১০. প্যারিস বা পারি একটি রাত-জাগা শহর

‘রাত্রি বেলায়
রাত্রি বেলায়
আমি নিজেকে যুক্ত করি রাত্রির সঙ্গে
সীমানাহীন রাত্রি
আমার, সুন্দর, আমার
রাত্রি, জন্মের রাত্রি
যা আমার কান্নায় আমাকে ভরে দেয়…’
–আঁরি মিশো

প্যারিস বা পারি একটি রাত-জাগা শহর। এখানে অনেক রেস্তোরাঁই খোলা থাকে রাত দুটো পর্যন্ত, কোনও-কোনওটার ঝাঁপ বন্ধ হয় ভোর চারটের সময়। আমরা তো আর সেসব জায়গায় যাই না, আমাদের পয়সা কোথায়? আমরা বাস ভাড়া, ট্রেন ভাড়া খরচ করি টিপেটিপে, দুপুরবেলায় রুটি আর খানিকটা চিজ আর স্যালামি কিনে নিয়ে কোনও পার্কে বসে খিদে মিটিয়ে নিই, বড় জোর এক কাপ কফি খাবার জন্য কোনও রেস্তোরাঁয় কিছুক্ষণ বসি। ফরাসিদেশের কুলি-মজুররাও রাস্তার ধারে বসে লাঞ্চ খাবার সময় এক বোতল রেড ওয়াইন খায়। ওয়াইন নানা রকম দামের হয়, হাজার টাকা বোতলও আছে, আবার দু-টাকাতেও পাওয়া যায় এক বোতল। সস্তার ওয়াইন মার্গারিট একেবারে সহ্য করতে পারে না, তাই আমরা ওয়াইন কিনি না। মার্গারিটের বাড়ির তৈরি কয়েক বোতল ওয়াইন সে এনে রেখেছে, নৈশভোজের সময় বাড়িতে বসে তা পান করা হয়। আমাদের দেশে আগে অনেক বাড়িতেই কাসুন্দি তৈরি হত, ফরাসিদেশে অনেক পারিবারিক ওয়াইনই সেরকম।

আমাদের নৈশভোজও অতি সংক্ষিপ্ত। সন্ধের সময় বাড়ি ফেরার পথে একখানা রুটি, বেশ শক্ত এবং প্রায় দুহাত লম্বা রুটি, কিনে আনি। এই রুটির নাম বাগেত, লাঠির মতন একখানা বাগেত হাতে নিয়ে অনেক লোক বাড়ি ফিরছে, এটা সন্ধেবেলার একটা পরিচিত দৃশ্য। একখানা রুটিতেই দু-তিনজনের খাওয়া হয়ে যায়। সঙ্গে কিছু স্যালাড, মাখন আর চিজ, কিছু একটা মাংসের টুকরো, তারপর আইসক্রিম।

এক একদিন ভাত খাবার জন্য আমার মন খুব আনচান করে। দিনের পর দিন স্যান্ডুইচ চিবোতে-চিবোতে মনে হয় বাংলাভাষাই বুঝি ভুলে গেছি, আমার হাসির আওয়াজটাও সাহেবদের মতন হয়ে যাচ্ছে। মার্গারিট আর মোনিক ভাত অপছন্দ করে না, কিন্তু ফ্যান গালতে জানে না বলে রাঁধতে হয় আমাকেই। আমেরিকায় তখন ইনস্ট্যান্ট রাইস বেরিয়ে গেছে, মাপ মতন জল দিয়ে পাঁচ মিনিট ফোঁটালেই ধপধপে সাদা ভাত হয়ে যায়, ফ্যান-ট্যান থাকে না, কিন্তু ফ্রান্সে সেই ইনস্ট্যান্ট রাইস খুঁজে পাইনি। ভাত তো আর স্যালামি কিংবা চিজ দিয়ে খাওয়া যায় না, তার জন্য ডাল-তরকারি-মাছ-মাংসের ঝোল লাগে। সুতরাং, ভাত খাওয়ার দিন পুরো রান্নার ভারই আমার ওপর। সকালবেলা আমি একটা থলে হাতে নিয়ে বাজার করতে যাই। ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, কুর্জেৎ নামে এক ধরনের কুমড়ো আর আলু পেঁয়াজ কিনি। টাটকা মাছ সে পাড়ায় পাওয়া যেত, ফ্রোজেন মাছ আর ওসব দেশের মুরগি আমার বিস্বাদ লাগে। গরুর মাংসের বেশ দাম, আমাদের পক্ষে বিলাসিতা, এক মাত্র কখনও কেউ নেমন্তন্ন করলে বিফ খাওয়ার সুযোগ ঘটত। সে সময় ঘোড়ার মাংস বিক্রি হত খুব, সেটাই সস্তা, তারপরই খরগোশের মাংস। আমি ঘোড়া কিংবা খরগোশের মাংসই কিনে এনে ঝোল বানাতাম। স্কুলে পড়ার সময় আমি বয়েজ স্কাউট ছিলাম, তখন রান্না শিখে কুকিং ব্যাজ পেয়েছি, আমার রান্নার কেউ নিন্দে করতে পারবে না!

সারাদিন আমরা ঘোরাঘুরি করতাম বলে দুপুরের খাওয়াটা যেনতেনভাবে সেরে নিতে হত, ভাত খাওয়ার আড়ম্বর রাত্তিরে। মোনিক প্রায়ই দেরি করে ফেরে, সে তার স্টেডি বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দামি-দামি রেস্তোরাঁয় খেতে যায়। কিন্তু যেদিন আমি ভাত রান্নার কথা ঘোষণা করি, সেদিন মোনিক ইন্ডিয়ান ফুড আস্বাদ করার জন্য তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। মোমানিকের ভাষায় সেটা হিন্দু খাদ্য।

রান্না ঘরটি বেশ বড়। আমি আদা-জিরে-পেঁয়াজবাটা মেখে যখন মাংস করি, তখন দুই যুবতী দুপাশে দাঁড়িয়ে উৎসুকভাবে দেখে। কখনও আমি গরম ডেকচিতে ভুল করে হাত দিয়ে ছ্যাঁকা খেলে ওরা হেসে হেসে একে অন্যের কাঁধে ঢলে পড়ে; ভাজবার জন্য গরম তেলে ফুলকপি ছাড়তেই সেই শব্দ শুনে ওরা কৃত্রিম ভয়ে দৌড় মারে। আবার কখনও মাংস প্রায় সেদ্ধ হতেই ওদের একজন হাতায় করে খানিকটা ঝোল তুলে চুমুক দিয়ে সেই হাতাটা আবার ডুবিয়ে দেয়। ফরাসিদের এঁটো জ্ঞান তো বিন্দুমাত্র নেই বটেই, ফরাসি বা ইংরিজি ভাষাতেও এঁটো শব্দটাই নেই।

খাওয়ার টেবিলে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প হয়। আমার রান্না ভাত-তরকারি মাংসের সঙ্গে মার্গারিটের মায়ের বানানো রেড ওয়াইন আর মোনিকের পিসির পাঠানো কালভাডোজ (আপেলের সুরা)। মার্গারিটের অধিকাংশ গল্পই কাব্য-সাহিত্য ও লেখক শিল্পীদের সম্পর্কে। মোনিক কথা কম বলে, কিন্তু মাঝে মাঝে টুক টুক করে বেশ মজা করতে পারে! হঠাৎ কোনও প্রশ্ন করে আমাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে পারলেও সে বেশ আনন্দ পায়।

একদিন সে জিগ্যেস করল, তুমি কীরকম ফরাসি শিখেছ, দেখি! এই কবিতার মানে বলো তো! সে গড়গড় করে বলে যেতে লাগল :

পারসিয়েন পারসিয়েন পারসিয়েন
পারসিয়েন পারসিয়েন পারসিয়েন
পারসিয়েন পারসিয়েন পারসিয়েন পারসিয়েন
পারসিয়েন পারসিয়েন পারসিয়েন পারসিয়েন
পারসিয়েন পারসিয়েন
পারসিয়েন পারসিয়েন পারসিয়েন
পারসিয়েন?

আমি চোখ গোল গোল করে বললাম, এ আবার কী কবিতা? এ তো মোটে একটাই শব্দ।

মোনিক বলল, এটা একটা বিখ্যাত কবিতা।

আমি বললাম, যাঃ, হতেই পারে না, এটা একটা ধাঁধা!

মোনিক বলল, তুমি বিখ্যাত কবি লুই আরাগঁ-এর নাম শোনোনি? এটা তাঁর লেখা!

লুই আরাগঁ-এর নাম শুনে আমার মাথা আরও ঘুলিয়ে যায়। তার নাম কে না শুনেছে? শুধু কবিতা নয়, আমি অনুবাদে আরাগঁ-এর লেখা উপন্যাসও পড়েছি। কিন্তু এটার মানে কী?

আমার ভ্যাবাচ্যাকা মুখ ও অসহায় অবস্থা দেখে দুই সখী হেসে গড়াগড়ি যেতে লাগল। ঝরনার কলস্বরের মতন তাদের হাসির ঝংকারে মুখরিত হল মধ্যরাত।

শেষ পর্যন্ত ওরা মানেটা বুঝিয়ে দিল। ফরাসি ভাষায় ‘পারসিয়েন’ শব্দটির দুটি মানে হয়। একটা হল ভেনেশিয়ান ব্লাইন্ডস যা আমরা যাকে বলি জানলার খড়খড়ি। আর একটা হল পারস্য দেশের রমণী। জানলার খড়খড়ি দিয়ে সামান্য আলো আসে, তার সঙ্গে মুখে ওড়না ঢাকা পারস্যরমণীর মিল খুঁজে পেয়ে আরাগঁ কৌতুক করেছেন।

কবিতাটি নিছক ধাঁধা নয়, পরে অনেক কাব্য সংকলনে আমি এই কবিতাটি দেখেছি। জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, কবিতা কী? কবিতা অনেক রকম! সেই উক্তির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই রচনাটি।

রাত দেড়টা-দুটো পর্যন্ত আড্ডা মেরে আমরা শুতে যাই। তিনজনের তিনটি ঘর। বিছানায় এসে কিছুক্ষণ আমার ঘুম আসে না। সেপ্টেম্বর মাস, শীত একেবারেই নেই, একটা জানলা খোলা, বাইরে নানারকম শব্দ শুনে বোঝা যায়, নগরী এখনও জেগে আছে। প্লাস-পিগাল একটা প্রমোদ পাড়া, সারারাত আলোয় ঝলমল করে। নানা রকমের নাইট ক্লাব রয়েছে এখানে, তেমন আবার গুণ্ডাদের উপদ্রবও আছে শুনেছি, আবার সকালবেলা অনেক নিরীহ বুড়ো বুড়ি কিংবা অফিসযাত্রীদের ছোটাছুটি করতেও তো দেখেছি।

অল্প বয়েসে আমার ছেলেমানুষি ধারণা ছিল, প্যারিস বুঝি শুধু শিল্পী আর কবিদের শহর। ফরাসি বিপ্লবের সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার আদর্শ এখানে এখনও জ্বলজ্বল করে। আসলে তো আর তা নয়, এই সুন্দর শহরটিতে, চোর-জোচ্চোর-বদমাশদের সংখ্যাও কম নয়, বহু ধরনের ব্যবসায়ীদেরও এটা আড্ডাস্থল, বিশ্বের বহু দেশেই ধনীরা এখানে আসে প্রমোদ সন্ধানে, তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হালকা করার জন্য বহু রকমের ছলা-কলা বিস্তার করে রয়েছে অনেক-নারী পুরুষ, এদের তুলনায় কবি-শিল্পী আর ক’জন! কবি-শিল্পীরা সব দেশের অতি মাইনরিটি। তবু বিশ্বের অন্য বিখ্যাত শহরগুলির তুলনায় প্যারিস শহরের ইতিহাসে সাহিত্যিক-শিল্পীরা অনেকখানি স্থান জুড়ে আছে।

জানলা দিয়ে কিছুক্ষণ রাত্তিরের পথের দৃশ্য দেখি। কোথা থেকে যেন একটা ক্ল্যারিওনেটের মিষ্টি আওয়াজ ভেসে আসছে। একটি উজ্জ্বল লাল রঙের স্কার্ট পরা তরুণী দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গেল, একটু বাদেই সে আবার হাতে এক গোছা সাদা ফুল নিয়ে ফিরে এল। এত রাতেও কি কোথাও ফুল বিক্রি হয়? মনে হয় যেন একটা স্বপ্নের দৃশ্য।

আমার মুশকিল এই যে, আমি বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে পারি না। অনেককে দেখেছি, বেলা দশটা-এগারোটা পর্যন্ত দিব্যি ঘুমোতে পারে। কিন্তু আমি যত রাতেই শুতে যাই, সূর্যের আলো ফোঁটার পর আর বেশিক্ষণ বিছানায় থাকতে পারি না। সাতটা-সওয়া সাতটার মধ্যেই চা-তৃষ্ণা পায়।

মার্গারিট আর মোনিক জাগে না, আমি প্যান্ট, জুতো-মোজা পরে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে খানিকটা হেঁটে আসি। এক একদিন ব্রেকফাস্টের খাবারপত্র কিনে আনি। সন্ধেবেলা যেমন বাগেত রুটি, সকালবেলা তেমনি ক্রোয়ার্স। ফরাসিরা পাউরুটি টোস্টের বদলে ক্রোয়াশ বেশি পছন্দ করে। অনেকটা বুমেরাং-এর মতন, গাঢ় বাদামি রঙের এই মুচমুচে খাদ্যটিকে ঠিক রুটি বলা যায় না, বরং ঢাকাই বাখরখানির সঙ্গে যেন খানিকটা মিল আছে। ইংরেজ-আমেরিকানরা সকালবেলা অনেক কিছু খায়, সেই তুলনায় ফরাসিদের ব্রেকফাস্ট অতি সংক্ষিপ্ত। একখানা ক্রোয়ার্স, একটুখানি জেলি বা মামালেড, আর খানিকটা চিজ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এরা কতরকম চিজ যে খায়, তার ইয়ত্তা নেই। ওয়াইন এবং চিজ নিয়ে আলাদা কালচার আছে। ফরাসিরা বলে, আমাদের ওয়াইন এবং চিজ ঠিক মতন উপভোগ করতে না শিখলে কেউ ফরাসি শিল্প-সংস্কৃতিও ঠিক মতন বুঝতে পারবে না।

আমাদের মতন এদের বিছানায় শুয়ে কিংবা চায়ের টেবিলে কাগজ পড়ার অভ্যেস নেই। রবিবার ছাড়া, অন্যান্য দিয়ে অনেকেই বাড়িতে খবরের কাগজ রাখে না। কাগজ পড়ার সময় কোথায়? বাড়ি থেকে বেরিয়ে অফিস যাওয়ার পথে এরা কাগজ কিনে নেয়, ট্রেনে কিংবা বাসে যেতে যেতে পড়ে, তারপর কাগজটা ফেলে দিয়ে যায়।

প্রথম জাগে মোনিক। একটা ড্রেসিং গাউন জড়িয়ে ছুটে এসে সে রান্নাঘরের স্টোভে গরম জলের কেটলি বসিয়ে দেয়। ততক্ষণে আমার একবার চা খাওয়া হয়ে গেছে। আমার দিকে একবার তাঁকিয়ে বঁ ঝুর বলেই সে টেবিলে বসে দুহাতে মাথা চেপে ধরে। তার চোখে তখনও ঘুম, ঠোঁটের রেখায় বিরক্তি। ঘড়িতে আটটা পঁয়তিরিশ, তাকে নটার মধ্যে বেরুতেই হয়।

আমি জিগ্যেস করি, আজ অফিস না গেলে হয় না?

মোনিক কাঁধ শ্রাগ করে। তারপর আপসোসের সুরে বলে, কেল ভি! তোমরা আজ কোথায় বেড়াতে যাবে?

আমি বলি, ভার্সাই যাব ভাবছি!

মোনিক বলে, তোমাদের কী মজা, এই চমৎকার আবহাওয়া পেয়েছ, রোজ ঘুরে ঘুর বেড়াচ্ছ, আর আমার এই সারা সপ্তাহ দারুণ কাজ!

বিনা প্রসাধনে, বিনা বিশেষ সাজে, সদ্য ঘুম ভাঙা অবস্থাতেই মোনিককে সবচেয়ে ভালো দেখায়। মোনিক চা খায় না, কফিতে তার আসক্তি। পর পর দুকাপ কফি খেয়ে সে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তারপর বাথরুম ও ব্রেকফাস্ট টেবিলে হুড়োহুড়ি করে সে সত্যি নটার মধ্যে তৈরি হয়ে যায়। এরই মধ্যে চুলের কায়দা করেছে, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, ভুরু আঁকা, চোখে কালো চশমা, খাঁটি প্যারিস-নাগরিকা সেজে, সে হাতে অফিসের ফাইল নিয়ে, আমার দিকে আরভোয়া ছুঁড়ে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়।

পশ্চিমি দেশে মেয়েদের এই স্বাধীন রূপটি দেখে আমি প্রথম থেকেই মুগ্ধ হয়েছি। মেমসাহেব বলে তো আর আলাদা কিছু নয়, কয়েকদিন একটু ঘনিষ্ঠভাবে মেলামশো করলেই বোঝা যায়, আমাদের দেশের মেয়েদের সঙ্গে এদের অনেক মিলও আছে। এদেরও রয়েছে সেন্টিমেন্ট, এক ধরনের নীতিবোধ, কর্তব্যজ্ঞান, মা-বাবার সম্পর্কে টান ভালোবাসা। মানিকের বাবা নেই কিন্তু তার মা এবং তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী থাকেন অরলিয়-তে, সেখানে মোনিক মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। নিয়মিত চিঠি লেখে, বাড়ি থেকে নানারকম উপহার আসে। মার্গারিটেরও বাবা-মা দুজনেই বেঁচে আছেন! কিন্তু এই সব মেয়েরা লেখাপড়া শেখার জন্য বাড়ির বাইরে চলে আসে, নেহাত দরকার না পড়লে বাড়ি থেকে টাকা নেয় না, নিজেদের পড়ার খরচ নিজেরাই উপার্জন করে, নিজেরাই থাকার ব্যবস্থা করে নেয়। তারপর যখন চাকরি শুরু করে, তখন তারা কোথায় থাকবে, কার সঙ্গে মিশবে, বিয়ে করবে কি করবে না, এসব ব্যাপারে তাঁরা সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিজের জীবনটা কীভাবে চালাবে, সে সম্পর্কে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়। এই স্বনির্ভরতার জন্য পৃথিবীর সব বিষয়েই এদের একটা নিজস্ব মতামত গড়ে ওঠে। সাহিত্য, শিল্প, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি যে-কোনও আলোচনাতেই এরা অংশ নিতে পারে। পৃথিবীর সমস্ত নারীজাতির মতন এদেরও শাড়ি-গয়না (ড্রেস মেটেরিয়াল, কস্টুম জুয়েলারি, জুতো) সম্পর্কে দুর্বলতা আছে, নিজেদের মধ্যে এক এক সময় সে আলোচনাতেও মেতে ওঠে, কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলেই যে পৃথিবীতে এদের অধিকার কিছু কম, তা এরা কক্ষনো মনে করে না।

মার্গারিট প্রত্যেক দিনই দেরি করে ওঠে এবং দারুণ লজ্জিত হয়। আয়ওরাতে ওকে ভোরবেলা ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে যেতে হত, এখানে সে দায় নেই বলেই ও যেন বেশি ঘুমিয়ে শোধ তুলছে। এক একদিন আমি কফির কাপ নিয়ে ওর দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলি, কাফে ও লে, মাদমোয়াজেল! বঁ ঝুর, বঁ ঝুর! পেতি দেজুনে (প্রাতরাশ) তৈরি আছে, দশটা যে বাজতে চলল।

সেজেগুজে আমরা শহর-অভিযানে বেরিয়ে পড়ি সাড়ে দশটার মধ্যে। এই অ্যাপার্টমেন্টের পাশাপাশি আরও অনেকগুলি অ্যাপার্টমেন্টে বেশ কিছু পরিবার থাকে। তাদের কয়েক জনের সঙ্গে আলাপও হয়ে গেছে। দেখা হলেই তাঁরা বঁ ঝুর বলেন ও একটু গল্প করতে আসেন। তাঁদের ব্যবহার দেখে বুঝতে পারি, আমি কালো রঙের মানুষ বলে তাদের চোখে-মুখে উপেক্ষার সামান্য চিহ্নও নেই। বুড়ো-বুড়িদের ব্যবহারও বেশ সহৃদয়। আগে শুনেছিলাম, ফরাসিরা বিদেশিদের সঙ্গে মিশতেই চায় না, কিন্তু এখানে দেখছি, অনেকেই নিজে থেকে কথা বলতে আসে। আমার মতন একজন পুরুষ যে একটি অ্যাপার্টমেন্টে আর দুটি নারীর সঙ্গে বাস করছে, এ ব্যাপারেও যেন কারুর আপত্তির কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কেউ কোনও কৌতূহলও প্রকাশ করে না।

পয়সার অভাবে আমি ফলি বার্জার কিংবা বিখ্যাত কোনও শো দেখিনি, কোনও নাইট ক্লাবেও ঢুকিনি, কিন্তু রাত্রির প্যারিস দেখেছি। পায়ে হেঁটে। এক শনিবার রাতে মোনিক আর মার্গারিটের সঙ্গে আমি ভোর পাঁচটা পর্যন্ত ঘুরে বেরিয়েছিলাম।

সারা বছর প্যারিসের রাত নিশ্চয়ই এরকম উৎসবমুখর থাকে না। বেশি শীতে তো বেরুবার প্রশ্নই ওঠে না, তা ছাড়া বছরের অনেক সময়ই বৃষ্টি পড়ে। কিন্তু অগাস্ট সেপ্টেম্বর মাসে সাধারণত আকাশ থাকে পরিষ্কার, দিনের বেলা এমন ঝকঝকে রোদ ইংরেজরা কদাচিৎ দেখতে পায়, সুইডেন-নরওয়েতে রোদ্দুর খুবই দুর্লভ। আমাদের চোখে সব সাহেব-মেমই ফরসা, কিন্তু ওখানে গিয়ে জেনেছি, ফরাসি বা ইতালিয়ানদের তুলনায় ইংরেজ বা সুইডিশরা বেশি ফরসা, কারণ ওদের গায়ে কম রোদ লাগে। এরকম আবহাওয়ার জন্যই প্যারিসে দু’মাস টুরিস্টদের সাংঘাতিক ভিড় হয়। খাঁটি প্যারিসিয়ানদের আবার টুরিস্টদের সম্পর্কে একটা অবজ্ঞার ভাব আছে, তারা অনেকে এই সময় ছুটি নিয়ে প্যারিস থেকে পালায়!

নিউ ইয়র্কও রাত-জাগা শহর, অ্যালেন গিনসবার্গের সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি, কিন্তু প্যারিসের মাদকতার সঙ্গে তার তুলনা হয় না। প্যারিসের সব রাস্তার মধ্যমণি সাঁজেলিজে-তে রাত দুটোর সময় এসে হঠাৎ মনে হয়, রাত আর দিনের ব্যাপারটা কি হঠাৎ উলটে গেল নাকি? অত চওড়া রাস্তাতেও এত নারী-পুরুষ যে গাড়ি চলার কোনও উপায়ই নেই। হাঁটার সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে লোকের গায়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়। সমস্ত দোকানপাট খোলা, চতুর্দিকে আলো, এরই মধ্যে কোথাও আলজিরিয়ানদের একটা ছোট দল ম্যাজিক দেখাচ্ছে, কিছু অফ্রিকান কালো মানুষ বিক্রি করছে নানা খেলনা, এক একট দল যাচ্ছে চেঁচিয়ে গান গাইতে-গাইতে। একটি ঈষৎ নেশাগ্রস্ত রমণী জিপসিদের কায়দায় নাচতে শুরু করল, অমনি প্রচুর লোক তাকে ঘিরে হাততালি দিয়ে তাল দিতে লাগল। চতুর্দিকেই মজা।

এক সময় আমরা ভিড়ের রাস্তা ছেড়ে চলে এলাম নদীর ধারে। এখানেও নারী-পুরুষ কম নয়। কপোত-কপোতীর মতন অনেকেই ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে আছে। শুনেছি, অনেকে প্রকাশ্যে চুম্বনে বেশি আনন্দ পায়।

আমরা একটা বাগানের ধারে, নিরিবিলি জায়গা দেখে বসলাম। এখান থেকে শোনা যাচ্ছে উৎসবের ধ্বনি। প্যারিসের সঙ্গে বীরভূমের কেঁদুলি জায়গাটার চেহারার কোনও মিলই নেই বটে, কিন্তু এর আগে আমি শুধু কেঁদুলির বাউলমেলাতেই সারারাত জেগে উৎসব দেখেছি। আমার সেই মেলার কথা মনে পড়তে লাগল।

হঠাৎ কানে এল একটা বেহালার সুর। আমাদের কাছাকাছি একট সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে একজন লোক বেহালা বাজাচ্ছে। তাকে ঘিরে আর কোনও মানুষজন নেই। সে একা। সে বাজিয়ে যাচ্ছে আপন মনে। কথা বন্ধ করে আমরা শুনতে লাগলাম সেই বেহালার করুণ মধুর সুর।

একসময় মার্গারিট বলল, সামনের ওই লোকটাকে দ্যাখো। জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে।

সত্যিই আগে দেখিনি, অন্ধকারের মধ্যে একজন লোক নদীর একেবারে ধারে গিয়ে বসেছে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জলের দিকে, একটুও নড়ছে না।

মার্গারিট বলল, তুমি বলছিলে না, এটা কবি আর শিল্পীদের শহর। অন্তত একজন শিল্পী আর কবিকে দেখা গেল। ওই যে লোকটা বেহালা বাজাচ্ছে আপন মনে, সে নিশ্চয়ই শিল্পী। আর জলের ধারে ওই লোকটিকে কবি বলে মনে হচ্ছে না? ও যেন জলের সঙ্গে কথা বলছে!

মার্গারিটের মতন মোনিক মোটেই রোমান্টিক নয়। সে বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল, ধ্যাত, কী যে বলিস তুই মার্গারিট! ও লোকটা কবি মোটেই নয়। কবিরা মোটেই রাত জাগে না, তারা ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয়। ফরাসি কবি-সাহিত্যিকরা সবাই সকালবেলা লেখে। আর জলের সঙ্গে যে কথা বলে, সে কবি হতে যাবে কেন, সে নির্ঘাত পাগল কিংবা মাতাল! কবিরা এই সব জিনিস চমৎকারভাবে বানায়, নিজেরা কিছু করে না। আর ওই যে লোকটা বেহালা বাজাচ্ছে, ও নিশ্চয়ই ভিখিরি। মেট্রো রেল স্টেশনে বাজনা বাজিয়ে ভিক্ষে করে। এখন কোনও নতুন সুর তুলছে! মোটেই ভালো বাজাচ্ছে না!

মোনিকের সিনিসিজম এমনই জোরালো যে প্রতিবাদ করা গেল না। একটু বাদে মোনিক জিগ্যেস করল, সুনীল, তুমি মার্গারিট নামটার মানে জান? আমি বললাম, না তো! তোমাদেরও নামের মানে থাকে বুঝি। আমি মোনিক মানেও জানি না। মোনিক উঠে গিয়ে বাগান থেকে একটা সাদা রঙের ফুল ছিঁড়ে নিয়ে এল। সেটা আমার সামনে ধরে বলল, এই ফুলের নাম মার্গারিট। নাও, তোমাকে দিলাম!