অর্জ্জুন কহেন, শুন পূর্ব্বের কাহিনী।
তপস্যা করিতে যবে গেল খগমণি।।
করিয়া কঠোর তপ বিষ্ণু আরাধিল।
মনোনীত বর পেয়ে নিবর্ত্তি আসিল।।
ঋষ্যমূক পর্ব্বতেতে আসে খগেশ্বর।
ঋষ্য নামে রাজা সেই গিরির ঈশ্বর।।
তার ভার্য্যা রূপবতী পরমা সুন্দরী।
সদা স্বামীসেবা করে পুত্র বাঞ্ছা করি।।
কতদিনে অপুত্রক মরে নরপতি।
স্বামীশোক শোকাকুলা ভার্য্যা গুণবতী।।
একাকিনী বনমধ্যে করেন ক্রন্দন।
ক্রন্দনের শব্দ শুনি বিনতা-নন্দন।।
কামরূপী বিহঙ্গম নানা মায়া জানে।
ধরিয়া মনুষ্যরূপ গেল তার স্থানে।।
দিব্যরূপে হইলেন দেবের লক্ষণ।
দেখি কামিনীর রূপ মোহে সেইক্ষণ।।
দৈব্যের নিবর্বন্ধ কভু না যায় খণ্ডন।
দেখিয়া কন্যার রূপ বিনতা-নন্দন।।
মদন মোহন বাণে হয়ে জর জর।
কন্যারে কহিল তবে বিনয় উত্তর।।
একাকী রোদন কর কিসের কারণ।
কার কন্যা তুমি, তব পতি কোন্ জন।।
নিজ পরিচয় মোরে কহ সুবদনি।
এত শুনি কহে কন্যা যুড়ি দুই পাণি।।
যক্ষবংশে জন্ম মম বিখ্যাত ভুবনে।
ঋষ্য নামে রাজা ছিল এইত কাননে।।
পুত্রবাঞ্ছা করি তপ করিল রাজন।
পুত্র না হইল, তাঁর হইল মরণ।।
রাজা হয়ে রাজ্য রাখে, বংশে কেহ নাই।
দুঃখানলে পুড়ে মন, কাঁদি আমি তাই।।
গরুড় কহিল, শোক না কর অন্তরে।
আজি জন্মাইব পুত্র তোমার উদরে।।
তোমাকে দেখিয়া মন মজিল আমার।
কামানলে দহে অঙ্গ করহ উদ্ধার।।
এত শুনি কহে কন্যা করি যোড়পাণি।
কৃপা যদি কৈলে তবে শুন খগমণি।।
শত পুত্র দান দেহ তোমার ঔরসে।
মহাবলবন্ত যেন হয়ত বিশেষে।।
কন্যার বচনে খগ অঙ্গীকার কৈল।
দ্বাদশ বৎসর ক্রীড়া আনন্দে করিল।।
কতদিনে ঋতুযোগে হৈল গর্ভবতী।
এককালে শত ডিম্ব প্রসবিলা সতী।।
সুশীলা নামেতে তার আছিল সতিনী।
সেবাবশে পরিতুষ্ট হয়ে খগমণি।।
স্বধর্ম্ম বুঝিয়া তারে করিল রমণ।
ঋতুযোগে গর্ভবতী হৈল সেইক্ষণ।।
দুইগুটি ডিম্ব সেই কন্যা প্রসবিল।
কত দিনে ডিম্ব দুটি ফুটিয়া উঠিল।।
সুশীলার গর্ভে হৈল যুগল নন্দন।
একজন অন্ধ হৈল দৈব নিবন্ধন।।
অন্ধক বলিয়া নাম রাখিল তাহার।
মহাবলবন্ত হৈল দ্বিতীয় কুমার।।
মনষ্যের প্রায়, যেন পক্ষীর আকৃতি।
জটায়ু তাহার নাম রাখে খগপতি।।
রূপবতী পুত্র হৈল মহাবলধর।
তেজঃপুঞ্জ সুগঠন পরম সুন্দর।।
প্রধান পুত্রের নাম রাখিল কুবল।
তারে রাজা করিল গরুড় মহাবল।।
ছত্রদণ্ড দিয়া তারে স্থাপিলা রাজ্যেতে।
কত দিনে গেল পক্ষী সুমেরু পর্ব্বতে।।
পবনের সহ তথা বিবাদ হইল।
বহুকাল খগেশ্বর তথায় রহিল।।
হেথা সব নাগগণ পেয়ে অবসর।
ঋষ্যমূক পর্ব্বতেতে আসিয়া সত্বর।।
কুবল পক্ষীর রাজা, গরুর কোঙর।
তার সঙ্গে যুদ্ধ হৈল শতেক বৎসর।।
শত ভাই সহ তারে করিল সংহার।
দেখিয়া অন্ধক পক্ষী করিল বিচার।।
ভ্রাতৃসহ নিল নাগগণের শরণ।
অভয় তাহারে দিল যত নাগগণ।।
অন্ধকেরে রাজা করি স্থাপিয়া রাজ্যেতে।
স্বগণ সহিত নাগ গেল পাতালেতে।।
কতদিনে খগেশ্বর আসিল তথায়।
পুত্রগণ মৃত্যু শুনি ক্রোধে কম্পকায়।।
সেই দোষে মারে বীর বহু নাগগণে।
ব্রহ্মা আসি শান্ত কৈল বিনতা-নন্দনে।।
জটায়ু ধার্ম্মিক হৈল তপস্বী আচার।
তাহার ঔরসে হৈল যুগল কুমার।।
শুক সারি নাম রাখে পক্ষীর প্রধান।
পরম সুন্দর হৈল মহাবলবান।।
অন্ধক-ঔরসে হৈল সহস্র কুমার।
মহাবলবন্ত হৈল, পক্ষীর আকার।।
প্রথম পুত্রের নাম বাতাপি রাখিল।
শুভক্ষণ দেখি তারে রাজ্যপথ দিল।।
মহাবলবন্ত হৈল পক্ষীর প্রধান।
গরুড়-বংশের কথা অদ্ভূত আখ্যান।।
কোটি কোটি পক্ষী জন্মে তাহার ঔরসে।
সব জ্ঞাতিগণে পালে ধর্ম্ম-উপদেশে।।
অন্তরে কপট তার, কেহ নাহি জানে।
মহাবুদ্ধিমন্ত বলি সবে তারে মানে।।
চিন্তিয়া বাতাপি পক্ষী বলে মহাবলী।
সব নাগগণ সঙ্গে করিয়া মিতালি।।
তাহার আশ্বাসে মুগ্ধ নাগরাজ-বংশে।
নিরন্তর বলে ছলে পক্ষিগণে-হিংসে।।
শুক-সারি দুই ভাই ছিল বুদ্ধিমন্ত।
জানিল বাতালি পক্ষী জ্ঞাতিগণ অন্ত।।
এতেক চিন্তিয়া দোঁহে সত্বরে চলিল।
হিমাদ্রির তটে গিয়া তব আরম্ভিল।।
করিয়া কঠোর তপ পূজি পঞ্চাননে।
মনোনীত বর পেয়ে ভাই দুই জনে।।
আসিয়া সকল শত্রু করিল বিনাশ।
কহিলাম তোমারে এ পক্ষী ইতিহাস।।
সেইরূপ ধৃতরাষ্ট্র করে আচরণ।
মুহূর্ত্তেকে সবংশেতে হইবে নিধন।।
অহিংসকে হিংসে যেই, দৈবে তারে হিংসে।
তার দোষে বাতি দিতে না থাকিবে বংশে।।
সঞ্জয় এতেক শুনি হৈল হৃষ্টমন।
কহিতে লাগিল পরে অন্য সর্ব্ব জন।।
সহদেবও নকুল বিরাট নৃপতি।
শিখণ্ডী, দ্রুপদ, ধৃষ্টদ্যুন্ন মহামতি।।
কহিবে অন্ধেরে আমা সবা নিবেদন।
সম্প্রীতে ছাড়িয়া রাজ্য দেহ তা রাজন।।
সম্প্রীতে না দিলে দুঃখ পাইবে পশ্চাতে।
সবংশে মজিবে রাজা, কহিনু নিশ্চিতে।।
এরূপে কহিল তথা যত বীরগণ।
সবারে সম্ভাষি তবে সূতের নন্দন।।
মেলানি মাগিয়া ধর্ম্মে আরাহিয়া রথে।
গিয়া সব নিবেদিল অন্ধের সাক্ষাতে।।
শুনিয়া নৃপতি নাহি নহে ভাল মন্দ।
চিত্তেতে আকুল হয়ে সদা ভাবে অন্ধ।।
নমো প্রভু নীলমণি বনমালাধারী।
নমো ব্রহ্ম-অবতার দারুরূপ হরি।।
দারুরূপে পূর্ণব্রহ্ম নীলাচলে বাস।
তাঁহার চরণ চিন্তি কহে কাশীদাস।।