন ব্যস্ত।
উদ্দেশ্য তার সফলই হল। জালা-মূর্তিটার পিছু পিছু তাকেও চ্যাপ্টা পাথুরে জাঁতা-ঢিবিটার পেছনে অদৃশ্য হতে দেখলাম।
কিন্তু সে গেল কোথায়?
কয়েক সেকেন্ড বাদেই সে জায়গায় পৌঁছে একেবারে দিশাহারা হয়ে গেলাম।
এমন দারুণ একটা ভৌতিক ব্যাপার আমার চোখের ওপরই সত্যি ঘটে গেল নাকি!
জালা-মূর্তিগুলোর সঙ্গে সুরঞ্জনও তার স্পেস-সুট নিয়ে মিলিয়ে গেল ওই জাঁতা-ঢিবির গায়ে?
শিগগির! শিগগির নেমে আসুন!
সুরঞ্জনের গলা শুনে চমকে না উঠলে ওইখানেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম কে জানে!
তারপর হতাশ হয়ে শূন্যযানেই ফিরতে হত।
কিন্তু স্পিকিং টিউবে সুরঞ্জনের গলা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিটা আপনা থেকেই পাথুরে ঢিবিটায় গিয়ে পড়ল। জালা-মূর্তি আর সুরঞ্জনের অন্তর্ধানের রহস্য সেইখানেই উদঘাটিত।
একমুহূর্ত দেরি করবার কিন্তু তখন আর সময় নেই।
সুরঞ্জনের গলাটা যেন কোন ভাঙা লাউড স্পিকারের ভেতর দিয়ে বিশ্রী বিকৃত গোঙানো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
দেরি করবেন না! দেরি—
বাকিটা আর শোনা গেল না। শোনার অপেক্ষা আমি অবশ্য করিনি।
তার আগেই ওই স্পেস-স্যুট নিয়েই প্রায় লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি জাঁতা-ঢিবিটার ধারে।