প্লেনটা দেড় ঘণ্টা লেট করে পৌঁছোল। কাকাবাবু ছবছর পর এলেন ভোপালে। এয়ারপোর্টটা বেশ বদলে গিয়েছে। অনেক বড় আর আধুনিক হয়েছে। সেবারে সন্তু আর জোজো সঙ্গে এসেছিল। এখানে ছিল ধীরেন, রীনা, আর তাদের দুই ছেলে। খুব আড্ডা আর মজা হয়েছিল। অবশ্য পরে খুনোখুনি আর সাংঘাতিক কাণ্ড হয়েছিল, তবু লোভীদের কাছ থেকে মুক্ত করা গিয়েছিল ভীমবেটকার মতো ঐতিহাসিক মূল্যবান জায়গা।
ধীরেন আর রীনারা এখানে নেই। সুদর্শন এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাকাবাবু কোনওক্রমেই পুলিশের সাহায্য নিতে চান না। এর মধ্যে সুদর্শনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু তিনি থাকবেন ঠিক করেছেন একটা হোটেলে। সেটা শহর থেকে একটু বাইরে। এই সময় ভোপালে খুব গরম হয়। তবু কাকাবাবু পরে আছেন একটা মোটা জামা, অনেকটা জ্যাকেটের মতো। উপহার পাওয়া।
আসবার সময় তাঁর বউদি জিজ্ঞেস করেছিলেন, রাজা, তুমি ওখানে ওই জামাটা পরে যাচ্ছ, তোমার গরম লাগবে না?
কাকাবাবু বলেছিলেন, বউদি, কয়েকবার বৃষ্টিতে ভিজে আসায় বেশ ঠান্ডা লেগে গিয়েছে। তা ছাড়া, প্লেনে যাওয়ার সময় এক-একদিন এমন ঠান্ডা ছাড়ে যে, শীত লেগে যায়।
সন্তু এখন বেশ ভাল আছে। তার বুকজোড়া বিশাল ব্যান্ডেজ এখনও রয়েছে বটে, কিন্তু সে নিজেই হেঁটে হেঁটে টয়লেটে যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়াশোনাও শুরু করেছে। তার পরীক্ষা সামনে। সে এই অবস্থাতেই পরীক্ষা দেবে।
সন্তু জিজ্ঞেস করেছিল, কাকাবাবু, এখন হঠাৎ ভোপালে যাচ্ছ কেন?
কাকাবাবু এখনও ক্যাপ্টেন ধ্যানচাঁদের ডেথ-ডেথ খেলার কথা সন্তুকে বলেননি, কাউকেই বলেননি। সন্তুর ওই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ভীমবেটকার গুহাগুলো আর একবার দেখে আসব ভাবছি। হাতে তো কোনও কাজ নেই এখন!
কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। অন্য কাজও আছে, একবার ভীমবেটকাতেও যাবেন ঠিকই।
নিজের ব্যাগটা সংগ্রহ করে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলেন কাকাবাবু। এখন দুপুর দুটো। প্লেনে খাবার দিয়েছিল, কিন্তু তার পছন্দ হয়নি, খাননি। খিদে পেয়েছে, হোটেলে পৌঁছে কিছু খেতে হবে।
ট্যাক্সির লাইন থেকে প্রথম ট্যাক্সিটাই নিলেন কাকাবাবু।
ড্রাইভার একা, তার কোনও সঙ্গী নেই। চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে দরজা খুলে তিনি ভিতরে বসলেন।
ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন স্যার?
কাকাবাবু বললেন, অলিম্পিক হোটেল। চেনো তো?
ড্রাইভার বলল, নিশ্চয়ই চিনি। খুব বড় হোটেল।
ট্যাক্সিটা এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে বেরিয়ে ছুটল হাইওয়ে দিয়ে। পিছনে কোনও গাড়ি অনুসরণ করছে কিনা, তা দেখতে লাগলেন ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। কেউ আসছে না বুঝে নিশ্চিন্ত হয়ে ভাল করে হেলান দিয়ে বসতেই চমকে উঠলেন। ড্রাইভারের পাশ থেকে উঠে এল লায়লা। তার হাতে রিভলভার।
সেই রিভলভার একেবারে কাকাবাবুর কপালে ঠেকিয়ে লায়লা বলল, একদম নড়বে না। তোমার ভাইপোর চেয়ে আমার টিপ অনেক ভাল। মাথাটা ছাতু করে দেব।
কাকাবাবু বিস্ময় সামলে নিয়ে হালকা গলায় বললেন, নলটা কপালে ঠেকিয়ে তারপর গুলি করলে তার জন্য আবার টিপ লাগে নাকি?
লায়লা বলল, ট্রিগারটা টিপলে তোমার মাথার ঘিলুফিলু চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে, সেটা কি ভাল হবে?
কাকাবাবু বললেন, মোটেই ভাল হবে না, তাতে ট্যাক্সিটা নোংরা হয়ে যাবে। ড্রাইভার সাহেবকে কষ্ট করে ধুতে হবে।
লায়লা বলল, সুতরাং চুপ করে বসে থাকো। তারপর ড্রাইভারকে বলল, গাড়ি থামাও। ওকে সার্চ করো।
ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে নেমে এসে কাকাবাবুর পকেট হাতড়ে রিভলভারটা বের করে নিল।
লায়লা বলল, ওর ক্রাচ দুটোও সামনে নিয়ে এসো। ও দুটো ডেঞ্জারাস জিনিস।
ড্রাইভার সে দুটো সরিয়ে নেওয়ার পর কাকাবাবু বললেন, এখন তো আমার কাছে আর অস্ত্র নেই! এবার তোমার রিভলভারটা সরাও। তুমি ছেলেমানুষ, হঠাৎ ট্রিগারে হাত চলে গেলে বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।
লায়লা বলল, সরাব। তার আগে তোমার হাত দুটো বাঁধতে হবে। নইলে তুমি ড্রাইভার বা আমার গলা টিপে ধরতে পারো!
ড্রাইভার একটা লোহার চেন দিয়ে বেঁধে দিল কাকাবাবুর হাত।
ড্রাইভার বলল, চোখ দুটোও বাঁধা দরকার। কারণ, আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা এঁর জানার দরকার নেই।
প্রতি ট্যাক্সিতেই একটা লাল রঙের কাপড় থাকে, সেটা দিয়ে বাঁধা হল কাকাবাবুর চোখ।
কাকাবাবু বললেন, বিচ্ছিরি গন্ধ! যাই হোক, রিভলভারটা সরিয়েছ তো?
লায়লা বলল, হ্যাঁ। তবে তুমি কোনওরকম চালাকির চেষ্টা করলে আমি কিন্তু ঠিক গুলি চালাব।
গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল।
কাকাবাবু বললেন, কয়েক দিন আগে তুমি আমার চোখে শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো ছুড়ে দিয়েছিলে। আজ একেবারে চোখ বেঁধে দেওয়ালে। চোখ বাঁধা থাকলে আমি কোনওরকম চালাকি করতে পারি না। তবে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি? উত্তর দেবে?
লায়লা বলল, প্রশ্ন শুনি, তারপর ঠিক করব, উত্তর দেব কিনা।
তুমি এই ট্যাক্সিটার মধ্যে কোথায় ছিলে? আমি তো ওঠার সময় তোমায় দেখিনি। ড্রাইভারের পাশের সিট খালি ছিল।
ভাল করে দ্যাখোনি। আমি ড্রাইভারের পায়ের কাছে শুয়ে ছিলাম। কম্বল গায়ে দিয়ে।
তা দেখিনি ঠিকই। আর-একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। আমি কোন ট্যাক্সিটা নেব, তা তোমরা বুঝলে কী করে? আমি তো অন্য ট্যাক্সিও নিতে পারতাম!
তুমি কখন এয়ারপোর্টের ভিতর থেকে বেরোচ্ছ, তা একজন জানিয়ে দিয়েছে মোবাইল ফোনে। সেই অনুযায়ী এ-ট্যাক্সিটা এগিয়ে আনা হয়েছে। এটা ছাড়াও ওখানে আমাদের সাতখানা ট্যাক্সির সঙ্গে ব্যবস্থা করা ছিল। একটা না-একটায় তো তোমাকে উঠতেই হত।
এয়ারপোর্টের মধ্যেও তোমাদের লোক আছে?
শুধু কি তাই? কলকাতা থেকেও তো একজন এই প্লেনেই এসেছে তোমার সঙ্গে।
ওরে বাবা, অনেক পয়সা খরচ করো তো তোমরা! কিন্তু জানলে কী করে যে, আজই এই প্লেনে আমি ভোপাল আসব?
তুমি দশ দিন আগে টিকিট কেটেছ। কোথাকার টিকিট কাটছ, সেটা জানা কি খুব শক্ত?
কাকাবাবু বললেন, হুঃ, তোমাদের দারুণ নেটওয়ার্ক। টাকাপয়সাও অনেক। আমার সেসব কিছুই নেই। এবার আমার লাস্ট কোয়েশ্চেন। তোমাদের ক্যাপ্টেন বলেছিলেন, আমাদের লড়াই হবে সামনাসামনি। কিন্তু এটা কী হচ্ছে? আমার অস্ত্র কেড়ে নিয়ে, চোখ আর হাত বেঁধে নিয়ে যাচ্ছ মেরে ফেলার জন্য। এটাই কি খেলার নিয়ম?
লায়লা বলল, হবে, হবে, সামনাসামনি লড়াই হবে। সেই জন্যই তোমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যাতে তুমি পুলিশের সাহায্য নিতে না পারো। শঙ্করপুরে তো তুমি পুলিশের সাহায্য নিয়েই বেঁচে গেলে। শঙ্করপুরে তোমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারিনি বলে আমি কর্নেলের কাছে ধমক খেয়েছি। তাই এবারে আর আমি কোনও চান্স নিইনি।
কাকাবাবু বললেন, শঙ্করপুরে আমি পুলিশের সাহায্য নিইনি। গাড়িটা হঠাৎ এসে পড়ল।
লায়লা ধমক দিয়ে বলল, ওসব বাজে কথা ছাড়ো। এখানেও তুমি পুলিশের সাহায্য নিতে, সে সুযোগই আমরা দিইনি। তোমাকে বলা হয়েছিল, তুমি একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট রাখতে পারো। তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট উন্ডেড, তা আমরা কী করতে পারি। কর্নেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে আমি তোমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছি।
কাকাবাবু একটুখানি হেসে বললেন, আমাকে ধমক দিতে পারে, এমন মেয়েও আছে! ভাল, ভাল, সার্কাসে তুমি কী খেলা দেখাতে?
লায়লা বলল, তোমার কোয়েশ্চেন শেষ হয়ে গিয়েছে। নাউ স্টপ!
কাকাবাবু বললেন, মাঝে মাঝে আমার গান গাইতে ইচ্ছে করে। গান গাইলে মন ভাল হয়ে যায়। একটা গাইব?
ইংলিশ অর বেঙ্গলি?
বেঙ্গলি হলে তো তুমি বুঝবে না। ঠিক আছে, ইংলিশই গাইছি।
একটুক্ষণ চুপ করে কাকাবাবু একটা গান বানালেন। তারপর নিজস্ব সুরে ধরলেন সেই গান :
আ গার্ল প্লেজ উইথ আ টাইগার ইন আ সার্কাস
বাট ইটস নট অ্যালাইভ, ইটস আ কা-কাস!
লায়লা জিজ্ঞেস করল, হোয়াট ইজ কা-কাস?
কাকাবাবু বললেন, কথাটার বানান হচ্ছে carcass, কিন্তু আর-টা উচ্চারণ হয় না। কা-কাস মানে, মরা পশু।
লায়লা ঝুঁকে এসে কাকাবাবুর গালে এক থাপ্পড় কষিয়ে বলল, ঠাট্টা হচ্ছে আমার সঙ্গে? স্টপ ইট। মরবে তো কিছুক্ষণ পরেই। এখনও গানের শখ!
কাকাবাবু বললেন, আর যদি না মরি? তা হলে তোমারও যে একটা থাপ্পড় পাওনা রইল আমার কাছে। যদি না মরি, তা হলে এটা শোধ দেব কী করে? আমি যে মেয়েদের গায়ে হাত তুলি না।
লায়লা ভেংচাতে ভেংচাতে বলল, তুমি আর ছেলে বা মেয়ে, কারও গায়েই হাত তুলতে পারবে না, রাজা রায়চৌধুরী। দিস ইজ দ্য লাস্ট ডে অফ ইয়োর লাইফ।
গাড়িটা বড় রাস্তা ছেড়ে একটা অন্য রাস্তায় ঢুকল বোঝা গেল। এ রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো। গাড়িটা লাফাচ্ছে। তবে বেশিক্ষণ নয়। এক জায়গায় গাড়িটা থেমে গেল।
কেউ একজন দরজা খুলে বলল, রায়চৌধুরীকে আনতে পেরেছ? গুড। এবার ওর চোখ খুলে দাও।
গলার আওয়াজ শুনেই কাকাবাবু বুঝলেন, এ সেই ধ্যানচাঁদ অর্থাৎ কর্নেল।
চোখ খোলার পর কাকাবাবু দেখলেন, এসে পড়েছেন একটা জঙ্গলের মধ্যে। খানিকটা ফাঁকা জায়গায় একটা মরা গাছের গুঁড়িতে বসে আছে দুজন লোক। কর্নেল ধ্যানচাঁদ যথারীতি পরে আছে প্যান্ট-কোর্ট। একটা বড় মাংসের টুকরো থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।
সে বলল, ওয়েলকাম, মিস্টার রায়চৌধুরী। আজই আমাদের খেলা শেষ হয়ে যাবে। তার আগে আমরা একটু কিছু খেয়ে নিচ্ছি। সরি, তোমাকেও দেওয়া উচিত। তুমি কিছু খাবে?
একটুও চক্ষুলজ্জা না দেখিয়ে কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, খেতে পারি, আমার খিদে পেয়েছে।
ধ্যানচাঁদ বলল, অ্যাই, রায়চৌধুরীকেও মটন রোস্ট দাও। লায়লা, তুমিও খেয়ে নিতে পারো।
কাকাবাবু চেন দিয়ে বাঁধা হাত দুটো তুলে দেখালেন।
ধ্যানচাঁদ বলল, না, না, হাত-বাঁধা অবস্থায় খাবে কী করে? লায়লা, ওর বাঁধন খুলে দাও। ওর কাছে অস্ত্রস্ত্র নেই তো?
লায়লা কাকাবাবুর বাঁধন খুলতে খুলতে বলল, নেই। তবে, ওই ক্রাচ দুটো দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। ডেঞ্জারাস জিনিস।
ধ্যানচাঁদ বলল, হ্যাঁ, শুনেছি, ওগুলো থেকে ছুরিটুরি বেরিয়ে আসে। গুলিও করা যায় নাকি?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, গুলিও করা যায়।
ধ্যানচাঁদ বলল, এ যে দেখছি জেমস বন্ডের অস্ত্রের মতো। ইন্ডিয়ায় তৈরি?
কাকাবাবু বললেন, না। সুইডেনে।
ধ্যানচাঁদ বলল, এ দুটো আমার নিজের কালেকশনে রেখে দেব। তোমার তো আর লাগবে না।
কাকাবাবুকে এক টুকরো মাংস দেওয়া হল। আর-একটা রুটি।
তিনি বেশ তৃপ্তি করে খেয়ে বললেন, বাঃ, ভাল মাংস। এবার একটু জল চাই।
লায়লা এগিয়ে দিল একটা জলের বোতল।
ধ্যানচাঁদ জিজ্ঞেস করল, তুমি কি সিগারেট কিংবা চুরুট খাও? তোমার শেষ যা-যা ইচ্ছে আছে, তা মিটিয়ে নিতে পারো।
কাকাবাবু বললেন, না, আমি ওসব খাই না। আমার আর কিছু চাই না। আই অ্যাম ফাইন।
ধ্যানচাঁদও খাওয়া শেষ করে হাতটাত ধুয়ে বলল, শোনো রাজা রায়চৌধুরী, আমি খেলাটা আজই মিটিয়ে ফেলতে চাই। আমি ছমাস সময়ের কথা বলেছিলাম। কিন্তু আর ধৈর্য ধরতে পারছি না। তা ছাড়া আমার অন্য কাজ আছে।
কাকাবাবু বললেন, আমাকে ধরেবেঁধে নিয়ে এসে এতজন লোক মিলে মারার চেষ্টা করবে, এটাই বুঝি খেলার নিয়ম ছিল?
ধ্যানচাঁদ বলল, না, না, এরা সকলেই চলে যাবে। আমি বলে দিচ্ছি। আমি জেন্টলম্যান, কথার খেলাপ করি না। শুধু লায়লা থাকবে অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে।
সে ড্রাইভারকে বলল, তুমি বাকি দুজনকে নিয়ে ফিরে যাও। এখানে আর আসতে হবে না। আমার গাড়ি একটু দূরে রাখা আছে। আমি তাতেই লায়লাকে নিয়ে ফিরে যাব। এই লোকটার ডেডবডি এখানেই পড়ে থাকবে, হায়না-শেয়ালরা খেয়ে নেবে।
অন্য লোক দুটিকে তুলে নিয়ে গাড়িটা স্টার্ট দিতেই কাকাবাবু চেঁচিয়ে বললেন, আমার ব্যাগ? আমার ব্যাগটা রয়ে গিয়েছে ট্যাক্সিতে।
ট্যাক্সিটা থেমে গেল।
ধ্যানচাঁদ হেসে বলল, এখনও ব্যাগের মায়া? ও ব্যাগ তো আর তোমার কাজে লাগবে না রায়চৌধুরী। আ ডেডম্যান নিডস নো লাগেজ। ব্যাগটা এখানে পড়ে থাকারও কোনও মানে হয় না। তাতে তোমার পরিচয় জেনে যেতে পারে কেউ। ড্রাইভার, যাওয়ার পথে একটা বড় নদী পড়বে। সেই নদীতে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে যেয়ো!
কাকাবাবু দুকাধ কঁকালেন। ধ্যানচাঁদ ধরেই নিয়েছে, সে জিতবে। দেখা যাক!
গাড়িটা চলে যাওয়ার পর ধ্যানচাঁদ বলল, রায়চৌধুরী, আমি তোমাকে চয়েস দিচ্ছি। তুমি আমার সঙ্গে তলোয়ারের লড়াই করতে চাও, না রিভলভার নিয়ে?
কাকাবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, তলোয়ারের লড়াই? আজকাল তো কেউ শেখে না।
ধ্যানচাঁদ বলল, তুমি জানো কিনা, সেটা বলো। আমাদের ফ্যামিলিতে সকলকে শিখতে হয়। বহুকালের ট্র্যাডিশন।
কাকাবাবু বললেন, কর্নেল, তুমি আমার সঙ্গে তলোয়ারের লড়াই করতে চেয়ো না। আমি আগেই বলে দিচ্ছি, তুমি পারবে না। এটা শুধু আমি নিজের সম্পর্কে গর্ব করে বলছি না। অল ইন্ডিয়া ফেনসিং কম্পিটিশনে আমি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দুবার। এখন আমি খোঁড়া বলে ছোটাছুটি করতে পারি না, তাতে অসুবিধে হয়। তবু সারা ভারতে এই লড়াইয়ে আমার সমকক্ষ আছে মাত্র চারজন। তুমি হেরে যাবে!
কর্নেল অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, তুমি অল ইন্ডিয়া কম্পিটশনে জিতেছ? আমি ইন্টারন্যাশনাল কম্পিটিশনে প্রাইজ পেয়েছি। তুমি পাঁচ মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারবে না আমার সামনে।
একটা লম্বা ব্যাগ পড়ে আছে একপাশে। সেটার জিপ খুলে দুটো খাপে ঢাকা তলোয়ার বের করল ধ্যানচাঁদ।
একটা কাকাবাবুর দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, লায়লার খুব ইচ্ছে, তোমার বুকে আমি তলোয়ার বসিয়ে দিচ্ছি, সেই দৃশ্যটা ও দেখবে?
লায়লা বলল, ফেয়ার গেম হবে। তুমি লড়াই করে হেরে গিয়ে মরবে।
কাকাবাবু বললেন, তোমার শখ মিটিয়ে কর্নেল তোমাকে খুশি করতে পারবে বলে মনে হয় না।
কাকাবাবুর কাছে ক্রাচ নেই, তিনি একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ধ্যানচাঁদ প্রথম আঘাত করতে আসতেই কাকাবাবু সেটা আটকালেন। তারপর ধ্যানচাঁদ লাফিয়ে লাফিয়ে যতবার মারতে এল, কাকাবাবুর হাত চলল বিদ্যুতের মতো। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ তার দৃষ্টি।
একবার ধ্যানচাদের তলোয়ার খুব জোর ঠেলে দিয়ে কাকাবাবু বললেন, অত লাফিয়ে লাভ নেই কর্নেল! সিনেমায় ওরকম দেখায়। তুমি একটু পরেই হাঁপিয়ে যাবে!
কর্নেল বলল, শাট আপ! আমাকে উপদেশ দিচ্ছ কোন সাহসে?
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে উপদেশ দেব না। এবার বুঝিয়ে দিচ্ছি তোমার দুর্বলতা কোথায়।
ধ্যানচাঁদ আরও একবার লাফিয়ে উঠতেই কাকাবাবু তার হাতের মুঠোর ধার ঘেঁষে মারলেন প্রচণ্ড শক্তিতে। ধ্যানচাঁদের হাত থেকে তলোয়ারটা খসে পড়ে গেল।
কাকাবাবু বললেন, তুলে নাও। আবার লড়ো। লায়লার দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার বুঝলে তো, কে কার বুকে তলোয়ার বসিয়ে দিতে পারে?
ধ্যানচাঁদ বলল, থাক, এ-খেলাটার দরকার নেই। অনেক সময় লাগবে। রিভলভার ভাল। আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। পাঁচটার সময় একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
ধ্যানচাঁদ নিজের রিভলভার হাতে নিল।
কাকাবাবু বললেন, আমি কি আমারটা ফেরত পেতে পারি? নাকি আমাকে খালি হাতে লড়তে হবে?
ধ্যানচাঁদ বলল, অফ কোর্স তোমারটা ফেরত পাবে। রায়চৌধুরী, তুমি বোধহয় জানো না, আর্মিতে আমার শার্প শুটার হিসেবে বিশেষ নাম ছিল। তিনটে মেডেল পেয়েছি। আমার একটা গুলিও নষ্ট হয় না।
কাকাবাবু কোনও মন্তব্য করলেন না। নিজের রিভলভারটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখলেন, চেম্বারে গুলি ঠিকঠাক আছে কিনা। তারপর বললেন, ঠিক আছে, আমি রেডি।
ধ্যানচাঁদ বলল, আমি কুড়ি পা দূরে গিয়ে দাঁড়াব। লায়লা এক-দুই-তিন গুনবে। তারপর আমরা একসঙ্গে গুলি চালাব। ফাইট টু কিল!
কাকাবাবু বললেন, হলিউডের ওয়েস্টার্ন সিনেমায় যেমন দেখা যায়? কিন্তু সেসব সিনেমার প্রত্যেকটাতেই যে হিরো, সে জেতে। ভিলেন তো কখনও জেতে না।
ধ্যানচাঁদ বলল, আমি আমার ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে এসেছি। আমিই হিরো।
কাকাবাবু বললেন, আমি এসেছি আমার ভাইপো সন্তুকে মারার চেষ্টার শাস্তি দিতে। তোমার ভাইয়ের মৃত্যুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। কিন্তু সন্তুকে তুমি খুন করতে চেয়েছিলে।
ধ্যানচাঁদ রুক্ষ গলায় বলল, ওসব বাজে কথা এখন থাক। লায়লা, স্টার্ট।
লায়লা গুনতে শুরু করতেই ধ্যানচাঁদ চট করে সরে গেল একটা গাছের আড়ালে। একটা হাত বের করে চালাল গুলি।
কাকাবাবু রিভলভার তুললেনই না।
ধ্যানচাঁদের পরপর দুটো গুলি এসে লাগল কাকাবাবুর বুকে। কিন্তু ভিতরে ঢুকল না। গুলি দুটোই পড়ে গেল মাটিতে।
দারুণ অবাক হয়ে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ধ্যানচাঁদ বলল, এ কী হল? এ কী হল?
লায়লা চেঁচিয়ে বলল, এ লোকটা জাদু জানে! কাকাবাবু এবার খালি জায়গায় পেয়ে গুলি চালালেন ধ্যানচাঁদের দিকে। গুলি লাগল ডান হাতে। রিভলভারটা ছিটকে গেল।
সে আঃ শব্দে আর্তনাদ করে বসে পড়ল মাটিতে। কাকাবাবু চেঁচিয়ে বললেন, এবার মারব তোমার বুকে। তারপরই খেলা শেষ!
অমনি লায়লা ছুটে এসে ধ্যানচাঁদকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, না, না, ওকে মারার আগে আমাকে মারতে হবে! প্লিজ, আমাকে মারো!
কাকাবাবু ধ্যানচাঁদকে ওভাবে মারতেন না, শুধু আর-একটু আহত করে দিতেন। লায়লাকে মারার তো প্রশ্নই ওঠে না।
লায়লাও বুঝে গিয়েছে যে, কাকাবাবু কোনও মেয়েকে মারবেন না। সে দুহাত তুলে ওই কথা বলতে বলতে ডান হাতের মুঠো থেকে একটা কিছু ছুড়ে মারল। এবারে আর লঙ্কার গুঁড়ো নয়, একটা গোলমতো জিনিস।
সেটা দেখতে পেয়েই কাকাবাবু মাটিতে শুয়ে পড়ে গড়াতে গড়াতে দূরে সরে গেলেন যতটা সম্ভব।
বিকট শব্দে ফাটল একটা হ্যান্ড গ্রেনেড। ধোঁয়ায় ভরে গেল জায়গাটা।
কাকাবাবু মাটিতে মুখ গুঁজেছিলেন, আবার মুখ তুলতেই দেখলেন, লায়লা আর ধ্যানচাঁদ দৌড়োচ্ছে একটা ঝোপের দিকে। ব্যথায় চিৎকার করছে ধ্যানচাঁদ।
তারপরই পাওয়া গেল একটা গাড়ির শব্দ।
কাকাবাবু তাঁর বুলেটপ্রুফ জামাটার ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, পালাল। ওর লেগেছে, কিন্তু কতটা? ডান হাতের পাঞ্জাটাই কি উড়ে গিয়েছে!