প্রিয়বাক্যে প্রজাগণের অভিনন্দনজ্ঞাপন
বৈশম্পায়ন বলিলেন, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র এইরূপ: অনুনয়, করিলে পৌর ও জানপদ প্রজাগণ সকলেই বাষ্পকুলুলোচনে, পরস্পর পরস্পরের মুখাবলোকনপূৰ্ব্বক বিচেতনপ্রায় হইয়া রহিল। তৎকালে তাহাদিগের মুখ হইতে কোন কথাই বিনির্গত হইল না। তখন অন্ধরাজ পুনৰ্ব্বার তাঁহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে ধাৰ্ম্মিকগণ! আমি নিতান্ত বৃদ্ধ ও পুত্রবিহীন হইয়াছি, পিতা ভগবান্ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ও ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির আমাকে অরণ্যগমনে অনুজ্ঞা করিয়াছেন। এক্ষণে আমি ধর্ম্মপত্নীর সহিত প্রণিপাতপুরঃসর করুণস্বরে বারংবার আপনাদিগকে কহিতেছি, আপনারা আমাদিগকে বনগমনে অনুমতি প্রদান করুন।”
অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র করুণস্বরে এই কথা কহিলে, প্রজাগণ নিতান্ত শোকসন্তপ্ত হইয়া জনকজননীর ন্যায় শূন্যহৃদয়ে কেহ কেহ করদ্বারা ও কেহ কেহ বা উত্তরীয়বসনদ্বারা মুখমণ্ডল আচ্ছাদনপূৰ্ব্বক রোদন করিতে লাগিল। অনন্তর তাহারা ক্রমে ক্রমে শোকবেগ সংবরণপূৰ্ব্বক একবাক্য হইয়া শাম্বনামক এক বেবেত্তা ব্রাহ্মণের নিকট আপনাদিগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া কহিল, “ভগবন্! আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমাদিগের বাক্য অন্ধরাজের নিকট কীৰ্ত্তন করুন।” তখন সেই বাক্যবিশারদ বেদবেত্তা মহাত্মা শাম্ব অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্রের নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! প্রজাগণ আপনাকে কহিতেছে, আপনি যাহা যাহা কহিলেন, তাহার কিছুই মিথ্যা নহে। কৌরবগণের সহিত আমাদের বিলক্ষণ সৌহার্দ্য আছে। আপনার বংশে কোন রাজাই প্রজাপালনে পরাঙ্মুখ বা প্রজাদিগের অপ্রিয় ছিলেন না। সকলেই পিতামাতার ন্যায় প্রজাদিগকে পালন করিয়াছিলেন। মহারাজ দুৰ্য্যোধনও আমাদিগের অপ্রিয়কার্য্যের অনুষ্ঠান করেন নাই। এক্ষণে ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মা বেদব্যাস আপনাকে যেরূপ উপদেশ প্রদান করিয়াছেন, আপনি সেইরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করুন। আমরা আপনার অদর্শনে নিতান্ত শোকাকুল হইব। আপনার গুণসমুদয় কদাচ আমাদের অন্তঃকরণ হইতে দূরীভূত হইবে না।
“পূৰ্ব্বে মহারাজ শান্তনু, আপনার পিতা বিচিত্রবীর্য্য ও মহাত্মা পাণ্ডু যেরূপে রাজ্যপালন করিয়াছিলেন, আপনার পুত্র মহারাজ দুৰ্য্যোধনও সেইরূপে রাজ্য রক্ষা করিয়া গিয়াছেন। তাহা হইতে আমাদিগের বিন্দুমাত্রও অনিষ্ট হয় নাই। আমরা তাঁহাকে পিতার ন্যায় বিশ্বাস করিতাম। এক্ষণেও আমাদিগের যেরূপ সুখস্বচ্ছন্দে কাল অতিবাহিত হইতেছে, তাহা আপনার অবিদিত নাই। অতএব প্রার্থনা করি, কুন্তীপুত্ৰ ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সহস্র বর্ষ রাজ্যপালন করুন; তাহা হইলে আমরা নিশ্চয়ই পরমসুখে কালহরণ করিতে সমর্থ হইব। মহারাজ যুধিষ্ঠির কুরু, সম্বরণ ও ভরত প্রভৃতি পুণ্যবান্ রাজর্ষিগণের রীতিনীতি অবলম্বন করিয়া ধৰ্ম্মানুসারে পৃথিবী শাসন করিতেছেন। তাঁহার শরীরে দোষের লেশমাত্র নাই। আমরা আপনার প্রসাদে পরমসুখে কালহরণ করিয়াছি। আপনারা পিতাপুত্রে আমাদিগের কখন কোন অনিষ্ট করেন নাই। আপনি কুলক্ষয়বিষয়ে দুর্য্যোধনের প্রতি যে দোষারোপ করিতেছেন, তাহা নিতান্ত অমূলক। এ বিষয়ে কি দুৰ্য্যোধন, কি শকুনি, কি কৰ্ণ, কি আপনি, আপনাদিগের কাহারও অপরাধ নাই। দৈববলেই কৌরবগণের ক্ষয় হইয়াছে।
“দৈব নিতান্ত দুর্নিবার্য্য। পুরুষকার কখনই উহাকে নিবারণ করিতে পারে না। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ ও কর্ণ প্রভৃতি কৌরবপক্ষীয় যোধগণ এবং সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, ভীমসেন, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেব প্রভৃতি পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ অষ্টাদশ দিবসের মধ্যেই যে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা নিপাতিত করিলেন, ইহা দৈববল ভিন্ন কখন কি সম্ভবপর হইতে পারে? বিশেষতঃ সংগ্রামে শত্ৰুসংহার ও কলেবর পরিত্যাগ করা ক্ষত্রিয়দিগের পরমধর্ম্ম। এই নিমিত্তই সেই মহাবলপরাক্রান্ত জ্ঞানবিজ্ঞানদর্শী বীরগণ পৃথিবীর অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণকে নিপাতিত করিয়া পরলোকে গমন করিয়াছেন। অতএব আর পুত্র দুৰ্য্যোধন, আপনার ভৃত্যগণ, মহাবীর কর্ণ, শকুনি ও আপনি, আপনাদিগের মধ্যে কাহাকেও ভূপতিগণের ক্ষয়ের কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় না। দৈববলেই ঐ কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে। দৈব ভিন্ন উহার অন্য কারণই নাই।
“আপনি সমুদয় জগতের গুরু। আমরা আপনাকে ও আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধনকে কদাচ অধার্ম্মিক বলিয়া জ্ঞান করি না। এক্ষণে প্রার্থনা করি, মহারাজ দুৰ্য্যোধন ব্রাহ্মণগণের আজ্ঞানুসারে বান্ধবগণের সহিত দুর্লভ স্বর্গসুখ অনুভব করুন। আপনিও তপস্যায় অনুরক্ত হইয়া সনাতন ধর্ম্মসমুদয় পরিজ্ঞাত হউন। পাণ্ডবগণের প্রতি আমাদিগের দৃষ্টিপাত করিতে হইবে না। ঐ মহাত্মারা পৃথিবীর কথা দুরে থাকুক, সমুদয় স্বর্গলোক প্রতিপালন করিতে পারেন। উঁহারা সম্পন্ন হউন বা বিপন্ন হউন, প্রজাগণ সৰ্ব্বদা উহাদিগের বশীভূত থাকিবে। দীর্ঘদর্শী জিতেন্দ্রিয় মহারাজ যুধিষ্ঠির পুরাতন রাজর্ষিদিগের বিধানানুসারে ব্রাহ্মণগণকে প্রচুর পরিমাণে ধনদান ও শ্রাদ্ধাদি কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। উঁহার তুল্য দয়াবান, সরল ও পবিত্রস্বভাব আর কেহই নাই। উনি আমাদিগকে পুত্রবৎ পালন করিয়া থাকেন। উহার মন্ত্রিদিগের মধ্যে কেহই ক্ষুদ্রদৃষ্টি বা অল্পজ্ঞানসম্পন্ন নহেন। উঁহার ভীমসেন প্রভৃতি মহাবলপরাক্রান্ত ভ্রাতৃগণও উহার প্রতি একান্ত অনুরক্ত। সুতরাং তাহারা যে আমাদিগের অপ্রিয়কার্য্যের অনুষ্ঠান করিবেন, তাহাও সম্ভবপর নহে।
“শিষ্টদিগের প্রতি সরলতা ও দুষ্টদিগের প্রতি তেজ প্রকাশ করা তাঁহাদিগের স্বভাবসিদ্ধ। আর মহানুভবা কুন্তী, দ্রৌপদী উলুপী ও সুভদ্রা ইঁহারাও কদাচ আমাদিগের প্রতিকূল ব্যবহার করিবেন না। আপনি আমাদিগের প্রতি যেরূপ স্নেহ প্রকাশ করিয়াছেন এবং যুধিষ্ঠির এক্ষণে আমাদিগকে যেরূপ স্নেহ করিতেছেন, তাহা আমরা কদাচ বিস্মৃত হইতে পারিব না। প্রজাগণ,: অধার্ম্মিক হইলেও মহারথ পাণ্ডবগণ ধর্ম্মানুসারে তাহাদিগকে প্রতিপালন করিবেন। অতএব আপনি এক্ষণে সন্তাপ পরিত্যাগপূর্ব্বক সুস্থচিত্তে ধর্ম্মানুষ্ঠান করুন।”
মহামতি শাম্ব ধৃতরাষ্ট্রের নিকট এই কথা কহিলে তত্রত্য সমুদয় প্ৰজাই তাঁহাকে বারংবার সাধুবাদপ্রদানপূর্ব্বক তাঁহার বাক্যে অনুমোদন করিল। তখন অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র প্রজাগণের অভিপ্রায় অবগত হইয়া বারংবার তাহাদিগের বাক্যে অভিনন্দনপূৰ্ব্বক তাহাদিগকে বিদায় করিয়া গান্ধারীর সহিত আত্মভবনে প্রবেশ করিলেন।