১০. পারতেই হবে

১০.

পারতেই হবে; দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। বেরোনোর পথ না পাওয়া পর্যন্ত এগিয়েই যেতে হবে আমাদের। নানা রকম প্রশ্ন মনে–কে বন্ধ করল দরজাটা? কেন করল? কি লাভ তার? কিন্তু প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবার সময় নেই। এখন।

একটা মোড় ঘুরে অন্যপাশে আসার পর দেখা গেল ক্রমশ খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে সুড়ঙ্গ। কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে এটা? বেরোনোর পথ সত্যি পাওয়া যাবে তো? সন্দেহ দেখা দিল কিশোরের। শুধু শুধু ঘুরে মরছে না তো?

আতঙ্ক এসে চেপে ধরতে শুরু করল। বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে। হৃৎপিণ্ডটা।

দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে নিশ্চয়, টর্চের আলো ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখে বলল মুসা। আলো কমে যাওয়ায় চারপাশে ছায়া বাড়ছে এখন। উলফ আমাদের খোঁজাখুঁজি করবে।

কি জানি! অনিশ্চিত শোনাল রবিনের কণ্ঠ।

তোমার কি মনে হয় সে-ই দরজাটা আটকে দিয়েছে? বুকের ওপর দুই হাত আড়াআড়ি চেপে ধরেছে কোরি। ভেজা বাতাসে ঠাণ্ডা লাগছে।

অসম্ভব কি?

সামনে কমে আসছে অন্ধকার। একটা মোড় ঘুরতেই আলো দেখা গেল। আলোর দুটো ঝিলমিলে বর্শা তেরছা হয়ে মেঝেতে এসে পড়েছে। দেখেই দৌড় দিল মুসা। পেছনে ছুটল অন্যরা।

ছোট একটা দরজা। তার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। ঠেলে খুলতে দেরি হলো না। হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে এল সবাই। অন্ধকার থেকে উজ্জ্বল সূর্যালোকে এসে চোখই মেলতে পারল না প্রথমে।

কিশোরের অনুমান ঠিক। সৈকতে বেরিয়েছে ওরা। উঁচু একটা ঢিবির ঢালে এমন জায়গায় এমন ভাবে রয়েছে সুড়ঙ্গমুখটা, সাগর থেকে দেখা যাবে না। নিচে সৈকতে দাঁড়িয়েও নয়। দেখতে হলে ঢাল বেয়ে উঠে আসতে হবে।

তাজা বাতাস কেমন লাগছে? হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

রোদ যে এত চমৎকার বুঝতে পারিনি কোনদিন, আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল রবিন।

এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোদ আর বাতাস খেলে পেট ভরবে না, তাগাদা দিল মুসা, হোটেলে যাওয়া দরকার।

হাসাহাসি করতে করতে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে মুখে যেন খই ফুটছে। উঠে এল হোটেলের পেছনের নির্জন। আঙিনায়। সুইমিং পুলের পাশ কাটাল। কাচের দরজা ঠেলে পা রাখল ঘরের ভেতর।

ডাইনিং রূমে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে মঞ্চটার দিকে। যেখানে ছিল ওটা সেখানে নেই। ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সুড়ঙ্গে ঢোকার দরজার কাছে।

কেন খোলা যায়নি দরজাটা বুঝতে অসুবিধে হলো না কারও। মঞ্চটা দিয়ে ইচ্ছে করেই আটকে দেয়া হয়েছে যাতে সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে শত ঠেলাঠেলিতেও না খোলে।

বোঝা গেল না কে করেছে এই অকাজটা।

*

বিকেলটা সৈকতে কাটিয়ে উত্তেজনা দূর করার চেষ্টা করল ওরা। পারল না। থেকে থেকে মনে আসছে কেউ একজন ইচ্ছে করে ওদেরকে সুড়ঙ্গে আটকে মারতে চেয়েছিল। কে লোকটা? উলফ? মিলার?

মিস্টার রোজারকে কথাটা জানানো দরকার, কিশোর বলল। সবাই একমত হলো ওর সঙ্গে।

কিন্তু ডিনারের সময় পাওয়া গেল না ব্যারনকে। খেতে এলেন না তিনি। চামচ দিয়ে এক টুকরো মাংস নিয়ে সবে মুখে দিয়েছে কিশোর, এই সময় রাইফেলে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ঢুকলেন মিলার। রাগে মুখ। লাল। এলোমেলো চুল। সেই সাফারি জ্যাকেটটাই পরে আছেন এখনও। বুকের কাছে ভোলা। নিচে হলদে স্পোর্টস শার্টের দুটো বোম নেই।

মিস্টার মিলার…এই যে, আমার বন্ধুরা:…সকালে দেখা হয়নি আপনার সঙ্গে, অস্বস্তি কাটানোর জন্যে কথা শুরু করতে গেল কিশোর।

এমন ভঙ্গিতে তাকালেন মিলার, যেন ওকেও চিনতে পারছেন না। মুসা, রবিন আর কোরির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল সে।

আনমনে ঘোৎ-ঘোৎ করলেন কেবল মিলার। হাত মেলালেন না। বিড়বিড় করে কি বললেন বোঝা গেল না। রাইফেলটা মেঝেতে শুইয়ে রেখে তার ভাই রোজারের চেয়ারটায় বসে খাবারের প্লেট টেনে নিলেন। হাপুস হুপুস করে খেতে শুরু করলেন নিতান্ত অভদ্রের মত।

সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সুপ শেষ করে সালাদের বাটিটা টেনে নিলেন। চামচের পর চামচ মুখে পুরে আধ চিবান দিয়ে দিয়েই গিলে ফেলতে লাগলেন।

শেষে আর সহ্য করতে না পেরে ভয়ানক অস্বস্তি দূর করার জন্যে কথা শুরু করল কিশোর, আপনার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে? …তিনি খেতে আসবেন না?

কিশোরের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখভর্তি খাবার চিবাতে থাকলেন মিলার। গিলে নিয়ে কোনমতে বললেন, না, রোজার এখানে নেই, বলেই আবার বড় এক চামচ সালাদ মুখে পুরলেন।

কোথাও গেছেন?

মাথা ঝাঁকিয়ে দায়সারা জবাব দিলেন মিলার। সশব্দে সালাদ চিবাতে লাগলেন।

অবাক লাগছে কিশোরের। এত বুনো কেন এই লোক? ভাইয়ের ঠিক উল্টো! দুই যমজ ভাইয়ের মধ্যে স্বভাবের এতটা পরিবর্তন কল্পনা করা যায় না।

কিশোরকে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবশেষে ঘোৎ-ঘোৎ করে বললেন মিলার, রোজার গেছে শহরে। শোরটাউন। তারপর আরও কি যেন বললেন, এতই অস্পষ্ট, বোঝা গেল না কিছু।

আমার আন্টির খোঁজ নিতে গেলেন নাকি? জানতে চাইল কোরি।

ভাল একটা চোখের দৃষ্টি কোরির ওপর স্থির করে মিলার বললেন, আন্টি? হ্যাঁ, তোমার আন্টি।

আবার খাওয়ায় মন দিলেন তিনি। সালাদ শেষ করে আস্ত একটা মুরগীর রোস্ট আর আলুভাজার বাটিটা টেনে নিয়ে খেতে শুরু করলেন। কারও জন্যে একটুও অবশিষ্ট না রেখে শেষ করে ফেললেন পুরোটাই।

তার এই কাণ্ড দেখে তাজ্জব হয়ে গেল সবাই।

কিন্তু কারও পরোয়া করলেন না তিনি। কোন রকম ভদ্রতার ধার ধারলেন না। খাওয়া শেষ করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কাত হয়ে তুলে, নিলেন রাইফেলটা। চেয়ার থেকে উঠে সেটাতে ভর দিয়ে চলে গেলেন ডাইনিং রুম থেকে।

হাঁপ ছেড়ে বাচল যেন সবাই।

এ তো রাক্ষস, বলে উঠল মুসা। এর সঙ্গে খেয়ে আমিও পারব না।

রোজার না বললেন বিষণ্ণতা রোগ আছে? কোরি বলল।

আছেই তো, কিশোর বলল, নইলে এমন আচরণ করে নাকি কেউ!

বিষণ্ণতা না ছাই! মুখ ঝামটা দিয়ে বলল কোরি। আস্ত এক উন্মাদ!

মিলারের সমালোচনা চলছে, এই সময় রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল উলফ। মুখটা আগের চেয়ে গোমড়া। বলল, কি, বলেছিলাম না এখানে থাকা নিরাপদ নয়? এখনও সময় আছে, পালিয়ে যাও।,

আর না পালালে? ভুরু নাচাল মুসা। ভূত ছাড়া আর কিছুকে ভয় পাই না আমি। সত্যি করে বলুন, ভূত আছে কিনা? আপনাদের ওই মিলার ভূতফুত না তো?

দেখো, আমার কথা না শুনে ভুল করছ তোমরা… দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল উলফ। বড় বড় হয়ে গেল চোখ।

ফিরে তাকাল কিশোর। রাইফেলে ভর দিয়ে ফিরে আসছেন মিলার। উলফের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন, থামলে কেন? চালিয়ে যাও তোমার বক্তৃতা।

কুঁকড়ে গেল উলফ। জ্যাকেটের মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে চাইল যেন শরীরটা। না, স্যার, আমি তো কিছু বলছি না…

জ্বলন্ত এক চোখ মেলে উলফের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিলার। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না উলফ। চোখ নামাতে বাধ্য হলো।

বরফের মত ঠাণ্ডা গলায় মিলার বললেন, তোমার ডিউটি রান্নাঘরে, সেখানেই যাও।

যাচ্ছি, স্যার! ভীত ইঁদুরের মত রান্নাঘরের দিকে ছুটে চলে গেল উলফ। পালিয়ে বাচল যেন।

সন্তুষ্টির হাসি ফুটল মিলারের ঠোঁটে। উলফকে ভয় দেখাতে পেরে খুশি হয়েছেন। এই প্রথম তার মুখে হাসি দেখল কিশোর। উলফ এত ভয় পায় কেন মিলারকে? রোজারকে পায় না। তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলে।

এমনকি অনেক সময় চাপাচাপিও করে। তাতে মনে হয় মনিব-ভূতের স্বাভাবিক সম্পর্কের চেয়ে কিছুটা বেশিই সম্পর্ক রোজারের সঙ্গে। অথচ তারই ভাই মিলারকে দেখলেই যেন গুটিয়ে যায় উলফ।

উলফকে তাড়িয়ে ছেলেমেয়েদের দিকে ঘুরলেন মিলার। পলকে মিলিয়ে গেল হাসিটা। কুঁচকে গেল ভুরু। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত একভাবে তাকিয়ে থেকে রাইফেলে ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। পা টানতে টানতে বেরিয়ে গেলেন আবার ঘর থেকে।

*

খাওয়ার পর ডাইনিং রূমের বড় জানালাটার ধারে বসে কথা বলছে ওরা। ঘণ্টাখানেক পর ঘরে ঢুকলেন রোজার। সেই সাদা পোশাক পরনে। হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ তোমরা? জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন, শোরটাউনে গিয়েছিলাম।

 হ্যাঁ, মিস্টার মিলার বলেছেন আমাদের, কোরি বলল। আন্টি কেমন। আছে?

ভাল। ফোন করেছিলেন। মিলার ধরেছিল। আমরা হোটেল বন্ধ করে দিয়েছি জেনে আর আসেননি। দুদিন ভালমত বিশ্রাম নেয়ার জন্যে থেকে গেছেন। তোমরা কাজ করছ এখানে, সেটাও জানানো হয়েছে তাঁকে। সবই করেছে মিলার, কেবল তোমাদের বলতে ভুলে গেছে, খবরটা। দুশ্চিন্তায় রেখে দিয়েছে। আজকাল আর কোন কথা মনে থাকে না ওর।

যাক, আন্টি তাহলে ভালই আছে। একটা দুশ্চিন্তা গেল। কিন্তু আমি যে ফোন করলাম, ধরল না কেন? বাড়িতে কেউ ছিল না নাকি?

কি জানি, জিজ্ঞেস করিনি। ভায়োলা চলে যায় হাসপাতালে। তোমার আন্টিও বোধহয় সাগরের ধারে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল, তুমি যখন ফোন করেছিলে ওই সময়।

তাই হবে। খবরটা এনে দেয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

ও ঠিক আছে। কোন খবর না পেয়ে দুশ্চিন্তা আমারও হচ্ছিল। জোয়ালিন বললেন, কাল-পরশু নাগাদ চলে আসবেন এখানে।…তো ঠিক আছে, তোমরা গল্প করো। আমি যাই।

.

১১.

 পরদিন সকালে নাস্তা খেতে এল না কোরি। অস্বাভাবিক লাগল না সেটা তিন গোয়েন্দার কাছে। এর আগেও এমন করেছে সে। দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। কাজ করার চেয়ে বিছানায় পড়ে থাকাটা ওর কাছে বেশি পছন্দের। ওকে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাল না কেউ।

ডিমভাজায় চামচ বসিয়ে দিয়ে বিশাল জানালাটা দিয়ে সাগরের দিকে তাকাল মুসা। সাঁতার কাটার দিন নয় আজ। আকাশের অবস্থা ভাল না।

কিশোর আর রবিনও তাকাল। ভারী মেঘে ধূসর হয়ে আছে আকাশ। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। জোরাল বাতাস বালির ঢিবিতে জন্মানো ঘাসের মাথাগুলোকে চেপে নুইয়ে দিচ্ছে।

না বেরোতে পারলে নেই, কিশোর বলল। ঘষাঘষির কাজ যতটা পারি সেরে ফেলব।

আজকেও যদি আবার আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ বেরিয়ে পড়ে? রবিনের প্রশ্ন।

অবাক হব না। পুরানো বাড়ি। সুড়ঙ্গ, গুপ্তকুঠুরি থাকতেই পারে।

সারাটা সকাল একনাগাড়ে কাজ করল ওরা। দেড়টায় লাঞ্চ খাওয়ার আগে আর থামল না।

রান্নাঘরের বড় সিংকে হাত ধুতে ধুতে কিশোর বলল, কোরি কি এখনও উঠল না? এতক্ষণ তো ঘুমানোর কথা নয়।

ওর ঘরে গিয়ে দেখা দরকার, মুসা বলল।

 কি জানি, রোজার কিংবা মিলারের সঙ্গে গিয়ে হয়তো আড্ডা দিচ্ছে, বলল রবিন। ওদের কাউকেও তো দেখলাম না।

তা ঠিক। নৌকা নিয়ে ব্যারনের সঙ্গে শোরটাউনেও চলে যেতে পারে, আন্টির সঙ্গে দেখা করার জন্যে।

ও তা কেন যাবে? প্রশ্ন তুলল কিশোর। আন্টি যে ভাল আছেন, শুনলই।

কেন, তোমার কিছু সন্দেহ হচ্ছে নাকি?

বুঝতে পারছি না, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। তবে ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগছে না আমার কাছে।

 নাস্তার পর উলফেরও আর দেখা মেলেনি। ওদের লাঞ্চের জন্যে রেফ্রিজারেটরে ঠাণ্ডা স্যান্ডউইচ আর ড্রিংকস রেখে গেছে। ডাইনিং রূমের ধূসর আলোয় দ্রুত খাওয়া শেষ করল ওরা। বাইরে মেঘের ঘনঘটা। কালো আকাশ। সকাল থেকে সেই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, থামছে না আর। কমছে, বাড়ছে, কমছে, বাড়ছে–চলছে এভাবেই।

খাওয়ার পর আবার কাজে লাগল ওরা। দেয়াল থেকে আরও অনেক কাগজ ছিঁড়ল। কিন্তু আর কোন গুপ্তদরজা বেরোল না। আগের দিনের দরজাটা তৈমনি লাগানো রয়েছে। ভোলার কথা একটিবারের জন্যে মনেও করল না কেউ। অন্ধকার সুড়ঙ্গে উঁকি দেয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আর।

সাড়ে চারটা নাগাদ যন্ত্রপাতি গুছিয়ে রেখে গোসল করতে চলল। নিজের ঘরে ঢোকার আগে কোরির দরজায় থামল কিশোর। টোকা দিল।

সাড়া নেই।

 থাবা দিয়ে জোরে জোরে কোরির নাম ধরে ডাকল।

জবাব মিলল না।

নব ঘুরিয়ে ঠেলা দিতেই খুলে গেল পাল্লা। ভেতরে আলো জ্বলছে। অগোছাল বিছানা। কিছু পোশাক এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে চেয়ারের হাতলে, কিছু বিছানায়। কিন্তু কোরি নেই।

কোরি? চিৎকার করে ডাকল কিশোর। বাথরূমে আছ নাকি?

কোন জবাব পাওয়া গেল না।

*

ডাইনিং রুমে বসে ডিনার খাচ্ছে ওরা, এই সময় সামনের দরজা দিয়ে রোজারকে ঢুকতে দেখল। ওদের দিকে তাকালেন না তিনি। দ্রুত হেঁটে চলে। যাচ্ছেন।

মিস্টার মেলবয়েস? ডাক দিল কিশোর। কোরিকে দেখেছেন কিনা জিজ্ঞেস করবে।

কিন্তু শুনতেই যেন পাননি ব্যারন। সোজা চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে।

কোরির জন্যে কিন্তু রীতিমত দুশ্চিন্তা হচ্ছে এখন আমার, কিশোর বলল। দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে।

দুশ্চিন্তাটা বাড়িয়ে দিতেই যেন রান্নাঘর থেকে খাবারের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল উলফ, মেয়েটা কোথায়?

ওকে দেখেননি?

 মাথা নাড়ল উলফ।

আমরা তো ভাবলাম মিস্টার রোজারের সঙ্গে নৌকায় করে শোরটাউনে। চলে গেছে।

না, সাহেবের সঙ্গে যেতে দেখিনি ওকে। সাহেব তো গেলেন ওয়ার্কারদের সঙ্গে কথা বলে জেনে আসতে কবে নাগাদ হোটেলের কাজ করতে আসছে ওরা।

 ভয় পেয়ে গেল কিশোর। রান্নাঘরে যাচ্ছে উলফ। তার দিকে তাকিয়ে রইল। আচমকা ফিরে তাকাল মুসা আর রবিনের দিকে। আর বসে থাকা যায় না। কোরিকে খুঁজতে যাব আমি। তোমরা আমার সঙ্গে যাবে, না ভাগাভাগি হয়ে খুঁজবে?

 একসঙ্গে থাকাই ভাল, মুসা বলল। ওর ঘর থেকে শুরু করা যাক। নাকি?

মাথা নাড়তে নাড়তে আনমনে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল রবিন, কোথায় আছে ও?

সত্যি সত্যি ভূতের খপ্পরে পড়েনি তো? ভয়ে ভয়ে বলল মুসা।

 ভূত না কচু, কিশোর বলল। আঙুল তুলে মঞ্চটা দেখিয়ে বলল, ওটাও কি ভূতে নিয়ে রেখে এসেছিল দরজার কাছে?

কিশোর ঠিকই বলেছে। মুসার দিকে তাকাল রবিন। কোন মানুষের কাজ। হয় উলফ, নয়তো মিলার।

উঠে দাঁড়াল কিশোর। আর দেরি করা ঠিক হবে না।

কোরির ঘর থেকে খোঁজা শুরু করল ওরা। কোন সুত্র নেই। জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড় দেখে বোঝা গেল না কোনটা নিখোঁজ হয়েছে কিনা। রাতে বিছানায় ঘুমিয়েছে কিনা তা-ও বোঝার উপায় নেই।

বিছানার অন্য পাশে গিয়েই চিৎকার করে ডাকল রবিন, এই, দেখে। যাও!

 তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল কিশোর আর মুসা। বিছানার পায়ের কাছে মেঝেতে চক দিয়ে আঁকা বিচিত্র কিছু নকশা আর চিহ্ন।

পেন্টাকল এঁকেছে! অবাক হয়ে বলল কিশোর। কাছেই পড়ে থাকতে দেখল একটা পুরানো বই। হাতে নিয়ে দেখল। জনৈক ভূত-গবেষকের লেখা। কি করে ভূত তাড়াতে হয়, কি করে ডেকে আনতে হয়, লিখে রেখেছে। কোথাও কোথাও নকশা এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছে।

ভুরু কুঁচকে মুসা বলল, খাইছে, ভূতকে ডেকে এনেছিল নাকি কোরি! শেষে ভুতেই গাপ করে দিল!

গম্ভীর হয়ে আছে কিশোর। জবাব দিল না।

কোরির ঘর, বাথরূম তন্নতন্ন করে খুঁজেও সন্দেহজনক আর কিছু পাওয়া গেল না।

ওল্ড উইঙে হলওয়ের দুই পাশে যত ঘর আছে, সবগুলোতে খুঁজে দেখা হলো। লবি আর রেকর্ড রূমেও পাওয়া গেল না কোরিকে। অফিস রূমে ঢুকল। অন্ধকার। নীরব। টর্চ জ্বেলে খুঁজে দেখল। নেই সে।

হোটেলের পেছনের আঙিনায় বেরিয়ে এল ওরা। বৃষ্টি থেমেছে। তবে আকাশ মেঘে ভারী হয়ে রয়েছে এখনও বাতাস গরম, ভেজা ভেজা।

সুইমিং পুলের কাছে এসে দেখা গেল বৃষ্টির পানিতে কানায় কানায় ভরে গেছে। কোরির নাম ধরে চিৎকার করে ডাকল কিশোর। জবাব পাওয়া গেল না। আরও কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর বলল, রোজার মেলবয়েসকে জানাতে। হবে।

রবিন বলল, পুলিশকে জানানো দরকার।

পুলিশ পাবে কোথায়? মুসা বলল, তার জন্যে শোরটাউনে যেতে হবে। কিংবা ফোন করতে হবে।

পাইরেট আইল্যান্ডেও পুলিশ আছে।

গোস্ট আইল্যান্ডের পাশের দ্বীপ পাইরেট আইল্যান্ড। গোস্ট আইল্যান্ডের চেয়ে বড়। মোটরবোটে যেতে দশ মিনিট লাগে।

ওখানে পুলিশ আছে জানলে কি করে? জিজ্ঞেস করল মুসা।

উলফের কাছে।

দ্রুতপায়ে হোটেলে ফিরে চলল ওরা।

*

ঘুমিয়ে পড়েননি তো? হোটেলে ঢুকে বলল রবিন।

হাতঘড়ি দেখল কিশোর। মাথা নাড়ল। মনে হয় না। মোটে তো সাড়ে আটটা।

ব্যারনের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। টোকা দিতে যাবে কিশোর, এই সময় ভেতর থেকে ভেসে এল তীক্ষ্ণ চিত্তার।

পরক্ষণেই আরেকটা চিৎকার শোনা গেল। অন্য কণ্ঠ।

তারপরেই শুরু হলো তর্কাতর্কি। রেগে রেগে কথা বলছে দুজন মানুষ। মিলারকে ধমক মারছেন রোজার। থেকে থেকে ঘোৎ-ঘোৎ করে উঠছেন। মিলার। চাপা গলায় জবাব দিচ্ছেন দুএকটা

দুজনকে থামানোর চেষ্টা করল একজন মহিলা।

কিশোরের হাত খামচে ধরল মুসা। ফিসফিস করে বলল, শুনলে?

পাগল! আস্ত পাগল! মহিলা বলল।

কে পাগল? খেঁকিয়ে উঠলেন মিলার।

তোমরা দুজনেই। বদ্ধ উন্মাদ! দুজনকেই তালা দিয়ে রাখা দরকার।

 দেখো কথাবার্তা একটু সাবধানে…

অ্যাই, থামো! ধমক দিয়ে ভাইকে থামিয়ে দিলেন রোজার।

দেখো, ওর পক্ষ নেবে না বলে দিলাম। ও তোমার সাহায্য চায় না। তুমি একটা গাধা। একটা রামছাগল।

মুখ খারাপ করছ কেন? মহিলা বলল।

সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন রোজার, আরে কি করছ! আরে!

মুসার দিকে তাকাল কিশোর। ভেতরে মারামারি বাধতে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।

যত কথাই বলো তোমরা, দুই ভাইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমান তেজে চেঁচিয়ে উঠল মহিলা, আমি তোমাদের পার্টিতে থাকছি না।

না থেকে যাবে কোথায়? রাগে খসখসে হয়ে গেছে মিলারের কণ্ঠস্বর। যাওয়ার উপায় নেই তোমার।

রোজার বললেন মহিলাকে, কি করব বলো? কত বোঝানো বোঝালাম ওকে–পায়ে ধরা বাকি রেখেছি শুধু। শুনল না। মিলার, শোনো…

না, কোন কথা শুনব না আমি! ষাড়ের মত চিৎকার করে উঠলেন মিলার। তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি….

প্লীজ, মিলার, ভীতকণ্ঠে বলল মহিলা, নামাও ওটা! নামাও।

 আরে করছ কি? রোজারও আঁতকে গেছেন কোন কারণে।

না না, মিলার! প্লীজ! রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এখন মহিলা।

দোহাই তোমার, মিলার, ভয় পেয়ে গেছেন রোজারও, মাপ চাই আমি। তোমার কাছে! তুমি না আমার ভাই…

গুলির প্রচণ্ড শব্দ হলো ঘরের মধ্যে।

তারপর সব চুপ।

.

১২.

দরজার দিকে পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে শুনে হলওয়ে দিয়ে দৌড় মারল কিশোর। দেখাদেখি রবিন আর মুসাও ছুটল। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়ল একটা অন্ধকার কোণে।

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল রোজারের ঘরের দরজা। রাইফেল হাতে বেরিয়ে এলেন মিলার। পরনে সেই সাফারি জ্যাকেট। উদভ্রান্তের মত ছুটে গেলেন একদিকে। একটামাত্র চোখ দিয়ে মনে হয় ঠিকমত দেখতে পাননি, ধাক্কা খেলেন গিয়ে উল্টোদিকের দেয়ালে। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে ফেললেন তিন গোয়েন্দাকে। বিশ্বাস করতে পারলেন না যেন নিজের চোখকে। ওদের এখানে আশা করেননি।

অ্যাক্সিডেন্ট! অস্বাভাবিক উঁচু গলায় ওদের বললেন তিনি। আমার ভাই রোজারের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।

রাইফেলটা ঘোরালেন চারপাশে। ভঙ্গি দেখে মনে হলো যেন যে কোন দিক থেকে শত্রু ছুটে আসার ভয় পাচ্ছেন। সেই অদৃশ্য শত্রুকে ঠেকানোর জন্যে তৈরি হয়েছেন।

 সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ওপরে উঠে এল উলফ। জিজ্ঞেস করল, মিস্টার মিলার? কি হয়েছে?

টলতে শুরু করলেন মিলার। একপাশের দেয়ালে গিয়ে পড়লেন। সামলে নিলেন কোনমতে। অ্যাক্সিডেন্ট! একটা সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে রোজারের!

ভুরু কুঁচকে গেল উলফের। নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ল। অ্যাক্সিডেন্ট?

ডাক্তার ডাকুন, জলদি! চিৎকার করে বলল কিশোর। মিস্টার রোজারকে গুলি করেছেন উনি! এগিয়ে এসে রোজারের ঘরের দরজা খোলার জন্যে হাত বাড়াল সে।

 খবরদার! গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন মিলার। যাও এখান থেকে। সরো!

এরকম হঠাৎ রেগে যাবেন মিলার, ভাবতে পারেনি কিশোর। ঢোক গিলে বলল, কিন্তু একটা মানুষ গুলি খেয়ে পড়ে আছে ভেতরে একজন মহিলাও আছেন…

তাতে তোমার কি? ভাগো এখান থেকে! দরজা জুড়ে দাঁড়ালেন মিলার। একচোখে কালো পট্টি। আরেক চোখে আগুন।

ডাক্তার ডাকতে বাধা দিচ্ছেন কেন? সামলে নিয়েছে কিশোর। মিলারের ধমকের পরোয়া না করে বলল, ভাইকে তো গুলি করলেন…

ডাক্তার ডেকে আর কোন লাভ নেই এখন।

মানে? লাল হয়ে গেছে উলফের মুখ।

দেরি হয়ে গেছে অনেক। রোজার মরে গেছে।

হাঁ করে মিলারের দিকে তাকিয়ে রইল উলফ। এগিয়ে গেল এক পা।

রাইফেল বাগিয়ে ধরলেন মিলার। প্রয়োজনে উলফকে গুলি করতেও দ্বিধা করবেন না।

উলফ বলল, অ্যাক্সিডেন্ট নয়, আপনি ভাল করেই জানেন…

না, জানি না, রাগত স্বরে বললেন মিলার, এটা অ্যাক্সিডেন্টই…

না, অ্যাক্সিডেন্ট নয়! মিস্টার রোজারকে গুলি করে মেরেছেন আপনি।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চোখে চোখে তাকিয়ে রইল দুজনে। তারপর ঝটকা দিয়ে রাইফেল তুলে কাঁধে ঠেকালেন মিলার। উলফকে নিশানা করলেন।

আরে একি করছেন! পাগল হয়ে গেলেন নাকি? চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।

*

সরান ওটা! শান্তকণ্ঠে বলল উলফ।

 লোকটার স্নায়ুর জোর দেখে অবাক হলো কিশোর। মাত্র তিন ফুট দূরে ওর বুকের দিকে তাকিয়ে আছে রাইফেলের নল। কিন্তু ভয় পাচ্ছে না।

 মিস্টার মিলার, আবার বলল উলফ, সরান ওটা। আপনি জানেন, আমাকে গুলি করতে পারবেন না।

জবাব দিলেন না মিলার। আস্তে আস্তে নামালেন রাইফেলটা।

উলফ বলল, আসুন আমার সঙ্গে। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করি? আগেও যেমন বহুবার করেছি। আমাদের মেহমানদের অহেতুক ভয় দেখাচ্ছেন আপনি। ওদের ঘুমোতে দিচ্ছেন না।

কিন্তু দেরি হয়ে গেছে তো অনেক… বিড়বিড় করলেন মিলার।

না, হয়নি। এখনও সময় আছে। আসুন।

দ্বিধা করলেন মিলার। রাইফেলটা লাঠির মত করে ধরে ভর দিলেন তাতে। আবার আমার সঙ্গে চালাকি করছ না তো?

না না, করছি না।

জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিলার। মাথা কাত করলেন, ঠিক আছে। চলো।

তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরল উলফ, এই, তোমরা ঘরে যাও। শুতে যাও। আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না।

মিলারকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল সে।

*

রোজারের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল কিশোর।

কোথায় যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল রবিন।

জবাব না দিয়ে রোজারের ঘরের দরজা খুলে ফেলল কিশোর। ঢুকে পড়ল ভেতরে। বারুদের গন্ধ এসে ধাক্কা মারল নাকে। বড় একটা সিটিং রম। ঝকঝকে ক্রোমের আসবাবপত্র, সাদা চামড়ায় মোড়া গদি। কাচের কফি টেবিলে রাখা রূপার একটা কেটলি আর কয়েকটা চীনামাটির কাপ পিরিচ। কাউচের পেছনে সাদা একটা কাঠের টেবিল।

পেছনের দেয়ালে দুটো দরজা। অন্য ঘরে যাওয়ার জন্যে নিশ্চয়। রবিন। বলল, রোজার কোথায়?

ঘরে রোজারও নেই, মহিলাও নেই। মেঝেতে রক্তও নেই।

ভেতরের ঘরে আছে হয়তো, মুসা বলল।

কিন্তু চিৎকার তো এঘরেই শুনলাম।

গুলি খাওয়ার পর হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেছেন…

মেঝেতে সাদা কার্পেট পাতা। একফোঁটা রক্তের দাগ নেই।

এগিয়ে গিয়ে বায়ের দরজাটা খুলে ফেলল কিশোর। ভেতরে উঁকি দিল। ছোট একটা বেডরূম। টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। এলোমেলো হয়ে আছে চাদর, বালিশ সব। খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন স্তূপ করে রাখা হয়েছে একপাশের দেয়াল ঘেষে। আরেকপাশে একটা বুকসেলফ। তাকের বই সব এলোমেলো। কুচকানো, ময়লা কয়েকটা শার্ট-প্যান্ট অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছে মেঝেতে।

এটা নিশ্চয় মিলারের ঘর, অনুমান করল সে।

কই, রোজার তো এখানে নেই! কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে বলল বিস্মিত মুসা।

ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। তাড়াতাড়ি গিয়ে ডানের দরজাটা খুলল। এটাও বেডরূম। আগেরটার চেয়ে বড়। এটা অন্যটার একেবারে বিপরীত। জিনিসপত্র সব নিখুঁতভাবে গোছানো। ঝকঝকে পরিষ্কার।

এখানেও নেই কেউ! এতক্ষণে কথা বলল কিশোর। মিস্টার রোজার নেই। মহিলাও নেই।

অসম্ভব! গেল কোথায়? বিড়বিড় করল মুসা। ভয় ফুটুল চোখে। এই, ভূতের কারবার না তো! একটা লাশ এভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে না। সেই সঙ্গে একজন জ্যান্ত মানুষ…

একজন নয়, মনে করিয়ে দিল রবিন, দুজন। কোরিকেও খুঁজে পাচ্ছি না আমরা।

.

১৩.

টোয়াইলাইট জোনে প্রবেশ করলাম নাকি আমরা? ধপ করে বিছানায় মুসার পাশে বসে পড়ল রবিন।

কথা বোলো না, আমাকে ভাবতে দাও, ওদের সামনে পায়চারি করতে করতে বলল কিশোর। মাথা গরম হয়ে গেছে আমাদের। ঠিকমত চিন্তা করতে পারছি না। সেজন্যেই উল্টোপাল্টা মনে হচ্ছে সব।

কিশোর, প্লীজ, এভাবে পায়চারি কোরো না। মাথাটা আরও গরম হয়ে যাচ্ছে আমার।

বোঝার চেষ্টা করছি আমি, আনমনে বলল কিশোর। রবিনের কথা যেন শুনতেই পায়নি। পায়চারি থামাল না। বাইরে দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যে তিনজন মানুষকে কথা বলতে শুনেছি আমরা। তর্কাতর্কি করছিল। তারপর গুলির শব্দ। এবং তারপর ঘর থেকে ছুটে বেরোলেন মিলার।

লাশটাকে টেনেহিঁচড়ে কোথাও সরিয়ে ফেলেছেন মিলার, অস্বস্তিতে বিছানায় নড়েচড়ে বসল রবিন। আশেপাশেই কোথাও আছে।

থমকে দাঁড়াল কিশোর। দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে আরও ভালমত খোঁজা উচিত আমাদের। বিছানার নিচে। আলমারির ভেতর।

কিন্তু যদি মিলার চলে আসেন? দরজার দিকে তাকিয়ে বলল রবিন। রাইফেলটা এখনও তার কাছে। আমাদের ঘরে দেখলে রেগে গিয়ে গুলি করে বসতে পারেন। একটা খুন ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন…

 জলদি সারতে হবে আমাদের। তিনজন তিন ঘরে খুজব, তাতে তাড়াতাড়ি হবে। তোমরা অন্য ঘরে যাও, আমি এখানে খুঁজি। এটা নিশ্চয় মিলারের ঘর।

কিন্তু কিশোর

যাও, দেরি কোরো না! বিছানার নিচে উঁকি দেয়ার জন্যে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল কিশোর

বেশ, অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল রবিন। মুসা, এসো।

ওরা দুজন বেরিয়ে আসার দুই মিনিটের মাথায় দরজায় এসে দাঁড়াল কিশোর। উত্তেজিত স্বরে বলল, দেখে যাও! কি পেয়েছি।

চমকে গেল মুসা। লাশটা নাকি?

জবাব না দিয়ে দ্রুত আবার মিলারের ঘরে ফিরে এল কিশোর। পেছন পেছন এসে ঢুকল অন্য দুজন।

এই দেখো, বড় একটা ফটো অ্যালবাম তুলে দেখাল কিশোর।

 দেখার জন্যে কাছে এসে দাঁড়াল মুসা আর রবিন।

 দেখতে দেখতে রবিন বলল, পুরানো ছবি। যে রকম কালো হয়ে গেছে, মনে হয় একশো বছরের পুরানো।

না, এত পুরানো নয়, একটা ছবিতে আঙুল রাখল কিশোর, দেখো তো এটা চিনতে পারো কিনা?

নাইট শ্যাডোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় সেডান গাড়ি। ফিফটির। মডেল। সুন্দর রোদ ঝলমলে দিন। অলঙ্করণ করা দামী গাড়িটায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ–একজন পুরুষ, আরেকজন মহিলা।

এ তো রোজার মেলবয়েস, রবিন বলল। চুল এত কালো, চেনাই যায় না।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। সঙ্গের মহিলাটিকে চিনতে পারো নাকি দেখো তো?

খাইছে! চিনে ফেলল মুসা। এ তো কোরির আন্টি! আন্ট জোয়ালিন।

হ্যাঁ। অবাক লাগছে না? তারমানে জোয়ান বয়েসে খাতির ছি দুজনের…

হলওয়েতে শব্দ হলো। হাত কেঁপে গেল কিশোরের। অ্যালবামটা মেঝেতে পড়ে গেল। তোলার চেষ্টা করল না। দরজার দিকে তাকিয়ে রইল।

কেউ এল না।

বেরোনো দরকার, ফিসফিস করে বলল রবিন। মিলার কখন ঢুকে পড়েন…

হ্যাঁ, ওর সঙ্গে একমত হলো মুসা। অ্যালবামের ছবি দেখে কোন। লাভ হবে না আমাদের। বরং তাড়াতাড়ি গিয়ে পুলিশকে খবর দেয়া দরকার। ওরা এসে খোঁজাখুঁজি যা করার করুক।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। এখানে কোথাও একটা ট্র্যাপোর আছে নিশ্চয়। রোজারকে গুলি করার পর লাশটা ওই পথে সরিয়ে ফেলেছেন হয়তো মিলার। মহিলাও ওখান দিয়েই পালিয়েছে।

 কিন্তু রক্ত কই? প্রশ্ন তুলল রবিন। এক ফোঁটা রক্তের দাগও তো নেই কোথাও।

এটাই গোলমাল করে দিচ্ছে সব। কিছু বুঝতে পারছি না!

কিশোর, আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক না। এসব কথা বাইরে গিয়েও আলোচনা করতে পারব আমরা। মিলার ঢুকে পড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

দাঁড়াও, আরেকটু দেখে নিই।

খুঁজতে শুরু করল কিশোর। দেয়ালে থাবা দিয়ে দেখল ফাপা আছে। কিনা। টেবিল ল্যাম্প উল্টে দেখল। ড্রেসার-ড্রয়ারের নব ঘুরিয়ে দেখল।

কি করছ তুমি? জানতে চাইল রবিন।

দেখছি গুপ্তদরজা খোলার কোন গোপন সুইচ আছে কিনা, দেয়ালে একটা লাইট সুইচ দেখে সেটা টিপে দিল কিশোর। আরি দেখো দেখো!

বুকসেলফটা রিভলভিং ডোরের মত ঘুরতে আরম্ভ করেছে। অর্ধেক ঘুরে থেমে গেল। বইয়ের তাক চলে গেল অন্যপাশে, এপাশে চলে এল একটা ডেস্ক।

আবার সুইচ টিপল কিশোর। ডেস্কটা ঘুরে আবার বুক শেলফটা ঘুরে এপাশে আসতে শুরু করতেই সুইচ টিপে অফ করে দিল সে। মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল ঘোরা। ফাঁক দিয়ে দেখা গেল অন্যপাশে আরেকটা ঘর।

ফাঁকটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল কিশোর। ফিরে তাকিয়ে বন্ধুদের বলল, এটা স্টাডিরূম। দেখে যাও।

লাশটা আছে? উঁকি দিল রবিন। কিন্তু অন্ধকারের জন্যে কিছু দেখতে পেল না। টেবিলে পেপারওয়েট চাপা দেয়া একটা কাগজের দিকে চোখ পড়তে স্থির হয়ে গেল দৃষ্টি। হাত বাড়িয়ে তুলে নিল কাগজটা। একবার পড়েই হাত কাঁপতে শুরু করল। কিশোর।

কি?

 জলদি এসো! কি লিখেছে দেখো!

 এপাশে বেরিয়ে এল কিশোর। রবিনের গা ঘেঁষে এল মুসা।

জোরে জোরে পড়তে শুরু করল রবিন,

ডিয়ার জোয়ালিন,
 মর্মান্তিক এই খবরটা তোমাকে জানাতে কি যে কষ্ট লাগছে আমার বলে। বোঝাতে পারব না। তোমার বোনঝি কোরি আর ওর তিন বন্ধু কিশোর, মুসা এবং রবিন হঠাৎ করে দ্বীপ থেকে রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। ওদের কি হয়েছে, কোথায় গেছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

কি যে মানসিক যন্ত্রণা হচ্ছে আমার বলে বোঝাতে পারব না। পাইরেট আইল্যান্ডের পুলিশকে খবর দিয়েছি। ওরা এসে দ্বীপের প্রতিটি ইঞ্চি খুঁজে দেখেছে। কিছুই পায়নি। কোন সুত্র নেই। দিনেরাতে বহুবার ফোনে তোমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। না পেরে শেষে এই চিঠি লিখে জানাতে বাধ্য হলাম।

ঘটনাটা অদ্ভুত। মাথামুণ্ড কিছু বুঝতে পারছি না। পুলিশ কোন আশা দিতে পারছে না। রহস্যময় এই ঘটনায় ওরাও পুরোপুরি বিমূঢ় হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েগুলোর বাবা-মাকে যে কি জবাব দেব ভেবে ভয়ে পালাতে ইচ্ছে করছে আমার। তোমার মুখোমুখি হওয়ার সাহসও আমার নেই।

 যাই হোক, ওদেরকে খুঁজে বের করার সাধ্যমত চেষ্টা আমি করছি। ওদের এই উধাও হওয়ার রহস্য ভেদ না করা পর্যন্ত আমি ক্ষান্ত হব না। সারাক্ষণ দোয়া করছি, ছেলেমেয়েগুলো সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসুক। কিন্তু বুঝতে পারছি, সেটা ঘটার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। অতীতেও এধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে এই দ্বীপে। হারানো মানুষকে আর জ্যান্ত ফিরে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে তাদের গলিত লাশ, কিংবা শুকনো কঙ্কাল। কি আর বলব, বলো? দ্বীপের এই বদনামের কথা তুমি তো সবই জানো।

মুখ তুলল রবিন। কাঁপা গলায় বলল, নিচে সই করেছেন মিলার মেলবয়েস! তারিখটা আজ থেকে দুদিন পরের!

.

১৪.

আমাদের খুন করার প্ল্যান করেছে সে! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে মুসার।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন, দাঁড়িয়ে আছ কেন এখনও? চলো না পালাই!

পাগল! বদ্ধ উন্মাদ! রবিনের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নীরবে আরেকবার পড়ল কিশোর। বিশ্বাস হতে চাইছে না তার। রসিকতা করেনি তো?

কার সঙ্গে করবে? কেন?

আমাদের খুন করতে চায় কেন?

কি করে বলব? পাগলের তো কত রকম ইচ্ছেই থাকে। অকারণেও অনেক কিছু করে। লোকটা একটা স্যাডিস্ট।

হু! নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর, উলফও কি এতে জড়িত আছে নাকি? নইলে রোজারকে খুন করা হয়েছে শুনেও পুলিশে খবর দেয়নি কেন?

দেয়নি, কি করে বুঝলে? জিজ্ঞেস করল মুসা।

 তাহলে এতক্ষণে পুলিশ চলে আসার কথা। পাইরেট আইল্যান্ড থেকে আসতে ওদের দশ-বারো মিনিটের বেশি লাগবে না।

আমরাও তো খবরটা দিতে পারি।

কি ভাবে? রবিনের প্রশ্ন। ফোন করতে গেলেই দেখে ফেলবে উলফ। ওদিকেই রয়েছে সে আর মিলার।

তাহলে নৌকা নিয়ে নিজেরাই চলে যেতে পারি পাইরেট আইল্যান্ডে। ঘাটে তো নৌকা বাধাই আছে।

আমাদের ব্যাগট্যাগ সব, সঙ্গে নিয়ে চলে যাব। একবার বেরোতে পারলে এখানে ফিরে আসার আর কোন মানে হয় না।

কিন্তু কোরির কি হবে? চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। ওকে এখানে ফেলে যেতে পারি না। মিলার ওকে দেখলেই খুন করবেন।

কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে ওকে? রবিন বলল, তাড়াতাড়ি গিয়ে পুলিশ নিয়ে এলে ওরাই ওকে খুঁজে বের করবে। উলফ আর মিলার এসে আমাদের আটকে ফেলার আগেই পালানো দরকার। চলো চলো, আর দেরি করা যায় না।

দাঁড়িয়েই রইল কিশোর। সমস্ত প্রশ্নের জবাব না জেনে যেন বেরোতে ইচ্ছে করছে না তার। বলল, কিন্তু উলফ যদি আমাদেরকে মারার প্ল্যানই করে থাকে, তাহলে শুরু থেকেই জায়গা দিতে চাইল না কেন? কেন সময়। থাকতে আমাদের পালাতে বলল?

আরে বাবা, এসব কথা তো বাইরে গিয়েও ভাবা যাবে! পুরোপুরি অধৈর্য হয়ে পড়েছে রবিন। ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগল দরজার দিকে। মিলার ঢুকে পড়লে আর রক্ষা থাকবে না। কিশোরের হাত ধরে টান দিল সে, এসো।

হলওয়েতে বেরিয়ে এল ওরা। এদিক ওদিক তাকাল। কাউকে চোখে পড়ল না। ফিসফিস করে কিশোর বলল, সামনে দিয়ে বেরোনো যাবে না। উলফ কিংবা মিলারের চোখে পড়ে যেতে পারি। পেছন দিক দিয়ে পথ আছে, দেখেছি। ওটা দিয়ে বেরোব।

আমিও দেখেছি, মুসা বলল। কিন্তু ওটা তো রান্নাঘর দিয়ে গিয়ে বেরিয়েছে। যদি উলফ থাকে সেখানে?

থাকবে না। খেতে তো আর নিয়ে যায়নি মিলারকে। কথা বললে ওরা। ডাইনিং রুমে বসে বলবে।

যার যার ঘরে ঢুকে দ্রুতহাতে ব্যাগ গুছিয়ে নিল ওরা। ঘর থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে চলে এল হলওয়ের মাথায়। কয়েক ধাপ সিঁড়ি আছে। নিচে আরেকটা করিডর। নামতে শুরু করল। মচমচ করে উঠছে পুরানো কাঠের সিঁড়ি। ওদের মনে হচ্ছে বোমা ফাটার শব্দ হচ্ছে যেন। মিলার কিংবা উলফের চলে আসার ভয়ে সারাক্ষণ সন্ত্রস্ত রইল।

সিঁড়ির গোড়ায়, করিডর এগিয়ে গেছে রান্নাঘরের দিকে। করিডরের একপাশে আরেকটা দরজা, অর্ধেক খোলা। সেটার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। কিশোর। কান পাতল কেউ আছে কিনা বোঝার জন্যে। কারও কথা শোনা গেল না। কানে আসছে শুধু ওদের নিঃশ্বাসের শব্দ।

ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। কৌতূহল হলো কিশোরের। কেউ যদি না-ই থাকবে আলো কেন? সাবধানে ভেতরে উঁকি দিল সে। কোনও ধরনের স্টোর রূম ওটা। একধরনের তেলতেলে ভাপসা গন্ধ। ভালমত দেখে বুঝল, স্টোর রূম নয়, ট্রফি রূম। শিকার করা জন্তু-জানোয়ারের স্টাফ করা। আস্ত দেহ সাজানো রয়েছে টেবিল আর বেদীতে। দেয়ালে বসানো হরিণ, ভালুক, আর নেকড়ের মাথা। আরেকদিকের দেয়ালে চোখ পড়তেই অস্ফুট শব্দ করে উঠল কিশোর।

কি হলো? জানতে চাইল মুসা।

নীরবে হাত তুলে দেখাল কিশোর।

 তাকাল মুসা আর রবিন। পাথর হয়ে গেল যেন মুহূর্তে।

দেয়ালে হরিণের মাথার মতই বসানো রয়েছে চারজন মানুষের কাটা মুণ্ড।

*

বাইরে উষ্ণ রাত। ঝিঁঝির কর্কশ চিৎকার। গাঢ় অন্ধকার।

পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা। উলফের চোখে পড়েনি। বেরিয়েই দৌড় দিল সৈকতের দিকে।

লম্বা ঘাসে পা লেগে হুবহুস শব্দ হচ্ছে। কেয়ারই করল না। ঢাল, বালি, ঘাসের বাধা, কোনটারই পরোয়া করল না। একটাই ভাবনা, কোনভাবে নৌকার কাছে পৌঁছে যাওয়া। ধরা পড়লে ভাগ্যে কি ঘটবে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। আরও তিনটে মানুষের মাথা যোগ হবে ট্রফি রূমের দেয়ালে বসানো চারটে মাথার সঙ্গে।

কিশোর ভাবছে হতভাগ্য মানুষগুলো কে ছিল? নিশ্চয় হোটেলের গেস্ট। কোন কারণে হোটেল যখন বন্ধ ছিল, তিন গোয়েন্দার মতই হয়তো তখন এসেছিল বেড়াতে। উন্মাদ খুনী মিলারের পাল্লায় পড়ে আর ফিরে যেতে পারেনি। মরে গিয়ে ট্রফি রূমের শোভা বাড়াচ্ছে ওরা।

হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ঠাণ্ডা হয়ে আসতে চাইল হাত-পা। কোরিকে ইতিমধ্যেই খুন করে ফেলেনি তো মিলার? করে হয়তো গুম করে রেখেছে কোনখানে। ওদের তিনজনকেও শেষ করার পর ধীরেসুস্থে মুণ্ড কেটে নেবে। আর ভাবতে চাইল না সে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডকের গেটে পৌঁছে গেল ওরা। গেট খোলার জন্যে পাল্লা ধরে টান দিয়েই থেমে গেল মুসা। খাইছে! আটকানো!

ডিঙিয়ে যাব, রবিন বলল।

যাওয়া যাবে না। গেটের ওপর কাঁটা বসানো।

তাহলে?

 চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, হোটলে ফেরা ছাড়া উপায় নেই।

কি বলছ!

হ্যাঁ, আর কোন উপায় নেই।

তর্ক করল না মুসা বা রবিন। কিশোর যখন বলেছে, নিশ্চয় না ভেবে বলেনি।

দেরি না করে ছুটল আবার ওরা।

কিছুদূর এসে ফিরে তাকাল হোটেলের দিকে। ওপরতলার আলো দুটোও এখন নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে আছে বাড়িটা। কালো। আকাশের পটভূমিতে হালকা কালো এক বিশাল ছায়ার মত দেখাচ্ছে।

ঢালে জন্মে থাকা লম্বা ঘাসের পরে বন। সেদিক দিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ওদের। হোটেল থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে চায়।

 বৃষ্টিতে ভেজা ঢাল বেয়ে নামাটা তেমন কঠিন না হলেও ওঠা খুব মুশকিল। তার ওপর সঙ্গে রয়েছে ব্যাগের বোঝা। কয়েক মিনিটেই হাঁপিয়ে গেল।

মেঘের ফাঁকে উঁকি দিল মলিন চাঁদ। ঘোলাটে আলোয় অন্ধকার কাটল কিছুটা। বনের মধ্যে একটা পেঁচা ডেকে উঠল।

বালির ঢিপির মাথায় সবার আগে উঠল রবিন। ডকের দিকে তাকিয়েই থমকে গেল।

সেটা লক্ষ করল কিশোর। কাছে উঠে এসে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?

হাত তুলে দেখাল রবিন।

ডকের দিকে তাকিয়ে একই অবস্থা হলো কিশোরেরও। চাঁদের আলোয় দেখা গেল, ছোট্ট ডকে যেখানে নৌকাগুলো বাধা থাকত, সেখানটা এখন। খালি। একটা নৌকাও নেই।

খাইছে! মুসার মনে হচ্ছে বরফের মত শীতল একটা হাত খামচি দিয়ে ধরেছে তার মেরুদণ্ড। যাব কি করে?

যেতে পারব না, বিড়বিড় করে বলল কিশোর। দ্বীপ থেকে বেরোনোর পথও বন্ধ করে দিয়েছে।