ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

১০. পাদুকাবিলাসী বাক

১০. পাদুকাবিলাসী বাক

বুনো কুকুরদের আক্রমণ যেখানে ঘটেছিল, সেখান থেকে স্লেজচালক দুটির নির্দিষ্ট গন্তব্য ডসন নামক স্থানটির দুরত্ব ছিল চারশো মাইল। পথের মধ্যে পড়ল একটা প্রকাণ্ড নদী। নদীর জলস্রোত ছিল অতিশয় প্রখর। নিদারুণ শীত ওই নদীর কয়েক জায়গায় নিরেট বরফের মসৃণ চাদর বিছিয়ে দিয়েছিল বটে, কিন্তু অধিকাংশ স্থানেই শীতের আক্রমণ অগ্রাহ্য করে জলস্রোত ছিল অব্যাহত। নদীর যেসব জায়গায় বরফের আবরণে নিরেট জমি তৈরি হয়েছিল, সেইসব জায়গার উপর দিয়ে প্রাণ বিপন্ন করে কুকুরবাহিত স্লেজ চার্লিয়ে নদী পার হল ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্ট। নদীটা পার হতে তাদের সময় লেগেছিল ছয়দিন। খুব সহজে অবশ্য কার্য সম্পন্ন হয়নি। বরফের চাদর ভেঙে একবার তলদেশে প্রবাহিত জলস্রোতের মধ্যে পড়েগিয়েছিল পেরল্ট। ভেঙে-পড়া বরফের গর্তের দু-ধারে নিরেট বরফ ঢাকা জমির উপর হাতের লম্বা বাঁশটা আড়াআড়িভাবে আটকে দিয়ে পের কোনোরকমে সলিলসমাধি থেকে আত্মরক্ষা করল বটে, কিন্তু তুষারশীতল জলে তার সর্বাঙ্গ এমন অসাড় ও আড়ষ্ট করে দিল যে, গর্তের ভিতর থেকে উপরের নিরাপদ আশ্রয়ে উঠে আসার ক্ষমতা তার রইল না। ফ্রাঁসোয়া অতিকষ্টে বিপন্ন বন্ধুকে সলিলসমাধি থেকে উদ্ধার করল। আর-একবার গোটা স্লেজগাড়িটাই বরফ ভেঙে তলদেশে প্রবাহিত জলস্রোতের মধ্যে ছিটকে পড়ল। প্রাণপণ চেষ্টায় দুই বন্ধু যখন স্লেজসমেত কুকুর বাহিনীকে নদীগর্ভ থেকে জমাট বরফের উপর তুলে আনল– তখন দেখা গেল প্রচণ্ড ঠান্ডায় কুকুরদের জলে-ভেজা রোমশ দেহের উপর পড়ে গেছে নিরেট বরফের আবরণ!

আর একবার স্পিটজের পায়ের তলায় ভেঙে গেল বরফ– সঙ্গে সঙ্গে তার পতনজনিত দেহের ভার সমগ্র কুকুরবাহিনীকে জলের মধ্যে টেনে আনার উপক্রম করল। ৰাক আর ডেভ শক্ত বরফ-ঢাকা জমির বুকে নখ বসিয়ে নিজেদের বাঁচাতে সচেষ্ট হল। তাদের চেষ্টা হয়তো সফল হত না, কিন্তু স্লেজটাকে পিছন থেকে টেনে ধরে ফ্রাঁসোয়া কুকুরগুলোকে জলের মধ্যে পড়তে দিল না। ওই অবস্থা থেকে তাদের উদ্ধার করল পেরল্ট ডেভ আর বাক ছাড়া যে কুকুরগুলো স্পিটজের ছিটকে-পড়া দেহের টানে জলে পড়ে গিয়েছিল, একে একে পেরল্ট তাদের জল থেকে তুলে আনল।

শুধু বিপজ্জনক বরফ নয়, আরও একটা সমস্যা বাককে বিপন্ন করে তুলেছিল। দীর্ঘকাল মানুষের আশ্রয়ে থাকার ফলে বাক-এর পায়ের তলা ছিল নরম। কিন্তু তার সঙ্গী হাস্কি কুকুরদের পা ছিল দীর্ঘভ্রমণে অভ্যস্ত ও কঠিন– ফলে ওই কুকুরগুলো কঠিন বরফ মাড়িয়ে অনায়াসে ছুটত আর বাক চলত খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ছুটোছুটির পালা শেষ করে বিশ্রামগ্রহণের সময় হলেই বাক মড়ার মতো শুয়ে পড়ত। অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হলেও সে আহার্যগ্রহণের জন্য উঠতে চাইত না। ফ্রাঁসোয়া খাদ্য পৌঁছে দিত তার কাছে এবং নৈশভোজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রতি রাত্রেই তার পা মালিশ করে দিত।

অবশেষে সমস্যার সমাধান করল পেরল্ট তার নিজস্ব মোকাসিন জুতোর উপরাংশ কেটে সেই চামড়া দিয়ে বাক-এর জন্য চারটি জুতো বানিয়ে দিল সে। জুতো পরে পথ চলতে কষ্ট পায়নি বাক। একসময়ে অনুভব করল তার পায়ের তলা বেশ শক্ত হয়ে গেছে, জুতো ছাড়াই সে হাঁটতে পারে সহজভাবে। তখন জীর্ণ পাদুকা চারটি পথেই বিসর্জন দেওয়া হল।

.

১১. কুকুর যখন পাগল হয়

স্পিটজ ছিল দলের নেতা। দলের কোনো কুকুর অবাধ্য হলে তার দেহের উপর পড়ত স্পিটজের দাঁতাল চোয়ালের ধারাল দংশন। কিন্তু বাক সম্পর্কে তার অস্বস্তি ছিল। দক্ষিণের অধিবাসী কোনো কুকুর ইতিপূর্বে তুষার আচ্ছন্ন এই দুর্গম পথ অতিক্রম করতে পারেনি; পথশ্রমে শ্রান্ত দক্ষিণাঞ্চলের কুকুর পথের উপরেই হয়েছে মৃত্যুশয্যায় লম্বমান। বাক ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম। প্রথম প্রথম স্বল্প খাদ্য, দুরন্ত শীত আর কঠিন পরিশ্রম তাকে কাবু করে ফেললেও শেষ পর্যন্ত সে তার সহকর্মী হাস্কি কুকুরদের মতোই কষ্টসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল। তার প্রচণ্ড শারীরিক শক্তি আর পরিবর্তিত হিংস্র চরিত্র স্পিটজকে উদবিগ্ন করে তুলেছিল।

কয়েকদিন পরে একটি অভাবিত দুর্ঘটনা দুই শত্রুর তিক্ত সম্পর্ককে আরও বেশি তিক্ত করে দিল। একদিন সকালে ফ্রাঁসোয়া যখন কুকুরদের স্লেজগাড়িতে জুতে রওনা হওয়ার উপক্রম করছে, সেইসময় প্রভাতের স্তব্ধতা ভেদ করে জাগল শ্বাপদকণ্ঠের তীব্র উৎকট ধ্বনি! ডলি নামে মেয়ে কুকুরটির গলা থেকে বেরিয়ে এসেছে ওই ভয়ংকর শব্দ!

ডলির চিৎকার শুনে ভয়ে চমকে উঠল কুকুরের দল। একবার মাত্র চেঁচিয়ে উঠেছিল ডলি, পরক্ষণেই সে তেড়ে গেল বাক-এর দিকে। বাক লড়াই করার চেষ্টা করল না, ডলির জ্বলন্ত চোখে সে উন্মাদের লক্ষণ দেখতে পেয়েছিল– সভয়ে পিছন ফিরে দৌড় দিল সে। বাক জানত পাগলা কুকুরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে তার মৃত্যু নিশ্চিত- ডলির চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েও সে রুখে দাঁড়াতে সাহস পেল না, চেষ্টা করল পালিয়ে বাঁচতে।

বাক ছুটছে আর ছুটছে, দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে তার গতি, তবু ডলির সঙ্গে তার দূরত্ব কমে আসছে। ডলির দেহে এখন উন্মাদের অস্বাভাবিক শক্তি, প্রাণপণে ছুটেও বাক তার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারছে না- ডলি একেবারে তার কাছে এসে পড়ল…

প্রাণের আশা যখন বাক ছেড়ে দিয়েছে, সেইসময় তার কান এল ফ্ৰসোয়র কণ্ঠস্বর- তার প্রভু তাকে ডাকছে। চোখ তুলে একবার সে ফ্রাঁসোয়ার মুখের দিকে চাইল, তারপর তিরবেগে ছুটে আসতে লাগল প্রভুর দিকে। বাক দেখল উদ্যত কুঠার হাতে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রাঁসোয়া। সে বুঝল এই প্রভুই তাকে বাঁচাতে পারে। ফ্রাঁসোয়ার পাশ দিয়ে বাক ছুটে বেরিয়ে গেল, তাকে অনুসরণ করে ফ্রাঁসোয়ার পাশে এসে পড়ল ডলি আর তৎক্ষণাৎ কুঠার তুলে ভীষণ জোরে আঘাত হানল ফ্রাঁসোয়া ডলির মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। বুনন কুকুরের দংশনে উন্মাদ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল ডলি।

ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে বাক-এর দম ফুরিয়ে এসেছিল, অতিকষ্টে হাঁফাতে হাঁফাতে শ্বাসগ্রহণের চেষ্টা করছিল সে। স্পিটজ বুঝল এই সুযোগ, ক্লান্ত অবসন্ন বাক-এর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে দাঁত বসিয়ে দিল। স্পিটজের ধারাল দাঁত মাংস ভেদ করে হাড় পর্যন্ত পৌঁছে গেল– বাক বাধা দিল না, কারণ বাধা দেবার ক্ষমতা তার তখন ছিল না।

 বিপন্ন বাককে সাহায্য করতে আবার এগিয়ে এল ফ্রাঁসোয়া। তার চাবুক পড়তে লাগল স্পিটজের সর্বাঙ্গে। ইতিপূর্বে ফ্রাঁসোয়ার হাতে এমন ভীষম মার খায়নি কোনো কুকুর। মহা-আনন্দে দৃশ্যটাকে উপভোগ করল বাক। এই ঘটনার পর বাক একটা চরম সিদ্ধান্তে উপস্থিত হল- এতদিন সে শুধু আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে, এইবার আক্রান্তের ভূমিকা ছেড়ে আক্রমণকারীর ভূমিকাতেই অবতীর্ণ হবে।

.

১২. সংঘাত

বাক এবার নেতা হল। ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্ট পরিচার্লিত স্লেজবাহক কুকুরদের অবিসংবাদিত নেতা এখনও স্পিটজ, কিন্তু পূর্বোক্ত কুকুরদের মধ্যে যে বিদ্রোহী দলটার সৃষ্টি হয়েছে, সেই দলের অবিসংবাদিত নেতা হল বিপুল বপু বাক।

একদিন সকালে প্রচণ্ড তুষারপাতের পর পাইক নামে অলস কুকুরটিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। কুকুরদের তখন স্লেজগাড়িতে জুতে দেওয়া হচ্ছে, একটু পরেই স্লেজ ছোটানো হবে, চিৎকার করে পাইকের নাম ধরে ডাকছে ফ্রাঁসোয়া- কিন্তু কোথায় পাইক? সে যেন হঠাৎ হাওয়ায় মিশে গেছে, তার সাড়াশব্দ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকের এই অবাধ্য আচরণে ক্রুদ্ধ স্পিটজ হানা দিয়ে ফিরতে লাগল সব জায়গায়, তবু তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। পাবে কি করে? এক ফুট গভীর তুষারের তলায় গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়েছিল পাইক।  

অবশেষে পলাতককে খুঁজে পেল স্পিটজ এবং হিংস্ৰদন্ত বিস্তার করে পলাতককে শাস্তি দিতে উদ্যত হল। কিন্তু স্পিটজের উদ্যম ব্যর্থ করে দিয়ে দুই কুকুরের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাক, তার প্রকাণ্ড দেহের ধাক্কায় ছিটকে পড়ল স্পিটজ। এতক্ষণ ভয়ে কাঁপছিল পাইক, এইবার বাককে তার হয়ে রুখে দাঁড়াতে দেখে সে সাহস পেল- সগর্জনে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্পিটজের উপর। দুই শত্রুর মিলিত আক্রমণের মহড়া নেওয়ার ক্ষমতা স্পিটজের ছিল না, সে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। ব্যাপারটা দেখে ফ্রাঁসোয়ার মুখে ফুটল চাপা হাসি, কিন্তু শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে সে চাবুকপেটা করল বাককে আর সেই সুযোগে স্পিটজ ভালোভাবেই দাঁতের ধার পরখ করল পাইকের দেহে।

এই ঘটনার পর দেখা গেল দলের অধিকাংশ কুকুরের মধ্যে বিদ্রোহের সঞ্চার হয়েছে। দলের কোনো কুকুরকে যখনই শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্যে শাস্তি দিতে উদ্যত হয়েছে স্পিটজ, তখনই মুর্তিমান বিঘ্নের মতো সেখানে হাজির হয়েছে বাক এবং অন্যায়কারীর সমর্থনে রুখে দাঁড়িয়েছে স্পিটজের বিরুদ্ধে। অবশ্য ফ্রাঁসোয়ার চোখের আড়ালেই ওইসব কাণ্ড ঘটত, দ্বিতীয়বার চাবুকের মার খেতে রাজি ছিল না বাক।

ক্রমশ এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল সব কুকুরের মধ্যে। কেউ আর স্পিটজের সারি সহ্য করতে ইচ্ছুক নয়। দলের মধ্যে আলস্য, বিশৃঙ্খলা আর লড়াই-এর ঘটনা ঘটতে লাগল বারবার। দুটি কুকুর অবশ্য বিদ্রোহীদের দলভুক্ত হতে সম্মত হয়নি- ডেভ আর সোল-লেকস।

বিদ্রোহীদের সাহস এমন বেড়ে গেল যে ভীতু পাইক পর্যন্ত একদিন স্পিটজের বরাদ্দ মাছ ছিনিয়ে নিয়ে খেয়ে ফেলল। কাছেই পাহারা দিচ্ছিল বাক, স্পিটজ কিছু করলেই সে তাকে বাধা দিতে প্রস্তুত- অতএব মনের রাগ মনেই চেপে স্পিটজ পাইকের দস্যুবৃত্তি হজম করে নিল। আর একদিন স্পিটজের বিরুদ্ধে মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াল ডাব আর ডো। একসঙ্গে দু-দুটো কুকুরের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা ছিল না স্পিটজের, সুতরাং অপরাধীদের শাস্তি না দিয়েই পিছু হটে এল স্পিটজ। দলের কুকুরগুলো ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠল, তারা আর স্পিটজকে দেখে ভয় পায় না। স্পিটজু তাদের ধমক দিলেই তারাও দাঁত খিঁচিয়ে তাকে পাল্টা ধমক দেয়। স্পিটজের সামনে এলেই বাক-এর সর্বাঙ্গে লোম খাড়া হয়ে উঠত এবং গলার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসত রুদ্ধ রোষের চাপা গর্জনধ্বনি।

বিদ্রোহ যদি তাঁবুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে বিশেষ ক্ষতি ছিল না। কিন্তু স্লেজ টেনে ছোটার সময়েও ককরদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠত। ঝগড়া, কামড়াকামড়ি, লাগাম জড়িয়ে স্লেজের গতিরোধ প্রভৃতি অবাঞ্ছনীয় ঘটনা ঘটতে লাগল অনবরত, প্রাণপণে চাবুক চার্লিয়েও যঁফ্রাঁসোয়া দলটার মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারল না। চাবুকের শাসন অগ্রাহ্য করে স্পিটজের বিরুদ্ধে হিংস্র বিদ্রোহ ঘোষণা করতে লাগল স্লেজবাহক সারমেয়-বাহিনী। ফ্রাঁসোয়া বুঝতে পারছিল বাক হচ্ছে এইসব অঘটনের নায়ক, সব নষ্টের গোড়া। কিন্তু তাকে হাতে-নাতে ধরার উপায় ছিল না– প্রথম দিন চাবুক খেয়েই সতর্ক হয়ে গিয়েছিল বাক, সব কিছুই করত সে ফ্রাঁসোয়ার অগোচরে।

সমগ্র দলটা যখন ডসন নামক গন্তব্যস্থলে পৌঁছল তখন কুকুরদের মধ্যে শৃঙ্খলার বালাই ছিল না, যে-যার ইচ্ছেমতো চলছে। স্পিটজের পক্ষে উক্ত বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করাও ছিল অসম্ভব। যে-সব সংবাদ পরিবেশনের ভার ছিল পেরন্টের উপর, সেগুলো বিলি করতে তার দেরি হল। কুকুরদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে না পারার জন্য পেরল্ট দায়ী করল বন্ধুকে, আর বন্ধুর

ফ্রাঁসোয়াও তার জবাব দিল কুদ্ধকণ্ঠে। কুকুরদের কলহ এবার ছড়িয়ে পড়ল তাদের মনিবদের মধ্যে। স্পিটজের সর্দারি যে ফুরিয়ে গেছে তা বুঝতে পেরে ভারি খুশি হয়ে উঠল বাক।

.

১৩. মৃত্যুপণ দ্বৈরথ

 এক রাতে নৈশভোজের পর ডাব নামে কুকুরটি বরফ-ঢাকা প্রান্তরের উপর একটি খরগোশ দেখতে পেল। সঙ্গেসঙ্গে সে খরগোশটাকে তাড়া করল। তার পিছনে ছুটল সমগ্ৰ কুকুরবাহিনী। কাছেই ছিল উত্তর-পশ্চিম পুলিশ বাহিনীর তাবু- সেই তাবু থেকে পঞ্চাশটা হাস্কি কুকুর বেরিয়ে এসে ডাব এবং তার সঙ্গীদের দলে যোগ দিল। তুষারাবৃত প্রান্তরের উপর খরগোশের পিছনে তাড়া করে ছুটতে লাগল কুকুরদের এক বিশাল বাহিনী।

দারুণ ঠান্ডায় জমে-যাওয়া নদীর নিরেট বরফের উপর দিয়ে ছুটল ভয়ার্ত খরগোশ, তারপর হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে নদীর ছোটো খাড়ির ভিতর ঢুকল সে। তার হালকা শরীর যেন উড়ে চলল বরফের উপর দিয়ে, কিন্তু অনুসরণকারী কুকুরদের পাগুলো জমাট তুষারের মধ্যে ঢুকে তাদের গতিবেগ কমিয়ে দিচ্ছিল। তবু পলাতক শিকারের পিছনে লেগে রইল নাছোড়বান্দা কুকুরের দল। দলটাকে পরিচালনা করে সর্বাগ্রে ছুটছিল বাক…।

এই ধরনের শিকারে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা ছিল স্পিটজের যেখানে খাড়ির মুখটা বেঁকে গেছে, দলের সঙ্গ ত্যাগ করে সেই বাঁকের মুখে উঁচু জমির উপর ওত পেতে পলাতকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরেই কুকুরদের তাড়া থেকে বাঁচতে বাঁকের মুখে উপস্থিত হল ধাবমান শশক সঙ্গেসঙ্গে এক লাফে শিকারের উপর পড়ে কামড় বসাল স্পিটজ। দুই দাঁতাল চোয়ালের কঠিন পেষণে তৎক্ষণাৎ প্রাণ হারাল নিরীহ খরগোশ।

কুকুরের দলটার নেতৃত্ব দিয়ে সকলের আগে-আগে ছুটে আসছিল বাক। সে যখন দেখল স্পিটজ তার শিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে, সে বুঝল এইবার চরম নিষ্পত্তির সময় হয়েছে- খরগোশের মৃত্যু দেখেও সে গতিবেগ একটুও সংযত করল না, ঝড়ের মতো এসে পড়ল স্পিটজের উপর, শুরু হল মৃতুপণ দ্বৈরথ। পরস্পরের দেহের সংঘাতে দুটি কুকুরই গড়িয়ে পড়ল তুষারের উপর। পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল স্পিটজ এবং বাক-এর কাঁধে কামড় বসিয়েই এক লাফে সরে গেল নিরাপদ দূরত্বে। পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে সুযোগের অন্বেষণে ঘুরতে লাগল বাক আর স্পিটজ…

মরা খরগোশটাকে উদরসাৎ করে কুকুরের দল প্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা দুটিকে ঘিরে বসে পড়ল, তাদের চোখগুলো জ্বলতে লাগল হিংস্র আগ্রহে।

দ্বৈরথ রণে অভিজ্ঞ যোদ্ধা স্পিটজ। বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন ধরেনর কুকুরের সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হয়েছে সে। বারংবার দংশনে বাক-এর স্কন্ধদেশ রক্তাক্ত করে দিল স্পিটজ, কিন্তু বাক একবারও শত্রুকে স্পর্শ করতে পারল না- আঘাত করা তো দূরের কথা। কুকুরের দল তাদের ঘিরে অপেক্ষা করছিল দুই যোদ্ধার মধ্যে যে ধরাশায়ী হবে, তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে শেষ করবে তারা। বাক-এর দম ফুরিয়ে এসেছিল, একবার স্পিটজের ধাক্কা খেয়ে সে ছিটকে পড়ল মাটির উপর অপেক্ষমাণ সারমেয়-বাহিনী হিংস্র আগ্রহে উঠে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু তারা ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই ভূমিশয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়ল বাক; কুকুরের দলও আবার বসে পড়ল যোদ্ধাদের ঘিরে এক সুবিশাল জীবন্ত বৃত্তের আকারে।

বাক এতক্ষণ তার সংস্কার আর দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করছিল, এইবার সে তার মস্তিষ্ককে ব্যবহার করল– দ্রুতবেগে প্রতিদ্বন্দ্বীর গলা লক্ষ্য করে কঁপ দিল বাক, পরক্ষণেই নিশানা পরিবর্তন করে প্রায় শায়িত অবস্থায় ছুটে এসে কামড় বসাল স্পিটজের বাঁ পায়ের উপর। সেই প্রচণ্ড দংশনে ভেঙে গেল স্পিটজের বাঁ পা, তিন পায়ে ভর দিয়ে শত্রুর সম্মুখীন হল স্পিটজ। আবার একই কৌশল অবলম্বন করল বাক, ভেঙে গেল স্পিটজের পিছনের ডান পা। আবার আক্রমণ করল বাক, পিছনের দুই পা ভেঙে স্পিটজ এখন অসহায় শত্রুর আক্রমণের বেগ সামলাতে না পেরে সে আবার ধরাশায়ী হল। শত্রুর গলায় কামড় বসিয়ে এক লাফে সরে এল বাক, সঙ্গেসঙ্গে অপেক্ষমাণ কুকুরের দল ঝাঁপিয়ে পড়ল মরণাহত স্পিটজের উপর….

একটু দূর থেকে বাক তার শত্রুর মৃত্যুদৃশ্য উপভোগ করতে লাগল পরমানন্দে- তুষারাবৃত উত্তরাঞ্চলে এই নিয়মই প্রচলিত– হয় মারো, নয় মরো।

.

১৪. দলের নায়ক বাক

পরের দিন সকালে ফ্রাঁসোয়া যখন স্পিটজকে দেখতে পেল না এবং বাক-এর সর্বাঙ্গে রক্তাক্ত ক্ষতগুলো যখন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল তখনই সে বুঝল চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, মৃত্যুপণ দ্বন্দ্বযুদ্ধে জয়ী হয়েছে বাক।

একটা কুকুরের মতো কুকুর ছিল বটে স্পিটজ, বন্ধুকে উদ্দেশ করে বলল ফ্রাঁসোয়া, যেসব কুকুর দলের নেতা হওয়ার ক্ষমতা রাখে, তাদের মধ্যে সেরা ছিল স্পিটজ। লড়াইতেও সে ছিল ওস্তাদ। পেরল্ট, বাক-এর ক্ষতচিহ্নগুলো একবার তাকিয়ে দেখ।

দেখেছি, পেরল্ট বলল, স্পিটজ ওস্তাদ লড়য়ে বটে, কিন্তু বাক তার চেয়েও বড়ো ওস্তাদ। তা না হলে বাক-এর বদলে স্পিটজকেই আমরা দেখতে পেতাম। তবে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে- স্পিটজের মৃত্যুর পর দলের মধ্যে এখন আর গোলমাল হবে না। আমরা সময়মতো। কাজকর্ম করতে পারব।

সোল-লেকস নামে কুকুরটাকেই দলের অধিনায়ক স্থির করা হল। স্লেজবাহকদের মধ্যে যে স্থানটি সোল-লেকস নামক কুকুরটার জন্য নির্দিষ্ট ছিল, সেখান থেকে সরিয়ে দলের সর্বাগ্রে তাকে জুতে দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসে ফ্রাঁসোয়া দেখল দলের পুরোভাগে অধিনায়কের স্থান অধিকার করে দাঁড়িয়ে আছে বাক! সে এখন দলের নেতা হতে চায়।

ফ্রাঁসোয়া হেসে উঠল, কী ভেবেছ তুমি? স্পিটজকে হত্যা করেছ বলে তোমাকেই দলনেতা করা হবে? যাও, যাও, পিছনে যাও- নিজের জায়গায় দাঁড়াও।

বাক মনিবের আদেশ পালন করল না। সোল-লেকসকে তাড়া করে তার আগেকার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে আবার এসে দাঁড়াল দলের পুরোভাগে। সে তার পছন্দমতো জায়গা থেকে এক পা-ও নড়তে রাজি হল না। অবশেষে তার ঘাড়ের চামড়া টেনে ধরে জোর করে তাকে সরিয়ে দিল ফ্রাঁসোয়া।

সরালে কি হবে? বাক দলের নেতৃত্ব ছাড়তে রাজি নয়। সোল-লেকসকে দলের অধিনায়ক করে স্লেজের সামনে জুতে দেওয়ার উপক্রম করতেই দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে এল বাক আর সভয়ে পিছিয়ে এসে তাকে দলনায়কের জায়গা ছেড়ে দিল সোল-লেকস।

ফ্রাঁসোয়ার মুখে কৌতুকজড়িত হাসির রেখা মুছে গেল বাক ভেবেছে কী? গায়ের জোরে দলের নেতা হবে?- একটা মুগুর নিয়ে তেড়ে এল ফ্রাঁসোয়া।

বাক ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল। সোল-লেকসকে দলের পুরোভাগে দিয়ে সমস্ত কুকুরের দলটাকে স্লেজগাড়ির সঙ্গে জুতে দেওয়া হল। বাক তখনও সামনে আসেনি। ফ্রাঁসোয়া তাকে গাড়িতে জোতার জন্য ডাকল। বাক অনড়। সে মারধরের ভয় করে না, কিন্তু দলনায়কের স্থানে তাকে স্বীকৃতি না দিলে সে স্লেজ টানতে রাজি নয়! এবার পেরল্ট আর ফ্রাঁসোয়ার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, তারা মুগুর ছুঁড়ে মারল। চটপট সরে গিয়ে বাক আত্মরক্ষা করল। তাকে পাকড়াও করার জন্য তাড়া করতেই সে মনিবদের নাগাল থেকে দ্রুত সরে গেল। মনিবরা তাকে গালি দিল, সেও দাঁত খিঁচিয়ে জবাব দিতে লাগল– অবশ্য নিরাপদ দূরত্ব থেকে।

পেরল্ট তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে তাদের রওনা হওয়া উচিত ছিল। বোকার মতো ফ্রাঁসোয়ার দিকে তাকিয়ে কাঁধে ঝাঁকুনি দিল পেরল্ট। বন্ধুর ইঙ্গিত বুঝে সোল-লেকসকে দলের পুরোভাগ থেকে সরিয়ে এনে আগের জায়গায় তাকে জুতে দিল ফ্লাগোয়া।

এবার ডাকতেই ছুটে এল বাক, স্থানগ্রহণ করল দলের প্রথমে। জোর করেই দলের নেতা হয়ে গেল সে!

সমস্ত দলটা এতদিন যা-খুশি তাই করে এসেছে। অবশ্য বাক-ই তাদের প্রশ্রয় দিয়েছিল। তার নেতৃত্বেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল কুকুরদের মধ্যে। কুকুরগুলো হয়ে উঠেছিল অবাধ্য, অলস, বিশৃঙ্খল। এখন চট করে বাক-এর কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে নিয়ম শৃঙ্খলার বাঁধনে আবদ্ধ হতে তারা রাজি হল না। কিন্তু দলপতি বাক-এর প্রচণ্ড শাসন কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের বঝিয়ে দিল, যা হয়েছে তা হয়েছে- এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে বর্তমান অবস্থায় নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে রাজি না হলে দলপতির দাঁত তাদের শরীরকে করে দেবে রক্তাক্ত! অতএব কিছুদিনের মধ্যেই বিশৃঙ্খল দলটা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে স্লেজ টানতে শুরু করল।

পথের মধ্যে রিংক র‍্যাপিডস নামক জায়গায় দুটি নতুন হাস্কি কুকুরকে দলভুক্ত করা হল। তাদের নাম চিক ও কুনা। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের বুনো স্বভাবকে বদলে দিল বার্ক। তারা হয়ে উঠল কর্তব্যপরায়ণ স্লেজবাহক। ফ্রাঁসোয়া অভিজ্ঞ স্লেজচালক, ইতিপূর্বে ক্ষমতাশালী বহু দলনায়কের সাক্ষাৎ পেয়েছে সে কিন্তু দলের নেতা হিসাবে বাক-এর দক্ষতা তাকে বিস্ময়ে অভিভূত করে দিল।

স্ক্যাগওয়ে নামক স্থানে পৌঁছে তারা হিসাব করে দেখল চোদ্দো দিনের মধ্যে প্রতিদিন তারা প্রায় চল্লিশ মাইল পথ অতিক্রম করেছে। স্লেজবাহক দলপতির মধ্যে এমন গতিবেগের চাঞ্চল্যকর উদাহরণ ইতিপূর্বে কেউ স্থাপন করতে পারেনি– বাক প্রমাণ করে দিয়েছে দলপতি হিসাবে সে অনন্য।