পোয়ারোর আস্তানায় পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না আমার। কিন্তু পোয়ারোকে বাড়িতে না পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর দিতে এলাম অথচ সে নেই।
পোয়ারোর এক প্রতিবেশী বেলজিয়ানের কাছে শুনলাম যে সে সম্ভবতঃ লণ্ডনে গেছে, কথাটা শুনে আমি রীতিমত বিস্মিত হলাম। লণ্ডনে আবার ওর কি কাজ পড়ল। চিন্তা করে কোনো হদিশ পেলাম না।
বিরক্ত হয়ে অগত্যা স্টাইলসের দিকেই হাঁটতে লাগলাম। পোয়ারোকে না পেয়ে মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে মনে হল। বরস্টিনের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে পোয়ারোর কতটুকু জানা আছে কে জানে–তবে এটা যে ওরই চেষ্টায় সম্ভবপর হল এটা তো জানা কথা। ব্যাপারটাকে সবাইকে জানান উচিৎ হবে কিনা বুঝতে পারছি না, সত্যিই বড় সমস্যায় পড়ে গেলাম।
অনেক ভেবে ঠিক করলাম জনকেই বরস্টিনের গ্রেপ্তার হওয়ার খবরটা জানাব। তারপর ও যা ভালো মনে করবে তাই হবে। জন কথাটা শুনে খুব অবাক হয়ে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এখন কি করা উচিৎ। অবশ্য কাল সকলে জেনে যাবে।
একটু চিন্তা করে জন বলল এখন কাউকে কিছু না জানানোই ভালো, সকলে যখন জানার তখনই জানবে।
পরদিন সকালে খবরের কাগজে দেখে খুবই অবাক হলাম। পাতা উল্টে কোথাও গ্রেপ্তারের খবর দেখলাম না, শুধু এক কোণে ছোট করে স্টাইলসের বিষ প্রয়োগের ঘটনার বিবরণ রয়েছে মাত্র। মনে হল এটা হয়ত ইনসপেক্টর জ্যাপেরই কাজ। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যেই হয়ত পুলিশ খবরটা চেপে গেছে। মনটা অবশ্য খুব খুঁতখুত করতে লাগল।
প্রাতঃরাশের পর ভাবলাম আরেকবার পোয়ারোর খোঁজ করতে যাব, দেখতে হবে পোয়ারো লণ্ডন থেকে ফিরল কিনা। হঠাৎ জানলার দিক থেকে অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে তাকিয়ে দেখি পোয়ারো। ছুটে গিয়ে হাত ধরে ওকে ঘরে নিয়ে এলাম। তাকে দেখে যে কি খুশী হয়েছি তা আর চেপে রাখতে পারলাম না। ওকে বললাম যে জনকে ছাড়া কথাটা আমি আর কাউকে জানাইনি।
পোয়ারো অবাক হয়ে কি কথা জানতে চাইল। আমি অধৈৰ্য্য হয়ে বললাম ডাঃ বরস্টিনের গ্রেপ্তারের কথা। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল ডাঃ বরস্টিন গ্রেপ্তার হয়েছেন? আমি বললাম মিসেস ইঙ্গলথর্পের খুনের অপরাধেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে।
পোয়ারো বাধা দিয়ে বলল একথা তোমাকে কে বলেছে? আমি আমতা আমতা করে বললাম যে এটা আমার ধারণা। পোয়ারো বলল ডাঃ বরস্টিন গ্রেপ্তার হয়েছেন গুপ্তচর বৃত্তির জন্য।
কথাটা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নিজেকে সামলে নিতে কিছুটা সময় লাগল। শেষ পর্যন্ত বললাম, ডাঃ বরস্টিন তাহলে একজন গুপ্তচর।
পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিল। সে প্রশ্ন করল আমার কি কখনও কোনো সন্দেহ হয়নি যে ডাঃ বরস্টিনের মত একজন নামী ডাক্তার এই অখ্যাত গ্রামে কেন বসে আছেন?
আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম যে এরকম কোনো চিন্তাই আমার আসেনি।
পোয়ারো বলতে লাগল বরস্টিন জন্মসূত্রে একজন জার্মান। এ দেশে অনেকদিন ধরে উনি আছেন, সকলে তাই ওকে ইংরেজ বলেই জানে। বছর পনের আগে এখানকার নাগরিকত্বও উনি পেয়েছেন, কিন্তু লোকটা খুব চালাক এবং একজন ইহুদীও বটে।
আমি বলে উঠলাম, লোকটা একটা আস্ত শয়তান।
পোয়ারো আমাকে বাধা দিয়ে বলল আমি ভুল বলছি, আসলে লোকটা দেশপ্রেমিক, ওর পরিণতিটা ভেবে দেখলেই তা বোঝা যাবে।
পোয়ারোর এইসব দার্শনিক চিন্তাভাবনা আমার একটুও ভালো লাগল না। তাই এই কথাটার কোনো উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গান্তরে গেলাম, বললাম এরকম একটা লোকের সঙ্গে মেরী ক্যাভেণ্ডিস দিনের পর দিন এমন কোনো জায়গা নেই ঘোরেননি, এই কথাটা শুনে পোয়ারো বলল বরস্টিন মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে বেশ ভালো করেই কাজে লাগিয়েছেন, ওদের নিয়ে যত কুৎসা রটেছে ততই বরস্টিনের আসল দোষ চাপা পড়ে গেছে।
পোয়ারোর কথাটা শুনে আমার আগ্রহ বাঁধ মানল না। জিজ্ঞাসা করলাম ডঃ বরস্টিন তাহলে মেরী ক্যাভেণ্ডিসের প্রতি অনুরক্ত নন। পোয়ারো বলল তা সে জানে না, তবে তার ধারণা ডঃ বরস্টিনের জন্য মেরী ক্যাভেণ্ডিসের কোনো মাথাব্যথা নেই। কথাটা শুনে মনের খুশী আর গোপন রাখা গেল না। পোয়ারো বলল সে নিশ্চিত যে তার ধারণাটাই ঠিক কারণ মেরী ক্যাভেণ্ডিসের নজর আরেকজনের দিকে।
পোয়ারোর কথা শুনে আবার চমক লাগল। ভাবতে লাগলাম ও কি বলতে চাইছে। আমার চিন্তায় হঠাৎ বাধা পড়ল। মিস হাওয়ার্ড ঘরে ঢুকলেন, চারদিকে তাকিয়ে বোধহয় দেখে নিলেন অন্য কেউ আছে কিনা। তারপর তাড়াতাড়ি একটুকরো বাদামী কাগজ বের করে পোয়ারোর হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন কাপড়ের আলমারীর মাথায়–পরমুহূর্তেই তিনি ছুটে বেরিয়ে গেলেন।
পোয়ারো তাড়াতাড়ি কাগজটার ভাঁজ খুলে দেখেই বেশ খুশী হয়ে উঠল। টেবিলের ওপর কাগজটা ছড়িয়ে দিয়ে আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, সইটা দেখে অক্ষরটা ইংরেজীর জে না এল মনে হচ্ছে।
পোয়ারোর ডাকে এগিয়ে এসে কাগজের টুকরোটা দেখলাম। কাগজটা বেশ ধুলো ময়লা মাখা, মাঝারি ধরনের। কাগজের ওপর যে ছাপটা ছিল পোয়ারো সেটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ছাপটা ছিল মেসার্স পার্কসন কোম্পানীর নামকরা নাটকের পোশাক সরবরাহকারী কোম্পানী। ঠিকানা ছিল . ক্যাভেণ্ডিস, স্টাইলস কোর্টস সেন্ট মেরী, এসেক্স। ক্যাভেণ্ডিসের আগের শব্দটার কথাই পোয়ারো জিজ্ঞাসা করেছিল কথাটা কি হতে পারে জে না এল।
ভালো করে লক্ষ্য করার পর আমি পোয়ারোকে বললাম এটা টি অথবা এল হতে পারে।জে কোনোমতেই হবে না।
পোয়ারো কাগজটা ভাজ করতে করতে বলল এটা তারও ধারণা। সেও অক্ষরটাকে এল বলে মনে করছে। সে জানাল এরকম একটা কিছু পাওয়া যাবে বলে তার সন্দেহ ছিল, তাই মিস হাওয়ার্ডকে সে খোঁজ করতে বলেছিল।
আমি জানতে চাইলাম মিস হাওয়ার্ড পোশাকের আলমারীর মাথায় বলে গেলেন কেন। পোয়ারো মৃদু হেসে বলল এর অর্থ আর কিছুই নয়, তিনি ওটা পোশাকের আলমারীর মাথায় পেয়েছেন।
হঠাৎ পোয়ারো আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে ডরকাসের নাম ধরে চিৎকার করতে করতে হলঘরের মধ্যে দিয়ে ছুটল।
চেঁচামেচি শুনে ডরকাস ভাড়ার ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এল। পোয়ারোর মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ডরকাস তাকালো। পোয়ারো জানতে চাইল, দুর্ঘটনার আগের দিনে মিসেস ইঙ্গলথর্পের বাজাবার ঘন্টাটা কি বিগড়ে গিয়েছিল?
প্রশ্নটা শুনে ডরকাসও খুবই অবাক হয়ে গেল, তারপর বলল তার ধারণা কোনো নেংটি ইঁদুর বা ঐ রকম কিছু ঘণ্টার তারটা কেটে দিয়েছিল মঙ্গলবার। সকালে মিস্ত্রী এসে সারিয়ে দেয়।
এ উত্তর শুনে পোয়ারো যেন উল্লাসে ফেটে পড়ল। তারপর আনন্দে লাফাতে লাফাতে পাগলের মত জানলার পাশ দিয়ে বাগানে চলে গেল। ওর কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
আচমকা কারও কণ্ঠস্বর শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি মেরী ক্যাভেণ্ডিস হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। পোয়ারোর কি হয়েছে জানতে চাইলেন। একটু আগে যা ঘটেছে তাই বললাম। মেরী হাসতে লাগলেন।
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম আজকে মেরীকে খুবই চিন্তিত দেখাচ্ছে। হাসির আড়ালে ওর বিষাদময় মুখচ্ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে আমার কাছে।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার মনে হল সিনথিয়ার সম্বন্ধে কিছু বলার এই সুযোগ। কিন্তু বলা শুরু করলেও বেশি কিছু বলতে পারলাম না। তার আগেই মেরী ক্যাভেণ্ডিস বেশ কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বরে বললেন আমি ওকালতি ব্যবসায় নামলে আমার পসার হত, সময় নষ্ট না করে যেন আমি তাই করি। শেষে বললেন সিনথিয়া তার কাছ থেকে একটুও খারাপ ব্যবহার পাবেন না।
মেরীর জবাব শুনে খুব লজ্জা পেলাম। কিছু বলতে গেলাম, উনি বাধা দিলেন। ওর এরপরের কথা শুনে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম। তিনি জানতে চাইলেন আমি কি তাদের সুখী দম্পতি বলে মনে করি। এরকম কথা যে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন তা আমি কখনও ভাবিনি। কোনো রকমে বললাম তাদের ঘরোয়া ব্যাপারে আমার হয়ত কথা বলা উচিত নয়। মেরী জানালেন তারা একটুও সুখী নন।
আমি কোনো প্রত্যুত্তর দিতে পারলাম না। মেরী শান্ত ঋজু ভঙ্গীতে ঘরময় পায়চারী করতে করতে বলতে লাগলেন। বেশ বোঝা যাচ্ছে ওর মনের মধ্যে ঝড় বইছে। উনি বললেন বিয়ের আগে তার একটা অতীত জীবন ছিল। তার বাবা ইংরেজ আর মা রুশ ছিলেন। মা খুবই সুন্দরী ছিলেন। তিনি তার ছোটবেলায় মারা যান, মৃত্যুর মধ্যেও যেন কেমন একটু রহস্য ছিল। ভুল করে তিনি বেশি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছিলেন। যাই ঘটে থাকুক, এই ঘটনায় তার বাবা খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন। এর পরই তিনি রাষ্ট্রদূতের কাজ নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ালেন। তিনিও তার সঙ্গে রইলেন। সেই সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে মেরীর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
চুপচাপ বসে বসে মেরীর স্মৃতিচারণ শুনতে লাগলাম। একটু থেমে উনি আবার বললেন এর পর বাবা মারা গেলে অথৈ জলে পড়ে গেলেন মেরী, মারা যাওয়ার আগে তিনি কিছু রেখে যেতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়ে ইয়র্কশায়ারে এক দূর সম্পর্কের বৃদ্ধা ঠাকুমার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিতে হল। কি নোংরামির মধ্যে যে তার দিন কেটেছে সে কথা বলতে গিয়ে মেরীর মুখে একটা তীব্র যন্ত্রণা ফুটে উঠল। সেই সময় একঘেঁয়ে বাঁধাধরা জীবনের মধ্যে দিনগুলো অসহ্যভাবে কাটছিল। আর ঠিক তখনই তার আলাপ হয় জন ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে।
মেরী বলতে লাগল জনকে দেখে তার ঠাকুমার বেশ ভালোই লাগে। তার মনে হয়েছিল জনের সঙ্গে মেরীকে ভালোই মানাবে। মেরী বলল এসব চিন্তা তার মাথায় আসেনি। তিনি শুধু ঐ আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন। ঐ গতানুগতিক জীবন তার অসহ্য লাগছিল। মেরী বলল আমি যেন তাকে ভুল না বুঝি। জনকে যে ওর ভালো লাগেনি তা নয় তবে জনের প্রেমে সে পাগল হয়ে যায়নি। জন খুবই উদারচেতা বলে ওদের বিয়েটাও হয়ে গেল।
আমি শুনে যেতে লাগলাম। মেরী বলল জন হয়ত প্রথমে তাকে ভালোবাসতেই চেয়েছিল কিন্তু পরে তারা বুঝতে পেরেছিল যে এ হবার নয়, তখনই তারা দূরে সরে যায়।
কথাটা শুনে আমি একটু আপত্তি করে কিছু বলতে যেতেই মেরী বাধা দিয়ে বললেন কথাটা সম্পূর্ণ সত্যি আর সেজন্য তারা প্রায় বিচ্ছেদের মুখেই এসে দাঁড়িয়েছে। শান্ত কণ্ঠে মেরী জানালেন তিনি স্টাইলসে আর থাকবেন না।
আমি শুধু জিজ্ঞাসা করলাম কেন তিনি চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন? বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত মেরী বললেন তিনি মুক্তি পেতে চান।
আমার মুখে কোনো কথা ফুটল না শুধু হতবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
হঠাৎ মেরী জোরে চিৎকার করে বলে উঠল এই জায়গাটা তার কাছে বন্দীশালার মত মনে হচ্ছে। আমি বললাম যে তার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তবু আমার অনুরোধ তিনি হঠাৎ যেন কিছু করে না বসেন।
কথাটা শুনে মেরী ক্যাভেণ্ডিস অদ্ভুত মুখভঙ্গী করলেন। আমারও হঠাৎ কি খেয়াল হল, বলে ফেললাম ডাঃ বরস্টিন যে গ্রেপ্তার হয়েছেন সে খবর তিনি জানেন তো? মেরীর মুখভাবটা সম্পূর্ণ বদলে গেল। বলে উঠলেন, সকালবেলাতেই জন দয়া করে তাকে খবরটা দিয়েছে। কথার ধরনে তার মনোভাবটা আঁচ করতে পারলাম।
আমি জানতে চাইলাম খবরটা শুনে তার কি মনে হচ্ছে? মেরী বললেন কিছুই মনে হবার নেই লোকটা জার্মান গুপ্তচর এই কথা তিনি শুনেছেন।
ওর মুখ দেখে মনের ভাব বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। মেরীকে সম্পূর্ণ পাষাণ প্রতিমা বলে মনে হল, কোনো অনুভূতির লেশমাত্রও যেন নেই। ডাঃ বরস্টিনের প্রতি ওর সত্যিই কোনো টান আছে কিনা বোঝা অসম্ভব। হঠাই মেরী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম, সত্যিই অদ্ভুত চরিত্রের মহিলা ইনি। যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি।
পরদিন সকালেও পোয়ারোর সাক্ষাৎ পাওয়া গেল না। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দাদেরও পাত্তা নেই। শুধু দুপুরে খাওয়ার সময় একটা ঘটনা ঘটল। ব্যাপারটা অবশ্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। মিসেস ইঙ্গলথর্প মারা যাওয়ার আগের দিন লেখা সেই চতুর্থ চিঠিটার একটা হদিশ পাওয়া গেল। ব্যাপারটা এক ফরাসী সঙ্গীত মুদ্রাকরের চিঠির মাধ্যমে জানা গেল। ওরা মিসেস ইঙ্গলথর্পের পাঠানো টাকার প্রাপ্তি স্বীকারের পর জানিয়েছেন রুশ লোকসঙ্গীতের সক্কলন ওরা যোগাড় করে উঠতে পারেনি।…এর ফলে চিঠির মধ্য দিয়ে রহস্য সমাধানের আশাও নির্মূল হয়ে গেল।
চা খাওয়ার আগে আরেকবার পোয়ারোর খোঁজে ওর আস্তানায় গেলাম। ওর দেখা না পেয়ে ভীষণ বিরক্তি লাগল। ওরই এক প্রতিবেশীকে জিজ্ঞাসা করলাম ওর খবর। তিনি জানালেন পোয়ারো ট্যাডমিনস্টারে এক মহিলার ডাক্তারখানা দেখতে গেছেন। মনে মনে ভাবলাম সিনথিয়া বুধবার ওখানে যায় না জেনেও পোয়ারো কি করতে ওখানে গেছে। যাই হোক প্রতিবেশীকে বলে এলাম পোয়ারো ফিরলে কাল সকালে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।
পরদিনও পোয়ারোর কোনো দেখা নেই। খাওয়াদাওয়ার পর লরেন্স আমাকে জিজ্ঞাসা করল পোয়ারোর সঙ্গে দেখা করতে যাব কিনা। অগত্যা অভিমান রেখে পোয়ারোর বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। এবার কিন্তু হতাশ হতে হল না। ঘরে ঢুকে দেখলাম পোয়ারো দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। আমার পায়ের শব্দে চমকে উঠে দাঁড়াল ও। তার শরীর খারাপ কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। পোয়ারো মাথা নাড়ল।
কি করব বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে শেষ ওকে জানালাম যে লরেন্স বলেছে সে বাড়তি কফির কাপটা খুঁজে পেয়েছে। পোয়ারোকে সেই চিঠির কথাটাও জানালাম।
পোয়ারো বলল তাহলে চিঠির থেকে কিছু তথ্য পাওয়ার আশা আর রইল না। এবার পোয়ারো আমাকে জিজ্ঞাসা করল হাতের ছাপ সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা আছে কিনা। আমি বললাম সে রকম কোনো ধারণা আমার নেই, শুধু এটুকু জানি যে দুজন মানুষের হাতের ছাপ একরকম হতে পারে না।
পোয়ারো একটা ছোট দেরাজ খুলে কয়েকটা ফটো বের করে টেবিলে রেখে বলল ফটোগুলোতে এক, দুই, তিন নম্বর দেওয়া আছে। এগুলো সম্বন্ধে আমার ধারণা সে জানতে চাইল।
পোয়ারোর অনুরোধে ভালো করে ছবিগুলো লক্ষ্য করলাম। দেখলাম, এগুলো অনেক গুণ বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এক নম্বর ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে কোনো পুরুষের বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনীর। দ্বিতীয় ছবিটা কোনো স্ত্রীলোকের–এটা তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট। আর তৃতীয়টা মনে হচ্ছে এক নম্বরেরই হাতের ছাপ।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে পোয়ারো ছবিগুলো আবার দেরাজে বন্ধ করে রাখল। আমার কৌতূহলী মুখের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বলল এক নম্বর হাতের ছাপটা মঁসিয়ে লরেন্সের হাতের ছাপ। দুনম্বরটা হল সিনথিয়ার। শুধু তিন নম্বরটাই গোলমেলে। ছবিটার ওপর একটা কালো দাগ রয়েছে দেখতে পেলাম।
আগ্রহান্বিত হয়ে জানতে চাইলাম ছবিগুলো কোথায় তুলেছে। পোয়ারো জানাল তিন নম্বর ছবিটা ট্যাডমিনস্টারের রেডক্রশ হাসপাতালের ডাক্তারখানার বিষের আলমারীর ওপরের তাকে রাখা একটা ছোটো বোতলের ছবি। ছবিটা বেশ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেখান হয়েছে।
আমি কথাটা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে বললাম লরেন্সের হাতের ছাপ ওখানে কি করে গেল। আমরা যেদিন ওখানে গেছিলাম সেদিন তো লরেন্স আলমারীর কাছে যায়নি।
পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল যে আমার ভুল হচ্ছে, আমরা সবসময় একসঙ্গে থাকিনি। সে আমাকে মনে করিয়ে দিল বারান্দা থেকে আমি লরেন্সকে একবার ডেকেছিলাম। আমি বললাম সে তো সামান্য সময়ের ব্যাপার। পোয়ারো বলল একজন ভেষজ ছাত্রের কাছে ঐ সময়টুকুর মধ্যে অনুসন্ধিৎসা পূরণ করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল।
অবাক বিস্ময়ে পোয়ারোর চোখের দিকে তাকালাম। সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞাসা করলাম বোতলে কি ছিল, জানলার দিকে তাকিয়ে পোয়ারো উত্তর দিল স্ট্রিকনিন হাইড্রোক্লোরাইড।
পোয়ারোর উত্তর শুনে শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। পোয়ারো বলতে থাকে আসলে স্ট্রিকনিন হাইড্রোক্লোরাইড খুব কমই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তরল স্ট্রিকনিন সাধারণতঃ ওষুধে ব্যবহার করা হয়। এই জন্যই বোতলের ছাপটা এখনও নষ্ট হতে পারেনি।
আমি জানতে চাইলাম ঐ ছাপের ছবি কিভাবে তুলেছে সে। পোয়ারো জানাল সে তার টুপিটা বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিল। বাইরের অতিথিদের তো ঐ সময়ে নিচে যেতে দেওয়া হয় না তাই সিনথিয়ার ঐ সহকারিণী মেয়েটি ওটা আনার জন্য নিচে যেতেই পোয়ারোর কাজ হয়ে যায়।
আমরা কথা বলছিলাম, এমন সময় একজন বেলজিয়ান ভদ্রলোক এসে জানালেন নিচে একজন ভদ্রমহিলা মিঃ হেস্টিংসের খোঁজ করছেন।
আমি আর পোয়ারো দুজনেই তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলাম। দরজার সামনে দেখলাম মেরী ক্যাভেণ্ডিস দাঁড়িয়ে আছেন। মেরী বললেন তিনি গ্রামের এক বুড়িকে দেখতে গেছিলেন। লরেন্সের কাছে শুনেছন আমি এখানে আছি তাই তিনি এসেছেন। পোয়ারো রসিকতার সুরে বলল সে ভেবেছিল মেরী তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। মেরী হেসে বললেন আরেকদিন তিনি আসবেন।
মেরী ক্যাভেণ্ডিস পোয়ারোকেও তার সঙ্গে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন। পোয়ারো রাজী হলে আমরা একসঙ্গে স্টাইলসের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম।
আমরা সকলে স্টাইলসের বড়ো দরজার কাছে পৌঁছতেই আমাদের অবচেতন মন বলে উঠল একটা কিছু যেন ঘটেছে।
হঠাৎ ডরকাস ছুটে এল। কান্নাঝরা মুখে দু হাত ঢেকে সে কী যেন বলতে গেল, কিন্তু বলে উঠতে পারল না। বাড়ির অন্যান্য পরিচারকরাও একপাশে দাঁড়িয়ে কানাকানি করছে।
আমি ডরকাসকে জিজ্ঞাসা করলাম কি ঘটনা ঘটেছে। ডরকাস অতি কষ্টে বলল ঐ গোয়েন্দারা মিঃ ক্যাভেণ্ডিসকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম লরেন্সকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। ডরকাসের চোখে একটা অদ্ভুত ভাব খেলে গেল, বলল মিঃ লরেন্সকে নয়, গোয়েন্দারা মিঃ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। কথাটা শুনেই আর্তনাদ করে মেরী ক্যাভেণ্ডিস আমার কাঁধে ঢলে পড়লেন। তাড়াতাড়ি ওকে ধরে ফেলতেই পোয়ারোর মুখের ওপর নজর পড়ল–একটা শান্ত জয়োল্লাসের ঝিলিক যেন পোয়ারোর চোখে খেলে গেল।