তবে জন্মেজয় বলে, শুন তপোধন।
তদন্তরে কোন্ কর্ম্ম কৈলা মহাজন।।
মুনি বলে, জন্মেজয় কহিয়ে তোমারে।
যেইমতে সান্ত্বনা হইল যুধিষ্ঠিরে।।
ব্যাসবাক্য শুনি রাজা মন কৈল স্থির।
ব্যাস বৈলা শোকচিত্ত নহ যুধিষ্ঠির।।
নানামত প্রসঙ্গ বুঝান ব্যাসদেব।
অনেক প্রকার করি বুঝাইল তবে।।
শুনিলা অনেক শাস্ত্র রাজা যুধিষ্ঠির।
ব্যাস বলে, শোক ত্যজে ধর্ম্মে কর স্থির।।
ধর্ম্মকথা শুনিবারে যদি আছে মন।
মন দিয়া শুন গিয়া ভীষ্মের বচন।।
বৃহস্পতি আদি করি যত মুনিগণে।
নীতি শাস্ত্র বুঝাইলা বিবিধ বিধানে।।
ত্রিভুবনে প্রতিষ্ঠিত কর ধর্ম্মপদ।
ব্রহ্ম ঋষি আদি ছিল যার সভাসদ।।
মহা ধর্ম্মশীল ভীষ্ম বীর মহাশয়।
ঘুচাইবে তেঁই তব চিত্তের সংশয়।।
আনন্দিত ধর্ম্মরাজ ব্যাসবাক্য শুনি।
আনন্দিত চারি ভাই দেব চক্রপাণি।।
ধৃতরাষ্ট্রে আগে করি পাণ্ডুর নন্দন।
ভীষ্মের সমীপে সবে করিল গমন।।
চারিদিকে বসিয়া যতেক মুনিগণ।
ধৃতরাষ্ট্র বসিলেন, দেব নারায়ণ।।
করযোড় করিয়া বলেন যুধিষ্ঠির।
আমা হেন পাপী নাহি সংসার ভিতর।।
জ্ঞাতি বন্ধু আদি মুঞি মরিনু যতেক।
লিখিতে না পারি যত করিনু পাতক।।
রাজ্যপদ লাগিয়া করিনু বহু পাপ।
ভীষ্মদেবে মারিয়া পাইনু বহু তাপ।।
এত শুনি বলে ভীষ্ম শুন যুধিষ্ঠির।
হিত উপদেশ কহি মন কর স্থির।।
ত্রিদশের নাথ হরি দেব নারায়ণ।
একমন হৈয়া চিন্ত তাঁহার চরণ।।
হর্ত্তা কর্ত্তা বিধাতা পুরুষ পুরাতন।
কি করিতে তোমরা আইলে মোর স্থান।।
আমার ভাগ্যের সীমা কহিতে না পারি।
কৃপা করি আইলেন আপনি শ্রীহরি।।
ত্রিভুবন মধ্যে সার দেব নারায়ণ।
অন্তকালে পাই যেন তোমার চরণ।।
জগতের কর্ত্তা তুমি দেব জগন্নাথ।
কি বলিতে জানি আমি তোমার সাক্ষাৎ।।
তুমি যাহা মনে কর সেইরূপ হয়।
সকল সংসার প্রভু তোমার লীলায়।।
কিবা না করিতে পার আপনি শ্রীহরি।
নাশিলে সে দুষ্টগণ ক্ষিতি ছিল ভারী।।
আদিও অনাদি তুমি সর্ব্বেশ্বর কর্ত্তা।
অনাথের নাথ তুমি সর্ব্বফলদাতা।।
তুমি সর্ব্বময় প্রভু তুমি নিরঞ্জন।
তুমি সর্ব্বপ্রাণ হেতু তুমি সে জীবন।।
দুষ্টে নাশ কর তুমি শিষ্টের পালন।
তুমি সে করুণাময় জগৎ তারণ।।
তুমি সৃষ্টি কর প্রভু সংহারহ তুমি।
চারি বেদ নাহি পারে কী বলিব আমি।।
তুমি স্বর্গ তুমি মর্ত্ত্য তুমি সে পাতাল।
সংসারেতে আছে যত তব ঠাকুরাল।।
তুমি ইন্দ্র তুমি চন্দ্র তুমি নারী নর।
তোমার অধিক নাহি সংহার ভিতর।।
আদি নিরঞ্জন তুমি আব্রহ্ম স্বরূপ।
কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড তব এক লোমকূপ।।
করূণা করিয়া তুমি তরাও যাহারে।
সেই সে তোমর ভক্ত জানিবারে পারে।।
তোমারে জানিবে হেন আছে কোনজন।
ভক্ত বিনে তোমারে না জানে অন্য জন।।
তব কথা শুনিয়াছি পূর্ব্বে মুনিস্থানে।
যেমত করিলে তুমি কহি বিদ্যমানে।।
পূর্ব্বে এক বিপ্র ছিল পরম ভকত।
তোমা বিনা অন্যে তার নাহি ছিল চিত্ত।।
কৃশানু তাহার নাম ছিল দ্বিজবর।
তোমার ভজন সেই করে নিরন্তর।।
রন্ধন করিয়া বিপ্র তোমা ধ্যান করে।
ভোজন করহ তুমি আনন্দ অন্তরে।।
দ্বিজে প্রবঞ্চনা করি করহ ভোজন।
অন্ন খাও দ্বিজে নাহি দেহ দরশন।।
আর দিন সেই বিপ্র রন্ধন করিয়া।
ধ্যান করে দ্বিজবর যোগাসন হৈয়া।।
কুকুর-মূরতি তুমি ধরিয়া তখন।
অন্ন খেতে বিপ্র তোমা দেখে নারায়ণ।।
বিপ্রকে দেখিয়া পলাইয়া ত আপনে।
পিছে পিছে ধায় তব সেই ত ব্রাহ্মণে।।
তোমাকে প্রতীত করি বলেন বচন।
কেন পলাইয়া যাহ না করি ভোজন।।
মোর দোষ ক্ষমা কর মোর অন্ন খাহ।
মোর দিব্য লাগে যদি পলাইয়া যাহ।।
অন্না আসি খাও তুমি না করিহ ডর।
ঈশ্বর বিরাজে সদা তোমার অন্তর।।
তোমাতে আছেন হরি শুন মহাশর।
অন্ন খেয়ে পূর্ণ কর আমার হৃদয়।।
এইমত কহি ধরে কুক্কুর-চরণ।
দ্বিজমূর্ত্তি হৈয়া হরি দিলা দরশন।।
দিব্যমূর্ত্তি হইলেন চতুর্ভুজধারী।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম হইল শ্রীহরি।।
দ্বিজবরে বিস্তর করিলে আশ্বাসন।
প্রতিদিন খাব অন্ন তোমার সদন।।
তোমার অধীন আজি হইনু ব্রাহ্মণ।
তোমারে ছাড়িতে আমি নারিব কখন।।
সেই হেতু তোমারে পরীক্ষা আমি কৈনু।
এত দুঃখ তোমারে ছাড়াতে নারিনু।।
নিশ্চয় বলহ প্রভু শুনহ বচন।
সর্ব্বমতে আমি তোমা করিব রক্ষণ।।
সেই মতে অন্ন খাই বুঝিল ধারণে।
কদাচিত যুধিষ্ঠির হয় সে ব্রাহ্মণে।।
অঙ্গীকার কৈলা সত্য পালন করিতে।
সেই এই যুধিষ্ঠির লয় মোর চিতে।।
সেই হেতু কৈলা দুষ্ট দুর্য্যোধনে নাশ।
আজি সে জানিল তাহা শুন শ্রীনিবাস।।
তোমা বিনে আর মোর নাহি সৃষ্টিকর্ত্তা।
আর যত আছে সব তোমার রক্ষিতা।।
কৃপা করি কর প্রভু মোর পরিত্রাণ।
উদ্ধার করিয়া মোরে লহ নিজস্থান।।
পূর্ব্বেতে গয়ায় এক ছিল দ্বিজবর।
অনাচার বৃত্তি সেই করে নিরন্তর।।
হরিতে ভজনা, সদা নীচ কর্ম্ম করে।
নীচ কর্ম্ম করি সেই দেহ মাত্র ধরে।।
পাদুকা-ব্যাপার করে ব্রাহ্মণ হইয়া।
চর্ম্মের পাদুকা বেচে দোকান করিয়া।।
তাহাতে বসিয়া সেই সদাকাল থাকে।
পাদুকা ঝাড়য়ে সদা ফুক দেয়মুখে।।
চর্ম্মের ব্যাপার করে মুচিসঙ্গে থাকে।
চর্ম্মের যতেক ধূলা লাগে তার মুখে।।
মুচির সঙ্গেতে তার সঙ্গ সর্ব্বক্ষণ।
আপনার ধর্ম্ম কর্ম্ম না করে ব্রাহ্মণ।।
সন্ধ্যা-গায়ত্রী হীন মুচিসঙ্গে রয়।
সর্ব্ব দিন গেলে সেই সন্ধ্যাকালে খায়।।
রন্ধন করিয়া তোমা কেরে সমর্পণ।
তবে ত তাহার পরে করয়ে ভক্ষণ।।
দিন গেলে একবার তব নাম লয়।
অন্যান্য সময় নহে সন্ধ্যার সময়।।
আর দিন নাম লৈয়া করিল শয়ন।
দৈবে সর্পাঘাতে দ্বিজ ত্যজিল জীবন।।
মরিলে যমের দূতে বান্ধি লৈয়া যায়।
বিষ্ণুদূত আসি তার বন্ধন খসায়।।
বিষ্ণুদূতে লৈয়া গেল বিষ্ণুর নগরে।
তবে যমদূত গেলা যমের গোচরে।।
ফেলিল হাতের পাশ ধর্ম্ম বরাবরে।
কহয়ে ধর্ম্মের আগে করি যোড় করে।।
তোমার স্থানেতে মোর নাহি প্রয়োজন।
এতেক শরীরে দুঃখ না যায় কথন।।
এতকাল চর্ম্ম বেচে ধর্ম্ম কর্ম্ম নাই।
মোরে মারি তারে লৈয়া যায় অন্য ঠাঁই।।
তপ-জপ-হীন বিপ্র নীচকর্ম্ম করে।
তবে কেন লৈয়া যায় বিষ্ণুর গোচরে।।
তোমার রহিল আর কিসে অধিকার।
আমরা আনিব কারে সংসার ভিতর।।
ধর্ম্ম বলে, কহ চিত্রগুপ্ত মহাশয়।
কোন কর্ম্ম করে বিপ্র কহত নিশ্চয়।।
চিত্রগুপ্ত বলে, ধর্ম্ম নাহি ত লিখন।
শয়নেতে হরিনাম করিত স্মরণ।।
শয়নে মরণে যেই হরিনাম লয়।
তারে তোর আনিতে উচিত নাহি হয়।।
শয়নে লইল নাম সেই ত ব্রাহ্মণ।
তবে কেন দূত যায় তাহার সদন।।
শয়নে মরণে যেই হরিনাম লয়।
মোর অধিকার তারে নাহিক নিশ্চয়।।
যম বলে, শুন দূত বচন আমার।
এই এই জনে মোর নাহি অধিকার।।
এক দিন যেই জন হরিনাম লয়।
তারে তুমি নাহি আন আমার আলয়।।
হরিনাম লৈয়া যেই জন মৃত্যু হয়।
কদাচিত নাহি যাহ তাহার আলয়।।
মরণ-সময়ে যেই জনে গঙ্গা পায়।
তথা হইতে ফিরি তোরা আসিবি নিশ্চয়।।
যার গলে রুদ্রাক্ষ তুলসী মালা থাকে।
কভু নাহি যাবি তোরা তাহার সম্মুখে।।
কবচ থাকিবে যার হরি-হর নামে।
কদাচিত তোমরা না যাবে তার ধামে।।
গঙ্গার মৃত্তিকা থাকে যাহার ললাটে।
কদাচ না যাবি তোরা তাহার নিকটে।।
তুলসীবেদীর মাটী তুলসীর পাত।
কভু নাহি যাবি তোরা তাহার সাক্ষাৎ।।
গোরজ গোময় মূত্র থাকে যার শিরে।
তাহে নাহি ছুঁবি তোরা কহিনু সবারে।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলি যেবা ত্যজয়ে জীবন।
তার তরে তোরা নাহি ছুঁবি কদাচন।।
মরণকালেতে গুরুদরশন পায়।
সর্ব্বপাপে মুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠেতে যায়।।
যাহার উপরে আছে মোর অধিকার।
তাহা যে বলিব সবে শুন সারোদ্ধার।।
পৃথিবীতে জন্মি যেই পরহিংসা করে।
গুরুভক্তি চিন্তা নাহি যাহার অন্তরে।।
বিপ্র দেখি প্রণাম না করে যেই জন।
মিথ্যা বাক্য কহে আর কর্কশ বচন।।
পরদ্রব্য লয় আর পরদার হরে।
দ্বিজভূমি হরে আর পরছিদ্র ধরে।।
মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় আর প্রবঞ্চনা করে।
দান দিয়া যেই জন ভাবয়ে অন্তরে।।
দেখিয়া পরের দুঃখ সুখ পায় মনে।
এই মত কত আছে অনেক কথনে।।
এইমত ধর্ম্মরাজ কহিল দূতেরে।
এই সব পাপী আন ডাঙ্গশ প্রহারে।।
সুদৃঢ় বন্ধন করি আন মোর হেথা।
মারিয়া ডাঙ্গশ বাড়ি ভাঙ্গি তার মাথা।।