১০. পলাতক জীবন

পলাতক জীবন

আগুনটাকে খুঁচিয়ে তার শিখাটাকে একটু বাড়িয়ে দিলাম, রিয়া দুই হাতে সেখান থেকে খানিকটা উষ্ণতা নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি কখনোই চিন্তা করি নি আমাকে এভাবে বন্য পশুর মতো লুকিয়ে থাকতে হবে।

আমি খুব দুঃখিত রিয়া।

কেন? তুমি কেন দুঃখিত ত্রাতুল?

আমার সাথে তোমার দেখা হল বলেই তো এই যন্ত্রণা। আমিই তো প্রথম বুঝতে পেরেছি যে এটা আসলে পরাবাস্তব জগৎ আমরা আসলে কৃত্রিম! যদি সেটা তুমি না জানতে তা হলে তোমার চমৎকার গেস্ট হাউজে আরামে থাকতে

একটা সত্য না জেনে আরামে থেকে কী হবে?

তোমার তাই ধারণা?

হ্যাঁ। রিয়া মাথা নেড়ে বলল, আমার মনে হয় সত্য কথাটা জানা খুব দরকার। জেনে হয়তো লাভ থেকে ক্ষতি বেশি হয় কিন্তু তবুও জানা দরকার। সত্য হচ্ছে সত্য।

কিন্তু এটা কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার! তুমি চিন্তা করতে পার আমরা কোনো একটা যন্ত্রের ভেতরে রাখা কিছু তথ্য? বিশ্বাস করতে পার?

রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, পারি না।

সে আরো কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, আমিও কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম, কোনো একটা বন্য পশু দূর দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। আমি গোপন তথ্যকেন্দ্রের কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সত্যিকারের ত্রাতুলের কাছে খবর পাঠানোর পর থেকে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন হন্যে হয়ে খুঁজছে। আমরা সেই থেকে বনে–জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।

রিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে বলেছিল এখানে সাতদিন থাকতে হবে। আজ তো সাতদিন হয়ে যাবে–এখন কী করবে বলে মনে হয়?

হয়তো তোমার স্মৃতিকে তোমার সত্যিকার অস্তিত্বে স্থানান্তর করে দেবে।

রিয়া চমকে উঠে বলল, আর তোমাকে?

আমি তুচ্ছ মানুষ সাধারণ মানুষ। আমার অস্তিত্বকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করবে না।

তা হলে? তা হলে কী হবে?

যন্ত্রের মাঝে রাখা সেই তথ্যগুলো মুছে দেবে–আমিও মুছে যাব।

রিয়া এক ধরনের যন্ত্রণাকাতর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হল সে আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। সে মাথা নেড়ে বলল, না না, এ কী করে হয়?

আমার রিয়ার জন্যে এক ধরনের মায়া হল। তার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম, তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। যা হবার হবে।

 রিয়া খপ করে আমার দুই হাত ধরে বলল, কী বলছ তুমি যে, যা হবার হবে? তোমার কিছু একটা হলে আমার কী হবে?

তোমার কিছুই হবে না। আমাদের এই কয়দিনের জীবন একটা স্বপ্নের মতো। তুমি কি স্বপ্নে দেখা কোনো মানুষের জন্যে কষ্ট পাও?

না। রিয়া মাথা নেড়ে বলল, এটা স্বপ্ন না। এটা সত্যি।

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। রিয়ার দিকে তাকিয়ে বুকের মাঝে সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের কষ্ট অনুভব করতে থাকি। এই অনুভূতির নামই কি ভালবাসা! রিয়ার সুন্দর মুখটির দিকে তাকিয়ে নিশ্চয়ই আমার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠেছিল, কারণ রিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হল তুমি হাসছ কেন?

আমি বললাম, হঠাৎ একটা কথা মনে হল তাই।

কী কথা?

সত্যিকারের রিয়া আর সত্যিকারের ত্রাতুলের কথা।

তাদের কী কথা?

সত্যিকারের পৃথিবীতে সত্যিকারের রিয়া হচ্ছে রাজকুমারী রিয়া–আর সত্যিকারের ত্রাতুল হচ্ছে একেবারে তুচ্ছ একজন মানুষ। তারা একজন আরেকজনকে চিনেও না। যদি তাদের মাঝে স্মৃতি স্থানান্তর না হয় তা হলে তারা কোনোদিন জানতেও পারবে না এই। পরাবাস্তব জগতে তারা কত কাছাকাছি দুজন মানুষ।

রিয়া আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি দেখলাম তার চোখে পানি টলটল করছে, সে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল, এটা চিন্তা করে তুমি হাসছ? হাসতে পারছ?

আমি রিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললাম, তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ, তোমার অনুভূতি পৃথিবীর সবচেয়ে পরিশুদ্ধ অনুভূতি! আমার বেলায় সেটা অন্যরকম, যেটা আনন্দের নয় তার মাঝেও কেমন জানি কৌতুক খুঁজে পাই।

রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, না, তুমি ওরকম করে কথা বলো না, কখনো বলো না।

আমি কোনো কথা না বলে আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

.

খুব ভোরবেলা হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আগুনের পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে রিয়া শুয়ে আছে। আমি একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম, কখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। আমার মনে হল কোনো একজন মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, শুকনো পাতা মাড়িয়ে কে যেন এগিয়ে আসছে। ভোরের আবছা আলোতে দেখতে পেলাম একজন। দীর্ঘদেহী মানুষ রিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে–মানুষটি এক হাতে আলতোভাবে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে রেখেছে।

আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম, মানুষটি নিঃশব্দে রিয়ার কাছে এগিয়ে এল, ঘুমন্ত রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল, আবছা আলোতে দেখা যাচ্ছে কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে হল তার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠেছে। মানুষটি আমাকে দেখে নি, আমি নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। যদি সে রিয়াকে আঘাত করার চেষ্টা করে আমার তাকে উদ্ধার করতে হবে। এটি পরাবাস্তব জগৎ হতে পারে, আমাদের অস্তিত্ব কৃত্রিম হতে পারে কিন্তু মানুষগুলো সত্যি।

মানুষটি তার অস্ত্র হাত বদল করল এবং একটা লিভার টেনে অস্ত্রটি পুরোটা রিসেট করে নিল, সেই শব্দে রিয়া হঠাৎ করে জেগে ওঠে। সে ধড়মড় করে উঠে বসল, বিস্ফারিত চোখে মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, কে? কে তুমি?

মানুষটি মাথার এলোমেলো সোনালি চুলকে পেছনে সরিয়ে বলল, আমার কোনো নাম নেই। অনেকে নুরিগা বলে ডাকে। আমি হচ্ছি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষগুলোর জিন্স নিয়ে আমাকে তৈরি করা হয়েছে।

রিয়া কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে নুরিগার দিকে তাকিয়ে রইল। নুরিগা হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমি শুনেছি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ হচ্ছ তুমি। তোমাকে দেখার একটা শখ ছিল।

রিয়া দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, এভাবে দেখা হবে আমি ঠিক বুঝতে পারি নি।

আমিও পারি নি। আমাকে সব সময় একটা খাঁচার মাঝে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখত। এখন কী মনে করে ছেড়ে দিয়েছে।

ছেড়ে দিয়েছে?

হ্যাঁ। শুধু ছেড়ে দিয়েছে তাই নয়, আমাকে একটা অস্ত্রও দিয়েছে। সেই অস্ত্র নিয়ে সারা রাত তোমাকে খুঁজছি।

আমাকে খুঁজছ?

হ্যাঁ। আমাকে বলেছে তোমাকে খুঁজে বের করতে। আমি অবিশ্যি সেজন্যে তোমাকে খুঁজি নি, নিজের কৌতূহলে খুঁজছি।

রিয়া শুকনো গলায় বলল, কিসের কৌতূহল?

দেখার কৌতূহল। প্রতিশোধ নেবার কৌতূহল।

প্রতিশোধ নেবার?

হ্যাঁ। দীর্ঘদেহী সোনালি চুলের মানুষটি তার অস্ত্রটি উদ্যত করে বলল, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ হিসেবে জন্ম নিতে চাই নি, কিন্তু আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ হয়ে জন্ম নিতে হয়েছে এবং শিকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় জীবন কাটাতে হয়েছে। তুমিও পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ হয়ে জন্ম নিতে চাও নি, কিন্তু তুমি সেভাবে জন্ম নিয়ে পৃথিবীর যত আনন্দ–সুখ সব ভোগ করছ। ব্যাপারটি ঠিক নয়–আমি সেই ত্রুটিটি শোধরাব।

কিছু বোঝার আগেই আমি দেখতে পেলাম নুরিগা তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি রিয়ার দিকে তাক করেছে। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, সাতদিন পর এভাবে তা হলে রিয়ার অস্তিত্বকে শেষ করে দেবার পরিকল্পনা করেছে? কিন্তু সেটি তো আমি হতে দিতে পারি না আমি নিঃশব্দে এগিয়ে পেছন থেকে মানুষটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

আমার আচমকা আঘাতে মানুষটি পড়ে গেল, তার হাতের অস্ত্রটি একপাশে ছিটকে পড়ল। আমি মানুষটিকে নিচে চেপে রেখে অস্ত্রটি হাতে তুলে নেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু মানুষটির শরীরে অমানুষিক জোর, ধাক্কা দিয়ে আমাকে নিচে ফেলে দিয়ে সে হিংস্র ভঙ্গিতে আমার টুটি চেপে ধরে। তার শক্ত লোহার মতো আঙুল আমার গলায় সঁড়াশির মতো চেপে বসে। আমি প্রাণপণে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করি কিন্তু তার অমানুষিক শক্তির কাছে আমি একেবারে অসহায়। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, এবং এক ধরনের অক্ষম আক্রোশে আমি মানুষটির মুখের দিকে তাকালাম–সোনালি চুল এবং সবুজ চোখের মানুষটিতে কী ভয়ংকর জিঘাংসা–

হঠাৎ করে মানুষটির হাত আলগা হয়ে গেল। সে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি? তুমি এখানে?

আমি কাশতে কাশতে কয়েকবার বুক ভরে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করতে করতে বললাম, তুমি আমাকে চেনো?

মানুষটি অবাক হয়ে বলল, কেন চিনব না? তুমি ভ্রাতুল। একটু আগেই তো তোমার সাথে কথা বললাম!

আমি মানুষটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিকার ভাতুলের সাথে এই মানুষটির যোগাযোগ হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষটির সাথে তার কেমন করে যোগাযোগ হল?

নুরিগা নামের মানুষটি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি এখানে কেমন করে এসেছ?

আমি গলায় হাত বুলিয়ে বললাম, সে অনেক বড় ইতিহাস।

নুরিগা মাথা নেড়ে বলল, তোমার সব কাজ, সব কথাবার্তা হেঁয়ালিপূর্ণ, তুমি সোজা ভাষায় কথা বলতে পার না?

কেন, কী হয়েছে? আমি কী বলেছি?

তুমি একটু আগে আমাকে বললে, রক্তের রঙ লাল।

তাই বলেছি? আর কী বলেছি?

আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? নুরিগা বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি জান না তুমি কী বলেছ!

তবু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।

বলেছ রক্তের রঙ সবুজ নয়। বলেছ আবার যখন দেখা হবে তখন সব বুঝিয়ে বলবে।

আমি নুরিগার দিকে তাকিয়ে রইলাম, নুরিগা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আবার দেখা হল এখন বুঝিয়ে বলল।

আমি কাঁপা গলায় বললাম, বলব। অবিশ্যি বলব। আমাকে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে দাও।

ঠাণ্ডা মাথায় কী ভাবতে চাও?

আমার কাছে যে তথ্যটা পাঠানো হয়েছে।

কে তথ্য পাঠিয়েছে?

আমি পাঠিয়েছি।

তুমি পাঠিয়েছ? তুমি কার কাছে পাঠিয়েছ?

আমি আমার কাছে পাঠিয়েছি।

নুরিগা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

.

রিগাকে প্রকৃত ব্যাপারটি বোঝানো খুব সহজ হল না। বোঝনোর পরও সে আমাদের কথা বিশ্বাস করল না। শেষ পর্যন্ত যখন সে বিশ্বাস করল তখন তার প্রতিক্রিয়াটি হল অত্যন্ত বিচিত্র। প্রথমে এক ধরনের অবর্ণনীয় আতঙ্ক এবং শেষে এক ভয়ংকর ক্রোধ। ক্রোধটি কার ওপর সে জানে না, একবার মনে হল প্রচণ্ড আক্রোশে সে রিয়া এবং আমাকেই শেষ করে দেবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিল। ক্রোধটি শান্ত হয়ে যাবার পর তার ভেতরে। এক বিচিত্র দুঃখবোধ এসে ভর করল। আহত পশুর মতো সে দুই হাতে নিজের মাথা আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। রিয়া গভীর মমতায় তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন কাঁদছ নুরিগা? 

আমি ভেবেছিলাম আমাকে ওরা মুক্তি দিয়েছে। আমাকে আর শেকল পরে খাঁচার ভেতরে থাকতে হবে না। কিন্তু আসলে মুক্তি দেয় নি। এই অস্তিত্বকে মুক্তি দিয়েছে–যেই অস্তিত্বের কোনো অর্থ নেই, কোনো মূল্য নেই!

আমি নরম গলায় বললাম, আছে। মূল্য আছে।

কীভাবে মূল্য আছে?

আমি এখনো জানি না। কিন্তু মনে নেই ত্রাতুল তোমাকে দিয়ে আমার কাছে খবর পাঠিয়েছে।

কী খবর পাঠিয়েছে?

রক্তের রঙ লাল, সবুজ নয়।

তার অর্থ কী?

আমি এখনো জানি না–কিন্তু সেই অর্থ খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের জানতে হবে কার রক্ত লাল নয় সবুজ।

কীভাবে সেটি জানবে?

প্রথমে যাই নেটওয়ার্ক কেন্দ্রে। লুকিয়ে থাকার দিন শেষ হয়েছে এখন সামনাসামনি প্রশ্ন করতে হবে।

নুরিগা তার চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল, বলল, চলো।

আমি তার হাত স্পর্শ করে বললাম, নুরিগা!

কী?

তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ কথাটি আমি বিশ্বাস করি না।

নুরিগা একটু হাসল, বলল, তুমি এই কথাটি আগেও আমাকে বলেছ।

সত্যি?

হ্যাঁ। সত্যি। নুরিগা আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, তোমাকে ধনবাদ। ত্রাতুল। এই একটি কথা কারো মুখ থেকে শোনা খুব প্রয়োজন ছিল।

ধন্যবাদ।

নুরিগা এবারে ঘুরে রিয়ার দিকে তাকাল, তারপর শোনা যায় না এরকম গলায় বলল, রিয়া আমি দুঃখিত যে তোমাকে আমি খুন করতে চেয়েছিলাম।

রিয়া হেসে ফেলল, আমার মনে হয় কিছু একটা করতে চাওয়া আর কিছু একটা করার মাঝে অনেক বড় পার্থক্য। আমি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ, কিন্তু আমার মাথায় কী চিন্তা আসে এবং আমি কী কী বিদঘুঁটে কাজ করতে চাই শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।

নুরিগা অনেকটা আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি। আমাকে সব সময় বলা হয়েছে আমি খারাপ–আমাকে জঘন্য অপরাধ করতে হবে। কিন্তু এখন দেখছি সেটা সত্যি নয়। তোমাদের সাহায্য করব চিন্তা করেই আমার ভালো লাগছে। অন্য রকম একটা ভালো লাগার অনুভূতি!

হ্যাঁ। রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, আমার মনে হয় এটাই হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার গোপন কথা। অন্যের জন্যে কিছু একটা করা।

.

নেটওয়ার্ক কেন্দ্রে আমরা যখন পৌঁছেছি তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। পুরো এলাকাটির মাঝে এক ধরনের শান্ত এবং কোমল ভাব রয়েছে কিন্তু ঠিক কী কারণ জানি না, আজকে তার মাঝেও আমি এক ধরনের অস্থিরতা খুঁজে পেতে ক্ষ করেছি। কেন্দ্রের দরজায় আমি কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার আশঙ্কা করেছিলাম কিন্তু দেখা গেল সেরকম কিছু নেই। আমরা গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। লম্বা করিডর ধরে হেঁটে একটা প্রশস্ত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নুরিগা বলল, এই যে, এখান থেকে আমাকে যেতে দিয়েছে।

আমারও ঘরটির কথা মনে পড়ল, এখানেই আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং হয়েছিল। নুরিগা ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভেতরের মানুষেরা ঘুরে আমাদের দিকে তাকাল, তাদের মুখে এক ধরনের বিষয়। আমি মানুষগুলোকে চিনতে পারলাম, এরা আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করেছিল। লাল চুলের শিরান নামের মানুষটি বলল, তোমরা? তোমরা এখানে কেন এসেছ?

আমি একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম, বলছি কেন এসেছি। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমাদের হাতে সময় খুব বেশি নেই। তাই কোনো ভূমিকা না করে আমরা সোজাসুজি কাজের কথায় চলে আসি।

শিরান, রিকি বা ক্লিশা কেউ কোনো কথা বলল না, এক ধরনের স্থির চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, আমরা জানি এটা পরাবাস্তব জগৎ–এখানে আমরা সবাই কৃত্রিম, সবাই কোনো যন্ত্রের তথ্য। আমরা তথ্য হিসেবে থাকতে চাইছি না, আমাদের প্রকৃত অস্তিত্বের সাথে মিলিত হতে চাইছি। তাই আমরা সত্যিকার পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে এসেছি।

মানুষ তিনজন অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, রিকি মাথা নেড়ে বলল, তোমরা কী বলছ আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

আমি হেসে বললাম, তোমার কথা আমার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।

নুরিগা হঠাৎ দুই পা এগিয়ে এসে বলল, এরা সোজা কথা বুঝতে চায় না। আচ্ছা মতন রগড়ানি দিতে হবে। আমার চাইতে ভালো রগড়ানি কেউ দিতে পারে বলে মনে হয় না।

নুরিগা সত্যি সত্যি কিছু একটা করে ফেলে কি না সেটি নিয়ে আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠে তাকে থামানোর চেষ্টা করে বললাম, মাথা গরম করো না নুরিগা, কথা বলে দেখা যাক।

নুরিগা তার অস্ত্রটি ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তিনজনের একজনকে খুন করে ফেলি তা হলে অন্য দুটো সোজা হয়ে যাবে।

না না আগেই খুন করতে যেও না।

ঠিক আছে খুন না করতে পারি, কিন্তু রক্তের রঙটা তো পরীক্ষা করে দেখতে পারি বলে কিছু করার আগেই নুরিগা সামনে এগিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে রিকির মুখে এত জোরে আঘাত করল যে সে এক কোনায় ছিটকে গিয়ে পড়ল। ঠোঁটের পাশে কেটে রক্ত বের হয়ে এল এবং হাত দিয়ে সেই রক্ত মুছে রিকি হতচকিতের মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

নুরিগা হিংস্র গলায় বলল, লাল, এই বদমাইশটার রক্ত লাল।

ক্লিশা ফ্যাকাসে মুখে বলল, তোমরা ঠিক বুঝতে পারছ না। এই পরাবাস্তব জগতের নিয়ন্ত্রণে আমাদের কোনো হাত নেই। আমরা সত্যিকার জগতে যোগাযোগ করতে পারি না।

আছে। আমি কঠিন মুখে বললাম, আমি গোপনে সাধারণ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই বাইরের পৃথিবীতে যোগাযোগ করেছি। তোমরা নিশ্চয়ই পার।

পারি না। ক্লিশার কথা শেষ হবার আগেই নুরিপা তাকে আঘাত করে বসে এবং ক্লিশা ছিটকে গিয়ে দেওয়ালে আছড়ে পড়ল।

কী করছ তুমি নুরিগা– বলে রিয়া ক্লিশার কাছে ছুটে যায় এবং তাকে কোনোভাবে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়। বেকায়দা আঘাত লেগে তার নাক থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে।

নুরিগা হিংস্র চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ, মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার কী করে করতে হয় আমি জানি না। আমাকে যেটা শেখানো হয়েছে সেটাই করছি।

রিয়া মাথা নেড়ে বলল, না নুরিগা, তুমি এটা করতে পার না। মানুষকে আঘাত করতে হয় না।

আমি দুঃখিত রিয়া। কিন্তু আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তা ছাড়া তোমরাই বলেছ এটা পরাবাস্তব জগৎ। এখানে আমরা সবাই নকল। সবাই কৃত্রিম। সবাই কিছু তথ্য।

কিন্তু আমাদের অনুভূতিটি সত্যি।

আমি একমাত্র অক্ষত মানুষ শিরানের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, দেখো শিরান তুমি মনে হয় ব্যাপারটির গুরুত্ব বুঝতে পারছ না।

বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাদের কিছু বলার নেই।

আমি কঠিন গলায় বললাম, এই শেষবার তোমাকে বলছি, তুমি আমাদের বাইরে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দাও।

আমরা পারব না।

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, নুরিগা, তুমি এদেরকে একটু চোখে চোখে রাখ, আমি দেখি কী করতে পারি।

শিরান ভয়ার্ত গলায় বলল, তুমি কী করতে চাও?

এই রাবাস্তব জগতের সাথে পৃথিবীর একটা যোগসূত্র আছে। সেটা খুঁজে বের করে নষ্ট করতে চাই।

শিরান চমকে উঠল, বলল, অসম্ভব।

মোটেও অসম্ভব নয়। আমাকে তোমরা মোটেও গুরুত্ব দাও নি–কিন্তু এসব কাজ আমি খুব ভালো পারি। আমি পুরো পরাবাস্তব জগতের সব তথ্য ওলটপালট করে দেব। তোমাদের এতদিনের কাজ, গবেষণা এক সেকেন্ডে আবর্জনা হয়ে যাবে।

শিরান এবং তার সাথে অন্য দুজন তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ঘরের চতুষ্কোণ মডিউলটির উপর উঠে ভেতরে উঁকি দিলাম। অনেকগুলো প্রি–প্রসেসরের পাশে বড় বড় হিটশিল্ড লাগানো কিছু প্রসেসর। হোট ঘোট ক্রিস্টাল বসানো আছে দেখে বোঝা যায় অবলাল রশ্মি ভেতর দিয়ে ছোটাছুটি করছে, আমি টেবিল থেকে একটা স্কু ড্রাইভার নিয়ে দুটো ক্রিস্টালের মাঝে রাখতেই ভ্রু ড্রাইভারটি ভস্মীভূত হয়ে গেল, সাথে সাথে মুহূর্তের জন্যে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়, দূরে কোথাও একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল!

শিরান আমার দিকে ছুটে এসে বলল, কী করছ আহাম্মকের মতো? কী করছ তুমি?

আমি মুখে মধুর হাসি ফুটিয়ে বললাম, দেখতেই পারছ কী করছি। চেষ্টাচরিত্র করে পরাবাস্তব জগৎটা উড়িয়ে দিতে চাইছি!

তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

না, হয় নি। খুব ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করছি। তোমরা যদি আমার কথা না শোন এবারে আমি বড় প্রসেসরটা টেনে তুলে ফেলব, আমার হাতটা হয়তো কাবাবের মতো ঝলসে যাবে কিন্তু পরাবাস্তব জগতের কোন অংশটা ধ্বংস হবে বলো দেখি?

শিরান পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরে বলল, না, তুমি এটা করবে না। খবরদার ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে যেতে পারে। এত ভয়ংকর যেটা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না

কেন? কী হয়েছিল?

একবার শরীরের অর্ধেক অংশ উড়ে গেল, সব মানুষের অন্য অর্ধেক ঠিক আছে। ব্যাপারটা চিন্তা করেই শিরান শিউরে ওঠে।

আমি সেরকম কিছু করতে চাই না। কাজেই বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা করে দাও। তাড়াতাড়ি।

শিরান তার লাল চুলে আঙুল দিয়ে কী ভাবল খানিকক্ষণ, তারপর এগিয়ে দেওয়ালের সাথে লাগানো কেবিনেটটি খুলে চতুষ্কোণ একটা ধাতব বাক্স নিয়ে আসে। আমার হাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, সাড়ে তেরো টেরা হার্টজে সেট করে নিলে যোগাযোগ করতে পারবে।

চমৎকার! আমি যোগাযোগ মডিউলটা হাতে নিয়ে বললাম, এটা কি দ্বিপক্ষীয়?

না শিরান গোমড়া মুখে বলল, শুধু তথ্য পাঠাতে পারবে। তথ্য ফিরে আসবে না।

এর সাথে কি ট্র্যাকিং ডিভাইস আছে?

অবিশ্যি আছে, সব সময় থাকে। নিরাপত্তার একটা ব্যাপার আছে না?

তার মানে ব্যবহার করতে গিয়ে আমরা মারা পড়তে পারি?

শিরান কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল।

আমি একটা নিশ্বাস ফেলে ঘরে সবার দিকে তাকালাম, যে যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি যুদ্ধজয়ের ভঙ্গি করে বললাম, এখন আমরা বাইরের পৃথিবীতে খবর পাঠাতে পারব। চলো যাই। তবে যাবার আগে আমাদের পরাবাস্তব জগতের আরো কিছু তথ্য দরকার। আমি রক্তাক্ত রিকি এবং ক্লিশার দিকে তাকিয়ে বললাম, তথ্যগুলো কি তোমরা এমনি দেবে নাকি কিছু মারপিট করতে হবে?

ক্লিশা তার হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখের রক্ত মুছে ফেলার চেষ্টা করতে করতে বলল, দেওয়ার মতো কোনো তথ্য নেই। সব মিলিয়ে ছয়টা ভিন্ন ভিন্ন স্তর আছে। এক স্তর থেকে অন্য কোনো স্তরে যাওয়া যেত না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে এখন যাওয়া যায়।

গোলমাল?

হ্যাঁ, মনে হল প্রোগ্রামিং স্তরে পরিবর্তন করেছে। বেআইনি পরিবর্তন।

আমি আনন্দে হা–হা করে হেসে বললাম, জিগি! জিগি?

হ্যাঁ, জিগি নামে আমার একটা বন্ধু আছে, সে হচ্ছে এই ব্যাপারে মহাওস্তাদ। আমি নিশ্চিত আসল ত্রাতুল আসল জিগিকে নিয়ে তোমাদের নেটওয়ার্কে হানা দিয়েছে।

আমার উচ্ছাসে অন্য কেউ অংশ নিল না। বরং ক্লিশা, রিকি আর শিরান তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি যোগাযোগ মডিউলটা হাতে নিয়ে বললাম, অন্য ছয়টি স্তরে কেমন করে যাওয়া যায়?

ক্লিশা বলল, সব এক সমতলে চলে এসেছে। এই এলাকাটার পরেই অন্য এলাকা, তোমাদের খুঁজে নিতে হবে।

তোমাদের কাছে কো–অরডিনেট নেই?

সার্কুলার কো-অরডিনেট, থাকলেই কী না থাকলেই কী?

আমি রিয়া এবং নুরিগার দিকে তাকিয়ে বলাম, চলো যাই।

রিয়া এবং নুরিগা আমার পিছু পিছু ঘর থেকে বের হয়ে এল। আমরা যখন করিডরে পৌঁছেছি ঠিক তখন নুরিগা হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে বলল, তোমরা একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।

কোথা থেকে আসছ? আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সে প্রশস্ত ঘরটিতে ফিরে গেল, সেখানে প্রথমে একটু হটোপুটি তারপর শিরানের কাতর আর্তনাদ শুনতে পেলাম। প্রায় সাথে সাথেই নুরিগা ফিরে এসে বলল, শিরানের রক্তও লাল। বেশ লাল।

রিয়া হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। এটি কৌতুককর কোনো ব্যাপার নয়, সত্যি কথা বলতে কী বেশ নৃশংস একটি ব্যাপার, তারপরও আমি হাসি আটকে রাখতে পারলাম না।