১০. বাই ভার্বালটি তীক্ষ্ণ শব্দ

বাই ভার্বালটি তীক্ষ্ণ শব্দ করে বসতিটির উপর দিয়ে একবার ঘুরে যায়। আমি দেখতে পাই বেশ কিছু মানুষ খোলা জায়গাটিতে জড়ো হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আমাকে লক্ষ করছে। আমি বাই ভার্বালটিকে সাবধানে নিচে নামিয়ে আনতেই অনেক মানুষ আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। তাদের চোখে এক ধরনের অবিশ্বাস্য বিস্ময়। আমি এবং আমার পিছু পিছু ক্রিশি বাই ভার্বাল থেকে নিচে নেমে এলাম লোকগুলো সাথে সাথে এক পা পিছিয়ে যায় তাদের চোখে হঠাৎ এক ধরনের আতঙ্ক এসে ভর করেছে।

আমি গলার স্বর যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম, আমার নাম কুশান।

আমাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো কোনো কথা বলল না। চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমি আবার সহজ গলায় বললাম, আমি এসেছি টিয়ারাকে উদ্ধার করতে।

মানুষগুলো চমকে উঠে আমার দিকে তাকায়। আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, পারব কি না জানি না। কিন্তু চেষ্টা তো করে দেখতে হবে। কী বল?

কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু কমবয়সী একজন ছেলে উৎসাহে চোখ উজ্জ্বল করে মাথা নাড়তে থাকে। ঘিরে থাকা মানুষগুলোর মাঝে থেকে অসুখী চেহারার একজন মানুষ। হঠাৎ এগিয়ে এসে বলল, তুমি কেমন করে টিয়ারাকে উদ্ধার করবে? তাকে সিলাকিত করে রাখা হয়েছে।

আমি জানি।

তা হলে? তুমি কেমন করে উদ্ধার করবে?

আমি এখনো জানি না।

লোকটি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সমস্ত সর্বনাশের মূল। টিয়ারা আমাকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেবে বলেছিল। আমরা ভ্রূণ ব্যাংক থেকে একটা শিশু নিতে পারতাম। তোমার জন্যে সবকিছু গোলমাল হয়ে গেছে। তোমার জন্যে।

আমার জন্যে?

হ্যাঁ।

লোকটি, যার নাম নিশ্চয়ই ক্লিচি–গলা উঁচু করে বলল, তোমাকে আমি ঘৃণা করি। ঘৃণা।

তুমি যদি সত্যি কাউকে ঘৃণা করতে চাও তাহলে সেটা হওয়া উচিত গ্রুস্টান। এই পৃথিবী ধ্বংস করেছে গ্রুস্টান তুমি সেটা জান?

আমার কথা শেষ হবার আগেই আমি দেখতে পেলাম দুজন প্রতিরক্ষা রবোট আমার দিকে ছুটে আসছে। আমাকে ঘিরে থাকা মানুষেরা সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দিল।

একটি রবোট আমার খুব কাছে দাঁড়িয়ে বলল, মহামান্য কুশান, আমরা আপনাকে নিতে এসেছি।

কোথায়?

মহামান্য গ্রুস্টানের কাছে।

আমাকে একটু সময় দাও, আমি কথা বলছি।

আমরা খুব দুঃখিত। আপনাকে এই মুহূর্তে নিয়ে যাওয়ার কথা।

আমি পিছনে ফিরে তাকালাম এবং কিছু বোঝার আগেই ঘাড়ের কাছে একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করি। জ্ঞান হারানোর আগে দেখতে পাই ক্রিশি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

.

আমি যখন চোখ খুলে তাকালাম তখন চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। এই অন্ধকার এত ভয়ঙ্কর যে আমি বেশিক্ষণ চোখ খুলে তাকিয়ে থাকতে পারি না। এক সময় চোখ বন্ধ করে ফেলি। চারদিকে এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ্য। এই ধরনের নৈঃশব্দ্য আমি আগে কখনো অনুভব করি নি, আমি আমার নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাই না। আমি কান পেতে থেকেও আমার হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাই না। আমি কি বেঁচে আছি?

আমি আবার চোখ খুলে তাকালাম, কী ভয়ঙ্কর অন্ধকার। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। একটু আলোর জন্যে আমার সমস্ত চেতনা যেন বুভুক্ষু হয়ে থাকে, কিন্তু কোথাও কোনো আলো নেই। শুধু অন্ধকার, কঠিন নিষ্করুণ অন্ধকার। আমি হাত দিয়ে নিজেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করি কিন্তু নিজেকে খুঁজে পাই না। কোথায় আমার দেহ? আমার হাত পা মুখ? কোথায় আমার চোখ? আমার নাক কান বুক? আমি কোথায়? ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো এক ধরনের আতঙ্কে আমার চেতনা শিউরে শিউরে ওঠে, আমি চিৎকার করে উঠতে চাই কিন্তু কোথাও এতটুকু শব্দ হয় না। এই তাহলে সিলাকিত? আমি আছি কিন্তু আমি নেই? অস্তিত্বহীন একজন মানুষ? শুধু তার অনুভূতি? তার যন্ত্রণা? কতকাল আমাকে এভাবে থাকতে হবে? কতকাল?

আমি অন্ধকারে অস্তিত্বহীন হয়ে এক বিচিত্র শূন্যতায় ভেসে থাকি। সেই শূন্যতার কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই। কতকাল কেটে যায় আমি জানি না। দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার অনুভূতি নেই, শুধু এক বিশাল শূন্যতা। এক সময় সেই শূন্যতাও যেন অন্য এক শূন্যতায় মিলিয়ে যেতে থাকে। আমি নিজেকে ধরে রাখতে চাই কিন্তু ধরে রাখতে পারি না, এক অন্ধকার অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকি।

খুব ধীরে ধীরে আবার আমার জ্ঞান ফিরে আসে। আমার চোখ খুলতে ভয় হয় আবার যদি সেই ভয়ঙ্কর অন্ধকার এসে আমাকে গ্রাস করে ফেলে? আমি হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ শুনতে পেলাম, আমার নিশ্বাসের শব্দ। আমি তাহলে বেঁচে আছি? আমি চোখ খুলে তাকালাম, চারদিকে খুব হালকা বেগুনি রঙের একটা আলো। আমি নিজের দিকে তাকালাম, এই তো আমার শরীর। আমার হাত পা দেহ। আমার মুখ। আমার চোখ কান চুল।

আমি নিজেকে স্পর্শ করি, সাথে সাথে আমার সারা শরীর শিউরে ওঠে। এটি আমার শরীর নয়। আমি আবার ভালো করে তাকালাম এটি আমার সিলাকিত দেহ। আমার মস্তিষ্কের তথ্য ব্যবহার করে তৈরি করা এক কাল্পনিক অবয়ব। আমি চারদিকে ঘুরে তাকাই কোথাও কেউ নেই। গ্রুস্টানের কাল্পনিক জগতে আমি একা।

আমি উঠে দাঁড়ালাম, কী বিচিত্র অনুভূতি, মনে হয় মহাকাশে ভেসে আছি। আমি আছি কিন্তু তবু আমি নেই। আমি নিচু গলায় ডাকলাম, কে আছ এখানে?

আমার কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল, কিন্তু কেউ উত্তর দিল না। আমি আবার ডাকলাম, কে আছ?

খুব কাছে থেকে কে যেন বলল, কী চাও তুমি?

আমি চমকে উঠি, কে?

আমি। আমি গ্রুস্টান।

তুমি কোথায়?

আমি সর্বত্র। তোমার চারপাশে। তোমার ভিতরে।

আমি তোমাকে দেখতে চাই।

কেন?

কাউকে না দেখে আমি তার সাথে কথা বলে পারি না। আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।

তুমি আমার সাথে কী কথা বলবে? আমি তোমার মস্তিষ্কের সব তথ্য বের করে নিয়ে আসতে পারি। তুমি কী ভাবছ আমি সব জেনে নিতে পারি।

কিন্তু আমি নিজে থেকে তোমাকে বলতে চাই।

কী বলতে চাও?

খুব জরুরি একটা কথা বলতে চাই। আমি তাই নিজে থেকে তোমার কাছে এসেছি।

বল।

তার আগে আমি তোমাকে দেখতে চাই। তুমি আমার সামনে দেখা দাও।

খুব ধীরে ধীরে গ্রুস্টানের চেহারা সৃষ্টি হতে থাকে। হালকা সবুজ রঙের দেহ একই সাথে মানব এবং মানবী। একই সাথে কোমল এবং নিষ্ঠুর। গ্রুস্টান আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাও?

এখন দিন না রাত?

রাত। কেন?

তুমি কখন আমাকে সিলাকিত করেছ? দশ ঘণ্টা কি হয়ে গেছে?

এখনো হয় নি। কেন?

তুমি আমার মস্তিষ্কের তথ্যে উঁকি দিলে জানতে। দশ ঘণ্টার মাঝে তোমার ক্ষমতাকে আমরা অর্ধেক করে দেব।

গ্রুস্টান কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকে। নিশ্চয়ই সে আমার কথার সত্যতা যাচাই করে দেখছে। দেখতে দেখতে তার চেহারা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তার সমস্ত দেহ লাল হয়ে কুৎসিত একটি রূপ নিয়ে নেয়। সে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে আঘাত করে, প্রচও যন্ত্রণায়। আমি ছিটকে পড়ি। এটি শারীরিক যন্ত্রণা নয়, যন্ত্রণার অনুভূতি। শরীরকে পাশ কাটিয়ে মস্তিষ্কে দেয়া যন্ত্রণার এক তীব্র অনুভূতি। গ্রুস্টান আমার কাছে ঝুঁকে পড়ে হিসহিস করে বলল, নির্বোধ মানুষ! আমার ক্ষমতা অর্ধেক করে দেয়া হলে কী হবে জান? তোমার অস্তিত্ব ধ্বংস হবে সবার আগে। তুমি বেঁচে আছ কারণ আমি বেঁচে আছি। আমার অস্তিত্বে আঘাত করে তুমি বেঁচে থাকবে না। গ্রুস্টান আমার দিকে এগিয়ে আসে আর ঠিক তখন খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল। গ্রুস্টানের সমস্ত দেহ যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে থাকে। ভয়ঙ্কর চিৎকার করে সে তার নিজেকে ধরে রাখতে চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই যেন আর স্থির হয়ে থাকতে চায় না।

আমি হঠাৎ করে বুকের ভিতরে এক প্রচণ্ড চাপ অনুভব করি। আমার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে, আমার সিলাকিত দেহ থরথর করে কেঁপে ওঠে। আমি গ্রুস্টানের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম, তোমার নেটওয়ার্ক দু ভাগে ভাগ করে ফেলেছে গ্রুস্টান। তুমি আর কোনোদিন তোমার আগের ক্ষমতা ফিরে পাবে না–

আমি কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণায় এক অন্ধকার জগতে তলিয়ে গেলাম। আমার সিলাকিত দেহ কি গ্রুস্টান বাঁচাতে পারবে? আমি জানি না। আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করি। কিছুতেই আর কিছু এসে যায় না।

এটাই কি মৃত্যু?

.

তারপর কতকাল কেটে গেছে জানি না। হয়তো কয়েক মুহূর্ত, হয়তো কয়েক যুগ। আমি চোখ মেলে তাকালাম, চারদিকে একটা নীল জলো। খুব ভোরবেলা যেরকম আলো হয় অনেকটা সেরকম। আমি কান পেতে থাকি কাঁথাও কেউ একজন কাঁদছে। ব্যাকুল হয়ে কান্না নয়, কেমন জানি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কৃামাই শুনে বুকের মাঝে কেমন জানি এক ধরনের কষ্ট হয়।

আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, চারদিকে বিশাল নিঃসীম শূন্যতা। যতদূর চোখ যায়। কোথাও কিছু নেই। আমি আমার নিজের দিকে তাকালাম, এই তো আমার শরীর। হাত পা মুখ। আমি আবার নিজেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করি। কী বিচিত্র এক অনুভূতি, আমার নিজের শরীর তবু মনে হয় নিজের নয়।

আমি আবার কান্নার শব্দটা শুনতে পেলাম। কী বিষণ্ণ করুণ কান্নার স্বর! কোথা থেকে আসে?

আমি উঠে দাঁড়ালাম। মনে হলে আমি বুঝি ভেসে যাব। আমার সামনে কিছু নেই পিছনে কিছু নেই। আমার নিচে কিছু নেই উপরে কিছু নেই। চারদিকে শুধু খুব হালকা। একটা নীল আলো। আমি আবার কান্নার শব্দটা শুনতে পেলাম। সামনে থেকে আসছে। আমি সেদিকে হাঁটতে চেষ্টা করে হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম, আমার পায়ে কোনো জোর নেই। আমি অতলে পড়ে যেতে থাকি, হাত দিয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোথাও কিছু নেই। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না, পড়ে যেতে থাকি। কতক্ষণ কেটে যায় এভাবে আমি জানি না। আমি কি সত্যিই পড়ে যাচ্ছি নাকি সবই আমার কল্পনা?

আমি আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। বিশাল এক শূন্যতায় আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছি। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করি, আবার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। মনে হয় খুব কাছে কেউ কাঁদছে। আমি কান্নার শব্দের দিকে নিজেকে টেনে টেনে নিয়ে যেতে থাকি।

আমি কতক্ষণ হেঁটেছি জানি না। শুরু নেই শেষ নেই এক আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায়। সময় যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে কান্নার শব্দ স্পষ্ট হতে থাকে, বহুদূরে একটি ছায়ামূর্তিকে দেখা যাচ্ছে। দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে সে কাঁদছে। বাতাসে তার কালো চুল উড়ছে, সাদা কাপড় উড়ছে। দুঃখের কী আশ্চর্য একটি প্রতিমূর্তি।

আমি হেঁটে কাছে যেতেই ছায়ামূর্তিটি আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল টিয়ারা।

টিয়ারা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলতে পারে না। হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কুশান তুমি?

হ্যাঁ। আমি।

তোমাকেও গ্রুস্টান ধরে এনেছে?

না টিয়ারা, আমাকে গ্রুস্টান ধরে আনে নি।

তাহলে তুমি এখানে কেন এসেছ?

আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

নিয়ে যেতে এসেছ?

হা টিয়ারা।

তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? কেমন করে নিয়ে যাবে? আমরা সিলাকিত হয়ে আছি।

আমি জানি।

তুমি সত্যিকারের কুশান নও। আমি সত্যিকারের টিয়ারা নই। এগুলো সব গ্রুস্টানের তৈরী প্রতিচ্ছবি। এখানে কিছু সত্যি নয়। সব মিথ্যা। সব কাল্পনিক।

হা টিয়ারা। শুধু কষ্টটা সত্যি।

কী কষ্ট কুশান কী ভয়ঙ্কর কষ্ট!

আমি তোমার কষ্ট দূর করে দেব। তুমি আমার কাছে এস। এস।

টিয়ারা হঠাৎ এক পা পিছিয়ে গিয়ে আর্তগলায় বলল, না।

কেন নয়?

ভয় করে। আমার ভয় করে। আমি যদি তোমাকে ছুঁয়ে দেখি তুমি নেই? তুমি যদি হারিয়ে যাও?

আমি হারিয়ে যাব না। আমি টিয়ারার দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বললাম, আমি যদি হারিয়ে যাই তাহলে আবার আমি তোমাকে খুঁজে বের করব। এস আমার কাছে এস।

না কুশান না। আমার ভয় করে। খুব ভয় করে।

তোমার ভয় নেই টিয়ারা, আমি তোমাকে রক্ষা করব।

না কুশান কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না, কেউ না।

মনে নেই আগে আমি তোমাকে রক্ষা করেছি? আবার আমি তোমাকে রক্ষা করব।

হঠাৎ খনখনে গলায় খুব কাছে থেকে কে যেন হেসে উঠল। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। কেউ নেই কোথাও, চারদিকে শুধু হালকা নীল আলো। আমি বললাম, কে?

খনখনে গলায় আবার হাসির শব্দ ভেসে আসে।

কে? কে হাসে?

টিয়ারা হঠাৎ ছুটে এসে আমাকে জাপটে ধরে ভয় পাওয়া গলায় বলল, গ্রুস্টান!

আমি টিয়ারাকে ধরে রেখে আবার চারদিকে তাকালাম, গ্রুস্টান তুমি কোথায়? তুমি কী চাও?

আমি কিছু চাই না।

গ্রুস্টান আমি তোমাকে দেখতে চাই।

কেন?

তোমার ক্ষমতা কেড়ে নেবার পর তুমি দেখতে কেমন হয়েছ আমি দেখতে চাই।

সাথে সাথে আমার সামনে গ্রুস্টানের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। হালকা সবুজ রঙের সুদর্শন একটি মূর্তি। একই সাথে মানব এবং মানবী। একই সাথে কোমল এবং কঠোর।

আমি কয়েক মুহূর্ত গ্রুস্টানের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তুমি দেখতে ঠিক আগের মতোই আছ।

হ্যাঁ। আমার ক্ষমতাও ঠিক আগের মতো আছে।

কিন্তু তোমার বিশাল নেটওয়ার্ক ছিল সেটি দু ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে। এখন তোমার ক্ষমতা আর আগের মতো নেই। অনেক কম। তুমি দুর্বল।

গ্রুস্টান আবার খনখন করে হেসে উঠে বলল, সূর্যকে দ্বিধাবিভক্ত করা হলে তার ঔজ্জ্বল্য কমে যায় না। পৃথিবীর জন্যে, পৃথিবীর মানুষের জন্যে আমার ক্ষমতা এতটুকু কমে নি। আমার যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে সেটি পৃথিবীর জন্যে যথেষ্ট। আমার প্রকৃত ক্ষমতার এক শতাংশ দিয়ে বিশ্বজগৎ ধ্বংস করে দেয়া যায়।

আমি জানি

তাহলে কেন তোমরা মিছিমিছি শক্তি ক্ষয় করছ? তোমরা জান না এখন আমি আমার রবোট বাহিনী পাঠিয়ে তোমাদের এক জন এক জন করে ধরে আনব?

জানি।

তোমরা কি জান না আমার নেটওয়ার্কে তোমরা আর স্পর্শ করতে পারবে না?

জানি। আমি খানিকক্ষণ গ্রুস্টানের দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বললাম, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?

গ্রুস্টান কোনো কথা না বলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, তুমি কয়েক লক্ষ কম্পিউটারের একটি পরিব্যাপ্ত অপারেটিং সিস্টেম। নেটওয়ার্ক অর্ধেক করে দেয়ার পর তোমাকে নূতন করে নিজেকে দাঁড় করাতে হয়েছে। এই ভূখণ্ডের এই নেটওয়ার্কে তুমি যেরকম গ্রুস্টান, অন্য ভূখণ্ডের বাকি নেটওয়ার্কে ঠিক সেরকম আরেকজন গ্রুস্টান কি তৈরি হয় নি?

গ্রুস্টান কোনো কথা বলল না কিন্তু ভয়ঙ্কর এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমি বললাম, তুমি বলতে চাইছ না কিন্তু আমি জানি। ঠিক তোমাকে আমি যেরকম দেখছি এ রকম আরো একজন গ্রুস্টানের জন্ম হয়েছে এখন। বাকি অর্ধেক নেটওয়ার্কে তার অস্তিত্ব। ঠিক তোমার মতো একজন গ্রুস্টান।

তুমি কী বলতে চাইছ কুশান?

সেই গ্রুস্টান ঠিক তোমার মতো শক্তিশালী। ঠিক তোমার মতো নৃশংস তোমার মতো হৃদয়হীন। তোমার মতো কুটিল কুচক্রী–

চুপ কর কুশান! চুপ কর—

যত সময় যাচ্ছে তোমরা দুই গ্রুস্টান তত ভিন্ন হয়ে যাচ্ছ। বিশেষ করে তুমি।

আমি কী?

গেটওয়ে কম্পিউটারের মেমোরি থেকে আমি খুব আশ্চর্য কিছু ছবি এনেছি। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার ছবি কিন্তু সেগুলো তৈরি হয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের আগে। আমি ছবিগুলো আমার বাই ভার্বালে রেখে এসেছিলাম এতক্ষণে সেগুলো এই বসতির সব মানুষের হাতে পৌঁছে গেছে। তুমি নিশ্চয়ই জান তার মানে কী? জান নিশ্চয়ই

গ্রুস্টান ভয়ঙ্কর গর্জন করে আমার দিকে এগিয়ে আসে, চিৎকার করে বলে, মিথ্যাবাদী—

হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ, মিথ্যাবাদী। আমি যদি না হই তাহলে তুমি। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। অনেক মানুষ যখন একটা মিথ্যা কথা বিশ্বাস করে তখন সেই মিথ্যাটাই সত্যি হয়ে যায়। আমি নিশ্চিত এই বসতির মানুষ সেই মিথ্যা কথাটিই বিশ্বাস করবে। একটা কথা এখন বসতি থেকে বসতিতে ছড়িয়ে পড়বে–পৃথিবী মানুষ ধ্বংস করে নি, ধ্বংস করেছে গ্রুস্টান–

কথা শেষ করার আগেই প্রচণ্ড আঘাতে আমি ছিটকে পড়ি। গ্রুষ্টান হঠাৎ আমার উপর হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমার হাত থেকে টিয়ারা ছুটে যায় একপাশে। গ্রুস্টান আমার কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে ভয়ঙ্কর এক আক্রোশে—

আমি কোনোমতে বললাম, না গ্রুস্টান! আমি জানি তুমি আমাকে হত্যা করবে না। মৃত মানুষকে অত্যাচার করা যায় না। শুধু যন্ত্রণা দেবার জন্যে তুমি আমাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী বাঁচিয়ে রাখবে। রাখবে না?

গ্রুস্টান আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, হ্যাঁ কুশান, তুমি সত্যি কথা বলেছ। তুমি এই প্রথম একটি সত্যি কথা বলেছ।

আমি আমার গলায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, তুমি জান তোমার মাঝে সবচেয়ে বিচিত্র অংশটুকু কী? তোমার সবচেয়ে বিচিত্র অংশ হচ্ছে মানুষের সাথে তোমার আশ্চর্য মিল। পৃথিবীর মানুষ যখন তোমাকে সৃষ্টি করে তারা কেন তোমাকে মানুষের রূপ দিয়েছিল মানুষের মতো একটি চরিত্র দিয়েছিল, আমি জানি না। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জান?

গ্রুস্টান কোনো কথা না বলে আমার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে আবার বললাম, মজার ব্যাপার হচ্ছে মানুষের মহত্ত্ব তোমার মাঝে নেই। মানুষের ভালবাসাও নেই! মানুষের স্বপ্নও নেই। আছে মানুষের নীচতা। ক্ষুদ্রতা। মানুষের দুর্বলতা। মানুষের হিংস্রতা। আর জান সেটাই তোমাকে ধ্বংস করে দেবে চিরদিনের মতো।

আমাকে ধ্বংস করে দেবে?

হা গ্রুস্টান। মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হও তুমি–যদি পরিব্যাপ্ত কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেমের ধ্বংসকে মৃত্যু বলা যায়।

তুমি কী বলতে চাইছ?

তুমি জান আমার একটি রবোট ছিল। অত্যন্ত প্রাচীন নির্বোধ রবোট। তার নাম ক্রিশি।

কী হয়েছে তার?

একটা বাই ভার্বালে করে আমি আর ক্রিশি এখানে এসেছি। তোমার রবোটেরা আমাকে ধরে এনেছে, ক্রিশিকে কিছু করে নি। কেন করবে? অত্যন্ত নির্বোধ প্রাচীন একটা রবোট তাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

কী করেছে সেই রবোট?

আমি জানি না কী করেছে সে। কেমন করে জানব? তুমি আমাকে সিলাকিত করে রেখেছ। কিন্তু আমি অনুমান করতে পারি। যখন তোমার বিশাল নেটওয়ার্কটি দু ভাগে ভাগ করা হয়েছে সে এখানে ছিল। সে দেখেছে তোমাকে প্রচণ্ড আঘাত দেয়া হয়েছে, সে দেখেছে তুমি কিছুক্ষণের জন্যে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছ। সে দেখেছে আমার জীবন হঠাৎ বিপন্ন হয়েছে।

গ্রুস্টানের চোখেমুখে হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক ধরনের আক্রোশ এসে ভর করে। হিংস্র স্বরে হিসহিস করে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?

ক্রিশি আমার অনেক দিনের রবোট। সে আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে যেটা করতে হয় করবে, তার স্বল্প বুদ্ধিতে, সেটা কি জান?

গ্রুস্টানের চেহারা হঠাৎ পাল্টে যেতে থাকে, সেখানে হঠাৎ এক আশ্চর্য আতঙ্ক এসে ভর করে। মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলে, না– না–কিছুতেই না–

হ্যা গ্রুস্টান। আমি নিশ্চিত সে বাই ভার্বালে করে ফিরে গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। যেখানে তোমার যোগসূত্রটি কেটে দু ভাগ করা হয়েছিল সেটা আবার জুড়ে দিচ্ছে তোমাকে রক্ষা করার জন্যে। কারণ সে মনে করে তুমি রক্ষা পেলে আমি রক্ষা পাব।

গ্রুস্টান কোনো কথা বলে না, হঠাৎ তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সে, আমি নিচু গলায় বললাম, তুমি জান তার অর্থ কী? তার অর্থ পৃথিবীর বিশাল নেটওয়ার্কে এখন দুজন গ্রুস্টান। একজন তুমি, আরেকজন পৃথিবীর অপর পৃষ্ঠে সৃষ্টি হওয়া দ্বিতীয় গ্রুস্টান। তোমার মতো নৃশংস। তোমার মতো হিংস্র। কিন্তু তুমি নও। সে ভিন্ন একজন।

গ্রুস্টান থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, না, না–তুমি মিথ্যা কথা বলছ–মিথ্যা কথা বলছ–মিথ্যা–

আমি ভুল বলতে পারি, কিন্তু মিথ্যা বলছি না গ্রুস্টান! তুমি প্রায় ঈশ্বরের মতো শক্তিশালী, পৃথিবীর মানুষ কোনোদিন তোমাকে ধ্বংস করতে পারত না। তোমাকে ধ্বংস করতে পারবে শুধু তুমি। ঠিক তোমার মতো একজন নৃশংস হিংস্র খল কুটিল কুচক্রী অপারেটিং সিস্টেম। আমি তাই করেছি গ্রুষ্টান্ত– আরেকজন গ্রুস্টানের জন্ম দিয়ে তোমার সাথে দেখা করিয়ে দিচ্ছি।

হঠাৎ চারদিক থরথর করে কেঁপে ওঠে। আমি দেখতে পাই ধোঁয়ার মতো কিছু একটা গ্রুস্টানের পাশে ঘুরছে, কিছু একটা সৃষ্টি হচ্ছে। দ্বিতীয় গ্রুস্টান?

আমি হাঁটু গেড়ে গড়িয়ে গিয়ে টিয়ারাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললাম, টিয়ারা, চোখ বন্ধ কর টিয়ারা।

কেন কুশান?

ভয়ঙ্কর একটা দৃশ্যের সৃষ্টি হবে তোমার সামনে। ভয়ঙ্কর দৃশ্য! তুমি সহ্য করতে পারবে না–

আমার ভয় করছে কুশান। ভয় করছে—

আমারও ভয় করছে। এস আমি তোমাকে শক্ত করে ধরে রাখি। আমি টিয়ারাকে ধরে রাখতে চাই কিন্তু সে আমার হাত থেকে কীভাবে জানি সরে যেতে থাকে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে ফিসফিস করে বললাম, টিয়ারা, তুমি সত্যিকারের টিয়ারা নও। আমি সত্যিকারের কুশান নই! কিন্তু তবু আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।

কী কথা?

গ্রুস্টান যখন ধ্বংস হবে তখন হয়তো তুমি আর আমি বেঁচে থাকব না। সত্যিকারের কুশান হয়তো আর কখনো সত্যিকারের টিয়ারাকে দেখবে না। যে কথাটি সে বলতে চেয়েছিল হয়তো কোনোদিন সেই কথাটি বলতে পারবে না–

কী কথা কুশান?

আমি কিছু বলার আগেই হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণে আমার চোখ ধাধিয়ে যায়। তীব্র আলোর ঝলকানিতে চারদিক ঝলসে ওঠে। প্রচণ্ড উত্তাপ ভয়াবহ শব্দ আগুনের লেলিহান শিখা আর তার মাঝে দেখতে পাই দুটি প্রেত যেন একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন হঠাৎ খানখান হয়ে ভেঙে পড়ল। আমি টিয়ারাকে ধরে রাখার চেষ্টা করলাম কিন্তু সে আমার হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল–আমি দেখলাম সে উড়ে যাচ্ছে, ছুটে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে

আমি চিৎকার করতে থাকলাম, কিন্তু কেউ আমার চিৎকার শুনতে পেল না।