১০.
বৃষ্টি বৃষ্টি আর বৃষ্টি–আকাশ থেকে ধেয়ে নিচে নেমে আসা সেই বৃষ্টির রঙ দেখতে দেখতে হঠাৎ, হা হঠাতই অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞেস করে বসলো ভেরা, এইসব কথা সত্যিই আপনি বিশ্বাস করেন মিঃ লম্বার্ড? হলঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আবার কেমন আনমনা হয়ে পড়লো সে।
অদূরেই বসেছিল লম্বার্ড। ভেরার আচমকা প্রশ্ন শুনে তার মুখের দিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো সে, কোন্ কথাগুলো বলুন তো? আপনি কি মিঃ ওয়ারেেভর কথা বলতে চাইছেন?
হ্যাঁ, তাই তো।
কেন, অবিশ্বাসের কথা তো তিনি বলেন নি। তার প্রতিটি যুক্তিই তো যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, নয় কি?
একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছি না, তবু যেন অবাক করার মতো তার কথাগুলো। আমাদের মধ্যেই একজন খুনী লুকিয়ে আছে, এ যেন বিশ্বাস করতেও মন চায় না।
না চাওয়ার তো কোনো কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি না মিস্ ক্লেথন। আপনার কি মনে হয় না, আগাগোড়া ব্যাপরাটাই অবিশ্বাস্য? বিশেষ করে ম্যাকআর্থার খুন হওয়ার পর এখন একটা ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হয়ে গেছি, আমরা এক জব্বর খুনীর পাল্লায় পড়েছি।
তা যা বলেছেন, যেন এক একটা দুঃস্বপ্ন। উঃ তিন তিনটে খুন। ভাবাই যায় না। এর পর আরো কি কঠিন ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে, আমরা কেউ তা জানি না। একটু থেমে ভেরা জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, আমাদের মধ্যে খুনী কে হতে পারে। আন্দাজ করতে পারেন?
তার মানে মৃদু হেসে বলল লম্বার্ড, আপনি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন, আপনি ও আমি, আমরা দুজনেই অপরাধীর তালিকা থেকে বাদ। সত্যি কথা বলতে কি এ ব্যাপারে আপনার ওপর আমার যথেষ্ট আস্থা আছে। পাগলামির কোনো লক্ষণই এ পর্যন্ত আমি দেখতে পাইনি আপনার মধ্যে। আর নিজের ব্যাপারে আমি জোর গলায় বলতে পারি, খুনী আমি নই, আর অপ্রকৃতস্থও নই। আপনার মতোই আমিও একজন নিরপরাধ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ।
সত্যি, আপনার কথাগুলো কতোই না মিষ্টি। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, যেন আমার কানে মধু বর্ষিত হচ্ছে। লজ্জায় আরক্ত মুখে ভেরা তাকালো তার মুখ পানে, ভেবে অবাক হচ্ছি, আপনার মতো এমন একজন নিষ্পাপ লোকের বিরুদ্ধেও ঐ শয়তানটা অভিযোগ আনলো কোন্ সাহসে।
আপনি সত্যিই বুদ্ধিমতী, একমাত্র আপনিই আমাকে ঠিক চিনেছেন, গদ গদ হয়ে বললো লম্বার্ড, তার কথায় মনে হচ্ছে, এখানে এসে আমি বুঝি মস্ত বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছি। যে যাইহোক এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের দুজনকে বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে মোট পাঁচজন। এখন দেখতে হবে, এই পাঁচজনের মধ্যে কে খুনী, কে সেই উন্মাদ। কেন জানি না একেবারে শুরু থেকেই ঐ বুড়ো ভাম ওয়ারগ্রেভের ওপরেই আমার সব সন্দেহ গিয়ে পড়েছে। এসব ঘটনার পিছনে ওর কালো হাতই সক্রিয়।
শিউরে উঠলো ভেরা বিস্ময়াবিষ্ট স্বরে বললো ওয়ারগ্রেভের বিরুদ্ধে আপনার এমন ধারণা হওয়ার কি কারণ ঘটলো জানতে পারি?
কারণটা আমি নিজেই জানি না, বলবো কি করে। তবে এটুকু বুঝি, বুড়ো এখন বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে, দীর্ঘ চাকরী জীবনে তাকে কোট কাছারী করে কাটতে হয়েছে, বহু জটিল খুনের মামলায় কাজীর বিচারে দেখাতে দেখাতে শেষ অবধি তিনি তার মাথাটাই খারাপ করে ফেলেছেন। এর পরিণাম যা হয় তাই হয়েছে। তিনি নিজেকে সর্বশক্তিমান পুরুষ বলে ভাবতে শুরু করেন হঠাৎ একদিন। মানুষের জীবন রক্ষা এবং জীবন খতম করা, এ দুটোই তার হাতের মুঠোয়, অতএব এখন এখানে যে সব অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলেছে, সেগুলো করতে তার আর বাধা কোথায়?
অসম্ভব কিছু নয়। অন্যের মনের খবর বোঝা মুশকিল।
এসব বলুন,রগার্স জানতে চাইলো, আপনার সন্দেহ কার ওপর?
ডঃ আর্মস্ট্রং, ওঁকেই আমার সন্দেহ হয়।
আমার সন্দেহের তালিকায় উনিই কিন্তু শেষ ব্যক্তি।
কোন যুক্তিতে? মৃদু প্রতিবাদ করলো ভেরা, আমরা জেনেছি, প্রথম দুজনের মৃত্যু হয়েছে বিষ প্রয়োগে। একমাত্র চিকিৎসকদের কাছেই সব সময়ে বিষ জাতীয় ওষুধ রাখা সম্ভব। তার ওপর এও তো হতে পারে, মিস্ রগার্সকে ঘুমের ওষুধের বদলে সরাসরি বিষ খাইয়ে থাকতে পারেন, পারেন না?
হুঁ, আপনার সন্দেহ অমূলক শুধু নয়, যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণও বটে।
আমার আরো বলার আছে আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন, পাগল ডাক্তারকে ওপর থেকে ঠিক বোঝা যায় না। বোধহয় তাদের অতিরিক্ত পরিশ্রমের দরুণ পাগলামিটা চাপা পড়ে যায়।
আপনার সব যুক্তিই আমি মেনে নিচ্ছি, কিন্তু একটা হিসেবে কোথায় যেন গরমিল থেকে যাচ্ছে। আজ সকালে ডঃ আর্মস্ট্রং যেটুকু সময় একলা ছিলেন, তাতে অতদূর গিয়ে (যা ছুটে গেলেও সম্ভব নয়।) জেনারেল ম্যাক আর্থারকে খুন করে আবার ফিরে আসা সম্ভব ব্যাপার। অতএব
এরপর এখানে অতএবের কোন স্থান নেই। নিজের যুক্তির সমর্থনে ভেরা বলে হয়তো তখন তিনি সুবিধা মতো সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে যথা সময়ে তিনি তাঁর কাজটা হাসিল করে আবার ফিরে এসেছেন এখানে।
তা সেই সময়টাই বা কখন, এখন একটু খুলে বলবেন?
সেই যে মনে পড়ছে এবার আজ দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের ঠিক একটু আগে একটু থেমে ভেরা আবার বলে অগ্রণী হয়ে আমাদের সকলকে টপকে তিনি যখন ডঃ ম্যাকআর্থারের কাছে ছুটে গেলেন, তখনি তার কাজ হাসিল হয়ে যায়।
লম্বার্ডের চোখে গভীর বিস্ময়। সত্যি, এ কথাতো আগে কখনো আমার মনে হয়নি। যাই হোক, কাজটা সারতে গিয়ে তাতে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়েছিল নিশ্চয়ই। তা আপনার বক্তব্য কি, এবার বলবেন?
কেন ঝুঁকি নিতে যাবেই বা কেন? জানেন তো, ডাক্তার হওয়ার অনেক বাড়তি সুযোগ সুবিধে আছে। যেমন ধরুন মৃত রোগীর নাড়ী টিপে বলে দিলেই হলো, ঘণ্টা খানেক আগে মারা গেছে। ব্যস, তাতেই কাজ হয়ে যাবে। বেদ বাক্য বলে চিকিৎসকদের মন্তব্যটা আমাদের মেনে নিতে হবে। ডাক্তারী জ্ঞান আমাদের নেই, তাই তাদের অঙ্গুলী হেলনে সায় দিতে হবে আমাদের।
অপূর্ব। অপূর্ব আপনার বিশ্লেষণ ক্ষমতা। উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলো লম্বার্ড, বোঝা যাচ্ছে আপনার মাথায় যথেষ্ট পরিমাণ ঘিলু আছে মিস ক্লেথন। আমি ভেবে অবাক হচ্ছি, এতে সব ভাবনা আপনার মাথায় এলো কি করে?
ব্লোরের সান্নিধ্যে এসে অনেকক্ষণ থেকে উসখুস করছিল রগার্স কথাটা বলার জন্য। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলল সে, আমাদের মধ্যে খুনী কে হতে পারে মিঃ ব্লোর?
তেমন করে তো ভাবিনি এখনো।
মিঃ ওয়ারগ্রেভের কথা মতো আমাদের মধ্যে থেকে খুনীকে যদি টেনে বার করতে পারতাম, তাহলে
একটু ধৈর্য ধরে থাকো। যথা সময়ে তার স্বরূপ ঠিক প্রকাশ হতে দেখবে। ব্লোর তাকে বোঝায় তুমি কি মনে করো তাকে জানার ইচ্ছে তোমার থেকে আমাদের কিছুমাত্র কম। আমরা সকলেই তার ওপর নজর রাখার চেষ্টা করছি।
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, কিছু একটা গোপন করতে চাইছেন আপনি। সত্যি করে বলুন তো? আপনি কি খুনীকে চিনতে পেরেছেন?
ঠিক এখনই জোর দিয়ে বলতে পারি না চিনেছি, তবে খানিকটা আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু তার নাম এখন জানতে চেও না। কেবল এটুকু বলতে পারি, ভারী ঠাণ্ডা মাথার লোক এই খুনী, খুব ভেবে চিন্তে কাজ করে থাকে সে।
তার মানে কখন যে ঠাণ্ডা মাথায় আমাদেরই কাউকে সে আবার খুন করে যাবে, কেউ আমরা টেরও পাবো না। উঃ এমনি এক দুঃস্বপ্নের ঘোরে বিভোর হয়ে থাকতে হবে আমাদের দিবা রাত্রি।
তা তুমিও তো দেখছি বেশ ভাবনা চিন্তা করছে। খুনী হিসেবে কাকে তোমার সন্দেহ হয় রগার্স?
আমি আর কি বলব স্যার মুখ্য সুখ্য মানুষ, আমাদের সব চিন্তা ভাবনাই এলোমলো, আপনাদের সঙ্গে মিলবে কেন বলুন? না সত্যি আমি কিসসু জানি না। আর জানি না বলেই তো এতো ভয়, এতে আতঙ্ক
রাগে উত্তেজনায় লাল চোখ করে পায়চারী করছিলেন ঘরের মধ্যে ডঃ আর্মস্ট্রং তেমনি উত্তেজিত স্বরে বিকট শব্দ করে বলে উঠলেন তিনি, আমি আর এক মুহূর্তের জন্যও থাকতে চাই না এখানে। যেভাবেই হোক এই দ্বীপ থেকে নিস্কৃতি পেতে হবে।
তার চোখে চোখ রেখে ঘাড় নাড়লেন ওয়ারগ্রেভ। তারপর মৃদু হেসে বললেন তিনি, নিস্কৃতি চাইলেই কি পাওয়া যায়? সমুদ্রের চেহারা দেখেছেন! যে ভাবে ফুঁসছে আগামী চব্বিশ ঘণ্টার পরেও এই অশান্ত সমুদ্র শান্ত হবার নয়। অতএব আজ অহেতুক উত্তেজিত না হয়ে আগামীকালের কথা ভাবুন, যদি কাল অন্তত নিস্কৃতি পান এই দ্বীপ থেকে।
কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার আগেই যদি সেই উন্মাদটা খুন করে ফেলে আমাদের? যদি আমরা তার হাতে প্রাণ হারাই?
কখনই না। খুন করা অত সহজ নয়। তাছাড়া আমার এখন অনেক সজাগ। খুনীর চরিত্র আমরা জেনে গেছি। এখন আমাদের মারে কে।
আগের তিনজনও কিন্তু মৃত্যুর আগে আপনার মতোই বুক ফুলিয়ে থাকবে
ওঁরা মৃত্যুর আগে একটুও প্রস্তুত ছিলেন না। তাই ওঁদের খুন হওয়াটা একটু আলাদা ধরনের ছিলো। কিন্তু আমাদের অবস্থা ওঁদের থেকে আলাদা। আমরা এখন চারদিকে চোখ কান খুলে রেখেছি, আমরা সজাগ, আমরা খুনীর গতিবিধি চিনে ফেলেছি। এখন আমাদের সঙ্গে কোনো রকম ছলচাতুরী করতে পারবে না।
আমরা খুনীর ছলচাতুরী জেনে ফেলেছি বলেই হয়তো সতর্ক হতে পারছি, একটু আগে আপনি বললেন, খুনীর চরিত্র আমরা জেনে গেছি। কিন্তু খুনী কে তা জানি না এখনো অবধি।
জানেন, হ্যাঁ আপনিও জানেন বৈকি ডঃ আর্মস্ট্রং।
তাহলে আপনিই জানেন দেখছি, জানেন নাকি?
এখনো পর্যন্ত পাওয়া সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যদি জানতে চান, তাহলে বলবো, আমি কিছুই জানি না। একটু আগে আপনি জানতে চাইলেন, আমি কাউকে সন্দেহ করি কিনা। হা, করি বৈকি। বিশেষ একজনকে, তার নাম আমি বলবো না, আমরা সকলেই চিনি তাকে।
বিস্ময়াবিষ্ট আর্মস্ট্রং ঠিক আন্দাজ করতে না পেরে তাকিয়ে রইলেন ওয়ারগ্রেভের দিকে।
দোতলায় এমিলি তার ঘরে বসে সময় কাটাতে বাইবেলের পাতা ওল্টালেন, অক্ষরগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে উঠলো। অগত্যা বইটা রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে টেনে বার করলেন তার সেই নোটবই আর পেন্সিলটা। তারপর ধীরে ধীরে লিখতে শুরু করলেন নোট বই
আজ জেনারেল ম্যাকআর্থারের আকস্মাৎ মৃত্যুটা আমার কাছে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা বলে মনে হয়েছে। (এখানে বলে রাখা ভাল ম্যাকআর্থারের ভাইপোর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমাদের ম্যাকআর্থারের) খুব সম্ভব তিনি সত্যিই সত্যিই খুন হয়েছে। ওয়াগ্রেভের সুনিশ্চিত বক্তৃতার বোঝা গেলো, তার সন্দেহ খুনী আমাদেরই মধ্যে কেউ একজন হবে। আমি তার সঙ্গে একমত। আর সেই নিষ্ঠুর খুনীকে আমি চিনি। তার নাম
এখানে থামলেন এমিলি, বর্তমান থেকে চলে গেলেন সেই সুদূর অতীতে। তাঁর স্থির দৃষ্টির সামনে অতীতের সব ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটে যেতে দেখলেন তিনি। হাতের পেন্সিলটা নিয়ে তিনি তার নোটবইতে কখন যে অক্ষরগুলো সাজাতে শুরু করেছিলেন, তা তার নিজেরই খেয়াল ছিলো না। হঠাৎ যখন হুঁশ হলো, নোটবইটির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। আশ্চর্য। এ আমি কি লিখলাম? তার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটি নাম সে নাম বেট্রিস টেলর।
ভীষণ ভয় পেলেন তিনি। সেই ভয়ের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য দ্রুত পেন্সিল চালিয়ে কেটে দিলেন নামটা। তারপর নিজের মনে বিশ্লেষণ করতে বসলেন, মনের অগোচরে কেন লিখলাম সেই নামটা? আমি, আমি কি তাহলে পাগল হয়ে গেছি।
বাইরে তখন ঝড়ের তাণ্ডব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে বৃষ্টি।
হলঘরে এসে বসেছেন সকলে। কারোর মুখে কথা নেই। ঝড়ো বাতাসের শন্ শন্ শব্দ ছাড়া অন্য কিছু কর্ণগোচর হচ্ছিল না কারোর। সেই সময় চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলো রগার্স। টেবিলের ওপর ট্রেটা নামিয়ে রাখলো সে।
এমিলির দিকে তাকিয়ে বললো ভেরা, মিস্ ব্লেন্ট, আজ আপনিই আমাদের চা পরিবেশন করুন।
না, আমি পারবো না। কেলীটা যা ভারী, যদি হাত ফসকে পড়ে যায়। তার ওপর মনটা আমার একেই অশান্ত, উলের দুটো গোলা কোথায় যে ফেললাম, খুঁজেই পাচ্ছি না।
শেষ পর্যন্ত ভেরার হাতেই পড়লো সেই ভারী কেলীর ওপর। বাইরে রিমঝিম বৃষ্টির ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টুং-টাং শব্দটা একটা অদ্ভুত ব্যঞ্জনা এনে দিয়েছিল যেন। ঘরে এখন একটু আগের সেই থমথমে ভাবটা এখন আর নেই। চায়ের পেয়ালায় কথার ঝড় উঠতে দেখা গেলো একটু পরেই। মেতে উঠলেন সকলে নতুন করে আনন্দে গা ভাসিয়ে দিয়ে। বৃষ্টি স্নাত বিকেলে ধূমায়িত চায়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত সামঞ্জস্যতা অনুভব করলেন সকলে। বুঝি এমনি এক মুখর আনন্দের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন তারা।
সকলেই চায়ের স্বাদ গ্রহণ করার জন্য চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিলেও ওয়ারগ্রেভ কিন্তু চোখ বুজে বসেছিলেন চেয়ারে। ও রসে বুঝিবা তিনি অনাগ্রহী, আসক্তি নেই তার চায়ে। চা তিনি পান করেন না।
হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো রগার্স, মুখে তার আতঙ্কের ছাপ, হত বিহ্বল দৃষ্টি, এদিক ওদিক, কি যেন খুঁজছে সে, তার আগমনে ঘরের সহজ সাবলীব ভাবটা যেন মুছে গেলো নিমেষে।
কি খুঁজলো রগার্স? চায়ের খালি কাপটা নামাতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো ওয়ারগ্রেভ, কিছু কি তোমার হারিয়েছে?
যৎসামান্য, মানে বাথরুমের পর্দাটা খুঁজে পাচ্ছি না।
সে কি। এবার প্রশ্ন চোখে তাকালেন ওয়ারগ্রেভ, আজ সকালেই তো ঝুলতে দেখেছি বাথরুমে।
হ্যাঁ স্যার, আমিও তো দেখেছি।
কি রকম পর্দা বলতো? ব্লোর জানতে চাইলো।
ঘন লাল রঙের সিল্কের পর্দা উধাও।
আরে এমন একটা তুচ্ছ জিনিষ নিয়ে তুমি মাথা ঘামাচ্ছো রগার্স? এ তোমার পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য এখানকার সব কিছুতেই তো পাগলামি। তবে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো তুমি। ঐ পর্দা দিয়ে কাউকে খুন করা সম্ভব নয়। হারানো পর্দার জন্য চিন্তা করো না।
চিন্তা করবো না বলছেন? কথাটি ঠিক মনে ধরলো না রগার্সের তবু ঘাড় নাড়লো, ঠিক চিন্তা করবো না। তেমনি ঘাড় নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে সে। তারপর ঘরে নেমে এলো অখণ্ড নীরবতা, এ ওর দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকলো বিস্ময় ভরা চোখে।
নৈশভোজের পর সকলে আবার ফিরে এলেন বড় হলঘরে। তখনো কথা নেই কারোর মুখে। কেমন যেন একটা অস্বস্তিবোধ কাবু করে ফেলেছিল সকলকে। সেই ভাবেই কাটলো রাত নটা পর্যন্ত।
প্রথমে এমিলিই উঠে দাঁড়ালেন, শোবার সময় হলো যাই এবার।
তার দেখাদেখি উঠে দাঁড়ালো ভেরাও, সকাল সকাল উঠতে হবে কাল। আমিও চললাম।
তাদের অনুসরণ করলেন ব্লোর এবং লম্বার্ড। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে গিয়ে তাদের কানে এলো দরজার খিল্ দেবার শব্দ। হেসে বললেন ব্লোর, আচ্ছা দেখছেন মিঃ লম্বার্ড। আমাদের আর সতর্ক করে দিতে হলো না। ভয় এমনি জিনিস ওঁরা নিজেরাই কেমন নিজেদের নিরাপত্তার ভার নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন, দরজার খিল দিতে ভুল করেন নি।
তাঁর কথা যেন শুনতে পায়নি, এমনি একটা ভাব দেখিয়ে নিজের মনেই বলে গেলো, যাক, বাঁচা গেলো আজ আমরা মোটামুটি সজাগ বলেই এখন অনেকটা নিরাপদ ভাবতে পারি। তারপর একটু থেমে সে আবার বললো, যে কাজে আসা তা তো তারা নিজেরাই সেরে নিলেন। চলুন এবার তাহলে নিচে যাওয়া যাক।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলেন ওঁরা আবার।
আরো ঘন্টাখানেক গল্পগুজব করে পুরুষ চারজন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকলেন যে যার ঘরে গিয়ে শোবার তোড়জোড় করার জন্য। খাবার ঘরের দরজার আড়াল থেকে তাদের গমনপথের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রগার্স। ওঁরা কেউই তার সেই গোপন পর্যবেক্ষণ লক্ষ্য করতে পারলো না।
সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে বাকী তিনজন পুরুষকে সতর্ক করে দিতে ভুললেন না ওয়ারগ্রেভ, ঘরের ভেতর থেকে দরজায় তালা দিতে ভুলে যাবেন না যেন।
সেই সঙ্গে ব্লোর আবার যোগ করলেন, বন্ধুগণ, আপনাদের আরো একটা কথা বলে রাখি, আমাদের খুনী অত্যন্ত চতুর, বাইরে থেকে তালা খোলার উপায় নিশ্চয়ই তার জানা থাকতে পারে। তাই বাড়ির সাবধানতার জন্য দরজার সামনে একটা চেয়ার ও রেখে দেবেন। তালা খুলে অন্ধকারে ঘরে ঢুকতে গিয়ে চেয়ারে হোঁচট খেলেই শব্দ হবে, আপনাদের ঘুম ভেঙ্গে যাবে। তাহলেই খুনীর ইচ্ছাপূরণ আর হবে না কেমন।
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠতে দেখা গেলো লম্বার্ডের ঠোঁটে। হ্যাঁ সবজান্তা উপদেষ্টার কথা আপনারা যেন কেউ ভুলবেন না কিংবা অবহেলা করবেন না।
খোঁচাটা হজম করতে হলো ব্লোরকে গম্ভীর হয়ে। অত বড় বড় চোখ করে লম্বার্ডের দিকে তাকালেন ওয়ারগ্রেভ। তারপর তিনি আর দাঁড়ালেন না সেখানে, সোজা গিয়ে ঢুকলেন নিজের ঘরে।
চারজন পুরুষের মধ্যে শেষ মানুষটি তার ঘরে প্রবেশ করা মাত্র খাবার ঘরের দরজার আড়াল থেকে অতি সন্তর্পণে বেরিয়ে এলো রগার্স। চারদিক দেখে নিয়ে সে আবার গিয়ে ঢুকলো নিজের ঘরে। নিজের মনে মাথা দুলিয়ে বললো সে কাল ভোর সকালে উঠতে হবে। তবে আজ রাতেই কালের প্রাতঃরাশের খাবার সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। ভোর সকালে উঠেই উনুন ধরাতে হবে। অতিথিরা ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই, খাবার তো প্রায় তৈরীই আছে শুধু চা তৈরি করতে হবে।
তারপর সে তার সেই ছোট্ট আলমারিটির দিকে তাকালো। তখনো সাতটা পুতুলই অবশিষ্ট রয়েছে। না, এবার আর একটি পুতুলও নিরুদ্দেশ হতে দেবো না। আজ আমি নিজে প্রয়োজন হলে সারা রাত জেগে থেকে পুতুলগুলোকে পাহারা দেবো। দেখি কে আমার চোখকে ফাঁকি দেয়। কার এতো দুঃসাহস আছে। আমাকে ডিঙ্গিয়ে উন্মাদটা তার খুশি মতো যখন তখন কাউকে না কাউকে খুন করবে, আর একটি করে পুতুল উধাও করে ফেলবে। আজ আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে সে
ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো সে অতঃপর।
.
১১.
ভোর হওয়ার ঠিক আগে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া লম্বার্ডের চিরদিনের অভ্যাস। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ঘুম ভাঙ্গতেই অনুভব করলো সে, গতকাল রাতের তুলনায় আজ বাতাসের সেই দাপট আর নেই। কান পেতে শুনতে গিয়ে বুঝলো সে, বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দও আর শোনা যাচ্ছে না। তাহলে বৃষ্টি কি থেমেচে? কথাটা ভাবতে ভাবতেই ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়লো লম্বার্ড।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের গতি আবার বাড়লো, কিন্তু লম্বার্ডের ঘুম আর যেন ভাঙ্গে না, ঘুম ভাঙলো সেই সাড়ে নটায়। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো সে। ঘড়ির টিক টিক টিক … না, আর দেরী করা ঠিক হবে না। কিছু একটা করা দরকার। আর এখনি, এখন নটা পঁয়তিরিশ।……..
ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথমেই সে গেলো ব্লোরের ঘরের সামনে, ন করলো। একটু পরেই দরজা খুলে গেল, দরজার ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ব্লোর ঘুম জড়ানো চোখে।
আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি। কতো বেলা হয়েছে, সে খেয়াল আছে?
দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন ব্লোর। চোখ থেকে ঘুম তখন তার নিরুদ্দেশ, তার বদলে একরাশ বিস্ময়। কি আশ্চর্য। বেলা এতো গড়িয়ে গেছে? এত বেলা পর্যন্ত ঘুম আমার, কখনো হয়নি। কিন্তু রগার্সই বা কি রকম লোক বলুন তো মশাই? সে ও তো ডেকে দিতে পারতো।
রগার্স আপনার ঘুম ভাঙাবে? তাহলেই হয়েছে। মুখ বিকৃত করে বললো লম্বার্ড, তার সম্বন্ধে আপনি আমি কতটুকুই বা জানি বলুন।
সে কি রকম? কৌতূহল ভরা চোখে তাকালেন ব্লোর।
কি বলে যে বোঝাব আপনাকে, জানেন রগার্স উধাও? তার পাত্তা নেই এ প্রাসাদের কোথাও। এমন কি, উনুন পর্যন্ত ধরিয়ে যায় নি সে।
সেকি? স্ফাউন্ড্রেলটা কি তাহলে আমাদের ফেলে সত্যি সত্যি কেটে পড়লো। গায়ে জামা গলাতে গলাতে বললেন ব্লোর, চলুন অন্য আরো অতিথিদের ঘরে। দেখা যাক ওঁরা যদি তার কোনো হদিস দিতে পারেন।
না কেউই তার খবর জানে না। আর্মস্ট্রং ওয়ারগ্রেভ কিংবা ভেরা, সকলের বক্তব্য একটাই–রগার্সকে তারা শেষ দেখেছেন গতকাল রাতে শুতে যাওয়ার আগে। এখন সকলের লক্ষ্য এমিলির ঘরের দিকে, যদি তার কোনো খবর দিতে পারেন তিনি। না তাঁর ঘরের সামনে গিয়ে আরো বেশী হতাশা হলেন সকলে। দরজা হাট করে খোলা, ঘরে নেই এমিলি।
এরপর একসঙ্গে সকলে গিয়ে ঢুকলেন রগার্সের ঘরে। এলোমেলো বিছানা রাতিযাপনের স্পষ্ট চিহ্ন চোখে পড়ে। দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম ড্রেসিং টেবিলের ওপর পড়ে রয়েছে ভিজে অবস্থায়।
এর অর্থ হলো, নিজের মনে লম্বার্ড বললো যথারীতি আজ ঘুম থেকে উঠে রোজকার অভ্যাস মতো দাড়ি কামিয়েছে সে।
তাহলে কি সে কোথাও লুকিয়ে ওঁৎ পেতে বসে আছে আমাদের মধ্যে থেকে কাউকে তার চতুর্থ শিকার হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্য। ভয়ে ভয়ে নিচু গলায় বললো ভেরা।
অসম্ভব কিছু নয়। লম্বার্ডকে দেখে মনে হলো, খুবই চিন্তিত সে। তাই যদি হয় তাহলে চলুন আমরা এক সঙ্গে এগিয়ে চলি। আমরা এক সঙ্গে থাকলে খুনীর বাবারও ক্ষমতা নেই, আমাদের গায়ে হাত তোলে।
আর মিস ব্লেন্টও বা কি রকম মহিলা বলুন তো। বিরক্ত হলেন ব্লোর বলা নেই, কওয়া নেই, সুট করে কোথায় চলে গেলেন। এ এক নতুন ফ্যাসাদ, ওঁকে এখন খুঁজি কোথায় বলুন তো?
নিচে নেমে এলেন সকলে অতঃপর। আর ঠিক তখনি প্রাসাদের খোলা ফটকে পথ দিয়ে এমিলিকে ঢুকতে দেখলেন তাঁরা, আপাদমস্তক তার ঢাকা গরম পোষাকে।
হলঘরের সামনে এসে ওঁদের দেখে মৃদু উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন এমিলি এই মাত্র সমুদ্র দেখে আসছি। উঃ কি ভয়ঙ্কর রুদ্র মূর্তি সমুদ্রের। এই দুর্যোগে লঞ না আসার সম্ভাবনাই বেশী।
অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন ব্লোর। তার কথা শেষ হতে না হতেই রাগত স্বরে বললেন তিনি, একা প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে কাজটা আপনি ভাল করেননি মিস্ ব্লেন্ট, বিশেষ করে আমাদের সকলের নামই যখন খুনের তালিকায় ঝুলছে।
ওটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার মিঃ ব্লোর। একটু রুষ্ট হয়েই জবাব দিলেন এমিলি, আপনার মাথা না থামালেও চলবে। আর এও জেনে রাখবেন চারদিক দেখে শুনেই আমি পা ফেলে থাকি।
বেশ তা না হয় মানলাম, এখন বলুন পথে রগার্সকে দেখতে পেলেন?
রগার্সকে। অবাক বিস্ময়ে ব্লোরের দিকে তাকালেন এমিলি, কেন বলুন তো?
কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন ব্লোর বলা হলো না ওয়ারগ্রেভের উৎসাহসব্যঞ্জক কথা শুনে। খাবার ঘরের দরজা ঠেলে একবার উঁকি মেরে মৃদু হেসে তিনি বলে উঠলেন, ঐ তো ব্রেকফাস্ট কেমন সাজানো রয়েছে।
দরজা ঠেলে প্রথমে খাবার ঘরে প্রবেশ করলেন ওয়ারগ্রেভ, তাকে অনুসরণ করলেন বাকী সকলে। সকলেই দেখলেন, টেবিলের ওপর ছটি প্লেটে সাজানো খাবার। দেখে মনে হলো টেবিলে খাবারের প্লেটগুলো রেখে খাবার জল আনতে গেছে রগার্স।
হঠাৎ ভয়ে আতঙ্কে কান্নার মতো চিৎকার করে উঠলো ভেরা। তারপর ওয়ারগ্রেভের কাঁধে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে।
স্তব্ধ, হতবাক সকলে, তার হঠাৎ সেই কান্নার মানে খুঁজে পেলেন না কেউ। ভেরার মুখের দিকে প্রশ্ন চোখে তাকিয়ে রইলেন সকলে, তার কান্নার হেতুটা কি জানার জন্য।
সেটা উপলদ্ধি করে ভেরা নিজের থেকেই আবার চিৎকার করে আঙ্গুল দেখিয়ে কান্না স্বরে বললো, ঐ আলমারিটার দিকে তাকালেন? দেখতে গিয়ে ভেরার মতো তারাও শিউরে উঠলেন প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলেন সকলে একি। সাতটার জায়গায় এখন মোট ছটা পুতুল রয়েছে
বেশী খুঁজতে হলো না। প্রাসাদের পিছনে জ্বালানী কাঠ রাখার গুদামের সামনে রগার্সকে পড়ে থাকতে দেখল সকলে। রক্তাক্ত দেহ, গলাটা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন, বাঁ হাতের মুঠোয় ধরে রাখা এক টুকরো কাঠ। রক্তরঙে রঞ্জিত কুড়ুলটা পড়েছিল তার মস্তকহীন ধড়ের পাশেই। সামনে জড়ো করা কাটা কাঠ। উনুন ধরাবার কাঠ কাটতে গিয়ে বুঝি কখন ভুল করে নিজের গলাতেই কুড়ুলে কোপ দিয়ে ফেলেছে সে। আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হয়। কিন্তু
আমাদের চতুর খুনীর আর একবার তার খুনের নেশা চরিতার্থ করতে একটুও অসুবিধে হয় নি, রগার্সের দ্বিখণ্ডিত মৃতদেহের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বললেন আর্মস্ট্রং দৃশ্যটা ছিলো ঠিক এই রকম, নিচু হয়ে কাঠ কাটছিল রগার্স উনুন ধরাবার জন্য আপন মনে, খুনী যে কখন পা টিপে টিপে নিঃশব্দে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। খেয়াল করতে পারেনি সে। তারপর খুনী অতর্কিতে হাত ধরে তার হাত থেকে কুড়ুলটা ছিনিয়ে নিয়ে তারই কুড়ুলের এক কোপে তার ধড় থেকে গলাটা নামিয়ে দিয়েছে।
দূর থেকে চকিতে একবার এমিলির মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে আর্মস্ট্রং এর উদ্দেশ্যে বললেন ডঃ ওয়ারগ্রেভ, ডঃ আর্মস্ট্রং আপনার কি মনে হয়, একাজ কোনো মহিলার পক্ষে করা সম্ভব?
হ্যাঁ, সম্ভব বৈকি। উপস্থিত সকলকে চকিতে একবার দেখে নিলের আর্মস্ট্রং। ভাগ্যিস এমিলি ও ভেরা বসেছিলেন দূরে রান্নাঘরে মেঝের ওপর। আর্মস্ট্রং নিজের কথায় জের টেনে আবার বললেন, চোখে লাগার মতো এমিলির দেহের গঠন, ভাল স্বাস্থ্য দেখেই আমি বলছি, এ কাজ তার অসাধ্য নয়। যদিও তাঁর বয়স হয়েছে কিন্তু তিনি যে ভাবে দ্রুত পা ফেলে ফেলে প্রাসাদে এসে ঢুকলেন, তাতে আমার এ কথাই মনে হয়। তাছাড়া মনটা শক্ত থাকলে শারীরিক ক্ষমতার অভাব হয় না।
নিচু হয়ে কুড়ুলটা পরীক্ষা করে উঠে দাঁড়ালেন ব্লোর, আগেই জেনেছি অত্যন্ত চতুর এই খুনী হাতের কোনো ছাপ রাখে নি, কাজ শেষে রুমাল দিয়ে মুছে দিয়েছে।
হঠাৎ মৌমাছির আগমন হতে দেখে সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন, এখানে মৌমাছি এলো কোথা থেকে। এ নিয়ে পুরুষরা যখন আলোচনায় ব্যস্ত, ঠিক তখনি আচমকা রান্নাঘর থেকে গলা ফাটানো হাসির শব্দ শুনে চমকে ফিরে তাকালেন তারা রান্নাঘরের দিকে। সেই পাগল করা হাসি হাসতে হাসতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো ভেরা। হাসির উচ্ছ্বাসে তার সারা শরীর ফুলে ফুলে ফেঁপে উঠছিল।
পুরুষদের দেখে হুঁশ হলো ভেরার। হাসি থামিয়ে মায়াবিনীর মতো স্বপ্নালু চোখে লম্বার্ডের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো সে লক্ষ্মীটি মিঃ লম্বার্ড, এই মৌমাছিগুলো কোথা থেকে আসছে, দেখুন আপনি। নিশ্চয়ই এই দ্বীপে কোথাও মৌচাক আছে। আমি সেই মৌচাকে ঢিল মেরে মদু আহরণ করে আনবো। আঃ চাক ভাঙা মধু খেতে কতোই না মিষ্টি হা-হা-হা-।
তার সেই পাগলামি দেখে সকলেই স্তম্ভিত, কারোর মুখে কথা ফোটে না পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকায়–মেয়েটি কি তাহলে
চুপ করে রইলেন কেন? আমার কথার জবাব দিন? লম্বার্ডের কাছে কৈফিয়ত চাইল ভেরা, আপনারা ভেবেছেন, আমি বুঝি পাগল হয়ে গেছি। না, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক। আ-আমি মৌচাকে ঢিল ছুঁড়বো, আমি মধু খাবো, চাক ভাঙা মধু। কেন মনে নেই সেই কবিতাটার কথা
মিঃ লম্বার্ড দয়া করে বলুন, কোথায় গেলে আমি পাবো মৌচাক। আমি ঢিল ছুঁড়বো আমি মধু খাবো, আ-আমি
হা-হা-হা-যেন সে উন্মাদিনীর মতো হেসে চলেছে একটানা। অসহ্য। আর থাকতে পারলেন না আর্মস্ট্রং। এক পা এক পা করে তার সামনে এগিয়ে গিয়ে একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলেন, ভেরার ফর্সা গালের ওপর সজোরে চড় মেরে বসলেন। এ যেন কল্পনার বাইরে,চমকে উঠলো ভেরা। গালে হাত বোলাতে বোলাতে এবার সে স্বাভাবিক গলায় বললো, আমার ভুল শুধরে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মুহূর্তে একেবারে বদলে গেলো ভেরা। শান্ত সহজ মেয়ে ভেরা, চোখে নেই চাঞ্চল্য কিংবা বিস্ময়বোধ। পিছু হটে গিয়ে নিজের থেকেই আবার বললো ভেরা দুঃখিত। এখুনি আমি আর মিস্ ব্লেন্ট আপনাদের ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করছি। তারপর রান্নাঘরের খালি উনুনের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে বললো সে, কয়েক টুকরো কাঠ পেলে উনুন ধরিয়ে আপনাদের চায়ের ব্যবস্থা করতে পারতাম।
এমিলিকে সঙ্গে নিয়ে ভেরা রান্নাঘরে চলে যেতেই আর্মস্ট্রং এর দিকে তাকালেন ব্লোর, কি ডাক্তার এটাও কি আপনাদের চিকিৎসা শাস্ত্রের একটা ওষুধ নাকি? বড়! ডোজ! এক চড়েই একেবারে চুপ।
তা চুপ না করালে মেয়েটি যে হিস্ট্রিয়া রোগগ্রস্ত হয়ে পড়তো। তখন আর এক ঝামেলা প্রসঙ্গটাকে চাপা দিয়ে আর্মস্ট্রং সকলকে মনে করিয়ে দিলেন, মেয়েটি জ্বালানি কাঠ চেয়ে গেছে। চলুন যাওয়া যাক। রগার্সের কেটে রাখা কয়েক টুকরো কাঠ বয়ে আনা যাক।
সবাই দুহাতে করে রান্নার কাঠ বয়ে নিয়ে এলেন রান্নাঘরে। চোখ তুলে তাদের একবার দেখে নিয়ে বললেন এমিলি আপনারা ডাইনিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসুন সবাই। আধ ঘণ্টার মধ্যেই আপনাদের ব্রেকফাস্ট তৈরি হয়ে যাবে।
লম্বার্ডকে একা পেতেই ফিসফিসিয়ে তাকে বললেন ব্লোর রগার্সের আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা যখন সবাই বিচলিত, কেবল একজন কেমন অবিচল থেকে দিব্যি স্বাভাবিক ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন? উনি আবার আমাদের জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরী করছেন এখন। বা চমৎকার। আপনার কি মনে হয়?
ঠিক এখনি কিছু বলা মুশকিল।
দেখুন মিঃ লম্বার্ড ওঁর সম্পর্কে আপনি কি ভাবছেন আমি জানি না। তবে এই সব চিরকুমারী মধ্যবয়স্কদের ওপর আমার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। বাইরে থেকে ধর্মের দোহাই দিয়ে সতোর যতো পরিচয়ই ওরা দিক না কেন, ভেতরে ভেতরে ওরা মহা শয়তান। হেন অসৎ কাজ নেই যে করতে পারে না।
কিন্তু আপনি বোধ হয় একটা ভুল করেছেন মিঃ ব্লোর সৎ অসৎ যাই হোক না কেন ধর্মের নামে বজ্জাতি আর উন্মত্ততা এক নয়।
লম্বার্ডের কথাটা যেন কানেই ঢেকে নি, এমনি ভাব দেখিয়ে বলতে থাকেন ব্লোর, আবার দেখুন আমরা যখন একা একা বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছি উনি তখন কেমন নির্ভয়ে বুক ফুলিয়ে বাইরে এক চক্কর দিয়ে এলেন। এর কারণটা বোঝা তো খুবই সহজ মশাই, প্রকৃত খুনীর আবার কিসের ভয়?
হ্যাঁ, ঠিক, ঠিক, মাথা নেড়ে সায় দিলো লম্বার্ড, আশ্চর্য, আপনার মতো এতো গভীর ভাবে আমি কেন চিন্তা করলাম না। তারপর এক গাল হেসে বললো লম্বার্ড, তবে এখন আমি একেবারে নিশ্চিন্ত, সেবারের মতো আবার যে আমাকে সন্দেহ করে বসেন নি, তাতেই আমি খুশি।
আরে মশাই, আমি কি শুধু শুধু সন্দেহ করেছিলাম? আপনার সেই রিভলবারটাই তো-কার না সন্দেহ হয় বলুন। তবে পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে আর লাভ নেই। আপনার সম্পর্কে এখন আর আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আশা করি আমার সম্বন্ধেও আপনার ধারণা এখন পাল্টেছে নিশ্চয়ই।
না পাল্টাবার কোনো প্রয়োজনই মনে করি না। কেন জানেন? বললো লম্বার্ড, আমি আপনাকে কোনোদিনই সন্দেহ করিনি। অপরাধ নেবেন না, হয়তো ছোট মুখ বড় কথা হয়ে যাচ্ছে, আপনার মগজে বুদ্ধি সুদ্ধি আছে বলে তো আমি মনে করি না। আর খুন করতে হলে যথেষ্ট বুদ্ধি থাকার প্রয়োজন। আপনার মতো একজন নিরেট বোকা লোক কি করে ল্যান্ডরকে কাবু করলেন, আপনি জানেন আর ঈশ্বর জানেন?
প্রসঙ্গটা তুলে ভালই করেছেন। খুলেই বলি তাহলে ল্যান্ডরের সত্যিই কোনো দোষ ছিলো না। কিন্তু ডাকাত দলের সংশ্রবে পড়ে শেষ পর্যন্ত তাকে ফাসাতে বাধ্য হয়েছি। তবে জেনে রাখুন তার মৃত্যুর ব্যাপারে বিশ্বাস করুন আমার কোনো হাত ছিলো না। তার ভাগ্য খারাপ, তাই
ভাগ্য তো আপনারও খারাপ মিঃ ব্লোর তা না হলে দীর্ঘ দিন পরে অতীতের সেই সত্য না মিথ্যে ঘটনার জেরই বা টানতে হবে কেন, আর তার জন্য আজ আপনার প্রাণনাশের আশঙ্কাই বা দেখা দেবে কেন বলুন।
আমার প্রাণনাশের আশঙ্কা? আরে ছাড়ুন। আমি এখন খুবই সতর্ক, আমাকে মারার মতো খুনীর জনম এখনো হয়নি।
না জন্মালেই ভাল, আর যদি জন্মে থাকে, মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে আমার ভবিষ্যৎ বাণীটা মনে রাখবেন। বোকারা প্রাণ হারায় সবার আগে। তাই আবার আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাকে, আপনার বুদ্ধি বলতে কিছুই নেই, তাই আপনার মৃত্যু আসন্ন, আপনার বেঁচে থাকার দিন প্রায় সীমিত।
আর আপনি নিজেকে যত চালাকই ভাবুন না কেন, আপনিও বাঁচতে পারবেন না।
আমি যে অমর সে কথা আমি বলছি না, মৃদু হেসে লম্বার্ড বললো তবে তাই বলে আপনার মতো এখানে পড়ে থেকে বেঘোরে প্রাণ দেবো না। খুনী আমাকে স্পর্শ করার আগেই আমি এখান থেকে চম্পট দেবো।
ব্রেকফাস্টের খাবার তৈরী করতে গিয়ে ভেরা তখন আপন মনে নিজেকে দুষছিলো। ছিঃ ছিঃ কাজটা আমি মোটেও ভাল করিনি। ওঁরা আমাকে পাগল ঠাওড়ালেন। আমি কি সত্যি পাগল হয়ে গেছি? নিজের একটু বোকামির জন্য সবাই আমাকে পাগল ভাবলেন। না, এখন থেকে মাথা গরম করলে চলবে না, ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে, একেবারে ঠাণ্ডা জলের মতো
জলের প্রসঙ্গ উঠতেই মনে পড়ে গেলো সিরিলের কথা। তখন সবাই বলাবলি করেছিল, আমার মাথা নাকি খুব পরিষ্কার তা না হলে সিরিলকে জলে ডুবতে দেখেও মেয়েটি একটু ঘাবড়ায়নি। সবাই আমার প্রশংসা করেছে, আমার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সিরিলকে বাঁচানোর প্রচেষ্টার মধ্যে।
কিন্তু হুগো, হুগো আমাকে ভুল বুঝলো, কোনো কথা না বলে এমন ভাবে তাকিয়েছিল ওর সেই জ্বলন্ত চাহনি আমি সহ্য করতে পারিনি। অথচ আমি ওর জন্যই, না, ফেলে আসা দিনগুলির কথা আর ভাববো না। অতীতের কথা আর ভাববো না। অতীতের স্মৃতি বড় বেদনাময়।
কি ভাবছে ভেরা? এমিলির কথায় ভেরা ফিরে এলো বর্তমানে, রুটিগুলো যে সব পুড়ে গেলো।
ছিঃ ছিঃ অমন অন্যমনস্ক হওয়া উচিত হয়নি। নিজের ত্রুটি স্বীকার করে নিয়ে কাজে মন দিলো ভেরা এবার। চটপট রুটির চাটুটা উনুন থেকে নামিয়ে রাখলো সে। তৈরি হয়েই ছিলেন এমিলি, এস্ত হাতে চায়ের কেতলীটা চাপিয়ে দিলেন উনুনের ওপর।
এমিলিকে সহজ ভঙ্গিমায় কাজ করতে দেখে কেমন হিংসে হলো ভেরার। আপনাকে দেখে আমার হিংসে হচ্ছে মিস্ ব্লেন্ট। এতো সব ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেলো একের পর এক, তবু আপনি কেমন মাথা ঠাণ্ডা রেখে সামনে কাজ করে যাচ্ছেন। কি করে মন মেজাজ ঠাণ্ডা রাখেন বলুন তো? আপনার মরতে ভয় করে না?
ভয় কেন করবে না? আলবাৎ করে। মরার ভয় কার না পায় বলুন? দৃঢ়স্বরে এমিলি বলে, কিন্তু আমি কেন মরতে যাব? আমি কোনো পাপ করিনি। আমি সহজে মরবো না। মরতে হয় আপনারা সবাই মরবেন। আমি শেষ দেখতে চাই। শেষটা না দেখা পর্যন্ত কোনো খুনীই আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না দেখবেন।
ওরা সবাই নিজেকে খুব চালাক বলে মনে করে, কিন্তু ওদের মতো বোকা বোধ হয় কেউ নেই। তা না হলে মরণকে ভয় করে হাত পা গুটিয়ে সবাই বসে থাকে। আরে ভয়কে জয় করতে হয় চোখে চোখ রেখে। মূল্যবান জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তো মানুষের নিজেরই। বোকা ম্যাকআর্থার সেই দায়িত্বটা পালন করলো না বলেই তাকে আজ অসময়ে প্রাণ হারাতে হলো। আর সেই নচ্ছার বেট্রিস টেবল ছিঃ ছিঃ ঐ জঘন্য বর্বরের কথা আমি আবার ভাবছি কেন? আপদ গেছে, ভালই হয়েছে? একটা অমানুষ? তা না হলে কেউ কি আত্মহত্যা করে?
নতুন রাধুনীদের তৈরী ব্রেকফাস্ট সবাই বেশ তৃপ্তি সহকারে খেলেও একটা দুশ্চিন্তায় তার ছজন যেন ক্রমশঃ কাবু হয়ে পড়েছিলেন এখন তাদের কেবল একটাই চিন্তা, এবার কার পালা? কে বধ হবে।
সমাধানের মার নেই। একটু চালাক চতুর হতে হবে। কিন্তু কথায় আছে, অতি চালাকের গলায় দড়ি। তাছাড়া এখানকার রকম সকম আলাদা, কখন কার ভাগ্যে কি যে ঘটবে আগে ভাগে কেউ টেরও পাবে না। যেমন পায়নি মার্স্টান, মিসেস রগার্স, ম্যাকআর্থার।
এখানে আসা অবধি যা যা অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে, এর পরেও যে নিরাপদে থাকতে পিরবো, তার কি নিশ্চয়তা আছে। এই ধরাই যাক না কেন উলের গোলাদুটোর কথা ঘরে রেখে গেলাম। ফিরে এসে দেখি নেই। ভাবতে কেমন লাগে, আমার উলের গোলাদুটোর কি প্রয়োজন হলো খুনীর। উল দিয়ে গলায় ফাঁস। যততো সব আজগুলি চিন্তা। যাই হোক, এখন থেকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে, আগের, চেয়ে একটু বেশী।
এদের বোকা না বলে বলবো গাভি। গাভি না হলে, আমার বানানো গল্প তারা কেমন বিশ্বাস করে নেয়? এতো সহজে কাজগুলো যে হাসিল করতে পারবো, করার আগেও ভাবতে পারিনি।
খাবার ঘরের আলমারিতে ছটা পুতুল দেখে এসেছি, কে জানে কাল সকালে আর একটা যেতে দেখবো কি না।
.
১২.
ব্রেকফাস্টের পর সকলকে ডেকে জানিয়ে দিলেন ওয়ারগ্রেভ একটা জরুরী আলোচনা আছে আপনাদের সঙ্গে। আধ ঘণ্টার মধ্যে আপনারা সবাই চলে আসুন বসবার ঘরে, ওখানেই–
তার প্রস্তাবটা সবারই বেশ মনে ধরলো, তাই সবাই মাথা নেড়ে সায় দিলেন সঙ্গে সঙ্গে।
ভেরাকে বাসন মাজার কাজে সাহায্য করতে গেলো লম্বার্ড।
এমিলিও উঠতে যাচ্ছিল তাদের সাহায্য করার জন্যে। কিন্তু পারলো না বসে পড়লো চেয়ারে কপালে হাত দিয়ে এলিয়ে দিলেন মাথাটা চেয়ারে একটা যন্ত্রণা কাতর শব্দ বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে অস্ফুটে।
ছুটে এলেন ওয়ারগ্রেভ, কি হলো মিস ব্লেন্ট।
মাথাটা হঠাৎ কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠলো।
তা তো করবেই। উঠে দাঁড়ালেন আর্মস্ট্রং এক মিনিট, আমি আপনার জন্য একটা ওষুধ
খবরদ্দার। তাঁকে বাধা দিয়ে উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলেন এমিলি, আপনার ওষুধে আমার কোনো প্রয়োজন নেই, আপনি এখন যেতে পারেন।
এ যে বিনা মেঘে বজ্রপাত। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন ডঃ আর্মস্ট্রং। ফ্যাকাসে মুখ, চোখের চাহনিতে পরাজয়ের গ্লানি, এমিলির দিকে না তাকিয়েই ক্ষোভের সঙ্গে বললেন তিনি, আমার সম্পর্কে আপনার যদি সে রকমই ধারণা হয়ে থাকে, তাহলে আমি চললাম। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন আর্মস্ট্রং ক্লান্ত পায়ে।
তারপর একে একে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। শুধু একা এমিলি বসে রইলেন চেয়ারে দেহটা এলিয়ে দিয়ে। বাথরুমের দিক থেকে ভেসে আসে মৃদু আলাপন এমিলির কানে ভালই হয়েছে, এখন ওঁর একটু বিশ্রাম দরকার……..।
ভো ভো ভো–ও…………?
চোখ বুজেই এমিলি ভাবেন, শব্দটা যেন মৌমাছির বলে মনে হচ্ছে। ভেরার কথা মনে পড়ে গেলো তার। চাক ভাঙ্গা মধু খেতে চেয়েছিল সে। ফোঁটা ফোঁটা মধু গড়িয়ে পড়বে মৌচাক থেকে আমার মুখে, একটু একটু করে সে মধু খেতে কতোই না তৃপ্তি, ভেবেই কত না সুখ-তখন ভেরার কথাগুলো পাগলের প্রলাপের মতো শোনালেও এখন মনে হচ্ছে, অনুভূতি ভেরার আমার সবার। কিন্তু ও কার পায়ের শব্দ? চোখ না খুলেই আধো ঘুমের ঘোরে অনুমান করতে চেষ্টা করেন এমিলি, পা টিপে টিপে কে যেন এগিয়ে আসছে। কে, কে ও, তবে কি ও বেট্রিস?
তুমি যাও বেট্রিস। আমি তোমার দিকে মুখ ফেরাতে চাই না। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। কেন জান? আত্মহত্যা করে তুমি অপমান করছো ঈশ্বরকে। তোমার মতো পাপীর মুখ আমি দেখতে চাই না।
আবার সেই মৌমাছির গুণ গুন ভো, ভো, ভেও
আরে এ যে দেখছি, না ওগুলো শুনে মনে হচ্ছে মৌমাছিটা আমার খুব কাছে এসে গেছে। আমার মাথার ওপর একটা চক্কর দিয়ে সেটা এখন আমার পিঠ ছুঁয়ে যাবার মতো, উড়ছে–ভো, ভো–ও-ও হুল ফোঁটাবে যা হওয়ার হোক। তবু চোখ খুলে দেখতে চাই না ওই পাপিষ্ঠার মুখ। কিন্তু হুলের কি জ্বালা। শেষ পর্যন্ত মৌমাছিটা আমার দিকে ঘাড়ের ওপর হুল ফোঁটালো। উঃ তীব্র যন্ত্রণায় আমার প্রাণটা বুঝি বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো
ওদিকে বসবার ঘরে সবাই তখন অপেক্ষা করছিলেন এমিলির জন্য তাকে আসতে না দেখে অধৈর্য হয়ে ভেরা উঠে দাঁড়ালো। কই মিস্ ব্লেন্ট তো এখনো এলেন না, আমি, ওঁকে ডেকে আনতে চললাম।
গিয়ে কোনো লাভ নেই, বাধা দিয়ে বললেন ব্লোর, এতোগুলো খুনের আততায়ীকে খোঁজার আর প্রয়োজন নেই বলে মনে করি আমি। আততায়ী আর কেউ নয়, মিস এমিলি ব্লেন্ট নিজেই।
খুনের মোটিভ? তার দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালেন আর্মস্ট্রং।
এ ধরনের খুনীর একটাই তো মোটিভ। বাতিক মশাই স্রেফ বাতিক। ধর্মের নামে বাতিক
আপনার কথা আমি অস্বীকার করবো না, জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন আর্মস্ট্রং, কিন্তু কেবল মাত্র অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কাউকে দোষী চিহ্নিত করা যায় না, তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত প্রমাণ।
আজ সকালে তার ভাবভঙ্গি আমাদের কারোর কাছেই তেমন স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। ব্লোর, আরো বলেন, তাছাড়া আমরা আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রতিবাদ জানিয়েছি, নিজেদের নির্দেশিত ব্যাপারে কিছু না কিছু একটা বক্তব্য রেখেছি, কিন্তু উনি কোনো জবাব দেননি। এর থেকেই কি প্রমাণ হয় না, উনি প্রকৃতই খুনী, তাই বলার মতো কিছু ওঁর নেই।
না, এখানে আমি আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না মিঃ ব্লোর, তার কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলে উঠলো ভেরা, পরে উনি আমাকে ওঁর অতীত জীবনের সব কথাই বলেছেন। উনি নির্দোষ। এর পর এমিলি বর্ণিত বেট্রিস টেলরের কাহিনী সংক্ষেপে বললো ভেরা।
এ তো বেশ সহজ সরল কাহিনী দেখছি। এতে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। পরোক্ষভাবে এমিলিকে সমর্থন করে বললেন ওয়ারগ্রেভ, তার এই কাহিনী নিঃসন্দেহে বিশ্বাসযোগ্য বলে আমার মনে হয়। তা আপনারা কি বলেন? তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন এগারোটা বাজতে পাঁচ এখন? না, আর তো অপেক্ষা করা যায় না। বরং খাবার ঘরে গিয়েই আমাদের আলোচনা শুরু করা যাক। আর সেখানে মিস ব্লেন্টকেও পাওয়া যাবে, কি বলেন?
হ্যাঁ, তাই চলুন প্রায় সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন। সবাই তখন উঠে খাবার ঘরে চলে এলেন।
তেমনি চেয়ারে হেলান দিয়ে ঠিক একই ভাবে দেহ এলিয়ে দিয়ে বসে আছেন এমিলি। তিনি এমনি গভীর চিন্তামগ্ন যে অতগুলো লোকের পদশব্দে তাঁর চিন্তায় কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করলো না, কিংবা ফিরে তাকাতে বাধ্য হলেন না।
তৈরি হয়েই এসেছিলেন ব্লোর, তীব্র ভাষায় আক্রমণ করবেন। এমিলিকে, তাই তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে পা টিপে টিপে এগিয়ে এলেন এমিলির কাছে। নিচু হয়ে তাকে ডাকতে গিয়েই দু পা পিছিয়ে একটা বিকট চিৎকার করে উঠলেন তিনি, হায় ঈশ্বর। এ তুমি কি করলে? এতো তাড়াতাড়ি ওঁকে আমার কাছে টেনে নিলে?
আরো একটি পুতুল, উধাও হলো, রইলো মোট পাঁচ।
ডঃ আর্মস্ট্রং এগিয়ে গিয়ে মৃত এমিলির মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লেন, নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করলেন, নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা। তারপর উঠে দাঁড়ালেন গম্ভীর মুখে।
ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো লম্বার্ড, কি ভাবে ওঁর মৃত্যু হলো ডাক্তার?
বিষ ক্রিয়ায়। ওঁর ঘাড়ের কাছে সিরিঞ্জের উঁচ। ফোঁটানোর দাগ দেখতে পেলাম।
ওদিকে জানালার শার্সিতে মৌমাছিটা আছড়ে পড়ছিলো বারবার ভোঁ-ভো, ভো–ও
ঐ তো সেই মৌমাছিটা চিৎকার করে উঠলো ভেরা বলেছিলাম না তুলের বিষে বড় জ্বালা বড় কষ্ট, তারপর পাগলের মতো শব্দ করে হাসতে শুরু করলো ভেরা।
হাতের ইশারায় তাকে থামতে বললেন ডঃ আর্মস্ট্রং আপনি খুব ভুল করছেন মিস্ ক্লেথন। মৌমাছি নয়, অন্য কোনো হিংস্র শ্বাপদ ও নয়। মানুষ, মানুষের হাতেই খুন হয়েছে মিঃ ব্লেন্ট। আমাদেরই কেউ একজন তার শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছেন ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে।
কি ধরনের বিষ হতে পারে বলে মনে হয়, আপনার?এই প্রথম কথা বললেন ওয়ারগ্রেভ।
মনে হয় পটাশিয়াম সায়ানাইড। মার্স্টানের পানীয়তেও ঠিক এই বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল এই খুনী।
কিন্তু ঐ মৌমাছিটা? ওটাকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। উড়ন্ত মৌমাছির দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে পলক ফেলতে ভুলে যায় ভেরা।
ওটার সঙ্গে মিস্ ব্লেন্টের মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। দৃঢ়স্বরে বললেন ডঃ আর্মস্ট্রং এটা খুনীর একটা চাল। মৃত্যুর প্রকৃত ঘটনাকে বদলে দেবার জন্য এক্ষেত্রে মৌমাছির সাহায্য নিয়েছে সে।
খুনী যত চালাকই হোক না কেন শুন্যে হাত পাকিয়ে বললেন ওয়ারগ্রেভ আমাদের বিচার বুদ্ধির কাছে হার মানতে বাধ্য সে। এখন বলুন, আমাদের মধ্যে কে সঙ্গে এনেছেন ইনজেকশনের সিরিঞ্জ।
আমি হ্যাঁ, আমিই এনেছি। চার জোড়া জ্বলন্ত চোখের চাহনি উপক্ষো করে বললেন আর্মস্ট্রং শুধু এখানে নয়, আমি যেখানেই যাই না কেন, সঙ্গে করে একটা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ নিয়ে যাই।
বেশ তো কোথায় আছে, সেটা একবার দেখাতে পারেন।
কেন, আমার ঘরে সুটকেসের মধ্যে আছে।
চলুন ওয়ারগ্রেভ তার পিঠের ওপর হাত রেখে বললেন, আপনার ঘরে গিয়ে সেটা দেখে আসা যাক।
নিঃশব্দে সাবধানে পা ফেলে ফেলে পাঁচজন উঠে এলেন দোতলায় ডঃ আর্মস্ট্রং এর ঘরে। সবার দৃষ্টি স্থির তখন আর্মস্ট্রং এর সুটকেসের ওপর। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে গিয়ে তার ব্যবহৃত সব কিছুই পাওয়া গেলো, কিন্তু পাওয়া গেলো না কেবল সেই ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা। ক্রোধ সামলাতে পারলেন না আর্মস্ট্রং রাগে চিৎকার করে উঠলেন, মিস ব্লেন্টকে খুন করার জন্যে নিশ্চয়ই খুনী আমার সিরিঞ্জটা লোপাট করে দিয়েছে।
ওদিকে চারজোড়া আগুন ঝরা চোখের দৃষ্টি স্থির নিবন্ধ হলো আর্মস্ট্রং এর ওপর। তারই মধ্যে যতোটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে বললেন ওয়ারগ্রেভ, আমি আগেও বলেছি, আবার এখনো বলছি, খুনী আমাদেরই এই পাঁচজনের মধ্যে একজন। অর্থাৎ চারজন নিরপরাধ আর একজন অপরাধী। এ অবস্থায় এখন আমাদের সকলের উচিৎ যে যার নির্দোষিতা প্রমাণ করা। তারা কেন খুনী নয়, যুক্তি তর্ক দিয়ে অবশ্যই বোঝাতে হবে। নিছক কর্তব্যের খাতিরে আপনাকেই প্রথমে জিজ্ঞাসা করছি–এখন বলুন কি কি ওষুধ আছে আপনার সঙ্গে?
বলার মতো তেমন কিছু নয়–এই ধরুন কিছু ঘুমের ট্যাবলেট এক প্যাকেট ব্রোমাইড এক শিশি সোডি বাই কাব আর কয়েকটা অ্যাসপিরিন। এগুলো আছে আলমারির দেরাজে। খুলে দেখতে পারেন আপনারা।
না, তার আর দরকার হবে না। আপনার মুখের কথাই যথেষ্ট। বললেন ওয়ারগ্রেভ, ঘুমের ট্যাবলেট আমার কাছেও আছে দু-একটা। তবে কি জানেন, মাত্রারিক্ত হলে সে ওষুধ আর ওষুধ থাকে না তখন, বিষে পরিণত হয়ে যায়। যাই হোক এবার লম্বার্ডের দিকে ফিরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন শুনেছি আপনার কাছে একটা পিস্তল আছে মিঃ লম্বার্ড?
ঠিকই শুনেছেন, কিন্তু তার জন্য কি হয়েছে।
অনেক কিছু হয়েছে, আর হতেই বা কতক্ষণ, যা সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, এখানে তাই আমার বক্তব্য হলো আপনার পিস্তল, ডঃ আর্মস্ট্রং এর ওষুধের বাক্স, আর আমার কাছে যে যে ওষুধ আছে, সবগুলো একটা বিশেষ জায়গায় রেখে আমাদের প্রত্যেকের ঘরে গিয়ে তল্লাসী চালিয়ে দেখবো ডাক্তারের ইনজেকশানের সিরিঞ্জ, ম্যাকআর্থারকে খুন করার জন্য যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল সেটা খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।
কিন্তু, আমি প্রথমেই বলে রাখছি, প্রতিবাদ করে উঠলো লম্বার্ড, আমি আমার পিস্তল হাতছাড়া করবে না, ওটা আমার কাছেই থাকবে।
হাতছাড়া করার প্রস্তাব তো আমি করছি না। আপনার পিস্তল সহ সব জিনিস থাকবে একটা চাবি লাগানো বাক্সে। আর সেই বাক্সটা যে আলমারিতে থাকবে, তার চাবি থাকবে আপনার কাছে। তার মানে ব্যাপারটা এই রকম দাঁড়াচ্ছে যে, আপনাদের দুজনের সম্মতি ছাড়া কেউ সেই বাক্সটা খুলতে পারবে না। কি রাজি আছেন তো?
হ্যাঁ, এতে আমার সম্মতি আছে।
তাহলে এখন বলুন, আপনার সেই পিস্তলটা কোথায় পাওয়া যেতে পারে?
আমার বিছানা সংলগ্ন টেবিলের ড্রয়ারে। এখুনি নিয়ে আসছি?
আমরাও আপনার সঙ্গে যাবো।
লম্বার্ডের ইচ্ছে নয়, ওঁদের সঙ্গে নেয়। যাই হোক, কোনো রকমে বিরক্তি ভাবটা দমন করে করিডোরের একেবারে শেষপ্রান্তের ঘরে গিয়ে ঢুকলো সে, বাকী চারজন তাকে অনুসরণ করলেন।
বিছানা সংলগ্ন টেবিলের ড্রয়ার খুলতে গিয়ে চকিতে একবার সে তাকালো সকলের মুখের দিকে, ভাবখানা এই যে, নিয়ে যাও পিস্তলটা
কিন্তু শূন্য ড্রয়ার, সেখানে পিস্তলের চিহ্ন দেখতে পাওয়া গেল না।
বিস্ময়ে সবাই হতবাক।
কি এর পরেও পিস্তল রাখার জন্য আলাদা একটা বাক্সের প্রয়োজন হবে? শ্লেষের সুরে বলল লম্বার্ড।
তার কথায় কেউ ভ্রূক্ষেপই করলো না। ভেরা তো কোনো মন্তব্য না করেই বেরিয়ে গেলো লম্বার্ডের ঘর থেকে। তবে ডঃ আর্মস্ট্রং ওয়ারগ্রেভ এবং ব্লোর হাল ছাড়লেন না। নতুন উদ্দমে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলেন লম্বার্ডের ঘর। কিন্তু শুধু পিস্তল নয়, সন্দেহজনক তেমন কোনো জিনিস বা কাগজপত্র পাওয়া গেলো না লম্বার্ডের ঘরে।
ওয়ারগ্রেভ, আর্মস্ট্রং কিংবা ব্লোর এরা কেউই রেহাই পেলেন না। এক এক করে প্রত্যেকের ঘরে তল্লাশী চালানো হলো, সন্দেহজনক কোনো কিছুই পাওয়া গেলো না। সব শেষে অভিযান চালানো হলো ভেরার ঘরে।
ভেরা জানতো বোধ হয়। তাই সে দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনে। ওয়ারগ্রেভের সঙ্গে তার দৃষ্টি বিনিময় হতেই মুখে সামান্য একটু হেসে তিনি বললেন, কি করবো বলুন কর্তব্যের খাতিরে আপনার ঘরেও খুঁজে দেখতে হবে। আমার কথায় আপনি হয়তো মনে মনে রাগ করেছেন। কিন্তু আমরা নাচার। কর্তব্যের খাতিরে
নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ভেরা। তারপর বাকী সকলে মিলে ভেরার ঘরে তল্লাসী চালালেন, কিন্তু তার ঘরেও লম্বার্ডের পিস্তলের কোনো পাত্তা নেই। ব্যর্থ মন নিয়ে ভেরার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওঁরা সবাই আবার এসে ঢুকলেন বসবার ঘরে। কিছু পরে ভেরা আসতেই আলোচনা শুরু হলো।
শুরু করলেন ওয়ারগ্রেভ প্রথমে। আমাদের কারোর কাছেই কোনো মারাত্মক অস্ত্র কিংবা বিষ লুকোনো নেই। বাঁচা গেলো, এখন আমাদের কাছে যা ওষুধপত্র আছে সেগুলো একটা বাক্সে পুরে তালা লাগিয়ে বাক্সটা আলমারির ভেতরে তুলে রাখছি। তারপর বাক্স ও আলমারির চাবি দুটো ব্লোর ও লম্বার্ডের হাতে তুলে দেবো। এই কার্যকরী ব্যাপারে আপনাদের কারোর আপত্তি নেই তো?
মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ। কাজে নেমে পড়লেন ওয়ারগ্রেভ চটপটু। চাবি লাগানো হলো বাক্সে, আলমারিতে। দুজনের হাতে চাবি তুলে দিয়ে তিনি বললেন, তবে এতেই যে সমস্যার সমাধান হলো তা নয়। পিস্তল এখনো বেপাত্তা। কোথায় সেটা, কে বলবে?
একমাত্র মিঃ লম্বার্ডই বোধ হয় বলতে পারবেন। লম্বার্ডের চোখের ওপর স্থির দৃষ্টি রেখে বললেন ব্লোর।
সেই থেকে চিনে জোঁকের মতো আমার পিছনে লেগে আছেন আপনি। রাগে ফুঁসে উঠলো লম্বার্ড, বারবার বলছি, ওটা নিশ্চয়ই কেউ সরিয়ে থাকবে, কথাটা কি কানে যায় নি?
বেশ তো এখন বলুন, শেষ কখন পিস্তলটা দেখেছিলেন আপনি? প্রশ্ন করলেন ওয়ারগ্রেভ।
গতকাল রাতে উত্তরে বলল লম্বার্ড শোকের আগে পকেট থেকে বার করে টেবিলের ড্রয়ারে রেখেছিলাম।
তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে আজ সকালেই খোয়া গিয়ে থাকবে ওটা।
চুরি গেলেও প্রাসাদের কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে ওটা, মন্তব্য করলেন ব্লোর।
নাও থাকতে পারে। প্রাসাদরে বাইরে কোনো গোপন জায়গায় পিস্তল সহ অন্য সব জিনিসপত্র দেখুন গিয়ে লুকিয়ে রেখেছে নিশ্চয়ই।
পিস্তলের খবর দিতে পারবো না। যেন নিজের মনে বললেন ব্লোর তবে সিরিঞ্জের হদিস দিতে পারি। আমার সঙ্গে চলুন আপনারা কোথায় সেটা আছে দেখাচ্ছি।
সিরিঞ্জটা পড়েছিল খাবার ঘরের জানালা বরাবর ফাঁকা উদ্যানে, আর পাশে পড়ে আছে একটা চীনে মাটির পুতুল, কালো মাণিক। পুতুলের মাথাটা থেঁতলে খুঁড়িয়ে গেছে কোনো কিছু ভারী জিনিসের চাপে।
এ সব হলো অনুমান মশাই, স্রেফ অনুমানের ওপর নির্ভর করে সিরিঞ্জটা আবিষ্কার করা, সাফল্যের হাসি ফুটে উঠলো ব্লোরের ঠোঁটে, এই খাবার ঘরেই মিস ব্লেন্ট খুন, হয়েছে একটু আগে অতএব অনুমান করে নিলাম, তাড়াতাড়ি খুনের চিহ্ন লোপার্ট করার জন্য ঐ জানালাটাই বেছে নিতে পারে আততায়ী, কার্যত আমার অনুমান অক্ষরে অক্ষরে মিলে যে গেলো, সে তো আপনারা নিজের চোখেই দেখতে পেলেন, কি বলেন?
হ্যাঁ, সিরিঞ্জ তো পাওয়া গেলো, তা আপনার কি ধারণা পিস্তলটা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে তাই না? উত্তরের অপেক্ষা না করেই নিজের থেকেই ভেরা আবার বললো, একটু খুঁজে দেখি যদি সেটা পাওয়া যায়।
দাঁড়ান। হাতের ইশারায় তাকে থামাতে বাধ্য করলেন ওয়ারগ্রেভ, আপনি একা একা যাওয়ার মতো এমন মারাত্মক একটা ভুল যেন কখনোই করবেন না। চলুন, আজ আর আপনি একা নন। আমরাও আপনার সাথে আছি, ছিলাম এবং ভবিষ্যতেও থাকবো, দেখি কি করতে পারি আপনাদের জন্য।
তল্লাসীর কাজ চললো প্রায় আধঘণ্টা ধরে। তবে সুবই পণ্ডশ্রমে পরিণত হলো। কোনো হদিশ পাওয়া গেলো না সেই রিভলবারের।
.
১৩.
প্রাসাদের বাকী পাঁচজন অতিথি এখন কেউ আর কাউকে যেন বিশ্বাস করে না। পরস্পরের মধ্যে একটা অবিশ্বাসের দানা বাঁধতে শুরু করলো তারপর থেকে। সবাই সবার চোখে খুনী হিসেবে প্রতিপন্ন হতে চলেছে। কেউ কারোর প্রাণ খুলে কথা বলতে চায় না, সবাই সবার কাছে কি যেন হারানোর কথা সাহস করে কেউ বলতেও চায় না, যদি তাদের মধ্যে যেই খুনী হোক না কেন, আচমকা আক্রমণ করে বসে, সেই ভয়ে। সেই নিগার দ্বীপের পাঁচজন অতিথি কার্যতঃ এখন দীপান্তরিত যেন। মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত। এমন সময় আসে নি বোধ হয় কোনো দিন এর আগে তাদের জীবনে।
ওয়ারগ্রেভ এমনিতেই বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছিলেন, তার ওপর আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কায় চব্বিশ ঘণ্টায় তার বয়স যেন আরো বেড়ে গেছে। সব সময় চোখ বন্ধ করে থাকেন তিনি। তাঁর ভয়, চোখ খুললেই যদি আবার কারোর মৃতদেহ দেখতে হয়। কান খাড়া করে রাখতে সাহস পান না যদি আবার কোনো দুঃসংবাদ শুনতে হয়।
সব থেকে করুণ অবস্থা হলো ব্লোরের, মৃত্যু ভয়ে সিটিয়ে আছে সে সব সময়ে। রাতে ঘুম নেই, কোটরাগত চোখ।
ভেরাও যেন কেমন গুম মেরে বসে থাকে সব সময়। কথা বলার সাহস সেও কেমন হারিয়ে ফেলেছে। মৃত্যুর প্রহর গুণতে চায় সে নীরবে নিভৃতে। গোপনে সংগোপনে চলে তার অন্বেষণ, খুনীকে খুঁজে বার করার।
আর আর্মস্ট্রংকে তো মনের দিক থেকে ভয়ঙ্কর ক্লান্ত অবসন্ন দেখাচ্ছিল। ঠায় বসে আছেন চেয়ারে, টেনে যাচ্ছেন একটার পর একটা সিগারেট! ওঁদের মধ্যে কেবল লম্বার্ডকে একটু ভিন্ন প্রকৃতির বলে মনে হলো। ভয় যে সেও কম পায় নি ঠিক তা নয়, তবে এ অবস্থায় তার বুদ্ধি বিভ্রম এখনো হয়নি। চোখ কান খুলে রেখেছে। কোথাও সামান্য শব্দ হলেই ছুটে যাচ্ছে। তারই মাঝে জনে জনে খোঁজ খবর নিচ্ছে, ভরসা দিচ্ছে ভয়ের কিছু নেই, আপনাদের পাশেই আছি আমি।
ওদিকে বেলা বেড়ে চলে যতো, ততোই যেন চল হয়ে ওঠেন আর্মস্ট্রং। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বলে উঠলেন, আসন্ন মৃত্যু ভয়ে এভাবে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না, শুধুই চলে যাচ্ছে সময়। তাই বলি কি সময়টাকে আরো রেখে যদি কিছু একটা করা যায়
কি করা যায়? কিই বা করা যেতে পারে। শুরু হল আর এক প্ৰথ আলোচনা। এক একবার এক একজন বক্তা, বাকী চারজন তখন নীরব শ্রোতা। দীর্ঘ আলোচনার পর একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছলেন তারা। বাইরে কেউ বেরুবে না একান্ত প্রয়োজন ছাড়া। যদি বা কেউ বেরোয়, বাকী চারজন অপেক্ষা করবে, তার ফিরে না আসা পর্যন্ত।
তোফা! তোফা! হাততালি দিয়ে উঠলো লম্বার্ড, এমন ভাল প্রস্তাব, বুঝি আর হয় না। এ ভাবেই আমরা কাটিয়ে দিতে পারবো কয়েক ঘন্টা। তারপর নিশ্চয় বৃষ্টি থামবে। তখন না হয় নতুন উদ্যম নিয়ে এ দ্বীপ থেকে আমাদের উদ্ধার করার জন্য এখান থেকে সংকেত পাঠাবার ব্যবস্থা করা যাবে। আর কেউ যদি লঞ সমতে উদ্ধার করতে না আসে, তখন নিজেরাই না হয় একটা ডিঙি নৌকা তৈরী করে তাতে চেপে বসবো সকলে, তারপর ভেসে চলবো নিশ্চিত জীবনের আশায়।
কিন্তু সেই সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকলে তবে তো? আর্মস্ট্রং এর মনে গভীর সংশয়।
আলবাৎ থাকবো। দৃঢ়স্বরে বললেন ওয়ারগ্রেভ, চোখ কান খুলে রাখলে মৃত্যু আশঙ্কার কোনো কারণ নেই।
তারপর আবার সবাই নীরবে তলিয়ে গেলেন চিন্তার অতলে। সবার সেই একটাই চিন্তা কি করে জয় করা যায় মৃত্যুকে। মৃত্যু ভয়কে। তবে এঁদের মধ্যে একজন ব্যতিক্রম, মৃত্যু ভয় তার নেই, মৃত্যুর উর্ধ্বে সে, তার ভয় চারজোড়া চোখ কি করে ফাঁকি দিয়ে কাজ হাসিল করা যায়, সন্দেহ এড়ানো যায়……।
…আমার সন্দেহ আর্মস্ট্রংকেই। ঐ লোকটা আগের চার চারটে খুনের জন্য দায়ী, তবে ব্যাটা অভিনয় ভালই জানে দেখছি। কেমন একটার পর একটা খুন করে, এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন তার কতোই না চিন্তা আমাদের আসন্ন মৃত্যু ভয়ে। কি অদ্ভুত তার চাহনি। ঘোলাটে, উদভ্রান্ত ভাব। এতোগুলো খুন করার পর লোকটা পাগল হয়ে গেলো নাতো। না, না হয়তো এটাও তার একটা অভিনয়। হ্যাঁ, অভিনয় নয় তো কি? ব্যাটা একটা মিট মিটে শয়তান, দাগী খুনী……।
…..খুনী, তুমি যতো চালাকই হও না কেন, আমাকে তুমি বোকা বানিয়ে তোমার কাজ হাসিল করতে পারবে না। হয়তো এখন একটু বেকায়দায় পড়েছি, তবে এর থেকেও আরো বেশি কঠিন বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে এর আগে। সে বিপদ যখন ঠিক কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, তখন কেন অহেতুক ভয় করতে যাবো তোমাকে?, কিন্তু ঐ পিস্তলটা? গেলোই বা কোথায়? নিয়েছে আমাদেরই মধ্যে কেউ একজন, তার ঠিকানা কি, কে বলতে পারে…।
….ওরা সবাই অহেতুক ভয় পাচ্ছে, মৃত্যু ভয় দেখাচ্ছে আমাকে। কিন্তু আমি যে আরো কিছুদিন বাঁচতে চাই, এতো তাড়াতাড়ি মরলে আমরা অনেক কাজই যে অসমাপ্ত থেকে যাবে……..
…..মৃত্যু ভাসে বাতাসে। এখানকার বাতাসে ছড়িয়ে আছে মৃত্যুর বীজ। যে কোনো মুহূর্তে সেই বীজ বপন হতে পারে আমরা শরীরে….
……সহজে কি মৃত্যুকে এড়ানো যাবে? যত সতর্কই হই না কেন, হয়তো মৃত্যুকে ঠেকাতে পারবো না। ঐ শুনি মৃত্যুর পদধ্বনি…….
……এখনো পাঁচটা বাজতে কুড়ি মিনিট। সময় যেন আর কাটতে চায় না। ঘড়িটা কি বন্ধ হয়ে গেছে? না ঐ তো কাঁটাগুলো ঠিকই তো চলছে টিক, টিক, টিক। মৃত্যুর পরোয়ানা জাহির করতে হবে। মাথায় এক সর্বনাশা আগুন জ্বলছে, বুকের ধুকধুকানি। শেষ বিচারের দিন আসন্ন। কেউ সন্দেহ করেনি তো? এ ব্যাপারে নিশ্চিত বলা যায়। তা সত্বেও আরো বেশী সতর্ক হতে হবে। কিন্তু, এর পর কাকে যেতে হবে? বিচারের রায় কার কার বিরুদ্ধে যাবে….
পাঁচটা বাজতেই উঠে দাঁড়ালো ভেরা, চা করতে চললাম।
দাঁড়ান। হাত নেড়ে বললেন ওয়ারগ্রেভ, আমরাও যাবো আপনার সঙ্গে। দেখবো কেমন করে আপনারা চা তৈরী করেন।তারপর নিজের মনেই বললেন তিনি, একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না, সাবধানের মার নেই।
চায়ের আয়োজন হলেও তা না খেয়ে গ্লাসে হুইস্কি ঢাললেন ওয়ারগ্রেভ, ডঃ আর্মস্ট্রং এবং ব্লোর।
ততধিক অন্ধকারের ছায়া নামলো লম্বার্ডের মুখে, রগার্স নেই, জেনারেটার চালানো হয়নি, তার মৃত্যুর পর কারোর খেয়ালও হয়নি।
বসবার ঘরে কয়েকটা মোমবাতি দেখে এসেছি, বললেন ওয়ারগ্রেভ, নিয়ে আসি, ওগুলো দিয়ে কাজ চালানো যাবে আপাতত।
দেখতে দেখতে ছটা কুড়ি বেজে গেলো।
ভেরার কপালে তীব্র যন্ত্রণা। তার মাথায় কেউ যেন একরাশ বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে, বাথরুমে গিয়ে খুব করে মাথায় জল ঢেলে বোঝাটা হাল্কা করার জন্য উঠে দাঁড়ালো ভেরা। সঙ্গে একটা মোমবাতি নিতেও ভুলল না সে।
বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে তার নাকে ভেসে এলো একটা গন্ধ, সমুদ্রের লোনা জলের গন্ধ। তবে কি গোটা সমুদ্রটাই উঠে এলো বাথরুমে, ভেরা ভাবে
তার সেই ভাবনা ছাপিয়ে যেন ভেসে এলো তার কানের কাছে একটি শিশুর কণ্ঠস্বর–আন্টি, আমি সাঁতার কাটবো আমাকে সমুদ্রে নিয়ে চলো। নিয়ে চলো না আমাকে।
পরমুহূর্তেই অনুভব করলো সে, কার যেন নিঃশ্বাসের শব্দ ঠিক ঘাড়ের কাছে। চমকে পিছন ফিরে তাকালো সে, না, কেউ তো নেই। তাহলে তার মনেরই ভুল সমুদ্রের নোনা গন্ধে মনটা কেমন ওলট পালট হয়ে গেছে।
তার মনটা তখনো যেন একটা কাল্পনিক জগতে ভেসে বেড়াচ্ছিল–অশান্ত সমুদ্র ফেনিল নীল জলরাশি, বাতাসে শীতের তীক্ষ্মতা, ঝড়ের দাপটে ঢেউগুলো তীরে এসে জলের স্রোতে ঢুকে পড়েছে বাথরুমে। জলের সেই কলকল শব্দ ছাপিয়ে তার কানে ভেসে আসছে কার যেন পায়ের শব্দটা, ঠিক তার পিছনে এসে থামলোকে হ্যাঁগো তুমি? কিন্তু তুমি তুমি এখানে এলে কি করে হুগো? আমি যে তোমাকে
কিন্তু কে কোথায়? এবারেও আমার দেখার ভুল, শোনার ভুল। হুগো কি করেই বা আসবে এখানে। সে তো এখন আমার কাছে অতীতের স্মৃতি বই আর কিছু নয়। অতীত কি কখনো জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে?
তবু, তবু কেন আমি তোমার হাতের স্পর্শ অনুভব করছি হুগো? আমার পিঠে তোমরা হাত বিলি কাটছে, যেন তুমি আমাকে আদর করছো, তোমার হাতের স্পর্শটা আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ওপরে উঠে আসছে। কিন্তু তোমার হাত তো কখনো লোমশ ছিল না।
হঠাৎ কথাটা মনে হতেই প্রচণ্ড ভয়ে, আতঙ্কে জোরে চিৎকার করে উঠল ভেরা।
তার অতি চিৎকার শুনে ওঁরা তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলেন। লম্বাৰ্ডই প্রথমে লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে ফেললো। অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ে না। বাথরুমে ঢুকে ভেরার উদ্দেশ্যে ডেকে উঠলো সে, আপনি কোথায় মিস্ ভেরা? ভয় নেই, এই তো আমরা এসে গেছি। কি হয়েছে আপনার?
ভেরার হাত থেকে মোমবাতিটা পড়ে গিয়ে নিভে গেছে। অন্ধকারে ডুবে আছে বাথরুম। টর্চের আলো ফেললো লম্বার্ড। মেঝের ওপর থেকে মোমবাতিটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার জ্বালালো। লম্বার্ডের ডাকাডাকিতে এক সময় ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো ভেরা। প্রথমেই তার চোখ পড়লো ছাদের ওপর। আর সঙ্গে সঙ্গে আবার সে আর্তনাদ করে উঠলো, ওটা, ওটা কি?
ভেরার দেখা দেখি তারাও তাকালেন ছাঁদের দিকে–ছাদ থেকে সাপের মতো ঝুলছে একটা সামুদ্রিক শেওলা। আর সেটাই খানিক আগে ভেরার পিঠ স্পর্শ করলে তার মনে হয়ে থাকবে কারোর নোমশ হাত বুঝি।
সেটা বুঝতে পেরেই সহসা উন্মাদিনীর মতো শব্দ করে হাসতে শুরু করে দিলো ভেরা, সমুদ্র ঢুকে পড়েছে বাথরুমে, ঘর ভর্তি নীল জল–
ভেরার অমন অবস্থা দেখে ছুটে গিয়ে নিচ থেকে ব্র্যান্ডির একটা ভোলা বোতল নিয়ে এলেন ব্লোর। এগিয়ে গিয়ে ভেরার মুখের কাছে বোতলের মুখটা তুলে ধরতেই ঝাঁপিয়ে পড়লো লম্বার্ড র ওপর, হ্যাঁচকা টান দিয়ে তার হাত থেকে বোতলটা কেড়ে নিলো সে। কিছুতেই খেতে দেবো না। না, কিছুতেই না।
অনুযোগ করলেন ব্লোর, ব্র্যান্ডিটা সন্দেহ করার কিছু ছিলো না।
কি করে বুঝলেন? প্রশ্ন চোখে তাকালেন আর্মস্ট্রং হয়তো আপনি নন, অন্য কেউ তো বোতলে বিষ মিশিয়ে দিয়ে থাকতে পারে। ওপর থেকে দেখে সেটা বোঝার কি উপায় আছে বলুন?
সেই সময় লম্বার্ড এসে ঢুকলো হাতে তার নতুন একটা ব্র্যান্ডির বোতল। ভেরার চোখের সামনে বোতলটি দেখিয়ে হাসলো সে, দেখে রাখুন, একেবারে ব্র্যান্ড নিউ।
সীলমোহর করা ছিপি খোলা হলো, ঢালা হলো ব্র্যান্ডি একটা গ্লাসে। তারপর গ্লাসটা তুলে ধরা হলো। ভেরার মুখের সামনে। এর চুমুক খেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। তৃষ্ণা মিটে গেছে তার। মুখ থেকে সরে গেছে সেই ভয়ার্ত ভাবটা।
আত্ম বিশ্বাসের হাসি ফুটে উঠলো লম্বার্ডের ঠোঁটে, ভাগ্য ভাল মিস্ ক্লেথর্নের, মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলেন তিনি।
আমার আনা ব্র্যান্ডিটাও কিন্তু ভালো ছিলো বিষমুক্ত, আবার বললেন ব্লোর।
সুস্থ হয়ে ওঠার পরেই কি খেয়াল হলো ভেরার, এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে উঠলো সেও, মিঃ ওয়ারগ্রেভ কোথায়, তাকে তো দেখছি না–কেন?
সত্যিই তো, আমরা সবাই এলাম, কিন্তু তিনি, তিনি এলেন না তো।
বড় ভাবনায় ফেললেন তিনি। চলুন, তাড়াতাড়ি নিচে গিয়ে দেখি, উনি কোথায়, কি করছেন।
এরকম ছুটেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন সবাই। তারপর সোজা হলঘরে, আর্মস্ট্রং প্রথমে তার নাম ধরে ডাকলেন। কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ নেই। আবার ডাকলেন, শুনছেন মিঃ ওয়ারগ্রেভ, কোথায় আপনি? সাড়া দিন। এবারেও কোনো উত্তর নেই।
সবাই তখন ছুটলেন বসবার ঘরে। ঢোকার মুখেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন আর্মস্ট্রং, তীব্র আর্তনাদ করে উঠলেন।
কাছে গিয়ে তার দেখতে হলো না। দূর থেকেই সবাই দেখলেন, চেয়ারে বসা ওয়ারগ্রেভের মাথাটা ঝুলে পড়েছে ডান দিকে। পরনে বিচারকের পোষাক, মাথায় পরচুলা, কপালে ক্ষতচিহ্ন, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝড়ে পড়ছিলো তখনো সেখান থেকে। নিষ্প্রাণ দেহ। পরীক্ষা না করেই বোঝা গেলো, বৃদ্ধ আর জীবিত নেই।
নিয়ম রক্ষার জন্য এগিয়ে গেল ডঃ আর্মস্ট্রং। নিচু হয়ে নাড়ি টিপলেন স্পন্দনহীন। উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন তিনি সব শেষ। গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন তিনি।
গুলি, চমকে উঠে লম্বার্ডের দিকে তাকালেন ব্লোর, তাহলে শেষ পর্যন্ত পিস্তলটার হদিস পাওয়া গেলো।
এবার গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে ওয়ারগ্রেভের মাথা থেকে পরচুলা তুলে নিতে গিয়ে অবাক হলো ভেরা, এ যে দেখছি মিস্ ব্লেন্টের হারানো উল কেটে তৈরী পরচুলা।
আর বুকের ঐ যে আলখাল্লায় আঁটা ফিতেটা দেখতে পাচ্ছেন আপনারা, বললেন ব্লোর, ওটা বাথরুম থেকে উধাও হওয়া পর্দা দিয়ে তৈরী।
মৃত ওয়ারগ্রেভের দিকে তাকিয়ে আপন মনে সেই কবিতাটা থেকে আবৃত্তি করে উঠলো লম্বার্ড, পাঁচটি কালোমানিক গেলো আদালতে দিতে বিচারে মন, একটি গেলো কারাগারে ফিরলো বাকী চারজন।
হ্যাঁ, এই পৃথিবীটাই তো ঈশ্বরের আদালত। বিচারক স্বয়ং ওয়ারগ্রেভই। নিজের এজলাসে তিনি নিজেই মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলেন। ভবিষ্যতে আদালতে তার মুখ থেকে আর কোনো খুনী আসামীর ফাঁসির দণ্ডাদেশ শোনা যাবে না। আজই তার শেষ বিচার, শেষ রায় দেওয়া, যে রায়ে নিজের মৃত্যুবরণ করলেন বিচারক ওয়ারগ্রেভ।
লম্বার্ডের চোখে স্থির দৃষ্টি রাখল ভেরা, অবিশ্বাসের চাহনি, কথায় বিদ্রুপের সুর আজ সকালে আপনি আপনার সন্দেহের কথা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ঐ ওয়ারগ্রেভই নাকি খুনী, উন্মাদ, আগের পাঁচটি খুনের জন্য দায়ী। এর পরেও কি আপনার সেই সন্দেহটা বলবৎ থাকবে মিঃ লম্বার্ড?
.
১৪.
তারা চারজন ধরাধরি করে ওয়ারগ্রেভের মৃতদেহ দোতলায় তুলে নিয়ে এসে তার ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিলো যত্ন সহকারে। সেখান থেকে ফিরে সবাই হলঘরে। আবার সেই আলোচনা–অতঃ কিম–
ওদিকে খিদেও খুব পেয়েছিল সকলের। মুখ-আঁটা চারটে টিনের খাবার আনা হলো রান্নাঘরে থেকে। টিনের মুখ কেটে খেতে শুরু করলেন সবাই। খেতে গিয়ে মন্তব্য করলো ভেরা অদ্যই শেষ রজনী! হয়তো এটাই আমাদের শেষ খাওয়া।
তার মুখের কথাটা লুফে নিয়ে বললেন ব্লোর, কিন্তু আমি, ভাবছি এবার কার পালা?
অনিচ্ছা সত্বেও হাসলেন ডঃ আর্মস্ট্রং, ওসব অলুক্ষণে কথা না বলে আরো বেশী সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করুন আপনারা। সাবধান হলে
তার আসমাপ্ত কথার জের টের এবার ব্লোর তার বক্তব্য রাখলেন, যিনি ছিলেন আমাদের প্রধান পরামর্শদাতা, সব সময় সতর্ক থাকার কথা বলতেন আমাদের, তিনিই আজ অসাবধানতার শিকার হলেন।
কিন্তু কি ভাবে এই এমন একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটলো?
খুব সহজ পথেই। ব্যাখ্যা করলো লম্বার্ড, এ সব খুনীর চালাকী, আগে থেকে বৃদ্ধ ওয়ারগ্রেভের ওপর থেকে আমাদের নজর অন্যত্র ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য ফাঁদ পেতে ছিল সে মিস্ ক্লেথনের বাথরুমে সংলগ্ন ঘরে শেওলা ঝুলিয়ে রেখে। দু-এক দু-চোর এর মত শেওলাটা সাপ ভেবে চিৎকার করে উঠতেই আমরা তার ঘরে ছুটে যাই ওয়ারগ্রেভ ছাড়া, ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম ওয়ারগ্রেভের কথা। তার সুযোগ নেয় আততায়ী তার পূর্ব পরিকল্পিত কাজ হাসিল করে।
তা না হয় হলো, কিন্তু গুলির আওয়াজ? সেটা কেন আমাদের কানে এলো না?
আসবে কি করে? বাইরে তীব্র ঝড়ো বাতাসের আওয়াজের সঙ্গে মিস্ ক্লেথনের চিৎকারের শব্দে গুলির আওয়াজটা চাপা পড়ে যায়।
তা সেই খুনী শয়তানটা আমাদের চারজনের মধ্যে একজন না হয়ে যেতে পারে না, সকলের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে অন্যদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখলেন আর্মস্ট্রং কে, কে হতে পারে সে?
আমি বলতে পারি সবজান্তার হাসি ফুটে উঠতে দেখা গেলো ব্লোরের ঠোঁটে।
আপনি? ভেরার দিকে ফিরে তাকালেন আর্মস্ট্রং আপনি কিছু জানেন মিস্ ক্লেথর্ন?
না, জানি না। ঘাড় নাড়লেন মিস ক্লেথর্ন। এ প্রসঙ্গে আমিও একজনকে আন্দাজ করেছি। কারোর দিকে না তাকিয়েই বললেন আর্মস্ট্রং।
আরো একটু খোলসা করে বললো লম্বার্ড, আর আমি তো একজনকে প্রায় চিহ্নিতই করে ফেলেছি, এখন তাকে হাতে নাতে ধরার যা অপেক্ষা।
মন ভাল নেই ঘুমও পাচ্ছে, উঠে দাঁড়ালো ভেরা, আমি এখন শুতে চললাম।
তারপর একে একে সবাই উঠে পড়লেন। সবার শেষে উঠলেন ডঃ আর্মস্ট্রং, তার কণ্ঠস্বর কেমন যেন ভারী ভারী শোনালো, হ্যাঁ ঘুমের মধ্যেই নিহিত আছে এক অপার শান্তি, অনন্ত সুখের সম্ভাবনা
আর সেই সুখ, সেই শান্তির সন্ধানে নিঃশব্দে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন যে যার ঘরের দিকে।
ভাল করে দরজা বন্ধ করলো লম্বার্ড। ঘরের ভেতর থেকে দরজা ঘেঁষে লোহার চেয়ারটা রাখতে ভুললো না, দরজা ভাঙ্গতে গেলে লোহার চেয়ারে আওয়াজ হতে বাধ্য, আর তাহলেই তার ঘুম ভেঙ্গে যাবে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবতে বসলো সে। এ এক উটকো ঝামেলায় পড়া গেলো। দুদিনে ভয়ে আতঙ্কে শরীরটা যেন একেবারে পঙ্গু হয়ে গেছে। এর শেষ কোথায় দেখা যাক।
পোষাক বদল করে বিছানায় শুতে যাবে, হঠাৎ পলঙ্ক সংলগ্ন টেবিলের ড্রয়ারের দিকে তার চোখ পড়তেই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো লম্বার্ড অনেকক্ষণ, অবিশ্বাস্য। ড্রয়ারের বাঁদিকে পড়ে রয়েছে তার হারানো পিস্তলটা……..সেই মুহূর্তে তার চোখ থেকে উধাও হয়ে গেলো রাতের ঘুম।
ওদিকে ভেরার চোখে ঘুম নেই। মোমের আলোর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে ভাবছে সে এখন, এখানে মৃত্যুর হাওয়া, নিঃশ্বাসে বিষ, দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম, তবু এরই মধ্যে রাতটুকুই যা নিরাপদ। চার দেওয়ালের এই নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে একবার ঢুকে পড়তে পারলেই হলো, এখানে মৃত্যুর পদধ্বনি শোনা যাবে না, বিষ মুক্ত বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। এখন অন্ধকারই ভাল লাগে, বেশী নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে একবার ঢুকে পড়তে পারলেই হলো, এখানে মৃত্যুর পদধ্বনি শোনা যাবে না, বিষ বেশী নিরাপদ বলে মনে হয়। এখন আলো দেখলেই আতঙ্কে বুক কাঁপে, বাইরে বেরুলে আলোয় গায়ে কাঁটা দেয় এক অজানা ভয়ে।
মোমের এই সামান্য আলোটুকু এখন আমার চোখে যেন একটা নরম উয় স্পর্শে রাখে, ভাল লাগে সেই অনুভূতিটা, ভুলে থাকা যায় অতীতের সেই কলঙ্কময় স্মৃতি। স্বল্প হলেও মোমের আলোয় আলোকিত ঘরখানি, সে আলোয় স্পষ্ট ঘরের সব কিছু দেখা যাচ্ছে, দরজা জানালা, আসবাবপত্র, সব কিছুই। এক এক করে দৃষ্টি পরিক্রমা শেষে তার চোখ গিয়ে বিদ্ধ হয় ছালের ওপর। আর তখনি তার আর এক দফা চমকানোর পালা–আরে ওটা কি সত্যিই সাপ নাকি?
কিন্তু ভালো করে তাকাতে গিয়ে দেখা গেলো ওটা সাপ নয়, লোহার হুক। ঐ হুকে পাখা ঝুলানো হয়। কিন্তু কি ব্যাপার, এর আগে ওটা তো চোখে পড়েনি একবারও, আর আজই বা হঠাৎ দৃষ্টিগোচর হলো কেন।
আর হুকটাই বা এলো কোথা থেকে? হুকের তো মানুষের মতো হাত পা নেই। নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে কেউ না কেউ ওটা লাগিয়ে থাকবে। কিন্তু কি উদ্দেশেই বা…
শত চেষ্টা সত্বেও ঘুমের সঙ্গে আর বোঝাপড়া হলো না ব্লোরেরও, তবে চার দেওয়ালের বন্ধ ঘরে অনেক বেশী নিরাপদ বলে মনে করলেন তিনি।
নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি এবার ভাবতে বসলেন ওয়ারগ্রেভের কথা। লোকটার ওপর অনেক অভিশাপ ছিলো, তার মৃত্যুতে কারোর কোনো দুঃখ থাকার কথা নয়, আপদ গেছে। অনেক লোককে বিচারের নামে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছে সে, মরে সে তার পাপের পায়শ্চিত্ত করেছে।
পিস্তলটাই বা গেলো কোথায়? সেই পিস্তলই দিয়েই কি ওয়ারগ্রেভের কপাল ফুটা করা হয়েছে। যাই হোক ওয়ারগ্রেভের আততায়ীই যে পিস্তল চুরি করেছিলো, তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই।
তাঁর ভাবনায় বাধা পড়লো ঢং ঢং করে পেটা ঘড়িতে বারোটার আওয়াজ হতে। তার মানে সকাল হতে এখনো ছ ঘণ্টা বাকী। এই ছ ঘণ্টা নিশ্চিন্তে কাটানো যাবে। সকাল হলেই তো আবার মৃত্যু ভয়।
অযথা মোমাবতিটা পুড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কাল যদি বেঁচে থাকি, যদি মৃত্যু আমাকে স্পর্শ না করে, কিংবা আমার প্রতি করুণা করে আর একটা দিন বেঁচে থাকার অনুমতি দেয়, তাহলে কাল রাতে আবার মোমবাতির প্রয়োজন হবে। কথাটা ভাবা মাত্র ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিলেন ব্লোর। ঘরের মধ্যে এক বুক অন্ধকার নেমে এলো। ছায়া ঘন অন্ধকার।
সেই আলো আঁধারিতে মনে হলো কারা যেন ঘরের মধ্যে চলা ফেরা করছে। ওরা কারা? এসে দেখছি মিসেস রগার্স আর মাস্টার্ন। বাঃ কি ভাবে দুজনে কেমন হাত ধরাধরি করে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গিয়ে মিলিয়ে গেলো দেওয়ালের সঙ্গে। আচ্ছা, ওরা কি বুঝতে পেরেছে, আমি জেগে আছি, ওদের অমন সহজ সাবলীল ভঙ্গিমা দেখে আমি অবাক হয়েছি? আর সেই জন্যই কি লজ্জা পেয়ে মুখ লুকালো ওরা। কি জানে–
কিন্তু তুমি আবার কে এসে হাজির হলে বাপু? আমার দিকে একবার মুখ ফেরাও দেখি, দেখি তোমার মুখখানি, আমার নয়ন সার্থক করি।
আমার কথা শুনলো সে, সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফেরালো আমার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলাম। ল্যান্ডার তুমি? কিন্তু তুমি এখানে এলে কি করে। তুমি তো আমার কাছে অতীত এখন, অতীতের পুরনো ইতিহাস। তুমি কি সেই ইতিহাসের পাঠ শেখাতে এসেছে আমাকে? বলো, তাড়াতাড়ি বল কি বলতে চাও। আমার সময় বড় অল্প। এখানে এখন মৃত্যুর হাওয়া বইছে, সে কোনো মুহূর্তে খুন হয়ে যেতে পারি আমি। অতএব
কি বললে? তোমার স্ত্রী পুত্রের খবর নিতে ছুটে এসেছে আমার কাছে। তুমি আর লোক পেলে না। ওদের খবর আমি রাখতে যাবো কেন? দেখ গিয়ে এতদিনে হয়তো তাদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে।
কিন্তু পিস্তলটা গেলো কোথায়? কে কে নিতে পারে সেটা?
ছেদ পড়ল তার ভাবনায়। হঠাৎ কান খাড়া হয়ে উঠলো তার। এক জোড়া পায়ের শব্দ হেঁটে বেড়াচ্ছে বারান্দায়, অতি সন্তপণে পা ফেলছে। কিন্তু এতো রাত্রে কার এমন দুঃসাহস হলো ঘরের বাইরে বেরুবার? তবে কি সেই খুনীটা হা, খুনীই নিশ্চয়। তার আবার মৃত্যুভয় কিসের।
একসময় সেই ভুতুড়ে শব্দটা থামলো। তবু কান পেতে রইলেন ব্লোর। না আর কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না, শুধু বাতাসের দাপাদাপি, সেই ঝড়ো বাতাসের হাওয়া লেগে থাকবে প্রাসাদের কোনো ঘরে। দরজার পাল্লা, পালা করে একবার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে।
তারপরেই আবার শোনা গেল একটা শব্দ। এবার যেন আগের চেয়ে অনেক ধীরে, পায়ের আওয়াজ অনেক মৃদু। শব্দটা যেন আর্মস্ট্রং এর ঘরে, লম্বার্ডের ঘর পেরিয়ে থামলো আমার ঘরের সামনে এসে। তাহলে
নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে দ্রুত হাতে দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন ব্লোর। চারদিকে সন্ধানী দৃষ্টি বোলালেন, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়লো না। তবে এবার মনে হলো, শব্দটা নিচের হলঘর পেরিয়ে প্রাসাদের প্রধান গেটের দিকে এগুচ্ছো। নিচে নামতে গিয়েও নামলেন না তিনি। কে জানে, তাকে ঘর থেকে টেনে বার করে আনার জন্য খুনীর এটা একটা চাল কিনা। যাই হোক। তার দৃষ্টি এখন ঘাটের দিকে। হঠাৎ তিনি যেন দেখতে পেলেন, গেট পেরিয়ে কে যেন ছুটে প্রাসাদের বাইরে পালিয়ে গেলো। হুঁশ হলো ক্লোরের। এখন আর চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই সব অদ্ভুত কাণ্ডখারখানা একা একা দেখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এখন একটা কিছু করা দরকার। হয়তো এখুনি ছুটে গেলে আগন্তুক তথা আততায়ীকে খুঁজে বার করা যেতে পারে। খুব বেশী দূরে যেতে পারেনি বলেই মনে হয়।
ছুটে গেলেন তিনি আর্মস্ট্রং-এর ঘরের সামনে। জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা মারলেন তিনি, তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর রাত্রির নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়লো–শুনছেন মিঃ আর্মস্ট্রং। আপনি যদি ঘরে থাকেন তো একেবারের জন্য বাইরে বেরিয়ে আসুন।
উত্তর নেই আর্মস্ট্রং এর।
দ্বিতীয়বার ডাকলেন, তৃতীয় বারেও কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। আর নয়, এবার তিনি ছুটে চললেন লম্বার্ডের ঘরে। জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিলেন। দরজা খুলে গেলো। লম্বার্ডকে দরজার ওপারে দেখতে পেয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলেন ব্লোর, অনেক ডাকলুম, কিন্তু আর্মস্ট্রংকে ঘরে পেলাম না। একটা ব্যবস্থা নিতে হয়, বাইরে আসুন আলোচনা করা যাক।
বাইরের পোষাক গায়ে চাপিয়ে একটু পরেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো লম্বার্ড।
পাশের ঘরটা ভেরার। দরজায় একবার মাত্র ধাক্কা দিতেই সাড়া মিললো। নিচু গলায় তাকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য বললেন ব্লোর, ঘর থেকে একদম বেরুবেন না মিস্ ক্লেথর্ন। সাবধান। সাবধান। যে কোনো মুহূর্তে খুনী আমাদের খতম করে দিতে পারে।
চলুন, এবার আর্মস্ট্রং এর ঘরের দিকে যাওয়া যাক, বলেই ছুটলেন ব্লোর, তার পিছু পিছু লম্বার্ড।
চলতি পথেই ব্লোরের মুখ থেকে সংক্ষেপে আর্মস্ট্রং এর সম্পর্কে সব শুনে লম্বার্ড বলে, তাহলে এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, আর্মস্ট্রংই এই খুনের নাটকের নায়ক, না ভিলেন বলা উচিৎ।
হ্যাঁ না কিছুই বললেন না ব্লোর। চুপ রইলেন।
আর্মস্ট্রং-এর ঘরের সামনে এসে থামলেন তারা। ঘর তখনো বন্ধ। তালায় চাবি ঝুলছে না দেখে তারা ধরে নিলেন, চাবি তিনি সঙ্গে নিয়ে গেছেন। এখন তাকে খুঁজে বার করতে হবে। প্রাসাদের বাইরে যাওয়ার আগে ক্লোরের উদ্দেশ্যে বললল লম্বার্ড, একটু অপেক্ষা করুন, আমি ততক্ষণে মিস ক্লেথনকে সাবধান করে দিয়ে আসি আর একবার।
ভেরার ঘরের সামনে এসে গলা চড়ালো লম্বার্ড, শুনুন মিস ক্লেথর্ন, আমরা এখন বেরুচ্ছি আর্মস্ট্রং এর খোঁজে। তাই আপনাকে সাবধান করে দিয়ে যাচ্ছি, কেউ ডাকলে দরজা খুলবেন না যেন। এমন কি আমাদের দুজনের মধ্যে একটা আলাদা করে কেউ ডাকলেও নয়। তবে আমরা যখন দুজেন এক সঙ্গে ডাকবো, তখনি কেবল খুলবেন। মনে থাকবে তো?
হুঁ।
চলুন এবার যাওয়া যাক, ক্লোরের উদ্দেশ্যে বললল লম্বার্ড।
যাবো বললেই হলো, একটু ইতস্ততঃ করলেন ব্লোর, পিস্তলটা তো ওঁর কাছেই আছে।
পিস্তলের জন্য চিন্তা করবেন না। ওটা এখন আমার কাছেই আছে। শুতে যাওয়ার সময় ওটা টেবিলের ড্রয়ারের সামনে আবিষ্কার করি।
সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ালেন ব্লোর, আমি আপনার সাথী হবো না।
সাথী হবেন না কেন? মুখ বিকৃত করে বলে উঠলো লম্বার্ড ভেবেছেন আমি আপনাকে গুলি করে মারবো? মোটেই না। জেনে রাখুন আপনার মতো একটা মাথা মোটা লোককে মারবার জন্য পিস্তলের প্রয়োজন হয় না। আর ন্যাকামো না করে চলুন এবার। বেশী দেরী হয়ে গেলে তাকে আর ধরা যাবে না।
দ্বিধা ভাব কেটে গেলো ব্লোরের। অনুগতের মতো লম্বার্ডের পিছু পিছু প্রাসাদের গেট পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। বাইরে তখন ঘোর অন্ধকার।
অনেকক্ষণ হলো ওঁরা বাইরে গেছেন অথচ এখনো ফেরার নাম নেই। দোটানায় পড়ে অধৈর্য হয়ে উঠলো ভেরা। অহেতুক ঘরের মধ্যে পায়চারি করলো বার কয়েক। জানালার পাল্লা সামান্য একটু টেনে চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো সে একবার, না কেউ কোথাও নেই। নিশ্চিন্ত হলো, শক্ত কাঠের দরজা। আর্মস্ট্রং এর মধ্যে সেই দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢোকে।
কিন্তু ওঁরাই বা এখনো ফিরছেন না কেন। রাতের অন্ধকারে গেলেনই বা কোথায়?
ঝন ঝন করে নিচে কাঁচ ভাগার শব্দে ভেরার চিন্তায় বাধা পড়লো। এক অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠলো সে। তার একটু আগের সব সাহস যেন নিমেষে হারিয়ে গেলো। এতো বড় প্রাসাদে সে এখন একা। যদি খুনী এসে এখন তাকে……
হ্যাঁ, ঐ তো কে যেন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে, মৃদু পায়ের শব্দ। ঐ আসছে, কে ও …..। শব্দটা বন্ধ হয়ে গেলো। তাহলে আমার শোনার ভুল
না, ঠিকই শুনেছি। ঐ তো আবার সেই পায়ের শব্দ। এবার আগের থেকে একটু জোরালো সেই সঙ্গে দুজনের কথোপকথনও ভেসে এলো। তার মানে একজন নয় দুজন আসছে। দরজার কাছে এসে থামলো দুজোড়া পায়ের শব্দ।
শুনছেন মিস ক্লেথর্ন? ঐ তো লম্বার্ডের কণ্ঠস্বর, আমরা ফিরে এসেছি।
তাড়াতাড়ি দরজা খুলুন। এবার বললেন ব্লোর, সাংঘাতিক ব্যাপার।
চটজলদি দরজা খুলে পালা করে দুজনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ভেরা, কি দেখলেন বলুন।
আর্মস্ট্রং বেপাত্তা, জবাব দিলো লম্বার্ড হাওয়ার মিলিয়ে গেছেন তিনি।
অসম্ভব। প্রতিবাদ করে উঠলো ভেরা, দেখুন গিয়ে কোথাও না কোথাও তিনি ঠিক লুকিয়ে আছেন।
সারা দ্বীপ আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি, কোথাও তার চিহ্নটি আমরা দেখতে পাই নি।
এমনো তো হতে পারে ভেরা বলে আপনারা বেরিয়ে যাবার পরেই ফিরে এসেছেন এই প্রাসাদে। এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছেন।
না, সে সম্ভাবনার কথাও বাতিল করে দিতে হচ্ছে। এ প্রাসাদের সব জায়গাই আমাদের দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু কোথাও নেই তিনি।
জানি না বাপু, ভুতুড়ে প্রাসাদ, এখানকার কোনো ব্যাপারেই আমার বিশ্বাস হয় না।
বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে শুনুন, খাবার ঘরের একটা শার্সি ভেঙ্গে চুরমার। আর
কি?
আর কি?
খাবার ঘরের আলমারির ভেতরে রাখা চারটের বদলে এখন পুতুল রয়েছে মোট তিনটে।
সেই কবিতাটির কথা যেন মনে পড়িয়ে দেয়—
চারটি কালো মানিক সাগর জলে
নাচে ধিন্ ধিন,
একটি গেলো সিন্ধু পাখির পেটে
ফিরলো বাকী তিন।